Bangla - নারীবিষয়ক গল্প - সামাজিক গল্প

অন্তঃসারশূন্য

Spread the love

অনিন্দিতা ধর


শীতের সকালের আলো জানালার পর্দা ছুঁয়ে ঘরে ঢুকছিল ধীরে ধীরে। দেয়ালের বইয়ের তাকের পাশে দাঁড়িয়ে দীপ্তেন্দু বসু আয়নায় নিজেকে দেখছিলেন। আয়নায় যেন সবসময়ই তার চেহারায় একটা সন্তুষ্টির ছায়া ধরা দেয়— একটা “আমি সমাজের জন্য কিছু করছি” ধাঁচের আত্মতৃপ্তি। আয়নার সামনে ছোট্ট টেবিলে রাখা ছিল ঘড়ি, পারফিউম, স্কুল ব্যাজ আর একটা পুরোনো খাতার পাতা— যেখানে কাল রাতেই লিখেছিলেন, “নারীর মর্যাদা রক্ষায় সমাজের ভূমিকা”। আজ শহরের এক নামী স্কুলে আলোচনা সভা; তিনিই প্রধান বক্তা। টেবিলের ওপর রাখা ছিল গীতার বানানো লাল চা। গীতা— গৃহপরিচারিকা মঞ্জুর মেয়ে, বয়স চোদ্দো, পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে প্রায় এক বছর হলো, তবু তার চায়ের স্বাদ দীপ্তেন্দু বাবুর ভীষণ প্রিয়। টিফিনের ব্যাগ গোছাতে গোছাতে তিনি বললেন, “গীতু, এই চাটা দারুণ হয়েছে আজ। কবে যে তোর হাতের চা ছাড়া চলতে পারব না!” মৃদু হেসে মেয়েটি মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেল, কিন্তু তার চোখের ভিতর অস্বস্তির ছায়া দীপ্তেন্দুর চোখে ধরা পড়ে না, কিংবা তিনি দেখেও কিছু না দেখার ভান করেন। তিনি মন দিলেন তার বক্তৃতার খসড়ায়। সমাজ, নারী, অধিকার, নিরাপত্তা— শব্দগুলো সাজিয়ে দারুণ এক শব্দচিত্র তৈরি করছিলেন তিনি। ঘরের কোণায় রোদ জমা হচ্ছিল, কিন্তু একটা অদৃশ্য ছায়া ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ছিল সেখানে।

বিদ্যালয়ে পৌঁছে দীপ্তেন্দু বসুকে ঘিরে ধরল সহকর্মীরা, ছাত্রছাত্রীরা। “স্যার, আজ তো মিডিয়াও আসবে শুনলাম!” — একজন বলে উঠল। তিনি হালকা হাসলেন, মাথা নেড়ে বললেন, “এইটুকু দায়িত্ব তো আমাদের নিতে হয়ই, সমাজ তো আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।” তিনি মঞ্চে উঠলেন। তার গলা দৃঢ়, চোখ জ্বলে উঠছে প্রত্যয়ের আলোয়— “আমরা কবে নারীকে মানুষ হিসেবে দেখতে শিখব? আমরা কি শুধুই নিজের সুবিধের জন্য নারীকে ব্যবহার করব? না, এবার সময় এসেছে নিজেকে বদলানোর।” করতালি পড়ল, কিছু ছাত্র মোবাইলে ভিডিও তুলছিল। পেছন থেকে হেডমিস্ট্রেস বললেন, “স্যার, আপনি সত্যিই এই স্কুলের গর্ব।” দীপ্তেন্দু বিনয়ের ভঙ্গিতে মাথা নিচু করলেন, কিন্তু তার ভিতরে গর্বের স্রোত প্রবল হয়ে উঠেছিল। বক্তৃতার পর শিক্ষক লাউঞ্জে চা খেতে খেতে তিনি বলছিলেন, “একটা গৃহকর্মীর মেয়েকেও যদি স্কুলে নিয়ে আসা যায়, তবে সেও শিক্ষিত হবে, সমাজ এগোবে।” কেউ জানত না, তাঁর বাড়ির সেই গৃহকর্মীর মেয়েটিই আজ স্কুল ছেড়ে কিচেন ঘরের কোণায় দাঁড়িয়ে। দীপ্তেন্দুর কথায় যেমন সদ্য ফোটার মতো সুবাস থাকে, তেমনি কিছু অদৃশ্য কাঁটা লুকিয়ে থাকে প্রতিটি বাক্যে— যা বাইরে থেকে বোঝা যায় না। তিনি ফিরলেন বাড়িতে দুপুরের দিকে— ক্লান্ত নয়, আত্মপ্রসাদে ভরা মুখে।

ঘরে ফিরে তিনি দেখলেন গীতা বারান্দার এক কোণায় বসে কাপড় ভাঁজ করছে, পাশে রাখা রেডিও থেকে আসছিল পুরোনো রবীন্দ্রসঙ্গীত— “স্রোতের ধারা সঙ্গী হয়ে চলি…”। দীপ্তেন্দু একটুখানি হাসলেন, “বাহ, গীতু, তুই তো এখন গানও শুনিস?” মেয়েটি মাথা নিচু করল, “রেডিওতেই চলছিল…” দীপ্তেন্দু একটু এগিয়ে গিয়ে তার পাশে দাঁড়ালেন। ঘরে আর কেউ নেই। মঞ্জু পাশের বাড়িতে রান্নার কাজে গেছে। ঘরটা নীরব। একটা নিঃশব্দ ভয় যেন গীতার বুকের মাঝে জমে উঠছিল— সে চোখ তুলে তাকাল না, শুধু কাপড়টা ভাঁজ করে চলল হাত কাঁপাতে কাঁপাতে। দীপ্তেন্দু এক হাতে মেয়েটির কাঁধ ছুঁয়ে বললেন, “ভয় পাচ্ছিস কেন গীতু? আমি তো তোর আপনজনের মতো…” তখনো বাইরে পাখির ডাক, রোদের আলো, জানালায় উড়ছিল একধরনের প্রশান্ত দুপুর। কিন্তু সেই মুহূর্তে একটা অন্ধকার ঘন হয়ে আসছিল ঘরের ভিতর— অন্ধকার যে শুধু ঘরে নয়, সমাজের ভদ্র মুখগুলোর ভিতরেই বাস করে বহুদিন ধরে। দীপ্তেন্দু বসু জানতেন, এই সমাজ তাকে দোষী ভাববে না। কারণ সমাজ কখনোই মুখোশের আড়ালের সত্যি দেখতে চায় না।

ঘরটা নিঃশব্দ হয়ে গিয়েছিল। যেন সকালের আলো আর দুপুরের গান হারিয়ে কোথাও গুম হয়ে গেছে। গীতা সেই মুহূর্তের পর থেকে আর কারও চোখে চোখ তুলে তাকায় না। মায়ের কাছে বলে না কিছুই, কিন্তু তার মুখে লেগে থাকে থমথমে একটি ছায়া। দীপ্তেন্দু বসুর বাড়িতে কাজ করে বহুদিন ধরে মঞ্জু, একরকম পরিবারের একজনের মতো হয়ে উঠেছেন। দুপুরবেলায় ফিরে এসে মেয়েকে দেখে বুঝতে পারেন— কিছু একটা ঘটেছে। “তুই আবার চুপ মেরে বসে আছিস কেন রে?”— গীতার মাথায় হাত রেখে প্রশ্ন করেন মঞ্জু। গীতা শুধু বলে, “পেটটা খারাপ লাগছে মা, মাথাও ঘুরছে…” মঞ্জু ভাবে, মেয়েটা হয়তো অসুস্থ। গরিবের ঘরে যেসব অসুখ হয়, সেগুলো নিয়ে বেশি ভাবার সুযোগ থাকে না। পরদিনও গীতা চুপচাপ থাকে, কাজের সময় হঠাৎ হাত থেকে গ্লাস পড়ে যায়, বুক ধক করে ওঠে মঞ্জুর, কিন্তু গীতা মুখ তুলে বলে না কিছুই। দীপ্তেন্দু বসু তখন পাশেই বসে পত্রিকা পড়ছেন, গ্লাসের শব্দে চোখ তুলে তাকান না— বা হয়তো তাকান, কিন্তু মুখে রাখেন না কোনো প্রতিক্রিয়া। তার দৈনন্দিন রুটিনে কোনও পরিবর্তন নেই— সকালের চা, বক্তৃতা প্রস্তুতি, গীতা ও মঞ্জুকে দয়া-স্নেহ মেশানো কথাবার্তা, আর নিজের ভাবমূর্তিকে আরও কিছুটা নিখুঁত করে তোলার প্রক্রিয়া। কিন্তু গীতার পৃথিবী বদলে গিয়েছে। তার দেহে জমে আছে এক অদৃশ্য বিষ, তার চোখে জমে আছে অবর্ণনীয় স্মৃতি। সমাজ তাকে প্রশ্ন করতে শেখায়নি, সাহস দিতে শেখায়নি— তাই সে চুপ।

স্কুলে যে শিক্ষক ‘নারীকে সম্মান’ শেখান, সেই শিক্ষকই যদি এমন হন— তাহলে সে কথা কাকে বলা যায়? মায়ের মুখে এই ‘দীপ্তেন্দু স্যার’-এর এত প্রশংসা শুনেছে গীতা ছোটবেলা থেকেই, যে সে নিজের ভয়কে বিশ্বাস করতে চায় না। তার মধ্যে লড়াই চলে— যা ঘটেছে তা কি সত্যিই ঘটেছে? না কি ভুল কিছু বুঝেছে সে? কিংবা সে-ই কি দোষী? এই অস্পষ্ট ভাবনাগুলো তাকে গিলে খেতে থাকে ধীরে ধীরে। সে খাওয়া-দাওয়া করে না, রাতে ঘুম হয় না, চোখের নিচে কালি জমে। মঞ্জু ভাবেন, হয়তো মেয়েটার হরমোনাল সমস্যা, না হয় কাশির ওষুধটা রিঅ্যাক্ট করছে। কিন্তু একদিন মঞ্জু মেয়ের শরীরে নীল দাগ দেখে চমকে ওঠেন। “কী রে এটা গীতু? পড়ে গেছিলি?” গীতা প্রথমে বলে না কিছুই, তারপর বলে, “না মা… কিছু না…” কিন্তু গলার স্বর কাঁপে, চোখ কাঁপে। মঞ্জুর মনের মধ্যে এক অজানা ভয় ঢুকে পড়ে। যাঁর ঘরে কাজ করেন, যাঁকে পরিবারের মানুষ মনে করেন— সেই মানুষটিকে নিয়ে এমন সন্দেহ করতে চাইছিলেন না, কিন্তু বুকের ভিতরে খচখচ করে উঠছিল কিছু একটা। গীতার নিঃশব্দ কান্না, না বলা কথা, বারবার চোখ নামিয়ে ফেলা— সবকিছু যেন একটা অভিশপ্ত বাক্যে পরিণত হচ্ছিল। তবু মঞ্জু ভেঙে কিছু ফেলেন না, শুধু ভাবতে থাকেন, “আমি কি কিছু বুঝতে পারছি না? না কি বুঝেও বুঝছি না?”

অন্যদিকে, দীপ্তেন্দু বসু আগের মতোই স্বাভাবিক থাকেন। স্কুলে গিয়ে বক্তৃতা দেন “নারী-নিরাপত্তা” নিয়ে, এক আলোচনায় বলেন, “নারীদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করাটাই তো সভ্যতার পরিচয়।” সেই বক্তৃতার ভিডিও ভাইরাল হয়, ফেসবুকে তাকে নিয়ে প্রশংসার ঝড় ওঠে। সহকর্মীরা বলেন, “স্যার সত্যিই অসাধারণ!” কিন্তু বাড়িতে, প্রতিদিন গীতার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা মানুষটির মধ্যে কোন অনুশোচনা নেই। তিনি গীতার চোখে ভয় দেখতে পান, আর সেই ভয় যেন তার আত্মবিশ্বাস আরও দৃঢ় করে। সমাজ তাকে সম্মান দেয়, কারণ সমাজ চোখে দেখে, কিন্তু মনে দেখে না। গীতার নীরবতা তাঁকে রক্ষা করে, আর মঞ্জুর ভদ্রতা তাঁকে শক্তি দেয়। এভাবেই দীপ্তেন্দুর ভদ্র মুখোশ আরও চকচকে হয়ে ওঠে। কিন্তু সেই মুখোশের নিচে জমে ওঠা বিকৃতি আর নৈরাজ্য ধীরে ধীরে ফাটল ধরাতে থাকে একটি অসহায় কিশোরীর আত্মায়। তার শরীরের চেয়ে বড় হয়ে উঠতে থাকে ভয়, এবং সেই ভয়ই একদিন হয়ে উঠবে প্রতিবাদের আগুন। কিন্তু এখন— গীতা শুধু চুপ। একটা দীর্ঘ, নিষ্প্রভ, তীব্র নীরবতা।

সন্ধ্যা তখন শহরের গায়ে নরম আলো ছড়িয়ে দিচ্ছিল। জানালার ওপারে রোদের রঙ হালকা কমলা থেকে ধূসর হয়ে আসছিল ধীরে ধীরে। দীপ্তেন্দু বসু ল্যাপটপ বন্ধ করে চোখ রাখলেন বারান্দার দিকে। কিচেনে তখন চায়ের কাপ ধোয়ার শব্দ— গীতা নিঃশব্দে কাজ করছিল। ঘরের বাতাস ভারী নয়, কিন্তু অদৃশ্য এক টানাপড়েন যেন প্রতিটি দেয়ালের ফাঁকে জমে উঠছিল। মঞ্জু পাশের বাড়িতে রান্নার কাজে গেছে, ফেরা হবে দেরি। দীপ্তেন্দু জানেন, এই সময়টা শুধু তাঁর আর গীতার। সেই জ্ঞান যেন এখন তাঁর অভ্যস্ত রুটিনের অংশ হয়ে গেছে। একসময় ছায়ায় ডুবে থাকা ঘরে ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে তিনি এসে দাঁড়ালেন গীতার পিছনে। “এই যে গীতু,”— কণ্ঠে যেন আদর মেশানো কোমলতা, “আজ তোকে দেখি আরও চুপচাপ লাগছে… অসুস্থ লাগছে?” মেয়েটা থমকে গেল। হাতের প্লেটটা ধরা, কিন্তু থমকে দাঁড়িয়ে আছে সে। “চা বানাতে পারবি একটা?” দীপ্তেন্দু জিজ্ঞেস করলেন। গীতা মাথা নাড়ল, ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল চুলার দিকে। তার হাতে কাপ ধরার সময় কাঁপুনি— সে বুঝতে পারছে কী আসছে। কীভাবে তা আটকাবে, বুঝে উঠতে পারছে না। জানে, কিছু বলার মতো ভাষা নেই, কণ্ঠ নেই।

চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে দীপ্তেন্দু বললেন, “তুই জানিস, তোর হাতের চা না খেলে আমার মাথা কাজ করে না। তোর মা তোকে স্কুলে পাঠাতে পারছে না, তাই না? আমি চাইলে তো এটা বদলাতে পারি।” কথাগুলো বলার সময় তার গলা নরম, মুখে হাসি। গীতা তাকায় না তার চোখে। কাপটা বাড়িয়ে দেয়। দীপ্তেন্দু চা হাতে নিয়ে চুমুক দেন, তারপর বসার ঘরের সোফায় বসেন— একপায়ে আরেক পা তুলে, এক রকম স্বচ্ছন্দতায়। কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটে। তারপর তিনি বলেন, “এসে একটু পাশে বসিস।” গীতা চমকে ওঠে। “কি…কি বললেন?”— তার গলা কাঁপে। “তুই ভয় পাচ্ছিস? আমি তোর আপনজন, তুই তো আমারই তো বাড়ির মেয়ে, বুঝলি না?” দীপ্তেন্দুর কণ্ঠে যেন কোমলতার আবরণে মিশে থাকে এক নির্মম আদেশ। গীতার শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়, তার হাতের আঙুল শক্ত হয়ে আসে, সে না এগোতে চায়, না পেছাতে। তার পায়ের নিচের মাটি যেন সরে যেতে থাকে। সে ভাবে, চিৎকার করলে কি কেউ শুনবে? না কি সবাই বলবে— “তুইই তো চুপ করে ছিলি! নিশ্চয় তোরই দোষ!” এই শহর কি শুনবে এক গরিব কাজের মেয়ের কথা, যদি সে বলে, এই মানুষটা… এই ভদ্রলোকটা…

দীপ্তেন্দু তখন উঠেছেন সোফা থেকে। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছেন গীতার দিকে। ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। বাইরের আলো নিভে গেছে প্রায়, ঘরে শুধু ছায়া আর শরীরের গন্ধ। গীতার ভেতরে তখন একটা যুদ্ধ চলছে— দৌড়ে পালিয়ে যাওয়া, না কি নিঃশব্দে সহ্য করে যাওয়া? কিন্তু সে জানে, পালাবার পথ নেই। তার মুখে কথা নেই, চোখে অশ্রু নেই, শুধু নিঃশ্বাস ঘন হয়ে উঠছে। দীপ্তেন্দুর হাত তার কাঁধে এসে পড়লে সে কেঁপে ওঠে। সে আর কিছু বোঝে না— সময় থেমে যায়, তার দেহের ওপর দিয়ে বয়ে যায় এক অন্ধকার ঝড়। এর পর কেবল নিঃশব্দ। সেই রাতে গীতা কিছু বলে না। তার শরীরের সবকিছু চুপ হয়ে থাকে। সে শুয়ে থাকে চাদরের নিচে, মুখ ঘুরিয়ে। বাইরে শীতল বাতাস বইছে, বারান্দার গাছের পাতাগুলো কাঁপছে হাওয়ায়, কিন্তু ঘরের মধ্যে যেন কিছু জমে উঠেছে চিরস্থায়ীভাবে। দীপ্তেন্দু ঘুমিয়ে পড়েন নিজের ঘরে, একটুও অস্বস্তি ছাড়াই। সকালে উঠে আবার স্কুল যাবেন, নতুন বক্তৃতা দেবেন “নারী অধিকার” নিয়ে। সমাজ তাঁকে শ্রদ্ধা করবে। আর গীতা? সে শুধু চুপ থাকবে, তার মুখে থাকবে একটানা নীরবতা— সন্ধ্যার সেই মুখোশ আর কখনও ভুলতে পারবে না সে।

রাত নামে শহরে, ছাদের উপরে চাঁদ উঠে, কিন্তু গীতার চোখে কোনো চাঁদ নেই, কোনো স্বপ্ন নেই। তার চোখের পাতা ভারী নয় ক্লান্তিতে, বরং বোঝা যায়— সে চোখ বন্ধ করতেই ভয় পায়। রাতের নিস্তব্ধতায় যেন একটা চাপা আর্তনাদ জমে থাকে প্রতিটি নিঃশ্বাসে। বিছানায় শুয়ে আছে সে, পাশ ফিরে, চাদর মুড়ি দিয়ে। মঞ্জু রান্নাঘরে ভাত গরম করছেন, মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছেন, “খাবি না রে?” গীতা মুখে একটাও শব্দ করে না। “তোর জ্বর আছে নাকি?”— মায়ের কণ্ঠে উদ্বেগ, কিন্তু গীতা সেই কণ্ঠেও সাড়া দেয় না। সে জানে, মা তাকে ভালোবাসে, কিন্তু সমাজে একজন গৃহপরিচারিকার কণ্ঠ কতটা দূর পৌঁছায়? সে যদি মাকে বলে, ‘মা, দীপ্তেন্দু স্যার…’, তবে কী হবে? মা কী বিশ্বাস করবে? না কি সমাজের মতো বলবে, “না রে, উনি এরকম হতেই পারেন না!” সে ভাবে, একটা চিৎকার দিলে হয়তো ভেতরটা হালকা হবে, কিন্তু গলার ভিতরে যেন শব্দ আটকে গেছে। সে বোঝে, যে ভয় তাকে পেছন থেকে গ্রাস করেছে, তা কেবল একদিনের নয়— এটা বহুদিন ধরে গড়ে ওঠা সেই সমাজের মুখোশ, যেটা সে নিজের চোখে আজ স্পষ্ট করে দেখেছে।

মঞ্জু রাতে মেয়ের কপালে হাত রাখেন— শরীর গরম। জ্বর এসেছে নিশ্চিত। মুখে বলার কিছু নেই মেয়ের, চোখ শুধু বন্ধ। মঞ্জু বলে, “কাল তোকে ডাক্তার দেখাতে হবে।” গীতা মাথা নাড়ে না, হ্যাঁ বা না কিছুই বলে না। তারপর মঞ্জু নিজের বিছানায় যান। রাত বাড়ে, কিন্তু ঘুম আসে না কারও। গীতার ভিতরে বয়ে যায় এক অস্থির নদী— যেন সেই জলের মধ্যে তার সমস্ত অস্তিত্ব ডুবে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। সে ভাবে, যদি নিজেকে শেষ করে দেয়? যদি ঘুমিয়ে না জেগে ওঠে আর কখনও? কিন্তু সাথে সাথে মনে পড়ে মায়ের মুখ— সেই শক্ত হাতে তাকে আগলে রাখা মা, যিনি সারাদিন কষ্ট করেন শুধু মেয়েটার মুখে হাসি দেখার আশায়। “তাকে জানালে কী হবে?” সে ভাবে— “মা কি প্রতিবাদ করতে পারবে?” কিংবা “আমাদের কথা কি কেউ শুনবে?” তার বয়স চোদ্দো— এই বয়সে স্কুলে যাওয়া, বান্ধবীদের সঙ্গে হাসাহাসি করার কথা ছিল। অথচ আজ এই বয়সেই তাকে বুঝতে হচ্ছে মানুষের বিকৃত রূপ, মুখোশপরা সমাজ, আর নিঃস্ব মানুষের মুখ বন্ধ করে রাখার প্রথা। গীতার চোখ থেকে জল পড়ে না— তার ভিতরের কান্না যেন কোথাও জমে পাথর হয়ে গেছে। সেই রাত, সেই নিঃশব্দ, কান্নাহীন রাত— তাকে বদলে দেয় একেবারে ভিতর থেকে।

পরদিন সকালে গীতা উঠে না। মঞ্জু এসে দেখে, মেয়ে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে— নিঃশ্বাস আছে, কিন্তু মুখে প্রাণ নেই। জল দিয়ে মুখ ধোয়ায় সে, মাথায় জল দেয়, তবু মেয়ের মুখে একটুও পরিবর্তন নেই। “গীতু… তুই… তোর কী হয়েছে রে?” — তার গলায় কাঁপুনি। গীতা ধীরে চোখ মেলে, কিছু বলে না। হঠাৎ মঞ্জুর মনে পড়ে যায়— কিছুদিন ধরেই মেয়ের শরীরে দুর্বলতা, কপালে অকারণে ঘাম, আচমকা কাপড় ফেলে দেওয়া, ভয় পাওয়া মুখ। মনের ভিতর বিদ্যুৎ খেলে যায়, কিন্তু কিছুতেই ভাবতে পারেন না সেই মানুষটিকে— যিনি এত ভদ্র, যাঁকে তিনি ‘বাবু’ বলেই জানেন, যিনি তার মেয়েকে একাধিকবার ‘মেয়ে’ বলে চিহ্নিত করেছেন— সেই মানুষটা? না, না… এটা হতেই পারে না। আবারও নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করেন মঞ্জু— “হয়তো আমি বাড়াবাড়ি ভাবছি।” কিন্তু তারপর হঠাৎ চোখে পড়ে মেয়ের হাতের আঙুলে একটা দাগ— যেন চেপে ধরা হয়েছিল। তখন তার বুকের ভিতরে গর্জে ওঠে এক অজানা আশঙ্কা। “গীতু, তুই কিছু লুকোচ্ছিস না তো?” — কিন্তু গীতা মুখ ঘুরিয়ে নেয়, কাঁদে না, বলে না কিছুই। অথচ সেই মুখে যে নীরব কান্না জমে আছে, তা মা ছাড়া কেউ বুঝবে না।

রাতে মঞ্জু আর ঘুমাতে পারেননি। বিছানায় শুয়ে কেবল গীতার মুখটা বারবার ভেসে উঠছিল চোখের সামনে— নিস্প্রভ, নিঃশব্দ, একটা তীব্র লজ্জা আর ভয় গিলে ফেলেছে যেন মেয়েটার আত্মাকে। নিজের অজান্তেই বারবার মনে পড়ছিল গত কয়েক সপ্তাহের কিছু ঘটনা— গীতার চোখেমুখে অকারণ ভয়ের ছাপ, হাত থেকে বারবার জিনিস পড়ে যাওয়া, হঠাৎ হঠাৎ থম মেরে যাওয়া। সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছিল দীপ্তেন্দু বাবুর আচরণ— যেভাবে গীতাকে মাঝে মাঝে ‘তোর হাতের চা তো আসলেই জাদু’, বা ‘তুই থাকিস বলেই তো এই বাড়িটা প্রাণ পায়’— এইসব কথাগুলো বলতেন, তখন তার মনের মধ্যে অল্প হলেও একটা অস্বস্তি জাগত, কিন্তু নিজের অবস্থানের কথা ভেবে সে চুপ করে থাকত। মঞ্জু ভেবেছিলেন, হয়তো তিনি অতিরিক্ত ভাবছেন— কিন্তু এখন আর সে সুযোগ নেই। সকালে গীতাকে কোলে নিয়ে বসে তিনি নরম গলায় বললেন, “তুই সত্যি করে বল গীতু, কী হয়েছে? কারা তোকে কষ্ট দিচ্ছে রে?” মেয়েটা প্রথমে চুপ থাকে, কিন্তু মায়ের গলা কাঁপতে থাকে। মঞ্জু বলে, “তুই যদি না বলিস, আমি কিচ্ছু করতে পারব না। আমি তোর মা— আমি সব শুনব, সব সহ্য করব, কিন্তু তুই তো বল।” অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর গীতা মুখ তোলে— তার চোখে জল নেই, কিন্তু মুখে ফাটল। নিঃশব্দে, কাঁপা গলায় সে বলে ওঠে— “মা, উনি… দীপ্তেন্দু স্যার…” বাকিটুকু আর উচ্চারণ করতে পারে না। কথা আটকে যায় গলার গভীরে, কান্না এসে আটকে পড়ে নিঃশ্বাসের ফাঁকে।

মঞ্জুর বুকটা যেন ছিঁড়ে গেল। শব্দগুলো তার কানে গিয়ে স্থির হয়ে থাকল— না কাঁদতে পারছেন, না চিৎকার করতে। তার চারপাশের জগৎটা ঘুরে উঠছে যেন। যাঁর বাড়িতে এত বছর ধরে কাজ করছেন, যিনি তাকে ‘পরিবারের একজন’ বলে পরিচয় দেন, যিনি সভা-সেমিনারে নারী অধিকার নিয়ে বক্তৃতা দেন— সেই মানুষটা? তারই মেয়ে? একটা মুহূর্তে মঞ্জু নিজেকে বিশ্বাস করতে পারেননি। “তুই ঠিক বলছিস তো গীতু? তোর কিছু ভুল তো হচ্ছে না তো?”— প্রশ্নটা না চাইলেও বেরিয়ে এলো। মেয়েটার মুখ থমকে গেল, গলার কণ্ঠ কেঁপে উঠল— “তুইও বিশ্বাস করবি না, তাই তো মা?” তারপর চোখ ঘুরিয়ে দিল গীতা— যেন চিরদিনের মতো। সেই চোখে একরাশ অভিমান, অসহায়তা, আর প্রত্যাখ্যান। মঞ্জু চিৎকার করে কেঁদে ফেললেন। নিজের মেয়েকে তিনি কখনো এরকম দেখেননি। পর মুহূর্তেই যেন ভিতরের সমস্ত শক্তি জেগে উঠল তার মধ্যে। দীপ্তেন্দু বসুকে তিনি যতদিন সম্মান করেছেন, আজ সেই সম্মান যেন বিষ হয়ে ধরা দিল। তিনি দাঁড়ালেন, চোখে আগুন। “এই আমি মঞ্জু, যে তোর বাড়ি ঝাঁট দিতাম, বাসন মাজতাম, তোর মুখে হাসি ফোটাতে গলা ভাঙতাম— আমি এখন সেই মা, যার মেয়েকে তুই ভেঙে দিয়েছিস। আমি তোকে ছাড়ব না।”

সন্ধ্যার দিকে দীপ্তেন্দু বসু যখন ঘরে ফিরলেন, তখন গেটেই দাঁড়িয়ে ছিলেন মঞ্জু। আজ তার কাঁধে কোনো কাপড় নেই, চোখে বিন্দুমাত্র ভয় নেই। দীপ্তেন্দু তাকে দেখে প্রথমে চমকে উঠলেন— “এই সময় বাইরে দাঁড়িয়ে কেন?” মঞ্জু কোনো উত্তর দিলেন না। চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। দীপ্তেন্দু এগিয়ে এসে বললেন, “তোমার শরীর খারাপ মনে হচ্ছে… কি হয়েছে?” মঞ্জু সেই কণ্ঠস্বরেই আঘাত করলেন— “তুমি আমার মেয়েটার সঙ্গে কী করেছো, বাবু?” শব্দটা শেষ হতে না হতেই দীপ্তেন্দুর মুখে এক ধরনের কপট বিস্ময় ফুটে উঠল। “মানে? কী বলছো তুমি?” মঞ্জুর কণ্ঠ এবার কাঁপল না, “তোমার অভিনয় আর চলবে না। গীতার মুখ আমি পড়তে পারি। তুই একটা জানোয়ার, একটা পিশাচ। তোকে আমি ছাড়ব না।” দীপ্তেন্দু প্রথমে বললেন, “তোমার মেয়ে হয়তো কিছু ভুল বুঝেছে… তুমি আগে বসো, ঠান্ডা মাথায় কথা বলি…” কিন্তু মঞ্জু তখন হাত তুলে বলে উঠলেন— “আমি তোর বাড়িতে আর এক পা রাখব না। তুই যা করেছিস, সেটা আইন জানবে, পাড়া জানবে, সমাজ জানবে। আমি তোদের এই ভদ্রলোকদের মুখোশ খুলে দেব।” তখন দীপ্তেন্দুর চোখে সেই ভদ্রতার কুয়াশা আর থাকে না— চোখ জ্বলে ওঠে হুমকির আগুনে। “সাবধান মঞ্জু, তুমি জানো না, আমি কে। তোর কিছুই হবে না, বরং তুই নিজেই বিপদে পড়বি।” মঞ্জু আর একটি মুহূর্তও সেখানে থাকেন না— তিনি চলে যান, মেয়েকে নিয়ে। কিন্তু যাওয়ার সময় পেছন ফিরে বলেন, “যে মা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শপথ করে, সে কোনোদিন ভয় পায় না। এবার তুই দেখ, তোর মুখোশ কতদূর যায়।”

মঞ্জু যেদিন দীপ্তেন্দু বসুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে, সেদিন শহরের বাতাস ছিল থমথমে। বাড়ি ফিরে মেয়ে গীতাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরেছিল সে, যেন একটিমাত্র চোয়াল-চেপে থাকা প্রতিজ্ঞা মাথার মধ্যে ঘুরছিল— “আমার মেয়ের সঙ্গে যা হয়েছে, তা আমি আর চুপ করে সহ্য করব না।” কিন্তু পরের দিন থেকেই অদ্ভুত কিছু ঘটতে শুরু করে। প্রথমে পাড়ার এক পুরনো পরিচিত বলে, “শোনো মঞ্জুদি, তুমি তো আমাদেরই মেয়ে— কিন্তু দীপ্তেন্দু স্যার যে এরকম কিছু করবেন, বিশ্বাস হয় না। উনি তো আমাদের শহরের গর্ব।” এরপর এল পাশের বাড়ির গৃহিনী— “তোমার মেয়েটা না বয়েসে একটু বড় দেখায়… আজকালকার মেয়েদেরও তো একটা সীমা থাকা দরকার।” কথাগুলো শুনে মঞ্জুর কানে যেন আগুন ঢুকে যায়। সে বুঝতে পারে, শহরটা কেমন নোংরা হয়ে গেছে— যেখানে একজন শিক্ষিত ধর্ষককে রক্ষা করতে সকলে উঠেপড়ে লেগেছে। তারপর একদিন ফোন এল— নাম্বার অজানা, কণ্ঠটি কড়াভাবে বলল, “তোমার মেয়েকে নিয়ে যদি আর বেশি কিছু করো, তোমার বাড়িতেও আগুন লাগতে দেরি হবে না।” ভয় নয়, মঞ্জুর শরীর কেঁপে ওঠে রাগে।

এরপর মঞ্জু থানায় যায় অভিযোগ জানাতে, কিন্তু সেখানেও শুরু হয় আরেক পর্ব। “আপনার কাছে কোনো প্রমাণ আছে ম্যাডাম? ডাক্তারি পরীক্ষা করিয়েছেন? যদি না থাকে, তাহলে তো মানহানির মামলা হয়ে যাবে।” কনস্টেবলের কণ্ঠে অবজ্ঞা, চোখে সন্দেহ। থানার ইনচার্জ তো স্পষ্ট বলেন, “এই ধরনের কেসে প্রমাণ ছাড়া কিছু করা যায় না। আমরা তো হুট করে একজন সম্মানিত নাগরিককে ধরতে পারি না।” মঞ্জুর চোখে জল আসে না, কিন্তু ভেতরটা ফেটে চিৎকার করে ওঠে— “সম্মানিত” শব্দটার আড়ালে যে কুৎসিত নোংরামি লুকিয়ে আছে, সেটা কি কেউ দেখতে পায় না? সে যখন বাড়ি ফেরে, তখন দেখেন, বাড়ির গেটের বাইরে ‘মিথ্যাবাদী’, ‘লোকনিন্দাকারী’ লেখা পোস্টার। কিছু ছেলেপেলে তাকে দেখে হেসে ওঠে— “এই তো সেই মঞ্জু, যাকে দীপ্তেন্দু স্যারের নামে মিথ্যে বলার সাহস হয়েছে!” এই শহর, এই সমাজ— যেটা একদিন তাকে আদর করত, আজ তার দিকে আঙুল তুলছে, শুধু একজন ‘ভদ্রলোক’কে রক্ষা করার জন্য। যেন এক অদৃশ্য ছায়া-রাজনীতি ঘিরে ধরেছে তাকে— যা ভয়, অপমান আর একাকিত্বে ঠেলে দিচ্ছে তাকে কোণায়।

কিন্তু সেই কোণায় ঠেলে যাওয়ার মেয়ে নয় সে। পরদিন সকালে সে মেয়েকে নিয়ে যায় এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায়— “নারী নিরাপত্তা সংগঠন – সত্যস্বর”। সেখানে গিয়ে পরিচিত হয় নন্দিনী সেন নামের এক আগুন-চোখের মহিলা নেত্রীর সঙ্গে, যিনি বছর দশেক ধরে নির্যাতিতা মেয়েদের নিয়ে কাজ করেন। মঞ্জুর মুখের সব কথা শুনে তিনি কেবল বলেন, “তুমি শেষমেশ ঠিক জায়গায় এসেছো। ওরা যতই বড় হোক, আমরা ছোট নই।” এরপর শুরু হয় নন্দিনীর নেতৃত্বে আইনি সাহায্যের ব্যবস্থা, ডাক্তারি পরীক্ষার প্রক্রিয়া এবং গীতার মানসিক চিকিৎসা। মিডিয়ার এক ছোট রিপোর্টার— শোভন সাহা, যে আগে থেকেই দীপ্তেন্দু বাবুর ওপর সন্দেহ করছিল, এগিয়ে আসে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে। সে বলে, “আমি জানি, ওর মতো লোকদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মানে নিজের কেরিয়ার ঝুঁকির মুখে ফেলা। কিন্তু চুপ করে থাকলে এইসব নরকের দেবতারা আরও ভয়ঙ্কর হবে।” শহরের একাধিক পত্রিকায় নাম প্রকাশ না করে গীতার বয়ান ছাপা হয়, কিছু প্রতিবাদী মহল মিছিল শুরু করে— “নারীর কণ্ঠ রুদ্ধ করা যাবে না”, “ভদ্রলোকের মুখোশ খুলে দাও”। স্কুল কর্তৃপক্ষ চাপের মুখে পড়ে এক বিবৃতি দেয়— দীপ্তেন্দু বসুকে সাময়িক ছুটিতে রাখা হয়েছে তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত। কিন্তু পেছনের চালটা যে আরও গভীর, সেটা তখনও বোঝে না সকলে।

দীপ্তেন্দু বসুর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক যোগাযোগ ছিল। শহরের সাংসদ, কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী ও স্কুল ট্রাস্টি বোর্ডের সঙ্গে তার নিয়মিত ওঠাবসা— এই ঘটনাটিকে চাপা দিতে তাঁরা সকলে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। একদিকে নন্দিনী সেন ও শোভন সাহার নেতৃত্বে বাড়ছে প্রতিবাদ, অন্যদিকে পুলিশ, প্রশাসন ও মিডিয়ার এক অংশ সেই প্রতিবাদের স্বরকে নষ্ট করার চেষ্টা করছে। কেউ বলে, “মঞ্জুর মেয়ে নাকি নিজে থেকেই ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছিল”, কেউ বা ফোটোশপ করা ছবি ছড়িয়ে দেয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। গীতার চরিত্রে কালি ছেটানো শুরু হয়— যেন তার শরীর নয়, তার আত্মাকেই প্রকাশ্যে হিঁচড়ে এনে পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। মঞ্জু আবার থানায় যায়, diesmal আইনজীবীকে সঙ্গে নিয়ে। FIR দায়ের হয় অবশেষে— কিন্তু তাতেও শুরু হয় দানবের প্রতিশোধ: একদিন মঞ্জুর বাড়ির পাশে বোমার আওয়াজ, রাতের অন্ধকারে জানালার ফাঁকে কারও চোখ। অথচ এসবের মধ্যেও দীপ্তেন্দু বসু বাড়ির ভেতরে বসে চুপচাপ সংবাদপত্র পড়েন, আর নিজের আইনজীবীকে ফোন করে বলেন, “ওরা যত বলুক, আমি জানি সমাজ কাকে বিশ্বাস করবে। আমাকে, কারণ আমি ভদ্রলোক।”

শোভন সাহা যখন প্রথম এই ঘটনার খবর পান, তখন এটা ছিল আরেকটা ‘আবছা রিপোর্ট’— গৃহপরিচারিকার কিশোরী মেয়ে, সম্মানিত এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে। খবরটা তার ডেস্কে এসেছিল এক ছোট সূত্র থেকে, যাকে বড় কাগজগুলো ‘রিউমার’ বলেই ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু শোভনের ছয় বছরের রিপোর্টিং অভিজ্ঞতা বলে— “সবচেয়ে বড় সত্য চাপা থাকে ‘সম্মানের শব্দে’।” দীপ্তেন্দু বসুর নাম দেখেই সে কেঁপে ওঠে, কারণ আগেও সে বহুবার দেখেছে এই মানুষটিকে— টিভি ডিবেট, পত্রিকার কলাম, আর একাধিক সরকারি ফোরামে। শোভনের কৌতূহল তাকে টেনে নিয়ে যায় ঘটনার গভীরে। সে খোঁজ নেয় সেই এলাকা থেকে, যেখানে মঞ্জুর পরিবার থাকে। গিয়েই দেখে, বাড়ির বাইরে মিডিয়ার ভিড় নেই, আছে নীরবতা, শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকা প্রতিবেশীরা। মঞ্জুর মুখোমুখি হতেই শোভন বুঝে যায়— এই মহিলার ভিতরে আগুন জমে আছে, কিন্তু সেই আগুন ঘিরে রেখেছে অজস্র ভয়, হুমকি আর অপমান। গীতার মুখ দেখে তার কলম থেমে যায়। সে সিদ্ধান্ত নেয়— এই গল্প সে থামতে দেবে না।

ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে শোভন যায় স্কুলে, যেখানে দীপ্তেন্দু বসু কর্মরত। সহকর্মীরা কেউ মুখ খুলতে চায় না, কেউ আবার বলে, “স্যার তো বরাবরই খুব ভালোমানুষ… এইসব গরিব মেয়েরা তো আজকাল একটু সুযোগ পেলেই…” — এইসব কথাগুলো যেন শোভনের বুক ফাটিয়ে দেয়। তিনি জানেন, ‘সমাজ ভদ্রলোকদের বিশ্বাস করে, গরিবদের মুখ চেপে ধরতে ভালোবাসে’। তবুও সে নাছোড়বান্দা হয়ে খোঁজ চালিয়ে যায়— স্কুলের পুরনো নিরাপত্তা গার্ড, এক পরিচ্ছন্নতাকর্মী, এমনকি পুরোনো অভিভাবকদের মধ্যে কয়েকজন— সবাই কিছু না কিছু বলে, কেউ স্পষ্ট করে, কেউ ইঙ্গিতে। “স্যার মাঝে মাঝে গার্ডেন হাউসে মেয়েদের নিয়ে যেতেন… কে কারা আসত জানি না…”— এক ড্রাইভার বলে। “তবে কিছু ঠিকঠাক মনে হতো না।” এসব ছোট ছোট সূত্র মিলিয়ে শোভনের চোখে একটা স্পষ্ট ছবি গড়ে ওঠে— একজন সম্মানিত মানুষ, যিনি আসলে অসংখ্য মুখোশের নিচে লুকিয়ে একজন যৌন শিকারি।

প্রথম প্রতিবেদনটা ছাপা হয় “ভদ্রলোকের মুখোশের নিচে” শিরোনামে। কোনো নাম লেখা হয়নি, কিন্তু শহরের সবাই বুঝে যায়, কাকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। সেই দিন সন্ধ্যায় শোভনের ওপর হামলা হয়— বাইকে চেপে দুজন মুখ ঢাকা লোক তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে যায়। থানায় গিয়ে অভিযোগ করলে কনস্টেবল বলে, “আপনার যদি এত কিছু নিয়ে কাজ করার শখ থাকে, তাহলে তার ফলও ভোগ করতে হবে।” শোভন হাসেন, মাথা নেড়ে বলেন, “আমি তো ফল খেতেই মাঠে নেমেছি, কাঁটা দেখে ভয় পাব না।” এরপর একে একে তার কলামে বেরোয় দীপ্তেন্দুর আগের দিনের কিছু বিতর্কিত লেকচারের ভিডিও বিশ্লেষণ, যেখানে নারীর প্রতি সম্মান নিয়ে তাঁর কথা আর বাস্তবের বিরাট দ্বন্দ্ব তুলে ধরা হয়। সে খুঁজে পায় এক পুরোনো ঘটনা— কয়েক বছর আগে স্কুলে এক মেয়েশিক্ষিকা রহস্যজনকভাবে চাকরি ছেড়েছিলেন, অভিযোগ ছিল মৌখিক অসদাচরণের, কিন্তু তখন চুপচাপ মিটমাট হয়ে গিয়েছিল। সেই শিক্ষিকার সন্ধান পেয়ে শোভন তাঁর সাক্ষাৎকার নেন, যেখানে তিনি বলেন, “আমি তখন চুপ করেছিলাম, কারণ আমার ছোট ছেলেটার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয় পেয়েছিলাম। আজ মনে হচ্ছে, আমি চুপ করেই সবচেয়ে বড় অপরাধ করেছিলাম।”

এই সমস্ত রিপোর্ট একত্র করে শোভন সাহা একটা ধারাবাহিক রিপোর্ট প্রকাশ শুরু করেন— “অন্তঃসারশূন্য: শহরের সম্মানীর ভেতরের আঁধার” নামে। প্রতিবেদনগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হতে থাকে। মঞ্জু ও গীতার পাশে এসে দাঁড়ায় শহরের কিছু সৎ সাংবাদিক, তরুণ ছাত্রছাত্রী, মহিলা অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা। কিন্তু পাশাপাশি প্রশাসন, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন শোভনের কণ্ঠ রোধ করতে— প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগ, মানহানির মামলা, এমনকি তার চাকরি পর্যন্ত হারানোর হুমকি। কিন্তু এই লড়াইয়ে শোভন একা নন— তাঁর সঙ্গে মঞ্জুর কান্নাহীন চোখ, গীতার ভাঙা অথচ সাহসী মুখ, এবং সমস্ত সেই মুখোশ-ছিন্ন সত্যেরা দাঁড়িয়ে ছিল। তাঁর কলম শুধু খবরের কালি নয়, হয়ে উঠেছিল সময়ের জবানবন্দি। “ভদ্রলোকের মুখোশ যতই চকচকে হোক, একদিন না একদিন সে ছিঁড়বেই”— শোভনের এই বাক্য রাতারাতি শহরের প্রতিবাদের মূল স্লোগানে পরিণত হয়।

আদালতের রোদেলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে মঞ্জু তাকিয়ে ছিলেন আকাশের দিকে। বহুদিন পর যেন বুকটা হালকা লাগছিল একটু— না, কারণ তাঁর যন্ত্রণা কমে গেছে বলে নয়, বরং কারণ তিনি আজ এই সমাজের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে প্রশ্ন তুলতে এসেছেন। তাঁর পাশে গীতা, সাদা সালোয়ারে, মাথায় ওড়না, চোখে চাপা ধকলের ছায়া— কিন্তু চোখে ভয় নেই। সত্যি কথা বলতে, সেই ভয়টা মঞ্জু নিজেই খুঁজে খুঁজে উপড়ে ফেলেছে মেয়ের মন থেকে। সেই প্রথম দিন আদালতের ফটক পার হওয়া, সেই প্রথম ‘আপত্তিকর স্পর্শ’ বোঝানোর চেষ্টা, সেই প্রথম ভয়— সব মিলিয়ে এই যাত্রাটা সহজ ছিল না। কিন্তু সত্য একবার উঠে দাঁড়ালে, আর তাকে বসানো যায় না। নন্দিনী সেন, আইনজীবী শিবাশিস চক্রবর্তী, আর সাংবাদিক শোভন সাহার সহায়তায় গীতা আজ মুখোমুখি হতে চলেছে সেই মানুষটার, যাঁকে সে একসময় ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করত। দীপ্তেন্দু বসু। স্যুট পরা, চোখে চশমা, ভদ্রলোকের পরিচিত মুখ— আজ তাঁকে এক নারকীয় অভিযোগের জবাব দিতে হবে। কোর্টের ভেতরে যখন নাম ডাকা হয়, গীতা দাঁড়ায়— বুকের ভেতরে অসংখ্য স্মৃতি লাফাতে থাকে, কিন্তু সে মুখে আনে কেবল সত্য।

সওয়াল শুরু হয় বিচারকের সামনে। অভিযুক্তের পক্ষের আইনজীবী প্রথমে প্রশ্ন করেন— “আপনি তো অনেকদিন ধরে এই বাড়িতে কাজ করছেন, আপনার মেয়েও সেখানে যেত— তাহলে হঠাৎ এতদিন পর আপনি এই অভিযোগ আনলেন কেন?” মঞ্জু চুপচাপ দাঁড়িয়ে, চোখে জ্বালা। গীতার গলা কাঁপলেও সে উত্তর দেয়— “আমি ভয় পেতাম।” তারপর প্রশ্ন আসে, “আপনার কোনো ভিডিও ফুটেজ, কোনো প্রত্যক্ষদর্শী আছে?” আইনজীবী যেন জিততে এসেছেন, না শুনতে। কিন্তু তখন গীতার পাশে দাঁড়িয়ে যান আইনজীবী শিবাশিস— বলেন, “নারী নির্যাতনের সবচেয়ে বড় প্রমাণ তাঁর শরীর, তাঁর মনের দাগ। আদালতের কাছে আমরা মেডিক্যাল রিপোর্ট পেশ করেছি, যেখানে স্পষ্ট শারীরিক আঘাতের প্রমাণ রয়েছে। এছাড়াও মিডিয়ায় প্রকাশিত ভিক্টিমের বয়ান, দীপ্তেন্দু বসুর অতীত রেকর্ড— আমরা সবকিছু জমা দিয়েছি।” শুনানি এগোয়। শোভন সাহার রিপোর্ট ও সাক্ষ্য আদালতে জমা পড়ে, পুরোনো সহকর্মীদের জবানবন্দি আনা হয়, দীপ্তেন্দুর আগের ‘মীমাংসিত’ অভিযোগগুলোর নথিও হাজির হয় আদালতের নোটিসে।

কিন্তু এখানেই শেষ নয়। আদালতের ভিতরে দীপ্তেন্দু বসুর পক্ষ থেকে বলা হয়, “এই কেস একেবারেই মনগড়া। এই সব মেয়েরা টাকা পেলে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। এই একটি অভিযোগে একজন সম্মানিত নাগরিকের চরিত্র হত্যা হচ্ছে।” তার বক্তব্যের সময় চারপাশের মিডিয়া, ক্যামেরা, বিচারক— সবাই চুপ। দীপ্তেন্দু তখনও নিজের ভাষায়, ভদ্রভাষায় নিজেদের দোষ ঢাকতে ব্যস্ত। কিন্তু সেই মুহূর্তেই দাঁড়িয়ে ওঠেন মঞ্জু— জজের অনুমতি নিয়ে বলেন, “আমি গরিব হতে পারি, কিন্তু আমি মিথ্যে বলিনি। একজন মা যখন তাঁর মেয়ের মুখে কান্না দেখতে পায় না, শুধু বোঝে— সে চিরকালের মতো নীরব হয়ে গেছে, তখন সে কেবল বিচার চায়, প্রতিশোধ নয়। আপনি যদি চান, আমি প্রমাণ দিই, তাহলে বলব— আমার মেয়ের নিঃশব্দ মুখটাই প্রমাণ।” কোর্টরুমে তখন সম্পূর্ণ নীরবতা। বিচারক শোনেন, চোখে কাচবেরি জ্বলে ওঠে। তিনি বলেন, “এই মামলা আমরা চটজলদি শেষ করব না। এই মামলাটি শুধু এক ব্যক্তির নয়, সমাজেরও। সত্য বের করতে সময় লাগবে, কিন্তু আমরা সত্যই জানব।”

সেদিন কোর্ট থেকে বেরিয়ে গীতা মাথা নিচু করে হাঁটে না। তার হাতে মায়ের শক্ত আঁকড়ে ধরা হাত, পাশে শোভন সাহার ক্যামেরা ও কলম, আর পেছনে সমাজের বদলে যাওয়া কিছু মুখ। দীপ্তেন্দু বসুর চোখে যদিও তেমন ভয়ের ছাপ নেই— তিনি বিশ্বাস করেন, টাকা আর পরিচয় মিলিয়ে তিনি বেরিয়ে আসবেন। কিন্তু শহরের গলি-গলি তখন অন্য কথা বলছে। মিডিয়া শিরোনামে উঠে এসেছে— “ভদ্রলোক নয়, শিকারীর মুখোশ খুলে গেল”, “মেয়েটির সাহস এক সমাজ বদলে দিল।” সত্য এখন আদালতের দরজায় দাঁড়িয়ে— সে রায় চায়, হ্যাঁ, কিন্তু তার চেয়ে বড়, সে মর্যাদা চায়। গীতা আজও রাতে ঘুমাতে পারে না ভালোভাবে, কিন্তু তার চোখে ভয় নেই। সে জানে, যারা সত্য বলে, তাদের পথে কাঁটা থাকবেই, কিন্তু সেই পথেই একদিন সমাজ হাঁটবে।

দীপ্তেন্দু বসু যেন বুঝেই উঠতে পারছিলেন না— এত বছর ধরে গড়ে তোলা তাঁর ‘ভদ্রলোকের’ প্রতিমূর্তি কীভাবে এভাবে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। প্রথমদিকে তিনি ভেবেছিলেন, এই অভিযোগও আগের মতো চেপে যেতে পারবে— কিছু টাকা, কিছু প্রভাব, কিছু “যোগাযোগ”— এই ত্রয়ী দিয়ে এতকিছু সামলেছেন তিনি, এবারও পারবেন। কিন্তু এবার পরিস্থিতি যেন অন্যরকম। আদালত কেবল তার কাজ করছে না, মিডিয়া, নাগরিক সমাজ, কিছু সাহসী কণ্ঠ— সকলে এক হয়ে যেন রীতিমতো ঘেরাও করেছে তাঁর অস্তিত্ব। দিন যত এগোয়, শহরের নামী প্রাক্তন ছাত্রদের একাংশ সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করতে থাকে— “স্মৃতির পেছনে লুকিয়ে থাকা সেই ভয়ের হাতটা আজ যেন পরিচিত হয়ে উঠেছে।” একটি অ্যালুমিনি ছাত্রী লিখেছে, “আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি, স্যার আমাকে আলাদা করে ডেকে কিছু ‘বিশেষ বই’ পড়াতে চেয়েছিলেন… আমি কোনোদিন কারও কাছে মুখ খুলিনি। আজ গীতার সাহসে সাহস পাচ্ছি আমি নিজেও।”

এভাবে একের পর এক পুরনো ছাত্রছাত্রী, সহকর্মী, এমনকি এক ড্রাইভার পর্যন্ত এগিয়ে আসে আদালতে জবানবন্দি দিতে। দীপ্তেন্দুর পক্ষে নিযুক্ত দামী আইনজীবী অসহায় হয়ে পড়ে। তাদের প্রতিরক্ষা টিমের প্ল্যান ছিল— গীতাকে ‘লোভী’, মঞ্জুকে ‘চক্রান্তকারী’, শোভন সাহাকে ‘উসকানিদাতা’ হিসেবে দেখানো। কিন্তু গীতার নিশ্চুপ, অথচ দৃঢ় বয়ান, শোভনের প্রামাণ্য রিপোর্ট, এবং সবচেয়ে বড় কথা— জনগণের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ সেই প্রতিরক্ষার ভীত ধসিয়ে দেয়। একদিন হঠাৎ শহরের বাইরে তাঁর বাগানবাড়িতে সাংবাদিকের গাড়ি আগুনে পুড়ে যায়— দীপ্তেন্দুর নাম না উঠলেও ছায়া পড়ে যায় তাঁর উপরেই। শোভন লেখেন এক পাতাজুড়ে— “যে সত্য পোড়াতে চায়, সে জানে তার মুখোশ ছিঁড়ছে”। শহরের ছাত্রছাত্রীরা পথে নামে— “নারীর শরীর তোমার ক্ষমতার খেলার মাঠ নয়”— এমন প্ল্যাকার্ডে ঢাকা পড়ে যায় চারপাশ। পুলিশ এবং আদালত এবার বুঝে যায়— এই মামলা আর চাপা রাখা যাবে না, কারণ জনগণ জেগে উঠেছে।

অবশেষে আসে সেই দিন— আদালত রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ করে। কোর্টরুমে দীপ্তেন্দু বসুর মুখে কোনো ‘অভিনয়’ নেই আজ। তাঁর চোখ অব্যক্ত আতঙ্কে ঘোলা, চশমার কাঁচ ঝাপসা। বিচারক বলেন, “আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলি পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত। এই আদালত মনে করে, অভিযুক্ত তাঁর প্রভাব ও অবস্থান ব্যবহার করে এক কিশোরীকে মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছেন। বিচার শুধু আইনের নয়, নৈতিকতারও প্রশ্ন।” রায় পড়ে শোনানো হয়— দীপ্তেন্দু বসু দোষী সাব্যস্ত, এবং তাঁকে দশ বছরের কঠোর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হচ্ছে। আদালত কক্ষে হাহাকার হয় না, উল্লাসও না— বরং নিঃশব্দে এক যুগসন্ধিক্ষণ জন্ম নেয়। গীতা চুপচাপ বসে, চোখে জল নেই, কিন্তু বুকের মধ্যে যেন একশো বছরের ভার হালকা হয়ে গেছে। মঞ্জু কাঁদে না, কেবল মেয়ের হাত চেপে ধরে রাখে, যেন বলে— “দেখিস, এই সমাজ একদিন বদলাবেই।” শোভন সাহা সেই মুহূর্তের ছবি তোলে না, সে কলমে লেখে, “আজ এক ভদ্রলোকের মুখোশ ফাটল, আর তাতে বেরিয়ে এল সমাজের আসল মুখ। নোংরা, কিন্তু সংশোধনের অপেক্ষায়।”

কোর্ট থেকে বেরিয়ে আসার সময় সাংবাদিকেরা ছুটে আসে গীতার দিকে— “আপনি কী বলবেন আজকের রায়ের পর?” গীতা ধীরে মুখ তোলে, তারপর বলে, “আমার শরীর নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলেছিল, তারা আজ চোখ নামিয়ে হাঁটে। আমি শুধু চাই— আর কোনো মেয়েকে যেন চুপ করিয়ে না রাখা হয়।” সেই বাক্য যেন ঝড়ের মতো ছড়িয়ে পড়ে। সোশ্যাল মিডিয়া, সংবাদপত্র, পথসভা— গীতার মুখ হয়ে ওঠে নতুন যুগের সাহসের প্রতীক। দীপ্তেন্দু বসু, একসময় যিনি শহরের শীর্ষ মঞ্চে বক্তৃতা দিতেন, এখন শোনেন চার দেয়ালের মধ্যে, কয়েদিদের ভিড়ে। তাঁর মুখোশ ফাটলেও সমাজের সব মুখোশ এখনো পড়ে আছে— কিন্তু ফাটতে শুরু করেছে। এক কিশোরীর সত্যভাষণের সাহসে সমাজে এক নতুন আলোর রেখা ফুটে উঠেছে। মঞ্জু মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলেন, “তুই শুধু আমার গীতা না, তুই এখন অন্য অনেক মেয়ের কণ্ঠ। তুই থামিস না রে।”

সময় কেটে গেছে কিছু মাস। গ্রীষ্মের কাঠফাটা দুপুর, শহরের ট্রাফিকের কোলাহল, আর চারপাশে আবার নতুন খবর, নতুন উত্তেজনা। কিন্তু একটা খবর এখনও বহু মানুষের মনে গেঁথে আছে— গীতার মামলা। অনেকেই এখন বলে, “ভালো হয়েছে… একবার তো মুখোশ খুলল।” আবার অনেকে ফিসফিসিয়ে বলে, “সবই নাটক… এসব আজকাল মেয়েরা করে নিজের নাম কামাতে।” কিন্তু যাদের শরীর ছিঁড়ে যায় সমাজের নখরে, তাদের কাছে এসব কথার গুরুত্ব থাকে না। গীতা আজ নিয়মিত কাউন্সেলিং নেয়, স্কুলে ফেরে না, কিন্তু পড়াশোনা ছাড়েনি। সে এখন নিজের মতো করে জীবনের অর্থ খুঁজে চলেছে। তার লেখা কবিতায় উঠে আসে নীরবতা, প্রতিবাদ আর আগুন— এক ছাইয়ের ভাষা, যা সে আজ নিজেই বুঝতে শিখেছে। মঞ্জু এখন আর পুরোনো বাড়িতে কাজ করেন না। তিনি স্থানীয় মহিলা অধিকার সংগঠনে যুক্ত হয়েছেন, মেয়েদের নিয়ে কাজ করেন, যারা কথা বলতে ভয় পায়। সে বলে, “আমার জীবনে অনেক ভুল ছিল, কিন্তু একটা কাজ ঠিক করেছি— চুপ করিনি।”

একদিন বিকেলে, শোভন সাহা আবার আসে গীতাদের বাড়িতে। সাথে ক্যামেরা নয়, কলমও নয়— আসে একখানা বই নিয়ে, যার নাম “অন্তঃসারশূন্য: মুখোশের শহরে সত্যের পথচলা”। কাভারে ছাপা গীতার চোখের ছবি— ঝাপসা নয়, তীক্ষ্ণ। বইটি সমাজে এক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে— শুধু শহরে নয়, গ্রামের স্কুলেও এখন সেই গল্প পড়ানো হচ্ছে, যেখানে একজন গৃহপরিচারিকার কিশোরী মেয়ের কণ্ঠ বদলে দিয়েছে এক মুখোশপরা কাঠামোকে। শোভন বইটি তুলে দেয় গীতার হাতে, আর বলে, “তুই তো চাইলে লেখক হতে পারিস, গীতা। তোকে কেউ আর থামাতে পারবে না।” গীতা হেসে বলে, “আমি তো আর মুখ বন্ধ করে থাকা গীতা নই।” সেই কথার মধ্যে একটা গভীর আলো— এমন এক আলো যা আর কেবল নিজের চারপাশকে উজ্জ্বল করে না, বরং পথ দেখায় অন্য মেয়েদেরও। শহরের এক এনজিও তাকে প্রস্তাব দিয়েছে— সমাজবিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে ভাষণ দিতে। প্রথমবার মাইক্রোফোন হাতে তুলে নেয় সে— কাঁপে না, কণ্ঠ থামে না, বলে, “আমরা যারা নীচু শ্রেণির মেয়ে, আমাদের ভাঙা কণ্ঠই একদিন এই সমাজ বদলাবে। কারণ সত্য কখনও মুখ বন্ধ রাখে না, শুধু সুযোগের অপেক্ষা করে।”

এই গল্পটা এখানেই শেষ নয়— বরং এখানেই শুরু। সমাজে দীপ্তেন্দুর মতো মুখোশপরা মানুষ রয়ে যাবে আরও অনেকদিন, কিন্তু মঞ্জু ও গীতাদের মতো প্রতিবাদী কণ্ঠও তৈরি হচ্ছে নতুন করে। সত্যের পথ সহজ নয়— সেখানে জড়িয়ে থাকে অপমান, হুমকি, নিঃসঙ্গতা। কিন্তু সেই আগুনের ভিতর দিয়েই তৈরি হয় সত্যিকার অন্তঃসার। ‘অন্তঃসারশূন্য’ শব্দটি হয়তো দীপ্তেন্দুদের জন্য, যাদের ভেতরে কিছু নেই— কেবল বাহ্যিক পর্দা। আর গীতাদের অন্তরে গড়ে ওঠে সেই আগুন, যা সময়কে বদলে দেয়। শেষ দৃশ্যে দেখা যায়— গীতা একটা নতুন বই লিখছে, নাম রেখেছে “জ্বলন্ত কণ্ঠ”। তার প্রথম লাইন—
“আমার শরীরকে কুড়িয়ে নিতে পারো,
কিন্তু আমার কণ্ঠকে পুড়িয়ে ফেলতে পারবে না।
সেই কণ্ঠ দিয়েই আমি প্রতিধ্বনি হবো—
সব সেই মুখোশপরা ‘ভদ্রলোক’-এর ঘরে।”

***

 

1000038725.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *