Bangla - ভূতের গল্প

অন্তহীন অন্ধকারে

Spread the love

অনির্বাণ ঘোষ


অদ্ভুত ধ্বনি

গাঁয়ের শেষ সীমানায়, ঘন জঙ্গল আর বুনো পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল বহুতলা ভুতের বাড়ি, যেখানে কোনোদিন মানুষের পা পড়েনি। গাঁয়ের বয়স্করা বলতেন, “এ বাড়ি শাপিত, এখানে বাস করা লোকের ভাগ্য বিপর্যস্ত।” কিন্তু আধুনিক যুবকরা এসব অন্ধবিশ্বাসকে গা ছেড়ে দিয়েছিল, আর তার মধ্যে এক জন ছিল আরিফ। এক রহস্যপ্রেমী সাংবাদিক, যিনি শহর থেকে এই গ্রামে এসেছিলেন কিছু অদ্ভুত ঘটনা অনুসন্ধান করতে।

আরিফের প্রথম দিনের সন্ধ্যায় যখন সূর্য পশ্চিম আকাশে অস্ত যাচ্ছিল, তখন গাঁয়ের বাজারের এক কনফেকশনারি দোকানে বসে শুপ্রা নামক এক স্থানীয় মেয়ের সাথে পরিচয় হলো। শুপ্রা কথায় কথায় বলল, “আপনি কি বহুতলা ভুতের বাড়ি সম্পর্কে জানেন?”

“জানি, অনেক শুনেছি। কিন্তু বিশ্বাস করি না। কী আর এমন বিশেষত্ব?” আরিফ উত্তর দিল।

শুপ্রা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল, “এ বাড়ির ইতিহাস অনেক পুরোনো। শোনা যায়, এখানে এক সময় ছিল এক গবেষক, যার কাজ ছিল মৃতদের জীবনের গল্প সংগ্রহ করা। আর এই বাড়ির ভিতরে রয়েছে একটা খাতা, যেটা একবার যদি কেউ খুলে ফেলে, সে সমস্ত মৃতদের আত্মাকে পুনরায় জীবিত করে তোলে। আপনি যদি বিশ্বাস না করেন, তাহলে একদিন এ বাড়িতে গিয়ে দেখে আসুন। আমি জানি, আপনি কখনও ফিরবেন না।”

আরিফ প্রথমে এই কথাগুলো একেবারে অবাস্তব মনে করেছিল, তবে শুপ্রার চোখের মধ্যে যে এক অজানা ভীতি ছিল, তা তাকে ভাবতে বাধ্য করল। “ঠিক আছে, যদি সত্যি থাকে, তাহলে আমি গিয়ে দেখব। কিন্তু আপনি কি যেতে পারবেন না?”

শুপ্রা চোখ নামিয়ে বলল, “আমি পারব না। কারণ, আমার পূর্বপুরুষদের সাথে এক ভয়ানক ঘটনা ঘটেছিল ওই বাড়িতে। আমি জানি, যদি সে খাতা খোলা হয়, তাহলে তাদের আত্মা আবার ফিরতে শুরু করবে। আর আমার মধ্যে এক অদ্ভুত শক্তি রয়েছে যা আমাকে এ বাড়ি থেকে দূরে রাখে।”

আরিফের কৌতূহল আরো বেড়ে গেল। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে পরের দিন, দিনের আলো ফুরানোর আগে, ওই পুরোনো বাড়িটিতে গিয়ে নিজের চোখে দেখবেন।

সে রাতে, বাড়ির অদূরে, এক অদ্ভুত হাওয়া উঠেছিল। গাছপালা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, আর বাতাসে এমন কিছু শব্দ ভেসে আসছিল, যা কোনো মানুষ স্বাভাবিকভাবে শোনেনি। আরিফ শুপ্রাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “এটা কী?”

শুপ্রা কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, “এ ধরনের শব্দই শোনা যায়, কিন্তু কেউ কখনো জানতে পারে না এর উৎস। হয়তো বাড়ির ভিতর কিছু রয়েছে যা আমাদের থেকে অনেক দূরে। কেউ ফিরে আসে, কেউ আবার চলে যায়।”

আরিফ হাসল, “এ সব তো পুরোনো কাহিনী। আমি যাচ্ছি পরের দিন, দেখি এর পেছনে কী সত্যি রয়েছে।”

পরের দিন, আরিফ হাতে ক্যামেরা নিয়ে গাঁয়ের দিকে চলে গেল। সময় ছিল বিকেল, গোধূলি লগ্নে, আর বহুতলা ভুতের বাড়ি ঠিক তার সামনে ছিল। এই বাড়ির বিশাল কাঠামো যেন এক যুগান্তরের নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। জানালা গুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত, ছাদে বড় বড় ফাটল। আরিফ বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে লাগল, কিন্তু কিছুটা ভয় তার মধ্যে বাড়ছিল।

বাড়ির প্রবেশদ্বারে পৌঁছানোর আগে, তিনি শুনলেন এক হালকা হাসির শব্দ। হঠাৎ মাথার উপরে ছাদের একটি টুকরো সরে গিয়ে তাঁর দিকে পড়ল। আরিফ তাড়াতাড়ি সরে গিয়ে পাশের গাছের তলায় দাঁড়াল। কিছুক্ষণ পর, ঘরের ভিতর থেকে একটা মৃদু গড়গড় শব্দ ভেসে আসছিল। আরিফের মন একেবারে সাড়া দিয়ে উঠল।

সে আর দেরি না করে দরজা খুলল। ভেতরে অন্ধকার ছিল, তবে কিছুটা আলো ভেতর থেকে আসছিল। একটা পুরনো খাট, কিছু ভাঙা চেয়ার, এবং খাটের এক কোণে পড়ে থাকা একটা পুরোনো খাতা ছিল। খাতাটা ছিল অদ্ভুতভাবে একেবারে নতুন, অথচ বাড়ির দীর্ঘদিনের অব্যবহৃত অবস্থায়, তা কিভাবে এত ভালো অবস্থায় ছিল?

আরিফ সামনে এগিয়ে গিয়ে খাতা তুলে নিল। ঠিক তখনই, অদ্ভুতভাবে এক অন্ধকার ছায়া তার সামনে এসে দাঁড়াল। “এটা তো… এটা কি করছো তুমি?” সেই ছায়াটি রূঢ় গলায় বলল।

আরিফ হড়বড়ে হয়ে গেল, খাতা সজোরে বন্ধ করল এবং পিছনে সরে যেতে লাগল। তার চোখের সামনে কিছু মুহূর্তের জন্য দেখা গেল এক ভূতী আভা, যেন সে তার দিকে এগিয়ে আসছে।

“আমি তোমার সাথে কোনো বিশ্বাসঘাতকতা করতে চাই না, তবে এই খাতা… তোমাকে এখানে আসতে দেব না। তোমার সাথে যা ঘটবে, সেটা তোমার কপালে লিখে রাখা হয়েছে।”

আরিফকে ছায়াটি গাঢ়ভাবে বলল এবং সমস্ত দৃষ্টি মুহূর্তে অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

এটা কি একটি প্রতারণা ছিল? অথবা সত্যিই কিছু অজানা শক্তি তার অপেক্ষায় ছিল?

অন্ধকারের ডেরা

আরিফের বুকের মধ্যে এক অদ্ভুত চাপ অনুভূত হচ্ছিল। ভুতের বাড়ির ভেতরে তাঁর সবার চেয়ে বড় ভয় ছিল, কিন্তু আজকের ঘটনা তা যেন নতুন মাত্রা দিল। ওই অন্ধকার ছায়ার কথাগুলো সে মনের মধ্যে গেঁথে ফেলেছিল। “তোমার সাথে যা ঘটবে, সেটা তোমার কপালে লিখে রাখা হয়েছে…” ছায়াটি কী বলতে চাইছিল? আরিফ বুঝতে পারছিল না, তবে তার কিছু না করার সুযোগ ছিল না। খাতা, যা সে তুলে নিয়েছিল, সেটা যেন সমস্ত রহস্যের কেন্দ্রে ছিল। যদি সেটা খোলার পর কিছু ঘটত, তবে তার পরিণতি কী হতে পারত?

সে খাতা বন্ধ করে এক পাশে রেখে দিল। ভয় ভরপুর ছিল তার দেহে, তবে কৌতূহল তাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। কি সেই অদৃশ্য শক্তি যা তাকে এই বাড়ির দিকে টেনে নিয়ে এসেছে? সে জানতো না, কিন্তু তার মন কোনোরকম শান্তি পেতে চাচ্ছিল না।

আরিফ ঘরের মধ্যে এগিয়ে গিয়েছিল। বাইরে ঝড়ো বাতাস চলছিল, আর তার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন তার অন্তরে অজানা আশঙ্কা তৈরি করছিল। বাড়ির প্রতিটি কোণায় এক ধরণের অলৌকিক অশান্তি বয়ে চলছিল। দরজা, জানালা সবই দুলছিল, আর পেছনে সিঁড়ির নিচে কিছু কাঁপাকাঁপি শুনতে পাচ্ছিল। কিছু একটা ছিল, সে সেটা অনুভব করতে পারছিল।

“এই বাড়ি… কেন আমার এমন অনুভূতি হচ্ছে?” আরিফ নিজেকে প্রশ্ন করছিল, যেন কিছু অদৃশ্য চোখ তাকে লক্ষ্য করছে। প্রতিটি শব্দ যেন অসহনীয় হয়ে উঠছিল, প্রতিটি নিঃশ্বাস তার কাছে আরও ভারী হচ্ছিল।

তিনি সামনে এগিয়ে গিয়েছিলেন, আর ঘরের দেয়ালে পুরনো লেখার ঝাঁকি দেখে তাজ্জব হয়ে গেলেন। সেই লেখাগুলোর মধ্যে এক অদ্ভুত ভাষা ছিল। একটি লেখা তার চোখে পড়ল, যা আগের কোনও ভাষা নয়। তবে কিছু শব্দ ছিল যা সে বুঝতে পারছিল। তা ছিল কিছু নাম, কিছু সংখ্যা, আর একটা আশ্চর্যজনক তারিখ, প্রায় একশো বছর পুরনো।

আরিফ সামনে এগিয়ে গিয়ে লেখাগুলো ভালো করে দেখল। লেখাগুলোর মধ্যে কিছু অক্ষর এতটাই অদ্ভুত এবং অচেনা ছিল যে তিনি ভেবেছিলেন তা কোনো শিলালিপির অংশ হতে পারে। কিন্তু এটি কীভাবে এখানে, পুরনো বাড়ির দেয়ালে, সংরক্ষিত ছিল?

ঠিক তখনই তার মনে পড়ল, শুপ্রা তাকে বলেছিল যে এই বাড়িতে একটি খাতা রয়েছে, যে খাতা মৃতদের আত্মাকে জীবিত করে তোলে। আরিফের মনে সন্দেহ ঢুকে পড়ল। এটা কি সেই খাতা, যা সে পেয়ে গেছে? এবং যদি তা হয়, তবে এর আসল রহস্য কী?

তার চিন্তা ছিন্ন করতে সেই মুহূর্তে বাড়ির ভিতর থেকে আরেকটি শব্দ ভেসে আসল। শব্দটা খুব মৃদু ছিল, তবে আরিফ সঠিকভাবে শুনতে পেরেছিল—একটি গভীর গড়গড়ি। শব্দটা আসছিল ভেতরের কোনো কোণ থেকে। সে সেখান থেকে চলে যেতে চাইল, কিন্তু কিছুতেই সে নিজেকে সরাতে পারছিল না।

তবে হঠাৎ, সেই গড়গড়ি শব্দের মাঝে অন্য একটি শব্দ ভেসে আসল—একটি নাম। “বিহারী…”

“বিহারী?” আরিফ এক মুহূর্তে থেমে গেল। এ শব্দের মধ্যে কেমন যেন একটা পরিচিতি ছিল। কেন এমন মনে হচ্ছে যে এই নাম তাকে চিনিয়ে দিচ্ছে?

“বিহারী…” শব্দটা আরও জোরালো হয়ে উঠেছিল। আরিফ ঘরটির এক কোণায় গিয়ে দাঁড়াল এবং লক্ষ্য করল, দেয়ালটি যেন কিছুটা সরে গেছে। এমনকি তিনি দেখতে পেলেন একটি গোপন দরজা, যা এতদিন সবাই উপেক্ষা করেছিল। দরজাটা অদৃশ্য হয়ে ছিল, তবে যেন কারও চোখে পড়েনি।

“এটা কি নতুন কিছু?” আরিফ মিউট করে ভাবল।

সে দরজাটি খুলে ভেতরে ঢুকল। ভেতরের পরিবেশ ছিল অনেকটা অন্ধকারে মোড়া। বাতাসের শীতলতা একে একে তার শ্বাসে ভর করছিল। কোনো শব্দ ছিল না, শুধু এক ধরনের স্তব্ধতা। কিন্তু সেখানে একটি বস্তু ছিল, একটি টেবিলের উপর, এবং তাতে ছিল সেসব বই, খাতা, আর চিঠিপত্র, যা যেন এতদিন এখানে রাখা হয়েছিল।

আরিফ একে একে বইগুলো ফেলে দেখে, কিন্তু একটা খাতা, অন্য সব থেকে আলাদা ছিল। সেটা যেন অন্য রকমই ছিল। সেই খাতা ছিল পুরনো, তার গায়ের কভারের মধ্যে কেমন একটা অদ্ভুত চিহ্ন ছিল, যা আরিফের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। নামটার সাথে কি কোনো সম্পর্ক ছিল?

সে খাতাটি হাতে নিয়ে তন্নতন্ন করে দেখতে লাগল। এর মধ্যে লেখা ছিল অনেক অদ্ভুত নাম, এবং সেই নামগুলোর পাশে কিছু সংখ্যা এবং তারিখ লেখা ছিল। আরিফ ভাবতে লাগল, এটা কি সেই খাতা?

অদ্ভুত ভাবে, যখন সে প্রথম খাতা খুলল, তখন তার কাছে আবার সেই গড়গড়ি শব্দ আসল। এই সময় আরিফের কাছে মনে হয়েছিল যেন সেই অদৃশ্য শক্তি তাকে অবিশ্বাস্যভাবে আকর্ষণ করছে।

“এটা কি আমি করতে যাচ্ছি?” মনে মনে আরিফ নিজেকে প্রশ্ন করেছিল।

আত্মার কাঁপন

আরিফ খাতা খুলতে সেদিন কিছুটা ভয় পেয়েছিল। সে জানত, এই মুহূর্তেই হয়তো কোনো অশুভ শক্তি তাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে আসবে। খাতার পাতাগুলো তার হাতের মধ্যে খুবই ভারী লাগছিল। যদিও তার মন কিপর্যন্ত এই রহস্যের শেষ না দেখতে, তবে সে পেছনে ফিরে যেতে পারছিল না। যেন কিছু একটা তাকে বাধ্য করছিল এই খাতা হাতে নিতে।

যতই সে পৃষ্ঠা উলটে যেতে লাগল, ততই একটি অদ্ভুত অনুভূতি তার ভেতরে বাড়ছিল। একদিকে যেমন মনে হচ্ছিল, সে কিছু গোপন রহস্য আবিষ্কার করছে, অন্যদিকে এক অজানা ভয় তার অন্তরকে চেপে ধরছিল। একসময় খাতার পৃষ্ঠাগুলি নেমে গিয়ে, একটি নামের উপর এসে থামল: বিহারী

“বিহারী…” এই নামটির সঙ্গে এক অদ্ভুত পরিচিতি অনুভব করল আরিফ। তার দৃষ্টিতে যেন এক ঝলক স্মৃতি ফিরে এল, যা খুব ম্লান ছিল। সেও কি এই নাম জানতো?

এবং তার পরেই খাতার আরেকটি পৃষ্ঠা খুলল। সেখানে লেখা ছিল, “যে কেউ এই নাম উচ্চারণ করবে, সে প্রত্যক্ষ করবে অতীতের সব অনুভূতি, প্রত্যেক ক্ষণ, প্রত্যেক গোপন সত্যের মুখোমুখি হবে।”

আরিফ শ্বাস টানতে ভুলে গেল। একটি অদ্ভুত শীতলতা সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। খাতার পৃষ্ঠা উল্টাতে গিয়ে, এক সময় আরিফ দেখতে পেলো একটি অদ্ভুত ছবি। ছবির মধ্যে ছিল এক যুবক, যার চোখে একটি গভীর দুঃখের ছায়া ছিল। ছবিটি দেখে তার মনে হল, সে যুবক হয়তো অনেকদিন আগে এই বাড়ির অধিবাসী ছিল। কী সম্পর্ক ছিল তার সাথে?

আরিফ ছবিটি ভালোভাবে দেখল, তারপর খাতার একটি পৃষ্ঠায় চোখ পড়ল। সেখানে লেখা ছিল:

বাড়ির প্রতিটি কোণার মধ্যে, মৃতদের আত্মা বিচরণ করে, তাদের জীবনযুদ্ধের প্রতিটি চিহ্ন ছড়িয়ে আছে।”

এবং সেই মুহূর্তে, আকাশে বজ্রপাতের মতো একটি বিকট আওয়াজ শোনা গেল। সমস্ত বাড়ি কাঁপতে শুরু করল। আরিফের চোখে অন্ধকার নেমে এল। হঠাৎ তার মনে পড়ল, শুপ্রা তাকে বলেছিল, এই বাড়ি একসময় মৃত্যুর সাক্ষী হয়েছিল। যারা এখানে বাস করত, তাদের সবাই অদ্ভুতভাবে চলে গিয়েছিল।

অন্ধকারে, সেই মুহূর্তে কিছু একটা ঠিকই চলছিল, যেন মৃতরা ফিরে আসছিল। আরিফ মাথা নিচু করে ফেলল। তার চারপাশে শীতল বাতাস বইছিল, আর আকাশে অসংখ্য অদ্ভুত আকারের মেঘ জমে যাচ্ছিল। যেন এ বাড়ি, এ জায়গা, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল।

এতক্ষণে, আরিফ বুঝতে পারছিল যে সে একদিকে যেমন ওই খাতার রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করছে, অন্যদিকে সে সেই রহস্যের আগুনে নিজেকেই পোড়াচ্ছে। কিন্তু এর পেছনে আসল সত্য কী? বিহারী নামে ওই যুবক, তার জীবনের অন্ধকারের পেছনে কি কিছু ছিল?

আরিফের মাথায় তখন এসব প্রশ্ন ঢুকে যাচ্ছিল। কিন্তু সে আর পিছু হটল না। সেও মনে মনে ঠিক করেছিল, এ বাড়ির প্রতিটি রহস্য উন্মোচিত করতেই হবে।

এদিকে, বাড়ির অন্য অংশে, দূর থেকে শুপ্রার মনে সেই দিনটির স্মৃতি ফিরে আসছিল। তার চোখে বিষন্নতা ছিল। কেন সে আরিফকে সতর্ক করেছিল? কেন তাকে এই পুরনো বাড়িতে আসতে বাধা দেয়নি? তার মন যেন পেছনের কিছু স্মৃতি আঁকড়ে ধরে রেখেছিল, যেগুলো সে কখনো ভুলতে পারছিল না। শুপ্রা জানত, এই বাড়ির অন্ধকারে তার পরিবারের শেকড় জড়িয়ে রয়েছে, আর আজও কেউ তার অজান্তে সেই শেকড়ের মধ্যে ফিরে যাচ্ছে।

এক অদৃশ্য ভয় তার সমস্ত শরীরকে ব্যথিত করছিল। শুপ্রা জানত, খাতা যদি পুরোপুরি খোলা হয়, তাহলে এক অজানা আত্মা, এক পুরনো গোপনীয়তা, আর সেই মৃত যুবক বিহারী তার আছড়ে পড়বে। আর সেই সময় শুপ্রা বাকি রহস্য জানার চেষ্টা করল। কিন্তু তাকে এড়াতে হবে। সে জানত, আরিফকে আর সেখান থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব ছিল না।

আরিফ বাড়ির এক কোণে দাঁড়িয়ে খাতার প্রতিটি পৃষ্ঠা দেখতে লাগল। তার চোখে যেন এখন মৃত্যু আর জীবনের মধ্যে এক অনিশ্চিত অন্তরাল ছিল। কিন্তু সে কি বুঝতে পারছিল—যে সত্য সে জানতে চাচ্ছিল, তা কি তাকে এক অন্ধকার পথে টেনে নিয়ে যাবে?

এই সময়, আবার সেই গড়গড়ি শব্দ ভেসে এল। এক ধরনের অশুভ চাপ আরিফকে চেপে ধরেছিল। আকাশের মেঘ আরও ঘন হয়ে উঠছিল, আর ঘরটি যেন শীতল হতে শুরু করেছিল। আরিফ একে একে খাতার পৃষ্ঠাগুলি ফেলে ফেলছিল, যেন তার কাছে কোনো গোপন শক্তি ছিল যা সে জানত না।

বিহারীর ছবি সামনে এসে দাঁড়াল। ছবিটি যেন তার দিকে তাকিয়ে ছিল, আর তার মধ্যে অদ্ভুত এক গাঢ় শূন্যতা ছিল। আরিফ যেন বুঝতে পারছিল, এটা শুধুমাত্র একটি ছবি নয়, বরং একে জীবন্ত করতে একটা গোপন শক্তি কাজ করছে।

অন্ধকারের চোখ

আরিফের শ্বাস আটকে যাচ্ছিল। তার হাতের খাতা এখন জীবন্ত ছিল, যেন প্রতিটি পৃষ্ঠা তার চোখের সামনে আরো বেশি অন্ধকারের আবরণ গড়ছিল। বিহারীর ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতেই তার মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি উদিত হল—এটা শুধু ছবি নয়, এটি যেন এক জীবিত সত্ত্বার দৃষ্টি। সেই দৃষ্টি, যা তার নিজের দিকে তাকিয়ে ছিল। আরিফ অনুভব করল, ছবিটি তাকে সরাসরি দেখছে। একটি চাপা ভয়ের অনুভূতি তাকে গ্রাস করল।

সে খাতা সরিয়ে পাশের টেবিলের উপর রাখল এবং গভীরভাবে ছবি থেকে চোখ ফিরিয়ে নিল। কিন্তু হঠাৎ, তার চারপাশে এক অদ্ভুত হালকা ঝিলিক দেখা দিল। রুমের কোণ থেকে হালকা একটি আলো বের হতে শুরু করল। এটি ছিল কোনো প্রাকৃতিক আলো নয়, বরং অদ্ভুত এক মায়াবী আলো, যা তাকে অচেতনভাবে আকর্ষণ করছিল।

আরিফ সরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল, কিন্তু তার পা যেন মাটি থেকে সরে না। তাকে অদৃশ্য শক্তি একে একে আরো কাছে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। একটা শীতল হাত যেন তার কাঁধে পড়ল, আর সেই মুহূর্তে ভেতরের অন্ধকার থেকে একটা গভীর গর্জন বের হলো। যেন কোনো শক্তি, কোনো আত্মা, তার ভেতরে প্রবেশ করতে চাচ্ছিল।

সে চিৎকার করল, কিন্তু তার গলা যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। কানের মধ্যে একটা ভারী শব্দ ধ্বনিত হচ্ছিল, আর মনে হচ্ছিল, তার শরীরের প্রতিটি কোষ সেই শব্দের সাথে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। কিছুক্ষণের জন্য, সে কিছুই বুঝতে পারছিল না। তবে, ঠিক তখনই, এক ঝলক প্রজ্বলিত চোখ তাকে দেখতে পেল—বিহারী।

এবার আরিফ দৃঢ়তার সাথে খাতাটি আবার হাতে নিল এবং তার মধ্যে পাতা উল্টাতে লাগল। প্রথমেই তাকে বিহারীর নাম দেখতে হলো। সে যতটা সম্ভব তার আতঙ্ককে দূরে রেখে, পাতা উল্টাতে থাকল। প্রতিটি পাতার মধ্যে যেটি ছিল তা হলো, একেকটি অক্ষর যা সে পড়তে পারছিল না। সেই অক্ষরগুলো যেন এক অদ্ভুত ভাষা—যে ভাষা কখনো পৃথিবীতে ছিল না। সেই ভাষা তাকে অদৃশ্যভাবে আকর্ষণ করছিল, যেন সে কিছু বিশেষ বার্তা পাচ্ছিল।

“এটা কী? কেন এই অক্ষরগুলো এত অস্বাভাবিক?” আরিফ নিজেকে প্রশ্ন করছিল। তবে ঠিক তখন, খাতার পাতা একটি অদ্ভুতভাবে ঘুরে গেল, আর সে একটি নাম দেখতে পেল—বিহারী’আত্মা, যিনি এখানে আটকে রয়েছেন।’

আরিফের মস্তিষ্কে যেন বিদ্যুৎ চমকালো। এই কি বিহারী? সে কি এখানে আটকে রয়েছে? যদি এমনটা হয়, তবে এই বাড়ি, এই পুরনো খাতা, সব কিছুই সে একেবারে ভুলভাবে বোঝে এসেছে!

সে আরও পাতা উল্টে দেখল। সেখানে লেখা ছিল—

যে কেউ বিহারীর নামে উচ্চারণ করবে, তার হৃদয়ে ভয় ঢুকবে। তার অবচেতন মন তাকে এই অন্ধকারে আটকে রাখবে, যতক্ষণ না সে রহস্য সমাধান করতে পারে। কেবল একমাত্র সৎ সাহসী আত্মাই এই ভূতনগরী থেকে মুক্তি পাবে।”

আরিফের হৃদয়ে কম্পন তৈরি হলো। “সৎ ও সাহসী আত্মা…” এই কথাগুলো তার উপর চাপ তৈরি করছিল। তার মনে হচ্ছিল, সে যেন একটা দুর্বোধ্য ভূতানুকূল দুনিয়ার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। এক তীব্র কাঁপুনি যেন শরীরের ভেতর এক ঝড়ের মতো দুলছিল।

সে নিজের মধ্যে শক্তি খুঁজতে চেষ্টা করছিল। “আমার কপালে কি সত্যিই কিছু লেখা আছে? যদি এটি সত্যি হয়, তবে আমি কীভাবে বেরোবো?” আরিফের মাথায় শুধুমাত্র একটাই প্রশ্ন ঘুরছিল।

ঠিক তখনই, খাতার পরবর্তী পাতার ভেতরে লেখা ছিল—

বিহারী এক সময় এখানে থাকতেন, এক সন্ন্যাসী হিসেবে। তার ছিল এক গভীর গোপনীয়তা, যা কখনো প্রকাশিত হয়নি। তিনি ছিলেন এক সময়ে এখানকার প্রতিটি ঘটনা রেকর্ড করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। কিন্তু তার এক ভুল সিদ্ধান্তই তাকে এই বাড়ির কঙ্কাল হয়ে দাঁড় করিয়েছে। সেই ভুল ছিল—একটি জীবিত আত্মাকে মৃতের মতো রেখে দেওয়া।”

আরিফ আবার খাতা বন্ধ করে দিল। তার মনে অসংখ্য প্রশ্ন। বিহারী এই বাড়িতে কী করেছেন? কেন তিনি এখানকার সমস্ত ইতিহাস রেকর্ড করেছেন? আর কেন তাকে এত শাস্তি ভোগ করতে হলো?

এই সময়, তার কানে আবার সেই গড়গড়ি শব্দ ভেসে এল। এবার শব্দটা এত তীব্র ছিল যে আরিফের মনে ভয় ঢুকে গেল। সে ঘর থেকে বের হতে চাইছিল, কিন্তু ঘরটি যেন তাকে আটকে রেখেছিল। দরজা খুলতে গেলে, এক শক্তিশালী বাতাস ভেতর থেকে আছড়ে পড়ল। আরিফ আবার ফিরে তাকাল। আর এবার, অন্ধকার থেকে কোনো কিছু এগিয়ে আসছিল।

সে চোখে তার ছবির অবয়ব দেখল—বিহারী। তবে এবার সে অদ্ভুতভাবে স্নিগ্ধ, যেন কোনো অতীতের প্রেতাত্মা থেকে ফিরে এসেছে। বিহারী তাকে এক পলক দেখল এবং তারপর মৃদু হাসি দিল। আরিফ কাঁপতে লাগল।

“তুমি কী চাও?” আরিফ ভয়ের সাথে বলল।

বিহারী হাসি থামিয়ে বলল, “আমি চাই তুমি জানো, আমার দোষ ছিল না। আমার জীবন ছিল ত্রুটি পূর্ণ, তবে যা ঘটেছে তা আমার হাতে ছিল না। তুমি যদি আমাকে মুক্তি দিতে চাও, তবে আমাকে মুক্তি দাও।”

এই কথাগুলোর মাঝে, তার শব্দ যেন এক চিলতে অন্ধকারে ঢুকে গেল। মুক্তি দাও…”

আরিফ কিছু না বুঝে সে খাতাটি আবার খোলার চেষ্টা করল।

মুক্তির সন্ধানে

বিহারীর চোখের দিকে তাকিয়ে, আরিফ যেন এক অদ্ভুত অনুভূতি অনুভব করল। মনে হচ্ছিল, সেই চোখের মধ্যে শুধু দুঃখ আর দীর্ঘদিনের বন্দিত্বের কষ্টের ইতিহাস ছিল। তার বুকের মধ্যে হঠাৎ করেই এক ভারী চাপ অনুভব হতে লাগল। বিহারী তাকে বারবার বলছিল, “তুমি আমাকে মুক্তি দাও,” কিন্তু কীভাবে?

“মুক্তি… তুমি কীভাবে মুক্তি চাও?” আরিফ অত্যন্ত সতর্কভাবে প্রশ্ন করল। তার গলা খানিকটা কাঁপছিল, কারণ সে জানত, এই বাড়ির অন্ধকারের মধ্যে কিছু এমন আছে যা সে এখনও পুরোপুরি বুঝতে পারেনি।

বিহারী একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল, “আমার আত্মা এই জায়গায় বন্দী। আমি জানি, যে খাতা তোমার হাতে, তা একমাত্র উপায়। তবে আমি একা এই খাতার রূপান্তর ঘটাতে পারব না। তুমি যে দৃষ্টিভঙ্গিতে আছ, তা পাল্টাতে হবে।”

“মানে?” আরিফ প্রশ্ন করল, তার মাথায় কিছু না কিছু ঝুলছিল।

বিহারী ধীরে ধীরে নিজের মুখের দিকে হাত রেখে বলল, “আমার নাম এখানে লেখা আছে। কিন্তু তুমি যদি শুধুমাত্র আমার নাম পড়ো, তবে কিছু হবে না। তোমাকে সেই ইতিহাস জানাতে হবে। তুমি যেভাবে এই বাড়ির রহস্য জানবে, ঠিক সেভাবেই আমাকে মুক্তি দিতে হবে। আমার নামের মধ্যে এক অতীত রয়ে গেছে। সেই অতীত আমাকে বন্দী করেছে।”

আরিফ ভাবল, সে ঠিক কী করতে পারবে। তবে, এক মুহূর্তের জন্য, তার মনে হল যে বিহারী তাকে কোনো ফাঁদে ফেলে দিচ্ছে। কিন্তু তার ভয়াবহতা, সেই অন্ধকার চোখ, আর তার কণ্ঠের গভীরতা তাকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিল—এটা কোনও সাধারণ গল্প নয়। এটি তার জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে।

“তোমাকে মুক্তি দিতে হবে, তাহলে আমি জানবো—তোমার নাম এবং ইতিহাস। তুমি যা বলেছ, আমি শুনতে প্রস্তুত। কিন্তু, আমি চাই তুমি আমাকে পুরোপুরি জানাও, সত্যটা কী ছিল?” আরিফ বলতে লাগল, নিজের আতঙ্কের অনুভূতি গোপন করে।

বিহারী কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তার পর সে গভীর কণ্ঠে বলতে শুরু করল, “এই বাড়ি ছিল এক সময়ের একটি সম্মানজনক স্থান। আমি, বিহারী, এক সময় ছিলাম একজন সন্ন্যাসী, যিনি সমস্ত গ্রামবাসীদের জীবনের ইতিহাস সংগ্রহ করতাম। আমার একমাত্র লক্ষ্য ছিল, মানুষের সুখ, দুঃখ, এবং সংগ্রাম রেকর্ড করা। কিন্তু একদিন, আমি ভুল একটি সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি একটি আত্মাকে, যে জীবিত ছিল, তাকে মৃতের মতো রেকর্ড করলাম। এটি ছিল আমার সবচেয়ে বড় ভুল।”

আরিফ আরও এগিয়ে গেল। “একটি আত্মাকে মৃত হিসেবে রেকর্ড করতে কী হয়েছিল? তুমি কি বলতে চাচ্ছো যে… তুমি কাউকে হত্যা করেছিলে?”

বিহারী হেসে দিল। “না, না। আমি হত্যা করিনি। তবে আমার রেকর্ডে তার জীবনকে মৃতের মতো করেছিলাম। আমি জানতাম না যে এটি আমাকে শাস্তি দেবে, কিন্তু সেই আত্মা আমাকে এবং এই বাড়ির সবাইকে শাস্তি দিয়েছে। তার প্রভাবেই, এই বাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে। আর সেই আত্মা এখন এই বাড়ির মধ্যে বন্দী, আমার সাথে।”

আরিফের মনে শঙ্কা তৈরি হল। “তাহলে, তুমি সেই আত্মার শাস্তি ভোগ করছো? আর এই বাড়িতে, তার গায়েও এই আবদ্ধতা রয়েছে?”

“হ্যাঁ। আমি তার নাম লিখেছিলাম, তাকে রেকর্ড করেছিলাম—মৃত বলে। তবে, সে জীবিত ছিল। তার সাথে যে সম্পর্ক ছিল, তা আমি বুঝতে পারিনি। সে আত্মা আমাকে শাস্তি দিচ্ছে, আর তার প্রভাবেই আমি এই বাড়িতে বন্দী। কিন্তু এখন, তুমি যদি সত্যি চাই, তুমি যদি আমাকে মুক্তি দিতে চাও, তবে তুমি খাতার পরবর্তী পৃষ্ঠাটি উল্টো। সেই পৃষ্ঠায় তার নাম থাকবে। একবার সেই নাম পড়লেই, আমাদের মুক্তি হবে।“

আরিফের চোখ খুলে গেল। “তাহলে, সেই আত্মার নাম কী?”

বিহারী মাথা নেড়ে বলল, “তার নাম ছিল অঞ্জলি। কিন্তু আমি তাকে ভুলবশত মৃত বলে ঘোষণা করেছিলাম। এখন, তাকে মুক্তি দিতে, তার নাম তোমাকে পড়তে হবে।”

আরিফ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর সে খাতা খুলে আবার নতুন পাতা দেখতে শুরু করল। খাতার শেষ পৃষ্ঠার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে, তার হাত কাঁপছিল। অবশেষে, সে পৃষ্ঠাটি উল্টে ফেলল। সেখানে লেখা ছিল—

অঞ্জলি: একজন যোদ্ধা, যিনি মারা যাননি, বরং তাকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। সে জীবিত ছিল এবং তাকে ভুলভাবে রেকর্ড করা হয়েছিল। মুক্তি পাওয়ার জন্য তার নাম উচ্চারণ করতে হবে। তার আত্মা মুক্তি চাইছে, আর মুক্তি তার অধিকার।”

আরিফ শ্বাস টানল। এই ছিল সেই রহস্যের শেষ অংশ! অঞ্জলির নামটি উচ্চারণ করতেই, কিছু অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটল। রুমের বাতাস বদলে গেল, এবং বাড়ির দেয়ালগুলো যেন আলো দিয়ে ভরে উঠল। এক সেকেন্ডে, অন্ধকারের মধ্যে আলো ঢুকে পড়ল, এবং বিহারী এবার ভয়ের পরিবর্তে শান্তি অনুভব করছিল। তার মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল।

“তুমি আমাকে মুক্তি দিলে,” বিহারী বলল, “এবার আমি এই বন্দীদশা থেকে বেরিয়ে যেতে পারব।”

আরিফের মনে একটা অদ্ভুত শীতল শান্তি অনুভব হচ্ছিল। সে জানত, আজ তার জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কিন্তু তার পরে কী হবে?

এবং তখনই, পুরো বাড়ি একবারে একসাথে রকমের এক অদ্ভুত শব্দ করল। আরিফের সামনে উন্মোচিত হল এক নতুন পৃথিবী—একটি মুক্তির পৃথিবী।

মুক্তির পরিণতি

আরিফের সামনে দৃশ্য পাল্টাতে শুরু করেছিল। অঞ্জলির নাম উচ্চারণের পর, বাড়ির মধ্যে এক অদ্ভুত শীতল বাতাস প্রবাহিত হচ্ছিল, আর দেয়ালগুলির ভেতর থেকে এক ধরনের মৃদু আলো ফুটে উঠছিল। এক মুহূর্তের জন্য, বাড়ি যেন নিজেকে নতুন করে চিনতে শুরু করল। অন্ধকারের ভেতর থেকে আলো আসছিল, যা সবকিছু পরিষ্কার করছিল। বিহারী, যার চেহারা এতদিন যেন অন্ধকারে চাপা পড়ে ছিল, এখন এক স্বচ্ছ অনুভূতির মধ্যে ছিল। তার চোখে শান্তি, মুক্তি, আর একটা দীর্ঘদিনের অপেক্ষার পরিসমাপ্তি ছিল।

আরিফ অনুভব করল, তার বুকের মধ্যে এক তীব্র শ্বাস প্রবাহিত হচ্ছে, যেন সে কোনো তীব্র অনুভূতির মাঝে ডুবে গেছে। ঘরটি এখন অনেক শান্ত ছিল, কিন্তু সেই শান্তির মধ্যে কিছু রহস্য ছিল, কিছু প্রশ্ন ছিল যা এখনও তার মনের ভেতর রয়ে গিয়েছিল।

“তুমি আমাকে মুক্তি দিলে, আরিফ,” বিহারী বলল, তার গলার কণ্ঠ যেন অনেক শান্ত। “এবার আমি শেষ হয়ে যাব। কিন্তু তুমি যা করেছ, তা তোমার জন্য অনেক বড় কিছু। তুমি এখন জানো যে এই বাড়ির ইতিহাস কতটা গভীর ছিল। তুমি জানো যে আমি কী করেছি এবং কেন এত বছর ধরে এই জায়গায় বন্দী ছিলাম।”

আরিফ কিছুটা হতবাক হয়ে বলল, “কিন্তু… তুমি তো বলেছিলে, অঞ্জলি জীবিত ছিল, তাকে ভুলভাবে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়েছিল, তো কীভাবে এই এত বছর ধরে, এমন একটি ঘৃণ্য ভুল থাকতে দিল?”

বিহারী এক গভীর শ্বাস ফেলে বলল, “আমি সেই সময় ভুল করেছিলাম, কিন্তু সে ভুলের পরিণতি ছিল ভয়ঙ্কর। যখন তাকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়েছিল, তখন তার আত্মা ভেঙে পড়েছিল। আমি জানতাম না, কিন্তু তাকে ভুলভাবে বন্দী করা, তার জীবনকে সীমাবদ্ধ করে ফেলা, তার জীবনের মূল্য হারিয়ে ফেলেছিল। সে একজন যোদ্ধা ছিল, আর আমি তাকে এত সহজেই হারিয়ে ফেলেছিলাম। তার শোক আমাকে আজও তাড়া করে।”

আরিফ বুঝতে পারছিল, বিহারী আসলে কিছুটা নীরব ছিল, নিজের ভুলের শাস্তি ভোগ করছিল। তবে, সেই সময়ে, তার চিন্তা তখনো অজানা ছিল। কিন্তু এখন, যখন সেই অঞ্জলির মুক্তির প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে, তখন কি আরিফকে আরও কিছু করতে হবে?

তিনি বিহারীকে প্রশ্ন করলেন, “তুমি কি জানো, যে অঞ্জলির আত্মা মুক্তি পেয়ে যাবে, তার পরবর্তী জীবনে কী হবে?”

বিহারী কিছুক্ষণ চুপ ছিল, তারপর বলল, “অঞ্জলির আত্মা এখন মুক্ত। সে তার জীবনের শেষ যাত্রা শুরু করবে, এবং তার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো সেই যুদ্ধে জয়ী হওয়া, যা তাকে এত বছর ধরে তাড়া করেছে। আমি জানি না সে কোথায় যাবে, তবে একদিন, সে শান্তি পাবে। আমি জানি, এখন সে একজন মুক্ত আত্মা। সে জানে যে তার কাছে এখন আর কোনো শৃঙ্খল নেই।”

আরিফ মাথা নেড়ে বলল, “তাহলে, তুমি কি সত্যিই শান্তি পাবে?”

বিহারী এক মৃদু হাসি দিয়ে বলল, “হ্যাঁ, আরিফ। আমি শেষ অবধি শান্তি পাবো। তুমি যে মুক্তির সীমানা পৌঁছেছ, সেটি আমার জন্য অনেক বড় কিছু। তোমার সাহস আর পেরেশানির জন্য, আমি আজ তোমাকে ধন্যবাদ জানাই। এখন, আমার সময় শেষ, আর আমার আত্মা, এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।”

আরিফ একটু শান্ত হল। সে বুঝতে পারছিল, বিহারী সত্যিই শান্তি পেতে চলেছে। কিন্তু তার ভেতর আরেকটি প্রশ্ন রয়ে গিয়েছিল। এই মুক্তি কি শুধুই বিহারীর জন্য ছিল, নাকি এটি ছিল পুরো বাড়ির জন্য, পুরো গ্রাম এবং অতীতের আত্মাদের জন্য?

হঠাৎ, রুমের বাতাসে একটা তীব্র শীতলতা ছড়িয়ে পড়ল। এর সঙ্গে সঙ্গে, ঘরটি এক মুহূর্তে অন্ধকারে ঢেকে গেল। আরিফ সরে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে গেল, কিন্তু তখনই বাড়ির দেয়ালগুলো একদম নীরব হয়ে গেল। তাকে যেন এক অদৃশ্য শক্তি চুপচাপ টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। সে চেষ্টা করল, কিন্তু তার পা যেন মাটি থেকে সরে না।

একটা ভীষণ আওয়াজ শুনে আরিফ পিছনে ঘুরে তাকাল। পুরো ঘর, পুরো বাড়ি যেন এক নতুন রূপে জেগে উঠছিল। তার সামনে, অঞ্জলি—যিনি এত বছর ধরে মৃত ছিলেন—তার নিজস্ব আভা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তার মুখে এক শান্তি ও তৃপ্তির চিহ্ন ফুটে উঠেছিল।

অঞ্জলি, এখন এক জীবিত আত্মা, আরিফের দিকে তাকিয়ে বলল, “ধন্যবাদ, আরিফ। তুমি আমাকে আমার মুক্তি দিয়েছো। আমি যে এত বছর ধরে বন্দী ছিলাম, সেটা আমার জন্য কোনো শাস্তি ছিল না, বরং এক প্রকার শিখন ছিল। তুমি আমাকে মুক্তি দিলেই, আমার আত্মা শান্তি পাবে। তুমি জানো, আমাদের সকলের গল্প—আমাদের কষ্টগুলো—শেষ পর্যন্ত স্বীকৃতি পায়। এখন আমার পালা চলে গেছে।”

আরিফ বলল, “তুমি কোথায় যাবে, অঞ্জলি? এখন তুমি মুক্ত, তবে তোমার গন্তব্য কোথায়?”

অঞ্জলি এক মৃদু হাসি দিয়ে বলল, “আমি জানি না, আরিফ। কিন্তু আমার যাত্রা শুরু হবে। যেখানেই আমি যাব, সেখানে শান্তি হবে। কারণ, তোমার কাছে আমি মুক্তি পেয়ে গেছি।”

আরিফের মন শান্ত হয়ে উঠল। সে জানত, অঞ্জলি, বিহারী এবং এই বাড়ির সমস্ত আত্মা এখন মুক্তি পেয়েছে, এবং তাদের পথ চলার জন্য নতুন দিগন্ত খুলে গেছে। তারপর, অঞ্জলি মৃদু হাসি দিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। আরিফ, যিনি এত দিন ধরে বাড়ির রহস্য উদঘাটন করতে এসেছিলেন, এখন জানতেন যে মুক্তির প্রক্রিয়া অনেক গভীর এবং তার চেয়ে অনেক বৃহত্তর ছিল।

এবং, বাড়ি আবার একবার শান্ত হয়ে গেল।

আরিফ জানত, তার কাজ শেষ। কিন্তু, জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা সে আজ পেয়েছে—মুক্তি কখনো সহজ আসে না, তবে এটা একমাত্র সেই আত্মার মর্জি, যারা সত্যিকারের শান্তির জন্য সংগ্রাম করেছে।

অন্ধকারের পর্দা

আরিফের মনে এক অবিরাম অনুভূতি বাসা বেঁধেছিল। অঞ্জলি আর বিহারী, দুজনেই মুক্তি পেয়েছিল। কিন্তু সে নিজেও কি মুক্তি পাবে? তাঁর চোখে ধীরে ধীরে অন্ধকারের ছায়া নেমে আসছিল, এক অজানা তীব্রতার মধ্যে। মুক্তির অনুভূতি, শূন্যতার অনুভূতি, একে একে যেন তার সত্তার ভেতর ছড়িয়ে যাচ্ছিল। সে জানত, সব কিছু শেষ হয়ে গেছে—এ বাড়ির অভিশাপ, বিহারীর আড্ডা, অঞ্জলির কষ্টের অধ্যায়। কিন্তু একটা অদ্ভুত শূন্যতা, এক বিরহ, তার মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল।

সে আবার বাড়ির ভেতর একবার পা দিল। বিহারীর চোখের মধ্যে শান্তির যে আলোর ঝলক ছিল, সেটাই যেন এখন তার মনের ভেতর প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। আরিফ ভাবছিল, এই বাড়ির অতীতের প্রতিটি গল্প আর অভিশাপ শেষে এসে দাঁড়াল, এক জায়গায়। কিন্তু যে জায়গাটা তাকে সব সময় প্রলুব্ধ করেছিল, তা হলো—এই রহস্যের পরিণতি কী?

বাহিরে আলো ফুরিয়ে আসছিল, রাত গভীর হতে শুরু করেছে। কিন্তু আরিফ সেই অন্ধকারে নতুন এক পথের সন্ধান পেল। সে বাড়ির এক কোণে এসে দাঁড়াল, যেখানে দেয়ালগুলো ভেঙে পড়েছিল, আর পুরনো চিত্রকলা গুলোর মধ্যে এক অবাস্তব আলো লুকিয়ে ছিল। সেই চিত্রকলা, যেগুলো এত বছর ধরে নিজের অতীতের আখ্যান নিয়ে চুপচাপ বসেছিল, আজ যেন জীবন্ত হয়ে উঠছিল।

আরিফ একে একে সেগুলো দেখতে শুরু করল। প্রতিটি চিত্র যেন এক নতুন রহস্য উন্মোচন করতে চাইছিল। প্রথম চিত্রে, বিহারীর মুখ ছিল। সে চিত্রের মধ্যে কোনো উত্তেজনা ছিল না, বরং তার চোখে গভীর শোক ছিল। যেন এই বাড়ির পুরনো ইতিহাসের নায়ক ছিল সে। আরিফ তার দিকে তাকিয়ে ভাবল, “বিহারী… তুমি কি জানাতে চেয়েছিলে, এই বাড়ি আর ইতিহাসের চূড়ান্ত শেষ কোথায়?”

দ্বিতীয় চিত্রে, অঞ্জলির চেহারা ছিল। তার মুখে এক অদ্ভুত শান্তি ছিল, যা দেখে আরিফ এক মুহূর্তের জন্য অভিভূত হয়ে পড়েছিল। অঞ্জলি, যাকে একসময় মৃত বলে ঘোষণা করা হয়েছিল, আজ তার মুখে চিরকালীন মুক্তির দ্যুতি। “অঞ্জলি, তুমি কি জানো, তোমার মুক্তির পরও আমার ভিতরে কত প্রশ্ন রয়ে গেছে?” আরিফ মনে মনে বলল।

বাড়ির কোণে, যেখানে চিত্রকলা শেষ হচ্ছিল, একটি ছোট্ট দরজা ছিল। দরজাটি এতদিন ধরে কেউ খুলতে সাহস পায়নি। তবে আরিফ জানত, আজ এই দরজার পেছনেই শেষ রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। সে কাছে গিয়ে দরজা খুলল। দরজার মধ্যে এক অদ্ভুত ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকল, যেন অতীতের সেসব আত্মার কষ্ট ছড়িয়ে পড়ছিল।

বাড়ির ভেতর প্রবাহিত হাওয়া যেন এক নতুন অধ্যায়ের জন্ম দিচ্ছিল। একে একে পুরনো জিনিসপত্র বেরিয়ে আসছিল। এক একটি ছবির মতো স্মৃতি তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। ছোট্ট ছোট্ট গহনাগুলোর মধ্যে, একটি কাঠের বাক্স ছিল। আরিফ সেই বাক্সটি হাতে তুলে নিয়ে একপ্রকার শঙ্কিত মনে খুলল।

বাক্সের মধ্যে ছিল একটি পুরনো ডায়েরি, যা সোনালী সুতায় বাঁধা ছিল। এই ডায়েরি, যা এতদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল, আজ তার হাতে এসেছে। আরিফ ডায়েরিটি খুলল, এবং এক পৃষ্ঠা পড়তে শুরু করল। প্রথম পৃষ্ঠাতেই লেখা ছিল:

আমি বিহারী, এই বাড়ির এক সময়ের অধিকারী। আমি আজ এই ডায়েরির মাধ্যমে সেই সব সত্য জানাব, যা আমার হারানো জীবনের অংশ। অঞ্জলি আমার ভুলের শিকার, এবং আমি তার প্রতি যে অন্যায় করেছি, তার পরিণতি ছিল ভয়ঙ্কর। কিন্তু আমি, যে মুক্তি চেয়েছিলাম, আজ আমার মৃত্যু হয়েছে। যদিও, এখন আমি জানি—প্রত্যেকের জীবনে এক দিন মুক্তি আসে।”

আরিফ ডায়েরির পৃষ্ঠা একে একে পড়তে লাগল। প্রতিটি কথায়, প্রতিটি শব্দে, এমন এক ঘোর লুকিয়ে ছিল, যা তাকে স্তব্ধ করে দিচ্ছিল। বিহারীর শেষ কষ্ট, অঞ্জলির মুক্তির জন্য তাকে যে শাস্তি ভোগ করতে হয়েছিল, সব কিছুই এই ডায়েরির পাতায় লেখা ছিল।

আরিফ যেন বুঝতে পারছিল, এর মাধ্যমে বিহারী, অঞ্জলি এবং তার মত অজানা আত্মাদের চাহিদা শুধু শাস্তি নয়—তারা এক চিরন্তন মুক্তির জন্য অপেক্ষা করছিল। আরিফ তার পা তুলে এগিয়ে গেল এবং সেই ডায়েরির পাতাগুলি আরও গভীরভাবে পড়তে লাগল।

“আমাদের জীবন, আমাদের গল্প, শুধুমাত্র ইতিহাস নয়,” আরিফ মনে মনে বলল। “এগুলো অস্থায়ী নয়, চিরকালীন। কিন্তু কীভাবে তা ফিরে আসে?”

তিনি জানতেন, এই জায়গা, এই বাড়ি, যেখানে এত বছর ধরে অন্ধকার ছড়িয়ে ছিল, তা আজ মুক্তির এক নতুন দিশা পেল। তবে, এর পরেও অনেক কিছু ছিল যা তিনি বুঝতে পারেননি। মুক্তির সত্য, এত সহজে এসে যায়নি। বরং, এর পিছনে ছিল বহু ত্যাগ, বহু ভুল এবং বেদনা। আরিফ একটি দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে সেই ডায়েরি বন্ধ করল এবং আবার নিজের পা ফেলল।

এখন, আরিফ জানত—এই বাড়ি তার জন্য আর কোনো রহস্য নয়। কিন্তু যে সত্য আজ প্রকাশিত হল, তা চিরকাল তাকে মনে থাকবে। আরিফ বুঝতে পারল, মুক্তির পরিণতি এক নতুন জীবন হতে পারে। যতটুকু অন্ধকারে ভরা, ততটাই আলোর দিকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে।

শেষ অধ্যায়

আরিফের মন এখন এক অদ্ভুত অস্থিরতায় ডুবে ছিল। তিনি জানতেন, যে বাড়ি তাকে এত দিন ধরে ভুগিয়েছে, আজ সেই বাড়ি মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু সেই মুক্তির পরিণতি কী হবে? তাঁর জীবনও তো এই বাড়ির রহস্যের মধ্যে গিঁথে ছিল। একসময়, এই বাড়ির ভিতরে ছিল এক ভয়ানক অভিশাপ, কিন্তু আজ তা এক ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিহারী আর অঞ্জলির মুক্তি আজ তাকে তার নিজের জীবন, নিজের পথ খুঁজে বের করতে বলছিল।

অতীতের সমস্ত স্মৃতি ধীরে ধীরে পেছনে সরে যাচ্ছিল, কিন্তু আরিফ জানত, এই মুক্তির পরিণতি এখন তার কাছে এক নতুন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে, পেছনে তাকানোর সাহস ছিল না। আজ আর তার ভয় নেই। আজ, তার সামনে ছিল শুধুমাত্র সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ। একে একে পেছনের সব অন্ধকার যেন উঠে গিয়েছিল।

আকাশে অদ্ভুতভাবে মেঘ জমতে শুরু করল। দিন যখন ঢলে পড়ছিল, তখন আরিফ বাড়ির কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। বাড়ির সামনে গাছগুলো, পুরনো কাঠামো, সব কিছু যেন এক জাদুকরি শান্তিতে বদলে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল, বাড়িটি এখন শান্ত, আর সেই শান্তি যেন এক চিরকালীন অবস্থায় পৌঁছেছিল। সে দাঁড়িয়ে ছিল, আর তার মনে হচ্ছিল, এই বাড়ি হয়তো এবার আর কোনো দুঃখের সাক্ষী হবে না। মুক্তি পেয়ে, সকল আত্মা তাদের পথ চলে গেছে।

“এটাই শেষ,” আরিফ নিজে নিজে বলল। “এবার এই জায়গার গল্প শেষ। তবে, আমি কখনো ভুলব না।”

সে বাড়ির দরজায় এক হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকল। দরজা, যা এতদিন বন্ধ ছিল, আজ খুলে গেছে। বাড়ির ভেতরে এক অদ্ভুত শীতলতা ছিল। এটি যেন সময়ের এক অসমাপ্ত অধ্যায়ের মতো, যা একদম শেষ হয়ে গিয়েছে। আরিফ জানত, যতক্ষণ না সে ফিরে আসবে, ততক্ষণ এই বাড়ি, এই রহস্য, তার সাথে থাকবে।

মাথায় আজও বিহারীর কথা কানে বাজছিল, “তুমি আমাকে মুক্তি দিলে, আরিফ। তুমি জানো, প্রতিটি আত্মা মুক্তি চায়, আর সেই মুক্তি কেবল সে আত্মারই অধিকার।”

আরিফ আবার বাড়ির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। বাড়ির দরজা সবে বন্ধ হচ্ছিল, আর সেই সময় বাইরে ঝড়ের বাতাসের মতো এক অদ্ভুত শব্দ শোনা যাচ্ছিল। এক মৃদু ঝিলিক, যেন অতীতের সব আত্মারা তাদের জায়গা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আরিফ জানত, এই জায়গা তার সঙ্গে কখনো আলাদা হয়ে যাবে না। কিন্তু এ বাড়ি আর তাকে ভয় দেখাবে না।

সামনে যখন সে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন চোখের সামনে উঠে এল শুপ্রার মুখ। শুপ্রা তাকে দেখতে পেল এবং হালকা হাসি দিয়ে এগিয়ে আসল। “তুমি ফিরে এলে?” শুপ্রা বলল, আর তার চোখে এক অদ্ভুত শান্তি ছিল। “তোমার পরিশ্রম শেষ হলো।”

আরিফ কিছুক্ষণ নীরব থাকল, তারপর বলল, “হ্যাঁ, শেষ। কিন্তু মনে হচ্ছে কিছু একটা আমার ভেতর থেকে বের হয়ে গেছে। অনেক কিছু আবিষ্কার করলাম, কিন্তু একে বিশ্বাস করা কষ্টকর। কিন্তু এখন, মনে হচ্ছে সব কিছু শেষ।”

শুপ্রা এক মৃদু হাসি দিয়ে বলল, “এটা স্বাভাবিক। কখনো কখনো অতীত আমাদের এতটাই আবদ্ধ করে, যে মুক্তি পাওয়ার পরও তার প্রভাব আমাদের ভেতর থাকে। তবে তুমি আজ এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করেছো।”

আরিফ এক পা পিছিয়ে গেল এবং বলল, “আমি জানি, তবে এখন যা ঘটেছে, তা সবই অজানা। এই বাড়ি, এই গল্প, আমার মধ্যে এক নতুন প্রভাব রেখেছে। আমি জানি না কোথায় যাব, কিন্তু আমি মুক্ত, এই অনুভূতি অনুভব করছি।”

শুপ্রা এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল, তারপর বলল, “তুমি কি জানো, এই বাড়ির ভিতরে আসলে একটাই মূল ব্যাপার ছিল? সেটা হলো, মুক্তি। মুক্তি শুধু দেহের নয়, আত্মারও। বিহারী, অঞ্জলি, তারা যখন মুক্তি পেল, তখন তাদের ঘর, তাদের পৃথিবী বদলে গেল। আর তুমি, তুমি সেই পরিবর্তনের সূচনা করেছো।”

আরিফ মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু মুক্তি কতটা মিষ্টি, আর কতটা তিক্ত, তা আমি এখনই বুঝতে পারছি। এই মুক্তি আমাদের আধ্যাত্মিক চাহিদার অংশ, যা আমরা আমাদের জীবনে বারবার খুঁজে পাই, কিন্তু কখনো তার প্রকৃত উত্তর খুঁজে পাই না।”

শুপ্রা কিছুক্ষণ নীরব থাকল, তারপর বলল, “এখন তুমি যদি মনে কর, তাহলে যে স্মৃতি তুমি এই বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছো, তা তোমার জন্য কোনো শিক্ষা হয়ে দাঁড়াবে। তবে তোমার সামনে এক নতুন জীবন, নতুন পথ থাকবে।”

আরিফ এবার কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে বলল, “হ্যাঁ, আমি জানি। হয়তো এখন, এই জায়গা আমার জন্য শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু এর অভিজ্ঞতা, এর শিক্ষা, আমাকে আর এক নতুন দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।”

তারা একসাথে গাঢ় অন্ধকারে হাঁটতে লাগল। ঝড়ের বাতাসের মধ্যে, যেন সব কিছু নতুন রূপে জেগে উঠছিল। বাড়ির অন্ধকার আর ভয় এখন হারিয়ে গিয়েছিল। তাদের সামনে ছিল নতুন পৃথিবী, নতুন শুরু, নতুন রূপে একটি মুক্তির জীবন।

আরিফ জানত, জীবন কখনো এক জায়গায় থেমে থাকে না। মুক্তি যেমন এক সময় আসে, তেমনি জীবনও কখনো থেমে থাকে না। অতীতের স্মৃতি, অভিজ্ঞতা, সব কিছুই আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য প্রস্তুত করে।

রূপান্তরের মুহূর্ত

আরিফ আর শুপ্রা এক সাথে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল। তার মনে তখন হাজারও প্রশ্ন, যা আজও কিছুটা অজ্ঞাত রয়ে গেছে। অঞ্জলি আর বিহারীর মুক্তি, সেই ইতিহাসের অন্ধকার, সব কিছুই যেন এক নতুন দিকের দিকে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু আরিফ জানত, এখন তাকে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মুক্তির এই প্রক্রিয়া তার জীবনকে অনেকটাই পরিবর্তন করে দিয়েছে, তবে এর পরিণতি কী হবে, তা জানাটা ছিল না।

শুপ্রা তার পাশে ছিল, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। “তুমি কি জানো, আজ তোমার জীবনে এক নতুন অধ্যায় শুরু হতে চলেছে?” সে মৃদু হাসল।

আরিফ এক মুহূর্ত নীরব ছিল। তার মনে হচ্ছিল, এই বাড়ির মুক্তির পরিসমাপ্তি আসলে তার জীবনের শুরুর দিকে এক নতুন মঞ্চে দাঁড়ানোর পথ খুলে দিয়েছে। তবে কি সে সত্যিই প্রস্তুত? এমনটা ছিল কি?

“আমি জানি না,” আরিফ বলল, “আমার মনের মধ্যে অনেক কিছু আজও শেকল হয়ে বাঁধা পড়ে আছে। এই বাড়ির ইতিহাস, বিহারী, অঞ্জলি—তারা সবাই যে মুক্তি পেয়েছে, কিন্তু আমি জানি না, কীভাবে আমি মুক্তি পাবো। হয়তো আমার জীবনটাও কখনো একদিন সেই মুক্তির পথে চলে যাবে।”

শুপ্রা এক পা সামনে রেখে বলল, “তুমি ভুল ভাবছো না। মুক্তি শুধু শারীরিক অবস্থার নয়, আত্মারও। তুমি আজ যে কাজটা করেছো, তা অনেক বড়। জীবনের এই মুহূর্তগুলো তোমার স্মৃতিতে থাকবে, আর একদিন তুমি জানবে, এই মুক্তি তোমার অন্তরের শান্তি।”

আরিফ মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু আমি জানি, মুক্তি কেবল বাইরের কোনো অভ্যন্তরীণ অনুভূতি নয়, এটি সত্যিই কিছু একটা যা মনকে সজীব করে তোলে। তুমি কী মনে করো, মুক্তি আসলে কিভাবে আমাদের জীবনে কাজ করে?”

শুপ্রা একটু থামল, তারপর বলল, “মুক্তি আসলে অদৃশ্য শক্তি, কিন্তু তা যখন ঘটে, তখন আমরা আমাদের ভেতর নতুন এক জীবন অনুভব করি। কেবল বাইরের জগৎই বদলায় না, আমরা নিজেরাই বদলে যাই।”

আরিফ কিছুটা চুপ করে রইল, তারপর বলল, “তাহলে, আমাদের জীবনে মুক্তি কি আসলে তখনই ঘটে, যখন আমরা অতীতের গ্লানি আর দুঃখকে পুরোপুরি ছেড়ে দিতে পারি? কীভাবে তা অর্জন করা যায়?”

শুপ্রা এক ধীর দৃষ্টিতে তাকাল, তারপর হেসে বলল, “এটাই তো জীবন। কখনো কোনো পথ সহজ হয় না, তবে একে একে আমরা এগিয়ে চলি, আর তখনই বুঝতে পারি, মুক্তি আসলে আমাদের মাঝে ছিল। এটি কোনো বিশেষ জায়গা নয়, এটি আত্মার এক প্রকার শুদ্ধতা।”

আরিফ আবার বাড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি জানি, এ বাড়ি আর কখনো আমার কাছে অন্ধকারে ভরা স্থান হবে না। আজ আমি জানি, মুক্তি আসলে আমাদের প্রতিটি দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে থাকে। এটা কোনো শারীরিক সীমানায় আটকে থাকে না, এটি আমাদের মন, আত্মা এবং হৃদয়ের মধ্যে থাকে।”

শুপ্রা এক নিঃশ্বাসে বলল, “ঠিক, আরিফ। আর এখন, তুমি জানো, এই মুক্তির মধ্যে নতুন সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিটি মানুষ তার জীবনের এক বিশেষ মুহূর্তে সেই পথ খুঁজে পায়, আর সে যখন সেই পথ পেয়ে যায়, তখন সে অনুভব করে, তার মধ্যে একটা চিরকালীন পরিবর্তন এসেছে।”

আরিফ গম্ভীর হয়ে বলল, “তবে, যে মুক্তি তুমি বলছো, সেটা কি শেষ হয় না? আমি জানি, মুক্তি আসলে চিরন্তন। কিন্তু আমি কি শেষ পর্যন্ত নিজেকে এতটা মুক্ত করে দিতে পারব?”

শুপ্রা তার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “তোমার প্রশ্নের উত্তর তুমি নিজেই পাবে। তুমি তো ইতিমধ্যেই সেই পরিবর্তনের অংশ হয়ে গেছো, যে পরিবর্তন সব কিছু বদলে দেয়।”

আরিফ এক দীর্ঘ শ্বাস নিল এবং তার চোখে এক নতুন দৃশ্য ফুটে উঠল। জীবনের সঠিক পথে হাঁটার জন্য, তাকে তার অতীতকে একেবারে ছেড়ে দিতে হবে। জীবনের পুরনো বোঝা আজই তার থেকে ঝরে পড়েছে। এই মুক্তির পথে যাত্রা, যা তাকে আজও অন্ধকারের মধ্যে থেকে আলোয় নিয়ে এসেছে, তা তার জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।

“তাহলে, এখন কি আমাকে কিছু করতে হবে?” আরিফ জানতে চাইল।

“না,” শুপ্রা মৃদু হাসল, “তুমি শুধু স্বাভাবিকভাবে এগিয়ে যাও। জীবন নিজেই তোমাকে পথ দেখাবে।”

আরিফ এক নীরব মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে থাকল, তারপর সে হাঁটা শুরু করল। আরিফ জানত, তার সামনে বিশাল এক পথ অপেক্ষা করছে, কিন্তু আজ, এই মুহূর্তে, তার মনে আর কোনো ভয় ছিল না। মুক্তি তাকে তার নিজস্ব পথে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি দিয়েছিল।

বাড়ির ভেতরে, বিহারী আর অঞ্জলি দুজনেই নিজেদের অবস্থান থেকে চলে গিয়েছিল। তাদের কষ্ট এবং ত্যাগ আজ শেষ হয়ে গেছে। আরিফ জানত, তাদের জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে, তাকে এক নতুন জীবন শুরু করতে হবে।

কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর আরিফ আজ একমাত্র নিজের ভেতর খুঁজে পাবে।

এবং সে চলে গেল, জীবন যে পথে চলতে বলে, সেই পথে।

শেষের সূচনা

আরিফের পা বাড়ছিল এক নতুন পথের দিকে, এক নতুন সম্ভাবনার দিকে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে, সামনে যে জীবন দাঁড়িয়ে ছিল, তা যেন তাকে নতুনভাবে চিনতে বলছিল। অন্ধকারের পর, মুক্তির আলো যেমন আসে, তেমনই জীবনের এই মুহূর্তে তার পথও আলোকিত হয়ে উঠছিল। আরিফ জানত, সে অতীতের যেখান থেকে এসেছে, তা কেবল তার শৈশবের গল্প ছিল। কিন্তু আজ, আজ তার সামনে যা ছিল, তা ছিল এক নতুন জন্ম, এক নতুন যাত্রা।

শুপ্রা তার পাশে ছিল। সে কিছুক্ষণ আরিফের পাশেই হেঁটেছিল, কিন্তু তারপর আলতোভাবে থেমে বলল, “তুমি তো জানো, মুক্তি কোনো একটা ঘটনার জন্য আসে না। মুক্তি আসে আমাদের নিজস্ব ভেতরের শান্তি আর সাহসের জন্য। তুমি সেই সাহস পেয়েছো।”

আরিফ মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, শুপ্রা। কিন্তু জীবনে আসল মুক্তি কীভাবে আসবে, সেটা তো আমি জানি না। আমি হয়তো মুক্তি পেয়েছি, কিন্তু এই পথে কতটুকু সামনে এগোতে পারবো, সেটা তো এখনো অজানা।”

শুপ্রা এক মুহূর্ত নীরব থাকল, তারপর ধীরে ধীরে বলল, “জীবন কখনো এক জায়গায় থেমে থাকে না, আর তুমি তো জানো, তুমি যা করতে চাও, তা করতে হলে ভেতরের বিশ্বাস থাকতে হয়। এই বিশ্বাস তোমাকে শুধু তোমার নিজের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে না, বরং তোমার যাত্রা হয়ে উঠবে আরেকটা অধ্যায়। তুমি সেই অধ্যায়েই চূড়ান্তভাবে পৌঁছাবে।”

আরিফ যেন গভীরভাবে শ্বাস নিল, আর এক ধীর দৃষ্টিতে সামনে তাকাল। তার মনে হচ্ছিল, সে এখন এক নতুন দিগন্তে পৌঁছাতে চলেছে। বহুদিনের জমে থাকা কষ্ট, দুর্বলতা—সব কিছু আজ মুক্তির আলোতে বিলীন হয়ে গেছে। সে জানত, জীবনের পরবর্তী অধ্যায়টা কী হবে, কিন্তু সেটা ছিল শুধু তার নিজস্ব যাত্রারই অংশ। আর সেই যাত্রা শুরু হয়েছে আজ।

বাড়ির দিকে ফিরে তাকিয়ে আরিফ বলল, “এ বাড়ির গল্প তো শেষ হয়ে গেল, কিন্তু আমার গল্প তো এখানেই শেষ হবে না। আমি জানি, জীবন আমাকে আরও কিছু শিখাবে, আরও কিছু সমাধান দেবে।”

শুপ্রা কিছুটা অবাক হয়ে তাকাল, “তুমি কি ভেবেছো, মুক্তি সব সমস্যার সমাধান দেয়? আসলে, মুক্তি জীবনকে বুঝতে শেখায়। শুধু পৃথিবী বা এই বাড়ি নয়, জীবন আমাদের অনুভূতি, চিন্তা, আর কাজের মধ্যে এক অদৃশ্য শক্তি তৈরি করে। তুমি যদি এখন কিছু শেখো, তা হলো—তুমি নিজে নিজের মুক্তি হও।”

আরিফ হাসল, তার চোখে কিছুটা অশ্রু জমে এল। “তুমি ঠিক বলেছো। মুক্তি তো আসলে আমাকে দিয়ে শুরু হয়। আমাকে দিয়েই জীবনের পরবর্তী অধ্যায় শুরু হবে। আমি আজ জানি, আমার পথ নির্ধারণ করতে, আমাকে আর বাইরের কিছুর ওপর নির্ভর করতে হবে না।”

দুজনই হাঁটছিল, গ্রামটা পার করে পাহাড়ের দিকে চলে যাচ্ছিল। আরিফ জানত, তার সামনে আরও বহু প্রশ্ন, বহু উত্তর অপেক্ষা করছে। কিন্তু সেই উত্তর, সেই পথে, সে একা নয়। তার পাশে শুপ্রা ছিল, আর সেই সাথে ছিল বিহারী আর অঞ্জলির মুক্তির গল্প। প্রতিটি গল্প, প্রতিটি অভিজ্ঞতা তার জীবনের নতুন দিশা প্রদর্শন করছিল।

তারা যখন পাহাড়ের উপরে পৌঁছাল, তখন সূর্য হেলিয়ে পড়ছিল, আকাশের অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ছিল। আরিফ এবং শুপ্রা দুজনেই একে অপরকে দেখছিল, আর মনে হচ্ছিল, এই সময়টুকু তাদের জন্য এক গভীর শান্তির মুহূর্ত। জীবনের সঠিক পথ খোঁজার জন্য আজ তারা এক নতুন দিক পেয়েছে, যা তাদের আজীবন প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।

আরিফ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। সেই মুহূর্তে, সে জানত—মুক্তির পরিণতি কখনোই শেষ হয় না। এটি শুধু একটি সূচনা। আর এই সূচনা তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মুক্তি এসেছে, তবে তার জীবন—এই নতুন জীবন—এখন তার সামনে উন্মুক্ত। এটি ছিল এক নতুন রূপান্তরের সূচনা, যার পথে সে এক অজানা সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে চলেছে।

আরিফের পা আবার চলতে শুরু করল। তার সামনে এক বিস্তীর্ণ পৃথিবী ছিল। কিন্তু সে জানত, তার ভেতরে যে শক্তি ছিল, তা তাকে তার পথ খুঁজে নিতে সাহায্য করবে। আর শুপ্রা, তার সহযাত্রী, তাকে সেই পথে আলো জ্বালিয়ে দেবে।

আজ, এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। আরিফ জানত, এই পথ একদিন তাকে জীবনের চূড়ান্ত শান্তিতে পৌঁছাবে, তবে সেটা তার নিজেরই যাত্রা, যার মধ্যে থাকবে অজস্র সুযোগ আর অভিজ্ঞতা, যা তাকে বাঁচার নতুন অর্থ দেবে।

শেষ

WhatsApp-Image-2025-07-07-at-4.27.35-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *