কমলিকা বসু
অয়নের জীবনটা যেন দীর্ঘদিন ধরেই একরকমের নিস্তব্ধতায় ঢেকে ছিল। প্রতিদিন সকালে উঠে ফ্রিল্যান্স কাজের চাপ, ক্লায়েন্টদের ই-মেইল, অগণিত অসমাপ্ত প্রোজেক্ট—সবই তার একঘেয়ে জীবনের অঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। শহরের কোলাহল, চেনা মুখের ভিড়, ব্যস্ত রাস্তা—সবকিছু তার কাছে নির্লিপ্ত মনে হতো। মানুষদের সঙ্গে মেশার সুযোগ থাকলেও সে তা এড়িয়ে চলত, কারণ অয়ন বরাবরই ভেতরে ভেতরে বিশ্বাস করত—মানুষের কাছাকাছি গেলে একসময় কষ্ট পেতেই হয়। শৈশবের ভাঙা পরিবার, বাবা-মায়ের অবিরাম দ্বন্দ্ব তাকে এ শিক্ষা দিয়েছিল। ফলে বাস্তব জীবনে তার সম্পর্কের পরিধি সীমিত, বন্ধুর সংখ্যা প্রায় নেই বললেই চলে। একাকীত্বের গহ্বর থেকে মুক্তি পেতে মাঝে মাঝে সে আশ্রয় নিত অনলাইন কমিউনিটিগুলোর আড্ডায়, যেখানে মুখ আর পরিচয় নয়, শুধু লেখা, ছবি আর অনুভূতির বিনিময় মানুষকে কাছে টেনে আনে। সেইসব ভার্চুয়াল জগতের এক সন্ধ্যায়ই হঠাৎ করে তার চোখ আটকে যায় এক অচেনা কবিতায়—যেন শহরের অন্ধকার ভেদ করে হঠাৎ একটুকরো আলো এসে পড়ল তার মনে। কবিতার নাম ছিল “অদৃশ্য হাতের ছোঁয়া”। প্রথম দু-এক লাইন পড়তেই অয়ন থমকে গেল। এ কেমন লেখা, এত সহজ অথচ এত গভীর! কয়েকটি সাধারণ শব্দে এমনভাবে একাকীত্ব, প্রেম আর অদৃশ্য আকাঙ্ক্ষাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল যে তার মনে হলো—এই কবিতাটি যেন তার নিজের জন্যই লেখা। লেখকের নাম লেখা ছিল—“মায়াবী”। সেই নামটাও অদ্ভুতভাবে তার মনে দাগ কেটে গেল, যেন অনেকদিনের হারানো পরিচিত কাউকে সে হঠাৎ করে খুঁজে পেয়েছে।
অয়ন কবিতাটির নিচে এক ছোট্ট মন্তব্য লিখল—“আপনার কবিতায় যে শূন্যতার কথা আছে, সেটা যেন আমার প্রতিদিনের সঙ্গী। অসাধারণ লাগল পড়তে।” সে ভেবেছিল, হয়তো এই বিশাল ভিড়ে তার মন্তব্য হারিয়ে যাবে, কিংবা লেখক এক নজরও দেখবে না। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তার ফোনে নোটিফিকেশন এলো। উত্তর এসেছে—“শূন্যতা হয়তো আমাদের সবার অদৃশ্য সঙ্গী, শুধু কেউ তা কবিতায় বলে, কেউ নীরব থেকে যায়। ধন্যবাদ আপনাকে।” এই এক ছোট্ট উত্তরের ভেতরেই অয়ন খুঁজে পেল এক অদ্ভুত উষ্ণতা। তার মনে হলো, কোনো অচেনা মানুষ তার অজানা দুঃখকে বুঝে ফেলেছে। এর পর থেকেই শুরু হলো কথোপকথন—প্রথমে কবিতার প্রশংসা, তারপর একেকটি মেসেজের ভেতর দিয়ে ছুঁয়ে যাওয়া জীবনকথা। ধীরে ধীরে তারা নিজেদের ভেতরের গল্প শেয়ার করতে শুরু করল। অয়ন জানাল, সে একজন গ্রাফিক ডিজাইনার, একাকী থাকে, খুব একটা বাইরে বেরোয় না। সোহিনী—যদিও সে তখনও নিজের নাম বলেনি, শুধু “মায়াবী” নামেই পরিচিত—উত্তরে লিখল, সে সাহিত্য ভালোবাসে, কবিতা তার নিঃশ্বাসের মতো। প্রতিদিনের চাপ, অনিশ্চয়তা আর অজানা শূন্যতাকে কলমে বন্দি করে রাখাই তার বেঁচে থাকার উপায়। তাদের আলাপ যেন অদৃশ্য সেতুর মতো প্রসারিত হতে লাগল—যেখানে বাস্তব আর ভার্চুয়াল সীমারেখা মুছে যাচ্ছিল, শুধু থেকে যাচ্ছিল একে অপরের কণ্ঠস্বরহীন উপস্থিতি।
দিনের পর দিন কেটে যেতে লাগল, আর প্রতিদিনই অয়ন অপেক্ষা করত মায়াবীর নতুন কোনো কবিতা বা মেসেজের জন্য। একসময়ের একঘেয়ে জীবন যেন হঠাৎ করে রঙিন হয়ে উঠল। কাজের ফাঁকে, কফির কাপ হাতে কিংবা রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে—প্রতিটি মুহূর্তে তার মনে হতো, আজ নতুন কী কথা হবে? হয়তো মায়াবী আবার কোনো কবিতার লাইন পাঠাবে, হয়তো দু’জনে মিলে একসাথে অনলাইনে গান শুনবে। ভার্চুয়াল জানালার ওপাশে যে মানুষটা আছে, তাকে সে কখনো দেখেনি, তার মুখচিত্র কল্পনাতেই তৈরি করছে, অথচ সেই অদৃশ্য মানুষটিই তার জীবনে আলো হয়ে উঠছে। সে বুঝতে পারল, আসলে সম্পর্কের জন্য সবসময় দৃশ্যমানতা জরুরি নয়—অনুভূতির সত্যতাই আসল। একসময় অয়ন ভাবতে শুরু করল, হয়তো এভাবেই তার জীবনের দীর্ঘ একাকীত্ব ভাঙবে, হয়তো এই অচেনা মায়াবীর হাত ধরে সে নতুন করে বাঁচতে শিখবে। কিন্তু একইসাথে ভেতরে ভেতরে একটা ভয়ও জমতে থাকল—যদি সবকিছু কেবল মায়ার ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকে? যদি এই অদৃশ্য হাতের স্পর্শ বাস্তবের আলোতে মিলিয়ে যায়? এই দ্বিধা-আশঙ্কার ভেতর দিয়েই শুরু হলো তাদের এক অদৃশ্য অথচ অদ্ভুতভাবে বাস্তব যাত্রা।
_
বন্ধুত্বের শুরুটা যেন ছিল এক অদৃশ্য দিগন্তের ওপারে। অয়ন নিজের নাম প্রকাশ না করে শুধু একটি পরিচিতি বেছে নিল—“অদৃশ্য হাত।” নামটির মধ্যেই ছিল এক অদ্ভুত প্রতীকী ইঙ্গিত, যেন সে স্বীকার করছে—তার উপস্থিতি আছে, কিন্তু ধরা যায় না, বোঝা যায় শুধু অনুভবে। অন্যদিকে মেয়েটি, যাকে সে প্রতিদিন আরও বেশি করে চিনতে শুরু করছিল, সে-ই সেই রহস্যময়ী “মায়াবী।” এই নামের ভেতরেও ছিল গভীর ইঙ্গিত—কেউ তাকে চিনতে পারবে না, সে শুধু ছায়ার মতো কাছে এসে থেকে যাবে। নামহীন এই বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে দুইজন মানুষের জীবনের মূল কেন্দ্র হয়ে উঠতে লাগল। তাদের প্রতিদিনের কথোপকথন যেন নতুন রঙ ছড়াচ্ছিল—কখনো কবিতার ছন্দে, কখনো ছবির বর্ণনায়, কখনো একেবারে নীরবতায়। অয়ন ভাবত, আশ্চর্য, যে মানুষটিকে সে কখনো চোখে দেখেনি, তার প্রতি এত আকর্ষণ কীভাবে জন্মায়? আর মায়াবীও একদিন লিখেছিল—“হয়তো আমরা নাম দিয়ে মানুষকে চিনি না, আমরা চিনি তার ভেতরের শূন্যতা, আনন্দ আর স্বপ্নকে।” এই একটি বাক্য পড়েই অয়নের ভেতর কেঁপে উঠেছিল। তার মনে হয়েছিল, কেউ তার অন্তরের কথাগুলো শব্দে সাজিয়ে দিয়েছে। এই নামহীনতা-ই যেন তাদের সম্পর্কের আসল শক্তি হয়ে উঠল, কারণ বাস্তবের দায়-দায়িত্ব, পরিচয়ের জটিলতা—কিছুই এখানে প্রভাব ফেলছিল না।
কথোপকথনের ভেতরে ভেতরে তারা একে অপরের জীবনের টুকরো ছবি শেয়ার করছিল। অয়ন লিখত, কীভাবে সে ঘন্টার পর ঘন্টা ডিজাইন নিয়ে কাজ করে, কীভাবে ক্লায়েন্টদের অবাস্তব চাহিদার চাপ তাকে ক্লান্ত করে ফেলে। মায়াবী উত্তর দিত—“তুমি রং দিয়ে গল্প লেখো, আমি শব্দ দিয়ে।” সে জানাত তার কবিতা লেখার অভ্যাসের কথা, কিভাবে সে কলেজ থেকে ফেরার পর নিঃশব্দ ঘরে কলমে আঁকে দিনের অভিজ্ঞতা। কখনো তারা নিজেদের একাকীত্ব নিয়ে কথা বলত, কখনো আবার বইয়ের চরিত্রদের মতো অভিনয় করে চ্যাট করত। অয়ন তাকে বলেছিল, ছোটবেলায় সে অনেক গল্প লিখতে চাইত কিন্তু কখনো সাহস পেত না। মায়াবী তাকে উৎসাহ দিয়েছিল—“গল্প লেখা থামিয়ো না, আমরা দু’জনেই তো একরকম গল্পে বেঁচে আছি।” তাদের আলাপের এই প্রবাহ একসময় এতটাই গভীর হলো যে, দিন না কাটত একে অপরের বার্তা ছাড়া। মেসেঞ্জারের ছোট্ট নোটিফিকেশন টোন যেন অয়নের কাছে হয়ে উঠেছিল জীবনের সুর। অফিসের কাজের ফাঁকে, রাত জেগে, সকালের কফির চুমুকে—প্রতিটি মুহূর্তে তার মনে হতো, “মায়াবী কি এখন অনলাইনে আছে?” অন্যদিকে সোহিনীও প্রতিদিন অদৃশ্য হাতের মেসেজের অপেক্ষায় থাকত। সে অনেক সময় খাতায় লিখে রাখত—আজ তাকে কী জানাবে, কী নতুন কবিতা শেয়ার করবে। এই অদৃশ্য সংযোগ আস্তে আস্তে তাদের ভেতরের শূন্যতা ভরিয়ে তুলছিল, যেন নামহীন বন্ধুত্ব জীবনের সমস্ত একাকীত্ব মুছে দিচ্ছে।
তাদের আলাপ যত গভীর হচ্ছিল, ততই অদৃশ্য সীমারেখা ভাঙতে শুরু করল। কখনো তারা একসাথে অনলাইনে গান শুনত, কখনো একই সিনেমা আলাদা ঘরে বসে চালিয়ে আলোচনা করত, যেন দু’জন পাশাপাশি বসেই উপভোগ করছে। অয়ন তাকে প্রথমবার একখানা ছবি পাঠাতে চাইলে মায়াবী দ্বিধা করেছিল। উত্তর এসেছিল—“চোখ দিয়ে হয়তো তুমি আমাকে চিনবে না, কিন্তু কথার ভেতর দিয়ে তো চিনেছ।” এই উত্তর অয়নকে আরও বেশি আকৃষ্ট করেছিল, কারণ সে নিজেও বাস্তবের মুখচিত্রে তেমন বিশ্বাস করত না। তাদের জন্য আসল ছিল অনুভবের সত্যতা। ধীরে ধীরে মায়াবী তার লেখা কবিতার সাথে সাথে ছোট ছোট ভয়, স্বপ্ন আর গোপন ইচ্ছেগুলো শেয়ার করতে লাগল। অয়নও তার ভেতরের অন্ধকার, পারিবারিক ভাঙনের কষ্ট, অবিশ্বাসের যন্ত্রণা সব খুলে বলতে শুরু করল। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, কেউ কাউকে নাম-পরিচয়ে জানত না, তবুও একে অপরের জীবনকে আগের যে কোনো মানুষের চেয়ে বেশি কাছ থেকে চিনতে শিখছিল। এই নামহীন বন্ধুত্ব যেন ক্রমশ এক অদৃশ্য সম্পর্কের দিকে এগোচ্ছিল, যেখানে বিশ্বাস আর মমতাই হয়ে উঠেছিল একমাত্র পরিচয়। অয়নের মনে হচ্ছিল, তার সমস্ত একাকীত্ব এক অদৃশ্য হাত ধরে আলোর দিকে হাঁটছে, আর সোহিনীরও মনে হচ্ছিল, এই অচেনা মানুষটিই তার কবিতার প্রাণের সুর। এভাবেই নামহীন বন্ধুত্ব একদিন অদৃশ্য প্রেমের প্রথম পদক্ষেপ হয়ে উঠল।
_
নামহীন বন্ধুত্বের অদৃশ্য সেতুতে হেঁটে যেতে যেতে একসময় তারা দু’জনেই বুঝতে শুরু করল, শুধু কবিতা, গল্প কিংবা গান দিয়েই আর নিজেদের ভেতরের সবটা বলা যাচ্ছে না। কথোপকথন একসময় এমন মোড়ে এসে দাঁড়াল, যেখানে দু’জনের নীরব যন্ত্রণা, অতীতের দাগ আর অদৃশ্য শূন্যতার কাহিনী ধীরে ধীরে খুলে ধরা শুরু করল। অয়ন প্রথমে একটু দ্বিধা করেছিল। এতদিন সে তার নিজের ব্যথাকে লুকিয়ে রেখেছিল, কারও সাথে শেয়ার করেনি। কিন্তু মায়াবীর মমতাময়ী কথাগুলো, তার কবিতার সংবেদনশীলতা, আর গভীর বোঝাপড়ার ভঙ্গি যেন তাকে অজান্তেই সাহস দিল। এক রাতে, অনলাইনে দীর্ঘ চ্যাট চলার সময় হঠাৎ করেই অয়ন লিখল—“আমি সবসময় ভেবেছি, মানুষকে বিশ্বাস করা মানে কষ্টের দাওয়াত দেওয়া।” এই একটি লাইন যেন তাদের সম্পর্কের নতুন দরজা খুলে দিল। মায়াবী সঙ্গে সঙ্গে জানতে চাইল—“এ কথা কেন বলছ?” তখন অয়ন ধীরে ধীরে খুলে বলতে শুরু করল, কেমন করে তার ছোটবেলা কেটেছে ভাঙা পরিবারের অস্থিরতায়। বাবা-মায়ের নিরন্তর ঝগড়া, রাতের পর রাত কান্না, একদিন হঠাৎ করে আলাদা হয়ে যাওয়া—সবকিছু যেন তার বিশ্বাসের ভিতটাই নড়িয়ে দিয়েছিল। অল্প বয়সেই সে বুঝে গিয়েছিল, যাকে খুব কাছের মনে হয়, তাকেই একদিন হারাতে হয়। তাই মানুষের কাছাকাছি যেতে ভয় পেত, সম্পর্ক মানেই যেন তার কাছে অস্থায়ী আশ্রয়। মায়াবীর নীরব উপস্থিতি আর শান্তভাবে শোনার ভঙ্গি অয়নকে সাহস জোগাচ্ছিল। সে অনুভব করল, এতদিনের চেপে রাখা কষ্ট যেন অবশেষে কারও কাছে বলা সম্ভব হচ্ছে।
অন্যদিকে সোহিনীও শুধু শ্রোতা হয়ে রইল না। অয়নের কথা শোনার পর সে বুঝতে পারল, তাদের মধ্যে অনেক অদৃশ্য মিল আছে। সেও তো ভেতরে ভেতরে এক বিশাল শূন্যতা বয়ে নিয়ে চলেছে। সেদিন রাতে অয়নকে উত্তর দিল—“তুমি বিশ্বাস হারিয়েছ বলে কষ্টে আছ, আমি বিশ্বাস হারাতে চাই না বলে লুকিয়ে বেঁচে আছি।” তারপর ধীরে ধীরে সে নিজের কাহিনী খুলে বলল। সোহিনী ছোটবেলা থেকেই সবার চোখে ‘ভালো মেয়ে’ ছিল—ভালো পড়াশোনা, ভালো ব্যবহার, সবার খুশি রাখার চেষ্টা। কিন্তু এই ‘ভালো’ হওয়ার ভেতরেই হারিয়ে গিয়েছিল তার নিজের অস্তিত্ব। কেউ তাকে সত্যিকারের তার মতো করে চিনতে চায়নি। পরিবার, আত্মীয়, সমাজ—সবাই তার কাছ থেকে প্রত্যাশা করেছে, কিন্তু তার নিঃসঙ্গতা বা ভেতরের চাপ বুঝতে চায়নি। কলেজে এসে যখন সে একটু নিজের মতো করে বাঁচতে চেয়েছিল, তখনও তাকে অনেক নিয়ম-শৃঙ্খলার বেড়াজালে আটকে ফেলা হয়েছিল। কবিতা লেখা, গোপনে গান গাওয়া—এসবই ছিল তার মুক্তির ছোট্ট জানালা। সে অয়নকে লিখল, “আমার চারপাশে যত মানুষই থাকুক না কেন, আমার ভেতরে একটা অদৃশ্য খালি ঘর আছে, যেখানে আমি একা থাকি। আর তুমি সেই ঘরে প্রথম আলো জ্বালালে।” অয়ন এ উত্তর পড়ে চুপ করে গিয়েছিল। তার মনে হচ্ছিল, জীবনে প্রথমবারের মতো কেউ তার ব্যথার ভাষা বুঝেছে, আর সেই মানুষটি তার মতোই অদৃশ্য শূন্যতায় আটকে থাকা।
এভাবেই একে অপরের একাকীত্বের গল্প ধীরে ধীরে হয়ে উঠল তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী সংযোগ। দু’জনের কথোপকথন যেন আর সাধারণ চ্যাট বা মেসেজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না; সেগুলো হয়ে উঠল গভীর স্বীকারোক্তি, যা শুধু বিশ্বাসের জায়গা থেকেই সম্ভব। নাম-পরিচয়, বাস্তবের চেনা মুখ, সামাজিক দায়—এসবের কোনো অস্তিত্ব ছিল না সেই আলাপে। ছিল কেবল দু’জন নিঃসঙ্গ আত্মা, যারা অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা পড়ে একে অপরকে শক্তি দিচ্ছিল। রাত গভীর হলে তারা একে অপরকে কবিতার লাইন শোনাত, ভোর হলে নতুন দিনের আশা শেয়ার করত। একদিন মায়াবী লিখেছিল—“হয়তো আমরা সমুদ্রের দুই তীরে দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু জোয়ারের জলে একে অপরের ছায়া ছুঁয়ে যাচ্ছি।” এই লাইন পড়ে অয়ন দীর্ঘক্ষণ নিরব ছিল। তার মনে হচ্ছিল, মায়াবী শুধু তার মনের কথাই নয়, তার অদৃশ্য একাকীত্বকেও ছুঁয়ে ফেলছে। সেই মুহূর্তে সে বুঝতে পারল, যে বন্ধুত্বটা নামহীন হয়ে শুরু হয়েছিল, তা এখন হয়ে উঠছে জীবনের আসল সেতুবন্ধন—একাকীত্বের সেতুবন্ধন। হয়তো এই অদৃশ্য সংযোগই একদিন তাকে শেখাবে, বিশ্বাস মানে সবসময় হারিয়ে যাওয়া নয়; বরং কখনো কখনো বিশ্বাসই অন্ধকারের ভেতরে একমাত্র আলো হয়ে ওঠে।
_
অয়ন এবং সোহিনীর যোগাযোগ ধীরে ধীরে এক অদৃশ্য কিন্তু দৃঢ় সেতুতে পরিণত হচ্ছিল। দিনের ক্লান্তি শেষে যখন পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়ে, তখনই তারা একে অপরের জানালায় আলো জ্বালাতো ভার্চুয়াল দুনিয়ার মাধ্যমে। চ্যাটবক্সে ভেসে বেড়াতো শব্দ, যা কখনো কবিতা, কখনো গানের লিরিক্স, কখনো আবার মনের একান্ত বেদনাগুলি। অয়ন নিজের লেখা ছোট ছোট কবিতা পাঠাতো—যেখানে তার ভাঙা পরিবারের ছায়া, অপূর্ণ স্বপ্নের আক্ষেপ আর একাকীত্বের ঘন ছায়া ফুটে উঠতো। সোহিনী সেই কবিতাগুলির উত্তরে লিখে দিতো এমন কিছু লাইন, যা পড়লে অয়ন মনে করতো—সে যেন সত্যিই বোঝা যাচ্ছে, তার সমস্ত শূন্যতাকে কেউ আলতো ছুঁয়ে দিয়েছে। রাত যত গভীর হতো, তত তারা নিজেদের খোলস ভেঙে আরও কাছে চলে আসতো। শুধু মেসেজ নয়, মাঝেমাঝে তারা একে অপরকে গান শোনাতো, ইউটিউব লিঙ্ক পাঠাতো, কিংবা কখনো অডিওতে নিজের কণ্ঠ রেকর্ড করে পাঠাতো। অয়নের জন্য এই মুহূর্তগুলো ছিল এক নতুন অভিজ্ঞতা, কারণ এতদিন তার কাছে ভালোবাসা মানে ছিল শুধু ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের কষ্ট; অথচ এখানে, নামহীন এক বন্ধুত্বের ভেতরেই জন্ম নিচ্ছিল অচেনা এক উষ্ণতা।
সোহিনীর দিক থেকেও এই বন্ধুত্ব ছিল এক অন্যরকম যাত্রা। সে সারাদিন হয়তো তার কাজ, পড়াশোনা, কিংবা পরিবার নিয়ে ব্যস্ত থাকতো, কিন্তু রাত নামলেই অপেক্ষা করতো অয়নের বার্তার জন্য। প্রতিটি শব্দ তার মনে আলো ছড়াতো, যেন অন্ধকার ঘরে হঠাৎ জানালা খুলে হাওয়া ঢুকে পড়েছে। সোহিনী তার নিজের লেখা কবিতা পাঠাতো, যেখানে ভাসতো মায়া, কল্পনা আর অদৃশ্য শূন্যতার ছবি। কখনো সে লিখতো—“আমরা হয়তো দূরে আছি, তবু আমাদের মনের ভেতরকার নদী একই স্রোতে বয়ে যায়।” এই লাইন পড়ে অয়ন থমকে যেতো। তার বুকের ভেতর হঠাৎ করেই কেমন যেন অদ্ভুত আলোড়ন তৈরি হতো। সে ভাবতো, এতদিন যাকে শুধু ভার্চুয়াল এক বন্ধু ভেবেছিল, সে কি আসলেই তার কাছে আরও গভীর কোনো জায়গা করে নিচ্ছে? চ্যাটবক্সের পর্দার ওপাশে থাকা এই মেয়ে কি কেবল এক অচেনা মানুষ, নাকি সত্যিই তার জীবনের শূন্যতায় ভর দিতে আসা এক ‘মায়াবী’? ধীরে ধীরে অয়ন বুঝতে শুরু করলো—এই সম্পর্ক কেবল সাধারণ বন্ধুত্ব নয়। এই আলাপের ভেতর এমন কিছু আছে, যা তাকে দীর্ঘদিনের অবসাদ থেকে টেনে তুলছে।
এই অনুভূতিই একদিন অয়নকে স্বীকার করতে বাধ্য করলো তার নিজের মনে জমে থাকা অস্বীকার করা সত্যিটা—“হয়তো এই অদৃশ্য হাতই আমার জীবনের সত্যি আশ্রয়।” সেই রাতে সে একদম খোলা মনের কথোপকথন শুরু করলো। লিখলো—“তুমি জানো, এতদিন আমার জীবনে যত মানুষ এসেছে, তারা সবাই কোনো না কোনোভাবে আমাকে ভেঙে দিয়েছে। কিন্তু তুমি আলাদা। তুমি আমাকে কেবল শোনাও না, আমার ভেতরের শূন্যতাকেও স্পর্শ করো।” সোহিনী এই বার্তা পড়ে চুপ করে বসে রইলো কিছুক্ষণ। তার বুকের ভেতরও একটা অদ্ভুত আলোড়ন হচ্ছিল। সে উত্তর দিলো—“তুমি জানো অয়ন, আমি কখনো ভাবিনি ভার্চুয়াল কোনো পরিচয় আমার কাছে এতটা সত্যি হয়ে উঠতে পারে। তোমার লেখা, তোমার কথাগুলো আমাকে এমনভাবে ছুঁয়ে যায়, যা আমি বাস্তবে কখনো পাইনি।” সেই মুহূর্তে তারা দু’জনেই বুঝলো, এই নামহীন বন্ধুত্ব আর স্রেফ বন্ধুত্ব নয়; এটা এক গভীর টান, এক অচেনা কাছাকাছি আসা, যা কোনো বাস্তব পরিচয় ছাড়াই জন্ম নিয়েছে। অয়ন অনুভব করলো, হয়তো তার সমস্ত অপেক্ষার শেষ এসে গেছে—সে সত্যিই তার অদৃশ্য আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে।
_
সোহিনী আর অয়ন বহু রাত ধরে একই ছন্দে বাঁধা কথোপকথনে নিজেদের মিশিয়ে নিচ্ছিল। ছদ্মনামের আড়ালেও তাদের আবেগ যেন ক্রমে নগ্ন হয়ে উঠছিল। সোহিনী যখন কবিতার লাইন পাঠাত, তাতে অদ্ভুত এক গোপন আকুলতা ভেসে উঠত—যেন কিছু না বলেও অনেক কিছু বলে ফেলা যায়। অয়ন সেসব পড়ত, মনোযোগ দিয়ে, তারপর ধীরে ধীরে নিজের অনুভূতির ছায়া মিশিয়ে দিত উত্তরগুলিতে। কিন্তু তার মন ততদিনে কেবল বন্ধুত্বের গণ্ডিতে আটকে ছিল না। সোহিনীর প্রতিটি লাইন, প্রতিটি শব্দে সে যেন নিজের ভাঙা আত্মার সান্ত্বনা খুঁজে পাচ্ছিল। এভাবেই এক রাতে সোহিনী লিখল—
“কখনো কি মনে হয়, কিছু মানুষ আমাদের জীবনে শুধু আলো হয়ে আসে? তাদের নাম আমরা জানি না, মুখও দেখি না, তবু তাদের উপস্থিতি ছাড়া দিন অসম্পূর্ণ লাগে।”
অয়ন পড়ল, চোখ থমকে গেল সেই লাইনেই। যেন তাকে নিয়েই লেখা হয়েছে। ভেতরে ভেতরে সে বুঝতে পারল, দু’জনের মধ্যে এক অদৃশ্য স্বীকারোক্তি জমে উঠছে।
এরপর দিনগুলো যেন অদ্ভুত ছন্দে কাটতে লাগল। প্রতিদিন রাতের শেষে তারা ঠিক সময়মতো অনলাইনে যুক্ত হতো—সোহিনী ‘মায়াবী’ নামে, অয়ন ‘অদৃশ্য হাত’ হয়ে। গল্প, কবিতা, গান, আর জীবনের ফাঁকা পাতাগুলো একে অপরকে দেখানোর মাঝে অদ্ভুত ঘনিষ্ঠতা জন্ম নিল। সোহিনীর চোখে পৃথিবী ছিল কাব্যের মতো, আর অয়নের চোখে ছিল ভাঙা বাস্তবের দাগ। তবুও একে অপরকে তারা এমনভাবে গ্রহণ করছিল যেন অন্য কোথাও, অন্য কোনো দুনিয়ায় দু’জনের দেখা হয়ে গেছে আগে। সোহিনী প্রথমে দ্বিধা করলেও নিজের মনের আবেগ আর লুকোতে পারছিল না। এক সন্ধ্যায়, কথোপকথনের মাঝেই হঠাৎ লিখল—
“আমি জানি না কেন, কিন্তু মনে হয় তোমার ছাড়া এখন আর লিখতে পারব না। হয়তো এটাকে ভালোবাসা বলে…”
লিখে পাঠানোর পর তার বুক কেঁপে উঠেছিল। ফোনের পর্দার দিকে তাকিয়ে সে যেন নিশ্বাস আটকে রেখেছিল, অয়নের উত্তর আসবে কিনা সেই প্রতীক্ষায়। অয়ন বারবার নিজের ভেতরে প্রশ্ন করছিল—এটা কি সত্যিই প্রেম, নাকি নিছক নিঃসঙ্গতার টান? কিন্তু যতই সে অস্বীকার করার চেষ্টা করেছে, হৃদয়ের ভেতর সেই অদ্ভুত আলো ছড়িয়ে পড়ছিল, যেটা সোহিনী ছাড়া কেউ এনে দিতে পারেনি।
অবশেষে অয়ন উত্তর দিল, অনেক দেরি করে, অনেক ভেবে—
“ভালোবাসা বড়ো শব্দ, মায়াবী। আমি জানি না আমি তার যোগ্য কি না। তবে একটা সত্যি আছে, তুমি আমার ভাঙা জীবনের যে ফাঁকা জায়গাগুলো ছিল সেগুলো পূরণ করেছো। হয়তো ভালোবাসা বলতে এটাকেই বোঝায়।”
সোহিনী স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বুঝল, অয়ন নিজের ভাষায়ই স্বীকার করেছে। অদৃশ্য হলেও সেই উত্তর যেন তার চোখে জল এনে দিল। দু’জনের নিঃসঙ্গতা এক সুতায় বাঁধা পড়ল সেই মুহূর্তেই। সেই রাত ছিল তাদের জীবনের মোড় ঘোরানো অধ্যায়—যেখানে বন্ধুত্বের নিঃশব্দ টান অতিক্রম করে তারা প্রবেশ করল হৃদয়ের গভীর অঞ্চলে। ভোর হয়ে এল, অথচ কেউ লগ আউট করতে পারল না। স্ক্রিনে নামগুলো জ্বলজ্বল করছিল, আর ভেতরে ভেতরে দু’জনেই অনুভব করছিল—এখন আর এই অদৃশ্য সম্পর্ক কেবল বন্ধুত্বের জায়গায় নেই, এটা এমন কিছুতে রূপ নিচ্ছে যেটা হয়তো জীবন বদলে দিতে পারে।
_
অয়ন আর সোহিনীর ভার্চুয়াল জগৎ ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিল একে অপরের কাছে নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো জরুরি। দিন-রাতের বেশিরভাগ সময় তারা ব্যয় করছিল মেসেজে, কবিতা ভাগ করে নেওয়ায়, অথবা হঠাৎ করে রাত তিনটেয় কারও লেখা গান শুনে আবেগে ভেসে যাওয়ায়। অথচ এই সময়েই বাইরের বাস্তব জীবনে পরিবর্তনের ছায়া ঘনিয়ে আসছিল। অয়নের জীবনে অমিতাভ নামের এক পুরোনো বন্ধু লক্ষ্য করতে শুরু করেছিল তার আচরণের রদবদল। আগে যে অয়ন সবসময় নির্লিপ্ত, একরকম নিরাশাগ্রস্ত হয়ে থাকত, এখন তার চোখে যেন একটা অন্যরকম আলো দেখা যায়, কথাবার্তায় অচেনা উচ্ছ্বাস মিশে থাকে। অমিতাভ প্রথমে অবাক হলেও ধীরে ধীরে সন্দেহ জন্ম নেয়—হঠাৎ কীসের এই পরিবর্তন? এ কি কোনও মেয়ে? যদি তাই হয়, তবে সে কে? অপরদিকে, সোহিনীর কাছের বান্ধবী ঋদ্ধি হঠাৎ করে লক্ষ্য করে তার একধরনের অমনোযোগিতা। ক্লাস, বই, কিংবা একসাথে সিনেমা দেখার আয়োজন—সবকিছুতেই যেন সোহিনী মন দিয়ে নেই। মোবাইলের স্ক্রিনেই তার মন পড়ে থাকে, আর একটু হাসি ফোটালেই বোঝা যায়, ওর ভেতরে চলছে অন্য এক জগৎ। ঋদ্ধির মনে দ্বিধা—বন্ধু সত্যিই খুশি, না কি এমন কিছুর মধ্যে জড়িয়ে যাচ্ছে যা পরে তাকে আঘাত করবে?
একদিন রাতে ঋদ্ধি আর সোহিনীর কথোপকথনে বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে উঠল। সোহিনী প্রথমে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বলছিল, কিন্তু বন্ধুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়াতে পারল না। শেষমেশ সে স্বীকার করল, “হ্যাঁ, আমি কারও সাথে কথা বলছি, অনলাইনে। ও আমার কাছে অনেকটা আপনজন হয়ে উঠেছে।” ঋদ্ধি অবাক হলেও ভয়ও পেল। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় অনেক প্রতারণা থাকে—এই মানুষটা সত্যিই কি সেই পরিচ্ছন্ন আত্মা, যেমনটা সোহিনী ভাবছে? নাকি অন্য কোনও উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে? সোহিনী এসব যুক্তি শুনতে চায়নি। তার কাছে অয়ন, ‘অদৃশ্য হাত’, এক বাস্তব অনুভূতি, যাকে সে বিশ্বাস করতে শিখেছে নিজের ভাঙা শূন্যতার ভেতরে। কিন্তু ঋদ্ধির মনে আশঙ্কা থেকেই যায়। অন্যদিকে, অমিতাভও সরাসরি একদিন অয়নকে প্রশ্ন করে বসে—“তোকে আমি চিনতাম অন্যরকম, হঠাৎ এত বদলে গেলি কীভাবে? কাউকে পছন্দ করিস নাকি?” অয়ন হেসে এড়িয়ে গেলেও অমিতাভ বুঝে ফেলল কিছু একটা ঘটছে, তবে বন্ধুর মুখে খোলাখুলি উত্তর না পেয়ে সে একরকম দ্বিধায় ভুগতে লাগল।
এভাবেই বাস্তব জীবনের মানুষগুলো তাদের চোখে ধরা পড়তে শুরু করল, অদৃশ্য এক সম্পর্কের আসল ছায়া। অথচ অয়ন আর সোহিনী কেউই সাহস পেল না নিজের চারপাশের মানুষকে সত্যিটা জানাতে। দুজনের ভেতরেও একরকম দ্বন্দ্ব ছিল—কেউ যদি ভুল বোঝে? যদি এই সম্পর্কটাকে নিছক মায়া বা অবাস্তব বলে উড়িয়ে দেয়? অথচ তারা জানত, এ সম্পর্কের গভীরতা অনেক বেশি, যা শুধু ‘ভার্চুয়াল’ শব্দ দিয়ে মাপা যায় না। তাই তারা দু’জনই গোপনে সেই অদৃশ্য হাতের স্পর্শ আঁকড়ে ধরে রইল, বাইরের দুনিয়ার প্রশ্নগুলো এড়িয়ে। কিন্তু সেই ছায়া ক্রমেই দীর্ঘ হয়ে উঠছিল, আর আশেপাশের মানুষগুলোও বুঝতে পারছিল—কিছু একটা ঘটছে, যা একদিন না একদিন আলোয় বেরিয়ে আসবেই। বাস্তবতার ছায়া তখন কেবল অপেক্ষা করছিল, উপযুক্ত মুহূর্তে সত্যিটাকে নগ্ন করে তোলার জন্য।
_
অয়ন আর সোহিনীর কথোপকথন তখন এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে একে অপরকে শুধু অক্ষরের ভেতর দিয়ে বোঝা আর সম্ভব হচ্ছিল না। রাতের নির্জনতায় ভেসে আসা মেসেজগুলো, ভোরের ঘুমভাঙা শুভেচ্ছা, হঠাৎ একেকটা কবিতার লাইন কিংবা সুর শোনানো—এসব কিছুই তাদেরকে অনেকটা কাছে এনে ফেলেছিল। তবু অয়ন বুঝতে পারছিল, অদৃশ্য জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মানুষটিকে সে কোনোদিন ছুঁতে পারেনি। সোহিনীও ভেতরে ভেতরে অনুভব করছিল, ছদ্মনামের এই সম্পর্ক যদি কখনো ভেঙে যায়, তবে একেবারেই শূন্যতায় পড়ে যাবে সে। তাই এক রাতে যখন হঠাৎ অয়ন লিখল—“আমরা কি সত্যি সত্যি দেখা করতে পারি না?”—সোহিনীর বুকের ভেতর অদ্ভুত এক ধাক্কা খেল। কয়েক মুহূর্ত স্ক্রিনের দিকে চেয়ে থেকে সে লিখল—“তুমি কি সত্যিই প্রস্তুত? মুখোমুখি হলে যদি আমাদের কল্পনার এই ঘর ভেঙে যায়?”—অয়ন জানত ঝুঁকি আছে, কিন্তু না দেখলে শান্তি মিলবে না। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সে বলল—“ভেঙে যাক, তবুও একবার দেখা হোক।” সেই মুহূর্ত থেকেই তাদের মনে এক ধরনের উন্মাদনা জন্ম নিল, যেন তারা হঠাৎ এক অজানা পথে হাঁটতে শুরু করেছে।
দিন-তারিখ ঠিক করতে গিয়ে দু’জনেই ভেতরে ভেতরে কাঁপছিল। অয়ন প্রথমে প্রস্তাব দিল এক পুরোনো ক্যাফের, যেটা কলেজে পড়ার সময় থেকে তার চেনা। সোহিনী দ্বিধা করল, কিন্তু শেষমেশ সম্মত হলো। পরের কয়েকদিন তাদের মেসেজে উত্তেজনা আর ভয় একসাথে ভাসতে লাগল। সোহিনী হঠাৎ ভাবতে লাগল—যদি অয়ন তার কল্পনার মতো না হয়? যদি তার চেহারা, তার ভঙ্গি, তার বাস্তব জীবন তাকে হতাশ করে দেয়? আবার অন্যদিকে, অয়ন নিজেকে আয়নায় বারবার দেখছিল, অচেনা অস্বস্তি তার গলা শুকিয়ে দিচ্ছিল। সে ভাবছিল—সোহিনী যদি তাকে দেখে বিরক্ত হয়? যদি ভেবে নেয় যে এই মানুষটিই তার জন্য নয়? এমনকি, ভয়টা এতটাই বেড়ে গেল যে, দু’জনেই একসময় সিদ্ধান্তটা বাতিল করার কথাও ভেবেছিল। কিন্তু ভেতরের আকর্ষণ, সেই অদৃশ্য সেতুবন্ধনের টান তাদেরকে আবার একই জায়গায় ফিরিয়ে আনল। তারা জানত, ভয়টা হয়তো ভেঙে দেবে সবকিছু, আবার হয়তো আরও দৃঢ় করে দেবে বন্ধনটাকে। এই অস্থিরতার মাঝেই দিনটা ঘনিয়ে এল—যেদিন তারা দু’জন বাস্তবের আলোতে একে অপরের মুখ দেখতে যাবে।
সেদিন সকালটা ভিন্ন রকম ছিল দু’জনের জন্যই। অয়ন অফিসে যাবার নাম করে বের হলো, অথচ তার চোখের নীচে স্পষ্ট দুশ্চিন্তার ছাপ। সোহিনী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বারবার তার চুল ঠিক করছিল, নিজের পোশাক নিয়ে দ্বিধায় ভুগছিল—কোনটা পরলে বেশি স্বাভাবিক লাগবে, কোনটা অতিরিক্ত হয়ে যাবে। তার মনে হচ্ছিল, এতদিন যে মানুষটিকে সে কেবল শব্দে চিনেছে, তাকে হঠাৎ সামনে দেখতে পেলে সে কেমন আচরণ করবে? ট্রেনে বসে অয়ন নিজের হাত মুঠো করে রাখল, যেন সেই চেপে রাখা উদ্বেগকে সামলাতে পারছে না। আর সোহিনী যখন ক্যাফের দিকে হাঁটছিল, তখন মনে হচ্ছিল প্রতিটা পদক্ষেপ তাকে অজানা এক পরীক্ষার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কল্পনার আকাশে যাকে তারা এতদিন ভরসা করে রেখেছিল, সে আজ বাস্তবে দেহ নিয়ে সামনে দাঁড়াবে। আর সেই মুহূর্তে হয়তো সবকিছু বদলে যাবে—ভালো বা মন্দ, যেটাই হোক। এই আশঙ্কা আর প্রত্যাশার মাঝেই তারা দু’জন মুখোমুখি হতে চলল, যেন অদৃশ্য জানালার ওপাশের কুয়াশা সরে গিয়ে সত্যিই রোদ এসে পড়তে যাচ্ছে।
_
ক্যাফের কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকার সময় অয়নের বুক ধড়ফড় করছিল যেন যুদ্ধের ময়দানে দাঁড়িয়ে আছে। এতদিন ধরে রাতজাগা চ্যাট, কবিতা বিনিময়, অদৃশ্য জানালার ওপারে জমে ওঠা বন্ধুত্ব আর ভালোবাসা—সবকিছুর রূপ আজ পরীক্ষা দেবে। পার্ক স্ট্রিটের এই আধুনিক কফি শপে নরম আলো, ভেসে আসা গানের সুর, আর চারদিকে অচেনা মুখের ভিড়ে সে খুঁজছিল শুধু একটি চেনা অচেনাকে—সোহিনীকে। মিনিটগুলো যেন দমবন্ধ করে তুলছিল। টেবিলের পাশে বসে হাতের আঙুল মুচড়াচ্ছিল, বারবার কফির মেনু খোলার ভান করছিল। মনে হচ্ছিল—হয়তো সোহিনী আসবে না, হয়তো সবটাই এক মরীচিকা। হঠাৎ করেই দরজা খুলে ঢুকে পড়ল এক মেয়ে—চোখে সরল অথচ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, কালো চুল খোলা, হালকা নীল পোশাক, মুখে হালকা মেকআপ ছাড়া স্বাভাবিক এক আভা। অয়ন তাকিয়েই বুঝল—এই তো সে, এই তো তার মায়াবী। বুকের ভেতরটা থমকে গেল। কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের ফারাক থাকলেও এক অদ্ভুত আকর্ষণে আচ্ছন্ন হয়ে গেল সে।
সোহিনীও অয়নকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। এতদিন ধরে ছদ্মনামে যার সঙ্গে কথা, যার কবিতার মধ্যে সে আশ্রয় খুঁজে নিয়েছিল, সেই মানুষটা আজ তার সামনে রক্তমাংসে। প্রথম মুহূর্তে তাকে মনে হল বেশ সাদামাটা—হালকা দাড়ি, সাধারণ শার্ট-প্যান্ট, চোখেমুখে ক্লান্তির রেখা। কিন্তু ঠিক সেখানেই লুকিয়ে ছিল এক অচেনা মায়া। সে বুঝতে পারল, অয়ন সেই মানুষ, যে শব্দের ভেতর দিয়ে তার একাকীত্ব বুঝেছিল, যে নীরবতার ভেতর থেকে তাকে টেনে বের করেছিল। তাদের চোখ এক মুহূর্তের জন্য আটকে গেল। অদৃশ্য পর্দা ভেঙে গেল—যেখানে এতদিন শুধু শব্দ ছিল, আজ সেখানে রক্তমাংসের উপস্থিতি। টেবিলের দু’পাশে বসতেই এক অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এল। কফির কাপ এলেও তারা প্রথমে কিছু বলতে পারছিল না। অয়ন শুধু সোহিনীর দিকে তাকিয়ে ভাবছিল—যদি বাস্তবের মুখ এই সম্পর্ক ভেঙে দেয়? সোহিনীও ভয় পাচ্ছিল—হয়তো সে তার কল্পনার মতোই নয়। কিন্তু যতক্ষণ তারা একে অপরের চোখে তাকিয়ে রইল, ধীরে ধীরে জমাট বাঁধা বরফ গলতে শুরু করল।
কথা শুরু হল সাধারণ বিষয় নিয়ে—ট্রাফিক, আবহাওয়া, কফি শপের সাজসজ্জা। কিন্তু একটু পরেই যেন শব্দগুলো নিজে থেকেই গভীর হতে লাগল। অয়ন বলল, “এতদিন ধরে মনে হচ্ছিল—হয়তো তুমি শুধু স্বপ্ন, হঠাৎ ভেঙে যাবে। কিন্তু আজ বুঝলাম, তুমি সত্যিই আছো।” সোহিনী হেসে বলল, “আমি-ও ভয় পাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম, যদি মুখোমুখি আসতেই সব ভুল মনে হয়? কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে না।” তাদের কণ্ঠে লুকোনো কাঁপুনি ছিল, কিন্তু সেই কাঁপুনির ভেতরেই ছিল সত্যিকারের টান। ঘড়ির কাঁটা ঘুরছিল, কিন্তু তারা দু’জন সময় ভুলে যাচ্ছিল। শহরের ভিড়ের ভেতরেও যেন এই টেবিলটা হয়ে উঠেছিল একান্ত জায়গা—যেখানে অদৃশ্য হাত আর মায়াবী অবশেষে নিজের মুখ পেয়েছে। বিদায়ের সময় দু’জনের মনেই ছিল অজস্র প্রশ্ন, ভয়, আর আশার ঝড়। সোহিনী ক্যাফের বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার আগে একবার ঘুরে তাকাল, আর অয়ন অনুভব করল—এ দৃশ্য, এ মুহূর্ত তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে। হয়তো এখান থেকেই শুরু হবে এমন এক যাত্রা, যা কেবল শব্দ নয়, বাস্তবতাকেও ছাড়িয়ে যাবে।
_
প্রথম সাক্ষাতের পর কফি শপে বসে অয়ন আর সোহিনী একে অপরকে চুপচাপ দেখছিল। চোখে ছিল বিস্ময়ের ছাপ, মনে ছিল অদ্ভুত এক ধাক্কা। এতদিন ধরে যাকে কল্পনায় তৈরি করে এসেছিল, হঠাৎ সে-ই বাস্তবে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। অয়ন ভেতরে ভেতরে একরকম স্বস্তি পেলেও তীব্র অস্থিরতাও অনুভব করছিল—কারণ অনলাইনের ‘অদৃশ্য হাত’ আর বাস্তবের অয়ন এক নয়, সোহিনীও নিশ্চয়ই সেটা টের পাচ্ছে। সোহিনীও অনুভব করছিল এই দ্বন্দ্ব—চ্যাটে যে মানুষ তার কাছে নিঃশর্ত ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছিল, বাস্তবে সে-ই হয়তো একেবারে ভিন্ন। তারা কথা বলতে শুরু করলেও কথার ভেতর যেন এক অদৃশ্য দ্বিধার পর্দা ছিল। নাম-পরিচয়, চাকরি, পরিবার, অতীত—সবই যেন নতুন করে প্রশ্ন তুলছিল। অয়ন ভাবছিল, “যদি সোহিনী হঠাৎ বুঝতে পারে আমি তার স্বপ্নের মানুষ নই?” আবার সোহিনীর ভেতরে চলছিল অন্যরকম ভয়—“যদি অয়ন বুঝে যায় আমি আসলে তার ভেবেছিলাম সেই মেয়েটি নই?” এই অস্বস্তি যেন এক অদৃশ্য কুয়াশার মতো তাদের চারপাশে ঘুরছিল, অথচ সেই কুয়াশার মাঝেই তারা দুজন একে অপরের দিকে টান অনুভব করছিল।
কফির কাপের ভেতর থেকে ধোঁয়া উঠছিল ধীরে ধীরে, আর তাদের নীরবতার ভেতর দিয়ে যেন অচেনা সুর বয়ে যাচ্ছিল। সোহিনী হঠাৎ বলল, “জানো, অনলাইনে তোমার সাথে কথা বলার সময় সবকিছু এত সহজ মনে হত… অথচ আজ তোমার সামনে বসে এত কঠিন লাগছে কেন?” অয়ন একটু হাসল, তবে সেই হাসির ভেতর কষ্ট লুকানো ছিল। সে বলল, “হয়তো এটাই বাস্তবের ভার। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় আমরা নিজেদের এমনভাবে মেলে ধরতে পারি, যেভাবে হয়তো আসলে পারি না।” সোহিনী উত্তর দিল না, শুধু তাকিয়ে রইল অয়নের দিকে। তার মনে হচ্ছিল—এই মানুষটি হয়তো সত্যিই তার ভরসা হতে পারে, কিন্তু তার চারপাশের বাস্তব সম্পর্ক, পরিবার, ঋদ্ধি—সবকিছু কি এত সহজে এড়িয়ে যাওয়া যায়? একই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল অয়নের মনেও। সে জানত, তার নিজের চারপাশেও নজরদারির চোখ আছে—অমিতাভ ইতিমধ্যেই তার ভেতরের পরিবর্তন বুঝে ফেলেছে। তবু তাদের চোখে চোখ পড়লে এক ধরনের অদ্ভুত নির্ভরতা কাজ করছিল। কিন্তু ভেতরে ভয়ও ছিল প্রবল—এই সম্পর্ক কি দিনের আলোয় টিকবে, নাকি রাতের ছায়ার মতো মিলিয়ে যাবে?
শেষমেশ তারা চুপচাপ কফি শপ থেকে বেরিয়ে এলো। বাইরে পার্ক স্ট্রিটের আলো ঝলমলে, চারপাশে মানুষজনের ভিড়, তবু তাদের মনে হচ্ছিল পৃথিবীতে যেন তারা ছাড়া আর কেউ নেই। দুজনেই হাঁটছিল পাশাপাশি, কিন্তু মনে হচ্ছিল দূরত্ব এখনো রয়ে গেছে। অয়ন বলতে চাইছিল—“আমি তোমাকে ভালোবাসি”—কিন্তু কথাটা ঠোঁট পর্যন্ত এসে থেমে যাচ্ছিল, কারণ সে ভয় পাচ্ছিল এই স্বীকারোক্তি হয়তো সবকিছু ভেঙে দেবে। সোহিনীরও একই অবস্থা—সে বলতে চাইছিল নিজের মনের সমস্ত সত্যি, অথচ বাস্তবের বেড়াজাল তাকে আটকে রেখেছিল। তাদের ভেতরে দ্বন্দ্ব চলছিল—একদিকে অনলাইনে গড়ে ওঠা সেই স্বপ্নময় সম্পর্ক, অন্যদিকে বাস্তবের কঠিন দায়বদ্ধতা। শেষে সোহিনী শুধু বলল, “চলো, আজ আর কিছু বলি না… সময় আমাদের উত্তর দেবে।” অয়ন মাথা নেড়ে রাজি হল, কিন্তু অন্তরে যেন শূন্যতার গভীর কষ্ট জমে উঠল। দুজনেই জানত—এই মুহূর্তে তারা একে অপরকে হাত ধরে সামনে হাঁটতে পারছে না, কারণ সত্য আর ভয় একসাথে তাদের থামিয়ে রেখেছে। তবু কোথাও একটা আশার আলো জ্বলছিল—হয়তো আগামীকাল তারা আরও সাহসী হবে, আর সত্যিই একে অপরের হাত ধরবে।
_
কফি শপের সেই সন্ধ্যার পর থেকে অয়ন আর সোহিনীর ভেতরে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব চলছিল। নাম-পরিচয়, সমাজ, পরিবার—সবই যেন তাদের টেনে নামিয়ে আনতে চাইছিল এক বাস্তবতার মাটিতে, যেখানে স্বপ্নের জায়গা কম। তবু তাদের মনের গভীরে জমে থাকা অনুভূতির ঢেউকে আর অস্বীকার করা যাচ্ছিল না। সেই রাতে কফি শপ থেকে বেরোনোর পর পার্ক স্ট্রিটের আলো ঝলমলে ভিড়ে হাঁটতে হাঁটতে তারা অনেক কথা বলে। সোহিনীর চোখে তখন দ্বিধা আর ভয়, কিন্তু তার কণ্ঠে ছিল এক অচেনা দৃঢ়তা—“আমরা তো এতদিন ধরে অদৃশ্য হাতে বাঁধা ছিলাম, তাহলে এই একটুকু দেখা কি সবকিছু নষ্ট করে দেবে?” অয়ন কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দেয়, “না, নষ্ট করবে না। আসলে আমি ভয় পাচ্ছিলাম—তুমি যদি আমাকে মেনে নিতে না পারো।” সেই মুহূর্তে দুজনেই বুঝতে পারে, আসলে তাদের সংযোগ ছিল অনুভূতির ভেতরে, নাম বা পরিচয়ের খোলসে নয়।
দিন গড়াতে থাকে, কিন্তু এখন আর তারা কেবল চ্যাট বা রাতের কবিতায় সীমাবদ্ধ থাকে না। দেখা হওয়ার পর তাদের আলাপচারিতা যেন আরও গভীর হয়ে ওঠে। অয়ন সোহিনীকে তার অসম্পূর্ণ গান শোনায়, যে গান এতদিন সে কাউকেই শোনাতে পারেনি। সোহিনী তাকে শোনায় নিজের ডায়েরির সেই পাতাগুলো, যেগুলোতে লিখে রেখেছিল জীবনের একাকীত্ব, হতাশা আর ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষা। প্রতিটি কথোপকথন যেন তাদের আরও কাছাকাছি টেনে আনে। তবে একইসাথে চারপাশের বাস্তবতাও চাপ সৃষ্টি করে। সোহিনীর পরিবারে ঋদ্ধির উপস্থিতি, অয়নের জীবনে অমিতাভের প্রভাব—সবকিছু মিলিয়ে তাদের মধ্যে টানাপোড়েন বাড়ে। তবু তারা ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করে, সত্যিকারের ভালোবাসা মানে সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করার সাহস। একদিন সোহিনী বলে, “আমরা যদি এই অনুভূতিটাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি, তবে নাম-পরিচয়, সামাজিক নিয়ম—এসব কোনোদিনই আমাদের ভালোবাসার চেয়ে বড় হতে পারবে না।” অয়ন কেবল মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়, তার চোখে তখন ঝলমল করছিল ভরসা আর অদৃশ্য আশ্রয়ের ছায়া।
শেষ পর্যন্ত তাদের ভালোবাসা এক নতুন অর্থ খুঁজে নেয়—যেখানে হাত ধরা মানে শুধু চেনা ত্বকের উষ্ণতা নয়, বরং অদৃশ্য এক স্পর্শ, যা ভেতরের আত্মাকে ছুঁয়ে যায়। অয়ন ও সোহিনী উপলব্ধি করে, অনলাইনের সেই “অদৃশ্য হাত” আসলে তাদের সম্পর্কের ভিত্তি তৈরি করেছে—যা ভাঙা যায় না সময়, দূরত্ব বা সন্দেহ দিয়ে। গল্প শেষ হয় এক বিকেলের দৃশ্যে, যখন তারা দুজন নদীর ধারে বসে আছে। আকাশে নীলের ভেতর ডুবে যাওয়া সূর্য আর হাওয়ায় ভেসে আসা গান যেন তাদের ভালোবাসার প্রতীক হয়ে ওঠে। অয়ন ধীরে সোহিনীর হাত ধরে বলে, “তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে সত্যি জিনিস।” সোহিনী চুপচাপ তাকিয়ে থাকে তার চোখে, আর সেই অদৃশ্য হাতের স্পর্শ যেন সত্যি হয়ে ওঠে বাস্তবের ভেতর। তাদের গল্প শেষ হয় না, বরং নতুন শুরু হয়—একটি শুরু যেখানে ভালোবাসা মানে আড়ালে থাকা ভয় নয়, বরং সাহস, সত্য আর আশা।
___




