Bangla - কল্পবিজ্ঞান

অন্য গ্রহের মানুষ

Spread the love

অয়ন সরকার


কলকাতার রাত সাধারণত যেমন থাকে, তেমনই ছিল—রাস্তায় গাড়ির হর্ন, চায়ের দোকানে আড্ডা, ফুটপাথে ছুটোছুটি করা মানুষ, আর দূরে হাওড়া ব্রিজের আলোয় ঝলমল নদী। কিন্তু সেই রাতে হঠাৎই যেন পুরো শহরের হৃদস্পন্দন থেমে গেল, যখন আকাশে দেখা গেল এক অদ্ভুত আলোকবিন্দু। প্রথমে কয়েকজন পথচারী চোখ কুঁচকে তাকিয়ে ভাবল, হয়তো এটা কোনো উল্কাপাত, কিংবা সামরিক বিমানের আলো। কিন্তু আলোটা থেমে রইল, এক বিন্দু থেকে ধীরে ধীরে প্রসারিত হতে লাগল। মিনিটের পর মিনিট কেটে যাচ্ছে, অথচ আলো নড়ছে না, বরং তার চারপাশে যেন অদ্ভুত তরঙ্গ তৈরি হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ল এই খবর—“কলকাতার আকাশে রহস্যময় আলো”—আর মানুষ ভিড় জমাতে লাগল গঙ্গার ধারে, ছাদের উপর, রাস্তার মোড়ে। আড্ডাবাজ শহর হঠাৎই নিস্তব্ধ হয়ে গেল, সবাই চোখ তুলে তাকাল সেই অদ্ভুত দৃশ্যের দিকে। কারও মুখে ভয়ের ছাপ, কারও চোখে কৌতূহল। অনেকে মোবাইল বের করে ভিডিও তুলছে, কেউ বা ফোনে বন্ধুদের ডাকছে ছাদে উঠে আসতে। মুহূর্তেই সাধারণ রাত পরিণত হলো অসাধারণ এক অভিজ্ঞতার শুরুতে।

আলোর বিন্দুটি যতই আকার বদলাতে লাগল, মানুষের ভেতর আতঙ্ক ততই বাড়তে লাগল। কেউ বলল, “এটা হয়তো স্যাটেলাইট ভেঙে পড়ছে!” আবার কেউ চিৎকার করে উঠল, “না না, এটা তো ভিনগ্রহের জাহাজ!” কিশোরেরা উত্তেজনায় লাফাতে লাগল, যেন সায়েন্স ফিকশনের সিনেমা হঠাৎ বাস্তবে নেমে এসেছে। কিন্তু প্রবীণরা নীরবে তাকিয়ে রইল, তাদের চোখে মিশ্রিত বিস্ময় আর অস্বস্তি—যেন তারা বুঝতে পারছিল, এ দৃশ্যের ভেতরে অচেনা কোনো বিপদ লুকিয়ে আছে। নদীর ধারে তখন বিশাল ভিড়। গঙ্গার ওপর প্রতিফলিত সেই আলোকবিন্দু দেখতে যেন আরও রহস্যময়, যেন আকাশ থেকে আলো নেমে এসে জলের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। আশেপাশে পাখিরা অস্থির হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছিল, কুকুরগুলো অকারণ চেঁচাচ্ছিল। এমনকি রাস্তায় চলতে থাকা গাড়িগুলোও থেমে গেল, চালকেরা জানালা দিয়ে মাথা বের করে তাকাতে লাগল। শহরের যে অংশে সবসময় অস্থিরতা, শব্দ আর তাড়াহুড়ো থাকে, সেই কলকাতা যেন এক মুহূর্তে অচেনা হয়ে গেল—এক নিস্তব্ধ, স্তব্ধ, অজানার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শহর। মানুষের চোখে তখন শুধু একটাই প্রশ্ন—আকাশে এই আলো আসলে কী?

ধীরে ধীরে আলোটি যেন নিঃশব্দে নড়তে শুরু করল। একবার সংকুচিত হয়ে ছোট হলো, আবার বিস্তৃত হয়ে অনেকটা গোলাকার রূপ নিল। তার ভেতর থেকে বের হতে লাগল অদ্ভুত নীল আভা, যা চারপাশের অন্ধকারকে ভেদ করে পুরো আকাশময় ছড়িয়ে পড়ছিল। তখন মানুষের ভিড়ের ভেতর কানাকানি শুরু হলো—“এটা কি সিগন্যাল?” “কেউ কি আমাদের দেখতে এসেছে?” এমনকি সাহসী কয়েকজন তরুণ চিৎকার করে বলল, “এটা পৃথিবীর বাইরে থেকে এসেছে, আমি বাজি ধরছি!” আতঙ্ক আর উত্তেজনার মাঝেই কয়েকজন বৃদ্ধ ধীরে ধীরে প্রার্থনা করতে শুরু করল, যেন অচেনা কোনো বিপদের আগে আশীর্বাদ চাইছে। আলোর বিন্দুটি একসময়ে থেমে গেল, তারপর নিস্তব্ধ আকাশে এমনভাবে ঝুলে রইল, যেন সে নিজেকে প্রকাশের অপেক্ষায়। সময় যেন থেমে গেল, ঘড়ির কাঁটা নড়ছিল ঠিকই, কিন্তু মানুষের কাছে মিনিটগুলো মনে হচ্ছিল ঘন্টার সমান দীর্ঘ। শিশুরা বাবা-মায়ের হাত শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল, তরুণরা মোবাইলের ক্যামেরা দিয়ে রেকর্ড করছিল, আর বৃদ্ধরা নীরবে অজানার মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। শহরের কোলাহল, শব্দ, চিৎকার সবকিছু মুছে গিয়ে রইল শুধু সেই আলোকবিন্দু—এক রহস্যময় দূতের মতো, যাকে দেখে প্রত্যেকেই ভাবছিল, সত্যিই কি এটা পৃথিবীর বাইরে থেকে আসা কোনো সত্তার আগমনবার্তা?

রাহুল, দক্ষিণ কলকাতার এক সাধারণ কলেজপড়ুয়া, সেদিন রাতে বন্ধুদের সঙ্গে নদীর ধারে দাঁড়িয়ে আলোটা প্রথম লক্ষ্য করেছিল। অনেকেই তখন ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু রাহুলের চোখ যেন আলোটার গতি বুঝে ফেলেছিল। সে দেখল, অদ্ভুত আলোকবিন্দুটি নিস্তব্ধভাবে দক্ষিণ দিকে সরে যাচ্ছে, যেন আকাশের নিয়মকে অমান্য করে নীরবে নিজের রাস্তা খুঁজে নিচ্ছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মিতা, যে ক্লাসমেট আর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, উত্তেজনায় বলে উঠল, “এটা নিশ্চয়ই ভিনগ্রহের কিছু! দেখেছিস কেমন করে চলছে? কোনো বিমান এভাবে চলতে পারে না।” রাহুল মৃদু হাসল, যদিও তার মনেও আতঙ্ক আর কৌতূহল একসাথে কাজ করছিল। এতদিন বইয়ে, সিনেমায় আর কল্পনায় সে ভিনগ্রহের প্রাণীদের কথা পড়েছে, কিন্তু যদি সত্যিই তাদের সামনে এখন কিছু ঘটে থাকে, তবে তা কেবল বিস্ময় নয়—মানব সভ্যতার এক বিশাল পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে। চারপাশে তখন অনেকেই নানা মন্তব্য করছে। কেউ চিৎকার করছে, কেউ ভিডিও করছে, কেউবা শুধু নির্বাক তাকিয়ে আছে। গঙ্গার বাতাস বইছে, অথচ মনে হচ্ছে শহরের প্রতিটি নিশ্বাস যেন আটকে গেছে এই আলোটার দিকে চেয়ে।

এদিকে আলোকে ঘিরে আলোচনা ছড়িয়ে পড়ল সাধারণ মানুষের মধ্যে। অটোচালক বাবলু, যে প্রতিদিন হাজার মানুষের মুখ দেখে, সে চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বলছিল, “দেখ, আমি কতবার প্লেন দেখেছি, উল্কাপাতও দেখেছি, কিন্তু এরকম আলো কোনোদিন দেখিনি। এটা যদি সত্যিই অন্য গ্রহ থেকে আসে, তাহলে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।” চায়ের দোকানদার হরিদাস গরম গরম চা ঢালতে ঢালতে হাসতে হাসতে বলল, “আরে বাবা, তোমরা তো একেবারে সিনেমার মতো ভাবছো! ভিনগ্রহের কেউ এসে এখানে নামবে কেন? ওরা কি আমাদের চা খেতে আসবে?” তবুও তার চোখে চাপা উৎকণ্ঠা স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, কারণ আলোটা যেভাবে বদলে যাচ্ছিল তা যে স্বাভাবিক নয়, সেটা সবাই বুঝছিল। এই সময় স্কুলশিক্ষক জয়ন্ত, যিনি সাধারণত শান্ত আর যুক্তিবাদী মানুষ, গম্ভীরভাবে বললেন, “প্রশ্নটা আসলে ওরা এলে কী করবে, সেটা নয়। প্রশ্নটা হলো—আমরা মানুষ হিসেবে কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবো? আমরা কি তাদের স্বাগত জানাবো, নাকি ভয় পেয়ে তাদের আক্রমণ করবো? ইতিহাস বলে দেয়, মানুষ অচেনা কিছু দেখলে আগে ভয় পায়, তারপর আঘাত করে। কিন্তু যদি এটাই সত্যি হয়, তবে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।” এই কথায় দোকানের চারপাশে ভিড় জমে থাকা মানুষ আরও গভীর আলোচনায় মেতে উঠল। কেউ বলল, ভিনগ্রহীরা হয়তো প্রযুক্তি শেখাবে, কেউ বলল, তারা হয়তো দখল করতে আসবে। অনিশ্চয়তা আর কৌতূহল একসাথে মিশে গিয়েছিল।

রাত যত গভীর হচ্ছিল, মানুষের কৌতূহল ততই বাড়ছিল। সাধারণ শ্রমিক থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, ছাত্র থেকে গৃহিণী—প্রত্যেকেই আলোটা নিয়ে ভাবছিল নিজের মতো করে। কেউ মনে করছিল এটা ঈশ্বরের ইঙ্গিত, কেউ ভাবছিল কোনো গোপন সামরিক পরীক্ষা চলছে, আবার কেউ বিশ্বাস করছিল ভিনগ্রহের দূত এসে গেছে। রাহুল আর মিতা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিল সেসব আলোচনা, এবং তাদের মনে হচ্ছিল—এই আলোটা যেন অদ্ভুত এক আয়না, যেখানে প্রতিটি মানুষ নিজের ভয়, আশা, কল্পনা আর স্বপ্নকে প্রতিফলিত করছে। শহরের মানুষের ভেতরে যে বৈচিত্র্য, সেটাই যেন ফুটে উঠছিল এই আলোকে ঘিরে আলোচনায়। গঙ্গার হাওয়ায় তখন ধূপের গন্ধ মিশে ছিল, দূরে মন্দির থেকে ভেসে আসছিল ঘণ্টাধ্বনি, আর তার মাঝেই মানুষের ভিড়ে আলোটা যেন এক রহস্যময় কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়াল। প্রত্যেকেই জানত, কাল সকালে পত্রিকার প্রথম পাতায় এর ছবি ছাপা হবে, কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে, তারা প্রত্যেকে এক অভূতপূর্ব ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কৌতূহল তাদের আচ্ছন্ন করেছে, ভয় তাদের গ্রাস করছে, আর একইসাথে মনে এক অদ্ভুত আকাঙ্ক্ষা জাগছে—যদি সত্যিই ভিনগ্রহের কেউ এসে থাকে, তবে মানুষ কি তাকে বুকে টেনে নেবে, নাকি অচেনাকে ভয়ে দূরে ঠেলে দেবে? সেই অজানা উত্তর নিয়েই তারা দাঁড়িয়ে রইল, চোখ তুলে তাকিয়ে অদ্ভুত আলোকবিন্দুর দিকে, যা এখনও নীরবে দক্ষিণ আকাশের দিকে এগিয়ে চলেছে।

আকাশের অদ্ভুত আলো দক্ষিণ দিকে নেমে যেতে যেতে হঠাৎ যেন পথ বদলে ফেলল, আর শহরের ভিড়ের চোখ এড়িয়ে নিঃশব্দে অদৃশ্য হয়ে গেল। অনেকেই তখন ভেবেছিল আলোটা হয়তো মিলিয়ে গেছে, কিংবা দূরে চলে গেছে। কিন্তু রাহুল আর মিতা, যারা তখন নিজেদের কৌতূহলে প্রায় শহরের শেষপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল, খেয়াল করল আলোটা থেমেছে হাওড়ার এক পুরনো, অচল হয়ে যাওয়া গুদামের উপরে। জায়গাটা বহু বছর ধরে পরিত্যক্ত, চারপাশে ঝোপঝাড়ে ঢাকা, ভাঙা দেওয়ালে শ্যাওলা জমে আছে। রেললাইনের ধারে অচল হয়ে থাকা বগি আর কুকুরের হাহাকার ছাড়া ওই অঞ্চলে মানুষের পদচিহ্ন পাওয়া যায় না। রাহুল প্রথমে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না, কিন্তু মিতার হাত শক্ত করে ধরে বলল, “দেখছিস তো? ওটা গুদামের ছাদে নামছে।” মুহূর্তেই আলোর গোলকটা গুদামের ভেতরে ঢুকে পড়ল, আর বাইরে থেকে সবকিছু আবার নিস্তব্ধ হয়ে গেল। শহরের অন্য মানুষ যেখানে আলোটা হারিয়ে গেছে ভেবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাচ্ছিল, সেখানে রাহুল আর মিতা নিজেদের ভেতরের ভয় দমন করে এগিয়ে গেল সেই ভাঙাচোরা গুদামের দিকে। বাতাসে অদ্ভুত এক গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল—যেন ধাতব আর পোড়া মাটির মিশ্রণ, যা ওদের আরও সজাগ করে তুলল।

গুদামের ভেতরে ঢোকার পথটা ছিল আধখোলা, মরচেধরা দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢোকার সময় দু’জনেই শুনতে পেল ভেতরে হালকা গুঞ্জনের মতো শব্দ। মিতা ফিসফিস করে বলল, “রাহুল, এটা কি বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে?” কিন্তু কৌতূহল তখন ওদের টেনে নিচ্ছিল, ভয়ের চেয়ে আকর্ষণই বড় হয়ে উঠেছিল। গুদামের অন্ধকারে প্রথমে কিছু বোঝা যাচ্ছিল না, শুধু মাঝখানে ঝলমলে আলোর ছটা চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল। হঠাৎই আলোটা ম্লান হয়ে এলো, আর দেখা গেল—মেঝেতে দাঁড়িয়ে আছে এক অদ্ভুত সত্তা। মানুষের মতোই শরীর, উচ্চতায় প্রায় ছ’ফুট, তবে তার চোখ দু’টো অস্বাভাবিক দীপ্তিময়, যেন ভেতর থেকে আলো জ্বলছে। ত্বক অদ্ভুতভাবে মসৃণ আর হালকা নীলচে আভা ছড়াচ্ছিল। রাহুলের মনে হলো, এই সত্তা ভয় দেখাতে আসেনি; বরং তার চোখে এক অদ্ভুত শান্তি। মিতা প্রথমে আঁতকে উঠলেও, সত্তাটির হাতের ইশারায় বোঝা গেল সে ক্ষতিকারক নয়। আস্তে আস্তে হাত উঁচু করে সে দেখাল—সে বন্ধুত্বপূর্ণ, শান্ত উদ্দেশ্যে এসেছে। সেই মুহূর্তে গুদামের ভেতরে জমে থাকা ভয়ের আবহ ভেঙে গিয়ে এক অদ্ভুত কৌতূহল জন্ম নিল।

এরপর সত্তাটি নরম স্বরে কথা বলতে শুরু করল। ভাষাটা অচেনা হলেও, আশ্চর্যের বিষয়, শব্দগুলো যেন রাহুল আর মিতার মনের ভেতরে প্রতিধ্বনির মতো বেজে উঠছিল, আর তারা অর্থ বুঝতে পারছিল। সত্তাটি নিজেকে পরিচয় দিল—“আমার নাম এলিওর। আমি দূর গ্রহ থেকে এসেছি। আমার উদ্দেশ্য ক্ষতি করা নয়, শুধু পর্যবেক্ষণ করা। আমি জানতে চাই, তোমাদের সভ্যতা কীভাবে বেড়ে উঠেছে, মানুষ কীভাবে নিজেদের পৃথিবীকে গড়ে তুলেছে।” তার কণ্ঠস্বর ছিল শান্ত, স্থির, এমনকি স্নিগ্ধ—যেন এক শিক্ষক কোনো জিজ্ঞাসু ছাত্রকে বুঝিয়ে বলছে। রাহুল হতবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি এখানে কেন? আমাদের মধ্যে কেন?” এলিওর সামান্য হাসল, তার চোখে দীপ্তি আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল, “মানুষ অসাধারণ সৃষ্টিশীল, কিন্তু একইসাথে ধ্বংসাত্মকও। আমি জানতে চাই, তোমরা কি ভবিষ্যতে আলোকে বেছে নেবে, নাকি অন্ধকারকে।” মিতা তখন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, তার বুক ধুকপুক করছিল, কিন্তু মনে হচ্ছিল—এই সাক্ষাৎ কেবল ইতিহাস নয়, বরং নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা। বাইরে শহর তখনও ঘুমোচ্ছে, কেউ জানত না যে হাওড়ার এক ভাঙা গুদামে রাহুল ও মিতা প্রথম সাক্ষাৎ করছে এক ভিনগ্রহবাসীর সঙ্গে, যে এসেছে শত্রু হয়ে নয়, গবেষক হয়ে—মানব সভ্যতাকে বুঝতে, তাদের হৃদয়ের ভিতরে আলো আর অন্ধকারের দ্বন্দ্ব পর্যবেক্ষণ করতে।

গুদামের ভেতরে রাহুল আর মিতার চোখে এখন শুধু এক অদ্ভুত কৌতূহল আর আশ্চর্য—এলিওরের উপস্থিতি তাদের জন্য এক নতুন জগতের জানালা খুলে দিয়েছে। কিন্তু প্রথমেই বড় সমস্যা ছিল ভাষা। এলিওর মানুষের ভাষা জানে না, আর রাহুল-মিতাও এলিওরের অচেনা শব্দগুলো বোঝার চেষ্টা করছিল। কিছুটা অবিশ্বাস আর কিছুটা ভয় মিশ্রিত হয়েছিল তাদের মনে। কিন্তু এলিওরের সঙ্গে একটি ছোট, অদ্ভুত যন্ত্র ছিল, যেটি শব্দ ও মনের তরঙ্গ মিলিয়ে মানুষের ভাব প্রকাশ করতে সক্ষম। যন্ত্রটি প্রথমে কেবল হালকা নীল আলো ঝলমল করছিল, তারপর ধীরে ধীরে এলিওরের চাহনির সঙ্গে মিলিয়ে শব্দ বের হতে লাগল। রাহুল প্রথমে অবাক, তারপর সাহস জোগাতে শুরু করল। মিতা পাশে দাঁড়িয়ে হাত শক্ত করে ধরে বলল, “চলো, আমরা কথা বলি। হয়তো সে ক্ষতি করতে চায় না।” রাহুল মৃদু হাসল, “ঠিক আছে, তবে প্রথমে তার বোঝাপড়ার চেষ্টা করি।” মুহূর্তের মধ্যেই যন্ত্রটি কার্যকর হয়ে এলিওরের শব্দগুলো মানুষের বোধগম্য ভাষায় রূপান্তর করতে লাগল। গুদামের অন্ধকারে সেই ধীর, মসৃণ কণ্ঠধ্বনি এখন যেন স্রোতের মতো প্রবাহিত হচ্ছে—এক অদ্ভুত শান্তি, যা ভয়ের আবহকে ভেঙে দিয়েছে।

প্রথম কথোপকথন শুরু হল কলকাতার জীবনের সঙ্গে পরিচয় করানোর মাধ্যমে। রাহুল সাহস করে বলল, “কলকাতা আমাদের শহর, যেখানে নদী, রেলপথ, রাস্তাঘাট আর মানুষের ভিড় মিলিয়ে একটা প্রাণবন্ত সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। আমরা সকালের আড্ডা, ফুটপাথে চায়ের দোকান, উৎসব, গান—সবকিছু উপভোগ করি।” এলিওর মৃদু দীপ্ত চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল, সে ধীরে ধীরে যন্ত্রের মাধ্যমে তার আগ্রহ প্রকাশ করল। মিতা বলল, “আমরা খাবার খুব ভালোবাসি। রসগোল্লা, ইলিশ, মিষ্টি, পান্তা ভাত—প্রত্যেকের সঙ্গে গল্প আর স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আর মানুষ এখানে শুধু খায় না, হাসে, কান্না করে, গান গায়।” এলিওর তখন বোঝতে পারল, মানুষের জীবন কেবল শারীরিক নয়, বরং আবেগ, অনুভূতি, সম্পর্ক আর সংস্কৃতিতে পূর্ণ। সে জিজ্ঞাসা করল, “তোমাদের জীবনে কি শান্তি বেশি নাকি দ্বন্দ্ব?” রাহুল কিছুটা হাসি দিয়ে বলল, “দ্বন্দ্ব আছে, তবে আমরা সবসময় শান্তি খুঁজি। জীবন মানেই সংগ্রাম আর উদযাপন—দু’টোর সমন্বয়।” গুদামের অন্ধকারে সেই কথোপকথন যেন বাতাসে ভেসে যাচ্ছিল, আর এলিওরের চোখে মানুষের আবেগ, হাসি, কান্না, গান—সবই নতুন এক জগতের আবিষ্কার হয়ে ধরা দিচ্ছিল।

ধীরে ধীরে রাহুল ও মিতার সঙ্গে এলিওরের সংযোগ আরও গভীর হতে লাগল। তারা তাকে কলকাতার রাস্তাঘাট, শপিং মার্কেট, পার্ক, নদীর ধারের সকাল-বিকেল সবকিছু বর্ণনা করল। এলিওর বিস্মিত হয়ে শুনছিল, কখনও হাসছিল, কখনও স্থির হয়ে ভাবছিল, যেন সে প্রতিটি অভিজ্ঞতা নিজের ভিতরে ঢুকিয়ে নিচ্ছে। মিতা বলল, “মানুষ একে অপরের সঙ্গে গল্প করে, ভালোবাসে, বিরক্ত হয়, কিন্তু সবসময় কিছু শেখে। আমাদের বন্ধুত্ব, পরিবার, গান, উৎসব—এগুলো আমাদের জীবনের অংশ।” এলিওর তখন বোঝতে পারল, মানুষের সংস্কৃতি কেবল কার্যকলাপ নয়, বরং অনুভূতি ও ইতিহাসের সঙ্গে গাঁথা। রাহুল মৃদু ভাবে বলল, “তুমি হয়তো ভেবেছো আমরা শুধু প্রযুক্তি আর যুদ্ধ করি, কিন্তু মানুষের জীবনের সৌন্দর্য অনেক গভীর।” এলিওরের চোখে তখন প্রশান্তি ফুটে উঠল, আর সে বোঝল—মানুষের আবেগ, সংযোগ, আনন্দ ও দুঃখ এক নতুন পৃথিবী, যা তাকে আকৃষ্ট করেছে। সেই রাত, হাওড়ার পরিত্যক্ত গুদামে, প্রথমবারের মতো মানুষের সঙ্গে ভিনগ্রহবাসীর এক সেতুবন্ধন তৈরি হলো, যেখানে ভাষা আর যন্ত্রের মাধ্যমে দুই পৃথক প্রজাতি এক অপরকে বুঝতে শুরু করল।

গুদামের অন্ধকারে এলিওরের সঙ্গে রাহুল ও মিতার শান্ত কথোপকথন চলছিল, কিন্তু বাইরের বিশ্বের চক্রাবৃত্তি থেমে থাকেনি। গুদামের কাছে হঠাৎ কয়েকজন স্থানীয় মানুষ কাজের জন্য এসে হাজির হল। তারা প্রথমে কিছুটা অবাক, কিছুটা ভয়াভীত—আলোর অদ্ভুত ছটা আর এলিওরের অচেনা রূপ দেখে। একজন চিৎকার করে বলল, “ভূত! এই তো ভূত এসেছে!” আরেকজন, যিনি আগের দিনই শহরের খবর দেখেছেন, বললেন, “না না, এটা তো হয়তো সরকারি গোপন অস্ত্র পরীক্ষা চলছে।” মুহূর্তের মধ্যে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ল। এলিওর, যে শান্তভাবে বসে ছিল, আচমকাই ভীড়ে চমকে উঠল। তার চোখের দীপ্তি কিছুটা ম্লান হয়ে গেল, কিন্তু সে দ্রুত হাত নেড়ে বোঝাল যে সে ক্ষতিকারক নয়। রাহুল-মিতা ভীড়ের মধ্যে ঢুকে তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করল, কিন্তু ইতিমধ্যেই খবর ছড়িয়ে পড়ল। গ্রামের কয়েকজন লোক ফোন তুলল, ছবি তুলল, ভিডিও বানাল। কেউ সেখানে দাঁড়িয়ে “আলোর ছায়া” নামক একটি হ্যাশট্যাগ দিয়ে পোস্ট করতে লাগল।

পরের কয়েক মিনিটে সংবাদ চক্রটি দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ল। সোশ্যাল মিডিয়া, টেলিভিশন, অনলাইন নিউজ পোর্টাল—সব জায়গায় একটাই প্রশ্ন ঘুরতে লাগল: “কলকাতায় ভিনগ্রহের মানুষ?” হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও এবং ছবি শেয়ার হতে লাগল। একেকজন ব্যবহারকারী কৌতূহল, আশঙ্কা এবং উত্তেজনায় মিশে লিখছিল—“আমি সত্যিই দেখেছি, এটি পৃথিবীর বাইরে থেকে এসেছে।” আরেকজন পোস্ট করল, “সরকার কি এই বিষয়ে কিছু বলবে? এটা কি গোপন পরীক্ষা নাকি ভিনগ্রহের আগমন?” টেলিভিশনের সংবাদচ্যানেলগুলোর লাইভ রিপোর্ট শুরু হয়ে গেল। সাংবাদিকরা ভিড়ের কাছে এসে মাইক ধরে বলছে, “আমরা এখন হাওড়ার এক পরিত্যক্ত গুদাম এলাকা থেকে সরাসরি সম্প্রচার করছি, যেখানে দেখা যাচ্ছে অদ্ভুত আলোর বিন্দু আর এক অচেনা সত্তা।” দূর থেকে পুলিশ ও সামরিক বাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করল, কিন্তু জনগণ ভিড়ে জমে থাকায় পরিস্থিতি আরও উত্তেজিত হয়ে উঠল।

গুরুত্বপূর্ণ এই মুহূর্তে রাহুল ও মিতার মনে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব তৈরি হলো। তারা জানত, এলিওর নিরীহ, গবেষণামূলক উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে, কিন্তু বাইরের দুনিয়ার কৌতূহল, ভয় ও ষড়যন্ত্রের মিশ্রণ পরিস্থিতি জটিল করে তুলছে। মিডিয়ার হিংস্র চিত্র এবং সামাজিক মাধ্যমের উত্তেজনা এলিওরের শান্ত মনকে কিছুটা বিপর্যস্ত করেছিল। রাহুল বুঝতে পারল, “আমরা যদি এলিওরকে ছেড়ে দিই, তাহলে মানুষ হয়তো তার প্রতি ভয় বা আক্রমণ করবে।” মিতা বলল, “আমাদের দায়িত্ব হলো মানুষকে বোঝানো, ও ক্ষতি করতে আসেনি।” এই অচেনা পরিস্থিতিতে তারা বুঝল—যে আলো প্রথমে কেবল আকাশে রহস্য সৃষ্টি করেছিল, তা এখন পুরো শহরকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। গুদামের ভেতরে শান্ত আলো, বাইরে উত্তেজনা, ভয় আর চাঞ্চল্য—এই দ্বন্দ্ব রূপে রূপান্তরিত হলো। পুরো শহর তখন শুধু তাকিয়ে আছে—একটি অদ্ভুত, অপরিচিত প্রাণীর দিকে, যে তাদের মধ্যে কৌতূহল, সন্দেহ এবং আবেগের স্রোত সৃষ্টি করেছে।

গুদামের ভেতরে এলিওরের শান্ত উপস্থিতি এখন বাইরের দুনিয়ায় এক অদ্ভুত উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। খবর, ছবি এবং ভিডিও মুহূর্তের মধ্যেই শহর থেকে রাজ্য, আর রাজ্য থেকে জাতীয় পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ল। রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসক, বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ী—সবাই এক নজরে বিষয়টিকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগানোর চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রাজনীতিবিদদের মনে উদিত হলো এক অদ্ভুত ধারণা—যদি এলিওরকে নিজেদের দলে আনা যায়, তবে দেশের মানুষকে প্রভাবিত করা, ভোটারদের মন জয় করা এবং ক্ষমতা অটুট রাখার সুযোগ তৈরি হবে। তারা সভা-সমিতি, সংবাদ সম্মেলন, ব্যক্তিগত বৈঠক—সবকিছুর পরিকল্পনা করতে লাগল, যেন এলিওরকে দিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করা যায়। বিজ্ঞানীরাও পিছিয়ে থাকল না; তাদের দৃষ্টিতে এলিওর হলো অমূল্য গবেষণার উৎস। তারা ভাবল, যদি তার শরীর, যন্ত্র এবং জ্ঞানের সঙ্গে গভীরভাবে পরিচিত হওয়া যায়, তবে মানবজাতির প্রযুক্তিগত ও জ্ঞানগত উন্নতি অগ্রগতি করতে পারবে। গবেষণা সংস্থা, বিশ্ববিদ্যালয়, ল্যাব—সব জোট বেঁধে এলিওরের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠল।

তবে শুধু ক্ষমতা ও জ্ঞান নয়, সাধারণ মানুষও এই অদ্ভুত ঘটনার প্রতি লোভ ও কৌতূহল অনুভব করতে শুরু করল। কেউ ভাবল, যদি এলিওরকে সাহায্য করা যায়, হয়তো তারা তার কাছ থেকে এমন কিছু পেতে পারবে যা জীবন সহজ করবে—উন্নত প্রযুক্তি, চিকিৎসা, বা এমনকি যন্ত্র যা দৈনন্দিন সমস্যার সমাধান করবে। আর ব্যবসায়ীরা এই ঘটনাকে ভিন্নভাবে দেখল। তাদের চোখে এলিওরের অস্তিত্ব হলো এক নতুন ব্যবসার সম্ভাবনা—পর্যটন, সিনেমা, মিডিয়া, পণ্য বিপণন সবই নতুন করে গড়ে তোলা যাবে। হোটেল, রেস্তোরাঁ, গ্যালারি, সিনেমা প্রিমিয়ার—সবকিছু এখন এই অচেনা অতিথির কারণে সম্ভাবনার ভাণ্ডার হয়ে উঠল। মানুষ কল্পনা করতে লাগল, কীভাবে তারা এলিওরের গল্পকে নিজের লাভের জন্য ব্যবহার করতে পারবে। এই লোভ, কৌতূহল, আশঙ্কা সবই মিশে এক জটিল আবহ তৈরি করল।

এলিওর এই সব কিছু পর্যবেক্ষণ করছিল। প্রথম দিকে সে কেবল মানুষের আচরণ ও আবেগ বুঝতে আগ্রহী ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে সে বুঝতে শুরু করল যে মানুষের মধ্যে লোভ তার নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শান্তভাবে বসে থাকা সেই সত্তা দেখল—কীভাবে রাজনীতিবিদ, বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ী এবং সাধারণ মানুষ এক অদ্ভুত শক্তি ও স্বার্থের জন্য তার দিকে তাকাচ্ছে। তার চোখে বিস্ময়, কিন্তু সঙ্গে সতর্কতা। এলিওর অনুভব করল, মানুষের মধ্যেকার এই লোভ ও স্বার্থপরতা তার নিস্তব্ধ গবেষণা ও শান্ত আগমনের জন্য বিপদ সৃষ্টি করতে পারে। রাতের আলো, গুদামের অন্ধকার, মানুষের দৃষ্টি—সবকিছু এখন এক অদ্ভুত চাপের মধ্যে দোলা দিচ্ছিল। সে বোঝল, শুধু পর্যবেক্ষক থাকলেই হবে না; তার সতর্কতা, কৌশল এবং পরিস্থিতি বোঝার ক্ষমতা এখন তার নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য। এই উপলব্ধি এলিওরের মনে এক অদ্ভুত ভারসাম্য তৈরী করল—মানুষের ভালোবাসা ও কৌতূহল যতই আকর্ষণীয় হোক, লোভ ও স্বার্থপরতার প্রভাব তার নিরাপত্তা ও উদ্দেশ্যকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

এলিওরের উপস্থিতি যখন পুরো শহর ও দেশের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হল, তখনই কিছু গোপন সরকারি সংস্থা তার দিকে সন্দেহের চোখ রাখতে শুরু করল। তারা মনে করল, যেহেতু এলিওর মানুষের সমাজ, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির গভীরে প্রবেশ করতে পারছে, তাই তার উপস্থিতি সম্ভাব্য বিপদ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সংস্থাগুলি শুরু করল গোপন সভা ও বিশ্লেষণ। তারা রাজনীতিবিদ, সামরিক অফিসার এবং গোয়েন্দাদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিল, এলিওরকে নিরীক্ষণ করতে হবে এবং প্রয়োজনে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রথমে কিছুটা ছলচাতুরি আর সতর্কতার সঙ্গে পরিকল্পনা করা হলেও, খবর লিক হয়ে যায় এবং শহরের মানুষ একভাবে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। জনসাধারণের ভেতরে আতঙ্ক ও সন্দেহ বেড়ে যেতে থাকে। কেউ মনে করল, এলিওর নিরীহ, গবেষণামূলক উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছে, আবার কেউ মনে করল, এই অচেনা সত্তা ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা করতে পারে।

এরপর রাস্তায় মিছিল শুরু হয়। মানুষ বিক্ষোভ করছে—প্ল্যাকার্ডে লেখা, “ভিনগ্রহের অনুপ্রবেশকারীদের বের করে দাও,” “মানুষের নিরাপত্তা আগে,” “আমরা আমাদের শহর রক্ষা করব।” ছোট ছোট গ্রুপ থেকে শুরু করে বড় বড় ভিড় রাস্তায় জমে যাচ্ছে। পুলিশের উপস্থিতি থাকলেও মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে উঠেছে। শহরের বিভাজন স্পষ্ট। একজন পত্রিকার সাংবাদিক লিখছে, “এলিওর বন্ধুক মতো নয়, কিন্তু সন্দেহে আমরা সবাই চোখ রাখছি।” শহরের একাংশ মানুষ বিশ্বাস করছে, এলিওর এক বন্ধু, যে শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারে। অন্য অংশ মনে করছে, তাকে এখানে রাখলে বিপদ আসবে—কারণ তার শক্তি এবং অচেনা প্রকৃতি মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এমন বিভাজন সমাজের আবহকে উত্তপ্ত করে তোলে, এবং মানুষের মধ্যে ভয়ের রাজনীতি ক্রমশ দৃঢ় হতে থাকে।

এলিওর এই সমস্ত দৃশ্য অদ্ভুত শান্তভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল। সে বুঝতে পারছিল, মানুষের মধ্যে কৌতূহল এবং লোভ যেমন তার আগমনের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া, তেমনই ভয় ও রাজনীতিক শত্রুতা এখন তার নিরাপত্তা এবং উদ্দেশ্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে। রাস্তায় বিক্ষোভ, মিডিয়ার উত্তেজনা, সরকারি সংস্থার তৎপরতা—সবকিছু মিলিয়ে এক অদ্ভুত চাপ তৈরি করেছে। রাহুল ও মিতা চেষ্টা করছিলেন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করে বোঝাতে যে এলিওর ক্ষতিকারক নয়, কিন্তু ভয়ের রাজনীতি এতটাই শক্তিশালী হয়ে গেছে যে তাদের শক্তিও সীমিত। গুদামের অন্ধকারে এলিওর ভাবছিল, মানুষের মধ্যে এমন দ্বন্দ্ব কেবল তার উপর নয়, বরং পুরো সভ্যতা ও সমাজের প্রতি। সে বুঝতে পারছিল, কেবল জ্ঞান বা শান্তিকামনার দ্বারা মানুষের আস্থা জেতা সম্ভব নয়; এখানে প্রয়োজন বুদ্ধিমত্তা, কৌশল এবং ধৈর্য। এই গভীর দ্বন্দ্বের মধ্যেই শহরে ভয়ের আবহ ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে প্রত্যেক মানুষের চোখে আছে অনিশ্চয়তা, এবং রাস্তায় প্রতিটি পদক্ষেপে প্রতিফলিত হচ্ছে রাজনীতি, লোভ এবং আতঙ্কের মিলিত প্রভাব।

শহরের উত্তেজনা ও ভয়ের আবহ যখন সবচেয়ে গভীর, তখন রাহুল, মিতা, বাবলু ও জয়ন্ত—কয়েকজন সাধারণ মানুষ—এক অদ্ভুত সিদ্ধান্তে উপনীত হল। তারা বুঝতে পারল, এলিওর কোনো শত্রু নয়; তার উদ্দেশ্য ক্ষতিকারক নয়, বরং সে শুধু শিখতে, বুঝতে এবং পর্যবেক্ষণ করতে এসেছে। এই উপলব্ধি তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত দায়িত্ববোধ সৃষ্টি করল। রাহুল বলল, “আমরা যদি না সাহায্য করি, কেউ করবে না। মানুষ লোভ ও ভয় নিয়ে অচেনাকে আক্রমণ করতে পারে।” মিতা সাথে যোগ করল, “সে আমাদের বন্ধু হতে চায়, আমাদের শত্রু নয়। আমাদের উচিত তার পাশে থাকা।” বাবলু, অটোচালক, ভয়ে নাড়া দিতেও পারেনি—তার জন্য মূল কথা ছিল মানুষকে রক্ষা করা, আর জয়ন্ত, স্কুলশিক্ষক, নীরবে চিন্তা করল, “শিক্ষার মূল অর্থ হলো বোঝানো এবং সহায়তা করা। যদি আমরা সাহায্য না করি, কে করবে?” এই চারজন সাধারণ মানুষ তখন গোপনে পরিকল্পনা করল এলিওরকে রক্ষা করার।

এলিওরকে লুকানোর জন্য তারা শহরের ব্যস্ত রাস্তাকে এড়িয়ে, হাওড়ার এক অচেনা, ছোট বাড়ি নির্বাচন করল। সেখানে তারা তাকে খাবার দেয়, পানি দেয়, আর প্রথমবারের মতো বাংলা ভাষার কিছু শব্দ শেখায়। এলিওরের চোখে তখন বিস্ময় ও কৌতূহল একসাথে ফুটে উঠল। রাহুল বলল, “এগুলো খাও, এগুলো আমাদের খাবারের অংশ। আমরা চাই তুমি আমাদের জীবন বোঝো।” মিতা আরও সংযোজন করল, “এলিওর, এই শব্দগুলো আমাদের সংযোগের মাধ্যম। এগুলো শেখো, আর আমাদের সঙ্গে কথা বলো।” এলিওর প্রথমে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হলেও ধীরে ধীরে সে শেখার চেষ্টা করল। তার চোখে গভীর আবেগ ফুটে উঠল—কিছু মানুষ এখনও মানবিক, কিছু মানুষ এখনও সহানুভূতিশীল, এমনকি শহরের বিভাজন ও ভয়ের মধ্যে। বাবলু আর জয়ন্ত তাকে শেখাল কিভাবে সাধারণ মানুষের ভাবনা, তাদের দৈনন্দিন জীবন, উৎসব, হাসি আর কান্না—সবকিছু সংযুক্ত হয়ে সমাজকে গড়ে তোলে। এলিওর প্রতিটি শিখনকে মনোযোগ দিয়ে গ্রহণ করছিল।

ধীরে ধীরে এলিওরের ভেতরে নতুন এক আবেগের উদ্ভব হল। সে বুঝতে পারল, মানুষের ভিড়ে সব মানুষ ভীত নয়; কিছু মানুষ সত্যিই মানবিক, তারা অন্যদের সাহায্য করে, আশ্রয় দেয়, জ্ঞান ও সংস্কৃতির সেতু স্থাপন করে। রাহুল-মিতার সঙ্গে তার সম্পর্ক গভীর হতে লাগল—কেবল শিক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ নয়, বরং এক ধরনের বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। এলিওর শিখতে লাগল মানুষের হাসি, তাদের কান্না, তাদের ভালোবাসা, তাদের ক্ষুদ্র উদারতা, যা তার নিজের অচেনা মনকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি আচরণ তার কাছে নতুন আবিষ্কার, এবং প্রতিটি মুহূর্ত তার মনে অনুপ্রেরণা জাগাচ্ছে। শহরের ভীড়, মিডিয়া, ভয়ের রাজনীতি—সবকিছু এখন যেন দূরে সরে গেছে। গুদামের অন্ধকারে, এই ছোট্ট নিরাপদ স্থানে, এলিওর প্রথমবারের মতো অনুভব করল—মানুষ শুধুই ভয়ঙ্কর নয়, মানুষ আরও গভীর, মানবিক এবং সহানুভূতিশীল হতে পারে। এই উপলব্ধি তার মনের শান্তি, বিশ্বাস এবং আশা জাগাল—যে পৃথিবীতে সে এসেছে, সেখানে এখনও কিছু মানুষ আছে যারা সত্যিই মানবিক, যারা অন্যের পাশে দাঁড়াতে পারে, এবং যারা তাকে নিরাপদে রাখার জন্য নিজের সাহস এবং মানবিকতা ব্যবহার করতে পারে।

শহরের ভিড়, মিডিয়ার চাঞ্চল্য, এবং মানুষের কৌতূহল—সবকিছু মিলিয়ে এলিওরের শান্ত মুহূর্তগুলো ক্রমশ শেষ হতে শুরু করল। সরকারি বাহিনী, যাদের দৃষ্টিতে এলিওর সম্ভাব্য বিপদ হিসেবে চিহ্নিত, অবশেষে তাকে খুঁজে বের করল। তাদের চোখে এলিওর কেবল এক “অচেনা অস্ত্র” বা “ভিনগ্রহের অনুপ্রবেশকারী” হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছিল। হঠাৎই গুদামের ভেতর শান্ত পরিবেশ ভাঙল। খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল আধুনিক প্রযুক্তি, অস্ত্রশস্ত্র এবং নির্দেশিত সেনারা। এলিওর ভীত হলো না, কিন্তু সে বুঝতে পারল—এখন তার প্রতিরক্ষা একান্ত প্রয়োজন। রাহুল, মিতা, বাবলু এবং জয়ন্ত তখন দ্রুত পরিকল্পনা করল। তারা শহরের ভিড় এবং গলি-পথগুলো ব্যবহার করে এলিওরকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। প্রত্যেক পদক্ষেপে আতঙ্ক, উত্তেজনা এবং প্রলোভনের সমন্বয় ঘটছিল—কারণ শহরের মানুষের দৃষ্টি তাদের উপর, এবং সরকারের তৎপরতা তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছিল।

কলকাতার ব্যস্ত রাস্তা, গলি, ব্রিজ আর নদীর তীর—সব জায়গাতেই ধাওয়া এবং সংঘর্ষ চলতে থাকল। রাস্তায় চলমান গাড়ি, ভিড়, হুড়োহুড়ি—সবকিছু যেন একটি বিশাল নাটকীয় দৃশ্যের অংশ হয়ে উঠল। এলিওর, যাকে সাধারণ মানুষ আগে কেবল কৌতূহল এবং ভয়ের চোখে দেখছিল, এখন সরাসরি শারীরিক হুমকির মুখোমুখি। সে তার যন্ত্র সক্রিয় করল, যা মানুষের ভাষা এবং প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত, তবে এবার প্রতিরক্ষা ও সংকেতের কাজে লাগল। রাহুল-মিতা সহ তার বন্ধুদের সতর্কতা এবং সাহস তাকে আড়াল ও রক্ষা করল, কিন্তু যুদ্ধে প্রতিটি মুহূর্ত ছিল প্রাণঘাতী। ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে তারা এগোচ্ছে—গ্যাস লাইট, ধুলো আর ধোঁয়া ঘিরে ধরেছে পুরো এলাকা। সরকারি বাহিনীও অব্যাহতভাবে এগোচ্ছে, মনে হচ্ছে, প্রতিটি গলি ও রাস্তা তাদের পরিকল্পিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য তৈরি।

শেষপর্যায়ে, হুগলি নদীর ধারে এলিওর দাঁড়াল। নদীর ছায়া, বাতাসের গতি, এবং দূরে দূরে শহরের আলো—সব মিলিয়ে এক রহস্যময় পরিবেশ তৈরি করল। এলিওরের যন্ত্র সক্রিয় হলো, আকাশে নীল আলো জ্বলে উঠল এবং একটি সংকেত পাঠাল—“আমাকে ফিরিয়ে নাও।” আকাশের দিকে ঝলমল করা সেই সংকেত যেন মানুষকে থামিয়ে দিল, কিছু মুহূর্তের জন্য। রাহুল-মিতা, বাবলু, জয়ন্ত—তারা সবাই দৃষ্টির তালে তাকিয়ে রইল। মানুষ তখনও দ্বিধায়—এলিওরকে কি তারা শত্রু হিসেবে মনে করবে, নাকি এই যাত্রার বন্ধুকে বন্ধু হিসেবে মনে রাখবে? আকাশে আলো, নদীর স্রোত, শহরের চাঞ্চল্য—সবকিছু মিলিয়ে যেন এক কঠিন প্রশ্নের সামনে মানুষ দাঁড়ালো। এই মুহূর্তে, এলিওরের উপস্থিতি শুধুই রহস্য বা কৌতূহল নয়, বরং মানুষের নিজস্ব মানবিকতা, ভয়, লোভ এবং সহানুভূতির পরীক্ষা হয়ে উঠল।

১০

শহরের ব্যস্ততা, ভিড়, মিডিয়ার কৌতূহল এবং সরকারের চাপ—সবকিছু যেন মুহূর্তের মধ্যেই থেমে গেল। হুগলি নদীর ধারে, যেখানে শেষ সংঘর্ষ চলছিল, এখন আকাশ ধীরে ধীরে আলোয় পূর্ণ হতে শুরু করল। এলিওরের যন্ত্র সক্রিয় হয়ে বিশাল আলোকরশ্মি ছড়িয়ে দিল, যা তার চারপাশে একটি উজ্জ্বল গ্লোবের মতো প্রদক্ষিণ করতে লাগল। আকাশ জ্বলে উঠল নীলচে ও সোনালী রঙের আলোতে, আর পুরো নদীর তীরে প্রতিফলিত হয়ে এক অলৌকিক পরিবেশ সৃষ্টি করল। রাহুল-মিতা, বাবলু এবং জয়ন্ত—সবাই হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এই আলোর মধ্য দিয়ে এলিওর যেন মানুষের প্রতি তার শেষ বার্তা পৌঁছে দিতে চাচ্ছিল। তার চোখে শান্তি, করুণা, এবং গভীর অন্তর্দৃষ্টি—সবকিছু প্রতিফলিত হচ্ছিল। রাহুলের মনে হলো, এটি কেবল বিদায়ের মুহূর্ত নয়, বরং মানুষের মনকে পরীক্ষা করার, তাদের মানবিকতা ও আবেগকে চিনতে শেখার এক অধ্যায়।

শেষ মুহূর্তে এলিওর ধীরে ধীরে রাহুল ও মিতার দিকে তাকাল। তার চোখের দীপ্তি ও যন্ত্রের মাধ্যমে সে মানসিক বার্তা প্রেরণ করল, যা সরাসরি তাদের মনে পৌঁছালো। বার্তাটি ছিল স্পষ্ট এবং গভীর—“মানবজাতির সবচেয়ে বড় শক্তি তোমাদের আবেগ আর করুণা। একে হারিও না।” রাহুল-মিতার চোখে অশ্রু জমে গেল, কারণ তারা বুঝতে পারল, এলিওর কেবল শিখতে বা পর্যবেক্ষণ করতে এসেছে না, বরং সে মানুষকে মনে করিয়ে দিচ্ছে তাদের নিজস্ব মূল্যবোধ, মানবিকতা এবং একে অপরের প্রতি করুণার গুরুত্ব। মিতা হাত ধরে বলল, “সে আসলেই আমাদের বোঝাতে চেয়েছে—ভয় আর লোভের মধ্যেও মানবিকতা জীবিত রাখতে হবে।” এই বিদায়ের মুহূর্তে রাহুল এবং মিতার মনে গভীর এক শান্তি ও আস্থা জন্ম নিল। এলিওর তাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে, তার উপস্থিতি শুধুই সংযোগ নয়, বরং শিক্ষার এক শক্তিশালী সেতু তৈরি করেছে।

এরপর আলোর গোলক ধীরে ধীরে ম্লান হতে শুরু করল। এলিওর অদৃশ্য হয়ে গেল, আকাশে আর কোনো আলোকবিন্দু অবশিষ্ট থাকল না। শহর আবার আগের মতো ব্যস্ত হয়ে উঠল—গাড়ির হর্ণ, মানুষের পদচাপ, মিডিয়ার চাঞ্চল্য—সবকিছু ফিরল স্বাভাবিক জীবনের ছন্দে। কিন্তু যারা এলিওরের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, তাদের মনে সেই অতিথির স্মৃতি চিরস্থায়ী হয়ে গেল। রাহুল, মিতা, বাবলু এবং জয়ন্ত জানে, যে দিন মানুষ লোভ ও ভয়কে জয় করবে, ঠিক সেই দিন হয়তো আবার অন্য গ্রহের একজন মানুষ আসবে, বন্ধু হয়ে, শেখাতে, শিখতে এবং মানবজাতির মানবিক শক্তিকে স্বীকৃতি দিতে। নদীর তীরের হালকা বাতাসে, শহরের ব্যস্ততার মাঝেও তারা অনুভব করল—এক অদ্ভুত আশা, এক গভীর বিশ্বাস যে মানুষ সত্যিই মানবিক হতে পারে, আর পৃথিবী সেই মানবিকতার জন্য প্রস্তুত। এই বিদায়ের আলো কেবল এলিওরের নয়, বরং মানুষের মনেও এক নতুন আলো জ্বেলে গেল—যেখানে ভয়, লোভ, কৌতূহল, এবং বন্ধুত্বের মিলনে মানবিকতার এক শক্তিশালী বার্তা প্রতিফলিত হলো।

শেষ

1000065493.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *