মৌমিতা ঘোষ
অধ্যায় ১: প্রথম সংকট
অঞ্জলী রায় সকালে অফিসে পৌঁছাতেই এক তরুণ পুলিশ অফিসার তার সামনে এসে দাঁড়াল। তার হাতে একটি ফাইল, আর চোখে তীব্র উদ্বেগ। “স্যার, ডিএসপি ম্যাম, আপনার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ কেস এসেছে।” অঞ্জলী দ্রুত ফাইলটি খুললেন। ফাইলের মধ্যে ছিল এক নারীর মৃতদেহের ছবি, এবং সাথে কয়েকটি প্রতিবেদন। ছবিতে ওই নারীর চোখ বন্ধ, মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, এবং শরীরের চারপাশে অসংখ্য রক্তের দাগ। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বলা হয়েছে, নারীর শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি, তবে তার মৃত্যু সন্দেহজনক। এই কেসের পেছনে কোনো অপরাধী রয়েছে কিনা, তা জানার জন্য তদন্ত শুরু করতে হবে। অঞ্জলী একটি গভীর শ্বাস নেন। এই ধরনের হত্যাকাণ্ডগুলো যখন সমাজের মারাত্মক সমস্যা হিসেবে হাজির হয়, তখন তা শুধুমাত্র একটি অপরাধ হিসেবে দেখা উচিত নয়। এর পেছনে রয়েছে সমাজের গভীর দাগ। নারীরা এখনও সমাজের নীচুস্তরে, শোষিত অবস্থায়, এবং সেসম্পর্কে সঠিকভাবে কোনো তদন্ত না করা হলে তা আরও বাড়তে পারে। তার মনে সেই পুরনো প্রশ্নটি আবার ভেসে ওঠে—নারীর জীবন কি সত্যিই মূল্যবান?
অঞ্জলী দ্রুত তার সহকর্মী, বিপ্লব দাসকে ডেকে পাঠান। বিপ্লব তার পুরনো বন্ধু এবং শ্রদ্ধেয় সহকর্মী। তারা একসাথে কাজ করেন এবং প্রায়ই একে অপরের শক্তি হয়ে ওঠে। বিপ্লব যখন অফিসে পৌঁছাল, অঞ্জলী তাকে কেসের বিস্তারিত জানিয়ে দিলেন। “রিপোর্ট অনুযায়ী, এই নারী কোনো ধরনের শারীরিক আঘাত পায়নি, তবে তার মৃত্যু পেছনে কিছু গভীর ষড়যন্ত্র থাকতে পারে,” অঞ্জলী বলেন। বিপ্লব কাঁধ ঝাঁকালেন, তার চোখে এক ধরনের চিন্তা ছিল। “এটি সাধারণ হত্যাকাণ্ডের মতো নয়, অঞ্জলী। এর পেছনে কিছু গোপন কারণ রয়েছে। হয়তো তা সমাজের কোথাও লুকানো। আমরা যত দ্রুত সম্ভব তদন্ত শুরু করতে পারি।” অঞ্জলী তার সহকর্মীর দিকে তাকিয়ে, গভীরভাবে একমত হন। তবে তিনি জানেন, এই কেস শুধুমাত্র পুলিশের জন্য নয়, এটি আরো বড় কিছু—পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একটা চিত্র তুলে ধরবে। একা একা এই কাজ করা অসম্ভব, তাই তারা একসাথে সিদ্ধান্ত নিলেন, তারা সমাজের এই অবিচার এবং প্রতারণার বিরুদ্ধে কাজ করবেন। কিন্তু এখানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে, যদি অপরাধী সত্যিই সমাজের প্রভাবশালী স্তরের কেউ হয়, তাহলে তাদের কাছে সঠিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা কতটা কঠিন হবে?
অঞ্জলী তদন্ত শুরু করেন। তিনি নারীর পরিচয় জানলেন, তার নাম ছিল শর্মী দাস, একজন যুবতী ও প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা। এই ধরনের কর্মজীবী নারীরা সমাজে সাধারণত এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় থাকেন। শর্মী একাই থাকতেন, তার পরিবার ছিল অনেক দূরে, এবং তার সহকর্মীরা তাকে কখনো কখনো বেশ অবহেলা করত। অঞ্জলী আরও জানতে পারলেন যে, শর্মী কিছুদিন আগে একটি বড় সমস্যা নিয়ে পুলিশে অভিযোগ করেছিলেন। এক পুরুষ সহকর্মী তাকে একাধিকবার যৌন হয়রানি করেছিল এবং শর্মী তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য পুলিশের কাছে একটি মামলা করেছিলেন। তবে সেই মামলা চলাকালীন, তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি এবং শর্মী নিজে ভীষণভাবে একাকী হয়ে পড়েছিলেন। এসব কথা জানার পর অঞ্জলী পুরোপুরি নিশ্চিত হন যে, শর্মীর হত্যাকাণ্ডটি শুধুমাত্র একটি সাধারণ হত্যাকাণ্ড নয়, এটি একধরনের সমাজের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে যুদ্ধ। অঞ্জলী যখন তদন্তের গতি বাড়ান, তখন তার সামনে এমন একটি প্রশ্ন আসে—এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে একজন অপরাধী কি শুধু শর্মীকে লক্ষ্য করেছিল, নাকি এটি সমাজের এক বৃহত্তর সমস্যা? তবে সে জানে, এই কেসে তার যাত্রা সহজ হবে না। যত দ্রুত সম্ভব সত্য উন্মোচন করতে হবে, কারণ তার সামনে এক ভয়ঙ্কর সংঘাত অপেক্ষা করছে, যেখানে অপরাধী কোনো সাধারণ ব্যক্তি নয়, বরং সমাজের একটি বড় শক্তি হতে পারে।
অধ্যায় ২: ন্যায় প্রতিষ্ঠার পথে
অঞ্জলী রায়ের মস্তিষ্কে শর্মী দাসের হত্যাকাণ্ডের তদন্ত এক অস্থির চাপে পরিণত হয়েছিল। সমাজের গভীরে লুকানো অসংগতি, পুরুষতান্ত্রিক শোষণ এবং নারীর প্রতি অবিচারের তীব্রতা তাকে অস্থির করে তুলছিল। শর্মীর মৃত্যুর পেছনে যে অপরাধী, তাকে খুঁজে বের করার চেয়ে বড় কাজ ছিল এই বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া যে, এই ধরনের অপরাধ সমাজের এক গভীর সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অঞ্জলী বুঝতে পারলেন, কেবল হত্যাকারীকে খুঁজে বের করলেই সমস্যা শেষ হবে না—বরং সমাজের সাধারণ মানুষের মনোভাব ও সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। হত্যাকারী হয়তো এক, কিন্তু তার পেছনে যে সামাজিক কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে, সেটি অনেক বড় এবং আরও ভয়ংকর।
তদন্ত শুরু করার পর, অঞ্জলী শর্মী দাসের প্রতিবেশী ও সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন। শর্মী যখন জীবিত ছিলেন, তখন তার জীবন ছিল একাকী এবং অবহেলিত। তার প্রতিবেশীরা জানালেন, শর্মী বেশ কিছুদিন ধরে দুর্বল ও আতঙ্কিত ছিলেন। প্রায়ই তিনি কোনো কিছু থেকে ভীত হয়ে বাড়ি ফিরতেন। কেউ বলতে পারল না, ঠিক কী কারণে সে এত উদ্বিগ্ন ছিল, কিন্তু শর্মী তার কাজের জায়গায় অনেক সমস্যায় পড়েছিল, এবং একদিন, সে এক পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেছিল। অভিযোগের পর, পুলিশ কোনো পদক্ষেপ নেননি এবং শর্মীকে একা পেতে দেওয়া হয়। অনেকে জানালেন, যে পুলিশ অফিসারটি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিল, সে একজন ক্ষমতাশালী ব্যক্তি এবং তার বিরুদ্ধে কিছু বলার কোনো সাহস ছিল না।
অঞ্জলী এসব তথ্য পেয়ে আরো একধাপ এগিয়ে গেলেন। তিনি সেই পুলিশ অফিসারের নাম জানতে পারেন—পুলিশ ইন্সপেক্টর রাকেশ মল্লিক, যিনি জেলার প্রভাবশালী একজন ব্যক্তি। অঞ্জলী জানতেন, রাকেশ মল্লিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুললে তার বিরুদ্ধে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়বে। তবে তাতে তার মনোবল কমেনি। এটি ছিল তার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত—অপরাধীকে ধরা সহজ নয়, তবে সে যদি চুপ করে থাকে, তাহলে সমাজের অন্ধকার দিক আরও গভীর হয়ে যাবে।
অঞ্জলী তার সহকর্মী বিপ্লব দাসকে ডেকে আনেন। বিপ্লব, যিনি সাধারণত অঞ্জলীর লড়াইয়ের পাশে দাঁড়ান, এবারও তাকে সাহস ও সমর্থন প্রদান করেন। “অঞ্জলী, তুমি যদি সত্যিকারের ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে চাও, তাহলে শুধু অপরাধীকে আটকানোই যথেষ্ট নয়। আমাদের সমাজের সেই সব নেতিবাচক মানসিকতাকেও ভাঙতে হবে, যেগুলি নারীদের প্রতি এই ধরনের আচরণকে বৈধ মনে করে। আর আমরা যদি রাকেশ মল্লিকের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করি, তাহলে অনেক বড় প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু যদি আমরা একসাথে থাকি, তবে আমাদের পক্ষে জয়ী হওয়া সম্ভব।” বিপ্লবের কথা শুনে অঞ্জলী আরও দৃঢ় মনোভাবে জানান, “আমরা একসাথে থাকব, বিপ্লব। আর আমরা কোনো বাধা গ্রাহ্য করব না। যতই কঠিন হোক না কেন, সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।”
অঞ্জলী ও বিপ্লব মিলে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে শুরু করেন। তারা রাকেশ মল্লিকের অতীতের সকল তথ্য সংগ্রহ করেন এবং তার কাজকর্মের প্রতি নজর রাখতে থাকেন। তদন্তের পথ যত কঠিন হতে থাকে, ততই অঞ্জলীর মনে একটি প্রশ্ন ফুটে ওঠে—এই একক কেস কি সমাজের বৃহত্তর সমস্যাকে তুলে ধরতে সক্ষম হবে? তার মনে একটি ক্ষুদ্র আশঙ্কাও ছিল—যদি সমাজ তার এই সংগ্রামকে গুরুত্ব না দেয়, তবে সে কীভাবে সেই কাঠামো ভাঙতে পারবে? তবে সে জানতো, এ যাত্রা তাকে একাই করতে হবে, তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
এদিকে, অঞ্জলীর পদক্ষেপের কারণে রাকেশ মল্লিক কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তিনি সোজাসুজি অঞ্জলীর কাছে আসেন এবং তাকে সতর্ক করেন। “তুমি কি মনে করো, আমি একদিন তোমার মতো একটা ছোট পুলিশ অফিসারের কাছে হেরে যাব? আমার ওপর নজর রাখতে থাকলে, আমি তোমাকে কঠিন সময়ে ফেলব,” রাকেশ মল্লিক বলেন। অঞ্জলী কোনো উত্তর না দিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় তার কাজ চালিয়ে যান। তার মনে ছিল একটি বিশ্বাস—যতই শক্তিশালী হোক না কেন, ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার পথটি কখনো বন্ধ হবে না।
অঞ্জলীর সেই দৃঢ় মনোভাব এবং বিপ্লবের সহযোগিতায় তদন্ত অব্যাহত থাকে। প্রতিদিন কিছু না কিছু নতুন তথ্য বের হয়ে আসে। তারা বুঝতে পারে, কেবল অপরাধীকে ধরা নয়, বরং সমাজের একটি সিস্টেমের বিরুদ্ধে লড়াই করা জরুরি। তাদের সামনে এখনও অনেক প্রতিবন্ধকতা, অনেক বাধা ছিল, কিন্তু তারা জানত, শেষ পর্যন্ত তাদের সংগ্রাম সাফল্য পাবে। নারীর প্রতি অবিচার আর সহ্য করা যাবে না, এবং অঞ্জলী তার জীবনকে সেই সংগ্রামে উৎসর্গ করেছেন।
অধ্যায় ৩: এক্সপোজিং দ্য সিস্টেম
অঞ্জলী রায় ও তার সহকর্মী বিপ্লব দাস রাকেশ মল্লিকের বিরুদ্ধে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে নতুন প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছিল। রাকেশ মল্লিক, যিনি এক সময় পুলিশ বিভাগে অত্যন্ত শক্তিশালী ও প্রভাবশালী ছিলেন, তাকে ধরতে গেলে অনেক বড় বিপদ অপেক্ষা করছিল। তবে অঞ্জলী জানতেন, একমাত্র এই শক্তিশালী পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে তদন্ত না করলে, শর্মী দাসের মৃত্যুর পেছনে থাকা বৃহত্তর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যা কখনোই উন্মোচিত হবে না। তাকে ধরা শুধু একটি ব্যক্তিগত প্রতিশোধ নয়, বরং সমাজের নারীদের প্রতি অবিচারের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধ।
তদন্তের তৃতীয় দিনে, অঞ্জলী এবং বিপ্লব একটি নতুন দিক আবিষ্কার করেন। রাকেশ মল্লিকের বিরুদ্ধে কিছু পুরনো অভিযোগ এবং সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়, যা তার অত্যাচারের বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত দেয়। অঞ্জলী বুঝতে পারেন, রাকেশ শুধু শর্মী দাসের জীবনই ধ্বংস করেনি, বরং বহু নারীর জীবনে বিপর্যয় এনে দিয়েছে। একের পর এক মামলা গোপন করা হয়েছিল, সাক্ষীকে ভয় দেখানো হয়েছিল, আর সঠিক সময়ে বিচার না পেয়ে অনেক নারী ন্যায়প্রাপ্তির আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। অঞ্জলী জানতেন, তার সামনে এখন শুধু একটি কেস নয়, এটি এক বৃহত্তর আন্দোলন হয়ে দাঁড়াচ্ছে—নারীর অধিকার ও মর্যাদার জন্য লড়াই।
তবে এই পথ মোটেই সহজ ছিল না। রাকেশ মল্লিকের ক্ষমতা এমন ছিল যে, কোনো সাধারণ পুলিশ অফিসার তার বিরুদ্ধে কাজ করতে গেলে সে প্রায় নিশ্চিতভাবে হেরে যাবে। অঞ্জলী যতই দৃঢ় মনোভাব নিয়ে কাজ করছিলেন, ততই তার চারপাশে এক অদৃশ্য প্রতিরোধ তৈরি হচ্ছিল। একদিন সকালে, অঞ্জলী যখন অফিসে পৌঁছান, তিনি দেখতে পান যে তার ডেস্কে একটি অজ্ঞাত নম্বর থেকে ফোন এসেছে। ফোনটি করার পর, তিনি কেবল একটি মেসেজ পান—”তুমি যদি এই কেসটি চালিয়ে যাও, তোমার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে।” এর পরই অঞ্জলী বুঝতে পারেন, রাকেশ মল্লিকের সশস্ত্র গোপন শক্তি শুধু তাকে বিরক্ত করছে না, বরং তার ক্যারিয়ারের দিকে বড় আঘাত হানার চেষ্টা করছে।
তবে অঞ্জলীর একটাই উত্তর ছিল—”এটা আমাকে থামাবে না।” সে জানত, ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হলে কখনোই ভয় পেলে চলবে না। বিপ্লব তার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে সাহস দেন। “আমরা একসাথে আছি, অঞ্জলী। তুমি একা নও। আমরা নিশ্চিত, সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। তোমার পাশে আমরা সবসময় রয়েছি।” বিপ্লবের কথা অঞ্জলীর মনে এক ধরনের শক্তি জোগায়। তার সামনে ছিল একটি অপ্রতিরোধ্য উদ্দেশ্য—নারীদের প্রতি অবিচার, সহিংসতা এবং শোষণের বিরুদ্ধে খোলাখুলি যুদ্ধ চালানো।
অঞ্জলী এবার সিদ্ধান্ত নেন, তাকে এবং বিপ্লবকে আরও গোপনে এবং সাবধানে কাজ করতে হবে। তারা রাকেশ মল্লিকের অতীত জীবন সম্পর্কে আরো তথ্য সংগ্রহ করতে থাকেন। শর্মী দাসের মৃত্যুর পর যে বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছিল, তা ছিল রাকেশের অত্যাচার ও প্রভাবশালী অবস্থান। যদিও শর্মী তার উপর নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছিলেন, তবে তার অভিযোগ কখনোই সত্য প্রমাণিত হয়নি—কারণ রাকেশ মল্লিকের ক্ষমতা তাকে সবসময় সুরক্ষা দিয়েছে। এবার অঞ্জলী তার নিজের জীবন এবং ক্যারিয়ারকে বাজি রেখে, শর্মীর মতো আরো অনেক নারীর পক্ষে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন।
তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে প্রতিদিন নতুন তথ্য বের হয়ে আসতে থাকে। অঞ্জলী এবং বিপ্লব ধাপে ধাপে রাকেশের অপরাধের জাল খুলে ফেলতে থাকেন। তারা জানতে পারেন, রাকেশ অনেক নারীকে তার শিকার করেছে এবং তার পেছনে যে সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক শক্তি রয়েছে, তা কোনো সাধারণ পুলিশের পক্ষে একা একা ভাঙা অসম্ভব। তবে অঞ্জলী দৃঢ়তার সঙ্গে তার পদক্ষেপ অব্যাহত রাখেন, কারণ তিনি জানতেন, এই এক কেস নয়—এটি এক বৃহত্তর লড়াই, যেখানে সমাজের পুরনো, অবিচারপূর্ণ ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করা হবে।
তবে অঞ্জলী যে রাকেশ মল্লিকের বিরুদ্ধে একে একে সমস্ত প্রমাণ জমা করে চলেছেন, তাতে তার উপর চাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে। একদিন সকালে অঞ্জলী যখন অফিসে ফিরে আসেন, তখন তিনি দেখতে পান যে তার ডেস্কে আরেকটি নতুন চ্যালেঞ্জ তার জন্য অপেক্ষা করছে—এইবার পুলিশ হেডকোয়াটারের একটি মেমো, যেখানে তার বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ আনা হয়েছে। মেমোতে বলা হয়েছিল, “অঞ্জলী রায় এক ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে কাজ করছেন এবং পুলিশ বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছেন।” এটা ছিল এক ধরনের সরাসরি আক্রমণ, যেন তাকে মামলা তুলে নিতে চাপ দেওয়া হচ্ছে। তবে অঞ্জলী কোনোভাবেই বিচলিত হননি। বরং তার দৃঢ়তা আরো বেড়ে গেল।
অঞ্জলী জানতেন, তার সামনে এখন একটি কঠিন পথ, তবে এর মাঝে একটি স্পষ্ট উদ্দেশ্য ছিল—”এটা শুধু শর্মী দাসের জন্য নয়, এটা সকল নারীর জন্য।” সে শপথ নিয়েছিল, যতই বিপদ আসুক না কেন, সে তার ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবে। তার শক্তি ছিল সেই অভ্যন্তরীণ বিশ্বাসে, যে একদিন এই সমাজ তার ন্যায়ের মূল্য দেবে।
অধ্যায় ৪: রেহানার রহস্য
অঞ্জলী রায় এবং বিপ্লব দাস যখন রাকেশ মল্লিকের বিরুদ্ধে তদন্ত গভীর করতে শুরু করেন, তখন এক নতুন পরিচিতি তাদের সামনে উঠে আসে—রেহানা বেগম। একদিন সকালে, অঞ্জলী তার ডেস্কে এক পুরনো নথি দেখতে পান, যেখানে রেহানার নাম উল্লেখ ছিল। রেহানা একটি ছোট শহরের এক শিক্ষিত, স্বতন্ত্র নারী ছিলেন, কিন্তু তার জীবনটা শান্ত ছিল না। রেহানা, যিনি নিজে একসময় শর্মী দাসের সহকর্মী ছিলেন, বেশ কিছু বছর আগে পুলিশের কাছে এক মামলায় অভিযোগ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তাকে একাধিকবার অত্যাচার করা হয়েছে, কিন্তু তার অভিযোগ কখনোই যথাযথভাবে তদন্ত করা হয়নি। বরং, তদন্তের মাঝখানেই তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং তার বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে কলঙ্কিত করা হয়েছিল। এই প্রথমবারের মতো অঞ্জলী বুঝতে পারেন যে, রেহানার গল্প শুধুমাত্র এক ব্যতিক্রমী ঘটনার ফল নয়, বরং এটি সমাজের মধ্যে এক দীর্ঘ সময় ধরে চলা এক অবিচারের অংশ।
অঞ্জলী রেহানার নামের সঙ্গে পরিচিত হলেও, তার জীবন এবং মৃত্যুর পেছনের কারণ সে জানতেন না। অঞ্জলী সিদ্ধান্ত নেন, তাকে জানতেই হবে—রেহানা কেন নিজের জীবন গোপনে কাটিয়েছিলেন? কেন সে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিয়ে আবার নিরব হয়ে গেল? রেহানার অল্প কিছু বন্ধু ছিল, কিন্তু তারা সকলেই জানতো না তার অতীত। একদিন, অঞ্জলী তার পুরনো বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলেন, রেহানা অনেক দিন আগে পুরনো একটি তন্ত্র সাধনার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ছিলেন। তার জীবনটা ছিল রহস্যময়, আর কিছু ঘটনা ছিল যা সমাজের সাধারণ মানুষের কাছে অবিশ্বাস্য ছিল। রেহানা তার প্রাক্তন প্রেমিকের কাছ থেকে গোপনে কিছু অবৈধ তথ্য পেয়েছিলেন, যা তাকে বিপদের মধ্যে ফেলেছিল। কিন্তু আসল রহস্যটা ছিল, কেন রেহানা এত ভয় পেয়েছিলেন? কেন তিনি এতদিন আত্মগোপনে ছিলেন?
অঞ্জলী ও বিপ্লব রেহানার জীবনের গভীরে যেতে থাকেন। তারা রেহানার পুরনো বাড়ি খুঁজে পান, যেখানে একসময় সে এক অদ্ভুত জীবন কাটিয়েছিল। বাড়িটি একদম পাথর-বাড়ির মতো খণ্ডিত ছিল। দেয়ালের কোণায় কিছু অদ্ভুত চিহ্ন ছিল, যা পরিষ্কারভাবে একটি গোপন তন্ত্র সাধনার দিকে নির্দেশ করছিল। অঞ্জলী ও বিপ্লব জানতেন, এটি নিছক এক রহস্য নয়, বরং রেহানার জীবনের এক গভীর সত্যের প্রতিফলন। এটি শুধুমাত্র একজন নারীর নির্যাতন বা শোষণের গল্প ছিল না, বরং এটি ছিল সমাজের পুরুষতান্ত্রিক শ্রেণির অন্ধকার দিক, যা দীর্ঘদিন ধরে লুকানো ছিল।
তদন্তের এক মুহূর্তে, অঞ্জলী একটি পুরনো ডায়েরি পান, যা রেহানার লেখা ছিল। ডায়েরিটিতে রেহানা তার জীবনের বেশ কিছু অদ্ভুত ঘটনা লিখেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “শক্তিশালী পুরুষরা যখন নারীদের বিরুদ্ধে চলে আসে, তখন সেই নারীর ক্ষমতা থাকে শুধু একটাই—নীরবতা। কিন্তু নীরবতা কখনোই তাদের শক্তি নয়, বরং একদিন সেই নীরবতার আওয়াজ সবার কানে পৌঁছাবে।” রেহানার এই কথাগুলি অঞ্জলীকে একটি নতুন দৃষ্টিকোণ প্রদান করে। এটি এক ধরনের প্রতিজ্ঞা ছিল—যে সমস্ত নারী নিঃশব্দে অপমানিত হয়, তাদের প্রতিটি শব্দ একদিন প্রতিধ্বনিত হবে। রেহানা তার জীবন থেকে এই শিখন নিয়েছিলেন, কিন্তু সে জানত, একদিন তার এই নীরবতা একদম ভেঙে যাবে।
অঞ্জলী রেহানার সাথে এই পুরনো জীবনের রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে আরও অনেক অজানা তথ্য আবিষ্কার করেন। তিনি শিখতে পারেন, রেহানা শুধুমাত্র শিকার ছিলেন না, বরং তিনি সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে এক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। তার জীবনে যে পুরুষদের হাত ছিল, তাদের বিরুদ্ধে কিছু না কিছু ছিল—কিছু নির্যাতন, কিছু প্রতারণা, কিছু বিশ্বাসঘাতকতা। রেহানার সেই গভীর অন্ধকার ইতিহাস অঞ্জলীর মনে এক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। যদি রেহানা এর আগে নিজের শিকার হয়ে থাকতেন, তবে সে তার নিজের জীবনকে পাল্টাতে কীভাবে সামর্থ্য পাবে? তার জীবন ছিল একজন নারীর আত্মসম্মান এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার এক অন্বেষণ।
অঞ্জলী এবং বিপ্লব বুঝতে পারেন, রেহানার মৃত্যু বা শর্মী দাসের হত্যাকাণ্ড শুধু একটি ঘটনার প্রতিফলন নয়—এটি একটি বড় সামাজিক সমস্যার ফল। নারীর প্রতি অবিচার, শোষণ এবং প্রতিকারহীনতা ছিল এই ঘটনার মূল উৎস। অঞ্জলী সিদ্ধান্ত নেন, রেহানার মতো নারীদের গল্প কখনোই অন্ধকারে চাপা পড়ে থাকতে পারবে না। এদের গল্পের মাধ্যমে সে সমাজে পরিবর্তন আনবে। রেহানার মৃত্যুর পেছনে যে কৌশল এবং পরিকল্পনা ছিল, তা অঞ্জলীকে আরো দৃঢ় করে তোলে। একটাই লক্ষ্য—এই পুরুষতান্ত্রিক শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করা, এবং নারীদের প্রতিটি অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো।
অঞ্জলী জানতেন, রেহানার মতো অনেক নারী এখনও সমাজের ছায়ায় আছেন, যারা নিজেদের অভ্যন্তরীণ যন্ত্রণাকে দিনের পর দিন চাপা দিয়ে বেঁচে আছেন। কিন্তু তিনি জানতেন, একটি একক প্রচেষ্টা সব কিছু বদলে দিতে পারে। নারীর জীবনে প্রকৃত স্বাধীনতা তখনই আসবে, যখন তাদের জীবন একাধিক রেহানার মতো সাহসিকতার সঙ্গে প্রতিস্থাপন হবে।
অধ্যায় ৫: অশোকের ষড়যন্ত্র
অঞ্জলী রায়, যিনি শর্মী দাস এবং রেহানা বেগমের মৃত্যুর পেছনে থাকা অপরাধী এবং সমাজের শোষণমূলক কাঠামো উদঘাটন করতে এগিয়ে চলছিলেন, এবার তার পথে বড় এক বাধা এল। রাকেশ মল্লিকের বিরুদ্ধে তার তীব্র তদন্ত এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অন্ধকার দিকগুলো উন্মোচন করার পথ যতই স্পষ্ট হচ্ছিল, ততই তার চারপাশে আরও কঠিন প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছিল। এবার সে প্রতিবন্ধকতা এসেছিল, তার নিজস্ব পুলিশ বিভাগের তরফ থেকে। পুলিশ সুপার অশোক মিত্র, যিনি নিজেও এক সময় মল্লিকের সহকর্মী ছিলেন, অঞ্জলীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেন।
অশোক মিত্রের কাছে বিষয়টি সহজ ছিল না। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে পুলিশ বিভাগে কাজ করেছেন এবং জানতেন, শক্তিশালী লোকদের বিরুদ্ধে তদন্ত করলে তার ক্যারিয়ার ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। অঞ্জলী যখন মল্লিকের বিরুদ্ধে এতটা দৃঢ় মনোভাব নিয়ে কাজ শুরু করেন, তখন অশোক বুঝতে পারলেন, যদি তিনি এভাবে চুপ করে থাকেন, তবে মল্লিকের ক্ষমতা থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো উপায় থাকবে না। অশোক মিত্র, যিনি পুলিশের একটি প্রভাবশালী অংশের সঙ্গে সম্পর্কিত, তিনি সিদ্ধান্ত নেন—অঞ্জলীর পথ আটকে দিতে হবে, এবং তার সামনে একটি কঠিন পরীক্ষা আসবে।
একদিন, অঞ্জলী যখন অফিসে পৌঁছান, তখন তিনি দেখতে পান, তার ডেস্কের ওপর একটি মেমো রাখা আছে। মেমোটি পুলিশের হেডকোয়ার্টার থেকে এসেছে। সেখানে লেখা ছিল, “অঞ্জলী রায়, আপনি তদন্তের সীমা অতিক্রম করেছেন। আপনার কাজের গতি এবং উদ্দেশ্য সন্দেহজনক। এই বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আপনার পদমর্যাদা সাময়িকভাবে স্থগিত করা হচ্ছে।” এটি ছিল অশোক মিত্রের প্রথম পদক্ষেপ। তার ইচ্ছা ছিল অঞ্জলীর মেধা ও শক্তিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলা, যাতে সে ভয় পায় এবং তদন্ত থেকে পিছু হটে যায়। মেমোটি হাতে নিয়ে অঞ্জলী কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলেন। তার মস্তিষ্কে একটি চমকানির অনুভূতি ছিল—এই পরিণতি তার জন্য ছিল অপ্রত্যাশিত, কিন্তু তার উদ্দেশ্য একেবারেই পরিষ্কার ছিল। সে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে।
অঞ্জলী জানতেন, যে কোনো ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে, তাকে নিজের শক্তি এবং আত্মবিশ্বাসের ওপর ভরসা করতে হবে। তার সামনে দুটি পথ ছিল—এক, সিস্টেমের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকবেন, আর দ্বিতীয়ত, কেবলমাত্র নিজের ক্যারিয়ার এবং নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে পিছু হটবেন। তবে অঞ্জলী কোনোভাবেই দ্বিতীয় পথটি বেছে নিলেন না। তার মনে ছিল এক দৃঢ় সংকল্প—এই মামলা না শুধু শর্মী দাসের জন্য, বরং সকল নারীর জন্য, যারা সমাজের শোষণ এবং অবিচারের শিকার।
অঞ্জলী তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন এবং সঙ্গী বিপ্লবের সঙ্গে মিলে আরও তীব্রভাবে তদন্ত চালিয়ে যেতে থাকেন। তার মনের মধ্যে ছিল একটি স্পষ্ট লক্ষ্য—অশোক মিত্রের মতো এক ক্ষমতাবান ব্যক্তির ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। এই মামলা ছিল তার একমাত্র লড়াই নয়, এটি ছিল সমাজের এক ন্যায় প্রতিষ্ঠার পথ। শর্মী এবং রেহানার মতো নারীদের জীবন প্রতিদিন নিঃশব্দে ধ্বংস হচ্ছে, এবং তাদের পক্ষে দাঁড়াতে হলে তাকে অশোকের মত অনেক শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।
অশোক মিত্র এবং রাকেশ মল্লিকের বিরুদ্ধে অঞ্জলী যত এগিয়ে যাচ্ছিলেন, ততই তার জীবন কঠিন হয়ে উঠছিল। একদিন, অঞ্জলী তার অফিসে ফিরতে গিয়ে একটি বড় খবর পান। পুলিশ বিভাগের এক প্রভাবশালী ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে একটি অপবাদ রটিয়েছে—সে যে কেসটি তদন্ত করছে, তা সম্পূর্ণভাবে অপ্রাসঙ্গিক এবং তার মেধার অভাব রয়েছে। অশোক মিত্র এই অপবাদটি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, যাতে অঞ্জলীকে আরও বেশি অবিশ্বাসের মুখে পড়তে হয়। খবরটি পেয়ে অঞ্জলী একদম অবাক হননি, কিন্তু তার মধ্যে এক অদ্ভুত ধাতু তৈরি হয়েছিল—এটা তাকে কোনোভাবেই থামাতে পারবে না। তিনি জানতেন, তার সামনে এখন শুধু তদন্ত নয়, এটি একটি যুদ্ধ। একদিকে তার নিজের ন্যায় প্রতিষ্ঠা, আর অন্যদিকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শক্তির বিরুদ্ধে এক বড় লড়াই।
বিপ্লব, অঞ্জলীর বিশ্বস্ত সহকর্মী এবং বন্ধু, তাকে সমর্থন করতে থাকেন। বিপ্লব জানতেন, অঞ্জলী যদি পিছু হটেন, তবে সে শুধু নিজের পরাজয়ই মেনে নেবে না, বরং সমস্ত নারীর জন্য এটি একটি বড় আঘাত হবে। একদিন, বিপ্লব অঞ্জলীকে বলেছিলেন, “তুমি যদি হারাও, তবে কেবল তোমার জয় নয়, অনেক নারীর সংগ্রামের পরাজয় হবে। তোমার শক্তি আমাদের শক্তি।” এই কথা শুনে অঞ্জলীর মনে একটা শক্তি জাগে, এবং সে প্রতিজ্ঞা করে—এখন আর থামবে না।
অশোক মিত্রের ষড়যন্ত্র যতই গভীর হোক না কেন, অঞ্জলী জানতেন, একদিন এই সামাজিক অবিচার এবং শোষণটা শেষ হবে। তার পথে এখন অনেক কাঁটা, কিন্তু সে কখনোই পিছু হটবে না।
অধ্যায় ৬: বিপদসংকুল চূড়ান্ত অভিযান
অঞ্জলী রায়ের সামনে এখন কেবল একটি লক্ষ্য ছিল—পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দুঃখজনক বাস্তবতা উন্মোচন করা এবং নারীদের প্রতি অবিচার বন্ধ করা। তবে তার পথ এবার একেবারে সরু হয়ে উঠেছিল। পুলিশ সুপার অশোক মিত্রের ষড়যন্ত্র, রাকেশ মল্লিকের বিরুদ্ধে চলমান তদন্ত এবং পুরুষ সহকর্মীদের অদৃশ্য বাধা—সব কিছু মিলিয়ে অঞ্জলীকে বুঝতে হচ্ছিল, তার যাত্রা কেবল একটি মামলার সুরাহা নয়, বরং এটি এক বৃহত্তর আন্দোলনের অংশ হয়ে উঠেছে। যতই এগিয়ে যাচ্ছিলেন, ততই তার ওপর চাপ বাড়ছিল, কিন্তু তিনি জানতেন, থামলে সমাজের এই অন্ধকার দিকগুলি আরও দীর্ঘদিন ধরে চাপা পড়ে থাকবে।
অঞ্জলী একদিন গভীর রাতে বসে চিন্তা করতে করতে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তাকে সব কিছু খোলামেলা করে ফেলতে হবে। তার তদন্তের পেছনে যতগুলো বড় বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল, সেগুলোর মধ্যে অশোক মিত্র এবং রাকেশ মল্লিকের শক্তিশালী সম্পর্ক সবচেয়ে ভয়ানক ছিল। তার একমাত্র উপায় ছিল—গোপনীয়ভাবে আরো গভীরে প্রবাহিত হওয়া, এবং দ্রুত সময়ে সত্য বের করা।
বিপ্লব, তার সহকর্মী এবং বিশ্বস্ত বন্ধু, তাকে সাহায্য করতে চাইলেন। একদিন, অঞ্জলী যখন তার অফিসে এক নতুন পন্থায় কাজ করার পরিকল্পনা সাজাচ্ছিলেন, তখন বিপ্লব এসে তার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমরা একসাথে থাকলে, এই মামলা শুধু সমাধান হবে না, বরং সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। তুমি যদি ফাঁদে পড়ে যাও, তবে কেবল তোমার নয়, সকল নারীর লড়াই হারবে। আজ আমরা এক সশস্ত্র লড়াইয়ে অংশ নিচ্ছি।” বিপ্লবের কথা অঞ্জলীকে আরো শক্তিশালী করে তুলল।
অঞ্জলী সিদ্ধান্ত নিলেন, তাকে শুধু পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শক্তির বিরুদ্ধে নয়, বরং সেই শক্তির প্রতিরোধও গড়ে তুলতে হবে। তবে, তার মাথায় এমন কিছু প্রমাণ জমা হয়েছিল, যা একে একে রাকেশ মল্লিকের অপরাধের পেছনের সমস্ত রহস্য বের করে আনতে সহায়ক হতে পারে।
এক রাতে, অঞ্জলী এবং বিপ্লব একটি ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নেন। তারা রাকেশ মল্লিকের ঘনিষ্ঠ কিছু লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, যারা বিভিন্ন সময় তার অপকর্মের শিকার হয়ে মুখ বুজে থাকলেও, তাদের মধ্যে কেউ কেউ এবার সত্য বলতে প্রস্তুত। তাদের কাছে পৌঁছানোর একমাত্র উপায় ছিল অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করা। তারা দ্রুত তাড়াতাড়ি এবং নির্বিঘ্নে কাজ করতে থাকেন।
অঞ্জলী এই সময় আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আবিষ্কার করেন। রাকেশ মল্লিক তার ক্ষমতার আওতায় অনেক নারীকে শিকার হিসেবে নিয়েছিলেন, কিন্তু তার এই শক্তির উৎস ছিল এক ব্যক্তির—a powerful politician—যার সাথে তার দীর্ঘ সময়ের সম্পর্ক ছিল। এই রাজনীতিবিদ এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন, যার প্রভাব পুরো পুলিশ বিভাগে, এমনকি সরকারের শীর্ষ পর্যায়েও বিস্তৃত ছিল। অঞ্জলী বুঝতে পারলেন যে, মল্লিকের অপরাধের পেছনে সরাসরি একটি বৃহত্তর চক্রান্ত রয়েছে। তার একমাত্র উপায় ছিল, সেটি প্রকাশ্যে আনতে হবে, যেভাবেই হোক।
একদিন, অঞ্জলী এক অদ্ভুত ফোন পেয়ে বসে ছিলেন। অপর প্রান্তে কেউ ছিল না, কিন্তু তিনি বুঝতে পারলেন—এটি কোনো শত্রু গোষ্ঠীর হুমকি ছিল। তবে, তিনি কোনোভাবেই ভেঙে পড়লেন না। ফোনের পরপরই, অঞ্জলী এবং বিপ্লব নিজেরাই তদন্তে নেমে পড়েন, এবং একের পর এক প্রমাণ বের করতে থাকেন, যা তাদের কেসের পেছনে সব কিছু উন্মোচন করে দেবে। একদিন তারা রাকেশ মল্লিকের এক পুরনো বন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করেন, যিনি সব কিছু জানতেন, কিন্তু ভয় পেয়ে কিছুই বলতেন না। সেই বন্ধু অবশেষে সাহস করে সব কিছু অঞ্জলীর কাছে উন্মোচন করেন। মল্লিক ও তার রাজনীতিক সহযোগীদের গোপন কথোপকথন, তাদের নানা অপরাধ, এমনকি পুলিশের উচ্চস্তরের অফিসারদের বিরুদ্ধে তাদের শোষণের পরিকল্পনা—সব কিছু পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
অঞ্জলী জানতেন, এই তথ্যগুলো এখন পুলিশের একাধিক সেক্টরে ছড়িয়ে পড়লে, তাকে আর কোনোভাবেই থামানো সম্ভব হবে না। তবে, তাতে বিপদের ঝুঁকি আরও বাড়বে। সে প্রস্তুত ছিল। এই সত্য প্রকাশের মুহূর্তে যে কোনো ধরনের বিপদ আসলেও, অঞ্জলী তার নিজস্ব আদর্শে অবিচল ছিলেন। তার একটাই লক্ষ্য—এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মূলোৎপাটন করা এবং নারীদের প্রতিটি অধিকার নিশ্চিত করা।
অঞ্জলী এখন আর শুধু তদন্তকারী পুলিশ অফিসার ছিলেন না; তিনি হয়ে উঠেছিলেন সমাজের এক শক্তিশালী প্রতিরোধ। তার তদন্তের প্রতিটি পদক্ষেপ এবং প্রতিটি সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে তিনি শুধু অপরাধীকে ধরছেন না, বরং তিনি পৃথিবীকে পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। একদিন, সে জানত, এই সত্য প্রকাশ হওয়ার পর, সমাজ আর আগের মতো থাকবে না।
অধ্যায় ৮: পালাবার পথ নেই
অঞ্জলী রায় এবং বিপ্লব দাস তাদের ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য এক কঠিন পথে হাঁটছিলেন। রাকেশ মল্লিক এবং তার রাজনৈতিক সহযোগীদের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রাম অনেক দূর এগিয়েছে, কিন্তু এখনও তাদের সামনে বহু বাধা ছিল। মল্লিকের অন্ধকার সাম্রাজ্য এবং তার সন্ত্রাসের ছায়া এখন পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে অঞ্জলী জানতেন, একবার যদি সত্য প্রকাশ পায়, তবে তাদের সংগ্রাম শেষ হবে না, বরং এটি সমাজের বৃহত্তর পরিবর্তনের সূচনা করবে।
এক সকালে, অঞ্জলী যখন তার অফিসে যাচ্ছিলেন, তখন হঠাৎ ফোনে একটি মেসেজ আসলো—“তোমার পেছনে অনেক বড় শক্তি রয়েছে। তুমি যদি রাকেশ মল্লিকের কেস চালিয়ে যাও, তবে তুমি জানো না কী ঘটবে। পালানোর পথ নেই।” মেসেজটি অজ্ঞাতনামা ছিল, তবে অঞ্জলী বুঝতে পারলেন, এটি একটি হুমকি। রাকেশ মল্লিক এবং তার সহযোগীরা একে একে সরাসরি তাদের জীবনে হস্তক্ষেপ শুরু করেছে। সে সময়ে অঞ্জলী ও বিপ্লবের মনে একটি ভয়ংকর প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল—তাদের সামনে এখন একমাত্র এক পথ: সামনে এগিয়ে যাওয়া অথবা তাদের আত্মসম্মান ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে থেমে যাওয়া। তবে তারা দুজনেই জানতেন, পিছু হটলে সমাজের সমস্ত ন্যায়হীনতা আরও বাড়বে।
তবে তখনই একটি নতুন ঘটনা ঘটে। একদিন রাতের অন্ধকারে, বিপ্লব তার ফোনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কল পান। অপর প্রান্তে, একজন নির্ভরযোগ্য সূত্র তাকে জানায় যে, রাকেশ মল্লিক এবং তার রাজনৈতিক সহযোগীরা তাদের বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি পরিকল্পনা করছে। তারা সব রকমের প্রমাণ ধ্বংস করতে এবং গোপনে তাদের হত্যার হুমকি দিতে পারে। এটি ছিল একটি ভয়ানক সংকেত।
“এখন আমাদের কেবল একটি কাজ করতে হবে,” অঞ্জলী বললেন, তার কণ্ঠে দৃঢ়তা ছিল। “আমাদের সব প্রমাণ একত্র করতে হবে এবং খুব দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে কেসটি আদালতে উপস্থাপন করতে হবে। আর আমাদের ভয়ের কিছু নেই। আমরা যদি এই যুদ্ধ না জিতি, তবে কখনও সমাজে পরিবর্তন আসবে না।”
অঞ্জলী এবং বিপ্লব বেশ কিছু দিন ধরে গোপনে কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। তারা সাথী দত্ত এবং অন্যান্য সাক্ষীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে, তাদের কাছে থাকা গোপন নথিগুলি পুনরায় যাচাই করতে থাকেন। রাকেশ মল্লিকের এবং তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে সরাসরি সাক্ষ্য দেয়ার জন্য তারা আরও কিছু প্রমাণ সংগ্রহ করেন।
এদিন, সন্ধ্যার পর, অঞ্জলী যখন এক নির্জন রাস্তা দিয়ে ফিরছিলেন, তখন হঠাৎ এক গাড়ি তার পাশ দিয়ে চলে যায়। গাড়িটি তার সামনে থেমে যায় এবং তার পাশে এক ব্যক্তি নামল। অঞ্জলী তত্ক্ষণাত্ বুঝতে পারেন, এটি কোনো গোপন পুলিশ বা গুপ্তচরের কাজ হতে পারে। ব্যক্তি তার দিকে আসতে থাকে। অঞ্জলী দ্রুত নিজেকে প্রস্তুত করে নেয়, কিন্তু ব্যক্তি মুখে এক হাসি দিয়ে বলেন, “আপনার মতো একজন মানুষের জন্য আপনি বড় বিপদে পড়েছেন, ম্যাডাম। রাকেশ মল্লিক এই শহরের রাজা। আপনি যদি তার বিরুদ্ধে কিছু বলেন, আপনার জন্য পালাবার পথ থাকবে না। মনে রাখবেন, তাকে বিপদে ফেললে আমাদের পালাবার কোনো পথ থাকবে না।”
অঞ্জলী এক মুহূর্তের জন্য থেমে গিয়েছিলেন, তবে খুব দ্রুত নিজেকে সামলান। “আপনি কি আমাকে ভয় দেখাতে চান?” তিনি তার ঠাণ্ডা কণ্ঠে বললেন, “আমি তো জানি, তোমরা যাদের প্ররোচনা দিয়ে মানুষকে ভয় দেখাচ্ছো, তারা কোনোদিনও সৎ পথ অনুসরণ করবে না। এই যুদ্ধ তোমাদের একা আর রক্ষা করবে না।“
তারপরে, অঞ্জলী দ্রুত সেখানে থেকে চলে যান। তার মনে ছিল এক দৃঢ় বিশ্বাস—এটা এক লড়াইয়ের শুরু। যেকোনো মুহূর্তে তাদের সামনে বড় কিছু ঘটতে চলেছে। তিনি জানতেন, রাকেশ মল্লিক এবং তার সহযোগীদের এখন পালাবার কোনো পথ নেই।
এদিকে, অঞ্জলী ও বিপ্লব তাদের প্রমাণ আদালতে পেশ করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। তারা জানতেন, এই মামলা শুধুমাত্র পুলিশের জন্য নয়, এটি ছিল সমাজের সকল নারীর পক্ষে। মামলার পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল অত্যন্ত কঠিন, কিন্তু অঞ্জলী আর এক পা পিছিয়ে যাবেন না।
“বিপ্লব, আমাদের প্রস্তুতি পুরোপুরি শেষ হতে চলেছে। এবার আমাদের একটি বড় পদক্ষেপ নিতে হবে,” অঞ্জলী বললেন। “এখন তারা আমাদের সামনে দঁড়িয়ে, কিন্তু আমরা তাদের ওপর শেষ আঘাত হানব।”
বিপ্লব তার পাশে দাঁড়িয়ে এক শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ে বললেন, “ঠিক আছে, অঞ্জলী। তবে মনে রেখো, আমরা একে একে এগোচ্ছি। এই চূড়ান্ত মুহূর্তে আমাদের ভুল করা যাবে না।”
অঞ্জলী তার চোখে দৃঢ়তার প্রতিচ্ছবি নিয়ে আদালতের দিকে এগিয়ে গেলেন। রাকেশ মল্লিকের জাল ভেঙে তার বিরুদ্ধে জয় লাভ করার পথ তাদের হাতে ছিল। তাতে পরিণত হবে সমাজের ন্যায়বিচার, যেখান থেকে কোনো মিথ্যা এবং শোষণ আর চলতে পারবে না।
এটাই ছিল সেই মুহূর্ত, যেখানে তারা জানতেন—অন্যায়, অবিচার এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রাম এবার শেষ মুহূর্তে পৌঁছেছে।
অধ্যায় ৯: ঝুঁকির মুহূর্ত
অঞ্জলী রায় এবং বিপ্লব দাস এখন চূড়ান্ত মুহূর্তের দিকে এগোচ্ছিলেন। দীর্ঘ সময়ের ধৈর্য, আত্মবিশ্বাস এবং কঠোর সংগ্রামের পর, তারা এক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন—এটি তাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে চলেছে। রাকেশ মল্লিক এবং তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য তারা একটিও সুযোগ হারাতে চান না। তবে তাদের সামনে যে বিপদ অপেক্ষা করছে, তা ছিল অপ্রত্যাশিত। যখন তারা মনে করছিলেন, তাদের সংগ্রাম শেষ হতে যাচ্ছে, তখন নতুন একটি ঝুঁকি সামনে এসে দাঁড়াল।
অঞ্জলী এবং বিপ্লব আদালতে পৌঁছানোর একদিন আগে, তারা জানতে পারেন, রাকেশ মল্লিক তার সম্পূর্ণ শক্তি ব্যবহার করে পুরো বিচারব্যবস্থাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন। মল্লিকের চক্রান্ত এতটাই গভীর ছিল যে, তার জন্য পুরো একটি দল কাজ করছিল, যারা সমস্ত সাক্ষীদের ভয় দেখাতে, প্রমাণ ধ্বংস করতে এবং তদন্ত প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে চাচ্ছিল।
অঞ্জলী জানতেন, এই মুহূর্তে একে একে সমস্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। তাকে সতর্ক থাকতে হবে। “এটা আমাদের একমাত্র সুযোগ, বিপ্লব,” অঞ্জলী বললেন, তার মুখে দৃঢ়তা ছিল। “যদি আমরা এখন ভুল করি, তবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও এই ন্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে হেরে যাবে। আমরা আর ফিরে যেতে পারি না।”
অঞ্জলী ও বিপ্লবের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল আদালতের দালালদের মোকাবিলা। তারা জানতেন, রাকেশ মল্লিকের এজেন্টরা তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে জানেন এবং একেবারে শেষ মুহূর্তে তারা কিছু না কিছু বাধা তৈরি করতে পারে। যেহেতু অঞ্জলী ও বিপ্লব পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলেন, তারা আরও কিছু সাক্ষী এবং প্রমাণ সংগ্রহ করতে থাকেন, কিন্তু এটা তাদের জন্য একটি মরণকূপে পরিণত হচ্ছিল।
একদিন, আদালতে যাওয়ার পথে, অঞ্জলী একটি অদ্ভুত ঘটনা লক্ষ্য করেন। গাড়ির মধ্যে বসে থাকা অবস্থায়, তিনি একটি অপরিচিত গাড়িকে খুব কাছ থেকে অনুসরণ করতে দেখেন। গাড়িটি তার পেছনে প্রায় অর্ধেক ঘণ্টা ধরে চলছিল। অঞ্জলী বুঝতে পারলেন, এটি নিছক একটি দুর্ঘটনা নয়—এটি ছিল সোজা সোজি একটা হুমকি। তিনি বিপ্লবকে ফোন করে বলেন, “এটা আমাকে অনুসরণ করছে। আমাদের দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। সব কিছু গোপনীয়ভাবে করতে হবে।”
বিপ্লব জানতেন, তাদের সামনে সময় খুব কম ছিল। তাদের একমাত্র কাজ ছিল—অতি দ্রুত এবং নিঃশব্দে আদালতে পৌঁছানো। সেই মুহূর্তে অঞ্জলী বুঝলেন, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ঝুঁকি নিলেই রাকেশ মল্লিক এবং তার শক্তি শেষ হয়ে যাবে। তবে তা করতে গেলে, তাকে নিজের জীবনকেও ঝুঁকিতে ফেলতে হবে। তিনি নিজের জীবনের কোনো মূল্য রাখতেন না, কিন্তু তার মধ্যে এক শক্তি ছিল, যা তাকে এই লড়াই চালিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করছিল।
অঞ্জলী এবং বিপ্লব যথেষ্ট সতর্কতা নিয়ে আদালতে পৌঁছান। তবে, আদালতের মধ্যে ঢোকার পর, তারা আরেকটি অস্বাভাবিক ঘটনা আবিষ্কার করেন। তাদের প্রমাণ সংক্রান্ত কাগজপত্র আদালতের রেজিস্টার থেকে গায়েব হয়ে গিয়েছিল। তারা বুঝতে পারলেন, রাকেশ মল্লিকের লোকেরা এই পুরো ঘটনাকে ডুবিয়ে দিতে একেবারে পরিকল্পিতভাবে কাজ শুরু করেছে। এটি ছিল তাদের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ।
এখন তাদের কাছে একটাই সুযোগ ছিল—প্রমাণগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে আদালতে উপস্থাপন করতে হবে, এবং যত দ্রুত সম্ভব তা করতে হবে। কিন্তু কিছু সময়ের জন্য, সব কিছু অন্ধকারে ঢেকে যায়। একদিকে তারা দেখতে পান, রাকেশ মল্লিকের লোকেরা বিচারক এবং আইনজীবীদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে ব্যস্ত। অন্যদিকে, তাদের চোখে একমাত্র লক্ষ্য ছিল—সত্য প্রকাশ করা।
অঞ্জলী কঠোরভাবে বলেন, “বিপ্লব, এবার আমরা কিছুই ছাড়ব না। আমরা যদি কাঁপতে শুরু করি, তারা আমাদের পিষে ফেলবে। আমাদের সংগ্রাম এখন সমস্ত দৃষ্টির মধ্যে।”
তাদের কাছে একমাত্র উপায় ছিল—বিপুল পরিমাণ প্রমাণ সত্ত্বেও যদি তারা সঠিক সময়ে সরাসরি সবকিছু আদালতে উপস্থাপন করতে পারে, তবে তারা রাকেশ মল্লিক এবং তার দলের বিরুদ্ধে এক বড় আঘাত হানতে সক্ষম হবে।
তাদের মধ্যে এক প্রতিজ্ঞা ছিল—এটি এক লড়াই, এক যাত্রা, যেখান থেকে পিছু হটার কোনো সুযোগ নেই। তাদের এক পা সামনে বাড়াতে হবে, যত বিপদই আসুক না কেন।
অঞ্জলী এবং বিপ্লব জানতেন, তাদের জন্য সবচেয়ে কঠিন অংশ ছিল এখান থেকেই শুরু হবে। তারা প্রস্তুত ছিল, কারণ তাদের কাছে যে সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল, তা ছিল সত্যের জয়—এবং সত্য কখনো হারতে পারে না।
অধ্যায় ১০: শেষ লড়াই
অঞ্জলী রায় এবং বিপ্লব দাস জানতেন, তাদের সামনে এখন এক চূড়ান্ত মুহূর্ত এসেছে। সারা জীবন ধরে সংগ্রাম করে, বহু বিপদ ও ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হয়ে, তারা এখন এমন একটি দারুণ মোড়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপই তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। আদালতে দাঁড়িয়ে থাকা মানে শুধুমাত্র সত্যের জয় নয়, বরং সমাজের নারীদের বিরুদ্ধে চলমান শোষণের অবসান এবং পুরুষতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে এক বড় জয়।
রাকেশ মল্লিক এবং তার শক্তিশালী সহযোগীরা শেষ মুহূর্তে তাদের বিরুদ্ধে এক অস্বাভাবিক পরিকল্পনা করেছিল। তারা জানতেন, অঞ্জলী ও বিপ্লব এই কেসটি সফলভাবে আদালতে প্রমাণ করতে পারবেন, কিন্তু তাতে তাদের অস্তিত্বের জন্য বিপদ সৃষ্টি হবে। তাই তারা শেষ মুহূর্তে সব কিছু ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। সাক্ষী, প্রমাণ এবং কাগজপত্র সব কিছু ভানটুকু গায়েব হয়ে গিয়েছিল, তবে অঞ্জলী জানতেন—যতই ষড়যন্ত্র করা হোক, শেষ পর্যন্ত সত্য অবলম্বন করবে।
অঞ্জলী এবং বিপ্লব এখন খুব সাবধানে কাজ করছিলেন। প্রমাণগুলোর কিছু অংশ তারা নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে রেখেছিলেন, এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের সঙ্গে গোপনীয় আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এখন সব কিছু নির্ভর করছিল সেই একটি সিদ্ধান্তের উপর—তারা কি রাকেশ মল্লিকের বিরুদ্ধে এত কষ্টের পর সত্য প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন?
অধিকাংশ সময় আদালত ছিল উত্তেজনাপূর্ণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ। রাকেশ মল্লিকের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল পরিকল্পিত এবং নির্দিষ্ট, কিন্তু অঞ্জলী ও বিপ্লবের মনোবল ছিল অটুট। তাদের কাছে শেষ মুহূর্তের পরিকল্পনা ছিল—যত দ্রুত সম্ভব সমস্ত সাক্ষীদের প্রমাণ আদালতে পেশ করতে হবে এবং মল্লিকের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
তাদের সামনে তখন একটি কঠিন পরীক্ষা ছিল। তারা জানতে পারলেন যে, এক তরুণ নারী, নাম মিতা, যিনি মল্লিকের সাথে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করতেন, সব কিছু জানতেন। মিতা ছিল এক সময় মল্লিকের অফিসে কাজ করা একজন গুরুত্বপূর্ণ সহকর্মী, যিনি অনেক অজানা কথা জানতেন, এবং তার সম্পর্কে কিছু চূড়ান্ত তথ্য ছিল। তবে, মিতা জানতেন, রাকেশ মল্লিকের বিপরীতে গিয়ে কিছু বললে তার জীবন বিপদের মুখে পড়বে। তবুও, অঞ্জলী এবং বিপ্লব তার কাছে পৌঁছানোর জন্য এক শেষ চেষ্টা করেন। তারা তাকে সাহস দেন এবং বোঝান যে, সত্য বললে সে শুধু নিজের জীবন নয়, সমাজের অনেক নারীর জন্য একটি আশার আলো সৃষ্টি করতে পারবে।
অঞ্জলী: “মিতা, যদি তুমি সত্যি বলো, তাহলে শুধু তোমার জীবন নয়, প্রতিটি নারী তার অধিকারের জন্য দাঁড়াতে পারবে। আমরা তোমার পাশে আছি।”
মিতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, “আমি ভয় পাচ্ছি, কিন্তু আমাকে সত্য বলতেই হবে। আমি জানি, রাকেশ মল্লিক কতটা ভয়ংকর। সে আমার জীবন শেষ করে দিতে পারে। কিন্তু আমি এখন আর চুপ থাকতে পারব না। আমি সত্য বলব, সব কিছু জানিয়ে দেব।”
মিতার কথা শোনার পর, অঞ্জলী এবং বিপ্লব দ্রুত তার সাক্ষ্য আদালতে উপস্থাপন করেন। মিতার সাক্ষ্য এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণের ভিত্তিতে, আদালত রাকেশ মল্লিক ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে শাস্তি ঘোষণা করতে শুরু করে। মল্লিক, যিনি এতদিন পুলিশের ক্ষমতার ভরসায় নিজের অপরাধ ঢেকে রেখেছিলেন, এবার নিজেই তার অপরাধের শাস্তি পেতে যাচ্ছিলেন।
তবে, বিষয়টি এখানেই শেষ হয়নি। আদালতে এক চূড়ান্ত মুহূর্তে, রাকেশ মল্লিক তার শক্তি ব্যবহার করে আদালতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। কিন্তু অঞ্জলী, বিপ্লব এবং মিতার দৃঢ়তা শেষ পর্যন্ত তার সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়।
শেষে, আদালত রাকেশ মল্লিকের বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযোগের প্রমাণ পায় এবং তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। তার সহযোগীদেরও শাস্তি দেওয়া হয়। এটি ছিল এক ইতিহাস।
অঞ্জলী এবং বিপ্লব জানতেন, এই জয় তাদের একক কৃতিত্ব নয়। এটি ছিল সকল নারীর জয়। তারা নিজেরাই জানতেন, তাদের সংগ্রাম একবারের জন্য শেষ হয়নি। সমাজে আরও বহু নারী আছেন, যারা অবিচার, শোষণ এবং অত্যাচারের শিকার। কিন্তু আজকের এই দিনটি ছিল এক নতুন সূচনা—এক নতুন সমাজের।
অঞ্জলী দাঁড়িয়ে ছিলেন, যখন আদালতের রায় ঘোষণা করা হয়। তার চোখে এক নতুন আলো জ্বলছিল। তার ভেতর ছিল এক গভীর প্রশান্তি। আজ, সে জানতো, সত্য অবশেষে জয়ী হয়েছে।
তার মনোযোগ ছিল এক স্থানে—এটি ছিল সেই মুহূর্ত, যেখানে তিনি শুধু নিজের জন্য নয়, পুরো সমাজের জন্য ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন।




