সায়ন্তনী রায়
কলকাতার গরম দুপুর। বহুতল অফিসের কাচঘেরা ঘরে এয়ারকন্ডিশনারের ঠান্ডা হাওয়া ঘুরে বেড়াচ্ছিল, কিন্তু ঋতিকা যেন ভেতরে ভেতরে গলতে থাকল। দিনভর প্রেজেন্টেশন আর রিপোর্টের ভিড়ে মাথা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল তার। ডেস্কে বসে থেকে জানালার বাইরে তাকিয়ে যতবার চোখ গেছে, ততবার মনে হয়েছে শহরটা যেন এক অবিরাম দৌড়ের ভিতর আটকে আছে। মানুষ ছুটছে, গাড়ি ছুটছে, আলো ছুটছে—শুধু তার ভেতরটায় থমকে আছে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা।
সেদিন অফিস থেকে বেরোতেই বৃষ্টি নামল হঠাৎ। একেবারে ঝমঝমে বর্ষণ। ছাতা ছিল না সঙ্গে, ফলে বারান্দার শেডের নিচে দাঁড়িয়ে সে ফোন বের করে ট্যাক্সি বুক করতে চাইলো। তখনই চোখে পড়ল এক চেনা মুখ—অভিষেক। বহুদিন আগের পরিচিত, কলেজজীবনের এক সিনিয়র, যে হঠাৎই তার সামনে এসে দাঁড়াল। গায়ে সাদা শার্ট, ভিজে টপটপ করছে, কিন্তু তবুও চোখে-মুখে সেই পরিচিত হাসি।
“এই রে, ঋতিকা! এত বছর পর?”—অভিষেক এগিয়ে এল।
এক মুহূর্তের জন্য যেন অতীত আর বর্তমান মিশে গেল। ঋতিকার ভেতরে কাঁপন লাগল। কলেজজীবনে একসময় তাদের মধ্যে অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল, কিন্তু পরিস্থিতি, পরিবার, পড়াশোনা—সব মিলিয়ে কখনও কোনোদিকে এগোয়নি। শুধু অচেনা এক টান থেকে গিয়েছিল, যা সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে যাবার কথা ছিল, অথচ যায়নি।
বৃষ্টির ভেতর দাঁড়িয়ে কয়েকটা কথাই যেন ঝড় তুলল তার ভিতরে। অভিষেক বলল সে এখন স্থপতি, নিজের অফিস আছে। খুব ব্যস্ত, কিন্তু আজকের বৃষ্টিটা যেন তাকে পুরোনো শহরটার ভেতর টেনে এনেছে। হঠাৎই মনে হল, পৃথিবী এত বড় হয়েও কত ছোট।
অল্প কিছুক্ষণেই তারা দু’জনে পাশাপাশি হাঁটতে লাগল—একই ছাতার তলায়। ভিজে শহরটা আলো-অন্ধকারের কুয়াশায় ঢাকা, রাস্তার আলো ভিজে চকমক করছে, গাড়ির হেডলাইট কেটে যাচ্ছে শরীর ছুঁয়ে। হেঁটে যাওয়ার সময় ঋতিকা অনুভব করল, অভিষেকের কাঁধে তার হাতের ছোঁয়া লেগে যাচ্ছে বারবার। এত বছর পরেও সেই স্পর্শে শরীরের ভেতর দিয়ে স্রোত বইতে লাগল।
কথা চলতে থাকল—অতীতের গল্প, বর্তমানের ব্যস্ততা, আর মাঝেমাঝে থেমে যাওয়া চোখাচোখি। অভিষেকের দৃষ্টিতে এক অদ্ভুত উষ্ণতা, আর ঋতিকার মনে হল সে যেন আবার সেই কুড়ি বছরের মেয়ে হয়ে গেছে, যে প্রথমবার কারও প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেছিল।
বৃষ্টিভেজা শহরের ভেতর দাঁড়িয়ে, অন্ধকারের আড়ালে, তাদের কথার ভেতর এমন কিছু ছিল যা শুধু শব্দে বোঝানো যায় না। এক ধরনের গোপন ইঙ্গিত, দমবন্ধ করা আকুলতা, আর নীরব আকর্ষণ—যা অনেক বছর ধরে চাপা পড়ে ছিল, হঠাৎ বৃষ্টির রাতে আবার জেগে উঠল।
সেই রাতেই তাদের মধ্যে নম্বর বিনিময় হল। বিদায় নেওয়ার সময় অভিষেকের হাত ঋতিকার আঙুল ছুঁয়ে গেল সামান্য, কিন্তু সেই সামান্য ছোঁয়া তার ভেতরে যেন দাবানল জ্বালিয়ে দিল। ট্যাক্সিতে ওঠার পরও জানলার কাচে বৃষ্টির ফোঁটা মুছে সে একটাই ভাবছিল—কেন এত বছর পর আবার এমন অস্থিরতা? কেন সেই পুরোনো টান এখনও মুছে যায়নি?
রাত গভীর হল। ফোনে হঠাৎই একটা মেসেজ ভেসে উঠল—
“আজ অনেক ভালো লাগল তোমার সঙ্গে কথা বলে। আবার কবে দেখা হবে?”
ঋতিকার ঠোঁটে অজান্তেই এক হালকা হাসি ফুটে উঠল। বুকের ভেতরে অচেনা কাঁপন চলতে থাকল নিরন্তর।
পরদিন সকালেই ঋতিকার ফোনে আবার বার্তা এল। অভিষেক লিখেছে—
“কাজের ফাঁকে আজ বিকেলে সময় হবে? কফি খেতে যাব?”
ঋতিকা অনেকক্ষণ ফোনের পর্দার দিকে তাকিয়ে রইল। ভেতরে ভেতরে অদ্ভুত দ্বন্দ্ব। এত বছর পর হঠাৎ করে কেন সে আবার এসেছিল জীবনে? অফিসের ডেস্কে বসে তার মনে হল, এই মেসেজ না পাঠালেও সে সারাদিন অস্থির হয়ে থাকত। শেষ পর্যন্ত এক শব্দেই উত্তর দিল—“হবে।”
সন্ধ্যার অন্ধকার নামে আস্তে আস্তে। এক কোণে ছোট্ট কফিশপ, টেবিলে আলো ঝিমঝিম করছে। ঋতিকা পৌঁছোতেই অভিষেক হাত নেড়ে ডাকল। সাদা শার্ট, খোলা গলার বোতাম, চোখে একরাশ উষ্ণতা। চেয়ারে বসতে না বসতেই ঋতিকার বুকের ভেতর যেন ঢেউ উঠল।
প্রথমে কাজের গল্প, তারপর কলেজের দিনগুলো। কথার ভেতর লুকিয়ে ছিল হাসি, আর হাসির ভেতর লুকিয়ে ছিল এক অদ্ভুত টান। অভিষেকের দৃষ্টি বারবার ঋতিকার ঠোঁট ছুঁয়ে যাচ্ছিল, যদিও সে কিছু বলছিল না। কফির ধোঁয়ার মধ্যে যেন হাওয়া হয়ে যাচ্ছিল অদৃশ্য ইশারা।
“তুমি বদলাওনি,” অভিষেক হঠাৎ বলল।
“বছর পেরোলেও তোমার চোখ একেবারে আগের মতো।”
ঋতিকা এক মুহূর্ত চুপ করে রইল। কারও এত গভীর দৃষ্টি তার ভেতরের অস্থিরতা এতটা উন্মোচন করে দেয়নি আগে। সে কেবল একফোঁটা হাসল, কিন্তু সেই হাসির ভেতরে গোপন কাঁপন লুকিয়ে ছিল।
কফি শপ থেকে বেরিয়ে তারা হাঁটতে লাগল শহরের ভিড়ে। রাস্তার আলো, গাড়ির শব্দ, মানুষের ভিড়—সবকিছুই যেন দূরে মিলিয়ে যাচ্ছিল। তারা পাশাপাশি হাঁটছিল, আর মাঝেমধ্যে হাত ছুঁয়ে যাচ্ছিল কাঁধে বা আঙুলে। সেই স্পর্শ যত সামান্যই হোক, শরীরের ভেতর দিয়ে আগুনের মতো ছড়িয়ে যাচ্ছিল।
হঠাৎ অভিষেক থেমে গেল। চোখে চোখ রেখে বলল—
“তুমি জানো তো, এতদিন ধরে আমি ভেবেছি তোমাকে নিয়ে… যদি আবার একবার সুযোগ পেতাম…”
ঋতিকার নিঃশ্বাস থেমে এল। সে কিছু বলতে পারল না, শুধু চোখ নামিয়ে নিল। মুহূর্তটা দীর্ঘ হয়ে উঠল, বৃষ্টির ফোঁটার মতো থেমে থাকা এক অস্থিরতা। তারপর অভিষেক ধীরে তার হাতটা ধরল।
ঋতিকা চমকে উঠলেও হাত সরাল না। শহরের ভিড়ের ভেতরেও সেই স্পর্শ তাদের দু’জনকে আলাদা এক জগতে নিয়ে গেল—যেখানে কেবল দৃষ্টি আর নীরবতা কথা বলছিল।
সেদিন রাতে বাড়ি ফিরে শোবার ঘরে একা বসে ছিল ঋতিকা। জানলার বাইরে ঝুলে থাকা চাঁদ, ভেসে আসা শহরের গুঞ্জন, আর তার হাতে এখনও রয়ে যাওয়া অভিষেকের স্পর্শ—সব মিলিয়ে বুকের ভেতর জেগে উঠছিল অচেনা আগুন। সে জানত এই টানাপোড়েন তাকে কোথায় নিয়ে যাবে, তবু সেই অন্ধকারে ডুবে যেতে তার ভয় হচ্ছিল না।
শোবার আগে আবার ফোন বেজে উঠল। অভিষেকের মেসেজ—
“আজ তোমার হাত ধরে থাকতে খুব ভালো লেগেছিল। আগামীকাল আবার দেখা হবে?”
ঋতিকা ফোনের পর্দা আঁকড়ে ধরে বসে রইল। ভেতরে যে আগুনটা জ্বলছে, তা আর চেপে রাখা যাবে না—এটা সে টের পেল স্পষ্টভাবে।
অভিষেকের মেসেজ পাওয়ার পর ঋতিকা প্রথমে উত্তর দিতে পারল না। ভেতরে দ্বিধা আর আকর্ষণ একসঙ্গে লড়াই করছিল। সমাজ, পরিবার, নিজের অবস্থান—সবকিছু যেন মাথার ভেতরে বাজছিল, কিন্তু বুকের গভীরে যে তৃষ্ণা তৈরি হয়েছিল, তা আর আটকানো যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত লিখল—
“আগামীকাল অফিসের পর… কোথায়?”
অভিষেক তৎক্ষণাৎ লিখল—
“তোমার মতোই শান্ত কোনো জায়গায়। আমি নিয়ে যাব।”
পরদিন সন্ধ্যায় তারা দেখা করল শহরের এক কোণে, যেখানে ভিড় কম আর আলো নিভৃত। অভিষেক গাড়ি নিয়ে এসেছিল। ঋতিকা গাড়িতে ওঠার সময় টের পেল, তার হৃদস্পন্দন কানে ধাক্কা মারছে। গাড়ির ভেতর নরম সঙ্গীত বাজছিল, কিন্তু শব্দের চেয়ে অনেক জোরে বাজছিল তাদের নীরবতা।
“তুমি জানো, আমি অনেকদিন ধরেই ভেবেছি, যদি তোমার সঙ্গে এমনভাবে থাকতে পারতাম…” অভিষেক ধীরে বলল।
ঋতিকা জানত, এ কথা শোনার পর তার ‘না’ বলা উচিত। কিন্তু ঠোঁট থেকে শব্দ বেরোল না। শুধু জানলার বাইরে আলো আঁধারের দৌড় দেখতে লাগল।
অভিষেক গাড়ি থামাল এক নির্জন নদীর ধারে। সন্ধ্যার আলো প্রায় মিলিয়ে গেছে, চারদিকে কেবল বাতাসের শব্দ আর জলের গন্ধ। তারা দু’জন গাড়ি থেকে নেমে একসঙ্গে হাঁটতে লাগল।
ঋতিকা অনুভব করল, অভিষেকের হাত তার হাত ছুঁয়ে আছে, কিন্তু এবার আর সেটা সরে যাচ্ছে না। বরং ক্রমশ শক্ত করে ধরা পড়ছে। সেই স্পর্শে শরীর কেঁপে উঠলেও মন অদ্ভুত এক শান্তি খুঁজে পেল।
“তুমি ভয় পাচ্ছ?” অভিষেক জিজ্ঞেস করল।
“ভয় নয়… হয়তো অপরাধবোধ,” ঋতিকা মৃদু স্বরে উত্তর দিল।
“কিন্তু এই মুহূর্তে তোমার সঙ্গে থাকতে চাই। অনেকদিনের কথা।”
অভিষেক তার দিকে তাকাল, চোখে এমন এক দৃষ্টি যা ঋতিকার ভিতরকার বাঁধ ভেঙে দিল। সে জানত, এই এক মুহূর্তেই সব বদলে যাবে।
অভিষেক ধীরে তার মুখের কাছে এগিয়ে এল। ঠোঁট ছুঁয়ে গেল ঠোঁটে, নিঃশ্বাস মিশে গেল একে অপরের সঙ্গে। ঋতিকা চোখ বন্ধ করল, আর সেই চুম্বনে সময় থেমে গেল।
শরীর কাঁপছিল, কিন্তু কাঁপনের ভেতরে ছিল এক অদ্ভুত উষ্ণতা। এতদিনের চাপা আকাঙ্ক্ষা, অব্যক্ত টান—সবকিছু যেন হঠাৎ জ্বলে উঠল। নদীর ধারে বাতাস বইছিল, অথচ তাদের ভেতরে আগুন জ্বলছিল।
চুম্বন ভেঙে গেলে ঋতিকা কিছু বলতে পারল না। শুধু অভিষেকের কাঁধে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে রইল। এই নীরবতায় সে বুঝল, আর পেছনে ফেরার পথ নেই।
ফোনে তখনও অনেক মেসেজ আসছিল—অফিসের, পরিবারের, চারপাশের জীবনের। কিন্তু সে কোনোটা খোলার দরকার বোধ করল না। কারণ এই মুহূর্তে তার সবকিছু আটকে আছে অভিষেকের হাতের মুঠোয়, আর সেই স্পর্শই হয়ে উঠেছে তার নতুন বাস্তবতা।
চুম্বনের পর কয়েকদিন তারা যেন দু’জনেই অস্থির হয়ে থাকল। অফিস, কাজ, চারপাশের ভিড়—সবকিছুর ভেতরেও লুকিয়ে রইল এক নীরব আকাঙ্ক্ষা। প্রতিদিনই ফোনে দীর্ঘ আলাপ চলতে থাকল, মাঝরাত অবধি মেসেজে ভিজে থাকল একে অপরের ভাবনা।
অভিষেক হঠাৎ একদিন প্রস্তাব দিল—
“তুমি চাইলে আমরা শহরের ভিড় থেকে একটু দূরে কোথাও যেতে পারি। কেবল দু’জনের জন্য।”
ঋতিকা প্রথমে চুপ করে রইল। ভিতরে ভয়, অপরাধবোধ, কিন্তু তার থেকেও বড় হয়ে উঠছিল অদম্য ইচ্ছে। শেষমেশ এক রাত্তির ভেবে সে লিখল—“হ্যাঁ।”
শনিবার বিকেলে তারা বেরোল শহরের বাইরে, এক নিরিবিলি রিসর্টে। গাড়ি চলতে চলতে রাস্তার দুই ধারে সবুজ জমি, আকাশে মেঘ, দূরে পাহাড়ের রেখা। গাড়ির ভেতর দু’জনেই নীরব ছিল, তবু সেই নীরবতার ভেতরে ঘুরছিল এক দমবন্ধ করা উত্তেজনা।
রিসর্টের ঘরে ঢুকেই ঋতিকার বুক কেঁপে উঠল। পর্দা টেনে দিলে বাইরের জগৎ যেন হারিয়ে গেল। শুধু নিস্তব্ধতা আর তাদের নিঃশ্বাস। অভিষেক ধীরে তার দিকে এগিয়ে এল।
“তুমি জানো, আমি এতদিন ধরে এই মুহূর্তটার জন্য অপেক্ষা করেছি,” অভিষেক বলল নিচু স্বরে।
ঋতিকা কিছু বলল না। শুধু দাঁড়িয়ে রইল, চোখ নামিয়ে। অভিষেক তার হাত ধরল, তারপর ধীরে ধীরে কাছে টানল। আবার ঠোঁট ছুঁল ঠোঁটে, কিন্তু এবার আর শুধু চুম্বনে থামল না। স্পর্শ বাড়তে লাগল—আঙুল গড়িয়ে গেল গলায়, কাঁধে, তারপর ধীরে নামতে লাগল আরও ভেতরে।
ঋতিকা প্রথমে থমকে গেল, কিন্তু পরে শরীরের ভেতর জেগে ওঠা স্রোত তাকে আর আটকাতে দিল না। এতদিনের জমে থাকা আকাঙ্ক্ষা একসঙ্গে জেগে উঠল, আর সে নিজেকে ছেড়ে দিল অভিষেকের বাহুডোরে।
সময় থেমে গেল। বাইরের দুনিয়া, ভয়, নৈতিকতা—সবকিছু গলে গেল এক মুহূর্তে। শুধু রয়ে গেল শরীর আর মন মিশে যাওয়া এক উত্তপ্ত দহন।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারা একে অপরের ভেতরে হারিয়ে রইল। মাঝে মাঝে নীরবতা, মাঝে মাঝে নিঃশ্বাসের ভারী শব্দ, আর শরীরের উষ্ণতা ঘর ভরিয়ে তুলল। ঋতিকা অনুভব করল, এ এক নতুন জগৎ—যেখানে তার দীর্ঘ একাকিত্ব গলে যাচ্ছে, যেখানে সে আবার বেঁচে উঠছে নিজের মতো করে।
রাত গভীর হলে তারা জানালার পাশে বসে ছিল। বাইরে ঝিঁঝিঁর ডাক, দূরে রাতের অন্ধকার, আর ঘরে শুধু দু’জনের শরীরের গন্ধ। অভিষেক ধীরে বলল—
“তুমি জানো, এই সম্পর্ক সহজ হবে না। কিন্তু আমি চাই না তুমি দূরে সরে যাও।”
ঋতিকা চোখ মেলল না। শুধু মাথা রাখল অভিষেকের কাঁধে। তার ভেতরে ভয় এখনও আছে, কিন্তু সেই ভয়কে ডুবিয়ে দিয়েছে এমন এক উষ্ণতা, যা থেকে সে আর নিজেকে সরাতে পারছে না।
রিসর্ট থেকে ফেরার পর ঋতিকা যেন বদলে গেল। প্রতিদিনের একঘেয়ে জীবন হঠাৎই অন্য রঙে ভরে উঠল। সকালের ট্রাফিক, অফিসের মিটিং, লাঞ্চব্রেক—সবকিছুর মাঝেই তার মাথায় ভেসে উঠছিল অভিষেকের চোখ, ঠোঁট, হাতের স্পর্শ। মনে হচ্ছিল, সে যেন নিজের ভেতর লুকিয়ে রাখা এক জগতে বেঁচে আছে, যেটা কেবল তাদের দু’জনের জন্য।
কিন্তু বাস্তব এত সহজ ছিল না। রাতে বাড়ি ফিরে একা বিছানায় শুয়ে থাকলে তার মাথায় আসতে লাগল প্রশ্ন। অভিষেকের সংসার আছে, স্ত্রী আছে—যদিও সম্পর্ক ভাঙা অবস্থায়, তবু সম্পর্ক তো রয়ে গেছে। ঋতিকা বুঝতে পারছিল, তাদের এই মিলন যত গভীর হচ্ছে, ততই জটিল হয়ে উঠছে তাদের চারপাশের পরিস্থিতি।
অভিষেক অবশ্য কোনো দ্বিধায় পড়ছে না মনে হচ্ছিল। প্রায় প্রতিদিনই ফোন, মেসেজ—
“তুমি আমার কাছে আসবে আজ?”
“আজ অফিস শেষে দেখা করব?”
“আমি তোমার ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না।”
ঋতিকা প্রতিবারই নরম হয়ে যাচ্ছিল। ভয়, দ্বন্দ্ব, অপরাধবোধ সব কিছু সরে যাচ্ছিল সেই এক মুহূর্তে যখন অভিষেকের কণ্ঠ বা দৃষ্টি তার ভেতরকে ছুঁয়ে যেত।
তাদের দেখা চলতে থাকল—কখনও শহরের ভিড়ের মধ্যে কফি শপে, কখনও অন্ধকার সিনেমা হলে, কখনও আবার হোটেলের নিভৃত কক্ষে। প্রতিটি সাক্ষাৎ যেন আরও বেশি করে তাদের শরীর আর মনকে বেঁধে ফেলছিল এক অদৃশ্য শৃঙ্খলে।
কিন্তু একদিন ঘটল অস্বস্তিকর কিছু। কফিশপে বসে থাকতে থাকতে ঋতিকা হঠাৎ টের পেল, এক চেনা সহকর্মী তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, কৌতূহলী হাসি। মুহূর্তের মধ্যেই তার বুকের ভেতর কেঁপে উঠল আতঙ্ক।
“আমাদের দেখে ফেলল বোধহয়,” সে ফিসফিস করে বলল অভিষেককে।
অভিষেক হাত চাপা দিল তার আঙুলে।
“চিন্তা কোরো না। মানুষ যত ভাববে, ভাবুক। আমরা জানি আমাদের সত্যি।”
কিন্তু ঋতিকা জানত, কথাটা এত সহজ নয়। একবার যদি ফিসফাস শুরু হয়, তাহলে অফিসে, সমাজে—সবখানে প্রশ্ন উঠবে। সেই রাতে বাড়ি ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখের দিকে তাকাল সে। ভেতরে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব—এই সম্পর্কে সে একদিকে পেয়ে গেছে নিজের বহুদিনের তৃষ্ণা, অন্যদিকে হারাচ্ছে নিজের নিশ্চিন্ত পৃথিবী।
অভিষেকের ফোন এল রাত বারোটায়।
“তুমি কাঁদছো?”
“না… শুধু ভাবছি।”
“কি নিয়ে?”
“আমরা কতদূর যেতে পারব…”
অভিষেক কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল—
“যতদূর তুমি চাইবে। আমি তোমাকে হারাতে চাই না, ঋতিকা।”
ঋতিকা ফোন কানে ধরে চুপ করে শুয়ে রইল। বাইরে তখন অন্ধকারের ভেতর দিয়ে হাওয়ার শব্দ আসছিল, ভেতরে তার শরীর আর মন জড়িয়ে যাচ্ছিল এক অনিবার্য টানে।
সে বুঝতে পারছিল—তাদের সম্পর্ক আর গোপন ছায়ায় আটকে থাকবে না। খুব শিগগিরই বাস্তবের আলোয় ধরা পড়বে। আর সেই আলো তাদের এক করবে না ভাঙবে, সেটাই এখন অনিশ্চিত।
অফিসে এক সপ্তাহ যেন অদ্ভুত অস্বস্তির মধ্যে কেটে গেল ঋতিকার। সহকর্মীর সেই সন্দেহভরা দৃষ্টি তার মনে গেঁথে বসেছিল। কাজের টেবিলে বসে থেকেও বারবার মনে হচ্ছিল, কেউ না কেউ তাকে লক্ষ্য করছে, কেউ হয়তো ফিসফিস করে বলছে— ও-ই তো, ও-ই…।
অভিষেক অবশ্য এ সবকিছুতে নির্লিপ্ত। প্রতিদিনই নতুন কোনো অজুহাত খুঁজে বের করছিল দেখা করার জন্য।
“আজ তোমার বাসার কাছে এক রেস্টুরেন্টে রিজার্ভ করেছি।”
“তুমি চাইলেই অফিস থেকে তোমাকে নিয়ে আসব।”
ঋতিকা প্রথমে আপত্তি করলেও শেষমেশ রাজি হয়ে যাচ্ছিল। তার নিজের ভেতরের টান এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে, সেই টানকে অস্বীকার করার ক্ষমতা তার আর ছিল না। কিন্তু প্রতিবার দেখা হওয়ার পর ফেরার পথে বুকের ভেতর একটা শূন্যতা এসে পড়ছিল—এই সব কি বেশিদিন গোপন থাকবে?
এক সন্ধ্যায় তারা আবার এক হোটেলে দেখা করল। ঘর ভরেছিল অন্ধকারের উষ্ণতায়, দু’জনের শরীর একে অপরের ভেতরে জড়িয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু মিলনের মাঝেই হঠাৎ ঋতিকা ফিসফিস করে বলল—
“অভিষেক, যদি কেউ জেনে যায়?”
অভিষেক তার ঠোঁট চাপা দিল নিজের ঠোঁটে।
“ভেবো না। কেউ জানবে না। এই সময়টা শুধু আমাদের।”
কিন্তু ঋতিকা জানত, এটা শুধু স্বপ্নের মতো বলা কথা। বাস্তব এত সহজ নয়।
ঠিক তখনই ফোন বেজে উঠল। অভিষেক প্রথমে ধরতে চাইল না, কিন্তু রিং থামছিল না। বিরক্ত মুখে ফোন কানে দিতেই তার ভ্রূ কুঁচকে গেল। কয়েক সেকেন্ড শোনার পর সে এক অস্বস্তিকর দৃষ্টিতে ঋতিকার দিকে তাকাল।
“মায়া,” সে ধীরে বলল। “ও সন্দেহ করছে।”
ঋতিকার শরীর হিম হয়ে গেল। বিছানার চাদরের মধ্যে সে হঠাৎ এক অচেনা আতঙ্ক অনুভব করল। এ সম্পর্ক শুধু আবেগ আর কামনার ভেতরে সীমাবদ্ধ নেই—এখন তা টেনে আনছে অজস্র ঝড়।
রাত্তিরে বাড়ি ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে নিজেকে দেখল—চোখ লাল, ঠোঁট ফোলা, শরীর ক্লান্ত অথচ ভেতরে এখনও অস্থির আগুন। এই আগুন সে চায়, আবার ভয়ও পায়।
পরদিন সকালে অফিসে ঢুকেই সহকর্মী শর্মিষ্ঠা এক কৌতূহলী হাসি দিয়ে বলল—
“বাহ, খুব ফ্রেশ লাগছে তোমাকে! উইকএন্ডটা বুঝি বেশ ভালোই কেটেছে?”
ঋতিকা জোর করে হাসল, কিন্তু বুকের ভেতর ধকধক করছিল। তাহলে কি গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে?
অভিষেক দুপুরে মেসেজ করল—
“আজ বিকেলেই আবার দেখা হবে।”
ঋতিকা ফোনের দিকে তাকিয়ে রইল। আঙুল কাঁপছিল। সে জানত, না বলার শক্তি নেই তার। অথচ প্রতিটি হ্যাঁ যেন তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক গভীর খাদে, যেখান থেকে ফেরার রাস্তা আর থাকবে না।
ঋতিকা চেষ্টা করছিল নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে, কিন্তু ভেতরের অস্থিরতা বারবার ভেসে উঠছিল। অফিসে মিটিং চললেও হঠাৎ খেয়াল করত, কলম কাঁপছে তার হাতে। মেসেঞ্জারে অভিষেকের নাম উঠলেই বুক ধকধক করতে লাগল।
তবে এবার পরিবর্তনটা এল অন্যদিক থেকে। এক সন্ধ্যায় অভিষেক ফোন করল, গলায় ক্লান্তি আর অস্বস্তি।
“মায়া কিছু টের পাচ্ছে। আজ রাতে ঝগড়া হল। ও বারবার জানতে চাইছিল, আমি কোথায় যাই, কার সঙ্গে থাকি…”
ঋতিকা চুপ করে রইল। কানে যেন শিস বাজছিল।
“তুমি কিছু বলেছ?”
“না। কিন্তু ওর চোখে সন্দেহ। আমি বুঝতে পারছি।”
সেই রাতে ঋতিকা ঠিকমতো ঘুমোতে পারল না। জানলার বাইরে বৃষ্টির শব্দে ভেসে যাচ্ছিল শহর, আর সে বিছানায় শুয়ে বারবার ভাবছিল—এই সম্পর্কটা যদি ভেঙে যায়, তবে কি শুধু ওর সংসার ভাঙবে, নাকি আমার জীবনও টুকরো টুকরো হবে?
পরদিন অফিসে পৌঁছেই সহকর্মী শর্মিষ্ঠা হালকা হাসি দিয়ে বলল,
“তোমার ফোনে বারবার এক নাম উঠতে দেখছি, খুব ‘ফ্রিকোয়েন্ট’ মনে হচ্ছে।”
কথাটা মজা করে বলা হলেও, ঋতিকার শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল।
সন্ধ্যায় অভিষেক দেখা করার জন্য অনুরোধ করল। তারা একটি নির্জন রেস্টুরেন্টে বসল। অভিষেকের চোখ লাল, ঘুমহীন।
“ঋতিকা, আমি জানি না কতদিন এভাবে চলতে পারব। মায়া যদি সত্যিই সব বুঝে যায়, তাহলে ব্যাপারটা বড় আকার নেবে।”
ঋতিকা চুপ করে ছিল। তার চোখে ভেসে উঠছিল দুই দিকের ছবি—একদিকে অভিষেকের উষ্ণ আলিঙ্গন, অন্যদিকে সমাজের আঙুল।
“তুমি কি ভয় পাচ্ছ?” অভিষেক ধীরে জিজ্ঞেস করল।
“ভয় না… আমি নিশ্চিত নই।”
“নিশ্চিত কী নিয়ে?”
“আমরা কি চাই একসঙ্গে থাকতে? নাকি শুধু এই গোপন আগুনটা আঁকড়ে ধরে বাঁচতে?”
অভিষেক তার হাত ধরল শক্ত করে।
“আমি তোমাকে ছাড়া ভাবতে পারি না।”
ঋতিকা আর কিছু বলল না। টেবিলে রাখা গ্লাসের ভেতর ভাসতে থাকা বরফ গলে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে—যেন তাদের জীবনও এভাবেই ভেঙে যাচ্ছে অচিরেই।
রাত গভীর হলে বাড়ি ফিরে সে এক মেসেজ পেল। নাম্বারটা অচেনা। বার্তায় লেখা—
“তুমি কে? অভিষেকের সঙ্গে তোমার সম্পর্কটা কী?”
ঋতিকার বুকের ভেতর যেন বজ্রপাত হল। ফোন হাত থেকে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। নাম লেখা ছিল—মায়া।
ফোনের পর্দায় সেই এক লাইন দেখে ঋতিকার বুক কেঁপে উঠল—
“তুমি কে? অভিষেকের সঙ্গে তোমার সম্পর্কটা কী?”
বার্তার শেষে লেখা ছিল নাম—মায়া।
অনেকক্ষণ সে পর্দার দিকে তাকিয়ে রইল, আঙুল স্থির। উত্তর দেবে কি দেবে না—এই দ্বিধায় কেটে গেল পুরো রাত। ঘুম এলো না, কেবল বুকের ভেতর এক অদ্ভুত শূন্যতা জমে উঠল।
পরদিন সকালে অভিষেককে ফোন করতেই সে অস্থির কণ্ঠে বলল—
“মায়া তোমাকে মেসেজ করেছে?”
“হ্যাঁ।”
“শোনো, উত্তর দিও না। আমি সামলে নেব।”
কিন্তু ঋতিকা জানত, ব্যাপারটা আর শুধু “সামলানো”-য় থেমে থাকবে না। একবার সন্দেহ জন্মালে তা মুছে যায় না, বরং আরও গভীর হয়।
দু’দিন পর, অফিস থেকে বেরোতেই হঠাৎ এক মহিলা সামনে এসে দাঁড়াল। মাঝবয়সী, চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। ঋতিকা চমকে উঠল—এ যে মায়া।
“তুমিই তো ঋতিকা?”
কণ্ঠস্বর ঠান্ডা, অথচ ধারালো।
“হ্যাঁ… কিন্তু—”
“আমার স্বামীর সঙ্গে তোমার ঠিক কী সম্পর্ক?”
রাস্তার মাঝেই সেই প্রশ্ন যেন ছুরি হয়ে বিঁধল। চারপাশে ভিড়, গাড়ির হর্ন, আলো—সবকিছু মিলিয়ে গেল কানে। ঋতিকা কিছু বলতে চাইল, কিন্তু ঠোঁট শুকিয়ে এল।
মায়া আরেক পা এগিয়ে এল।
“আমি জানি তোমরা শুধু ‘বন্ধু’ নও। অভিষেকের চোখে আমি যা দেখেছি, তা স্পষ্ট। তোমাকে সতর্ক করে দিলাম—এখানেই থামো।”
কথা বলে চলে গেল সে। ঋতিকা দাঁড়িয়ে রইল স্থির হয়ে, হাত কাঁপছিল, বুকের ভেতর হাহাকার।
সেই রাতেই অভিষেক ফোন করল। গলা ভাঙা, যেন অনেকটা চেঁচামেচি হয়েছে।
“মায়া সব জেনে গেছে। ঝগড়া হল প্রচণ্ড। ও বলছে, যদি আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে থাকি, তাহলে আলাদা হয়ে যাবে।”
ঋতিকা স্তব্ধ হয়ে শুনছিল।
“তাহলে… তুমি কী করবে?”
অভিষেক নিঃশ্বাস ফেলে বলল—
“আমি জানি না। কিন্তু আমি তোমাকে ছাড়তে পারব না।”
ঋতিকা ফোন কানে ধরে দীর্ঘক্ষণ চুপ করে রইল। ভেতরে ভয়, অস্থিরতা, তবু সেই ভয়কে ছাপিয়ে উঠছিল এক অদ্ভুত উষ্ণতা—কারণ অভিষেকের কণ্ঠে সে শুনল মরিয়া এক সত্যি, যা তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল আরও গভীরে।
কিন্তু সে জানত—এখন থেকে প্রতিটি পদক্ষেপ আগুনের ওপর হাঁটার মতো হবে।
মায়ার মুখোমুখি হওয়ার পর ঋতিকা আর স্বাভাবিক থাকতে পারছিল না। অফিসে বসে কাজ করলেও মনে হচ্ছিল, চারপাশের সবাই তার গোপনটা জেনে ফেলেছে। কফিশপে গেলে মানুষের দৃষ্টি তাকে অস্বস্তি দিচ্ছিল, বাসায় ফিরলে আয়নায় নিজের চোখের দিকে তাকাতে ভয় হচ্ছিল।
অভিষেক প্রতিদিনই ফোন করছিল, কখনও রাত দুটোয়, কখনও ভোরে। তার কণ্ঠে এক ধরনের তাড়াহুড়ো ছিল।
“আমি ওকে আর সামলাতে পারছি না, ঋতিকা। মায়া প্রতিদিন ঝগড়া করছে। এবার যদি আলাদা হয়ে যায়, তাহলে হয়তো সব শেষ।”
ঋতিকা ক্লান্ত স্বরে বলত,
“তাহলে কি আমাদের থেমে যাওয়া উচিত?”
অভিষেক গলা চড়িয়ে বলত,
“থেমে যাওয়া? এত দূর এসে? আমি তো তোমার ছাড়া কিছু ভাবতে পারি না।”
একদিন সন্ধ্যায় তারা দেখা করল শহরের বাইরে, একই রিসর্টে। দরজা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিষেক তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। যেন ভেতরের সমস্ত ভাঙন, ভয় আর রাগ মিশে গেছে সেই আলিঙ্গনে।
“তুমি আমার শেষ আশ্রয়, ঋতিকা। আমি যদি সব হারাই, তবু তোমাকে হারাতে চাই না।”
ঋতিকা তার কাঁধে মাথা রেখে কাঁপছিল। শরীর চাইছিল সেই উষ্ণতা, কিন্তু মন বারবার বলছিল—এভাবে কি টেকানো সম্ভব?
তাদের মিলন সেদিন আরও তীব্র, আরও মরিয়া হয়ে উঠল। প্রতিটি স্পর্শ যেন বিদ্রোহের মতো, প্রতিটি চুম্বন যেন ঘোষণা—আমরা হার মানব না। কিন্তু মিলনের পর শূন্যতায় বসে ঋতিকা জানত, শরীরের আগুন কিছুক্ষণের জন্য ভোলাতে পারে, কিন্তু বাইরে অপেক্ষা করছে এক ভীষণ বাস্তব।
পরের দিন সকালে ফোনে আবার মায়ার নাম ভেসে উঠল। কণ্ঠ ঠান্ডা, অথচ ধারালো।
“তুমি কি ভেবেছো, আমি চুপ করে থাকব? যদি আর একবার তোমাকে অভিষেকের সঙ্গে দেখি, আমি সব ফাঁস করে দেব। তোমার অফিসে, তোমার পরিবারে—সবাই জানবে।”
ঋতিকা ফোন কেটে দিল, কিন্তু বুকের ভেতর কাঁপুনি থামল না। সে জানত, সময় ফুরিয়ে আসছে।
অফিসে বসে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মনে হল—এখন আর শুধু প্রেম বা আকর্ষণের খেলা নয়। এখন বিষয়টা বেঁচে থাকার, মানসম্মানের, ভবিষ্যতের।
রাতে অভিষেক আবার ফোন করল।
“চলো, আমরা পালিয়ে যাই। এখানে কারও কাছে কিছু প্রমাণ করার দরকার নেই।”
ঋতিকা স্তব্ধ হয়ে গেল। পালানো মানে সব ভেঙে ফেলা। নিজের পৃথিবী, অভ্যাস, নিরাপত্তা—সবকিছু ছেড়ে দেওয়া।
সে কাঁপা গলায় বলল,
“তুমি কি সত্যিই প্রস্তুত?”
ফোনের ওপারে দীর্ঘ নীরবতা, তারপর অভিষেকের নিঃশ্বাস ভেসে এল—
“তুমি থাকলেই প্রস্তুত।”
ঋতিকা জানল—শেষ মুহূর্ত এসে গেছে।
রাত গভীর। জানলার বাইরে ঝড়ো হাওয়া বইছে, আকাশে মেঘ জমে আছে। বিছানায় শুয়ে থাকা ঋতিকা ফোনের আলোয় অভিষেকের মেসেজ পড়ছিল—
“আগামীকাল রাতেই বেরোব। তুমি যদি রাজি থাকো, আমরা দু’জন নতুন করে শুরু করব।”
শব্দগুলো বুকের ভেতর ঢেউ তুলল। এতদিনের আকাঙ্ক্ষা, এতদিনের টানাপোড়েন যেন এক চরম সিদ্ধান্তে এসে দাঁড়াল। কিন্তু সেইসঙ্গে ভেতরে বাজছিল ভয়—পালিয়ে গেলে কি সত্যিই মুক্তি মিলবে? নাকি আরও গভীর অন্ধকারে আটকে যাব?
অফিসে পরের দিন ঋতিকা চেষ্টা করল স্বাভাবিক থাকতে। কিন্তু সহকর্মীদের চোখে যেন লুকনো প্রশ্ন ঝলকাচ্ছিল। লাঞ্চব্রেকে হঠাৎ শর্মিষ্ঠা হেসে বলল,
“এই যে, তুমি যেন অনেকদিন ধরে অন্য জগতে আছ। কারও বিশেষ সঙ্গ পাচ্ছো বুঝি?”
ঋতিকা ভেতরে ভেতরে সঙ্কুচিত হল। এভাবে আর বেশিদিন গোপন রাখা যাবে না—এটা সে বুঝতে পারল।
সন্ধ্যায় তারা দেখা করল। অভিষেকের চোখে অস্থিরতা, ঠোঁটে তীব্র এক সিদ্ধান্তের রেখা।
“আমি আর পিছু হটব না। কাল রাতেই আমরা শহর ছেড়ে যাব।”
ঋতিকা তার দিকে তাকাল। একদিকে সেই চেনা উষ্ণতা, অন্যদিকে চারপাশের অগণিত শেকল। নিজের পরিবার, সমাজ, ভবিষ্যৎ—সবকিছুর ছবি ভেসে উঠছিল চোখে।
“তুমি নিশ্চিত?” সে জিজ্ঞেস করল।
অভিষেক হাত ধরে বলল,
“তুমি ছাড়া আমি কিছুই চাই না। ভয় নেই।”
ঋতিকা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ধীরে হাত সরিয়ে নিল।
“কিন্তু আমার আছে।”
অভিষেক স্তব্ধ হয়ে গেল।
“কি বলছ?”
“আমি তোমাকে চাই, অভিষেক। চাই তোমার উষ্ণতা, চাই তোমার আলিঙ্গন। কিন্তু এর বাইরে আমি আর সবকিছু হারাতে পারব না। আমি ভেঙে পড়ব।”
অভিষেক কিছু বলল না। শুধু তার চোখ ভিজে উঠল।
সেই রাতে ঋতিকা একা বাড়ি ফিরল। জানলার পাশে দাঁড়িয়ে শহরের আলো দেখতে দেখতে বুঝল—জীবন সবসময় ইচ্ছে মতো চলে না। কিছু সম্পর্ক থাকে শুধু অন্তরঙ্গ ছায়ার মতো—যা উষ্ণও, অস্থিরও, কিন্তু কখনো দিনের আলোয় টিকে থাকে না।
ফোনে অভিষেকের নাম বারবার ভেসে উঠছিল, কিন্তু সে ধরল না। জানত, এবার দূরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
আকাশে হঠাৎ মেঘ সরল, বেরোল পূর্ণিমার আলো। সেই আলোয় ঋতিকা অনুভব করল—ভালোবাসা সবসময় অধিকার নয়, কখনও কখনও কেবল স্মৃতির মতো থেকে যায়, শরীর আর হৃদয়ের গভীরতম ছায়ায়।
তার ঠোঁটে ধরা দিল এক দীর্ঘশ্বাসমাখা হাসি।
“অন্তরঙ্গ ছায়া”—এই নামেই হয়তো বেঁচে থাকবে তাদের কাহিনি।
***
				
	

	


