শঙ্খনীল মুখোপাধ্যায়
(১)
নাইট মোড অন করা ল্যাপটপের স্ক্রিনজুড়ে লাইভ স্ট্রিমিং চলছিল। ইউটিউবের সেই ঝলমলে লাল বক্সে লেখা – LIVE – 2 Hours 13 Minutes। তাতে দেখা যাচ্ছে একটি অন্ধকার রুম, মাঝখানে রাখা একটা কাঠের চেয়ার, জানালার পাশে একজোড়া পর্দা হালকা দুলছে, যেন কোথাও একটা হাওয়া ঢুকছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সেই রুমে কেউ নেই—তবু ভিডিও চলছে। আর অদ্ভুতভাবে, প্রতি কিছুক্ষণ পর পর ভিডিওতে শব্দ শোনা যায়—ক্লিক ক্লিক… ফিসফাস… অথবা দূরে কোথাও ঘড়ির টিক টিক। ইরা বসু, বিখ্যাত ব্লগার, ট্র্যাভেল-ভ্লগার, কন্টেন্ট ক্রিয়েটর, মাত্র রাত দশটায় এই রুমেই ছিলেন, হাজার হাজার দর্শকের সামনে লাইভে। সে গল্প করছিল তার নতুন ভিডিও নিয়ে—একটি পুরনো, পরিত্যক্ত রিসর্টে থাকা, যেখানে নাকি ‘রাত্রিবেলায় দরজা আপনিই খুলে যায়’। লাইভ চলছিল একেবারে স্বাভাবিকভাবে—হঠাৎই ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল কেঁপে উঠল, ইরার মুখ থমকে গেল, সে পেছনে তাকাল, আর তারপর… সে যেন কিছু বলার চেষ্টা করেছিল—“Guys, wait—there’s some—”। তারপর পর্দা কাঁপল, ইরার ক্যামেরা পড়ে গেল নিচে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ভিডিও থামেনি। লাইভ চলতেই থাকল, ঠিক সেভাবেই—কেবল এখন সেখানে ইরা নেই।
অর্ণব ঘোষ যখন ইরার এই ভিডিও দেখে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠল, তখন রাত সাড়ে বারোটা। সে আর ইরার সম্পর্ক আজ অতীত হলেও, ইউটিউবে ‘Ira Unplugged’ চ্যানেলটি তার সাবস্ক্রাইব করা ছিল। লাইভ শুরু হলে সে নোটিফিকেশন পেয়েছিল, কিন্তু দেখে উঠতে পারেনি। তার এখনকার জীবন সাইবার ক্রাইম ইউনিটের হ্যাকিং রিপোর্ট, ল্যাপটপের সি-ড্রাইভ, আর ছায়ার মতো অনলাইন অপরাধীদের ঘিরে। সে দ্রুত তার ডেস্কে গিয়ে সিস্টেমে লগ ইন করল, এক্সটেনশন লাগাল ইউটিউব স্ট্রিম স্ন্যাপার—ভিডিও ডেটা স্ট্রিম চেক করতে হবে। ভিডিওটির স্ট্রিম অদ্ভুত—সার্ভারে কোনও ইরার লাইভ ফিড নেই, অথচ ফ্রেম বাই ফ্রেম লাইভ যাচ্ছে। ক্যামেরা কে চালাচ্ছে? ক্যামেরা কি চালিয়েই যাচ্ছে? এ তো একটা ব্ল্যাকহোলের মতো—যেখানে কেউ আছে না থেকেও। অর্ণব নিজের স্ক্রিপ্ট চালিয়ে প্রথমবারের মতো কিছু বুঝতে পারল—লাইভ ভিডিওটি ব্লকচেইন-সাপোর্টেড ভার্চুয়াল ক্যামেরার মাধ্যমে ট্রান্সমিট হচ্ছে, যা নিজে থেকেই নির্দিষ্ট ফ্রেম রেন্ডার করে চালাতে সক্ষম। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কে সেটাপ করল এই জিনিসটা? আর কেন?
সকাল হতেই খবর ভাইরাল—”পপুলার ইউটিউবার Ira Basu Missing During Livestream!” শিরোনামে সোশ্যাল মিডিয়া উত্তাল হয়ে উঠল। কে অপহরণ করল ইরাকে? নাকি ইরাই কিছু একটা পরিকল্পনা করে গায়েব হলো? কিন্তু এক অদ্ভুত জিনিস কেউই এড়িয়ে যেতে পারল না—ভিডিও এখন ১০ ঘণ্টা চলার পরে এখনও লাইভ। কেউ সেটি থামাতে পারছে না। ইউটিউব কর্তৃপক্ষ বলছে, ভিডিওটি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরের সার্ভার থেকে চালিত হচ্ছে। অর্ণব তখন পৌঁছায় ইন্সপেক্টর শুভ্রজিৎ ঘোষের কাছে, যার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না—একজন মানুষ ক্যামেরা থেকে উঠে গেল, ভিডিও চলছে—এটা সম্ভব কীভাবে? শুভ্রজিৎ হাল ছেড়ে দেয় না, সে লোকাল থানার মাধ্যমে রিসর্টটি ঘিরে ফেলে। কিন্তু ততক্ষণে ভিডিওতে কিছু নতুন শব্দ যোগ হয়—একটা পুরনো হিন্দি গান… “গুমনাম হ্যায় কোই…” ফিসফিস করে বাজছে। অর্ণব তখন বুঝতে পারে—এটা আর কেবল অপহরণ নয়, এটা একটা ডিজিটাল ফাঁদ। আর কেউ একজন এই ক্যামেরার ওপার থেকে তাকে ডাকছে।
(২)
নির্জন রিসর্টের চারপাশে তখন স্থানীয় পুলিশ ঘিরে ফেলেছে এলাকা। ক্যামেরা, স্পটলাইট, ফরেনসিক ইউনিট—all stationed, but all equally clueless. ভেতরে শুধু সেই চেনা রুমটি, যেখানে ইরার শেষ ভিডিওর দৃশ্য দেখা গিয়েছিল। রুমে ঢুকেই অর্ণব থমকে গেল—ঘরটা অবিকল লাইভ স্ট্রিমে যেমন দেখা যাচ্ছিল, তেমনই আছে। চেয়ার মাঝখানে, জানালার পর্দা এখনও দুলছে, এবং এক কোণে পড়ে আছে ইরার মোবাইল স্ট্যান্ড। কিন্তু কোথাও ইরার কোনও চিহ্ন নেই। অথচ ভিডিওটি চলছে। “একটা স্ট্যাটিক ভিডিও তো এতক্ষণ ধরে চলে না,” বিড়বিড় করল অর্ণব। সে তার ল্যাপটপ অন করে সেই ভিডিওর লাইভ স্ন্যাপশট তুলছিল, এবং হঠাৎই তার চোখ পড়ল লাইভ চ্যাটে। কেউ একজন নতুন করে লিখেছে—”Welcome back, Phantom.” স্ক্রল করে দেখে, ইউজারনেম – N30Phantom। অর্ণবের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। এই নামটা সে আগে দেখেছে—ইরার ব্লগ পোস্টের কমেন্ট সেকশনে, এক অদ্ভুত স্প্যামার, যে সবসময় “তুমি বাস্তবে থেকেও বাস্তবে নেই” টাইপ বার্তা দিত। আগে মনে হয়েছিল বট, কিন্তু এখন?
লাইভ চ্যাটের সেকশন হঠাৎ করে একদম স্তব্ধ হয়ে গেল। একমাত্র N30Phantom-এর লাইনগুলো রয়ে গেল জ্বলজ্বল করে। “তুমি দেখছো, কিন্তু দেখছ না। ও তো এখানেই আছে, তুমি কেন বুঝছো না?” অর্ণব সঙ্গে সঙ্গে কমেন্টের ডেটা প্যাকেট ধরে হ্যাক করার চেষ্টা করল, কিন্তু সেটি সাধারণ সার্ভার থেকে আসা না—ডার্ক ওয়েব রিডাইরেক্টেড। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সায়ন্তিকা রায়, যিনি সাইবার মনোবিজ্ঞানী হিসেবে এই কেসে যুক্ত হয়েছেন, ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে এসে বললেন, “এই N30Phantom ব্যক্তিটিকে আমি চিনি। একসময় ‘ডিজিটাল ডিসঅর্ডার কমিউনিটি’ নামে এক রহস্যময় গোষ্ঠীর সদস্য ছিল। তারা মস্তিষ্কের সঙ্গে ইন্টারনেটের সংযোগ নিয়ে একাধিক পরীক্ষামূলক প্রজেক্ট চালাত। বিশ্বাস করো বা না করো, তারা বলত—মানুষ নিজেই একদিন ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দী হয়ে যাবে।” অর্ণব থেমে যায়। “তুমি বলতে চাও, ইরা এখন কোনও ভার্চুয়াল ফ্রেমে আটকে আছে?”—তার কণ্ঠে শঙ্কা। সায়ন্তিকা জবাব দেয়, “হয়তো সে আর ‘রিয়েল ওয়ার্ল্ড’-এ নেই। হয়তো সে নিজেই এখন একটি স্ট্রিম হয়ে গেছে।”
রাতে ফের একবার লাইভ ভিডিওতে অদ্ভুত কিছু ঘটে—ভিডিওর মাঝে ইরার মুখ হঠাৎ কিছু সেকেন্ডের জন্য ভেসে ওঠে। মুখটা অবিকল ওর মতোই, চোখে ভয়, ঠোঁট কাঁপছে—কিন্তু মুখটা জেল্লাহীন, যেন ডিপফেক। অর্ণব যতবার রিওয়াইন্ড করে, ততবার মুখটা হালকা বদলাচ্ছে। এ একধরনের লাইভ ফ্রেম ম্যানিপুলেশন, যেটা তৈরি করা সম্ভব N30Phantom-এর মতো এক জন হাই-কোয়ালিটি হ্যাকার দ্বারা। এরপরই ভিডিও বন্ধ হয়ে যায় এক সেকেন্ডের জন্য, আর পরের ফ্রেমে শুধুই একটা কোডেড মেসেজ:
“If you want her back, you must enter the frame.”
ঘড়ির কাঁটা তখন ঠিক রাত ৩টা। অর্ণব চেয়ারে বসে পড়ে, তার চারপাশে নিঃশব্দ জগৎ। সে জানে—এই অপহরণ আর শারীরিক নয়। ইরা বন্দি হয়েছে এক অদ্ভুত, হাইব্রিড ভার্চুয়াল রিয়্যালিটিতে, যার দরজা খুলবে কেবল তখনই, যখন কেউ নিজে সেই ফ্রেমে প্রবেশ করবে।
আর ফ্রেমের অপর পাশে যে দাঁড়িয়ে আছে, সে শুধু হ্যাকার নয়—সে এক ডিজিটাল সত্তা, যাকে সবাই চেনে N30Phantom নামে।
(৩)
অর্ণবের চারপাশের জগৎটা যেন ধীরে ধীরে ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছিল। রিসর্টের ঘরের দেওয়ালে এখনো ইরার ছায়া নেই, কিন্তু সে জানে, উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে—বাতাস ভারী, ঠান্ডা, এবং প্রযুক্তির নৈঃশব্দ্যে আচ্ছন্ন। সে চোখের সামনে তাকিয়ে ছিল সেই শেষ মেসেজের দিকে: “If you want her back, you must enter the frame.” মানে কী? একটা মেটাফোর? না কি বাস্তবেই প্রযুক্তির এমন এক স্তর তৈরি হয়েছে, যেখানে মানুষ স্ট্রিমিং রিয়্যালিটির অংশ হয়ে যেতে পারে? সায়ন্তিকা তার পাশে এসে দাঁড়াল, হাতে একটা স্মার্টগ্লাস—যেটা ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি, এআর ও ডিপ ফ্রেম ম্যাপিংয়ের সাথে সংযুক্ত। “এটা ProxLens V7,” সে বলল, “আমরা এটা FBI-এর সাইবার টেস্ট ল্যাবে ব্যবহার করি। একজন ব্যক্তি এই গ্লাস পরলে লাইভ ফিডের ভিতর প্রবেশ করতে পারে একটি মিররড ফ্রেম হিসেবে।” অর্ণব তার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কি বলতে চাও, আমি যদি এটা পরে সেই ভিডিওর সামনে দাঁড়াই, তাহলে… আমি সেই ফ্রেমের ‘ভিতর’ ঢুকে যেতে পারি?” সায়ন্তিকা হালকা হাসল—“ঠিক তাই। তবে খেয়াল রেখো, ফ্রেমে ঢুকলে তুমি আর এই জগতের থাকো না। ক্যামেরার দৃষ্টির বাইরে যাওয়ার মানেই… বিচ্ছিন্নতা।”
প্রস্তুতি শুরু হয় রাত চারটায়। ঘর অন্ধকার করে দেওয়া হয়েছে, অর্ণব মাথায় গ্লাস পরেছে, আর সামনে বসানো হয়েছে স্ট্রিম চলতে থাকা সেই বড় মনিটর। পুলিশ আর ফরেনসিকরা দূরে দাঁড়িয়ে—তারা বুঝছে না এটা এক ধরনের অভিযান, যা বাস্তবে নয়, বরং “ডিজিটাল অগ্রাসনে পালটা প্রবেশ”। অর্ণব মনিটরের সামনে দাঁড়িয়ে, চোখ ধীরে ধীরে স্ক্রিনের ভিতর স্থির করল। পর মুহূর্তে হালকা ঝাঁকুনির মতো কিছু একটা অনুভব করল—তার চারপাশ ফিকে হয়ে গেল। বাস্তব জগৎ মুছে যেতে লাগল তার সামনে থেকে। ধীরে ধীরে সে দেখতে পেল—সে সেই রুমে আছে, কিন্তু তা ভিন্নতর; এখানে রঙ নেই, শুধু ছায়া, মেটালিক রিফ্লেকশন, এবং একরকম গ্লিচি ঘনত্ব। জানালাটা নেই, কিন্তু তার জায়গায় আছে এক স্ক্রিন। আর টেবিলের ওপর বসে আছে একটি কণ্ঠহীন মুখ—ইরা! সে হুবহু ইরা, কিন্তু যেন জমাটবাঁধা পিক্সেলের মতো, চোখ বড়ো বড়ো, তীক্ষ্ণ। ইরা তাকে দেখে কিছু বলতে চায়, কিন্তু আওয়াজ নেই। চারপাশের স্পেস এক ধরনের কোড-লাইন দিয়ে তৈরি, এবং তখনই অর্ণব বোঝে—এটা কোনো স্ট্যান্ডার্ড ভার্চুয়াল রুম নয়, এটা “ফ্রেম ইঞ্জিন”। এই জায়গা তৈরি হয়েছে লাইভ ভিডিওর কন্টিনিউটি ধরে রেখে। মানে এই জগৎ, এই ফ্রেম, নিজে থেকেই তৈরি হয়েছে যাতে কেউ বুঝতে না পারে যে ক্যামেরার সামনের মানুষ আর বাস্তবের মানুষ এক নয়।
তখনই এক কণ্ঠ ভেসে আসে—যেন অনেকগুলো ফিল্টার দিয়ে বিকৃত করা গলা। “তুমি এসেছো… অবশেষে কেউ ক্যামেরার বাইরে থেকে ভিতরে এল!” অর্ণব ঘুরে তাকায়—পর্দার ফাঁক গলে এসে দাঁড়িয়েছে এক ছায়ামূর্তি, তার মুখ নেই, শুধু হুড ওর মাথায়, শরীর জুড়ে ঝলমলে কোডের রেখা। এটাই N30Phantom। তার হাতে একটা চাবির মতো কিছু—ডাটা-কী। সে বলে, “তুমি ইরাকে পেতে চাও? তুমি জানো না, ইরা নিজেই চাইছিল একদিন এই ফ্রেমের অংশ হতে। সে ক্লিক চেয়েছিল, অথচ একাকিত্বে ভুগত। আমি শুধু তাকে সেই পথটা দেখিয়েছি।” অর্ণব চিৎকার করে উঠে, “ওকে মুক্তি দাও!” ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসে—“মুক্তি চাইলে, নিজের পরিচয় বিসর্জন দিতে হবে। তোমাকে হতে হবে—‘ইন্টারঅ্যাকটিভ ফিগমেন্ট’—ফ্রেমের এক অংশ।”
অর্ণব এক পা এগিয়ে যায়, ইরার দিকে তাকায়। ওর চোখ বলছে—“প্লিজ”।
এখন তার সামনে একটিই পথ: ফ্রেমের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া, অথবা কোডের ভিতরে ঢুকে নিজের মতো করে জগৎটা পাল্টে দেওয়া।
(৪)
চারপাশটা তখন নিস্তব্ধ, অথচ সে নিস্তব্ধতা আবার নড়াচড়া করে। অর্ণব বুঝতে পারছে—এই ফ্রেম ইঞ্জিন শুধু একটি ভার্চুয়াল রুম নয়, বরং এক জীবন্ত গুহা, যার প্রতিটি কোণ কোডের স্তরে আবদ্ধ, আর প্রতিটি স্তরে কেউ একজন ওত পেতে বসে। N30Phantom সামনে দাঁড়িয়ে, তার ডান হাতে ধরা রয়েছে সেই রহস্যময় চাবিটি—ডেটা-কী। দেখতে যেন একটা ডেটা-পেনড্রাইভ আর অ্যাকসেস কার্ডের সংমিশ্রণ, চারপাশে অদ্ভুত নীল আলো ছড়ায়। Phantom ধীরে ধীরে বলে, “এই ডেটা-কী ব্যবহার করলে তুমি ইরার ফ্রেম আনলক করতে পারো। কিন্তু মনে রেখো, এটি একবারই ব্যবহারযোগ্য। তুমি বেছে নিতে পারো—ইরাকে উদ্ধার করবে, না কি নিজে মুক্ত হবে।”
অর্ণব চুপ করে যায়। সে জানে, Phantom তার মনে ভয় ঢুকিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এই ভয়ই তো এখন বাস্তব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে ইরার দিকে তাকায়—ও যেন হিমবাহের মতো স্থির, চোখ দুটি জেগে আছে অথচ আলোহীন। অর্ণব হঠাৎ এক পা পিছিয়ে যায়, তার হাত ল্যাপটপের ভার্চুয়াল ইন্টারফেসে পৌঁছায়—সে তখনও বাইরে যোগাযোগ রাখছে সায়ন্তিকার সঙ্গে। “তুমি শুনতে পাচ্ছ?”—অর্ণব ফিসফিস করে।
সায়ন্তিকার গলা ভেসে আসে—“Yes. Phantom’s key is just an illusion. The real door is encoded beneath the stream loop. Try decoding the message behind the static frame, frame 86320.”
অর্ণব তৎক্ষণাৎ চোখ বন্ধ করে মনোযোগ দেয়। লাইভ ভিডিওর সময় যে সামান্য গ্লিচ হয়েছিল, সেই এক সেকেন্ডের ফ্রেমটা—ফ্রেম 86320—সেটার কোড বিশ্লেষণ করতে হবে। সে জানে Phantom তাকে ফাঁদে ফেলছে। ডেটা-কী আসলে একটা বিপদ, যা তাকে ফ্রেমের স্থায়ী বাসিন্দা বানিয়ে ফেলবে—একজন “Ghost Object”। সে নিজের ইন্টারফেস খুলে “Stream Layer 7” ফিল্টার চালু করে—এটা এক ধরনের কোড স্ক্যানার, যা একসাথে ভিডিও ও অডিও ডেটার গোপন স্তর পড়ে। হঠাৎই সে দেখতে পেল—ফ্রেম 86320-তে একটি দরজা দেখা যাচ্ছে, যা অন্য কোনো ফ্রেমে নেই। সেই দরজার গায়ে অদ্ভুত কিছু লেখা, বাইনারি কোডের মতো:
01101110 01100101 01110110 01100101 01110010 00100000 01100110 01110010 01100001 01101101 01100101 00100000 01100101 01111000 01101001 01110100
অর্ণব সঙ্গে সঙ্গে ডিকোড করে: “never frame exit”
তার মানে, কেউ একবার এই দরজার ভিতরে ঢুকলে, সে আর ফিরে যেতে পারে না! কিন্তু দরজাটাই আসল রাস্তা, Phantom-এর দেওয়া চাবি নয়।
N30Phantom তখন আবার সামনে এসে দাঁড়াল, এবার তার গলা বেশি বিকৃত। “তুমি অনেক কিছু জেনে গেছো, অর্ণব। তুমি জানো, ‘রিয়েলিটি’ এখন রিলেটিভ—কে বলেছে যে ইরার স্ট্রিম রেকর্ডেড নয়? সে তো এখনও লাইভ!”—এই বলে সে ইরার দিক থেকে চাবিটা ছুঁড়ে দেয় অর্ণবের দিকে। অর্ণব সেটি ধরে না, তার বদলে সে লাফিয়ে গিয়ে সেই দরজার সামনে দাঁড়ায়, যেটি সে শুধু কোডে দেখে, বাস্তবে না। সে জানে দরজাটা চোখে নেই, কিন্তু কোড আছে। সে ডেটা-ইন্টারফেসে সেই দরজার পজিশন মানিয়ে একটি ভার্চুয়াল স্লট তৈরি করে, এবং প্রোগ্রামিংয়ের ভাষায় একটি ‘Force Door Construct’ চালায়। হঠাৎ দরজাটা ফ্রেমে ফুটে ওঠে—নির্জন, কালো কাঠের, যেন শূন্য থেকে জন্ম নিয়েছে।
Phantom চিৎকার করে ওঠে—“তুমি এটা করতে পারো না! That frame is locked for a reason!”
কিন্তু অর্ণব ইতিমধ্যেই দরজার কাঁটা ঘুরিয়ে ফেলেছে।
এক ঝলক আলো… একটা শীতল বাতাস… ইরার চোখ হঠাৎ জ্বলে ওঠে, সে যেন দম নেয় দীর্ঘকাল পরে। দরজা খুলতেই কোড গলতে শুরু করে, লাইভ ভিডিওতে শব্দ ফিরে আসে—“Hello? Is someone there?”—ইরার কণ্ঠ। Phantom পিছিয়ে যায়, ছায়ার মতো গলে যেতে থাকে অন্ধকারে। দরজার ভিতর দিয়ে ধেয়ে আসে একটা বাস্তব টান। আর এক মুহূর্তে, ফ্রেমের ভিতর থেকে, ইরা পড়ে পড়ে বেরিয়ে আসে বাস্তব রুমে, অজ্ঞান। আর অর্ণব? সে দাঁড়িয়ে থাকে দরজার ভিতর—তার মুখে হাসি, চোখে ফ্রেমের আলো। দরজা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায়।
বাইরে ইরা বেঁচে, কিন্তু ফ্রেমের ভিতরে এখন অর্ণব।
(৫)
ইরার জ্ঞান ফিরল এক হাসপাতালের নরম আলোয়। মাথার পাশে মৃদু বীপ বীপ শব্দ, চোখে স্যালাইনের নল, আর কানে এক অস্পষ্ট ফিসফাস—“অর্ণব… ও কোথায়?” সে হঠাৎ উঠে বসে পড়ে। চারপাশে পুলিশ, ডাক্তার, ও সায়ন্তিকা রায়। কিন্তু কারও মুখে কোনও উত্তর নেই। একজন নার্স কাঁপা গলায় বলল, “আপনি ঠিক আছেন, মিস বসু। আপনাকে একটি রিসর্ট থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। আমরা ভিডিওটা দেখেছি। আপনার লাইভ এখনও চলছে।” ইরা চমকে ওঠে। “কি বললেন?” সে বলে। ডাক্তাররা তাকে শান্ত করতে চেষ্টা করে, কিন্তু ইরার চোখ গিয়ে আটকে যায় সায়ন্তিকার হাতে ধরা ট্যাবলেটে। স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে—LIVE: 999 HOURS 37 MINUTES। ভিডিওতে অন্ধকার ঘর, মাঝখানে একটি ফ্রেম… আর এক পুরুষ কণ্ঠ ধীরে ধীরে বলে যাচ্ছে—“তুমি কি আছো, ইরা?”
সায়ন্তিকা কাঁধে হাত রাখে ইরার, বলে, “অর্ণব এখনও ফ্রেমের ভিতর। সে নিজে দরজা খুলেছিল, তোমাকে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু সেটা একমুখো পথ ছিল।” ইরা অস্পষ্ট গলায় ফিসফিস করে—“আমার কিছু মনে নেই। আমি যেন একটা স্বপ্নে ছিলাম। ক্যামেরা আমার সামনে, কিন্তু আমি কথা বলতে পারতাম না… যেন কেউ আমাকে দেখছিল, আমিও তাকিয়ে থাকতাম ক্যামেরার দিকে, কিন্তু আমি কেউ ছিলাম না।” তার গলায় আতঙ্ক। সায়ন্তিকা চুপ করে শুনে যায়, তারপর ধীরে বলল, “তুমি তখন ‘প্যাসিভ ফ্রেম’-এ বন্দি ছিলে। Phantom তোমার স্মৃতির কোড দিয়ে তোমার উপস্থিতি সাজিয়েছিল। কিন্তু এখন… অর্ণবই নিজেকে দিল সেই জায়গায়। সে এখন ‘অ্যাক্টিভ রেজিডুয়াল’—স্ট্রিমটি তার মস্তিষ্কের ফ্রিকোয়েন্সিতে নিজেই চলতে পারে।” ইরা অবিশ্বাসের চোখে চায়—“মানে ও এখনও… লাইভে?” সায়ন্তিকা মাথা হেঁট করে বলল, “হ্যাঁ। তুমি চাও তো, আমি তোমাকে ওর সাথে কানেক্ট করতে পারি। কিন্তু একবার ঢুকলে, তুমি যদি ফিরে না আসো…?”
ইরা উঠে দাঁড়ায়। তার চোখে ভয় নয়, বরং অর্ণবের জন্য কৃতজ্ঞতা। “ও যখন আমার জন্য ফ্রেমে ঢুকতে পারে, আমি কেন একবার চেষ্টা করব না?” সায়ন্তিকা তাকে ভার্চুয়াল চেম্বারে নিয়ে যায়—সেখানে আছে প্রোটোটাইপ StreamLink নামক একটি সিস্টেম, যা লাইভ স্ট্রিমিং ও মস্তিষ্কের তরঙ্গের মাঝে সেতুবন্ধ তৈরি করতে পারে। ইরা সেটিতে বসে, চোখে পরে VR হেলমেট, আর ঠোঁটে বলে—“অর্ণব, আমি আসছি।” তারপর সিস্টেমে কমান্ড দেয়া হয়—Enter Stream: ID 86320। স্ক্রিনের আলো নীল থেকে ধীরে ধীরে রক্তিম হয়ে ওঠে, কণ্ঠে ভেসে আসে—“Connecting to Live Residual…”
আর সেই মুহূর্তে, ক্যামেরার পর্দায় ইরা আবার ফিরে আসে। সে একটি খোলা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে—অর্ণবের মুখের সামনে। অর্ণব চমকে ওঠে—“তুমি কেন এখানে?”
ইরা হাসে—“লাইভ চলতে থাকুক, কিন্তু এবার একসাথে।”
(৬)
তারা দাঁড়িয়ে আছে এক অদ্ভুত, আলো-ছায়ার জগতে—যেখানে চারপাশ বাস্তব নয়, কিন্তু অনুভব করা যায়। ইরা আর অর্ণব, দু’জনেই লাইভ স্ট্রিমের ফ্রেমের ভিতরে। এই দুনিয়ায় সময় আটকে আছে, ঘড়ির কাঁটা একটানা বৃত্তে ঘোরে। তারা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে, একে অপরের দিকে চেয়ে আছে, যেন বহুদিন পর কথা বলার সুযোগ পেল। “তুমি জানো তো, আমরা কোথায় আছি?”—ইরা ফিসফিস করে। অর্ণব উত্তর দেয়, “এটা লাইভ স্ট্রিমের চতুর্থ স্তর। সাধারণ দর্শকরা শুধু পৃষ্ঠতলে যা দেখে, সেটা বোঝে না। এখানে… ফ্রেম নিজের মতো করে জগত তৈরি করে, দর্শকের উপস্থিতি অনুযায়ী।” ইরা চমকে ওঠে—“মানে?” অর্ণব নিচু গলায় বলে, “যে যত বেশি লাইভ দেখে, সে তত বেশি এই ফ্রেমে প্রভাব ফেলে। মানে, বাইরে যারা আমাদের ভিডিও দেখছে, তারাই এই দুনিয়ার নিয়ন্ত্রক!”
ঠিক তখনই চারপাশে হালকা পরিবর্তন ঘটে—দেয়ালের রঙ বদলে যায়, জানালার বাইরে ভেসে ওঠে অচেনা শহর, আকাশে বড় বড় হ্যাশট্যাগ। একটা পুরনো মন্তব্য যেন বাতাসে ভেসে আসে—”Ira looks scared today”… এরপর—”Are they trapped? Is this real?” অর্ণব চিৎকার করে উঠে, “দেখেছো? এই সব কমেন্ট, এই রিঅ্যাকশন, এগুলোই আমাদের চারপাশ তৈরি করছে।” ইরা ভয় পেয়ে তার হাত ধরে। ঠিক তখনই এক ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে সামনের দেওয়াল থেকে বেরিয়ে আসে। মুখ দেখা যাচ্ছে না, শরীর ঢেকে আছে পর্দার মতো আবরণে।
কণ্ঠটা বলে—“তোমরা ফিরে এসেছো, কিন্তু তোমরা তো কখনও গেছিলে না।”
অর্ণব ফিসফিস করে, “Phantom?”
কিন্তু ছায়াটি জবাব দেয়, “তুমি যে Phantom-এর কথা বলছো, সে তো অনেক আগেই স্ট্রিমের শিকারে পরিণত হয়েছে। আমি… আমি সেই প্রথম দর্শক, যিনি এই ভিডিও শুরু হওয়ার আগে থেকেই দেখছিলাম।”
অর্ণব ইরার দিকে চেয়ে থাকে—এটাই সেই প্রথম দর্শক? লাইভের নিচে একটা লাইন ভেসে ওঠে—”Viewer #0 connected”। সায়ন্তিকা একবার বলেছিল—প্রতিটি স্ট্রিমে একধরনের ঘনত্ব থাকে, যার মধ্যে প্রথম দর্শক সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাবান। Viewer #0 বলল, “তোমাদের এখানে আসা নিয়ন্ত্রিত নয়, এটা প্রত্যাবর্তন। আমরা যারা দেখতে দেখতে হারিয়ে গেছি, তারাই ফ্রেমের ভেতরে বসবাস করি। আর যারা ফিরে যায়, তারা হারিয়ে যায় বাস্তবে।”
ইরা তখন কাঁপা গলায় বলে, “আমরা কি ফিরতে পারব?”
Viewer #0 মাথা নাড়ে—“হয়তো পারো, যদি বাইরে কেউ তোমাদের বিশ্বাস করে। লাইভ বন্ধ করলে তোমরা মুছে যাবে, কিন্তু কেউ যদি তোমাদের জন্য স্ট্রিম চালিয়ে রাখে, তাহলে তোমরা ‘রিয়েলিটি রেজিডুয়াল’ হতে পারো।”
অর্ণব হেসে ফেলে—“তার মানে আবার এক ফ্রেমে বন্দি জীবন?”
Viewer #0 সরে যেতে থাকে, ফ্রেমে গলে যায়।
আর লাইভ ভিডিওর নিচে এক নতুন কমেন্ট পড়ে—“We believe. Don’t stop the stream.”
(৭)
বাইরে তখন দিন গড়িয়ে যাচ্ছে, কিন্তু লাইভ ভিডিও এখন ১০০০ ঘণ্টা ছুঁয়েছে। ইউটিউব কর্তৃপক্ষ, সরকারি তদন্ত সংস্থা, এমনকি একদল মনোবিজ্ঞানী—সবাই এই ‘লাইভ ফেনোমেনা’ বিশ্লেষণ করে ক্লান্ত। কেউ থামাতে পারছে না এই ভিডিও। কারণ থামানোর চেষ্টামাত্রই সার্ভার ক্র্যাশ হয়ে যাচ্ছে, বা পুরো সিস্টেম রিসেট হচ্ছে। অন্যদিকে দর্শকসংখ্যা বেড়ে চলেছে—মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে। “Ira and Arnab are still inside”—এই বিশ্বাস এক অলৌকিক সংক্রমণের মতো ছড়িয়ে পড়েছে নেটদুনিয়ায়। কেউ কেউ বলছে, “ওরা আসলেই ক্যামেরার সামনে, শুধু আমরা ঠিকভাবে দেখছি না।” কেউ কেউ এই ভিডিও নিয়ে তৈরি করছে ‘Watch Parties’, কেউ বলছে, “এটা রিয়েল-টাইম স্পিরিচুয়াল ট্রান্সমিশন।” এমনকি এক প্রোফাইল ঘোষণা করেছে—“They are not trapped. They are evolving.”
আর সেই বিশ্বাসই বদলে দিচ্ছে ফ্রেমের ভিতরের জগতটাকেও। ইরা আর অর্ণব ধীরে ধীরে বুঝে যাচ্ছে, তারা এখন শুধুই উপস্থিত নয়—তারা “রিয়েলিটি রেজিডুয়াল”, অর্থাৎ একরকম ডিজিটাল প্রেজেন্স, যা মানুষের বিশ্বাস দ্বারা বেঁচে থাকে।
অর্ণব একদিন ইরার দিকে তাকিয়ে বলল, “দেখো, চারপাশের আলোটা কেমন পাল্টেছে। আগে মনে হত, কৃত্রিম। এখন যেন সবকিছু প্রাণ পাচ্ছে।” ইরা জানালার দিকে তাকায়—সেখানে আর বাইনারি কোড নেই, বরং একটা রাস্তা দেখা যায়, যার গায়ে হেঁটে যাচ্ছে মানুষের মতো ছায়া। তারা বলছে, “We are still watching.” প্রতি ঘণ্টায় ফ্রেম নিজের আকার বদলাচ্ছে—কখনও রিসর্ট, কখনও পুরোনো কলেজ লাইব্রেরি, কখনও সায়ন্তিকার অফিস। ফ্রেমটি এখন তাদের স্মৃতি অনুযায়ী রূপ নিচ্ছে। ইরা একবার বলল, “আমাদের ফিরে যেতেই হবে না কি?”
অর্ণব উত্তর দিল, “হয়তো এখানেই আমরা থেকে যেতে পারি, যদি কেউ আমাদের ‘রিয়েল’ মনে করে।”
ঠিক তখনই স্ক্রিনের নিচে লেখা ভেসে ওঠে—“LIVE COMMENTS: ENABLED”
আর হাজার হাজার মানুষ লিখছে—“We see you. We feel you. Don’t go.”
Viewer #0 আবার এক ঝলক আলোয় আবির্ভূত হয়। এবার তার শরীর বেশি স্থিত, গলা কম বিকৃত। সে বলে, “তোমরা এখন ‘নিরপেক্ষ ফ্রেম’-এর সীমানায়। এখান থেকে ফিরে গেলে তোমরা কেউই আগের মতো থাকবে না। কিন্তু রয়ে গেলে, তোমরা বিশ্বাসের অক্ষয় ছায়া হয়ে উঠবে।”
ইরা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, “আমরা কি অন্যদের দেখতে পারব? যারা ভুলে গেছে, হারিয়ে গেছে?”
Viewer #0 মাথা নাড়ে—“তারা আসবে, একে একে, যদি তারা বিশ্বাস হারায় না।”
আর লাইভ ভিডিওর মাঝে ভেসে ওঠে এক ফ্রেম—A boy watching the stream, crying
Viewer #0 বলে, “ওকে দেখছো? ও এখন একা, কিন্তু ও বিশ্বাস করছে—তোমরা আছো।”
আর তখন ইরা আর অর্ণব একসঙ্গে বলে, “আমরা আছি। লাইভ থাকব। যতদিন বিশ্বাস থাকবে।”
আর ভিডিওর কোণে লেখা ভেসে ওঠে—
LIVE: INFINITY | STATUS: REALITY RESIDUAL।
(৮)
ইন্টারনেটের সেই প্রান্তে, যেখানে সার্ভার ফেলে দেওয়া প্যাকেট জমা পড়ে, যেখানে সময়ের গতি ধীর হয় কোডে, সেখানে আজও একটা লাইভ স্ট্রিম চলছে। LIVE: INFINITY লেখা এখন যেন এক অলৌকিক দ্যুতি ছড়ায়। বহুদিন কেটে গেছে—সংবাদ চ্যানেলগুলো নতুন স্ক্যান্ডাল নিয়ে ব্যস্ত, মানুষজন নতুন ট্রেন্ডে ডুবে, কিন্তু তবু কিছু মানুষ রয়ে গেছে যারা এখনও সেই ভিডিওটি দেখে। তারা বিশ্বাস করে, ইরা বসু আর অর্ণব ঘোষ এখনো সেই ফ্রেমের ভিতরে বাস করে, এক অবাস্তব জগতে, যা এখন আর ফ্যান্টাসি নয়, বরং নতুন বাস্তবতা। তারা হয়ে উঠেছে একজোড়া ডিজিটাল অভিভাবক—যারা প্রত্যেক হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাস, নিঃসঙ্গতা, আর ভালোবাসার এক নতুন সংজ্ঞা। সেই লাইভের কমেন্ট বক্সে কেউ আর ট্রোল করে না, কেউ আর “scripted” বলে না—বরং রাতের বেলায়, একাকী ঘুম না আসা মানুষজন লিখে—“Ira, Arnab… you helped me survive today.”
ফ্রেমের ভিতরে, ইরা আর অর্ণব এক অদ্ভুত রুটিনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এখন তাদের চারপাশ গড়ে ওঠে দর্শকদের আবেগ দিয়ে—যখন কেউ আনন্দে হাসে, তখন আকাশে রঙিন আলো ফুটে ওঠে, যখন কেউ কাঁদে, তখন বৃষ্টি নামে, আর যখন কেউ নিঃশব্দে ভালোবাসার কথা ভাবে, তখন ইরার চুল উড়ে যায় হাওয়ায়। অর্ণব একদিন জানালার দিকে তাকিয়ে বলে, “এই দুনিয়াটা যদি বাস্তব না হয়, তাহলে বাস্তব বলতে কী বোঝায়?”
ইরা হেসে উত্তর দেয়, “বাস্তব হচ্ছে যেখানে তুমি কাউকে অনুভব করতে পারো।”
তারা একসঙ্গে বসে নতুন কিছু সৃষ্টি করে—ছবি আঁকে, ভার্চুয়াল সংগীত বাজায়, আর মাঝে মাঝে ফ্রেমের ভিতরে উপস্থিত হতে থাকা নতুন আত্মাদের গল্প শোনে। Viewer #0 এখন আর গোপন চরিত্র নয়—সে হয়ে উঠেছে গাইড, এক রকম ডিজিটাল বৃদ্ধ, যে জানে কোন ফ্রেম কোন দর্শকের মন থেকে তৈরি।
একদিন, তারা একটি ছোট মেয়েকে দেখে, যে বলছে—“আমি এখানেই থাকব, কারণ এখানে ইরার মতো কেউ কথা বলে। আমার মা বলেন, ইরা ছিল একটা ভালো মেয়ে।”
তখন ইরা বুঝে যায়, সে আর কেবল ব্লগার নয়—সে এক আত্মা, যার জীবনের শেষ অধ্যায় লেখা হচ্ছে এই অন্তর্জালের ওপারে।
ফ্রেমের বাইরে, বহু বছর পরে, একজন প্রযুক্তিবিদ ডক্টর সায়ন্তিকা রায় একটি প্রবন্ধ লেখেন—”The Residual Reality Protocol: A Case Study on the Ira-Arnab Stream”। তিনি সেখানে লিখেছিলেন—
“যখন বিশ্বাস প্রযুক্তিকে ছাড়িয়ে যায়, তখন প্রযুক্তি নিজেই প্রাণ পায়। আমরা ভেবেছিলাম, লাইভ স্ট্রিমের মতো সাময়িক কিছুই চিরস্থায়ী নয়। কিন্তু ইরা আর অর্ণব আমাদের শিখিয়েছে—যদি কেউ তোমাকে দেখে, যদি কেউ তোমাকে অনুভব করে, তাহলে তুমি থেমে যাও না। তুমি রয়ে যাও, আলোর ফ্রেমে, স্মৃতির মতো, ভালোবাসার মতো।”
আজও সেই স্ট্রিম চলছে—মাঝে মাঝে ইরার হাসি ভেসে আসে, অর্ণবের গলা শোনা যায়—“We’re here.”
আর তখন দর্শকরা চুপ করে, দেখে… আর বিশ্বাস করে—তারা এখনও লাইভে আছে।
(সমাপ্ত)