Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

অদৃশ্য শিকল

Spread the love

সোমা সেন


শহরের ভিড়ভাট্টা আর হট্টগোলের মধ্যে অনন্যার জীবন যেন এক অন্য ছন্দে বাঁধা। সকালবেলায় তার দিন শুরু হয় একেবারে মেশিনের মতো—অ্যালার্মের কর্কশ আওয়াজে ঘুম ভাঙা, দ্রুত শাওয়ার নেওয়া, নিখুঁতভাবে ইস্ত্রি করা শার্ট আর স্কার্ট পরে আয়নার সামনে দাঁড়ানো। সেই আয়নায় প্রতিদিনই ফুটে ওঠে এক সফল নারীর প্রতিচ্ছবি—চোখে হালকা কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিকের টান, আর কাঁধে দামী চামড়ার ব্যাগ। দামী গাড়ির দরজা খুলে যখন সে শহরের ব্যস্ত রাস্তায় নামে, তখন মানুষ তাকে দেখেই ভাবে—এই তো আধুনিক নারীর প্রতীক, সাফল্যের উজ্জ্বল উদাহরণ। বহুজাতিক কোম্পানির উচ্চপদে তার কাজ, মাস শেষে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া মোটা বেতন, আরামদায়ক ফ্ল্যাট—সব মিলিয়ে অনেকের কাছে ঈর্ষার বস্তু। অফিসে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই অনন্যা যেন এক আলাদা চরিত্রে ঢুকে পড়ে। সে জানে কীভাবে মিটিংয়ে দৃঢ়ভাবে কথা বলতে হয়, কীভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, কীভাবে একসাথে টিম সামলাতে হয়। সহকর্মীরা তার উপস্থিতিতে একধরনের আত্মবিশ্বাস পায়, আর বসেরা ভাবে—এই মেয়ে একদিন খুব বড় জায়গায় পৌঁছবে। কর্পোরেট জীবনের মঞ্চে অনন্যা যেন সর্বদা আলোয় আলোকিত, সর্বদা প্রমাণ করে চলেছে যে সে যোগ্য, সে পারবে।

কিন্তু এই আলো ঝলমলে মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ভিন্ন অনন্যা, যার কণ্ঠস্বর বাইরে কেউ শোনে না। দিনের শেষে যখন অফিস থেকে ক্লান্ত শরীরে সে নিজের ফ্ল্যাটে ফেরে, তখন চারদেয়ালের নিঃসঙ্গতা তাকে আঘাত করে। নীরব ঘর, খালি রান্নাঘর, ফ্রিজে রেখে দেওয়া আগের দিনের খাবার—সব মিলিয়ে যেন জীবনের এক অদৃশ্য শুন্যতা তাকে গ্রাস করে। অথচ বাইরের পৃথিবী ভাবে তার সব আছে, আর কোনো কিছুর অভাব নেই। কিন্তু সত্যি হলো, সাফল্যের এই চকচকে আড়ালে সে এক অদ্ভুত শূন্যতায় ভুগছে, যা ক্রমশ তার ভেতরটাকে খালি করে দিচ্ছে। তবে সবথেকে কষ্টকর হয় তখন, যখন সে নিজের পরিবারে ফিরে যায়। বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন কিংবা প্রতিবেশীরা সবাই একসুরে বলে ওঠে—“কাজ করছো ভালো কথা, কিন্তু সংসারই তো নারীর আসল পরিচয়। এখনো বিয়ে করলে দেরি হয়নি।” তাদের কথায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তার এই চাকরি, সম্মান কিংবা আর্থিক সচ্ছলতা তাদের কাছে কোনো বড় অর্জন নয়। তাদের চোখে অনন্যা কেবল ‘অসম্পূর্ণ’, কারণ তার জীবনসঙ্গী নেই, সংসার নেই, সন্তান নেই। যতবার সে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে চায়, ততবার এই কথাগুলোই তাকে আঘাত করে। যেন বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হয়—তুমি যতই সাফল্য পাও না কেন, সমাজের চোখে তুমি সম্পূর্ণ নও।

অনন্যার ভেতরে তখন এক অদৃশ্য দ্বন্দ্ব শুরু হয়। বাইরে সে যতোই দৃঢ় আর আত্মবিশ্বাসী হোক, ভেতরে ভেতরে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে এই অনবরত তুলনা আর প্রশ্নে। কেন তার অর্জনগুলো কেউ মূল্য দেয় না? কেন সে নিজের স্বপ্ন পূরণ করেও অপরাধবোধে ভোগে? মায়ের মুখের অনুযোগ, বাবার নিরুত্তাপ নীরবতা, আত্মীয়দের ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি—সব মিলিয়ে সে বুঝতে পারে, তার ব্যক্তিগত সাফল্য আসলে সমাজের কাছে কিছুই না। আর এই অবহেলার বোঝাই তার আসল কষ্ট। কর্পোরেট জগতে অনন্যা যতটা দৃঢ়, সংসারের প্রশ্নে ততটাই ভঙ্গুর। রাতের বেলা অফিসের ফাইল বন্ধ করে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সে প্রায়ই ভাবে—তার জীবনের কোনটা আসল? বাইরের পৃথিবীর সেই সফল অনন্যা, নাকি ভেতরের সেই একলা, চাপা কষ্টে ভরা মানুষটি? এই প্রশ্নের উত্তর সে খুঁজে পায় না। কিন্তু জানে, একদিন হয়তো তাকে ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে—সে কি সাফল্যের পথে এগিয়ে যাবে, না সমাজের তৈরি বাঁধা নিয়ম মানতে গিয়ে নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন দেবে। আপাতত সে দুই জগতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে, নিজের পরিচয় খুঁজে বেড়াচ্ছে। আর এই দ্বন্দ্বই তার গল্পের সূচনা, যেখানে সাফল্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে গভীর চাপা কষ্ট।

প্রতিবার যখন অনন্যা বাড়ি ফেরে, তাকে স্বাগত জানায় না গর্বের দৃষ্টি, বরং নীরব অভিযোগের ছায়া। মা যেন সবসময় তৈরি হয়ে থাকেন একই কথাগুলো বলার জন্য—“তোর বয়স তো কম হলো না, এখনো বিয়ে করলি না কেন? এইসব চাকরি-টাকরি কতদিন থাকবে? কাল যদি অসুস্থ হয়ে পড়িস, কে দেখবে?” এই কথাগুলো শুনতে শুনতে অনন্যার কানে যেন একঘেয়ে ঘণ্টাধ্বনির মতো বাজতে থাকে। আত্মীয়রা এলে আরও স্পষ্ট হয় সেই চাপা দৃষ্টিভঙ্গি। কারও গলায় ব্যঙ্গ, কারও গলায় পরামর্শ, আবার কারও চোখে করুণা। তাদের সবার বক্তব্য একটাই—নারীর আসল পরিচয় তার সংসারে, তার সন্তানে। কর্পোরেট অফিসে সে যতই উচ্চপদে আসীন হোক না কেন, সমাজের দৃষ্টিতে তা কোনো পরিচয় গড়ে তুলতে পারে না। অথচ অফিসে প্রতিদিনই তার চারপাশের সহকর্মীরা তাকে অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখে, তার সিদ্ধান্তকে সম্মান করে। কেউ তার মতো হতে চায়, কেউ আবার তার কাছ থেকে শেখে। এই দুই পৃথিবীর মধ্যে বিরাট ফারাক—একদিকে সম্মান, অন্যদিকে অবমূল্যায়ন। এর মাঝখানে দাঁড়িয়ে অনন্যা যেন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়ে, যেন এক অদৃশ্য শিকল তাকে জড়িয়ে ধরেছে, যার থেকে সে যতই পালাতে চায়, মুক্তি মেলে না।

এই অদৃশ্য শিকলের সবচেয়ে বড় আঘাত আসে যখন তার পরিবার তার প্রতিটি অর্জনকেও খাটো করে ফেলে। মা প্রায়ই বলেন—“টাকা-পয়সা রোজগার করলে কী হবে? রাতবিরেতে ফিরিস, রান্নাঘরে কিচ্ছু জানিস না, সংসার চালাতে পারবি কী করে?” আত্মীয়রা তার ফ্ল্যাট, গাড়ি কিংবা বিদেশযাত্রার গল্প শুনলেও শেষে এসে হাসাহাসি করে বলে ওঠে—“এই সব জিনিস দিয়ে কি সংসার টিকে থাকে? বয়স তো বাড়ছে, তাড়াতাড়ি দেখেশুনে একটা ছেলেকে বিয়ে কর।” অনন্যা চুপচাপ শুনে যায়, কখনও প্রতিবাদ করতে চায়, আবার কখনও মনে হয় প্রতিবাদ করে লাভ নেই। কারণ, এই সমাজে একজন নারীর সাফল্য কত বড়ই হোক না কেন, তার মূল্যায়নের মাপকাঠি নির্ধারিত হয় শুধুই সংসারের পরিমাপে। এ যেন এমন এক মানসিক চাপ, যা দিনের পর দিন তার আত্মবিশ্বাসকে খেয়ে নিচ্ছে। অফিসে প্রতিদিন মিটিংয়ে দৃঢ় কণ্ঠে যে মেয়ে কথা বলে, রাতে বাড়িতে ফিরে একই মেয়ে এক অদ্ভুত অপরাধবোধে ভুগতে থাকে—সে কি সত্যিই ব্যর্থ? তার এত সাফল্য, এত পরিশ্রম, এত অর্জন—সব কি আসলে বৃথা? নিজের ভেতরে ভেতরে অনন্যা বুঝতে পারে, এই মানসিক চাপই হলো সেই অদৃশ্য শিকল, যা তার স্বাধীনতাকে, তার আত্মপরিচয়কে বেঁধে রেখেছে।

এই শিকল ভাঙার সাহস অনন্যার নেই, আবার মেনে নেওয়ার শক্তিও নেই। তাই প্রতিদিন সে যেন দুটি আলাদা পৃথিবীতে বেঁচে থাকে। দিনের বেলায় অফিসে অনন্যা এক শক্তিশালী নারী, যিনি সহকর্মীদের চোখে উদাহরণ; কিন্তু রাতে পরিবারের মধ্যে সে হয়ে যায় অপরিণত, অসম্পূর্ণ এক মানুষ, যাকে বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে সে ব্যর্থ। এই দ্বন্দ্বই তার জীবনের সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা। মাঝেমধ্যে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে সে ভাবে, সমাজের চোখে নারীর সাফল্যের সংজ্ঞা এত সংকীর্ণ কেন? কেন একজন নারী নিজের স্বপ্ন পূরণ করেও অসম্পূর্ণ বলে গণ্য হবে? তার মনে হয়, এ শুধু তার একার কষ্ট নয়, বরং অসংখ্য মেয়ের গল্প, যাদের অদৃশ্য শিকলে বেঁধে রাখা হয় সংসারের ছাঁচে। কিন্তু তবুও, গভীরে কোথাও এক অদম্য ইচ্ছে কাজ করে—একদিন সে প্রমাণ করবে, নারীর পরিচয় শুধুই সংসার নয়। তবে সেই দিন আসা পর্যন্ত অনন্যাকে বয়ে বেড়াতে হবে এই অদৃশ্য শিকল, যা তাকে শ্বাসরুদ্ধ করলেও লড়াই করার তাগিদও জাগিয়ে রাখে।

রাত তখন প্রায় তিনটে বাজে। অফিসের ফাইলের স্তুপ শেষ করে যখন অনন্যা ল্যাপটপ বন্ধ করল, তখন তার চোখ লাল হয়ে উঠেছে, মাথায় একধরনের ভার জমেছে। বাইরে শহর ঘুমিয়ে আছে, কিন্তু তার ঘরের আলো তখনও জ্বলছে, যেন সেই আলোও তার একাকীত্বের সাক্ষী। সে জানে আগামী সকালেও তাকে আবার ভোরে উঠে নতুন লড়াই শুরু করতে হবে—অফিসের টার্গেট, মিটিং, ক্লায়েন্টদের সঙ্গে অসংখ্য কথোপকথন। কিন্তু দিনের শেষে যখন পরিবারের একটি মাত্র কথা তার কানে বাজে—“তুই অসম্পূর্ণ, সংসার ছাড়া জীবনে কোনো মানে নেই”—তখনই তার ভেতরটা ভেঙে যায়। এত পরিশ্রম, এত অর্জন, তবুও সমাজের চোখে সে অপূর্ণ? সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখের দিকে তাকায়, যেন উত্তর খুঁজে বেড়ায়—সে কি সত্যিই অপূর্ণ, নাকি শুধু সমাজের তৈরি নিয়মেই সে অপূর্ণ হয়ে পড়ছে? এই প্রশ্ন যেন তাকে প্রতি রাতে তাড়া করে ফেরে, আর সেই তাড়নার ভেতরেই জন্ম নেয় তার গভীর ভিতরের লড়াই।

এই লড়াইকে সামলাতে গিয়েই অনন্যা একদিন ডায়েরি লেখা শুরু করল। প্রথমে সে ভেবেছিল কেবল নিজের মনের ভার লাঘবের জন্য দু-একটা লাইন লিখবে, কিন্তু ধীরে ধীরে সেটাই হয়ে উঠল তার অন্তরের আয়না। ডায়েরির পাতায় সে অকপটে লিখে ফেলে তার চাপা কষ্ট, আঘাত পাওয়া স্বপ্ন, আর নিঃশব্দ কান্না। সেখানে সে লিখে রাখে অফিসে সহকর্মীদের প্রশংসার কথা, আবার লিখে রাখে মায়ের মুখের অভিযোগ, আত্মীয়দের খোঁচা আর সমাজের চাপা দৃষ্টির কাহিনি। একেকটি বাক্যে যেন ফেটে পড়ে তার দ্বন্দ্ব—“আমি কি সত্যিই অসম্পূর্ণ? আমার স্বপ্ন পূরণ করা কি অপরাধ? কেন একজন নারীকে সবসময় সংসারের মাপে মাপা হবে?” ডায়েরি লেখার সময় তার কলম কখনো থেমে যায়, কখনো দ্রুত ছুটে চলে যেন বুকের ভেতর জমে থাকা সব প্রশ্ন একসাথে ছুটে বেরিয়ে আসতে চায়। এই লেখা যেন তার কাছে আত্মমুক্তির পথ হয়ে দাঁড়াল—কেউ তাকে না বুঝলেও, ডায়েরির পাতাগুলো নিরবে শুনে নেয় তার প্রতিটি কান্না, প্রতিটি প্রশ্ন।

তবে এই ডায়েরিই তাকে আবার নতুন করে ভেতরের শক্তি খুঁজে নিতে সাহায্য করে। প্রতিটি পাতায় লেখা শব্দ যেন তাকে আয়নার মতো দেখায়—সে আসলে কতটা লড়াই করছে, কতটা সাহস নিয়ে বেঁচে আছে। বাইরের পৃথিবী তাকে যতই অসম্পূর্ণ বলে দিক, তার নিজের চোখে সে তো এক যোদ্ধা, যে নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য দিনরাত খেটে চলেছে। তবুও লড়াই থেমে নেই—ভেতরের কণ্ঠস্বর বারবার বলে ওঠে, “হয়তো আমি ভুল করছি, হয়তো তারা ঠিক বলছে।” আবার আরেক কণ্ঠস্বর জোরে চিৎকার করে ওঠে, “না, আমি ঠিক, আমি নিজের পথে হাঁটছি।” এই দ্বন্দ্বই তার প্রতিটি রাতের সঙ্গী হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রতিটি লেখা শেষ করার পর তার মনে হয়, সে এক পা করে মুক্তির দিকে এগোচ্ছে। হয়তো সমাজ এখনো তাকে বুঝবে না, কিন্তু অন্তত সে নিজেকে বোঝার পথে হাঁটছে। এই ডায়েরি তার আত্মার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠল, আর সেই প্রতিচ্ছবির ভেতরেই স্পষ্ট হলো—ভেতরের লড়াই শেষ হয়নি, বরং এখনই শুরু।

সেদিন ছিল এক বিশেষ দিন, যখন অনন্যাকে তার অফিস থেকে পাঠানো হয়েছিল একটি সেমিনারে যোগ দিতে। শহরের এক বড় কনভেনশন সেন্টারে আয়োজিত সেই সেমিনারের বিষয় ছিল—“আধুনিক কর্মজীবী নারী: সাফল্যের পথ ও সামাজিক বাঁধা।” চারদিক আলোয় ঝলমল, ভেতরে ভিড় ঠাসা চেয়ার, আর মঞ্চে মাইক্রোফোনের সামনে একের পর এক বক্তা তাদের মতামত রাখছিলেন। প্রথমে অনন্যা ভেবেছিল, এটা কেবল আরেকটা আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠান, যেখানে সবাই একসাথে কিছু তত্ত্বকথা বলে চলে যাবে। কিন্তু তখনই মঞ্চে উঠলেন অদিতি—একজন সমাজকর্মী, যিনি বছরের পর বছর ধরে নারীর স্বাধীনতা, শিক্ষা ও আত্মনির্ভরতার জন্য কাজ করছেন। অদিতির কণ্ঠে ছিল এক অদ্ভুত দৃঢ়তা, তার চোখে ছিল এক ঝলকানো আগুন। তিনি নিজের গল্প বলতে শুরু করলেন—কীভাবে তিনি ছোটবেলায় সংসারের চাপে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বসেছিলেন, কীভাবে চারপাশ থেকে শুনেছিলেন “নারীর আসল জায়গা রান্নাঘরে,” আর কীভাবে সেই একই কথাগুলো একদিন তাকে ভেতরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। তিনি সাহস করে ঘর ছেড়েছিলেন, লড়াই করেছিলেন, আর আজ সেই লড়াইয়ের ফলেই অসংখ্য নারী নতুন করে বাঁচার সাহস পাচ্ছে। অনন্যা ভিড়ের মধ্যে বসে ছিল, কিন্তু তার মনে হচ্ছিল, যেন প্রতিটি কথা শুধু তার উদ্দেশ্যেই বলা হচ্ছে।

অদিতির কণ্ঠে অনন্যা খুঁজে পেল সেই অচেনা শক্তি, যা এতদিন তার ভেতরে ঘুমিয়ে ছিল। তিনি বলছিলেন—“নিজের সুখ খোঁজা মানে পরিবারের অসম্মান নয়। বরং একজন নারী যদি নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে, তাহলে সে নিজের পরিবারকেও নতুন আলো দেখাতে পারে।” এই কথাগুলো অনন্যার বুকের ভেতর কাঁপন ধরিয়ে দিল। এতদিন সে ভেবেছিল, নিজের ইচ্ছাকে বাঁচানো মানেই হয়তো স্বার্থপর হওয়া, হয়তো পরিবারের বিরুদ্ধে যাওয়া। কিন্তু অদিতি প্রমাণ করলেন—এটা কোনো বিদ্রোহ নয়, বরং নিজের অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া। অনন্যা ভিড়ের মধ্যে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ অনুভব করল, সে একা নয়। তার মতো অসংখ্য নারী প্রতিদিন লড়ছে একই শিকলের বিরুদ্ধে। কারও লড়াই প্রকাশ্যে, কারও লড়াই নিঃশব্দে। আর অদিতির মতো মানুষরাই তাদের দেখাচ্ছে এক ভিন্ন পথ—যেখানে নারীর পরিচয় কেবল সংসারে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সে নিজেও একটি পূর্ণাঙ্গ সত্তা।

সেমিনার শেষে যখন অনন্যার সঙ্গে অদিতির আলাপ হলো, তখন সেই কথোপকথন যেন তার ভেতরের অন্ধকারে আলো জ্বালিয়ে দিল। অদিতি হাসিমুখে বললেন, “তুমি জানো, নিজের প্রতি দায়বদ্ধতা সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। যদি তুমি নিজেকে খুশি না রাখতে পারো, তবে কাউকেই খুশি রাখতে পারবে না।” এই সরল কথাগুলো অনন্যার কাছে একেবারে নতুন দিশা হয়ে এলো। সেদিন রাতে বাড়ি ফিরে অনন্যা ডায়েরি খুলে লিখল—“আজ মনে হলো আমি একা নই। আমি যদি নিজের স্বপ্নকে স্বীকৃতি দিই, তবে সেটাই হবে আমার আসল সাফল্য।” তার মনে হলো, সমাজ যতই বাঁধা দিক, এই অচেনা কণ্ঠস্বর তাকে পথ দেখাতে শুরু করেছে। হয়তো সে এখনো পুরোপুরি মুক্ত নয়, হয়তো শিকল এখনো আছে, কিন্তু ভেতরে কোথাও জন্ম নিচ্ছে এক নতুন সাহস, যা একদিন তাকে মুক্তি দেবে। অদিতির গল্প শুধু তার মনকে ছুঁয়ে যায়নি, বরং তার ভেতরে গড়ে তুলেছে এক নতুন উপলব্ধি—নিজের অস্তিত্বকেই স্বীকৃতি দেওয়া হলো জীবনের প্রথম সোপান।

বাড়ির ড্রয়িংরুমে সেই সন্ধ্যায় বাতাস যেন আরও ভারী হয়ে উঠেছিল। অনন্যার মা কথাটা সরাসরি বলে ফেললেন—“এই চাকরি-টাকরি অনেক হয়েছে, এখন তোকে সংসার করতে হবে। তুই যদি এখনই ঠিক না করিস, কালকে দেরি হয়ে যাবে।” বাবাও নীরব গলায় যোগ করলেন, “মেয়েদের আসল নিরাপত্তা চাকরিতে নয়, সংসারে। যতই উপার্জন করিস, একদিন বুঝবি একা জীবন কোনো জীবন নয়।” এই কথাগুলো শোনার মুহূর্তে অনন্যার বুকের ভেতর যেন বিদ্রোহ ফেটে উঠল। এত বছর ধরে নিজের রক্ত-ঘাম দিয়ে যে জায়গায় পৌঁছেছে, সেখানে দাঁড়িয়ে কেন তাকে হঠাৎ করে থামতে হবে? কেন তার স্বপ্নকে বিসর্জন দিতে হবে? সে প্রতিবাদ করে উঠতে চাইলো, কিন্তু বাবা-মায়ের চোখে একধরনের আঘাত আর হতাশার ছায়া দেখে তার গলা শুকিয়ে গেল। পরিবারের প্রতি ভালোবাসা তাকে টেনে ধরে, অথচ নিজের স্বপ্নের প্রতি দায়বদ্ধতা তাকে ছাড়তে দেয় না। এই দ্বন্দ্বই তাকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়।

রাতে একা ঘরে ফিরে সে আবারও ডায়েরি খুলে বসে। কলম যেন আর হাতের মধ্যে থাকতে চায় না, কিন্তু বুকের ভেতরের চাপা কান্না তাকে লিখতে বাধ্য করে। সে লিখল—“আমি কি এতটাই স্বার্থপর, যে নিজের সুখের জন্য বাবা-মায়ের ইচ্ছেকে উপেক্ষা করব? নাকি আমি এতটাই দুর্বল, যে নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে তাদের খুশি রাখব?” এই প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর নেই, শুধু আছে এক অজানা যন্ত্রণা। সে জানে, ভালোবাসার মানুষদের কষ্ট দিয়ে কোনো স্বপ্ন পূর্ণ হয় না। আবার এটাও জানে, নিজের স্বপ্ন মেরে ফেলে শুধু সমাজের চোখে খুশি থাকার চেষ্টা করলে সে ভেতরে ভেতরে মরে যাবে। অদিতির কণ্ঠস্বর তার কানে বাজে—“নিজের প্রতি দায়বদ্ধতা সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।” কিন্তু বাস্তবে দাঁড়িয়ে সেই দায়বদ্ধতাকে মেনে নেওয়া এত সহজ নয়। শিকল যেন আরও আঁটসাঁট হয়ে তার নিঃশ্বাস চেপে ধরে।

ঠিক এই সময়েই অফিস থেকে আসে এক অভাবনীয় খবর। তাকে জানানো হলো, তার দায়িত্ববোধ, পরিশ্রম আর নেতৃত্বগুণের জন্য কোম্পানি তাকে বড় একটি প্রোমোশনের জন্য মনোনীত করেছে। এর মানে হলো আরও উচ্চ পদ, আরও দায়িত্ব, আর্থিক স্বচ্ছলতা, আর সবচেয়ে বড় কথা—নিজেকে প্রমাণ করার এক নতুন সুযোগ। খবরটা শুনে সহকর্মীরা তাকে অভিনন্দন জানাল, সবাই তার অর্জনে গর্বিত হলো। কিন্তু অনন্যার মনে তখন তীব্র ঝড় বইছে। পরিবারের চাপ একদিকে তাকে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পথে ঠেলে দিচ্ছে, আর অন্যদিকে সামনে এসেছে জীবনের সবচেয়ে বড় সুযোগ। দুই দিকের টানাপোড়েনে সে বুঝতে পারছে না, কোন পথে হাঁটবে। ভাঙনের এই মুহূর্তে তার ভেতরের লড়াই যেন চূড়ান্ত আকার নেয়—সে কি পরিবারের ইচ্ছের কাছে মাথা নত করবে, না নিজের স্বপ্নকে বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত লড়াই করবে? এই দ্বিধাই তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা হয়ে দাঁড়াল।

প্রোমোশনের খবরটা অনন্যার কাছে আশীর্বাদের মতো আসলেও পরিবারের চোখে সেটা ছিল আরও বড় বিপদের সংকেত। মা সোজাসাপ্টা বললেন, “এই প্রোমোশন মানেই তোকে আরও রাত জেগে কাজ করতে হবে, সংসার করার সময় তোকে আর কখনোই পাওয়া যাবে না। তুই কি তাহলে আজীবন একাই থাকতে চাইছিস?” বাবার কণ্ঠ ছিল আরও কঠিন—“চাকরি তো সব মেয়েই করে, কিন্তু সংসার করার সাহস কজনের আছে? এখনো সময় আছে, না হলে পরে আফসোস করতে হবে।” অনন্যা চুপ করে শুনছিল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার শরীর আগুনের মতো জ্বলে উঠছিল। এত পরিশ্রমের পর যে সুযোগটা তার সামনে এসেছে, তা যদি হারিয়ে ফেলে, তবে সে নিজেকে আর কখনো ক্ষমা করতে পারবে না। অথচ পরিবারের চাহিদাকে উপেক্ষা করলে তাদের ভালোবাসা, আশীর্বাদ সবকিছু হারিয়ে ফেলবে—এই ভয়ও তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। সে বুঝতে পারছিল, এই মুহূর্তে যেদিকেই সে পা বাড়াক, কোনো না কোনো কিছু ভেঙে যাবে।

সেদিন রাতে বিছানায় শুয়েও তার চোখে ঘুম এল না। বারবার মনে হচ্ছিল, যেন সে দুটি অগ্নিকুণ্ডের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে প্রোমোশনের আগুন—যা তার স্বপ্ন পূরণের উজ্জ্বল আলো জ্বালাতে পারে, অন্যদিকে সংসারের আগুন—যা তার ভেতরের সব আকাঙ্ক্ষাকে পুড়িয়ে দিতে পারে। এ যেন এমন এক দ্বন্দ্ব, যেখানে জয়-পরাজয় দুটোই একইসাথে বিদ্যমান। অনন্যা জানালার ধারে বসে শহরের আলো-ঝলমল রাতের দিকে তাকিয়ে রইল। নিচে গাড়ির হেডলাইট একটার পর একটা ছুটে যাচ্ছে, যেন সবাই জানে তাদের গন্তব্য কোথায়। অথচ সে নিজেই নিজের গন্তব্য নিয়ে অনিশ্চিত। কলম হাতে ডায়েরি খুললেও আজ কোনো শব্দ বের হলো না। শুধু ভেতরে ভেতরে এক অদ্ভুত যন্ত্রণা যেন তাকে গ্রাস করতে লাগল। তার মনে হচ্ছিল, মাথার ভেতর দুটো কণ্ঠস্বর একে অপরকে ধাক্কা মারছে—একটা কণ্ঠ বলছে, “প্রোমোশন নাও, এটাই তোমার জীবন,” আরেকটা কণ্ঠ বলছে, “পরিবারকে হারিয়ে দিলে কিছুই টিকবে না।”

ভোর হতে না হতেই অনন্যা বুঝতে পারল, সারারাত সে যেন আগুনে পুড়ে গেছে। চোখে ক্লান্তি, শরীরে অবসাদ, তবুও তার ভেতরের আগুন নিভল না। পরিবার তাকে চরম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করছে, অথচ তার হৃদয় চাইছে নিজের স্বপ্নের পথে এগোতে। এই টানাপোড়েনে সে বুঝতে পারছিল, আর বেশিদিন এভাবে টিকে থাকা সম্ভব নয়। তাকে হয়তো শিগগিরই কোনো এক সিদ্ধান্ত নিতে হবে—যেটা হয়তো তার জীবনকে চিরদিনের জন্য বদলে দেবে। কিন্তু কোনটা বেছে নেবে? এই প্রশ্নের উত্তর এখনো অন্ধকারেই ঢাকা। শুধু এতটুকুই স্পষ্ট, তার ভেতরের দ্বন্দ্ব এখন আগুন হয়ে জ্বলে উঠেছে, আর সেই আগুনের শিখায় সে ক্রমশ ভস্মীভূত হতে শুরু করেছে।

একটা সকাল যেন অন্যরকম হয়ে এল অনন্যার জীবনে। রাতভর চিন্তার পর তার ভেতরে জমে থাকা দ্বিধা যেন ধীরে ধীরে সরে গেল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে প্রথমবার নিজেকে অন্যভাবে দেখল—একজন ক্লান্ত নারী নয়, বরং এক যোদ্ধা, যে এতদিন সমাজের বাঁধা আর পরিবারের চাপের কাছে নতজানু হয়ে থেকেছে। অদিতির কথাগুলো বারবার কানে বাজছিল—“নারীর আসল দায়িত্ব হলো নিজের স্বপ্ন বাঁচানো।” এই কথাটাই যেন আজ নতুন অর্থ পেল তার কাছে। সে বুঝল, নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়ে পরিবারকে খুশি রাখলে হয়তো কিছুদিন শান্তি মিলবে, কিন্তু তার ভেতরের আগুন নিভে যাবে না, বরং তাকে ছাই করে দেবে। তাই এবার সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সে ডায়েরির পাতায় লিখল—“আজ আমি নিজের মুক্তির চাবি খুঁজে পেলাম। এই চাবি দিয়ে আমি সমাজের বাঁধা ভাঙব, নিজের পথ খুলব।”

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে সে শান্ত গলায় মায়ের সঙ্গে কথা শুরু করল। “মা, আমি জানি তুমি চাইছো আমি সংসার করি। তোমাদের স্বপ্নও আমি জানি। কিন্তু আমি যদি নিজের স্বপ্ন বাঁচাতে না পারি, তবে কোনো সংসারই আমাকে সুখী করতে পারবে না। আমি আমার প্রোমোশন গ্রহণ করব।” মায়ের মুখ শক্ত হয়ে উঠল, চোখে জল জমল, আর বাবা নীরবে তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। অনন্যা থামল না, সে দৃঢ় গলায় বলল—“সংসার মানেই জীবন নয়। একজন নারীও নিজের কর্মজীবন, নিজের সুখ বেছে নিতে পারে। আমি যদি নিজের স্বপ্ন পূরণ করি, তবে সেটাই আমার কাছে সত্যিকারের সংসার—যেখানে আমি নিজেকে খুঁজে পাই, হারাই না।” মুহূর্তটা ছিল অগ্নিপরীক্ষার মতো। পরিবার হয়তো প্রথমবার তার মুখ থেকে এমন দৃঢ়তা শুনল। তাদের চেহারায় ছিল বিস্ময়, অভিমান, আর অজানা ভয়, কিন্তু অনন্যা বুঝল—আজ সে নিজের পরিচয়কে নতুন করে ঘোষণা করল।

রাতের শেষে সে এক অদ্ভুত শান্তি খুঁজে পেল। অনেক দিন পর তার ভেতরের কণ্ঠস্বর একমত হলো—সে ভুল করছে না। মুক্তির চাবি তার হাতেই আছে, আর সেই চাবি দিয়ে সে নিজের ভবিষ্যতের দরজা খুলছে। হয়তো পরিবার একদিন তাকে বুঝবে, হয়তো সমাজের চোখে সে এখনো অসম্পূর্ণ থাকবে, কিন্তু সে জানে—নিজের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার মধ্যেই তার সম্পূর্ণতা। জানালার বাইরে আকাশে চাঁদ উঠেছিল, নরম আলো ঘরে ছড়িয়ে পড়ছিল, যেন প্রকৃতিও তাকে আশীর্বাদ জানাচ্ছে। সে বুঝল, মুক্তি মানে কারও বিরুদ্ধে যাওয়া নয়, বরং নিজের ভেতরের শিকল ভেঙে সামনে এগোনো। আর সেই মুক্তিই হলো তার জীবনের আসল জয়।

অধ্যায় ৮ – অদৃশ্য শিকল ভাঙা

প্রথম কয়েকটা সপ্তাহ অনন্যার জন্য সহজ ছিল না। সে জানত, নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানে হলো পরিবার ও সমাজের বিরোধিতা বরণ করা। ঘরে মা অনেকদিন কথা বলেননি, বাবা শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন, আর আত্মীয়রা ফোনে নানা উপদেশ দিতে থাকত—“মেয়ে মানুষের এত একগুঁয়েমি ভালো নয়”, “বিয়ে ছাড়া মেয়েদের ভবিষ্যৎ হয় না”, “কর্মজীবন তো সংসার সামলে করাও যায়”। সব কথা শুনতে হতো তাকে, কিন্তু এবার সে আর ভেতরে ভেঙে পড়ল না। বরং প্রত্যেকটা সমালোচনা যেন তার দৃঢ়তাকে আরও শক্ত করল। অফিসে প্রোমোশন পাওয়ার পর তার দায়িত্ব বেড়ে গেল, কাজের চাপও বাড়ল, কিন্তু সে নিজের ভেতরের শক্তি দিয়ে সব সামলাতে লাগল। মাঝে মাঝে ক্লান্তি এলে সে মনে করত অদিতির সেই কথাগুলো, আর মনে হতো—হ্যাঁ, আমি সঠিক পথেই হাঁটছি। নিজের স্বপ্নের সঙ্গে আপস করলে আমি হয়তো কারও কাছে ভালো মেয়ে বা ভালো কন্যা হতে পারি, কিন্তু নিজের কাছে আমি হারিয়ে যেতাম। এখন অন্তত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখের দিকে তাকালে আমি নিজেকে চিনতে পারি।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের মনোভাবেও পরিবর্তন এলো। একদিন বাবা চুপচাপ তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “তুই যদি সত্যিই খুশি থাকিস, তবে সেটাই আমাদের জন্য যথেষ্ট।” সেই মুহূর্তে অনন্যার চোখ ভিজে উঠল। মা-ও ধীরে ধীরে তার সাফল্যকে স্বীকার করতে শিখলেন। আত্মীয়দের অনেকেই এখনও নানা মন্তব্য করত, কিন্তু মা আর তাদের কথায় কান দিতেন না। একদিন পাড়ার এক কাকিমা এসে বললেন, “তোমার মেয়ে তো বেশ সাহসী, আমরা তো ভাবতাম সংসার ছাড়া মেয়েদের কিছু হয় না।” মা প্রথমবার গর্বিত গলায় জবাব দিলেন, “আমার মেয়ে সংসার করছে, তবে নিজের সঙ্গে। সেই সংসারও কম নয়।” এই কথাটা শুনে অনন্যা বুঝল, অদৃশ্য শিকল শুধু সে-ই ভাঙেনি, বরং তার ভাঙা শিকলের শব্দ অন্যদের মনেও পৌঁছে গেছে। ধীরে ধীরে তার পরিবারও শিখল—সংসার মানে শুধু চার দেওয়ালের ভেতরে আটকে থাকা নয়, বরং সেই জায়গা যেখানে একজন নারী স্বাধীনভাবে নিজের স্বপ্ন বাঁচাতে পারে।

অনন্যা ধীরে ধীরে সমাজের অন্য নারীদের কাছেও এক অনুপ্রেরণা হয়ে উঠল। অফিসে জুনিয়র মেয়েরা তার কাছে এসে বলত, “দিদি, আপনি যদি এত কিছু সামলাতে পারেন, তবে আমরাও পারব।” আশেপাশের মেয়েরা তার গল্প শুনে নতুন করে সাহস পেত। সে যেন এক নিঃশব্দ বিপ্লবের প্রতীক হয়ে উঠল। অনেক দিন ধরে যে অদৃশ্য শিকল মেয়েদের বেঁধে রেখেছিল—‘নারীর আসল দায়িত্ব সংসার’, ‘নারী মানেই ত্যাগ’—সেই শিকল অনন্যা ভেঙে দিল। সে প্রমাণ করল, নারী নিজের স্বাধীনতাকে বাঁচিয়ে রাখলে কেবল নিজের জীবন নয়, অন্যদের জীবনও আলোকিত হয়। শেষ রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে মনে মনে বলল, “আমি জেনেছি মুক্তির স্বাদ কেমন। এই মুক্তিই আমার আসল জয়। আর এই মুক্তিই হবে আগামী প্রজন্মের উত্তরাধিকার।” চাঁদের আলোয় ভেসে থাকা সেই রাত যেন সাক্ষী হয়ে রইল—একজন নারী যখন নিজের শিকল ভাঙে, তখন শুধু সে নয়, পুরো সমাজ এক ধাপ এগিয়ে যায়।

***

1000069361.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *