Bangla - ভূতের গল্প - রহস্য গল্প

অন্ধকার কূপের ডাক

Spread the love

এক

গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে, বাঁশঝাড়ের আড়ালে এক বিস্মৃত কূপ বহুদিন ধরে অচল পড়ে আছে। সময়ের ভারে তার ইটগুলো ভেঙেচুরে এক অদ্ভুত শৈবাল-ঢাকা রূপ নিয়েছে, যেন প্রকৃতি নিজেই কূপটিকে ঢেকে রাখতে চায়। চারপাশে গজিয়ে ওঠা কাঁটাঝোপ, শুকনো ডালপালা আর বনলতা মিলেমিশে এমন এক পরিবেশ তৈরি করেছে যেখানে দিনের আলোও প্রবেশ করতে চায় না। গ্রামের শিশুরা দূর থেকে কূপটিকে দেখে আঁতকে ওঠে, আর বয়স্করা ভয়ে নামও মুখে আনে না। শোনা যায়, একসময় এ কূপই ছিল গ্রামের প্রধান পানির উৎস। মানুষজন প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা জল তুলতে আসত, কূপপাড়ে হাসি-ঠাট্টার আসর বসত। কিন্তু প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে এক ভয়াবহ ঘটনার পর হঠাৎ করেই কূপটি অশুভের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। লোকেরা দাবি করে, রাতে এর ভেতর থেকে ভেসে আসে অস্পষ্ট এক নারীকণ্ঠের কান্না, যা এতটাই করুণ যে শুনলে হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যায়। আর যদি কেউ সাহস করে সেই কান্নার উৎস খুঁজতে কূপের কাছাকাছি যায়, তবে সে আর কখনও ফিরে আসে না। এভাবে বছরের পর বছর ধরে কূপের রহস্য শুধু গ্রামবাসীদের নয়, আশেপাশের গ্রামগুলোর লোকজনকেও আতঙ্কিত করে রেখেছে।

যে-কোনো অচেনা ভ্রমণকারী বা নতুন মানুষ যখন এ কূপের কথা শোনে, প্রথমে সেটিকে নিছক গুজব বা গ্রামের লোককথা মনে করে হেসে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু যারা গ্রামে দীর্ঘদিন বসবাস করছে, তাদের চোখে মুখে ভয় আর সতর্কতার ছাপ স্পষ্ট বোঝা যায়। বৃদ্ধারা বলেন, বহু আগে শ্যামলী নামে এক তরুণীকে দেখা গিয়েছিল কূপের ধার ঘেঁষে বসে থাকতে। পরদিন আর তাকে পাওয়া যায়নি। কেউ বলে সে কূপে ঝাঁপ দিয়েছিল, আবার কারও মতে তাকে পরিকল্পিতভাবে কূপে ঠেলে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু রহস্য এই যে, তার মৃতদেহ কখনো উদ্ধার হয়নি। এরপর থেকেই কূপটি অশরীরীর আস্তানা হয়ে ওঠে। রাতে যখন সবকিছু নিস্তব্ধ, তখনই শুরু হয় অদ্ভুত কান্নার শব্দ। মাঝে মাঝে সেই কান্না রূপ নেয় শীতল হাহাকারে, আবার কখনও মনে হয় কেউ দমবন্ধ হয়ে কেঁদে উঠছে। গ্রামের পুরোহিতরা মন্ত্রপাঠ করে কূপকে শুদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। বরং যারা এ কাজে যুক্ত হয়েছিল, তাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হয়ে মারা গেছে, আবার কেউ নিখোঁজ হয়েছে অদ্ভুতভাবে। এসব ঘটনার পর থেকে কূপের কাছে যাওয়া একেবারেই নিষিদ্ধ হয়ে যায়।

তবে নিষিদ্ধের দেয়াল যতই উঁচু হোক, কৌতূহলের পথ আরও দ্রুত জন্ম নেয়। গ্রামের কিশোররা মাঝে মধ্যে চ্যালেঞ্জের খেলা খেলে—কে কূপের কাছে গিয়ে একটি পাথর ছুড়ে আসতে পারবে। যারা সাহস করে কূপের ধারে যায়, তাদের চোখে-মুখে আতঙ্ক লেগে থাকে, কারণ সবাই দাবি করে ভেতরে তাকালেই দেখা যায় অন্ধকারের ভেতর দুটি লালচে আলো জ্বলজ্বল করছে, যেন কারও চোখ। বয়স্করা এসব কথা শুনে বকাঝকা করে বলে, “অত ভয়ের জায়গায় যাবি কেন? ওখানকার ডাক কারও পক্ষে উপেক্ষা করা যায় না।” গ্রামের ভেতরে প্রতিটি বাড়ির চৌকাঠে এই গল্প বহু প্রজন্ম ধরে বলা হয়ে আসছে। কিন্তু ঠিক কী আছে কূপের ভেতরে, কেনই বা রাতের পর রাত কান্নার শব্দ শোনা যায়—সেই রহস্য এখনো কেউ উন্মোচন করতে পারেনি। কূপটি দাঁড়িয়ে আছে নীরব প্রহরীর মতো, যেন সময়ের সাক্ষী হয়ে প্রতিদিন গ্রামের মানুষদের চোখে অদৃশ্য ভয়ের প্রতিচ্ছবি এঁকে দেয়। আর কূপের চারপাশে তৈরি হওয়া এই ভৌতিক পরিবেশই পরবর্তীতে গ্রামটিকে এমন এক গোপন রহস্যে ঢেকে দেয়, যেখান থেকে আর ফিরে আসার পথ থাকে না।

দুই

গ্রামের মানুষজন কূপকে যতই এড়িয়ে চলুক, তবুও কিশোর বয়সের দুষ্টুমি আর কৌতূহল সবকিছু ভেদ করে বেরিয়ে আসে। শুভ, প্রায় ষোল বছরের এক কিশোর, সবার কাছে তার সাহসী স্বভাবের জন্য পরিচিত ছিল। সে অন্য ছেলেদের মতো অন্ধকারকে ভয় পেত না, বরং চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসত। গ্রামের কিশোররা যখন কূপের গল্পে ভয় পেয়ে সরে যেত, তখন শুভ হেসে বলত, “ওসব ভূত-টুত বলে কিছু নেই। ভয় দেখানোর জন্য এসব বানানো গল্প।” তার বন্ধুদের অনেকে একদিন তাকে চ্যালেঞ্জ দিল—রাতে কূপের ধারে গিয়ে দাঁড়াতে পারলে তবে প্রমাণ হবে সে সত্যিই সাহসী। শুভ চ্যালেঞ্জ ফিরিয়ে দেওয়ার মানুষ নয়। সে শপথ করল, পূর্ণিমার রাতে, যখন চারদিক আলোকিত থাকবে, তখন সে একাই কূপের কাছে যাবে আর ফিরে এসে প্রমাণ করবে যে ভয় নামক জিনিসটি শুধু দুর্বলদের কল্পনায় থাকে। গ্রামের বয়স্করা শুনে কপালে হাত দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, কিন্তু কিশোরের কানে এসব সতর্কবার্তা পৌঁছাল না।

চাঁদের আলোয় ভেসে আসা সেই রাত ছিল অদ্ভুত নীরব। চারদিকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, দূরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ, আর মাঝে মাঝে বাতাসের ঝাপটায় বাঁশঝাড়ের কটকট শব্দ—সব মিলে যেন প্রকৃতিই সতর্কবার্তা দিচ্ছিল। শুভ কাঁধে লণ্ঠন নিয়ে এগোতে থাকল। তার সঙ্গীরা দূরে দাঁড়িয়ে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে দেখছিল, কেউ কেউ কৌতূহল চাপতে না পেরে গলা ফাটিয়ে হাসছিল। শুভ আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে কূপের কাছে পৌঁছে দাঁড়াল। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে তার চোখে পড়ল কূপের চারপাশে অদ্ভুত ছায়া ঘুরছে। সে ভেবেছিল হয়তো চাঁদের আলোয় গাছের ডালপালা নড়ছে, কিন্তু ভেতরে তাকাতেই তার বুক কেঁপে উঠল। কূপের অন্ধকারে যেন দুটি চোখ জ্বলজ্বল করছে, রক্তিম লাল, এক অদ্ভুত শীতল আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ সে শুনতে পেল মৃদু কান্নার শব্দ—ধীরে ধীরে শব্দটি করুণ আর স্পষ্ট হতে শুরু করল। “শুভ…” কণ্ঠটা যেন তার নাম ধরে ডাকছে। লণ্ঠন তার কাঁপা হাতে কাঁপতে লাগল, কিন্তু সে স্থির থাকল, যেন প্রমাণ করতে চায় তার ভয়ের কিছু নেই।

বন্ধুরা দূর থেকে ডাকতে থাকল, “শুভ! ফিরে আয়!” কিন্তু শুভ যেন সেই কান্নার শব্দে মোহিত হয়ে গিয়েছিল। তার চোখ কূপের ভেতরে স্থির হয়ে গেল, আর শরীর নিজের অজান্তেই সামনে ঝুঁকতে লাগল। ধীরে ধীরে যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে ভেতরে টেনে নিচ্ছে। বন্ধুরা ছুটে এসে চিৎকার করলেও হঠাৎ বাতাসের এক ঝাপটায় লণ্ঠন নিভে গেল, চারপাশ অন্ধকারে ঢেকে গেল। সেই অন্ধকারে ভেসে উঠল এক বিকট চিৎকার, তারপর সব নিস্তব্ধ। যখন আলো জ্বালানো হলো, তখন দেখা গেল কূপের ধার খালি, শুভ কোথাও নেই। শুধু লণ্ঠনটি ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে, তার কাচের টুকরো চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে। সেই রাতের পর থেকে শুভ আর কখনও বাড়ি ফেরেনি। গ্রামে শোক আর আতঙ্কের ছায়া নেমে এলো। কারও কণ্ঠে আর উচ্চারিত হলো না “অন্ধকার কূপ” নামটি, তবুও প্রত্যেকেই বুঝল—কূপ আবারও তার শিকার বেছে নিয়েছে। শুভর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা যেন গ্রামের অমোঘ নিয়তি হয়ে গেল, আর মানুষদের মনে গভীরভাবে গেঁথে দিল এই সত্য—যে কূপের ডাক এড়িয়ে যাওয়া যায় না।

তিন

শুভর নিখোঁজ হওয়ার পর পুরো গ্রাম যেন অবর্ণনীয় আতঙ্কে ডুবে গেল। দিনের আলোতেও মানুষের চোখেমুখে অস্বস্তি, আর রাত নামলেই যেন এক অদৃশ্য ভয়ের ছায়া চারপাশে ভর করে। কারও গৃহস্থালির কাজের ফাঁকে হাসি নেই, মাঠে কাজ করতে গিয়ে কৃষকের মুখে গান শোনা যায় না। বরং সবার চোখে ভেসে ওঠে শুভর ছবি—সেই সাহসী ছেলেটি যে চোখের সামনে হাওয়ার মতো মিলিয়ে গেল, আর আরেকবারও ফিরল না। বৃদ্ধরা বলল, তারা তো বহু বছর ধরেই সতর্ক করে আসছিল কূপের অশুভ শক্তি নিয়ে, কিন্তু নতুন প্রজন্ম তা শোনেনি। অনেকেই ফিসফিস করে দাবি করতে লাগল যে শুভর আত্মাও হয়তো কূপের ভেতর বন্দি হয়ে গেছে। রাত গভীর হলে মাঝে মাঝে কূপ থেকে ভেসে আসে অস্পষ্ট এক কণ্ঠস্বর, যা অনেকের কানে শুভর মতো শোনায়। লোকেরা আর সাহস করে কূপের দিকে তাকাতেও পারে না, যেন সেই কণ্ঠস্বর আবার কাউকে নিজের দিকে টেনে নেবে।

এদিকে কূপের পুরনো কাহিনি আবারও নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। বৃদ্ধাদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তে লাগল শ্যামলীর গল্প—সেই রহস্যময় তরুণী, যাকে বহু বছর আগে কেউ কূপে ফেলে দিয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। কেউ বলে, শ্যামলী ছিল অতি সুন্দরী, যার সৌন্দর্যে গ্রামের অনেকের ঈর্ষা ছিল। আবার কেউ বলে, সে প্রেমে প্রতারিত হয়েছিল এবং অভিমানে নিজের জীবন দিয়েছিল। তবে সব গল্পের শেষ এক জায়গায় গিয়ে মিলিত হয়—তার আত্মা শান্তি পায়নি, বরং কূপে বন্দি হয়ে প্রতিনিয়ত প্রতিশোধের খোঁজ করছে। কূপের পাশে দাঁড়িয়ে শোনা যায় তার হাহাকার, তার কান্না, আর কখনও কখনও তার ডাকে সাড়া দেওয়া মানুষের নিঃশ্বাসরুদ্ধ আর্তনাদ। এভাবে কূপটি ধীরে ধীরে অশুভের প্রতীক হয়ে ওঠে। লোকেরা বিশ্বাস করতে শুরু করল, কূপ কেবল জলধারার উৎস নয়, বরং অদৃশ্য দুনিয়ার এক প্রবেশদ্বার, যেখানে একবার প্রবেশ করলে আর ফেরা সম্ভব নয়।

এই ভয় গ্রামের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে গেল। সন্ধ্যা নামার আগেই সবাই দরজা জানালা বন্ধ করে দিত। শিশুদের কঠোরভাবে নিষেধ করা হতো কূপের দিকেই না যেতে। এমনকি কেউ অসুস্থ হলে বা কারও বাড়িতে বিপদ নেমে এলে সবাই মনে করত, এ কূপের অভিশাপই তার মূল কারণ। গ্রামের পুরোহিতরা বহুবার পূজা দিয়ে কূপকে শুদ্ধ করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু প্রত্যেকবারই ব্যর্থ হয়েছে। কিছু পূজার পর অদ্ভুত দুর্ঘটনা ঘটেছে—কখনও হোমের আগুন নিভে গেছে হঠাৎ ঝোড়ো বাতাসে, আবার কখনও মন্ত্রপাঠ করতে গিয়ে পুরোহিতের কণ্ঠ থমকে গেছে যেন কারও অদৃশ্য হাত তাকে চেপে ধরেছে। এসব ঘটনার পর কূপের নাম মুখে আনা আরও নিষিদ্ধ হয়ে গেল। তবুও মানুষের মনে এক প্রশ্ন অনবরত ঘুরপাক খেতে লাগল—কূপের গভীরে আসলে কী লুকিয়ে আছে? কেনই বা সেই কান্না এত জীবন্ত শোনায়? শুভর হারিয়ে যাওয়া যেন উত্তর খুঁজতে গিয়ে আরও রহস্য তৈরি করল, আর গ্রামবাসীরা বুঝল যে অন্ধকার কূপ এখন শুধু ভয় নয়, মৃত্যুরও আরেক নাম হয়ে উঠেছে।

চার

শুভর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার কয়েক মাস কেটে গেল, কিন্তু তার পরও গ্রামের ভীতি আরও ঘনীভূত হলো। এ সময় শহর থেকে গ্রামে বেড়াতে এল অরিন্দম, বয়সে প্রায় বাইশ, কলেজে পড়াশোনা করা এক চঞ্চল যুবক। শহরের মানুষ বলে তার চোখে অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা ভূতপ্রেতের ভয়ের কোনো ছাপ নেই। গ্রামে আসার পর থেকেই সে দেখল, প্রতিটি ঘরে ঘরে ভয়ের চাপা আবহ বিরাজ করছে। সন্ধ্যা নামার আগেই সব দরজা-জানালা বন্ধ হয়ে যায়, আর কূপের নাম উচ্চারণ করলেই মানুষ কেঁপে ওঠে। অরিন্দম এসব দেখে প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিল। সে বলল, “এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে তোমরা এখনো ভূতপ্রেত নিয়ে মাথা ঘামাও? এসব নিছক কুসংস্কার ছাড়া আর কিছু নয়।” কিন্তু তার আত্মবিশ্বাসী কথার জবাবে গ্রামের লোকেরা শুধু শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল। বৃদ্ধরা বলল, সাহসী শুভও একদিন এমন কথা বলেছিল, আর তার পরিণতি সবাই জানে। কিন্তু অরিন্দম বিশ্বাস করল না, বরং আরও কৌতূহলী হয়ে উঠল।

দিন গড়াতে গড়াতে সে কূপ নিয়ে নানা খোঁজখবর নিতে লাগল। বৃদ্ধারা একে একে শ্যামলীর কাহিনি শোনাল, কেউ বলল কূপে অভিশপ্ত আত্মা রয়েছে, কেউ বলল এটি অপশক্তির আস্তানা। কিন্তু এসব শুনে অরিন্দমের মধ্যে অদ্ভুত এক চ্যালেঞ্জের আগুন জ্বলে উঠল। সে মনে করল, এই গ্রামে অযথা ভয়ের আবহ তৈরি হয়েছে, আর সেই ভয় ভাঙার দায়িত্ব তারই নেওয়া উচিত। বন্ধুদের কাছে সে ঘোষণা করল, “আমি কূপের রহস্য উদঘাটন করব। আমি সেখানে যাব, আর প্রমাণ করব যে ভয় বলে কিছু নেই। মানুষ ভয়েই মরে, আসলেই ভূত বলে কিছু নেই।” তার দৃঢ় কণ্ঠস্বর শুনে গ্রামের কিশোররা অবাক হয়ে গেল, কেউ কেউ মনে মনে প্রশংসা করল, আবার কেউ নিঃশব্দে আতঙ্কিত হলো। কারণ শুভর কথা তাদের এখনও গা শিউরে তোলে। কিন্তু অরিন্দম তার সিদ্ধান্ত থেকে একচুলও সরল না। সে নির্ধারণ করল, পূর্ণিমার রাতেই সে একা কূপের ধারে যাবে, লণ্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে সত্য উদঘাটন করবে।

যেদিন সে পরিকল্পনা করল, সেদিন থেকেই গ্রামে আবার গুজব ছড়িয়ে পড়ল। কেউ বলল অরিন্দম অভিশাপকে চ্যালেঞ্জ করছে, কেউ বলল তার জীবনও শুভর মতো অদৃশ্য হয়ে যাবে। সন্ধ্যা নামতেই বাড়ির আঙিনায় ফিসফাস শোনা যেতে লাগল—“অরিন্দম আজ রাতেই যাবে।” চাঁদ উঠতেই নীরবতার সঙ্গে মিশে গেল অদ্ভুত অস্বস্তি। গ্রামের মানুষ ঘরে বসে দরজা বন্ধ করল, কিন্তু তাদের কানে কানে শুধু একটাই প্রশ্ন—সে কি ফিরতে পারবে? অরিন্দম এদিকে তার লণ্ঠন জ্বালাল, হাতে একটি দড়ি আর মুঠোভর্তি সাহস নিয়ে রওনা হলো কূপের পথে। বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে হাওয়া বইছিল, চারপাশে ছায়া নড়ছিল, কিন্তু তার চোখে ভয় নেই, শুধু দৃঢ়তা। দূর থেকে কয়েকজন কিশোর লুকিয়ে তাকাল, কিন্তু কেউ কাছে আসার সাহস পেল না। অরিন্দম এগিয়ে গেল কূপের ধারে, আর সেই মুহূর্তেই গ্রামের ইতিহাসে আরেকটি ভৌতিক অধ্যায়ের সূচনা হলো।

পাঁচ

পূর্ণিমার আলোয় ভেসে থাকা সেই রাতটি যেন অন্য সব রাতের থেকে আলাদা ছিল। আকাশ ছিল অস্বাভাবিকভাবে স্বচ্ছ, চাঁদের আলো কূপের চারপাশে রুপালি আভা ছড়িয়ে দিচ্ছিল, অথচ সেই আলোতে কোনো উষ্ণতা ছিল না—বরং অদ্ভুত শীতলতা যেন চারপাশকে গ্রাস করেছিল। অরিন্দম যখন কূপের ধারে পৌঁছাল, তখন গ্রামের বাকি মানুষজন দরজা-জানালা বন্ধ করে নিজেদের গৃহে লুকিয়ে ছিল, কেবল কয়েকজন কিশোর দূর থেকে গোপনে তার সাহসী পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করছিল। কূপের চারপাশের ঝোপঝাড়ে বাতাস বয়ে যাচ্ছিল, যার শব্দ যেন কানে ফিসফিস করে কিছু বলতে চাইছিল। অরিন্দম লণ্ঠন মাটিতে রেখে গভীরভাবে কূপের দিকে তাকাল। কূপের অন্ধকার যেন আরও গভীর, চাঁদের আলোও ভেতরে প্রবেশ করতে পারছিল না। ঠিক সেই সময়ই ভেসে এল এক হালকা কান্নার শব্দ, যেন অনেক দূর থেকে কেউ কেঁদে উঠছে।

শুরুর দিকে অরিন্দম ভেবেছিল এটি হয়তো বাতাসের শব্দ, অথবা কোথাও থেকে ভেসে আসা পেঁচার ডাক। কিন্তু ধীরে ধীরে শব্দটি স্পষ্ট হতে লাগল, আর তার বুকের ভেতর এক অদ্ভুত শীতলতা নেমে এলো। কান্নার শব্দটি আর সাধারণ শোনাচ্ছিল না; বরং মনে হচ্ছিল এটি এক নারীর কান্না, যা এতটাই করুণ যে তার শরীর কেঁপে উঠল। আরও অবাক করা বিষয় হলো, শব্দটি যেন তার নাম ধরে ডাকছিল। সে স্পষ্ট শুনল—“অরিন্দম…” শব্দটি যেন কূপের ভেতর থেকে প্রতিধ্বনির মতো ভেসে আসছিল। সে থমকে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকাল, কিন্তু আশেপাশে কেউ নেই। তার ভেতরে তর্ক চলছিল—এ কি শুধুই কল্পনা, নাকি সত্যিই কেউ তাকে ডাকছে? লণ্ঠনের আলো হালকা কেঁপে উঠছিল, আর সেই আলোয় কূপের প্রাচীন ভাঙা ইটগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠছিল।

অরিন্দম তার সমস্ত সাহস একত্র করল। বুকের ভেতর ভয় থাকলেও সে তা মুখে প্রকাশ করল না। ধীরে ধীরে সে কূপের ধারে ঝুঁকে ভেতরে তাকাতে চেষ্টা করল। অন্ধকারের গভীরতা এতই প্রবল ছিল যে চোখ কিছুমাত্র স্পষ্ট দেখতে পেল না। কিন্তু সেই গভীরতার মাঝেই হঠাৎ যেন দুটো অদ্ভুত আলো জ্বলে উঠল—রক্তিম লাল চোখ, যা সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টি ছিল ভয়ঙ্কর, অথচ টানও তৈরি করছিল। কান্নার শব্দ এবার স্পষ্ট হয়ে চিৎকারে রূপ নিল—“আমাকে মুক্তি দাও…”। অরিন্দমের শরীর শিহরিত হয়ে উঠল, ঘামে ভিজে গেল তার কপাল, কিন্তু সে পিছু হটল না। বরং মনে হলো তার কানে কণ্ঠস্বর ফিসফিস করছে—“আরও কাছে এসো…”। সেই মুহূর্তে অরিন্দম বুঝল, কূপের রহস্য শুধু কুসংস্কার নয়, এর ভেতরে সত্যিই কিছু ভয়াবহ শক্তি বন্দি আছে। কিন্তু সে সাহস হারাল না, কারণ তার মনে হলো—এই রহস্য উদঘাটন করতেই হবে, যতো ভয়ই তাকে ঘিরে ধরুক না কেন।

ছয়

কূপের গভীর অন্ধকারে যখন লালচে দুটি চোখ জ্বলে উঠেছিল, তখন অরিন্দমের মনে হয়েছিল তার শিরায় রক্ত যেন জমে গেছে। তবুও সাহসী মানসিকতা তাকে পিছু হটতে দেয়নি। সে এক পলকও চোখ সরাল না, বরং অদ্ভুত এক আকর্ষণে তাকিয়ে রইল সেই গভীরতার দিকে। ঠিক তখনই কান্নার শব্দ ধীরে ধীরে থেমে গিয়ে রূপ নিল ফিসফিস কণ্ঠে, যা ভেসে আসছিল অদৃশ্য থেকে। সে শুনতে পেল—“আমি একা… আমাকে মুক্তি দাও…”। অরিন্দম গলা শুকিয়ে আসা সত্ত্বেও বলল, “কে তুমি? তোমার কী চাই?” প্রশ্ন শেষ হতেই কূপের ভেতর থেকে ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা বেরিয়ে এল, লণ্ঠনের শিখা কেঁপে উঠল, আর বাতাসে ভেসে উঠল তীব্র এক গন্ধ—আধপচা ফুল আর ভেজা মাটির গন্ধ, যা মৃত্যুর আভাস দেয়। তার বুকের ভেতরে অস্বস্তি বাড়তে লাগল, কিন্তু সে জানত এ মুহূর্তে পিছিয়ে আসা মানে তার সাহসকে পরাজয় স্বীকার করানো।

কিছুক্ষণ পর সেই অন্ধকার থেকে ধীরে ধীরে ভেসে উঠল এক ছায়া। প্রথমে তা অস্পষ্ট ছিল, যেন কুয়াশার পর্দা। কিন্তু অল্প সময়েই ছায়াটি আকার নিতে শুরু করল—লম্বা চুল, ভেজা সাদা শাড়ি, মুখের ওপর চুলের ঘন আবরণ, আর হাত দুটি অস্বাভাবিকভাবে দীর্ঘ ও কৃশ। অরিন্দম হঠাৎ এক পা পিছিয়ে গেল, কারণ তার মনে হচ্ছিল ছায়াটি সরাসরি তার দিকে এগিয়ে আসছে। কণ্ঠস্বর এবার পরিষ্কার হলো—“তুমি আমার কথা শুনছো… তোমার সাহস আছে… তুমি আমাকে মুক্তি দেবে…”। প্রতিটি শব্দ যেন অরিন্দমের মনে ঢুকে যাচ্ছিল, তার চিন্তা শক্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছিল। তার চোখে ভেসে উঠছিল বিভ্রম—কখনও মনে হচ্ছিল শুভ দাঁড়িয়ে আছে কূপের ধারে, আবার কখনও এক নারী ভিজে শরীরে সাহায্য চাইছে। এই ভ্রম আর বাস্তবের সীমারেখা অরিন্দমকে বিভ্রান্ত করে দিল।

হঠাৎ করেই ছায়াটি কূপ থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করল। তার ভেজা সাদা শাড়ি কূপের অন্ধকার জল টেনে আনছিল, আর চারপাশে সেই জলে ভিজে যাচ্ছিল মাটি। অরিন্দমের মনে হলো তার দেহ জমে যাচ্ছে, পা সরাতে চাইছে কিন্তু পারছে না। ছায়ার মুখ এখনও অচেনা, কিন্তু তার কণ্ঠে ছিল এক অদ্ভুত করুণতা, যা ভয়ের মাঝেও অরিন্দমকে থামিয়ে রাখল। ছায়া ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে তার দিকে এগিয়ে এল। সেই হাত শীতল, মৃত মানুষের মতো, অথচ তার ভেতরে অদ্ভুত এক আকর্ষণ লুকিয়ে ছিল। ঠিক তখনই অরিন্দম অনুভব করল, কূপের ভেতর থেকে ভেসে আসছে অসংখ্য অচেনা মুখ, যারা সবাই শূন্য চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তারা ছিল গ্রামের সেই সব মানুষ, যারা একে একে নিখোঁজ হয়ে গেছে। আর তাদের মুখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই ছায়াই যেন তাদের নিয়ন্ত্রণ করছে। অরিন্দম বুক ভরে শ্বাস নিল, কারণ সে বুঝল—এই ছায়ার মোকাবিলা না করলে আর ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না।

সাত

অরিন্দমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই নারীর ছায়া এক মুহূর্তে যেন গোটা গ্রামের শতাব্দীপ্রাচীন রহস্যের দরজা খুলে দিল। তার ভেজা সাদা শাড়ি, দীর্ঘ চুল, আর করুণ কণ্ঠস্বর মিলেমিশে এমন এক ভয়ের আবহ তৈরি করেছিল যে মনে হচ্ছিল বাতাসও থেমে গেছে। ঠিক তখনই গ্রামের বৃদ্ধা প্রতিমা-দিদিমার বলা গল্পগুলো অরিন্দমের মনে ফিরে এলো। বহু বছর আগে শ্যামলী নামে এক তরুণীকে নিয়ে অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটেছিল। গ্রামের মানুষ বলত, সে ছিল অনিন্দ্যসুন্দরী, যার সৌন্দর্যে অনেকের হিংসা জেগেছিল। কিন্তু আরও বড় কারণ ছিল তার প্রেমের কাহিনি। শ্যামলী ভালোবেসেছিল গ্রামের প্রভাবশালী জমিদারের ছেলেকে, অথচ সেই সম্পর্ক সমাজ মেনে নেয়নি। লোকেরা বলেছিল শ্যামলী অভিশপ্ত, তার ভালোবাসা অশুভ, আর সেই কারণে এক রাতে তাকে রহস্যময়ভাবে হারিয়ে যেতে হলো। কেউ বলত, সে নিজেই কূপে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে, আবার কেউ দাবি করত, তাকে হত্যা করে কূপে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যেটিই সত্য হোক, একটি বিষয় অস্বীকার করা যায় না—তার দেহ আর কখনো পাওয়া যায়নি।

এই হারিয়ে যাওয়া দেহই যেন কূপের অন্ধকারে বন্দি থেকে প্রতিদিন নতুন নতুন অভিশাপ ছড়িয়ে দিচ্ছে। অনেকেই বিশ্বাস করত, শ্যামলীর আত্মা শান্তি খুঁজে পায়নি, বরং প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে জ্বলতে কূপের গভীরে বন্দি হয়ে আছে। তার কান্না আসলে মুক্তির আর্তি নয়, বরং প্রতিশোধের শপথ। অরিন্দম যেন সেই অতীতের গল্পকে নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করছিল। তার কানে স্পষ্ট ভেসে এলো এক কিশোরীর চিৎকার—“আমাকে বাঁচাও… আমাকে ঠেলে দিল তারা…” তারপর হঠাৎ শব্দ মিলিয়ে গিয়ে আবার অশান্ত হাহাকার ভেসে উঠল। অরিন্দমের বুক ধকধক করে উঠল, কিন্তু তবুও সে পিছিয়ে আসতে পারল না। তার মনে হলো, এই কণ্ঠস্বর শুধু শ্যামলীর নয়, বরং সেই সব আত্মার, যারা বছরের পর বছর ধরে একে একে নিখোঁজ হয়ে গেছে। কূপের গভীরতা আসলে এক কবরস্থান, যেখানে দেহ নেই, আছে কেবল অশান্ত আত্মার ভিড়।

গ্রামের বয়স্করা সবসময় বলত, কূপ আসলে এক অভিশপ্ত দ্বার, যেখানে পৃথিবী আর পরলোকের সীমারেখা মিশে গেছে। একবার যদি কেউ সেই দ্বারের টান অনুভব করে, তবে আর মুক্তি মেলে না। শুভর মতো অনেকেই সেই দ্বারে ঢুকে গেছে, আর আর ফিরে আসেনি। এখন অরিন্দমের মনে হলো, সে নিজেও সেই টানের কবলে পড়ে গেছে। ছায়াটি বারবার তার দিকে হাত বাড়িয়ে বলছিল—“আমাকে মুক্তি দাও, আমাকে বের করো…” অথচ তার চোখের গভীর দৃষ্টি প্রকাশ করছিল অন্য কিছু—অদৃশ্য প্রতিশোধ, অন্তহীন রাগ, আর অশান্ত আত্মার ভয়াবহ তৃষ্ণা। অরিন্দম বুঝল, এই রহস্য উন্মোচন করা মানে শুধু এক নারীর আত্মাকে শান্ত করা নয়, বরং সেই অন্ধকার শক্তির মুখোমুখি হওয়া, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে গ্রামটিকে গ্রাস করে রেখেছে। কিন্তু তার মনে আরেকটি প্রশ্ন ভেসে উঠল—শ্যামলী কি সত্যিই মুক্তি চায়, নাকি প্রতিশোধের খেলা চালিয়ে যেতে চায় চিরকাল?

আট

অরিন্দম বুঝতে পারল, কূপের অন্ধকার কেবল এক নারীর কান্নায় সীমাবদ্ধ নয়—এখানে লুকিয়ে আছে অসংখ্য আত্মার আর্তনাদ, যাদের দেহ নেই, আছে কেবল বন্দি হয়ে থাকার অভিশাপ। সে চোখ বন্ধ করে বুক ভরে শ্বাস নিল, তারপর দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “তুমি যদি সত্যিই মুক্তি চাও, তবে আমাকে বলো কীভাবে।” কিন্তু ছায়াটি উত্তর দিল না। বরং তার লালচে চোখ আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল, আর এক শীতল কণ্ঠস্বর কানে বাজল—“তুমি আমার কাছ থেকে পালাতে পারবে না… তোমাকে আমারই হতে হবে।” এই কথা শুনে অরিন্দমের বুকের ভেতর হাহাকার জেগে উঠল। সে বুঝল, শ্যামলীর আত্মা তাকে মুক্তির হাতিয়ার নয়, বরং নতুন শিকার হিসেবে চাইছে। কূপ থেকে হঠাৎ গর্জন করে উঠল বাতাস, লণ্ঠনের শিখা নিভে গেল, চারপাশ ঢেকে গেল ঘোর অন্ধকারে। সেই অন্ধকারে অসংখ্য মুখ ভেসে উঠল—শুভ, আরও অচেনা যুবক, নারী, শিশু—যারা একে একে কূপের অভিশাপে হারিয়ে গেছে। তাদের সবার চোখ ফাঁকা, মুখে নিঃশব্দ আর্তনাদ, যেন তারা সবাই অরিন্দমকে সতর্ক করছে, আবার একইসাথে টেনে নিচ্ছে।

অরিন্দম মরিয়া হয়ে লণ্ঠনের ভাঙা কাচে রাখা দিয়াশলাই খুঁজে বের করল। কাঁপতে থাকা হাতে দিয়াশলাই জ্বালাতেই ক্ষীণ আলো ছড়িয়ে পড়ল। সেই আলোয় সে দেখল ছায়াটি তার একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভিজে সাদা শাড়ি থেকে জল ঝরছে, আর তার ঠান্ডা হাত প্রায় অরিন্দমের বুক ছুঁয়ে ফেলছে। অরিন্দম আতঙ্কে পিছিয়ে যেতে চাইলো, কিন্তু তার পা যেন মাটিতে গেঁথে গেছে। তখনই তার মনে পড়ল শহরে শোনা এক পুরোনো কাহিনি—অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা আত্মাদের প্রতিহত করার সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হলো আগুন। এক মুহূর্ত দেরি না করে সে দিয়াশলাই থেকে আগুন লণ্ঠনের তেলের অংশে ধরিয়ে দিল। মুহূর্তে চারপাশ আলোকিত হয়ে উঠল, আর আগুনের উজ্জ্বল আলোয় ছায়াটি চিৎকার করে উঠল। তার মুখ থেকে ভেসে এলো বিকট হাহাকার, যা বাতাসকে কাঁপিয়ে দিল। ছায়ার শরীর ধীরে ধীরে কুঁকড়ে যেতে লাগল, আর তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা অসংখ্য অশরীরীর মুখগুলো অস্বস্তিতে কেঁপে উঠল।

কিন্তু সংগ্রাম এখানেই থেমে রইল না। আগুনের আলোয় অরিন্দমের শরীর শক্তি ফিরে পেলেও, কূপের গভীরতা থেকে আরও অশুভ শক্তি বেরিয়ে আসতে শুরু করল। শ্যামলীর ছায়া আবারও রূপ নিতে লাগল, এবার আরও বিকট, আরও ভীষণ। তার মুখের চুল সরে গিয়ে প্রকাশ পেল চোখবিহীন এক ফাঁপা গহ্বর, যার ভেতর থেকে নিঃশব্দে ভেসে আসছিল অসংখ্য কান্না। অরিন্দম লড়াই চালিয়ে গেল, সে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করল—শৈশবে ঠাকুমার কাছে শেখা প্রাচীন শ্লোকগুলো। আগুন আর মন্ত্রের মিলিত শক্তিতে ছায়ার শরীর টালমাটাল হতে লাগল, যেন সে দুই দিক থেকে টেনে ধরা পড়েছে। তবুও তার আর্তনাদ থামছিল না। অরিন্দমের শরীর থেকে ঘাম ঝরছিল, শ্বাস দ্রুত হয়ে উঠছিল, কিন্তু তার মনে ছিল একটাই সংকল্প—যা-ই ঘটুক, সে এই অভিশাপকে ভাঙবেই। আর সেই সংকল্পই তাকে অদৃশ্য ভয়কে অতিক্রম করার সাহস দিল। কূপের চারপাশ কাঁপতে শুরু করল, ঝড়ের মতো বাতাস বইতে লাগল, গাছপালা ভেঙে পড়ছিল, আর গ্রামের অর্ধেক মানুষ ঘরে বসে আতঙ্কে চিৎকার করছিল। এই সংগ্রাম স্পষ্ট করে দিল—অরিন্দম শুধু এক আত্মার বিরুদ্ধে নয়, বরং প্রজন্ম ধরে জমে থাকা এক অশুভ শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করছে।

নয়

অরিন্দমের সংগ্রাম যেন এক অন্তহীন যুদ্ধে পরিণত হয়েছিল। আগুনের আলোয় চারপাশ ঝলমল করলেও কূপ থেকে বেরিয়ে আসা অশুভ শক্তির দম বন্ধ করা চাপা গর্জন থামছিল না। গ্রামের আকাশ ঢেকে গিয়েছিল কালো মেঘে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল, আর ঝোড়ো হাওয়ায় প্রতিটি গাছ মূর্তির মতো দুলছিল। মানুষজন ঘরে বসে দরজা-জানালা বন্ধ করে আতঙ্কে কেঁপে উঠছিল, কেউ প্রার্থনা করছিল, কেউ আবার কাঁদছিল। আর কূপের ধারে দাঁড়িয়ে অরিন্দম নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে লড়ছিল। তার হাতে জ্বলতে থাকা আগুনের আলো মুহূর্তের জন্য ছায়াগুলোকে পিছু হটাচ্ছিল, কিন্তু যতবার সে একটিকে প্রতিহত করত, ততবার কূপের ভেতর থেকে নতুন অশুভ আকৃতি বেরিয়ে আসত। তাদের মধ্যে কেউ ছিল শিশু, কেউ বৃদ্ধ, কেউ আবার মধ্যবয়সী নারী—সবাই সেই ভয়ঙ্কর শূন্য চোখ নিয়ে অরিন্দমকে ঘিরে ধরছিল। মনে হচ্ছিল পুরো গ্রামের ইতিহাস একসাথে বেরিয়ে এসে তাকে গ্রাস করতে চাইছে।

হঠাৎ কূপ থেকে শ্যামলীর ছায়া আরও ভীষণ রূপ নিয়ে বেরিয়ে এলো। এবার তার সাদা শাড়ি রক্তে ভেজা মনে হচ্ছিল, আর তার লম্বা চুল ছড়িয়ে ছিল ঝড়ো বাতাসে। তার চোখের গহ্বর থেকে নিরন্তর কান্নার শব্দ বেরোচ্ছিল, আর সে চিৎকার করে বলল—“আমার বেদনা কেউ বোঝেনি! তোমরা সবাই আমাকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছো!” তার চিৎকারে মাটি কেঁপে উঠল, কূপের চারপাশ ফেটে ফেটে যেতে লাগল। অরিন্দম বুঝল, এই রাত শুধু তার জন্য নয়, গোটা গ্রামের ভাগ্য নির্ধারণ করবে। সে সমস্ত ভয় সরিয়ে রেখে নিজের ভেতরের শক্তিকে আহ্বান করল। মন্ত্রোচ্চারণ আরও দ্রুত হলো, আর আগুনের শিখা তার হাতে অদ্ভুত এক দীপ্তি ছড়িয়ে দিল। মনে হচ্ছিল, আগুন কেবল আলো নয়, বরং এক অদৃশ্য শক্তির প্রতীক হয়ে উঠেছে। শ্যামলীর ছায়া হাহাকার করে ঝাঁপিয়ে পড়ল, কিন্তু অরিন্দম সেই আগুন উঁচিয়ে ধরতেই তার শরীর দাউদাউ করে কেঁপে উঠল। মুহূর্তে চারপাশের অন্যান্য ছায়ারাও আর্তনাদ করে পিছু হটল, তবুও তারা পুরোপুরি হারিয়ে গেল না।

রাত গভীর হচ্ছিল, আকাশে পূর্ণিমার আলো মেঘের ফাঁক দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ বেরিয়ে আসছিল। সেই আলো পড়তেই কূপ থেকে নির্গত অন্ধকার কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ছিল। অরিন্দম বুঝল, প্রকৃতিও তার লড়াইয়ে অংশ নিয়েছে। সে চিৎকার করে মন্ত্রোচ্চারণ চালিয়ে গেল, আগুন জ্বালিয়ে রাখল, আর নিজের বুকের ভেতর থেকে সাহসকে জাগ্রত রাখল। শ্যামলীর ছায়া ক্রমশ নিস্তেজ হতে লাগল, তার হাহাকার মিইয়ে এল, আর আশেপাশের অসংখ্য অশরীরী মুখ অদৃশ্য হতে শুরু করল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে শ্যামলীর কণ্ঠস্বর আবার ভেসে এলো—“আমার প্রতিশোধ শেষ হয়নি… কেউ মুক্তি পাবে না…”। এই বলে তার শরীর হঠাৎ ছিন্নভিন্ন হয়ে কূপের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। চারপাশে এক ভয়ার্ত নীরবতা নেমে এলো। গ্রাম যেন নিশ্বাস ফেলে শান্ত হলো, কিন্তু অরিন্দম জানল—এটা ছিল শুধু যুদ্ধের একটি অধ্যায়। অভিশাপ ভাঙেনি, কেবল ক্ষণিকের বিরতি এসেছে। আর সেই উপলব্ধিই তার বুকের ভেতর এক অজানা আতঙ্কের পাশাপাশি নতুন দৃঢ়তাও জন্ম দিল।

দশ

অরিন্দম ক্লান্ত দেহে কূপের ধারে বসে পড়েছিল। তার বুক দমে দমে উঠছিল, হাতে ধরা আগুন প্রায় নিভে আসছিল, আর চারপাশে হাহাকারময় নীরবতা ভেসে বেড়াচ্ছিল। রাতের ঝড় তখনও থামেনি, তবে তার তীব্রতা অনেকটা কমে গিয়েছে। মনে হচ্ছিল, চারদিক যেন অপেক্ষা করছে শেষ মুহূর্তটির জন্য। কূপের অন্ধকার গভীরে এখনও এক অদৃশ্য টান ছিল, যার ভেতর থেকে ভেসে আসছিল ক্ষীণ কান্না। অরিন্দম বুঝল, শ্যামলীর আত্মা সম্পূর্ণভাবে মিলিয়ে যায়নি, কেবল আংশিকভাবে দুর্বল হয়ে ফিরে গেছে। কিন্তু এভাবেই যদি রাত শেষ হয়, তবে অভিশাপ কখনোই ভাঙবে না। গ্রামের শতবর্ষের অশান্তি আবার নতুন করে মাথা তুলবে। সে উঠে দাঁড়াল, চোখ বন্ধ করে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল—যা-ই হোক, সে এই অভিশাপের সমাপ্তি ঘটিয়েই ছাড়বে।

হঠাৎ পূর্ণিমার আলো এক ফাঁক দিয়ে কূপের গভীরে পড়ল, আর সেই আলোয় অরিন্দম দেখল অসংখ্য মুখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। শুভও তাদের মধ্যে ছিল—তার চোখে ছিল এক অদ্ভুত শান্তি, যেন সে মুক্তির অপেক্ষায় আছে। অরিন্দম বুকের ভেতর জোয়ারের মতো আবেগ অনুভব করল। তার কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল, কিন্তু তবুও দৃঢ়ভাবে মন্ত্র উচ্চারণ করল। আগুন নিভে যাওয়ার আগে সে নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে কূপের ভেতরে তা নিক্ষেপ করল। মুহূর্তেই শিখা বিস্ফোরণের মতো জ্বলে উঠল, আর চারপাশ কাঁপিয়ে অন্ধকার ফেটে যেতে লাগল। কূপের ভেতর থেকে শোনা গেল বিকট হাহাকার—শ্যামলীর শেষ চিৎকার, যা যেন গোটা আকাশ ছিঁড়ে ফেলল। কিন্তু সেই চিৎকার ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল, আর তার জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল এক প্রশান্ত নীরবতা। অসংখ্য আত্মার মুখ ভেসে উঠল, তারা যেন একে একে প্রণাম জানিয়ে আলোয় মিশে গেল। শুভর হাসিমাখা মুখও অরিন্দমের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হলো। অরিন্দম বুঝল, তাদের মুক্তি মিলেছে।

প্রভাতের আলো ফুটতেই গ্রাম যেন নতুন করে জন্ম নিল। ঝড় থেমে গিয়েছে, গাছপালা ভিজে ঝলমল করছে, পাখির কণ্ঠস্বর ফিরে এসেছে। মানুষজন ঘর থেকে বেরিয়ে এসে কূপের দিকে তাকিয়ে দেখল—অরিন্দম দাঁড়িয়ে আছে ক্লান্ত কিন্তু দৃঢ় চোখে। তারা বুঝতে পারল, অরিন্দম এক অসম্ভব লড়াই জয় করেছে। প্রতিমা-দিদিমা কেঁদে ফেললেন, আর গ্রামের পুরুষরা মাথা নত করল কৃতজ্ঞতায়। তবে অরিন্দম জানত, এটা কেবল তার জয়ের গল্প নয়। এটা শ্যামলীর আত্মার মুক্তি, আর সেই সঙ্গে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসা অভিশাপের অবসান। কূপ এখনো গ্রামে আছে, কিন্তু তার অন্ধকার আর ভয়ের প্রতীক নয়—বরং মুক্তির স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অরিন্দম চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল, পূর্ণিমার আলোয় মিশে যাওয়া মুখগুলো তার মনে গভীর ছাপ রেখে গেল। সে জানত, এই অভিজ্ঞতা তাকে চিরদিন তাড়া করবে, তবে একটাই সান্ত্বনা রইল—অন্ধকার কূপের ডাক আর কোনোদিন ভয় হয়ে ফিরে আসবে না।

শেষ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *