Bangla - প্রেমের গল্প

অন্য আলোয় তুমি

Spread the love

মিতালী চট্টোরাজ


নীল জানালার পাশে

শীতের সকালটা ঠিক যেন অলস হয়ে উঠেছিল। কলকাতার দক্ষিণ শহরতলিতে এমন গা-ছুঁয়ে যাওয়া শীত খুব বেশি পড়ে না, তবু জানালার ধারে বসে ঐন্দ্রিলা নিজের শাড়ির আঁচলটাকে একটু ভালোভাবে গায়ে জড়াল। জানালার বাইরে একটা কৃষ্ণচূড়ার গায়ে রোদ পড়েছে, লালচে পাতাগুলো ঝলমল করছে। চুপচাপ বসে থাকা ঐন্দ্রিলার মনে হচ্ছিল, অনেকদিন এমনভাবে নিজেকে ছুঁয়ে দেখেনি সে।

চারপাশে স্বাভাবিক জীবনের নিস্তরঙ্গতা। স্বামী সুজয় সকালেই বেরিয়ে গেছেন, বরাবরের মতোই। তাঁর সঙ্গে কথোপকথন এখন প্রায় শুধুই প্রয়োজনীয়তায় সীমাবদ্ধ। ছেলে তমাল ব্যাঙ্গালোরে—আইটি কোম্পানির চাকরিতে ব্যস্ত। ঐন্দ্রিলা এখন আর কারো ‘মা’, ‘স্ত্রী’, ‘ম্যাডাম’ হয়ে বাঁচতে চায় না। নিজের নামটা আবার নিজের মতো করে উচ্চারণ করতে ইচ্ছে করে তার—ঐ-ন্-দ্রি-লা।

একটা সময় সে কবিতা লিখত। পত্রিকায় বেরোত। এখন ক্লাস নোট আর অফিস ফাইলের মধ্যে তার শব্দরা হাঁপিয়ে ওঠে। ঠিক এমন এক সকালে, তার মোবাইলে একটা ইনবাউন্ড মেসেজ আসে। নামটা প্রথমে চিনতে পারেনি — রুদ্রনীল সরকার।

“আপনার সেই ‘সূর্যস্নান’ কবিতাটা এখনও মনে আছে, ম্যাম। আপনার মতো কেউ লিখতে পারে?”

চমকে ওঠে ঐন্দ্রিলা। এই নামটা খুবই পরিচিত — বছর দশেক আগে কলেজে পড়ত। ইংরেজি অনার্সের ছেলেদের মধ্যে একটু আলাদা ধাঁচের ছিল। চোখে চশমা, গলায় গোঁফের রেখা, কিন্তু আচরণে স্পষ্ট একটা কৌতূহলী আত্মবিশ্বাস। তার কবিতার প্রেমে পড়েছিল হয়তো, নাকি তার ভিতরের অনাহূত বিষাদে?

তবে সে এখন একটা গার্মেন্ট ফার্ম চালায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের পেজ আছে—রুদ্র নিজের ব্র্যান্ড নিয়ে এখন পরিচিত নাম। মেসেজে সেই পুরনো ছাত্র, এত বছর পর কেন এমন করে হাজির হয়?

ঐন্দ্রিলা লিখল,

“তুমি তো খুব বড় হয়ে গেছো। কী মনে করে এই কবিতা?”

রুদ্র উত্তরে পাঠাল একটা স্ক্রিনশট—কলেজ ম্যাগাজিনের সেই পুরনো পৃষ্ঠাটা। তার পাশে একটা নোট লেখা—

“এই লাইনটা, ম্যাম—
‘আমি যে রোদের চিঠি লিখি, তা কেবল ছায়ার ঘরে পৌঁছায়’—আজও আমার ভিতরে বাজে।”

ঐন্দ্রিলা জানালার ধারে বসে, নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দেখল। সে বুঝতে পারল না—এই কথাগুলোর মধ্যে বেশি কাঁপুনি কোথায়? পুরনো কবিতায়, নাকি নতুন করে জেগে ওঠা অভিমান-ভরা ভালোবাসায়?

একটা সপ্তাহ যায়। রুদ্র মেসেজ করতে থাকে। মাঝে মাঝে ছবি পাঠায়—নতুন ফ্যাশন ডিজাইন, অফিসের ইন্টেরিয়র, কিংবা কোনো ক্যাফে থেকে তার সেলফি। একদিন হঠাৎ সে লিখে—

“ম্যাম, আপনি কি চা খান? একদিন আমার ক্যাফেতে আসবেন? আপনার কবিতার নামে একটা ড্রিঙ্ক বানিয়েছি।”

ঐন্দ্রিলা হেসে ফেলে। এই ছেলেটা এখনও সেই পুরনো রুদ্র। কিন্তু সে জানে না, সময় মানুষকে কতটা পাল্টে দেয়।

তবু ঐন্দ্রিলা ভাবে—সে কি একদিন যেতে পারে?
সে কি নিজের মতো করে, শুধুমাত্র “ঐন্দ্রিলা” হয়ে, এক কাপ চায়ের পাশে বসতে পারে?

সন্ধ্যেয়, সে আয়নায় নিজেকে দেখে। বয়স তার চোখে ছাপ ফেলেছে ঠিকই, কিন্তু একটা নিজস্ব দীপ্তি আছে। সে শিফনের শাড়িটা পরে। একটা হালকা লিপস্টিক, একজোড়া ঝুমকা, আর স্লিভলেস ব্লাউজ। গলায় ছোট্ট চেন।

সে চুপচাপ মোবাইলে টাইপ করে—

“আগামী বৃহস্পতিবার? বিকেল পাঁচটা?”

রুদ্র ফিরিয়ে দেয়:

“আমি অপেক্ষা করব। আজও যেমন করতাম, ম্যাম।”

ঐন্দ্রিলা জানে—এই শুরুটা হয়তো সহজ নয়।

কিন্তু মাঝে মাঝে, জীবন নিজেই একটা জানালা খুলে দেয়।
ঠিক যেমন আজ খুলে গেছে তার নীল জানালাটা।

রুদ্রের ক্যাফে ও চায়ের গল্প

বৃহস্পতিবার, বিকেল প্রায় পাঁচটা।

ঐন্দ্রিলা দক্ষিণ কলকাতার এক ছোট্ট রাস্তায় নামল। অটোর ভেতরেও কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছিল—নিশ্চয়ই উত্তেজনা নয়, বরং এক অজানা দ্বিধা। এত বছর পর, একজন পুরনো ছাত্রের সামনে নিজেকে নারীর মতো করে ভাবার অনুমতি সে নিজেকে দেবে কি না, সেই নিয়ে যেন নিজের ভেতরেই এক দ্বন্দ্ব।

কিন্তু এখন দাঁড়িয়ে আছে ‘ক্লে কাপে’ ক্যাফের সামনে। আধুনিক, কিন্তু সাদামাটা ডিজাইন। কাঁচের দরজার ওপারে ভেতরে বসে থাকা মানুষগুলোর মুখে সন্ধ্যার আলো লেগেছে। ঐন্দ্রিলার মনে হল—সে একদম বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, জীবনের বাইরের প্রান্তে, এই প্রথম ভেতরে ঢুকতে চায়।

ভেতরে ঢুকতেই হালকা ঘ্রাণ—দার্জিলিং চায়ের মতো, তাতে একটা নারকেলের গন্ধ। দেয়ালে কবিতার লাইন—অপরিচিত সব লেখকদের নাম, কিন্তু চমৎকার শব্দচয়ন। চোখ ঘোরাতেই তাকে দেখে উঠে দাঁড়ায় রুদ্র। গাঢ় নীল শার্ট, কালো প্যান্ট, চোখে সেই চেনা চশমা। কিন্তু তার চোখে এখন একটা ভিন্ন আলো—সম্মান আর আকর্ষণের মাঝামাঝি কোথাও।

“আপনি এলেন ম্যাম! আমি ভাবিনি সত্যিই আসবেন।”

ঐন্দ্রিলা হেসে ফেলল, “আমি ভাবিনি আসব না।”

তারা একটা জানালার ধারে বসে। রুদ্র নিজে হাতে তৈরি করেছে এক বিশেষ ব্লেন্ড—নারকেল আর তুলসির পাতার চা। কাপটা ঠোঁটে তুলতেই ঐন্দ্রিলা থমকে যায়।

“এর নাম কী?”

রুদ্র মাথা নিচু করে বলে, “সূর্যস্নান।”

ঐন্দ্রিলা তাকিয়ে থাকে কাপটার ধোঁয়ার দিকে। এই তরুণ, এখন সফল, তার জীবনের সবচেয়ে নিঃশব্দ অথচ সাহসী প্রেমিক হয়ে উঠছে কি?

তারা কথা বলে। কলেজের দিন, কবিতা, ক্লাসের পর গল্প—রুদ্র কীভাবে ব্যবসা শুরু করল, কীভাবে পুঁজি জোগাড় করল, এমনকি কেন সে এখনো ‘ঐন্দ্রিলা ম্যাম’-এর কবিতা পড়ে।

“জানেন?” রুদ্র বলে, “আপনি পড়াতেন কবিতা, কিন্তু আপনি নিজেই একটা কবিতা। যা আমি কখনো ব্যাখ্যা করতে পারিনি।”

ঐন্দ্রিলার গলা শুকিয়ে আসে। শরীরের মধ্যে একটা নরম কাঁপুনি, কিন্তু সে নিজেকে সংযত রাখে। অনেক বছর পরে, কেউ তাকে এমনভাবে দেখছে—একজন নারী হিসেবে, একজন আত্মা হিসেবে—not just a role.

একসময় চায়ের কাপ ফাঁকা হয়ে যায়। রুদ্র বলে, “চলুন, আমার স্টুডিওটা ঘুরে দেখাই আপনাকে।”

ঐন্দ্রিলা একটু দ্বিধায় পড়ে। কিন্তু চোখে চোখ পড়তেই সে মাথা নাড়ে।

ছোট্ট একটা ঘর—মার্কেটিং ডেস্ক, কাপড়ের রোল, কাটিং টেবিল। দেয়ালে রঙিন কাপড়ের স্কেচ। হঠাৎ রুদ্র একটা ফ্রেম টেনে দেখায়—একটা স্কার্ফ, যার ওপর সূচিকর্ম করা—

“রোদের চিঠি ছায়ার ঘরে পৌঁছায় না।”

ঐন্দ্রিলা থেমে যায়। গলার কাছটায় একটা আবেগ দলা পাকায়।

“তুমি এখনও এটা মনে রেখেছো?”

রুদ্র ফিসফিস করে, “আমি আপনাকে ভুলিনি কখনো।”

ঐন্দ্রিলা পেছন ফিরে দাঁড়ায় জানালার সামনে। বাইরের রোদ তখনও হালকা ঝিকমিক করছে। সে জানে, তার জীবনে এখনো সময় আছে আলোতে দাঁড়ানোর। সে জানে, সে ভালোবাসতে চায়—নিজেকে, রুদ্রকে, এই সময়টাকে।

সে ধীরে ধীরে ফিরে তাকায়।

রুদ্র এক ধাপ এগিয়ে আসে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, কিন্তু ছুঁয়েও দেখছে না।

ঐন্দ্রিলা বলে, “এই পথটা খুব বিপজ্জনক, রুদ্র। আমি একজন বিবাহিতা নারী।”

রুদ্র চোখ নামায় না, “আমি কাউকে ভাঙতে আসিনি। আমি শুধু চাই আপনি বুঝুন, আপনিও মানুষ। আপনি শুধু স্ত্রী বা মা নন। আপনি নারী। আপনিও ভালোবাসা পেতে পারেন।”

ঐন্দ্রিলা জানে, এই ভালোবাসা সহজ হবে না। কিন্তু এতদিন পরে এই একটুকু স্পর্শহীন মুহূর্ত, এই চায়ের ধোঁয়া আর কবিতার লাইন, তাকে নতুন করে ভাবতে শেখাচ্ছে।

সে চুপচাপ বলে, “আরেক কাপ চা হবে?”

রুদ্র হেসে ফেলে, “এইবার আপনাকে একদম নিজের হাতে বানিয়ে খাওয়াবো।”

ভালোবাসা যদি ছুঁয়েই যায়…

সেই সন্ধের পরদিন সকালটা অন্যরকম আলোয় ভরে উঠেছিল। ঐন্দ্রিলার মনে হচ্ছিল যেন একটা দীর্ঘদিনের ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে সে। জীবনের খাতায় বহুদিন ধরে জমে থাকা নীরবতা যেন কিছুটা ঝরে গেছে। যদিও সে জানে, বাস্তব ঠিক ততটা কোমল নয়। এই শহরে, এই সংসারে, “অন্যরকম” কিছু ভাবা মানেই বহু বাঁধা অতিক্রম করা।

রুদ্রের সঙ্গে সেই সন্ধ্যেটা — যেখানে কেউ ছুঁয়েও দেখেনি, অথচ তার স্পর্শ সারা শরীরে যেন এখনো রয়ে গেছে — ঐন্দ্রিলার অস্তিত্বে তার ছায়া রেখে গেছে।

তবে এইসব অনুভবের মাঝে একটা অব্যক্ত ভয় তার ভিতরে কাজ করছিল। সমাজের চোখ, স্বামীর চোখ, এমনকি তার নিজের চোখ — কতগুলো অলিখিত নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য করেছে এতদিন।

সেই সন্ধ্যার দুদিন পরেই কলেজে একটা গেস্ট লেকচার ছিল। ঐন্দ্রিলা রোজকার মতো শাড়ি পরে ক্লাসে ঢুকল, কিন্তু সহকর্মী ঝরনার চোখে আজ একটা কৌতূহল ছিল।

“কী ব্যাপার, আজ তো একটু বেশিই ফ্রেশ লাগছে তোমায়।”

ঐন্দ্রিলা হেসে এড়িয়ে গেল। নিজের মধ্যে যে আলো ছড়িয়ে পড়েছে, সেটাকে বাইরে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করল সে। কিন্তু তার চোখের ভাষা, ঠোঁটের কোণ, এবং গলার স্বর—সবই যেন একটা অদৃশ্য ভালোবাসার ছায়া বহন করছিল।

সেদিন সন্ধ্যায় হোয়াটসঅ্যাপে রুদ্রের মেসেজ এল—

“আপনি যদি কিছু না বলেন, তাহলে আজ রাতে একটা কবিতা পাঠাবো। আপনাকে ভাবতে ভাবতেই লিখেছি।”

ঐন্দ্রিলার ঠোঁটে নরম হাসি। সে লিখল:

“শুধু পাঠাবে? আবৃত্তি করবে না?”

সেই রাত দশটা নাগাদ, ফোনে একটা অডিও ক্লিপ এল।

রুদ্রর কণ্ঠে এক অজানা কবিতা—

“তোমার চোখের ভাষা আমি শিখিনি,
শুধু জানি, চুপচাপ বসে থাকলেই
জেগে ওঠে আমার ভেতরের রোদটা।
তুমি আঙুল ছুঁয়ে দাও না,
তবুও আমার কাঁধে শীত নামে।”

ঐন্দ্রিলার বুক ভার হয়ে এল। এমন করে তো কেউ কখনও তাকে অনুভব করেনি।

সে জানে, এই অনুভূতি চিরস্থায়ী হতে পারে না। এ শহরের অগণিত ঘরে এমন অনেক অনুচ্চারিত সম্পর্ক দিনের পর দিন দগ্ধ হয়ে মিশে যায় ধোঁয়ার মতো।

কিন্তু এক্ষণকার এই মুহূর্ত তার একান্ত। এই আবেগ, এই কবিতা, এই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা—সবকিছুই যেন ঐন্দ্রিলার জীবনের সবচেয়ে জীবন্ত সময়।

দুই দিন পরেই রবিবার।

সুজয় যখন ঘুমোচ্ছেন, ঐন্দ্রিলা ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। সকালবেলার রোদ গায়ে মেখে সে হোয়াটসঅ্যাপে লিখে ফেলে—

“তুই আমায় ‘ম্যাম’ বলিস না রুদ্র। অন্য কিছু ডাক খুঁজে বের কর।”

রুদ্রের রিপ্লাই আসে সঙ্গে সঙ্গে—

“ঐন্দ্রিলা। এই নামটা যখন বলি, মনে হয় এক গোটা কবিতা উচ্চারণ করলাম।”

ঐন্দ্রিলা জানে, সে ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ছে। তার শরীর, মন, অনুভব—সব মিলে এক অজানা সম্পর্কে ঢুকে পড়ছে।

একটা সম্পর্ক যেখানে যৌনতা আছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি আছে স্পর্শহীন ভালোবাসা।
একটা সম্পর্ক যা শরীরের উষ্ণতা ছাড়াও হৃদয়ের গভীরে উত্তাপ জাগায়।

সন্ধেবেলায়, রুদ্র হঠাৎ ফোন করে।

“শুনুন, একটা এক্সিবিশনে আমন্ত্রণ পেয়েছি। আমার ডিজাইনগুলো শো-অফ হবে। আপনি যদি সঙ্গে আসেন, আমার পাশে থাকেন… তাহলে মনে হবে সবকিছু সার্থক।”

ঐন্দ্রিলা চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে—

“তোর পাশে থাকলে আমারও বেঁচে থাকা সার্থক বলে মনে হয় রুদ্র।”

শহরের আলো, করিডোরের অন্ধকার

কলকাতা শহর তখন এক রকম সন্ধ্যাবেলার রঙে ডুবে আছে। চারপাশে ল্যাম্পপোস্টের আলো, ক্যাফের চুপি চুপি বাজা স্যাক্সোফোনের সুর, আর মানুষজনের হাঁটার ছন্দময় শব্দে শহরটা যেন একটা নিজস্ব কবিতা লিখে চলেছে।

রুদ্রের এক্সিবিশনটা ছিল গল্ফ গ্রীন অঞ্চলের এক আধুনিক আর্ট গ্যালারিতে। ঐন্দ্রিলা যখন গাড়ি থেকে নামল, তখন তার শরীরজুড়ে সোনালী রঙের চিফন শাড়ি, হালকা কাজ করা ব্লাউজ, একদম স্লিভলেস। কোনো চড়া সাজ নয়, তবু তার চোখের কাজল আর ঠোঁটের ন্যুড শেডের মধ্যে এমন কিছু ছিল, যা তাকে ভীষণ স্পষ্ট করে তুলছিল — একজন আত্মবিশ্বাসী নারী, নিজের শরীর, মন, পরিচয়ের প্রতি সম্পূর্ণ সচেতন।

রুদ্র গেটেই দাঁড়িয়ে ছিল, অদ্ভুত এক অভিমোহে তাকিয়ে ছিল ঐন্দ্রিলার দিকে। আজ যেন তার চোখে সেই ছাত্রসুলভ মুগ্ধতা নেই, আছে একজন পুরুষের সজাগ প্রত্যাশা।

“তুমি দারুণ লাগছ আজ,” রুদ্র বলল, গলার স্বরটা একটু বেশি নিচু।

ঐন্দ্রিলা হেসে বলল, “তুইও কম যাচ্ছিস না। এই শার্টটা নতুন তো?”

“হ্যাঁ। তোমার জন্যই কিনেছি,” রুদ্রের উত্তরটা সরল, অকপট।

তারা গ্যালারির ভেতরে ঢুকে পড়ে। আলো-আঁধারির খেলা, গ্যালারির সাদা দেয়ালে ঝোলানো স্কেচ আর ফ্যাব্রিক আর্ট, যেখানে কবিতার লাইন সেলাই হয়ে বসে আছে একেকটা ওড়নায়, ব্লাউজ-পিসে। ঐন্দ্রিলা হাঁটতে হাঁটতে থেমে যায় একটায়—

“তোমার চোখে যদি থেমে যেতে পারতাম,
হয়তো অন্য জীবন লিখে ফেলতাম।”

ঐন্দ্রিলা নিঃশব্দে বলল, “তুই এগুলো আমার জন্যই বানাস?”

রুদ্র খুব আস্তে বলল, “তোমার ভাবনায় বানাই, তোমার গন্ধে রঙ দিই।”

চারপাশে লোকজন ছিল, কিন্তু ঐন্দ্রিলা টের পেল, তারা দুজন যেন আলাদা একটা চোরাগলি ধরে হাঁটছে—যেখানে আলো আছে, কিন্তু কোনো সঠিক দিশা নেই।

গ্যালারির পেছনে একটা লম্বা করিডোর, যেখানে কিছু মুহূর্তের নির্জনতা পাওয়া যায়। রুদ্র ওখানে ঐন্দ্রিলাকে নিয়ে এল। হঠাৎই কিছু একটা বদলে গেল।

রুদ্র একটু ঝুঁকে এল, চোখের দিকে তাকিয়ে ধীরে বলল—

“তোমাকে ছুঁতে ইচ্ছে করে, অথচ ভয়ও পাই… যদি হারিয়ে ফেলি…”

ঐন্দ্রিলা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। একটাও শব্দ করে না, কিন্তু তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে।

রুদ্র খুব আস্তে, কাঁপা হাতে ঐন্দ্রিলার চুলের পাশে একটুখানি ছোঁয়া দেয়। তেমন কিছু নয়, তবু ঐন্দ্রিলার পিঠ বেয়ে একটা কাঁপুনি নেমে যায়।

তারা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। কেউ কিছু বলছে না। শুধু চোখে চোখে কথা।

ঐন্দ্রিলা এবার একটু ফিসফিস করে বলে, “এই সম্পর্কটা অন্যরকম, রুদ্র। তুই আমাকে নতুন করে চিনতে পারিস, কিন্তু তুই কি আমাকে পুরোটা গ্রহণ করতে পারবি? আমার অতীত, আমার সংসার, আমার বিভ্রান্তি?”

রুদ্র থেমে থাকে। তারপর বলে, “আমি তোমার সবকিছু চাই। তোমার অসম্পূর্ণতাও। ভুল করেও যদি পা পিছলে যায়, আমি চাই সেটা আমার সামনে ঘটুক।”

ঐন্দ্রিলার চোখ ভিজে যায়। সে জানে, এই রুদ্র সেই ক্লাস টুয়েলভ-এর মুগ্ধ ছাত্র নয়, বরং একজন পুরুষ, যে তাকে ছুঁতে চায়, বোঝাতে চায়, আঁকড়ে ধরতে চায়।

হঠাৎ করিডোরের দূরে কারও পায়ের শব্দ। দুজনেই চট করে সরে যায়। বাস্তব ফিরে আসে ছায়ার মতো।

ফিরতি পথে ঐন্দ্রিলা গাড়িতে বসে। বাইরের আলো সরে যাচ্ছে দ্রুত। তার মাথার ভিতর এখনো বাজছে রুদ্রের কথা—“আমি চাই তোমার অসম্পূর্ণতাও।”

বাড়ি ফিরে সে দরজা খুলে দেখে, সুজয় টিভির সামনে বসে। একহাতে রিমোট, অন্য হাতে ওয়াইন গ্লাস।

“এই তো, ফিরে এলি? সুন্দর লাগছে আজ তো। কোথায় গিয়েছিলি?”

ঐন্দ্রিলা পেছনে দরজা বন্ধ করে বলে, “একটা প্রদর্শনী ছিল। কবিতার, শিল্পের… হয়তো আমার কিছুটা দরকার ছিল এই শহরের বাইরে ভাবার।”

সুজয় ভ্রু কুঁচকে তাকায়, কিন্তু কিছু বলে না।

ঐন্দ্রিলা পায়ের চপ্পল খুলে সোজা ঘরে ঢুকে পড়ে। আয়নার সামনে দাঁড়ায়।

আজ সে শুধু সৌন্দর্যে নয়, এক অদ্ভুত শক্তিতে ভরে গেছে।

তার চেহারার ছায়া গ্লাসে পড়ছে। তার চুল, তার ঠোঁট, তার চোখ—সব কিছু যেন বলছে—

“এই আমি, অন্য আলোয়। আমার আলোয়।”

গোপন রাত, উষ্ণ বারান্দা

রাত ন’টা পেরিয়ে গেছে। বাইরের রাস্তায় গাড়ির আওয়াজ ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে। জানালার ফাঁক গলে রাত্রির ঠান্ডা হাওয়া এসে পড়ছে ঘরের ভেতর, কিন্তু ঐন্দ্রিলার মনে আজ যেন উষ্ণ এক স্রোত বইছে।

সে আজ একটু বেশিই সচেতন নিজের শরীর নিয়ে। শাড়ি খুলে একটা সাদা স্যাটিন নাইটিতে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজের চোখে তাকায়—এমন করে অনেকদিন দেখেনি নিজেকে। বয়স কুড়ি না হলেও, যৌবনের ছায়া আজও স্পষ্ট। বরং অভিজ্ঞতার পরিপক্বতা তাকে আরও লাবণ্যময় করে তুলেছে।

সে হোয়াটসঅ্যাপ খুলে রুদ্রকে মেসেজ করে:

“আজ বারান্দায় বসে আছি। শরতের রাত, একা। গায়ে শুধু সাদা রাতের ছোঁয়া। তুই থাকলে কেমন হতো বলতো?”

রুদ্র উত্তর দিতে দেরি করে না—

“আমি এখন তোর গলার কাছটায় নিঃশ্বাস ফেলতে চাই। তোর পাশে বসে হাত রাখি তোর উরুর গা ঘেঁষে। চুপচাপ।”

ঐন্দ্রিলার বুকের ভিতরটা যেন কেঁপে ওঠে। এই টান, এই টানাটানি, যে স্পর্শ হয় না অথচ অনুভবে পোড়ে—তাই কি তবে প্রেম?

সে লিখে ফেলে—

“তুই আসবি এখন? যদি সত্যিই চাস, আমি দরজা খুলে রাখব।”

একটু সময় নেয় রুদ্র। তারপর তিনটে শব্দ:

“Coming. Wait awake.”

ঐন্দ্রিলা জানে, সে কোনো কিশোরীর মতো উন্মাদ আচরণ করছে। কিন্তু সে এটাও জানে, যে ছেলেটি তার মনের ভেতরকে এমনভাবে বুঝেছে, সে শরীরকেও অবহেলায় রাখবে না।

সে ঘরের আলো নিভিয়ে বারান্দার একটা কোণে গায়ে শাল জড়িয়ে বসে। তলায় নরম মাদুর, পাশে ল্যাম্পের মৃদু আলো আর এক কাপ দার্জিলিং চা। সে জানে, আজ রাতটা হয়তো পাল্টে দেবে অনেক কিছু।

প্রায় কুড়ি মিনিট পর, বেল বাজে। ঐন্দ্রিলা নিঃশব্দে দরজা খুলে দেয়।

রুদ্র যেন নিঃশব্দেই ঘরে ঢুকে পড়ে। তার মুখে কোনো কথা নেই, চোখে শুধু একরাশ জিজ্ঞাসা। যেন সে বলতে চাইছে—”তুমি কি সত্যিই আমায় এমন করে চাইলে?”

ঐন্দ্রিলা একটা ইশারায় তাকে বারান্দায় নিয়ে আসে। দুজনে পাশাপাশি বসে।

রুদ্র তার দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি জানো তো, আমি আজ এখানে আসার সাহস করলাম, কারণ আমি তোমায় কেবল কবিতা নয়, বাস্তবতাও দিতে চাই।”

ঐন্দ্রিলা চোখ নামিয়ে বলে, “তুই আমাকে বুঝিস, তুই আমায় দেখিস। আর সেই চোখের ভেতরেই আমি নিজেকে খুঁজে পাই। কিন্তু আমি এখনো একা নই, জানিস তো?”

রুদ্র আস্তে তার হাত ধরে। “আমি চাই না তুমি কাউকে ছেড়ে আমার কাছে আসো। আমি চাই তুমি আমার হয়ে ওঠো, সেইভাবে যেভাবে কেউ কারও হয়ে ওঠে—অন্তরে, গোপনে, অথচ গভীরে।”

ঐন্দ্রিলা প্রথমবার রুদ্রর কাঁধে মাথা রাখে। সে অনুভব করে, তার শ্বাস যেন ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে রুদ্রের গায়ের গন্ধে।

রুদ্র আস্তে বলল, “তোমার ঘাড়ের কাছে একফোঁটা জল পড়ে আছে।”

ঐন্দ্রিলা একটু চমকে তাকায়। “বর্ষার নয়, হয়তো অপরাধবোধের জল। তুই মুছতে পারবি?”

রুদ্র তার আঙুল দিয়ে ধীরে ধীরে সেই অলক্ষ্য বিন্দু মুছে দেয়।

রাত তখন এগারোটার ঘরছাড়া এক নিঃশব্দ রাজত্ব।

রুদ্র উঠে দাঁড়ায়। “আমি যাই। আজকের রাতটা থাক। আগামীকাল যদি মনে হয়, আমি আবার আসব।”

ঐন্দ্রিলা দরজার ফ্রেমে দাঁড়িয়ে তার চলে যাওয়া দেখে। চোখে জল নেই, কেবল ঠোঁটের কোণে সেই চিরপরিচিত অপূর্ণতার হাসি।

ফোনটা টিপে সে রুদ্রকে একটা লাইন পাঠায়—

“তুই আমার কাছে শরীর চাইতে আসিস না, তুই আমার শরীরের সমস্ত নিঃসঙ্গতা বোঝার জন্য আসিস। তোর আসা একটা আত্মার ঋতু।”

রাতটা শেষ হয় না। কিংবা হয়তো এখান থেকেই একটা নতুন রাতের জন্ম হয়।

অথচ কেউ জানে না…

শহরটা ব্যস্ত। মানুষ ছুটছে, বাস ছুটছে, ট্র্যাফিক সিগনালের নিচে অগণন মুখ এক মুহূর্তের জন্য থেমে যাচ্ছে, আবার ছুটে যাচ্ছে অজানা কোনো গন্তব্যে। এই সব কিছুর মাঝখানে, ঐন্দ্রিলা তার অফিস ডেস্কে বসে। কাঁচের জানালা দিয়ে সে দেখছে বাইরের পৃথিবী, আর ভিতরে চলছে এক গোপন রোমাঞ্চের নীরব জলপ্রবাহ।

গত রাতের রেশ এখনো তার গায়ে লেগে। রুদ্রর চোখ, তার নিঃশ্বাস, আর সবচেয়ে বেশি—তার না বলা কথাগুলো, ঐন্দ্রিলার শরীরের ভেতরে যেন স্পন্দনের মতো কাজ করছে। এমন এক অনুভূতি, যা শুধুই তার, যেটা কাউকে বলা যায় না, অথচ বুকের মধ্যে নিঃশ্বাস ফেলার মতো সত্য।

তবু, এই শহরে কেউ জানে না—এই অফিসের শাড়িপরা, কড়াভাবে মিটিংয়ে অংশ নেওয়া নারীটির চোখের ভেতরে লুকিয়ে রয়েছে এক গভীর জোয়ার। কেউ জানে না, তার ফোনের গ্যালারিতে একটা নির্জন বারান্দার ছবি আছে, যেখানে রাতে একজন পুরুষ আস্তে করে ছুঁয়েছিল তার আঙুল। কেউ জানে না, ঐন্দ্রিলার প্রতিটা দিন আর প্রতিটা রাত এখন দুটো ভিন্ন আলাদা সত্তায় বিভক্ত।

একটা কল আসে—“দিদি, আজ বিকেলে একটা প্রেস মিট আছে, আপনি থাকবেন তো?”

“হ্যাঁ,” ঐন্দ্রিলা সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয়, কিন্তু মনটা সরে আছে অন্যখানে।

তার ফোনে তখনো ভেসে রয়েছে রুদ্রর ভোরবেলার মেসেজ—

“তোমার চুলে একটা ঘুমের গন্ধ ছিল। তুমিই কি আমার শয্যাপথের শেষ প্রহর?”

ঐন্দ্রিলা উত্তর দেয়নি তখন, শুধু ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে থেকেছে। আজ দুপুরেও সেভাবেই সে তাকিয়ে থাকল, জানালার বাইরে, কিংবা নিজের ভিতরে।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। প্রেস মিট শেষ করে ঐন্দ্রিলা যখন গাড়িতে ফিরছে, হঠাৎ সুজয়ের ফোন আসে।

“আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরবি? তোর সঙ্গে বসে একটু কথা বলতে চাই।”

ঐন্দ্রিলা একটু থমকে যায়। এই “বসে কথা বলা”র মধ্যে কোথায় যেন একটা অদ্ভুত টানাপড়েন থাকে। দীর্ঘদিনের সংসার অনেক কিছু মুছে দেয়—কিন্তু কিছু কিছু প্রশ্ন থেকে যায়।

“হ্যাঁ, ফিরব,” সে শুধু এটুকুই বলে ফোন কেটে দেয়।

তার বুকের ভিতরে তখন দুটো কণ্ঠ কথা বলছে।

একটা কণ্ঠ বলছে—তুই ভুল করছিস, তুই প্রতারণা করছিস।
অন্যটা বলছে—তুই বাঁচতে চাস, নিজেকে ভালোবাসতে চাস।

বাড়ি ফিরতেই দেখে, সুজয় আজ একটু অন্যরকম। তার মুখে অদ্ভুত এক গাম্ভীর্য।

“বসবি?” সে ইশারায় ড্রয়িংরুমের সোফায় বসতে বলে।

ঐন্দ্রিলা চুপ করে বসে পড়ে।

সুজয় বলে, “কিছুদিন ধরে দেখছি, তুই বদলে গেছিস। এমন নয় যে আমি কিছু সন্দেহ করছি। কিন্তু তুই যেন আর আগের ঐন্দ্রিলা নেই। তোর চোখে একধরনের কষ্ট আর আত্মতৃপ্তি—দুটো একসঙ্গে দেখা যাচ্ছে।”

ঐন্দ্রিলা চুপ করে থাকে। কথা খুঁজে পাচ্ছে না।

“তুই কিছু বলতে চাস?”

ঐন্দ্রিলা ধীরে বলে, “সুজয়, আমরা কি সত্যি করে ভালোবাসতাম একে অপরকে? নাকি সামাজিক চুক্তিতে আটকে থাকা একজোড়া মানুষ হয়ে গেছি?”

সুজয় কিছুক্ষণ চুপ করে। তারপর বলে, “আমি তোকে ভালোবেসেছিলাম, এখনো বাসি। কিন্তু তোর ভেতরে যে মহাকাশ আমি দেখতে পাই না, সেটা আমি অস্বীকার করব না। তুই কি কাউকে খুঁজে পেয়েছিস?”

ঐন্দ্রিলা একটু থেমে বলে, “হয়তো পেয়েছি। কিংবা হয়তো নিজেকে নতুন করে খুঁজে পেয়েছি।”

এই প্রথমবার সুজয় চুপ করে যায়।

রাত গভীর। ঐন্দ্রিলা বারান্দায় বসে। সে জানে, সম্পর্ক গড়ে ওঠে বিশ্বাসে, কিন্তু সম্পর্ক ভাঙে টানাপড়েনে। ভালোবাসা এক ধরনের নেশা, আর স্বাধীনতাও। দুটো একসঙ্গে থাকলে, মানুষ বাঁচে। না থাকলে—শুধু বেঁচে থাকে।

তার ফোনে একটা মেসেজ আসে—

“তোমার নীরবতাও কবিতা, শুধু কেউ পড়ে না বলে তুমি লেখা বন্ধ কোরো না।”

সে জানে, এই শব্দগুলো ঠিক করে তার বুকের ভিতর ছুঁয়ে যায়।

সে উত্তর দেয়—

“আমি লিখছি, রুদ্র। আমার শরীরে, আমার চুলে, আমার দীর্ঘশ্বাসে। তুই পাতা উল্টে নিস তো?”

যে সন্ধ্যার গল্প কাউকে বলা যায় না

শহরের সন্ধ্যাগুলো যেন একটা অদ্ভুত জাদু নিয়ে নামে। অফিস ফেরত মুখগুলো ক্লান্ত, কিন্তু জানালার বাইরে আকাশে রঙ বদলায় যতটা, তার থেকেও বেশি বদলায় মানুষের ভেতরের রং। ঐন্দ্রিলার আজকের সন্ধ্যাটা অন্যরকম। এতদিন পর হয়তো একটু নিঃশ্বাস নিতে পারছে সে। অথচ সেই নিঃশ্বাসও যেন এক অদৃশ্য ভার টেনে রাখে।

বাথরুম থেকে বেড়িয়ে সে স্লিভলেস একটা কালো ব্লাউজ পরে শিফন শাড়িতে নিজেকে জড়িয়ে নেয়। তার চোখে কাজল, ঠোঁটে হালকা মেরুন, আর কানের পাশে একটা ছোট্ট নথ—এই সাজটাই যেন তাকে ফিরিয়ে দেয় সেই মেয়েটির কাছে, যে একদিন বারান্দায় বসে কবিতা লিখত, নিঃশব্দ প্রেমে ভিজে থাকত।

ঘরটা আজ খানিক সাজানো। টেবিলের উপর ওয়াইন গ্লাস, একপাশে চিজ প্ল্যাটার। এইসব সে নিজে বানায়নি। রুদ্র এসেছে। চুপচাপ, বিকেলের আলো ফুরোবার আগেই, একটা বই হাতে।

“আজকের বইটা তোমার জন্য,” সে বলেছিল।
“তাতে কী আছে?”
“একটা মেয়ের আত্মজীবনী। যে ভালোবাসার নামে অনেক কিছু দিয়েছিল, কিন্তু কিছুই পায়নি, তাও থেমে থাকেনি।”

ঐন্দ্রিলা জানে—এই বইটা তারই গল্প হতে পারত।

রুদ্র আজ চুপচাপ। তার চোখে গভীরতা, কিন্তু ঠোঁটে হাসি নেই। ঐন্দ্রিলা নিজে একটা গ্লাস এগিয়ে দেয় তার দিকে।

“তুই আজ চুপচাপ কেন?”

রুদ্র একটু চুপ করে বলে, “আজ তোকে দেখে মনে হচ্ছে তুই খুব সুন্দর, কিন্তু খুব একা। তুই কি জানিস, সুন্দরতা মানুষকে যতটা টানে, তার চেয়েও বেশি একাকীত্ব টানে?”

ঐন্দ্রিলা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। “আমি কি তোর চোখে শুধুই একা একজন নারী?”

রুদ্র বলে, “তুই আমার চোখে একটা প্রাপ্তবয়স্ক কবিতা। যেখানে শব্দেরা জানে কীভাবে পোড়ে, আবার কীভাবে শান্ত করে।”

ঐন্দ্রিলা উঠে আসে রুদ্রর পাশে। তার চুল খুলে একপাশে সরিয়ে বলে, “তুই আমাকে পড়তে পারিস, এটা জানি। কিন্তু তুই যদি আমার ছোঁয়ার নিচে থাকা না-পাওয়া দাগগুলো পড়তে পারিস, তবে আমায় ছুঁস।”

রুদ্র ধীরে তার গাল ছুঁয়ে বলে, “এই মুখ, এই শরীর, আমি কখনো ভোগ করতে চাইনি। আমি শুধু চাই, এক সন্ধ্যায় তুই আমাকে এমন একটা গল্প শোনাস যা কেউ কোনোদিন শোনেনি।”

ঐন্দ্রিলা একবার চোখ বুজে, আবার খুলে।
“আমি তো তোকে সেই গল্পটাই শোনাচ্ছি প্রতিদিন। এই শহরের একজন নারী, যার ঘরে ভালোবাসা নেই কিন্তু নামের পাশে ‘বিবাহিতা’ বসে আছে। সে একজন প্রেমিককে নিজের মধ্যে জায়গা দিয়েছে, অথচ প্রতিটা ছোঁয়ার ভিতরেও সে দ্বিধা রাখে। এই গল্পটাই কেউ জানতে চায় না। কারণ এই গল্পটা নারী বললে সমাজ কাঁপে। পুরুষ বললে, সেটা সাহস হয়।”

রুদ্র কিছু বলে না। শুধু ঐন্দ্রিলার গাল ছুঁয়ে চুমু খায়। ধীরে, সম্মতিতে, গভীরে।

রাত বাড়ে। ঘড়িতে সাড়ে দশটা।

রুদ্র চলে গেছে। আবার সেই নিঃসঙ্গ ঘর, সেই বারান্দা, সেই শিফন শাড়ি। কিন্তু আজ ঐন্দ্রিলার শরীরে একটা অন্য আলো। যেন সে নিজের কাছে এক ধরণের সত্যি স্বীকার করেছে।

সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে। চোখে একধরনের ঝলকানি, ঠোঁটে ক্ষীণ হাসি, আর বুকের মধ্যে একটা রক্ত-মাংসের প্রতিধ্বনি—যেখানে একটা অপরাধী ভালোবাসা জন্ম নিচ্ছে, অথচ সে নিজেকে অপরাধী ভাবে না।

সে মেসেজ করে রুদ্রকে—

“আজ তোকে ভীষণ ভালোবেসে ফেললাম। কিন্তু এই ভালোবাসার নাম নেই, ঘর নেই, পরিচয় নেই। তুই কি তবু থেকেস?”

রুদ্রর উত্তর আসে অনেকক্ষণ পর—

“তুই যেটুকু দিস, আমি সেটুকুই নিয়ে কবিতা লিখি। যদি একদিন তুই নাও থাকিস, তবু তোকে আমি লিখেই যাব।”

ঐন্দ্রিলার চোখে জল আসে না। কেবল হৃদয়ের ভিতরে একটা ঝড় থেমে যায়।

নির্জনতার গায়ে লেখা নাম

সকালটা ছিল অদ্ভুতভাবে শান্ত। বাইরের গলির গাছের পাখিরা যেমন কর্কশ গলায় ডাকে প্রতিদিন, আজ তাদের কণ্ঠে যেন বিষণ্নতার পরত। ঐন্দ্রিলা জানালার পাশে বসে কফির কাপ হাতে ভাবছিল—এই যে প্রতিদিন ভোর আসে, সূর্য ওঠে, মানুষ ব্যস্ত হয়, সবকিছুর ভিতরেও কিছু কিছু সম্পর্ক শুধু নীরব থাকে। মুখে আসে না, উচ্চারিত হয় না, কিন্তু তবুও খুব তীব্রভাবে বেঁচে থাকে।

রুদ্রর সঙ্গে দেখা হয়নি তিন দিন।
না কোনো মেসেজ, না কোনো কল।

এ যেন এক অভ্যস্ত প্রেমের অনভ্যস্ত বিরতি।

ঐন্দ্রিলা নিজেই ভাবছিল—এই প্রেম কি অভ্যেসে ঢুকে গেছে? নাকি অভ্যেসটাই এখন প্রেমের আরেক নাম? মানুষ যেমন প্রতিদিন চুল আঁচড়ে নেয়, সাবান দিয়ে শরীর ঘষে, সকালে খবরের কাগজ পড়ে—ঠিক তেমনই কি তার রুদ্র? প্রতিদিন দেখা না হলে অস্থির লাগে, অথচ সম্পর্কের সীমানা এখনো ঠিক কাগজে লেখা হয়নি।

বিকেলে ঐন্দ্রিলা বেরিয়ে পড়ে। গন্তব্য সাউথ সিটি মলের ক্যাফেটেরিয়া। একা বসে। হালকা সাজ, চোখে সানগ্লাস, শিফন শাড়ি আজ গোলাপি। নিজের একাকীত্বকে আজ সে একটু স্টাইলিশভাবে বহন করছে।

হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ায় রুদ্র।

“তুই জানতিস আমি আসব?”

ঐন্দ্রিলা হাসে না। শুধু বলে, “আমি জানতাম না, তবু অপেক্ষা করছিলাম।”

রুদ্র একটা চেয়ার টেনে নেয়।

দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে।

তবে চুপ থাকাটাও একধরনের সংলাপ। চোখের ভিতরে চোখ রেখে চুপ করে থাকা—সেখানে অজস্র অক্ষর ঘোরে, শরীরের ভাঁজে জমে থাকা শব্দগুলো একেকটা নিঃশ্বাস হয়ে ভেসে আসে।

অবশেষে রুদ্র বলে, “এই কয়েকদিন আমি নিজের ভিতরে ডুবেছিলাম। ভয় পেয়েছিলাম হয়তো। তোর ভালোবাসা এত জোরালো যে নিজেকে ক্ষুদ্র লাগে।”

ঐন্দ্রিলা ধীরে বলে, “ভালোবাসা ক্ষুদ্র করে না। যদি করে, তাহলে সেটা ভালোবাসা নয়, কিছুটা ভয়। আমি তোকে কোনোদিন ছোট করতে চাইনি। আমি শুধু চেয়েছি—তুই আমাকে ছুঁস, ভেতর থেকে। যতটা পারিস, যতটুকু সাহস হয়।”

রুদ্র হাত বাড়িয়ে তার আঙুল ধরে।

“তুই আমার নির্জনতা। যার গায়ে আমি নাম লিখে রেখেছি, অথচ কাগজে না। শুধুই অনুভবে।”

ঐন্দ্রিলা চোখ নামিয়ে বলে, “আমি তোকে কখনো চাইনি কারো থেকে ছিনিয়ে নিতে। শুধু চেয়েছি, নিজের ভিতরে তোর একটা জায়গা হোক—যেটা কারো জানা নেই, কিন্তু আমার নিজস্ব।”

রাতের শহর ফিরে আসে নিজের গতিতে।
ঐন্দ্রিলা আর রুদ্র আজ একসঙ্গে ফেরে না।
কিন্তু মনে মনে একে অপরকে চিঠি লেখে।

ঘরে ফিরে ঐন্দ্রিলা নিজের লেখার ডেস্কে বসে। একটা পুরনো খাতা খুলে লেখে—

“এই প্রেমটার কোনো ঠিকানা নেই।
কোনো নাম নেই।
কোনো দাবি নেই।
তবু আমি জানি, এটা আছে।
আমার শরীরে, আমার নিঃশ্বাসে, আমার গল্পে।”

রাত বাড়ে। ঘর নিস্তব্ধ। শহরের সমস্ত শব্দ যেন ছুটে পালিয়েছে কোনো অজানা নদীর দিকে।

এমন এক মুহূর্তে ঐন্দ্রিলা নিজের মুখ আয়নায় দেখে।

চোখে ক্লান্তি নেই।
তবে এক গভীর শান্তি আছে।

এই শান্তি, যে শান্তি কেবল ভালোবাসার পরে আসে—অথচ যা কারো সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায় না।

আলো-ছায়ার ভিতর তোমায় খুঁজি

বিকেলটা যেন আজ একটু বেশিই নিস্তরঙ্গ। ঘরের ভিতর আলো-ছায়ার খেলা চলছে। জানালার পর্দা হালকা বাতাসে দুলছে, যেন কোনো নিঃশব্দ আহ্বান জানায় বারবার। ঐন্দ্রিলা আজ নিজের শরীরটা একটু আলগোছে জড়িয়েছিল। লাইট সাদা-হলুদ, ঘরটা স্নিগ্ধ। বুকে হালকা কাঁপন।

রুদ্র আজ আসবে না জানে সে, তবু শাড়ি পরে বসে আছে। সেই সবুজ শিফনটা, যেটা রুদ্র প্রথম দেখেই বলেছিল—“এই শাড়িতে তুই বিষাদকেও সুন্দর করে তুলিস।”

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঐন্দ্রিলা আজ নিজেকে নতুন করে দেখছিল। বয়স তার শরীর ছুঁয়েছে ঠিকই, কিন্তু চোখে এখনো এক অমোঘ আকর্ষণ। ঠোঁটের কোনে থাকা হালকা রেখাগুলোতে যাপন মিশে আছে। এই নারী ক্লান্ত, কিন্তু সাহসী। এই নারী পরিণত, কিন্তু তৃষ্ণার্ত।

রাত নেমেছে আস্তে আস্তে। চায়ের কাপ ফাঁকা, ঘরে নীরবতা বাড়ে।

হঠাৎ ফোনটা আলো দেয়।
রুদ্রর মেসেজ:

“তুই জানিস, তোর অভাবটা এখন আমার রাতের সবচেয়ে লুকানো ব্যথা।”

ঐন্দ্রিলা উত্তর দেয় না। শুধু ফোনটা বুকের উপর রাখে। চোখ বন্ধ করে। ভেতরের একটা গোপন কান্না উঠে আসে, আবার থেমে যায়।

রাত বারোটায় আবার একটা মেসেজ।

“আজ যদি তুই বলিস, আমি ভোরের আগে তোর দরজায় থাকব।”

ঐন্দ্রিলা এবার লিখে ফেলে—

“ভোরের আলোয় আমাদের সম্পর্ক বেশি সত্যি লাগে। রাতটা কেবল শরীর চায়, আলোটা চায় আত্মা।”

ভোর হয়।

রুদ্র এসেছিল কি না, ঐন্দ্রিলা জানে না।

সে ঘুমিয়ে পড়েছিল কি না, সেটাও জানে না।
কিন্তু সকালবেলা জানালার পাশে এক গাদা হলুদ চাঁপা ফুল রাখা। কাগজের ঠোঙায় লেখা—

“তুই আলো, কিন্তু আমি তো ছায়া। তবুও তোকে খুঁজে বেড়াই আমার ছায়ার ভিতরে।”

ঐন্দ্রিলা ফুলটা বুকের কাছে ধরে রাখে। হঠাৎ করেই নিজেকে অপরাধবোধহীন লাগে।

এই সম্পর্ক—যেখানে স্পষ্টতা নেই, স্বীকৃতি নেই, কিন্তু গভীরতা আছে।
যেখানে অন্যায় বলে কিছু নেই, যদি হৃদয়ের ভাষা সত্যি হয়।

সন্ধ্যায় সে রুদ্রকে ফোন করে।

“আজ আমি তোকে দেখতে চাই।”

রুদ্র একটু চুপ করে বলে, “যেখানে আলোর ছোঁয়া আছে, তেমন কোনো ঘরে চল।”

ঐন্দ্রিলা বলে, “আজ আমি ঘর চাই না। আজ আমি একটা নদীর ধারে দাঁড়িয়ে তোকে ছুঁতে চাই, যেন আমাদের ভালোবাসা কোনো শহরের গল্প না হয়ে, একটা প্রকৃতির নিঃশব্দ সাক্ষী হয়।”

রুদ্র হাসে।

রাত্রির শেষে তারা গিয়েছিল গঙ্গার ধারে।
ঘুটঘুটে অন্ধকার, কেবল ল্যাম্পপোস্টের আলো আর নদীর শব্দ।

ঐন্দ্রিলা হালকা কাঁপে। রুদ্র তার শাড়ির প্রান্ত ধরে টেনে নেয় কাছে।

“তুই কি জানিস, এই নিঃশব্দতা আমাদের সবচেয়ে সুন্দর চুম্বন?”

ঐন্দ্রিলা চোখ বন্ধ করে। শরীর তার কাঁপে, কিন্তু ভয় পায় না। প্রেম যে শরীর দিয়ে শুরু হলেও শেষ হয় চোখে, এ সত্যি তার চেয়ে ভালো আর কে জানে?

তোমার নামের ভিতর নিজেকে খুঁজি

ঐন্দ্রিলার ঘুম ভেঙে যায় এক অন্যমনস্ক সকালে। জানালার বাইরে মেঘ জমেছে, আকাশ কালচে ধূসর। এই শহরে এমন আকাশ বিরল—একটা অনিশ্চিত আবহ, যেন মন খারাপের আগাম বার্তা। এমন দিনে মন গা ছমছম করে। অথচ আজ ঐন্দ্রিলা অসম্ভব শান্ত।

চায়ে চুমুক দিতে দিতে সে ভাবে, ভালোবাসা কখনও কখনও দাগ ফেলে না, আঁচর কাটে। সেই আঁচর থেকেই জন্ম নেয় নিজস্বতা। রুদ্র তার জীবনে শুধু প্রেমিক হয়ে আসেনি, এসেছে এক আয়নার মতো। সে ঐন্দ্রিলাকে ঐন্দ্রিলার কাছেই ফিরিয়ে দিয়েছে।

ফোনটা কাঁপে।
রুদ্র।
দীর্ঘ বিরতির পর আজ সকালেই ফোন করেছে। খুব সাবলীলভাবে।

“তুই আছিস তো?”

ঐন্দ্রিলা মৃদু হাসে, “ছিলাম, আছি, থাকব।”

রুদ্র বলল, “আজকে একটু তোর সঙ্গে দেখা করতে চাই, শেষবারের মতো নয়… বরং একবার ঠিক করে নিজের মতো করে।”

ঐন্দ্রিলা কিছু বলে না। শুধু বলে, “এস। কিন্তু আজ কোনো কথা নয়। শুধু বসে থাকব দুজনে।”

বিকেলে তারা দুজন দেখা করে বালিগঞ্জের একটা পুরনো বাড়িতে—যেখানে রুদ্র মাঝেমধ্যে লেখালেখি করতে আসে। দোতলার ঘরটায় কাঠের জানালা, পুরনো ফ্যান আর একরাশ নীরবতা।

ঐন্দ্রিলা ঢোকে। তার পরনে সাদা কটন শাড়ি, চোখে সামান্য কাজল। রুদ্র তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ, নিঃশব্দে।

তারা পাশাপাশি বসে।

সন্ধ্যার আলো এক এক করে ঘরের দেয়ালে পড়ে। আলো ঢেউ খেলায় তাদের মুখে, চুলে, আঙুলে। সেই মুহূর্তে কোনো কথা নেই, শুধু নিঃশ্বাসে এক ছন্দ।

হঠাৎ ঐন্দ্রিলা বলে, “তুই জানিস, তোকে ভালোবেসে আমি নিজেকে ভালোবাসতে শিখেছি। আগে আমার প্রতিফলন ছিল শুধু অন্যদের চোখে। এখন আমি নিজের ভিতরেই নিজেকে দেখি।”

রুদ্র কিছু বলে না।
তার চোখে জল।
সে হয়তো বলত, “তুই আমার নামের ভিতর লেখা এক কবিতা—যেটা কখনও শেষ হবে না।”

ঐন্দ্রিলা উঠে দাঁড়ায়। জানালার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে বলে—

“আমরা কেউই কারো জীবন দখল করতে আসিনি। শুধু পাশে থাকতে চেয়েছি, নিরবধি। এই ভালোবাসা এমন এক নদী, যার কিনারা নেই, গভীরতা আছে, অথচ ডুবে যাওয়ার ভয় নেই।”

রুদ্র ধীরে এসে তার পেছনে দাঁড়ায়। হাত রাখে ঐন্দ্রিলার কাঁধে।
কোনো স্পর্শ নেই সেখানে, যা ভোগের, যা ইচ্ছার।
সেখানে আছে শুধু আত্মা ছোঁয়ার কণ্ঠরব।

ঐন্দ্রিলা ধীরে ঘুরে তাকায়, চোখে জল।

“তোর নামের ভিতর আমি নিজেকে খুঁজি রুদ্র। তুই চলে গেলে হয়তো বেঁচে থাকব, কিন্তু অসম্পূর্ণভাবে। তবু তোর ছায়াটা আমার ভিতরে থেকে যাবে, চুপচাপ।”

রুদ্র তার মুখে হাত রাখে।

“তুই আমার জীবনের একমাত্র সত্যি। বাকি সব অন্ধকার।”

সেই রাতে তারা দুজনে একসঙ্গে ছিল।
না, শরীরের মধ্যে নয়—প্রেমের গভীরতর স্তরে।
যেখানে কোনো শব্দ নেই, কেবল একে অপরকে চেনার আলো।

ভোর হলে ঐন্দ্রিলা চুপচাপ বেরিয়ে আসে।
রুদ্র ঘুমায়। মুখে এক শান্তির রেখা।

বেরোনোর সময় ঐন্দ্রিলা ছোট্ট একটা কাগজে লিখে রেখে যায়—

“এই ভালোবাসা কোনো দাবি নয়, কোনো প্রাপ্তির হিসেব নয়।
এটা শুধু এক আত্মার পাশে অন্য আত্মার হেঁটে যাওয়া।
আমি যাবো, কিন্তু আমার প্রতিচ্ছবি থেকে যাবে তোর আয়নায়, চিরকাল।”

শেষ

1000017696.jpg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *