Bangla - প্রেমের গল্প

অন্য কোনো সকাল

Spread the love

ঋদ্ধিমা বসুরায়


পর্ব ১: প্রথম দেখা

কলকাতার বুকে যখন বৃষ্টির প্রথম ছিটে পড়ে, শহরটা যেন হঠাৎ করেই কিছুটা নরম হয়ে যায়। ছাদের কার্নিশ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে আর অদ্ভুত একটা সুর তোলে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অরিত্রর কানে। সে চুপচাপ কফির কাপটা ঠোঁটে নিয়ে তাকিয়ে ছিল রাস্তার দিকে। এমন সময় তার ঘরে ঢুকল ঐশী। বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে, দু’ছেলের মা, তবে মুখের ত্বকে সময়ের আঁচ তেমন পড়েনি। কিন্তু চোখদুটো? গভীর আর ক্লান্ত।

“আজকে সিগনেচার দিতে যেতে হবে না?” অরিত্র জিজ্ঞেস করল।

ঐশী হালকা হাসল। “তুমি না থাকলে এসব কাজ কিছুই আর গুরুত্ব পায় না অরিত্র।”
এই ছেলেটা তার থেকে প্রায় বারো বছরের ছোট, তবু কেমন করে যেন প্রতিদিন একটু একটু করে ঢুকে পড়েছে তার জীবনের ফাঁকে।

অরিত্রর বয়স আটাশ। সদ্য এমএ শেষ করে, সাহিত্য পত্রিকার কাজ করছে। ঐশীর স্বামী, দেবজ্যোতি, বড়লোক ব্যবসায়ী, দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে অফিস আর ফোনে। বিয়েটা হয়ে উঠেছিল সামাজিক দায় মেটানোর মতো একটা বোঝা, যে বোঝা ঐশী একসময় না চাইলেও বয়ে বেড়িয়েছে।

অরিত্রর সঙ্গে তার প্রথম দেখা হয়েছিল রবি ঠাকুরের এক সন্ধ্যা পাঠে, শান্তিনিকেতনে। ছেলেটা পড়ছিল “শেষের কবিতা,” আর তার গলার আওয়াজে যেন শব্দেরা জীবন্ত হয়ে উঠছিল। ঐশীর চোখ থেমে গিয়েছিল ওর ঠোঁটের নড়াচড়ায়।

তারপর ধীরে ধীরে নিয়মিত দেখা, প্রথমে বই নিয়ে আলোচনা, তারপর চায়ের কাপ, তারপর সেই এক বিকেল—যেদিন বৃষ্টির ভেজা শহরে ওরা একসঙ্গে ভিজে গিয়েছিল।

সেদিনই অরিত্র প্রথম ঐশীর ঠোঁটে হাত রাখে। কোনও প্রশ্ন ছিল না, শুধু চোখের ভেতর এক অজানা তৃষ্ণা। ঐশী তখনও জানত না, এই ছেলেটা শুধু তার শরীর নয়, তার ভিতরের শুকিয়ে যাওয়া নারীত্বটাকে জাগিয়ে তুলবে।

“আজ একটু দেরি করে ফিরব,” ঐশী বলল। “দেবজ্যোতি কাল থেকে গোয়ায়, অফিস ট্রিপ।”
অরিত্র হালকা হাসল। “তাহলে আজকের রাত আমাদের?”

ঐশী তাকিয়ে রইল ওর চোখে। “তুমি এখনও বুঝতে পারো না অরিত্র, আমি কবে তোমার হয়ে গেছি।”

ঘরের ভেতর নরম আলো, জানলার কাচে বৃষ্টি টিপটিপ, আর সেই মুহূর্তে ওরা দুজন একে অপরের দিকে এগিয়ে আসে। ওর কপালের চুলগুলো সরে যায় অরিত্রর আঙুলে, ঠোঁটের কোণে নেমে আসে নরম স্পর্শ। ঐশীর বুকের ভিতরটা কেমন ফাঁকা হয়ে আসে, আবার তীব্র এক অনুভবে ভরে ওঠে।

অরিত্রর হাত ওর পিঠ বেয়ে নিচে নামছে, ঐশীর শাড়ির আঁচলটা খুলে যাচ্ছে যেন নিজের ইচ্ছেতেই। শরীর শুধু শরীর নয়, মনের মধ্যে জমে থাকা অভিমান, না-পাওয়ার দীর্ঘশ্বাস, সব মিলে এক মাদকতা হয়ে ওঠে।

বিছানার চাদরটা একটু এলোমেলো হয়ে যায়। ঐশী তখন আর কোনও বাধা দেয় না। আজ সে শুধু এক স্ত্রী নয়, সে একজন নারী—আবেগের, চাহিদার, আর ভালোবাসার পূর্ণ অবয়ব।

“তোমার গায়ে যে গন্ধটা থাকে, সেটা আমাকে পাগল করে দেয়,” অরিত্র বলল।

ঐশী জানে, এ সম্পর্কের কোনও সামাজিক নাম নেই। সে জানে, এই সম্পর্কের শেষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটা কেউ জানে না। তবু অরিত্রর বুকের পাশে মাথা রাখলে তার মনে হয়, এই পৃথিবীতে আর কিছু দরকার নেই।

ওদের নিশ্বাস মিশে যায়, ঘরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। বৃষ্টির শব্দ যেন বাইরে থেমে গেছে, কেবল ভিতরে এক অদ্ভুত ছন্দে বেজে চলে ওদের শরীরের কথোপকথন।

রাতের দিকে ঐশী বলল, “আমার কি লজ্জা পাওয়া উচিত?”

অরিত্র ওর কপালে চুমু দিয়ে বলল, “তুমি আমার কাছে যেমন আছো, তেমনটাই চাই। কোনো লজ্জা নয়, শুধু চাই তুমি থাকো।”

ঐশী জানে, আগামীকাল আবার তাকে সংসারের কাঠামোয় ঢুকে পড়তে হবে। তবু এই রাত, এই ঘর, এই ছেলেটার চোখ—সব মিলিয়ে এটা একটা নতুন সকাল। হয়তো একেবারে ‘অন্য কোনো সকাল’।

পর্ব ২: গোপন জানালা

ঘড়িতে তখন বিকেল পাঁচটা। জানলার পাশের সোফায় বসে অরিত্র তার ল্যাপটপে টাইপ করছিল। চোখে ভারি চশমা, পরনে ধূসর হাফশার্ট আর ছেঁড়া জিনস। বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে মেঘের ছায়া। ঐশী জানত, এই ছেলেটা শুধুই যৌবনের শরীরী টান নয়—ওর ভেতরে এমন কিছু আছে যা তাকেও লিখতে শেখাচ্ছে, ভাবতে শেখাচ্ছে, এমনকি নতুন করে বাঁচতেও।

ঐশী আজ একটু আগে এসেছিল। দুটো বাজতে না বাজতেই বউবাজারের সেই পুরনো গলিটার মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিল এক ট্যাক্সির ভেতর। শাড়ি আজও নিঃশব্দে বলে দেয় তার বয়স। তবু চোখে আজ অন্য রকম দীপ্তি।

অরিত্র দরজা খুলতেই ঐশী বলল, “আজ একটু বেশি সময় পাবো… দেবজ্যোতির ফ্লাইট বাতিল হয়েছে, ফোনে বলল, আগামীকাল সকালেই রওনা হবে।”

অরিত্রর ঠোঁটের কোণে খেলল এক বাঁকা হাসি। “তবে তো বৃষ্টি আজ পুরোটাই আমাদের,” সে বলল।

ঐশী জানত, এই খেলার নিয়ম নেই। এখানে প্রতিদিন নতুন নিয়ম, নতুন নিষেধ, নতুন অবাধ্যতা।

তারা একসঙ্গে বসে কফি খাচ্ছিল। ঐশী হঠাৎ বলল, “তুমি যদি একদিন আমার স্বামী হতে চাও?”

অরিত্র থেমে তাকাল। “তুমি চাও?”

ঐশী হেসে বলল, “চাওয়া আর হওয়ার মধ্যে কত ফারাক জানো? আমি চাই, কিন্তু জানি সেটা হবে না। আমি চাই, কিন্তু সমাজ চায় না। আমার সন্তানেরা চায় না। কিন্তু আমি, ঐশী, একান্তই একজন নারী হিসেবে, শুধু চাওয়া জানি।”

অরিত্রর মুখ কঠিন হয়ে এল। “তাহলে চলো পালিয়ে যাই। চলো এক নতুন শহরে, যেখানে কেউ আমাদের চিনবে না। শুধু তুমি আর আমি।”

ঐশী ঠোঁটে আঙুল রেখে বলল, “এই কথাটা বললেই তো সব সত্যি হয়ে যাবে না অরিত্র। আমি কোনো উপন্যাসের চরিত্র নই। আমি এক জীবন্ত, লুকোনো সংসারের ভেতরে লুকিয়ে থাকা একটি অনাহুত আলো।”

তবু সেই আলোকে ও লুকাতে পারছে না।

অরিত্র এবার একটু কাছে এসে ঐশীর হাত ধরল। “তোমার শরীরটা আমার কাছে শুধু শরীর নয়। এটা এক অভিজ্ঞতা। এক ধৈর্যের নদী। এক আত্মসমর্পণের অনন্ত সমুদ্র।”

ঐশীর শিরা-উপশিরা গরম হয়ে উঠল। শরীরে আগুন ছড়িয়ে পড়ল যেন।

তার গলার কাছে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল অরিত্র। “তুমি জানো, তোমার গলার এই অংশটাই আমার সবচেয়ে প্রিয়?”

ঐশীর গলা দিয়ে একটা ক্ষীণ শব্দ বেরোল, ঠোঁট থরথর করে কাঁপতে লাগল। অরিত্রর হাত ওর শাড়ির খোলা অংশে, বুকের ঠিক নিচে স্পর্শ করতে করতে নামছে ধীরে ধীরে।

“আজ তোমাকে শুধু ভালোবাসব না, চুপি চুপি লিখে রাখব আমার কবিতার পাতায়—তোমাকে, তোমার গন্ধ, তোমার স্তব্ধতা,” অরিত্র বলল।

ঐশী তখন আধখোলা শরীরে ধরা, চোখে জল আর কামনার তীব্রতা। সেই বিকেলের বৃষ্টি, সেই জানলার গ্লাসে জমা কুয়াশা আর ঘরের মধ্যে অস্পষ্ট ছায়া—সব মিলিয়ে যেন এক গোপন জানালা খুলে গেল।

যেখানে সে শুধুই নারী। শুধু ঐশী। একজন স্ত্রী নয়, একজন মা নয়—একজন প্রেমিকা। একজন পূর্ণ নারী, যার হৃদয়টা প্রতিদিন একটু একটু করে জেগে উঠছে অরিত্র নামের সেই যুবকের চুম্বনে।

রাত ঘনিয়ে এলে, বিছানার চাদরে গড়িয়ে থাকা স্নিগ্ধ দেহ দুটি, বাতাসে লেগে থাকা ঘামের হালকা গন্ধ, আর ঘড়ির কাঁটার শব্দ—সব মিলিয়ে সেই সন্ধেটা হয়ে উঠল একান্ত নিজস্ব।

সেই সন্ধে, যা তাদের বিয়ের চেয়ে বেশি আন্তরিক, সংসারের চেয়ে বেশি গভীর, আর সমাজের চোখের চেয়ে অনেক বেশি সত্য।

পর্ব ৩: বুকের ভিতরের দরজা

সকালে ঘুম ভাঙতেই ঐশীর শরীরটা কেমন ভারী মনে হলো। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখে অরিত্র এখনো ঘুমিয়ে। বালিশে এলোমেলো চুল, ঠোঁটের কোণে আলতো হাসি। তার দিকে তাকিয়ে ঐশীর মনে হলো—এই ছেলেটা যেন কোনো এক অসমাপ্ত গান, যা ও কেবল শুনে যেতে পারে, কিন্তু শেষ করতে পারে না।

ও চুপচাপ উঠে জানলার পর্দা সরাল। বাইরে ভোরের আলো ফুটেছে। পাখির ডাক, দূরে একটা পুরনো ট্রামের ঘণ্টা—সব মিলিয়ে শহরের ঘুম ভাঙার শব্দ। কিন্তু ঐশীর ভিতরটা জেগে ছিল অনেক আগেই।

আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে ও হঠাৎ নিজেকে নতুন করে চিনল। চোখে এখনও ঘুমের ছায়া, তবু এক ধরনের জ্যোতি আছে। যেন রাতের ভালোবাসা ওর ত্বকের উপর একধরনের আভা রেখে গেছে।

বিছানায় ফিরে এসে অরিত্রর কপালে হাত রাখল ঐশী। সেই স্পর্শেই অরিত্র চোখ খুলল।

“তুমি চলে যাচ্ছো?”
“না এখনই না,” ঐশী মৃদু হেসে বলল। “কিন্তু মনে হচ্ছে, একটা দরজা খুলে ফেলেছি… যেটা একবার খুললে আর বন্ধ করা যায় না।”

অরিত্র উঠে বসল, ওর কাঁধে হাত রেখে বলল, “তুমি কি ভয় পাচ্ছো?”

ঐশী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “ভয় নয়, বরং এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ। তুমি আমার জীবনটাকে ঠিকঠাক বানিয়ে দাওনি অরিত্র, তুমি সব এলোমেলো করে ফেলেছো। আর তাতেই আমি জেগে উঠেছি।”

“তোমার চোখে যে আগুনটা আছে এখন, সেটা আমি রাখব। যতদিন তুমি চাও, ততদিন,” অরিত্র মৃদু স্বরে বলল।

ঐশী হেসে ফেলল। সেই হাসিতে ছিল কষ্ট, ছিল কামনা, আর ছিল এক অব্যক্ত আহ্বান।
হঠাৎ সে উঠে দাঁড়াল, ওর শাড়ি সামলাল, বলল, “আজ একটা নতুন ব্লাউজ পরবো, লাল রঙের। তুমি পছন্দ করো না?”

অরিত্র চোখ বুজে বলল, “তোমাকে কোনো রঙেই বেঁধে রাখা যায় না। তবু, লালে তোমাকে দেখে মনে হয়, তুমি আগুন। আমি সেই আগুনে পুড়েও শান্তি খুঁজে পাই।”

ঐশীর বুকের ভিতর কেঁপে উঠল। এই ছেলেটা যেন শুধুই প্রেমিক নয়, একপ্রকার অমোঘ নেশা। এমন নেশা যা দিনে দিনে ঘনীভূত হয়, সরে যায় না, বরং ভিতরের শূন্যতা পূর্ণ করে।

“চলো একদিন শুধু ঘুরতে যাই কোথাও,” ঐশী বলল হঠাৎ।

“কোথায়?”

“মন্দারমণি, বকখালি, বা হয়ত আরও দূরে। এমন কোথাও, যেখানে কেউ আমাকে ডাকবে না মা বলে, বা বৌমা বলে। শুধু তুমি ডাকবে—ঐশী।”

অরিত্র হাসল। “তা হলে ঠিক করলাম, এবার তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যাবো। একদিনের জন্য হলেও।”

ঐশী বলল, “তুমি জানো, এই খেলাটা আমাদের কাছে শুধু শরীরের নয়। এই খেলাটা আমি তোমার বুকের ভিতরের সেই দরজায় খেলে যাচ্ছি, যেখানে তুমি কাউকে ঢুকতে দাও না।”

“তুমি সেই প্রথম মানুষ যে সেই দরজায় নক করেছে,” অরিত্র কানে কানে বলল।

তারপর ওর ঠোঁট ছুঁয়ে যায় ঐশীর গলার কাছে। ঐশীর চোখ বন্ধ হয়ে আসে, শ্বাস ঘন হয়ে যায়, শরীর আবার আলগা হয়ে যায় সেই চেনা জ্বরের মতো আবেগে।

শরীর শুধু তৃপ্তি নয়, তাদের মধ্যে এটা একধরনের আশ্রয়। একে অপরের মধ্যে ওরা খুঁজে পায় সেইসব উত্তর, যা সংসারে কোনোদিন প্রশ্ন করাও যায় না।

যখন ঐশী বেরিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল, অরিত্র বলল, “আবার কবে আসবে?”

ঐশী তাকিয়ে বলল, “যেদিন আমার বুকের ভিতর আবার শূন্যতা জমে উঠবে… আমি তখনই আসব তোমার কাছে।”

অরিত্র হাসল না, শুধু জানালার দিকে তাকিয়ে রইল। বাইরে সূর্য উঠছে। কিন্তু ঘরের ভিতর আরেকটা সকাল জন্ম নিচ্ছে, একেবারে অন্য রকম এক সকাল—অন্য কোনো সকাল।

পর্ব ৪: ছাদের নিচে চাঁদ

বাড়ির ছাদটা ঐশীর সবথেকে প্রিয় জায়গা ছিল। ছোটবেলায় যেমন খুদের পায়ে দৌড়ে যেত আকাশ ছোঁয়ার ইচ্ছায়, এখনো সেই পুরনো ইচ্ছে রয়ে গেছে। শুধু ছাদটা এখন আর শুধু ছাদ নয়—এটা একটা গোপন আশ্রয়, যেখানে ও অরিত্রর স্পর্শে বাঁচতে শেখে।

আজও ও এসেছে সেই ছাদে, কিন্তু একা নয়।

রাত দশটা। ছাদে অন্ধকার ছায়া, গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো পড়ছে ঐশীর মুখে। অরিত্র চুপচাপ বসে আছে ওর পাশে। হাত ধরে আছে শক্ত করে, যেন কিছুতেই ছাড়বে না।

“তুমি জানো অরিত্র,” ঐশী ফিসফিস করে বলল, “আমার বিয়ের প্রথম বছরটা ছিল কেবল ছায়া। দেবজ্যোতি আমাকে ছুঁত না। এমনকি কথা বলতেও যেন একটা দায় মেটাতো। সেই শূন্যতাটা আমি বছর বছর বয়ে নিয়ে চলেছি।”

অরিত্রর চোখে তখন অদ্ভুত আলো। “তুমি জানো, আমি চাই না তুমি শুধু আমার শয্যাসঙ্গিনী হও। আমি চাই তুমি আমার ছায়াও হও, আলোও হও। শুধু এই ছাদের নিচে নয়, জীবনের প্রতিটি কোণায় তুমি থাকো।”

ঐশী একটু হেসে বলল, “তুমি বড্ড ছোট এখনও এসব বলার জন্য। তোমার বয়সে আমি আমার প্রথম ছেলেকে কোলে নিয়েছিলাম।”

“আর এখন?” অরিত্র জিজ্ঞেস করল।

ঐশী বলল, “এখন আমি নিজেকেই খুঁজে ফিরছি… আর তুমি আমার আয়না।”

সেই কথা শেষ না হতেই অরিত্র উঠে দাঁড়াল। ধীরে ধীরে ঐশীর কাছে এল। ওর শাড়ির আঁচলটা এলোমেলো করে দিয়ে বলল, “তুমি জানো, তুমি যখন চুপ করে তাকিয়ে থাকো, আমি বোঝা শক্ত হয়ে পড়ে—তুমি কী চাইছো। তখন শুধু শরীরই নয়, তোমার চোখও আমাকে ছুঁয়ে যায়।”

ঐশী চোখ বন্ধ করল। এক হাত দিয়ে অরিত্রর মুখ ছুঁয়ে বলল, “আমি চাই তুমি আমাকে এমনভাবে চাও—যেভাবে কেউ চায় শেষবারের মতো।”

অরিত্রর ঠোঁট তখন ওর গলার হাড় ছুঁয়ে গেছে। ঐশীর দেহে যেন আগুনের ঢেউ। ছাদের ছায়া যেন সাক্ষী সেই গভীর সংলাপের—যেখানে কোনো শব্দ নেই, শুধুই স্পর্শ, শুধুই দহন।

ওর হাত বুকে বেয়ে নিচে নামছে, ওর শাড়ির কুচি খুলে যাচ্ছে আপনাতেই। ঐশীর ঠোঁট কাঁপছে, শরীরের প্রতিটি কোণে ভেজা নিঃশ্বাস জমে উঠছে। রাতের আকাশ দেখে মনে হচ্ছে যেন তারা একজোড়া চোর—ভালোবাসা চুরি করছে একাকীত্বের খালি বাক্স থেকে।

“তোমার শরীরের এই বাঁকগুলো আমার কবিতা,” অরিত্র বলল, “তোমার ঘামের গন্ধ আমার গল্পের প্রথম বাক্য।”

ঐশী তখন কোনও কথা বলছে না, শুধু চোখে জল—কিন্তু সেই জল তীব্র সুখের, দীর্ঘদিনের অবদমনের মুক্তি। সেই মুহূর্তে ওরা একে অপরের মধ্যে ডুবে যায়—কোনওকিছু না ভেবে, না জেনে, শুধু শরীর আর মনের সমস্ত সীমা পেরিয়ে।

রাত বাড়ে। ছাদের নিচে চাঁদের আলো ফিকে হয়ে আসে। বাতাসে ভেসে থাকে দুটো শরীরের দাহ, দুটো হৃদয়ের শ্বাস, আর একটা সম্পর্ক—যা নিন্দিত, তবু সত্যি।

ঐশী মাথা রেখে অরিত্রর কাঁধে বলল, “আমি চাই না কেউ জানুক, তবু আমি চাই তুমি কখনো ভুলে না যাও… এই রাতটা, এই ছাদটা… এই চাঁদটা।”

অরিত্র বলল, “এই চাঁদটা আমিও আর কোনোদিন আগের মতো দেখব না।”

পর্ব ৫: নীচু গলায় নাম

ঐশী আজ সকাল থেকেই অস্থির। ফোনটা বারবার চেক করছে, আবার রেখে দিচ্ছে। বাড়ির ভিতরে স্বামী আর বড় ছেলে, সকালের চায়ের কাপ হাতে রোজকার খবরের কাগজ নিয়ে বসে। কিন্তু ঐশীর মন আজ কোনও শিরোনাম ধরতে পারছে না।

অরিত্রর মেসেজ আসেনি এখনও।
না “শুভ সকাল”, না “আজ কখন আসবে?”—কিছুই না।

ঐশীর বুকের মধ্যে কেমন খচখচ করতে লাগল। যে মানুষটা একদিনে একটা চুম্বনে ওর জীবনের শূন্যতা মুছে দিয়েছিল, সে-ই আজ সকাল থেকে নিরব!

আসলে এই সম্পর্কের কোনো অধিকার নেই। ফোন না ধরলে রাগ করতে নেই, দেখা না হলে প্রশ্ন করতে নেই, ভালবাসার দাবি রাখাও যেন পাপ।
তবু ঐশী নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না।

ফোন হাতে তুলে দিল এক মেসেজ—
“সব ঠিক তো? অনেকক্ষণ হয়ে গেল…”

পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট… তারপর হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল।
অরিত্রর নাম দেখে বুকটা হু হু করে উঠল। দ্রুত ধরে বলল, “কোথায় ছিলে তুমি?”

ওপাশ থেকে গলা এল, একটু কাঁপা, একটু গলা নীচু করা—“ঐশী, আজ তোকে না বলেই একটা কিছু করে ফেলেছি…”

“মানে?” ঐশীর গলা চড়া হয়ে আসে।

“আজ মা’র সঙ্গে আমার কথা কেটে গেছে। তুই ফোন করছিলি, তখনই মা এসে দেখে ফেলে। আমি তো তোকে ‘ঐশী’ নামে সেভ করে রেখেছি। মা জিজ্ঞেস করল, কে এই নাম? আমি বললাম… আমার এক লেখিকা… তোর বয়স অনেক বেশি… মেন্টর মতন… কিন্তু…”

ঐশীর শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। “তুমি আমার বয়স বললে? তুমি আমাকে লেখিকা বললে?”

“না মানে… আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম… জানি আমার সাহস নেই… জানি তুই এখন রাগ করবি… তবু…”

ঐশী আর কিছু শুনতে পেল না। ফোন কানে ধরে থেকেও সে কেবল শুনল নিজের ভিতরের একটা আওয়াজ—যেটা গর্জে উঠছে।

এই সম্পর্কের ভিতরে একটা জেদ আছে, কিন্তু একটা লজ্জাও আছে। ঐশী জানে, যে সমাজ তাকে মায়ের আসনে বসায়, স্ত্রী হিসেবে সম্মান দেয়, সেই সমাজ তাকে অন্য চোখে দেখবে যদি জানে সে একজন কম বয়সী ছেলের প্রেমে পড়েছে—তাও শরীর দিয়ে, শরীর ছুঁয়ে, গলার নীচে নাম লিখে।

তবু ঐশীর ভিতর থেকে আরেকটা কণ্ঠ উঠে এল—“তুমি জানো অরিত্র, আমি কখনো চাইনি তুমি আমাকে লুকাও। আমি কখনো চাইনি তুমি আমার বয়সের কথা বলে পালিয়ে যাও। আমি শুধু চেয়েছিলাম, তুমি আমাকে ঐশী বলে ডাকো—নিচু গলায়, নিজের মনে, কিন্তু সত্যি করে।”

ওপাশ থেকে নিঃশ্বাসের শব্দ।

“ঐশী, আমি তোকে ভালোবাসি, রগরগে শরীর দিয়ে নয়, এক রকম গহীন অন্ধকার দিয়ে, যেটা তুই একা বুঝিস। আমি ভয় পেয়েছি, কিন্তু তোকে ভুলিনি…”

ঐশীর চোখে জল এসে গেল। রাগ, অভিমান, কামনা—সব মিলে এক অদ্ভুত বৃষ্টির মতো ঝরতে লাগল ভেতর থেকে।

সে বলল, “তুমি যা করেছো, আমি বুঝি। কিন্তু মনে রেখো, প্রেমে গলা যতই নিচু করো, নাম যেন ভুলে না যাও।”

ওদের সম্পর্ক এখন আর চুপচাপ নয়। এখন সেটা নিজের জায়গা চায়—নীচু গলায় হলেও, সত্যি নাম নিয়ে।

পর্ব ৬: শরীর যেখানে থামে না

ঐশী আজ সন্ধ্যেবেলায় মেকআপ করল। খুব বেশি না, ঠোঁটে একটা গাঢ় লাল লিপস্টিক আর চোখে হালকা কাজল। পরল সাদা-লাল সীমান্তে সূতো-তোলা শাড়ি। এই শাড়িটা অরিত্র একদিন বলেছিল, “তোমায় আগুনের মতো দেখায়।”

দরজা খুলতেই অরিত্র কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “তুমি আজ গল্পের মতো লাগছো… এমন গল্প যেটা আমি লিখতে পারি না, কেবল পড়ে যেতে পারি… আর বারবার ফিরে যেতে পারি একই লাইনে।”

ঐশী হাসল না, কাঁধের আঁচলটা একটু সামলে ঘরে ঢুকে বলল, “আজ গল্প লিখব না। শুধু থাকব। তোমার সঙ্গে, শরীরের পাশে, মনের গভীরে।”

ঘরটা আজ অন্যরকম। জানালা খোলা, বাইরের বাতাসে কেমন একটা নোনা গন্ধ, যেন হাওয়ার ভেতরে কামনা ছড়িয়ে আছে।

অরিত্র ধীরে ধীরে ঐশীর পেছনে এসে দাঁড়াল। তার চুল সরিয়ে কাঁধে আলতো চুমু রাখল।
ঐশী চোখ বন্ধ করল।

“তুমি জানো?” সে ফিসফিস করে বলল, “শরীরের শেষ নেই। আমরা যত ভেবে নিই, এটা শুধু বিছানা পর্যন্ত, আসলে আমাদের এই সম্পর্ক শরীর থেকে অনেক দূরে চলে গেছে।”

অরিত্র তার কানে চুমু দিয়ে বলল, “তোমার শরীর আমাকে শুধুই উত্তেজিত করে না, আমাকে নরম করে। আমাকে ভেঙে ফেলে। আমি তোমার গন্ধে নিজের অসহায়তা খুঁজি। আমি তোমার বুকের ভিতর সেই জায়গাটা খুঁজি, যেখানে কেউ কোনদিন পৌঁছায়নি।”

ঐশীর হাত ধীরে ধীরে নামছে অরিত্রর বুক থেকে কোমরের দিকে। তাপ ছড়িয়ে পড়ছে হাতের তালু দিয়ে। ওরা কোনো কথা বলে না—শুধু নিঃশ্বাসে কথা চলে।

বিছানায় ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ে দুটো দেহ। শাড়ির কুচি একপাশে, চুল বিছানার কিনারায় ছড়িয়ে, ঠোঁট ঠোঁটে লেপ্টে থাকে। ওদের শব্দ হয় না, ওদের শরীর শব্দের চেয়ে বেশি স্পষ্ট।

এই মুহূর্তে ঐশী আর স্ত্রী নয়, মা নয়—ও কেবল নারী, কেবল ভালোবাসার উন্মাদ এক অস্তিত্ব। অরিত্রর আঙুলে ওর মেরুদণ্ড কাঁপে, ওর ঠোঁটের কোণে জ্বলন ধরে। ঘরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে ঘামে, রতিতে, রাগে, ভালোবাসায়।

“তোমাকে আমি পুরোপুরি চাই,” অরিত্র গলায় জেদ নিয়ে বলল।

ঐশী বলল, “তুমি যদি জানো, আমার মধ্যে এখনো কতটা ভাঙা, তবেই বুঝতে পারবে, আমি নিজেকে কতটা দিয়েছি তোমায়…”

অরিত্র থেমে গিয়ে ওর বুকের কাছে মুখ রাখে। “তুমি আমায় শুধু দেহ দাওনি ঐশী, তুমি আমাকে ছুঁতে দিয়েছো সেই জায়গাটায়—যেখানে মেয়েরা সাধারণত কাউকে ঢুকতে দেয় না।”

রাত গভীর হয়। বিছানার চাদরে ঘাম, কামনা আর ভালোবাসার ছাপ।

ঐশী ওর কানে ফিসফিস করে বলে, “তুমি জানো, আমি অনেকদিন পর আমার নিজের শরীরটাকে সুন্দর বলে মনে করছি। তোমার চোখেই দেখেছি নিজেকে নতুন করে।”

অরিত্র বলল, “তোমার প্রতিটি দাগ, প্রতিটি ভাঁজ—আমার কাছে গল্পের মতো, যেখানে তুমি লেখিকা, আমি কেবল পাঠক।”

রাত থেমে থাকে না, ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যায়। তবু ঐ ঘরের ভেতর যেন সময় থেমে গেছে। সেখানে কেবল দুটি দেহ, দুটি মন, আর এক অপার্থিব প্রেম—যেটা শরীর যেখানে থেমে যায়, ঠিক তার অনেক পরে শুরু হয়।

পর্ব ৭: নামহীন সন্ধের ছবি

সেদিন সন্ধ্যেবেলা, কলকাতার আকাশটা কেমন অদ্ভুত রঙের ছিল। লাল, নীল, বেগুনি সব গুলিয়ে একরকম ছায়া ছড়াচ্ছিল শহরের গায়ে। ঐশী ট্রামে উঠেছিল সেদিন—অনেক বছর পর। কলেজে পড়ার সময় যেমন হাওয়ায় চুল উড়িয়ে বসে থাকত, আজও যেন সেই বয়স ফিরে এসেছে।

তবে পাশে কেউ নেই আজ। অরিত্র ব্যস্ত। বলেছে, “আজ অফিসে একটা ইন্টারভিউ আছে, গল্প পাঠাতে হবে রাতে, ফোন তুলতে পারব না।”

ঐশী মেনে নিয়েছে। মুখে কিছু বলেনি, তবু ট্রামের জানালার ধারে বসে মনে মনে বলেছে, “তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা কি তবে শুধু শারীরিক ছিল? তুমি কি ধীরে ধীরে হাঁটা থামিয়ে দিচ্ছো?”

একটা বয়সের পর, প্রত্যাশা মানুষ নিজেই কমিয়ে নেয়। কিন্তু ভালোবাসা যখন শরীর ছুঁয়ে আত্মায় পৌঁছে যায়, তখন প্রত্যাশা অজান্তেই বাড়তে থাকে। ঐশী অনুভব করে, অরিত্রর চোখের দিকে তাকালেই তার মন বোঝা যায়। আর এখন সেই চোখে একটু অন্য রকমতা—একটু ক্লান্তি, একটু দূরত্ব।

ট্রাম থেমে যায় ধর্মতলায়। ঐশী নেমে একটা বইয়ের দোকানে ঢোকে। পুরনো বইয়ের গন্ধ ওর খুব প্রিয়। একটা মোটা কবিতার বই তুলে নেয়—একটা পৃষ্ঠা খুলতেই চোখে পড়ে কবিতাটা:

“আমি যদি ছুঁই, তুমি কি কাঁপবে?
নাকি কেবল শরীরেই থেমে যাবে গল্প?”

ঐশীর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। মনে হয়, কবিতাটা ওরই লেখা, ওর জীবনেরই প্রতিফলন।

তবে সেই সন্ধেয় অরিত্র ঠিকই ফোন করেছিল।
“তুমি কোথায়?”
ঐশী উত্তর দিয়েছিল, “আমি একটা ট্রামে বসেছিলাম। একা।”

“আমি চাইনি তুমি একা থাকো। আমি শুধু একটু সময় চেয়েছিলাম। জানো, তোমার থেকে দূরে গেলে আমার কেমন ভয় লাগে?”

ঐশী চোখ বন্ধ করে বলেছিল, “ভয়ের চেয়েও খারাপ হলো, তুমি অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছো। আমার শরীরে, আমার উপস্থিতিতে, আমার প্রেমে—তুমি অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছো।”

ফোনের ওপাশে নীরবতা।

অরিত্র ধীরে ধীরে বলল, “আমি তোমার শরীরে অভ্যস্ত নই ঐশী, আমি আসলে তোমার অভাবেই অভ্যস্ত হচ্ছি। তুই যখন থাকিস না, তখন বুঝি তুই কতটা আমার হয়ে গেছিস।”

ঐশীর চোখে জল চলে আসে। এই সম্পর্কের কোনো নাম নেই, অথচ এই সম্পর্ক ছাড়া যেন কিছুই বেঁচে থাকে না।

সেদিন রাতে দেখা হয়নি। তবু ঐশী সেই কবিতার বইটা বিছানার পাশে রেখে ঘুমাতে যায়। জানলার ধারে চাঁদের আলো এসে পড়ে, আর একটা নামহীন প্রেমের সন্ধে ছবির মতন আঁকা হয়ে থাকে ওর বুকের ক্যানভাসে।

পর্ব ৮: দরজার ওপাশে অন্য কেউ

ঐশীর দিনগুলো এখন বিভাজিত। একদিকে সংসার—যেখানে তার পরিচয় শুধুই এক স্ত্রী, এক মা। অন্যদিকে অরিত্র—যেখানে সে শুধুই ঐশী, এক নারী, যাকে চাওয়া হয়, ছোঁয়া হয়, ভালোবাসা হয়, আর যে প্রতিদিন একটু করে ভেঙে পড়ে, আবার নিজের মধ্যে নতুন করে গড়ে ওঠে।

সেদিন বিকেলে ওরা দেখা করল একটা হোটেল রুমে। সল্টলেকে, একটা শান্ত জায়গা।
রুমের ভিতর ঢুকতেই অরিত্র ওকে টেনে নিল নিজের দিকে।

“তুই জানিস না ঐশী, আমি তোকে ছাড়া এখন কিছু ভাবতেই পারি না। এই চুলের গন্ধ, এই শরীরের উষ্ণতা, তোর গলার হালকা কাঁপুনি—সবকিছু আমার মতো করে হয়ে গেছে।”

ঐশী হাসল।
“তুমি জানো না অরিত্র, আমিও তোমায় ছাড়া বাঁচতে পারি না, কিন্তু বাঁচতে হয়… কারণ আমি যখন এই দরজাটা খুলে বাইরে যাই, তখন আমি আর ঐশী থাকি না।”

“তাহলে কেন থাকিস ঐ দরজার ওপাশে?”

ঐশী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “কারণ ওখানে আমার ছেলে আছে… যার চোখে আমি এক আশ্রয়… আর স্বামী, যার চোখে আমি একটা প্রাচীন অভ্যাস। ভাঙতে পারি না। হয়তো সাহস নেই। হয়তো কারণ তুই আমার জীবনের আনন্দ, কিন্তু দায় না।”

অরিত্রের চোখে তীব্র অভিমান।

“তুই জানিস না, কত রাতে ঘুম ভাঙে আমার। তোর ঠোঁট খুঁজে পাই না পাশে। তোর শাড়ির গন্ধে আমি ঘুমোতে পারি। আর আজকাল তুই অনেক দূরে চলে যাচ্ছিস… তুই কি কাউকে লুকিয়ে ভাবছিস?”

ঐশী থমকে গেল। “তুমি কী বলতে চাও?”

“তুই কি আমার সঙ্গেও সত্যি থাকিস, ঐশী? নাকি আমিও একদিন এক দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকব… যেখানে তুই বলবি—আমাদের শেষ হয়ে গেছে?”

ঐশী রেগে গিয়ে উঠে দাঁড়াল। চোখ লাল হয়ে উঠেছে।

“তুমি কি আমাকে সন্দেহ করছো?”
“আমি ভয় পাচ্ছি,” অরিত্র ধীরে বলল। “ভয় পাচ্ছি এই সম্পর্ককে হারাতে। তুই যদি একদিন সত্যিই বলে ফেলিস—‘আর না’, আমি হয়তো কিছুই ভাঙতে পারব না, কিন্তু ভেঙে যাব আমি নিজে।”

ঐশী ধীরে ধীরে কাছে এল। ওর ঠোঁটে হাত রাখল।

“শোনো, তোমাকে ছাড়া আমি নিজেকে কল্পনাও করতে পারি না। তুমি হয়তো আমার পুরুষ হয়ে উঠোনি, কিন্তু তুমি আমার প্রেম হয়ে গেছো। আর প্রেম একবার শরীর ছুঁয়ে মন ছুঁয়ে গেলে, সেটা আর মুছে যায় না।”

অরিত্র ওকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। চোখে জল।
ওরা সেদিন আবার একে অপরের শরীরে ডুবে গেল—যেন সম্পর্কের সমস্ত প্রশ্ন ভুলে গিয়ে কেবল কামনায় জেগে উঠল সেই প্রহর।

কিন্তু ঐশী জানে—দরজার ওপাশে আছে একটা সংসার, একটা নিয়মতান্ত্রিক জগৎ… আর একদিন হয়তো সত্যিই এই দরজাটা বন্ধ হয়ে যাবে। আর তখন?

তখন কেবল থাকবে এই মুহূর্তগুলো। এই নিঃশ্বাস, এই ভালোবাসা। যা সত্যিই কোনো নাম নেয় না… কেবল শরীরের মতো প্রবল, কিন্তু আত্মার মতো চিরস্থায়ী।

পর্ব ৯: কাঁধে রাখা পুরোনো সুখ

ঐশী সেদিন সন্ধ্যাবেলায় নিজের শাড়ির পাড়ে একটু বেশি সময় দিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখল, মুখে যেন ক্লান্তির ছায়া। কিন্তু চোখে এখনও সেই আগুন, যা অরিত্র প্রথম দিন বলেছিল—”তোমার চোখ দুটো যেন কুয়াশার মধ্যে আগুন জ্বলছে।”

ওর ছেলেটা পাশের ঘরে পড়াশোনা করছে, স্বামী ফোনে কথা বলছে মালয়েশিয়ার ক্লায়েন্টের সঙ্গে। আর ঐশী জানালার ধারে দাঁড়িয়ে মনে মনে গুনছে—অরিত্র ঠিক এখন বাস থেকে নামবে, পকেটে সিগারেট আর ফোন, হয়তো কল করবে কিছুক্ষণ পরে।

হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল।

“বল তো, আজ কোন রঙের শাড়ি পরেছিস?”
ঐশী হাসল। “নীল পাড়ের সাদা। তুমি ভালোবাসো যে শাড়িটা।”

“তুই জানিস, তুই যখন শাড়িতে আসিস, তখন মনে হয় সময় থেমে গেছে। তখন শুধু তুই আছিস, আমি আছি, আর একটা পুরোনো সুখ… যা কাঁধে রাখা যায়… কিন্তু নামানো যায় না।”

ঐশী কিছু বলল না। কেবল চোখ বন্ধ করল।

“আমি আজ তোকে দেখে কিছু বলব না,” অরিত্র বলল। “আজ শুধু তোকে ছুঁব। চুপ করে ছুঁয়ে ছুঁয়ে বলব, তুই আমার।”

রাতটা ওরা কাটাল সল্টলেকের একটা ছোট গেস্ট হাউসে। পুরনো কাঠের বিছানা, জানলার পাশে বাল্বের মিঠে আলো। ঐশী শাড়ি খুলে বিছানায় বসে ছিল। অরিত্র দরজা বন্ধ করে ধীরে ধীরে ওর কাছে এল।

“তুই জানিস, আমি আজ আর প্রেমিক হতে চাই না। আমি চাই তোর সবটুকু জেনেও, সব দাগ, সব ভাঙন নিয়েই তোকে ভালোবাসতে।”

ঐশী চোখে চোখ রাখল। “তুমি জানো অরিত্র, আমার শরীরে যে দাগগুলো আছে, সেগুলো কেউ কোনোদিন জিজ্ঞেস করেনি। তুমি করো। আর আমি উত্তর দিতে চাই।”

অরিত্র ওর পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, “তোর পিঠে ওই তিলটা, তোর বুকের নিচে রেখা, তোর কোমরের পাশে হালকা টান—সবই আমার কাছে কবিতার লাইন। আমি পড়ি, আবার পড়ি… কখনও তৃপ্ত হই না।”

রাত গভীর হতে হতে, ঐশী নিজেকে পুরোপুরি অরিত্রর মধ্যে হারিয়ে ফেলল। বিছানায় দুটো দেহ মিশে গেল এক তীব্র আদরে। ওর নখ গেঁথে গেল অরিত্রর কাঁধে, ওর ঠোঁট কাঁপল, ওর বুক থেকে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাসের মতো দীর্ঘ প্রেম।

পরে, ওরা পাশাপাশি শুয়ে রইল। বাইরে চাঁদের আলো পড়ছে পর্দার ফাঁক গলে।

ঐশী বলল, “তুমি যদি না থাকো একদিন, আমি এই পুরোনো সুখ কাঁধে নিয়ে বাঁচতে পারব না।”

অরিত্র কাঁধে মাথা রেখে বলল, “তুই থাকলে আমি আর কিছুর দরকার মনে করি না। তুই না থাকলে, আমি থাকি না।”

ঐ মুহূর্তে, সত্যি বলতে, কিছুই আর অপরাধ লাগল না ঐশীর কাছে। পরকীয়া, বয়সের ব্যবধান, সমাজের চোখ—সব যেন মুছে গেল অরিত্রর নিঃশ্বাসে।

কারণ ভালোবাসা যদি দাগ নিয়েও স্বচ্ছ হয়, তবে সেটাই সবচেয়ে সত্যি প্রেম।

পর্ব ১০: সেই সকাল, যখন কিছু বদলায় না

সেদিন সকালটা যেন সব সকাল থেকে আলাদা। জানলার কাচে শিশির, আকাশ একেবারে ফিকে নীল। ঐশী ঘুম ভেঙেই টের পেল, আজ তার ভিতরে একটা অদ্ভুত শান্তি। এমন শান্তি, যা আসে কোনো দীর্ঘ লড়াইয়ের পরে।

অরিত্র পাশে নেই। রাতটা ছিল না ওর সঙ্গে। ঐশী জানে, আজকের সকালটা তাকে একা কাটাতে হবে।

ও বাথরুমের আয়নায় নিজের মুখ দেখে। চুল এলোমেলো, চোখে গভীর ক্লান্তি, কিন্তু ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি। এই মেয়েটাকে এখন আর সে অপরাধবোধে ভরিয়ে রাখে না।

ফোন হাতে নেয়।
একটা মেসেজ আসে—
“আজ সকালে আমার গল্পে তুই নেই। কিন্তু তোকে ছাড়া আমি লিখতেই পারছি না।”

ঐশীর বুকটা যেন হালকা হয়ে আসে। জানে, ওদের মধ্যে এখন একটা অব্যক্ত চুক্তি—যেখানে কাগজে লেখা হবে না কোনো নাম, থাকবে না কোনো স্বীকৃতি, তবুও তাদের সম্পর্ক নিজের মতো করে বেঁচে থাকবে।

সে নিচে নেমে এল। রান্নাঘরে ছেলে বসে আছে, চোখে ঘুম, হাতে নোটবই। স্বামী তার পাশে চা খাচ্ছে, চোখে খবরের কাগজ। এই সংসার এখনো দাঁড়িয়ে আছে নিজের ছাঁচে।

ঐশী চুপচাপ চা বানাতে বানাতে ভাবল—“আমার জীবনের সবচেয়ে সত্যি অংশটা আসলে কারো জানার কথা নয়। সেটাকে আমি বুকে রাখব, গোপনে। খুব যত্নে। যেমন গোপনে রাখা হয় ভালোবাসার সেইসব ক্ষণ, যেগুলো কখনও ছবিও হয় না, স্মৃতির অ্যালবামেও থাকে না।”

সেদিন দুপুরে, ঐশী পুরোনো সেই ব্লাউজটা বের করল—লাল সুতোর, যেটা অরিত্র ভালোবাসে। সে জানে না, আবার কবে দেখা হবে। অথবা আদৌ হবে কি না।

কিন্তু জানে, যদি কোনোদিন দেখা না-ও হয়, তবুও এই সম্পর্ক কোনোদিন মুছে যাবে না। কারণ, অরিত্র ওকে নতুন করে ছুঁয়েছিল। শরীরের ভাঁজে নয়—মন আর চোখের গভীরে। এমনভাবে, যা আর কোনো পুরুষ করেনি।

রাতের দিকে, নিজের ডায়েরি খুলে ঐশী লেখে—

“তুমি আমার পরকীয়া নও।
তুমি আমার অপরাধ নও।
তুমি সেই ‘অন্য কোনো সকাল’—
যেখানে আমি প্রথমবার বাঁচতে শিখেছিলাম।”

শেষ

1000018562.jpg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *