ঋত্বিক গাঙ্গুলি
পর্ব ১ : অচেনা শহর
স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো একে একে ট্রেনে উঠছে। ভোরের অন্ধকার তখনও কেটে যায়নি, দূরের আকাশে একটা অর্ধচন্দ্র ম্লান আলো ছড়াচ্ছে। শহরের নাম—চন্দ্রপুর। বেশ বড় নয়, আবার একেবারেই ছোটও নয়। মফস্বল আর শহুরে জীবনের মাঝামাঝি এক টানটান অবস্থান। এ শহরে হঠাৎ এসেছিল অর্ণব দত্ত—চোখে কালো চশমা, পরনে জিন্স আর ফেডেড জ্যাকেট। লম্বা, চওড়া কাঁধ, হাঁটার ভঙ্গিতে সেনা-শৃঙ্খলার আভাস। সে ছিল একসময় আর্মির মিলিটারি পুলিশ। এখন ঘুরে বেড়ানোই তার কাজ। কোথাও গন্তব্য নেই, কোথাও থাকার বাধ্যবাধকতা নেই।
চন্দ্রপুরে নামার সিদ্ধান্তটা ছিল সম্পূর্ণ হঠাৎ। ট্রেনটা থামলো, আর সে নেমে গেল। চারপাশের মানুষরা তার দিকে তাকালো, কিন্তু দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নিল। সে হাঁটতে লাগলো শহরের দিকে। মাথার ভেতর অদ্ভুত শান্তি, তবু চোখদুটি সবসময় সতর্ক। অভ্যাস, বছরের পর বছর টিকে থাকার অভ্যাস।
বাসস্ট্যান্ডের কাছে একটা ছোট চায়ের দোকানে ঢুকল সে। দোকানদার, বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, মুখে খয়েরি দাগ, অবাক হয়ে তাকালো।
—“নতুন নাকি? আগে দেখিনি।”
অর্ণব হেসে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, একটু ঘুরতে এসেছি।”
চা এগিয়ে দিতে দিতে দোকানদার বলল, “এই শহরে ঘুরতে আসার লোক খুব কম। যারা আসে, তাদের অন্য কোনো কারণ থাকে।”
অর্ণব ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “হতে পারে।”
কথা শেষ হতেই দোকানের বাইরে একটা হট্টগোল। দু’জন লোক একজনকে ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। লোকটা চিৎকার করছে, “আমি কিছু করিনি! আমাকে ছেড়ে দাও!” আশেপাশের মানুষরা নিশ্চুপ। কেউ এগিয়ে গেল না। দোকানদার মুখ ঘুরিয়ে বলল, “ওদের ঝামেলায় যাবেন না ভাই। এখানে কথা না বলাই ভালো।”
অর্ণব উঠে দাঁড়াল। অভ্যাস তাকে থামতে দিল না। চায়ের দাম মিটিয়ে বাইরে বেরোল। দেখল, দুইজন গুণ্ডা ধরণের লোক সরু গলির দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক তরুণকে। বয়স তেইশ-চব্বিশ, দেহ শুকনো, চশমা পড়া। অর্ণব সোজা তাদের পথ আটকাল।
—“কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন ছেলেটাকে?”
একজন গুণ্ডা দাঁত বের করে হাসল।
—“কে তুমি? হুট করে এলেন, আর প্রশ্ন করছেন? সরে দাঁড়ান।”
অর্ণব শান্ত গলায় বলল, “আমার নাম অর্ণব দত্ত। আর ছেলেটাকে ছাড়ুন।”
গুণ্ডারা হেসে উঠল। এরকম হুমকি তারা প্রায়ই শোনে। কিন্তু পরের মুহূর্তেই তারা কিছু বুঝে ওঠার আগে অর্ণবের হাত ঝটকা মেরে একজনকে মাটিতে ফেলে দিল। অন্যজন ঘুষি তুলতেই অর্ণব তার কব্জি ধরে টেনে মচকালো। ভাঙার শব্দ হলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দুজন ধপাস করে মাটিতে পড়ল।
ভয়ে কুঁকড়ে থাকা ছেলেটি দাঁড়িয়ে রইল। অর্ণব তার দিকে তাকাল, “তোমার নাম কী?”
—“সুব্রত,” ছেলেটি তোতলাতে তোতলাতে বলল।
—“ওরা তোমাকে কেন টানছিল?”
সুব্রত চারপাশে তাকালো, তারপর ধীরে বলল, “আমি কিছু দেখেছি… যেটা দেখা আমার উচিত হয়নি।”
অর্ণব চুপ করে তাকিয়ে রইল। গলির ভেতরে অচেনা ভয়, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা কিছু মানুষ। সবাই যেন জানে কিছু একটা অন্ধকার প্রবাহিত হচ্ছে শহরের ভেতরে।
সুব্রত কাঁপা গলায় বলল, “তিন দিন আগে… আমি একটা খুন দেখেছি।”
অর্ণবের চোখ সঙ্কুচিত হলো।
—“খুন?”
—“হ্যাঁ। রাত বারোটার সময় রেলওয়ে কলোনির পুরনো গুদামঘরে। চারজন লোক একজনকে মেরে ফেলল। আমি জানতাম না কারা। কিন্তু তারা আমাকে দেখে ফেলে। তখন থেকেই তারা আমাকে খুঁজছে।”
অর্ণব বুঝল বিষয়টা সাধারণ নয়। খুন, গোপন সাক্ষী, আর শহরে ভয়ের বাতাস। ঠিক তার ধরণের গল্প। যে গল্পে সে অজান্তেই জড়িয়ে পড়ে যায়।
অর্ণব সুব্রতকে বলল, “চলো। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ নয়।”
দু’জন মিলে এগোল কাছের একটা লজের দিকে। ছোট, অচেনা জায়গা। একটা ঘরে সুব্রতকে বসিয়ে অর্ণব তার মুখোমুখি হলো।
—“খুনের শিকার কে ছিল?”
সুব্রত মাথা নেড়ে বলল, “জানি না। আমি শুধু দেখেছি, তারা একটা ফাইল নিয়ে যাচ্ছিল। ফাইলের কভারে লাল চিহ্ন ছিল।”
অর্ণবের মনে হলো, বিষয়টা হয়তো কোনো সাধারণ ঝামেলা নয়। কোনো নথি, কোনো গোপন তথ্য। আর্মিতে থাকার সময়ে সে অসংখ্যবার দেখেছে—কোনো ডকুমেন্ট, কোনো প্রমাণ লুকানোর জন্য মানুষ কতদূর যেতে পারে।
সেই মুহূর্তেই দরজায় ধাক্কা।
ধড়াস!
এক লাথিতে দরজা খুলে গেল। তিনজন অস্ত্রধারী ঢুকে পড়ল। চোখে স্পষ্ট ঘৃণা।
—“ছেলেটাকে আমাদের হাতে তুলে দাও। নইলে তোমাকেও ছাড়ব না।”
অর্ণব ধীর পায়ে উঠে দাঁড়াল। বুকের ভেতর শান্ত শ্বাস, চোখে শীতল আগুন। তার ভেতরের পুরনো যোদ্ধা আবার জেগে উঠল।
—“চেষ্টা করো।”
পরের মুহূর্তে ঘর ভরে গেল হিংস্র লড়াইয়ে। লোহার রড একপাশে, ছুরি অন্যপাশে। কিন্তু অর্ণবের শরীর যেন মেশিন। এক ঘুষিতে একজনের দাঁত ভেঙে গেল। আরেকজনের কাঁধ চেপে মাটিতে ফেলে দিল সে। শেষজন ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেই অর্ণব তার হাত মচকিয়ে ছুরি কেড়ে নিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তিনজন অজ্ঞান হয়ে ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে।
সুব্রত হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
অর্ণব বলল, “এখন তুমি বুঝতে পারছ, কেন তারা তোমাকে এত মরিয়া হয়ে খুঁজছে?”
সুব্রত ফিসফিস করে বলল, “তাহলে আমি কি মরব?”
অর্ণব শক্ত দৃষ্টিতে বলল, “যতক্ষণ আমি আছি, ততক্ষণ না।”
বাইরে তখন ভোরের আলো ফুটছে। শহর ঘুম ভাঙছে। কিন্তু চন্দ্রপুরের ছায়ার ভেতরে জন্ম নিচ্ছে এক অদৃশ্য আতঙ্ক। অর্ণব জানে, সে যদি এখান থেকে চলে যায়, ছেলেটার মৃত্যু নিশ্চিত। আর যদি থাকে, তাহলে তাকে লড়তে হবে—শহরের অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে।
সে হঠাৎ অনুভব করল, এই শহর তাকে ডাকছে। যেন বলছে—থাকো, কারণ তোমাকেই দরকার।
অর্ণব জানালার দিকে তাকাল। ঠান্ডা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল—এই খেলাটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত চন্দ্রপুর ছেড়ে সে যাবে না।
পর্ব ২ : গুদামঘরের ছায়া
চন্দ্রপুর শহর ভোরের আলোয় ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। বাজার খুলছে, রিকশাওয়ালা ডাকছে, স্কুলের বাচ্চারা ইউনিফর্ম পরে হাঁটছে। অথচ একটা ঘরের ভেতর, অর্ণব দত্ত দাঁড়িয়ে আছে তিনজন অজ্ঞান দুষ্কৃতীর পাশে। মেঝেতে পড়ে আছে লোহার রড আর ছুরি। সুব্রত ভয়ে ভয়ে চেয়ারের কিনারায় বসে আছে।
অর্ণবের অভ্যাস ছিল, লড়াই শেষ হওয়ার পর জায়গাটা দ্রুত পরিষ্কার করা। সে জানত, দেরি করলে পুলিশ আসবে, আর পুলিশ এলেই ঝামেলা হবে। এই শহরে সে কারো পরিচিত নয়, নিজের পরিচয় বোঝানো কঠিন হবে। তার ওপর, পুলিশও হয়তো ওই লোকগুলোর প্রভাবের মধ্যে আছে।
সে সুব্রতকে বলল,
—“চলো, এখান থেকে সরে যাই।”
—“কোথায় যাবো?”
—“যেখানে ওরা তোমাকে এত সহজে খুঁজে পাবে না।”
সুব্রত আতঙ্কিত চোখে বলল, “তাহলে তুমি আমাকে নিয়ে পালাচ্ছ?”
অর্ণব উত্তর দিল না। দরজা খুলে বাইরে এল। সরু রাস্তা দিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগল। সুব্রত তার পেছনে ছোটে।
শহরের ভেতরে ঢোকার পর অর্ণব থামল। রাস্তার পাশে পুরনো সাইকেল মেরামতের দোকান, দোকানের পেছনে অন্ধকার ঘর। সে দরজায় টোকা দিল। ভেতর থেকে এক বৃদ্ধ বেরিয়ে এলেন। চোখে ঘোলা চশমা, হাতে তেল মাখা কাপড়।
—“কে?”
অর্ণব বলল, “আপনাকে সেনাবাহিনীর পুরোনো ক্যান্টনমেন্টে দেখেছিলাম, মনে আছে?”
বৃদ্ধ ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকালেন, তারপর ধীরে মাথা নেড়ে বললেন, “মনে আছে। আপনারা তো সেদিন আমাদের খাবার দিয়েছিলেন।”
অর্ণব হেসে বলল, “আমাদের একটু আশ্রয় দরকার।”
বৃদ্ধ কোনো প্রশ্ন করলেন না। ভিতরে নিয়ে গেলেন। ছোট ঘর, ধুলো জমা, কিন্তু নিরাপদ।
—“এখানে থাকতে পারেন। তবে বেশি দিন নয়। শহরের মানুষ এখন আর কাকে বিশ্বাস করবে না।”
অর্ণব ধন্যবাদ জানাল। সুব্রতকে বসিয়ে সে বলল,
—“এখন আমাকে সব বলো। খুনটা কেমন ছিল?”
সুব্রত ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
—“সেদিন রাত বারোটার দিকে আমি রেল কলোনির গুদামের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। জানি না কেন, ভেতর থেকে আওয়াজ পেলাম। জানালার ফাঁক দিয়ে দেখলাম, চারজন লোক একজনকে মারছে। লোকটা বারবার বলছিল—‘ফাইলটা আমার কাছে নেই, বিশ্বাস করুন।’ কিন্তু তারা শোনেনি। শেষমেশ লোহার রড দিয়ে আঘাত করে মেরে ফেলল। তারপর একটা কালো ব্যাগ থেকে ফাইল বের করল। লাল সিল ছিল কভারে। ওরা যখন বেরোচ্ছিল, আমায় দেখে ফেলল।”
অর্ণব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। সে বুঝল, ফাইলটা-ই আসল রহস্য। আর যে মারা গেছে, সে হয়তো কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের সঙ্গে জড়িত।
অর্ণব বলল, “তুমি কি কারো কাছে বিষয়টা জানিয়েছিলে?”
সুব্রত মাথা নেড়ে বলল, “না। ভয় পেয়েছিলাম। কেবল আমার কলেজের বন্ধু রাহুলকে বলেছিলাম। সে বলল, চুপ করে থাকতে। কিন্তু পরের দিন থেকে এই লোকগুলো আমাকে খুঁজতে শুরু করল।”
অর্ণব বুঝল, শহরে কোনো শক্তিশালী সিন্ডিকেট কাজ করছে। তারা পুলিশের ভয় পায় না, খোলাখুলি মানুষ ধরে নিয়ে যায়। আর তাদের হাতে আছে এমন কিছু, যা শহরের ভবিষ্যৎ পাল্টে দিতে পারে।
অর্ণব দাঁড়িয়ে বাইরে তাকাল। হাওয়া থেমে গেছে। দূরে গলির মুখে ভাঙা পোস্টার ঝুলছে—“শহরের উন্নয়ন প্রকল্প: নতুন শিল্পাঞ্চল তৈরি হবে।” হঠাৎ তার মনে হলো, এই প্রকল্পের সঙ্গে খুনের কোনো যোগ আছে কি না।
সে সুব্রতকে বলল,
—“আজ রাতে তুমি আমাকে সেই গুদামঘরে নিয়ে যাবে। আমি নিজে সব দেখতে চাই।”
সুব্রত আতঙ্কিত চোখে তাকাল।
—“না! ওখানে যাওয়া মানে মৃত্যুর ফাঁদে পা দেওয়া।”
অর্ণব ঠান্ডা গলায় বলল,
—“আমি বহুবার মৃত্যুর ফাঁদে গিয়েছি। এবারও যাবো। তবে তুমি চাইলে বাইরে থাকতে পারো।”
সুব্রত কিছু বলল না। মুখ নামিয়ে ফেলল।
সন্ধ্যা নেমে এলো। শহরের আলো ঝলমল করছে, কিন্তু গলির ভেতর অন্ধকার ঘন। অর্ণব আর সুব্রত ধীরে ধীরে রেল কলোনির দিকে হাঁটছে। পথের ধারে পুরনো গাছ, ভাঙা ল্যাম্পপোস্ট। গুদামঘর দেখা যাচ্ছে—দীর্ঘ, ধূসর, শেওলা ধরা দেওয়াল। জানালাগুলো বন্ধ, দরজা বাইরে থেকে তালাবদ্ধ।
অর্ণব ধীরে দরজার কাছে গেল। তালাটা দেখে বুঝল, এটা নতুন। সে জ্যাকেট থেকে একটা ছোট পকেট নাইফ বের করল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তালা খুলে গেল।
ভেতরে ঢুকতেই পচা গন্ধ। কাঠের বাক্স, মরচে ধরা লোহার ড্রাম, আর মেঝেতে শুকনো রক্তের দাগ। সুব্রত কেঁপে উঠল।
—“এইখানেই… এখানে খুন হয়েছিল।”
অর্ণব চারপাশ খুঁটিয়ে দেখল। বাক্সের একপাশে কিছু কাগজ ছড়ানো, যেন তাড়াহুড়োয় ফেলে রাখা। সে একটা কাগজ হাতে নিল। তাতে লেখা: “Project Sunrise – Confidential”।
অর্ণব চোখ ছোট করল। Project Sunrise? শব্দগুলো তার মাথায় বাজল। হয়তো কোনো গোপন চুক্তি, হয়তো সরকারী ফাইল। কিন্তু কেন খুন?
ঠিক তখনই বাইরে থেকে শব্দ পেল। কেউ আসছে।
অর্ণব তাড়াতাড়ি সুব্রতকে আড়ালে টেনে নিল। ফাঁক দিয়ে দেখল, চারজন লোক ভেতরে ঢুকছে। তাদের হাতে টর্চ, একজনের কাঁধে বন্দুক। তারা সরাসরি সেই জায়গায় গেল যেখানে রক্তের দাগ। একজন বলল,
—“এখনও দাগ মুছে যায়নি। আমাদের কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে। কেউ যদি আরেকবার দেখে ফেলে, সর্বনাশ।”
অন্যজন বলল,
—“বড় সাহেব আজ রাতে আসবেন। তিনি নিজে ফাইল নেবেন। তখন সব শেষ।”
অর্ণব চুপচাপ শুনল। বড় সাহেব—মানে এখানে আরও বড় কেউ জড়িত। যিনি আজ রাতে আসবেন, ফাইল নেবেন।
তারা কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করল, তারপর আবার বেরিয়ে গেল। দরজা বাইরে থেকে তালা দিল।
অর্ণব নিঃশ্বাস ছাড়ল। সুব্রত কাঁপতে কাঁপতে বলল,
—“তুমি শুনলে? বড় সাহেব আসবেন আজ রাতে! আমরা তো ফেঁসে গেলাম।”
অর্ণব শান্ত দৃষ্টিতে বলল,
—“না। এটাই আমাদের সুযোগ। আমরা ওদের অপেক্ষা করব।”
রাত আরও গভীর হলো। গুদামের ভেতরে দু’জন মানুষ নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে। অর্ণবের হাত মুঠো হয়ে আছে, চোখ স্থির। সুব্রত ভয়ে বারবার ঘাম মুছছে। বাইরে হঠাৎ গাড়ির শব্দ। দরজা খুলে গেল।
চারজন লোক ঢুকল, তাদের পেছনে আসল সেই মানুষ—কালো কোট পরা, মাথায় টুপি। তার মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু কণ্ঠস্বর ভারী, নির্দেশমূলক।
—“ফাইল এনেছো?”
একজন গুণ্ডা ব্যাগ বাড়িয়ে দিল। মানুষটা ফাইল হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখল। কভারে লাল সিল, স্পষ্ট লেখা—“Project Sunrise – Restricted Access”।
অর্ণব জানত, এটাই খুনের আসল কারণ।
হঠাৎ একটা শব্দ। সুব্রত অজান্তেই বাক্সে হাত ঠুকে দিল। সব চোখ ঘুরে গেল তাদের দিকে।
—“ওখানে কে?” কালো কোটওয়ালা গর্জে উঠল।
অর্ণব দাঁড়িয়ে বেরিয়ে এল। ছায়া থেকে তার লম্বা দেহ বেরোল। ঠান্ডা গলায় বলল,
—“আমার নাম অর্ণব দত্ত। আর ওই ফাইলটা তোমার নয়।”
ঘরের ভেতর হঠাৎ নিস্তব্ধতা। তারপরই বন্দুকের নল তার দিকে উঠল।
পর্ব ৩ : মুখোমুখি আগুন
গুদামঘরের ভেতর নিস্তব্ধতা জমে উঠল। মেঝের ধুলোতে বাতাস সামান্য কেঁপে উঠছে, টর্চের আলো দেয়ালে লাফাচ্ছে। অর্ণব দত্ত ছায়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। তার মুখ কঠিন, চোখ দুটো অদ্ভুত শান্ত অথচ জ্বলন্ত। সামনে চারজন গুণ্ডা বন্দুক তাক করে আছে, আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে কালো কোটওয়ালা মানুষটি ফাইল হাতে শক্ত করে ধরেছে।
কালো কোটওয়ালা ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো। আলোয় তার মুখ খানিকটা স্পষ্ট হলো—চওড়া কপাল, তীক্ষ্ণ চোখ, বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপের হাসি।
—“তুমি কে?”
অর্ণব একদম সরলভাবে উত্তর দিল, “পথিক। কিন্তু অন্যায় চোখে পড়লে থেমে যাই।”
লোকটা হেসে উঠল।
—“অন্যায়? তুমি জানো এটা কী? জানো এটার পেছনে কত কোটি টাকার খেলা আছে?”
অর্ণব শান্ত গলায় বলল,
—“একটা ফাইলের জন্য মানুষকে খুন করা অন্যায়। যত টাকারই খেলা থাকুক।”
কালো কোটওয়ালা হাত নেড়ে তার লোকদের বলল,
—“ওকে মেরে ফেল।”
অর্ণবের বুকের ভেতর ঢেউ উঠল না। বরং নিখুঁত সৈন্যের মত শরীর নড়ল। প্রথম লোকটা বন্দুক তুলতেই সে পাশে সরে গিয়ে মাটির কাছ থেকে একটা ভাঙা কাঠের তক্তা তুলে আঘাত করল। বন্দুকধারী ছিটকে গিয়ে পড়ল। দ্বিতীয় লোক গুলি ছুড়ল, কিন্তু অর্ণব ঝাঁপিয়ে পড়ে তার হাত থেকে বন্দুক ছিনিয়ে নিল। গুলির শব্দে গুদামঘরের কাচ কেঁপে উঠল।
মুহূর্তের মধ্যে লড়াই ভয়াবহ হয়ে উঠল। তৃতীয় লোক ছুরি নিয়ে এগোতেই অর্ণব তার গলা ধরে পেছনে ছুঁড়ে ফেলল। চতুর্থ জন গলায় দড়ি ফেলার চেষ্টা করছিল, কিন্তু অর্ণব পেছনে কনুই চালিয়ে তার নাক ভেঙে দিল।
কয়েক সেকেন্ডে সব শেষ। চারজন মাটিতে ছড়িয়ে আছে। অর্ণব ধীরে ধীরে কালো কোটওয়ালার দিকে তাকাল।
লোকটা কিন্তু পিছোয়নি। বরং হেসে বলল,
—“বাহ! তোমার মতো কাউকে আমার দরকার ছিল। কিন্তু তুমি ভুল জায়গায় দাঁড়িয়েছ।”
অর্ণব তার দিকে পা বাড়াল।
—“ফাইলটা আমাকে দাও।”
লোকটা ফাইল বুকে চেপে ধরল।
—“জানো এটা কী? প্রজেক্ট সানরাইজ। এই শহর বদলে যাবে এর মাধ্যমে। নতুন শিল্পাঞ্চল, নতুন ক্ষমতা, নতুন টাকা। যারা পথে দাঁড়াবে, তারা মরে যাবে।”
অর্ণব এক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর ঠান্ডা স্বরে বলল,
—“মানুষের জীবন দিয়ে কোনো শহর গড়ে না।”
লোকটা হেসে ফাইল উঁচিয়ে ধরল।
—“তুমি আমাকে থামাতে পারবে না। কারণ আমি একা নই। আমার পেছনে আছে ক্ষমতা—রাজনীতি, ব্যবসা, পুলিশ—সবাই।”
ঠিক তখনই গুদামের বাইরে সাইরেন বেজে উঠল। পুলিশের গাড়ির শব্দ। সুব্রত আড়াল থেকে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে এল। কালো কোটওয়ালা ঘুরে দাঁড়াল, দরজার দিকে ছুটল।
অর্ণব ঝাঁপিয়ে পড়ল, কিন্তু লোকটা ধোঁয়ার ক্যান ছুড়ে দিল। গুদাম ভরে গেল সাদা কুণ্ডলীতে। চোখ জ্বালা করছে, কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
যখন ধোঁয়া কেটে গেল, তখন ফাইলসহ লোকটা গায়েব। বাইরে পুলিশ দাঁড়িয়ে। টর্চের আলো, চিৎকার।
—“হাত উপরে!”
অর্ণব শান্তভাবে দাঁড়াল। পুলিশরা ভেতরে ঢুকল, চারদিকে ছড়িয়ে থাকা অজ্ঞান গুণ্ডাদের দেখল। সুব্রত আতঙ্কে চিৎকার করে বলল,
—“স্যার, ওরা খুনি! আমি সব দেখেছি! উনি আমাকে বাঁচিয়েছেন!”
পুলিশ অফিসার তীক্ষ্ণ চোখে অর্ণবকে দেখল। তারপর গম্ভীর স্বরে বলল,
—“তাহলে তোমরাই সেই সাক্ষী?”
অর্ণব বলল,
—“হ্যাঁ। আর খুনিরা তোমাদের আগে এখান থেকে পালিয়ে গেল।”
পুলিশ একে অপরের দিকে তাকাল। তাদের চোখে এমন কিছু ছিল, যা অর্ণবকে সন্দেহে ফেলল। অতিরিক্ত নির্লিপ্ত, অতিরিক্ত ঠান্ডা। যেন তারা সত্যিই খুনিদের ধরতে চায় না।
অফিসার শুধু বলল,
—“চলো থানায়।”
থানায় নিয়ে যাওয়া হলো দু’জনকে। পুরনো বিল্ডিং, দেয়ালে ধুলো জমা। অফিসার কাগজপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে প্রশ্ন করল।
—“তুমি বলছো, চারজন খুনি, আর একজন কালো কোটওয়ালা?”
সুব্রত ভয়ে ভয়ে বলল, “হ্যাঁ স্যার।”
অর্ণব গম্ভীর স্বরে বলল, “খুন হয়েছিল, আর ফাইল নিয়ে গেছে।”
অফিসার একদম নির্লিপ্ত গলায় বলল,
—“আমরা খোঁজ নিচ্ছি।”
অর্ণব বুঝল, খোঁজ নেওয়া হবে না। এরা সবাই খেলায় আছে। থানার বাইরে দাঁড়ানো এক লোকের চোখে সে সেই একই ঠান্ডা দৃষ্টি দেখল। শহরের পুলিশ হয়তো পুরোপুরি কেনা।
রাত গভীর। থানার অন্ধকার সেলে বসে সুব্রত আতঙ্কিত হয়ে বলল,
—“আমরা শেষ হয়ে গেছি। পুলিশও ওদের লোক।”
অর্ণব কাঁধে হাত রাখল।
—“এখনও শেষ হয়নি। আমরা বাঁচব।”
সে মাথা ঠেকিয়ে দেয়ালের তালাটা খুঁটিয়ে দেখল। পুরোনো লোহার তালা, মেকানিজম দুর্বল। পকেট থেকে ছোট তার বের করে কয়েক সেকেন্ডে খুলে ফেলল। সুব্রত অবাক হয়ে তাকাল।
—“তুমি এও জানো?”
অর্ণব হেসে বলল,
—“মিলিটারি পুলিশে শিখতে হয়।”
তারা নিঃশব্দে বাইরে বেরোল। থানার করিডরে টর্চের আলো ঘুরছে। অর্ণব পেছন দিয়ে নিয়ে গেল, ভাঙা জানালা দিয়ে বেরিয়ে এলো।
বাইরে রাতের হাওয়া তীব্র। দূরে গলির ভেতর কালো কোটওয়ালার লোকেরা টহল দিচ্ছে। অর্ণব জানত, এখন যদি গা-ঢাকা না দেয়, তবে সকাল পর্যন্ত বাঁচা যাবে না।
সে সুব্রতকে বলল,
—“শহরের ভেতরে থাকা যাবে না। আমাদের বাইরে যেতে হবে। কিন্তু তার আগে আমার জানতে হবে—এই প্রজেক্ট সানরাইজ আসলে কী।”
সুব্রত ফিসফিস করে বলল,
—“আমার কলেজে এক অধ্যাপক বলেছিলেন, সরকার গোপনে একটা জমি অধিগ্রহণ করছে। সাধারণ লোকদের তাড়িয়ে দিয়ে কারখানা বসানো হবে। হয়তো তারই অংশ এই ফাইল।”
অর্ণব মাথা নেড়ে বলল,
—“তাহলে এটা শুধু শহরের নয়। এর সঙ্গে অনেক মানুষের জীবন জড়িত। আর এ কারণেই খুন।”
রাত তিনটে বাজে। তারা শহরের বাইরে এক পরিত্যক্ত কারখানায় আশ্রয় নিল। মাটির উপর ধুলো, ভাঙা মেশিন। অর্ণব মেঝেতে বসে নিজের হাতের ক্ষত বেঁধে নিল। সুব্রত নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
—“তুমি কেন আমাকে সাহায্য করছ?”
অর্ণব অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল,
—“কারণ আমার জীবনেও অনেক অন্যায় দেখেছি। প্রতিবার আমি ভাবতাম, কেউ তো দাঁড়াবে। শেষে বুঝলাম, আমাকেই দাঁড়াতে হবে।”
সুব্রত বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকল।
ঠিক তখনই বাইরে গাড়ির শব্দ। হেডলাইট কারখানার ভাঙা দেয়ালে পড়ে ভেতর আলোকিত হলো। অর্ণব উঠে দাঁড়াল।
—“ওরা এসেছে।”
দশ–বারো জন লোক নামল গাড়ি থেকে। হাতে রড, বন্দুক। কালো কোটওয়ালার লোকজন। তারা ঘিরে ফেলছে কারখানা।
অর্ণব চোখ বন্ধ করল এক মুহূর্ত। বুকের ভেতর নিখুঁত শান্তি। আবার লড়াইয়ের সময় এসেছে।
পর্ব ৪ : অবরুদ্ধ রাত
পরিত্যক্ত কারখানার ভাঙা কাঁচের জানালা দিয়ে হেডলাইটের আলো ভেতরে ঢুকছে। ধুলোয় ভরা মেঝে যেন সাদা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। বাইরে দশ–বারো জন লোক নামছে গাড়ি থেকে। তাদের হাতে লোহার রড, বন্দুক, লাঠি। পদক্ষেপে এক অদৃশ্য হিংস্র সুর।
অর্ণব দত্ত ভেতর থেকে সব দেখছে। তার পাশে সুব্রত দাঁড়িয়ে কাঁপছে।
—“ওরা তো আমাদের ঘিরে ফেলছে! এবার আমরা বাঁচব না!”
অর্ণব শান্ত গলায় বলল,
—“চুপ করে থাকো। ভয় দেখাবে ওরা, কিন্তু আমাদের মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে।”
সে চোখ বুলিয়ে নিল পুরো জায়গায়। ভাঙা মেশিন, মরচে ধরা লোহার রড, ছেঁড়া টিন। প্রতিটি জিনিসই অস্ত্র হতে পারে, যদি হাতের সঠিক নিয়ন্ত্রণ থাকে।
বাইরে থেকে চিৎকার ভেসে এলো।
—“ওই ভেতরে আছিস জানি! বেরিয়ে আয়!”
অর্ণব জানালার আড়ালে দাঁড়িয়ে হিসেব করল—ওরা সংখ্যায় অনেক, সামনে লড়াইয়ে সুযোগ নেই। কৌশল চাই। সে মাটিতে পড়ে থাকা একটি লোহার পাইপ হাতে নিল।
সুব্রত ফিসফিস করে বলল,
—“তুমি কি সত্যিই লড়তে পারবে এতজনের সঙ্গে?”
অর্ণব চোখে আগুন জ্বালিয়ে বলল,
—“সেনাবাহিনীতে আমরা সংখ্যার হিসেব করি না। আমরা কৌশল খুঁজি।”
লোকগুলো কারখানার ভেতরে ঢুকল। পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে কাছে আসছে। হঠাৎই অর্ণব ভাঙা মেশিনের এক পাশে লোহার পাইপ ঠুকল। গম্ভীর শব্দ গোটা হল ঘরে প্রতিধ্বনিত হলো।
গুণ্ডারা চমকে উঠে ভুলপথে এগোতে লাগল। অর্ণব সুযোগ নিয়ে আড়াল থেকে বেরিয়ে প্রথমজনের মাথায় পাইপ আঘাত করল। লোকটা ধপাস করে মাটিতে পড়ল। দ্বিতীয়জন ঘুরে গুলি চালাল, কিন্তু অর্ণব ঝাঁপিয়ে পড়ে মেশিনের আড়ালে সরে গেল। গুলি কংক্রিটে আঘাত করে ছিটকে গেল।
অর্ণব আড়াল থেকে বেরিয়ে বিদ্যুতের মতো ছুটে গিয়ে বন্দুকওয়ালার হাত মচকালো। বন্দুক মাটিতে পড়তেই সে কিক মেরে দূরে সরিয়ে দিল। তৃতীয় লোক ছুরি নিয়ে এগোতেই অর্ণব তার গলা ধরে মাটিতে আছাড় মারল।
সুব্রত ভয়ে আড়ালে লুকিয়ে আছে, তবু চোখ সরাতে পারছে না। সে প্রথমবার দেখছে একজন মানুষ কীভাবে ঝড়ের মতো একা লড়াই করতে পারে।
লড়াই থেমে নেই। পাঁচ-ছয়জন একসঙ্গে আক্রমণ করল। অর্ণব পাইপ ঘুরিয়ে মুষ্টাঘাতের মতো আঘাত করতে লাগল। দুজন একসঙ্গে পড়ে গেল। কিন্তু একজন পিছন থেকে লাঠি নিয়ে আঘাত করল তার কাঁধে। ব্যথায় শরীর কেঁপে উঠল, কিন্তু অর্ণব থামল না। সে ঘুরে লাঠিটা কেড়ে নিয়ে উল্টে আঘাত করল।
ধীরে ধীরে মেঝেতে পড়ে রইল সাতজন। কিন্তু বাইরে এখনও লোকজন আছে। গাড়ির হেডলাইট জ্বলছে, তাদের নেতা হয়তো বাইরে দাঁড়িয়ে দেখছে।
ঠিক তখনই, ভাঙা দরজা দিয়ে ঢুকল কালো কোটওয়ালা সেই মানুষ। ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি।
—“বাহ! তুমি সত্যিই অসাধারণ। কিন্তু এই লড়াই বৃথা। কারণ তুমি জানো না, কার বিরুদ্ধে লড়ছ।”
অর্ণব দাঁড়িয়ে রইল, বুকের ভেতর শ্বাস ভারী হলেও চোখ শান্ত।
—“তাহলে তুমি বলো। আমি শুনব।”
লোকটা কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,
—“প্রজেক্ট সানরাইজ কোনো সাধারণ শিল্পাঞ্চল নয়। এটা দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি অস্ত্র কারখানার পরিকল্পনা। এখানে তৈরি হবে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। সরকার অর্ধেক জানে, অর্ধেক জানে না। কিন্তু পুরো লাভ যাবে আমাদের হাতে।”
সুব্রত স্তম্ভিত হয়ে গেল।
—“অস্ত্র কারখানা?”
কালো কোটওয়ালা হাসল।
—“হ্যাঁ। আর যারা আমাদের পথে দাঁড়াবে, তাদের মৃত্যু নিশ্চিত। সেই জন্যই সেই লোকটাকে মেরে ফেলেছিলাম—সে ছিল অভ্যন্তরীণ তথ্যদাতা। আর এখন তোমাদের পালা।”
অর্ণব ঠান্ডা গলায় বলল,
—“তুমি ভুল করছ। যারা মানুষের জীবনের ওপরে টাকা বসায়, তারা শেষমেশ ধ্বংস হয়।”
লোকটা ইঙ্গিত করতেই আরও চারজন বন্দুকধারী ভেতরে ঢুকল। তারা ঘিরে ফেলল অর্ণবকে।
সুব্রত চিৎকার করে উঠল,
—“না! ওকে মেরো না!”
কিন্তু অর্ণব কাঁধে হাত রাখল।
—“চুপ করে থাকো।”
তার চোখে তখন নিখুঁত যুদ্ধকৌশল। সে জানত, বন্দুকের সামনে খালি হাতে এগোনো আত্মঘাতী। তাই সে অন্য পথ বেছে নিল। হঠাৎই পাশে থাকা একটি মরচে ধরা সিলিন্ডার টেনে এনে মেঝেতে আছাড় দিল। ধোঁয়া আর গ্যাস বেরিয়ে পুরো ঘর ভরিয়ে দিল। চোখ জ্বালা করছে, দৃষ্টি অস্পষ্ট।
গোলমাল হতেই অর্ণব সুব্রতকে টেনে পাশের ভাঙা জানালা দিয়ে বাইরে ঝাঁপ দিল। কাঁচ ভেঙে দু’জন নিচে পড়ে গেল। গায়ে ব্যথা লাগলেও বেঁচে গেল।
পেছনে গুলি চলল, কিন্তু তারা অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
শহরের প্রান্তে, পুরনো নদীর ধারে থামল তারা। নিশ্বাস ফুলে উঠেছে, শরীর কাঁপছে। সুব্রত কণ্ঠ কাঁপিয়ে বলল,
—“এরা তো পুরো দেশকেই বিপদে ফেলবে!”
অর্ণব মাথা নেড়ে বলল,
—“হ্যাঁ। আর এখন আমাদের হাতে সময় কম। কালো কোটওয়ালা আজ বা কাল ফাইল নিয়ে শহরের বাইরে চলে যাবে। তখন তাকে আর ধরা যাবে না।”
সুব্রত চোখ বড় করে বলল,
—“তাহলে এখন কী করব?”
অর্ণব গম্ভীর গলায় বলল,
—“আমরা ওদের খেলা উল্টে দেব। আমাদের খুঁজতে খুঁজতে ওরা শহরের ভেতর ব্যস্ত। তার মানে ওদের কেন্দ্র কোথাও আছে—যেখানে ফাইল লুকানো বা চালান দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। আমাদের সেটা খুঁজে বের করতে হবে।”
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। শহর ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। রাস্তায় লোকজনের ভিড় বাড়ছে। কিন্তু অর্ণব আর সুব্রত গা ঢাকা দিয়ে এগোচ্ছে পুরনো বাজারের দিকে।
একটা ছোট পানশালার ভেতর ঢুকে অর্ণব চা অর্ডার করল। দোকানদার তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল, কিছু বলল না। অর্ণব নীচু গলায় সুব্রতকে বলল,
—“এখন আমাদের তথ্য চাই। শহরে যে মানুষগুলো সব জানে, তাদের একজন হলো—রাতারাতি চালান করা ট্রাকের ড্রাইভাররা।”
সুব্রত বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল,
—“মানে?”
অর্ণব ব্যাখ্যা করল,
—“যেখানে এত বড় অস্ত্র প্রকল্প গড়ে উঠছে, সেখানে নিশ্চয়ই প্রচুর জিনিস আনা-নেওয়া হচ্ছে। সেসব ট্রাকের ড্রাইভার জানে আসল গন্তব্য কোথায়। আমাদের একজনকে খুঁজতে হবে।”
ঠিক তখনই পাশের টেবিলে বসা এক মাতাল ড্রাইভার গলা উঁচু করে বলল,
—“কাল রাতে আবার ট্রাক গেছে পুরনো সেতুর দিক দিয়ে। কারখানার জিনিস যাচ্ছে বলে শুনলাম!”
অর্ণব আর সুব্রত একে অপরের দিকে তাকাল।
অর্ণব ঠান্ডা গলায় বলল,
—“তাহলে লক্ষ্য পাওয়া গেছে।”
বিকেলের দিকে তারা দু’জন এগোল শহরের বাইরে সেই পুরনো সেতুর দিকে। সেতুর ওপারেই এক বিশাল পরিত্যক্ত খামারঘর। বাইরে বড় বড় ট্রাক দাঁড়িয়ে, লোডিং চলছে। লোকজন পাহারা দিচ্ছে বন্দুক হাতে।
অর্ণব দূর থেকে সব দেখে নিল। চোখে দৃঢ়তা।
—“এইখানেই ফাইল লুকানো আছে। আর এখান থেকেই শুরু হবে ওদের খেলা।”
সুব্রত ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
—“তাহলে আমাদের এখন কী করা উচিত?”
অর্ণব ঠান্ডা গলায় বলল,
—“রাত নামার অপেক্ষা। অন্ধকারের ভেতরেই ঢুকতে হবে। আর তখনই আমরা জানব প্রজেক্ট সানরাইজের আসল রহস্য।”
দূরে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, আকাশ লাল হয়ে উঠছে।
অর্ণব জানে, এই যুদ্ধ শুধু টিকে থাকার নয়। এটা শহরের ভবিষ্যতের জন্য লড়াই।
পর্ব ৫ : অন্ধকারের ভেতরে
সন্ধ্যা নেমে এসেছে চন্দ্রপুর শহরের আকাশে। নদীর ধারে ঝিঁঝিঁর ডাক, দূরের মসজিদের আজানের সুর মিলেমিশে তৈরি করেছে এক অদ্ভুত ছায়া। অর্ণব দত্ত আর সুব্রত দাঁড়িয়ে আছে পুরনো সেতুর ওপারে খামারঘরের সামনে। অন্ধকারে বিশাল কাঠামোটা দানবের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা ট্রাক, তাদের চারপাশে বন্দুক হাতে লোকজন পাহারা দিচ্ছে। আলো-আঁধারিতে তাদের চোখে যেন শিকারির ক্ষুধা।
অর্ণব শান্ত চোখে সব দেখছে।
—“এটাই কেন্দ্র। এখানেই ফাইল রাখা হয়েছে। আর এখানেই কালো কোটওয়ালার নেটওয়ার্ক।”
সুব্রত ভয়ে গিলে ফেলল থুতু।
—“কিন্তু আমরা ঢুকব কীভাবে? এত পাহারা…”
অর্ণব ঠান্ডা গলায় বলল,
—“পাহারা যত শক্তই হোক, অন্ধকার সবসময় ফাঁক রেখে দেয়। সেখান দিয়েই আমরা ঢুকব।”
সে চারপাশ খুঁটিয়ে দেখল। খামারঘরের একপাশে ভাঙা দেয়াল, যেটা হয়তো পুরনো কাঠামো থেকে পড়ে গেছে। সেখান দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঢোকা সম্ভব।
অর্ণব বলল,
—“শুনে রাখো, ভেতরে গিয়ে যদি আমরা আলাদা হয়ে যাই, তোমার কাজ হবে চুপচাপ লুকিয়ে থেকে শোনো। কোনো ঝুঁকি নেবে না। আমি সামলাব।”
সুব্রত মাথা নেড়ে রাজি হলো।
অন্ধকারে তারা নিঃশব্দে এগোল ভাঙা দেয়ালের দিকে। ঝোপঝাড় সরিয়ে তারা হামাগুড়ি দিয়ে ভেতরে ঢুকল। খামারঘরের ভেতরটা বিশাল, চারদিকে কাঠের বাক্স আর লোহার ড্রাম সাজানো। বাতাসে তেল আর মরচের গন্ধ। উপরে ঝুলছে বড় লাইট, কিন্তু সব জ্বলছে না। মাঝে মাঝে অন্ধকারে ফাঁকা জায়গা তৈরি হচ্ছে।
অর্ণব ধীরে এগোল, কান খাড়া করে রাখল। হঠাৎই তারা শুনতে পেল কিছু লোকের গলা।
—“কাল রাতের ভেতর সব ট্রাক বেরিয়ে যাবে। সাহেব নিজে এসে দেখবেন।”
—“ফাইল কোথায় রাখা হয়েছে?”
—“অফিস কেবিনে। তালা দিয়ে বন্ধ। সাহেব ছাড়া কেউ খুলতে পারবে না।”
অর্ণব চোখে ইশারা করল সুব্রতকে। ফাইলের অবস্থান পরিষ্কার হলো—অফিস কেবিন।
তারা ধীরে ধীরে এগোল। সুব্রত হাঁপাচ্ছিল, কিন্তু সাহস করে শব্দ বের করতে পারল না। অর্ণব সামনে গিয়ে হঠাৎ একটা আড়াল পেল—ভাঙা কাঠের তাক। সেখান থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে কেবিনটা। বাইরে দুইজন পাহারাদার দাঁড়িয়ে।
অর্ণব শান্ত গলায় বলল,
—“তোমাকে বাইরে অপেক্ষা করতে হবে। আমি ঢুকব।”
সুব্রত কেঁপে উঠল।
—“কিন্তু তুমি একা?”
অর্ণব হেসে বলল,
—“আমি সবসময় একাই থাকি।”
সে আড়াল থেকে বেরিয়ে নিঃশব্দে এগোল। মাটির ধুলো চাপা দিতে পা ফেলল খুব ধীরে। প্রথম পাহারাদারকে পেছন থেকে ধরে টেনে আড়ালে টেনে নিল। গলা চেপে ধরল, লোকটা লড়ল, কিন্তু কয়েক সেকেন্ডেই নিস্তেজ হয়ে গেল। দ্বিতীয়জন টের পাওয়ার আগেই অর্ণব তার মাথায় ঘুষি মেরে অচেতন করে ফেলল।
কেবিনের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল অর্ণব। তালা নতুন, শক্তিশালী। কিন্তু অর্ণবের হাতে সময় কম। সে পকেট থেকে তার বের করে নিখুঁত কৌশলে তালা খুলে ফেলল।
ভেতরে ঢুকে সে দেখল টেবিলের ওপরে একটি লাল সিল করা ফাইল রাখা। তাতে লেখা—Project Sunrise – Master Document।
অর্ণব ফাইল খুলল। ভেতরে নকশা, রিপোর্ট, চুক্তিপত্র। সবকিছুই প্রমাণ করছে যে এই খামারঘর আসলে গোপন অস্ত্র কারখানার কেন্দ্র। দেশীয় কারখানা নয়, বিদেশি কোম্পানির সাথে আঁতাত করে তৈরি হবে। সরকারকে অর্ধেক অন্ধকারে রাখা হয়েছে। কয়েকজন স্থানীয় নেতা আর ব্যবসায়ী এই প্রজেক্টের মূল খেলোয়াড়।
অর্ণব গভীরভাবে শ্বাস নিল।
—“এটাই ওদের হাতিয়ার।”
ঠিক তখনই দরজা হঠাৎ খুলে গেল। কালো কোটওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে, ঠোঁটে বিষাক্ত হাসি। তার সঙ্গে আরও কয়েকজন বন্দুকধারী।
—“অসাধারণ! তুমি সত্যিই সাহসী। আমার ফাইলেই হাত দেবে ভাবিনি।”
অর্ণব শান্তভাবে ফাইল বন্ধ করল।
—“মানুষকে বাঁচানোর জন্য যা প্রয়োজন, আমি সব করব।”
লোকটা বিদ্রুপ করে বলল,
—“তাহলে মরার জন্য প্রস্তুত হও।”
বন্দুক উঠতেই অর্ণব টেবিলটা ঠেলে দিল। বন্দুকের গুলি কাঁচ ভেঙে বেরিয়ে গেল। সে টেবিলের আড়াল নিয়ে এক ধাক্কায় দুইজনকে ফেলে দিল। কিন্তু সংখ্যায় তারা বেশি। গুলি ছুটছে, কাঠ ভাঙছে, কাগজ উড়ছে।
সুব্রত বাইরে থেকে আতঙ্কে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ সে দেখল, ভেতর থেকে এক ফাইল মাটিতে গড়িয়ে বাইরে চলে এল। সে তাড়াতাড়ি সেটা কুড়িয়ে নিল। বুকের কাছে চেপে ধরল।
ভেতরে তখন মারামারি তুঙ্গে। অর্ণব নিখুঁত আঘাতে দুইজনকে অজ্ঞান করল, কিন্তু ততক্ষণে কালো কোটওয়ালা বেরিয়ে গিয়ে সাইরেন বাজিয়ে দিল। পুরো খামারঘরে সতর্কতা ছড়িয়ে পড়ল।
অর্ণব জানত, আর সময় নেই। সে দৌড়ে বাইরে এলো, সুব্রতকে টেনে নিল। দু’জন মিলে অন্ধকারে দৌড়াতে লাগল। চারপাশ থেকে আলো জ্বলে উঠছে, লোকজন চিৎকার করছে।
তারা ঝোপঝাড় ভেদ করে নদীর দিকে দৌড়ালো। পেছনে গুলি ছুটছে। একবার গুলি খুব কাছে এসে পাথরে লাগল, স্ফুলিঙ্গ উড়ল।
অর্ণব চিৎকার করে বলল,
—“নদীতে ঝাঁপ দাও!”
দু’জন একসঙ্গে ঝাঁপ দিল নদীর ঠান্ডা জলে। প্রবল স্রোত তাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেল। বন্দুকের গুলি পানির ভেতর থেমে গেল।
কয়েক মিনিট পর তারা দূরের ঘাটে উঠে এল। ভিজে শরীর, হাঁপ ধরা নিঃশ্বাস। সুব্রত বুকের কাছে ফাইল চেপে ধরেছে।
—“আমাদের হাতে ফাইল আছে!”
অর্ণব মাথা নেড়ে বলল,
—“হ্যাঁ। কিন্তু এখনো শেষ হয়নি। ওরা জানে আমরা বেঁচে আছি। এখন গোটা শহর জুড়ে আমাদের খোঁজ চলবে।”
সুব্রত কাঁপা গলায় বলল,
—“তাহলে আমরা কার কাছে যাব? পুলিশ তো ওদের লোক।”
অর্ণব ঠান্ডা চোখে তাকাল।
—“সব পুলিশ ওদের লোক নয়। শহরে একজন আছেন যাকে আমি বিশ্বাস করি।”
সুব্রত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
—“কে?”
অর্ণব একদম ধীরে বলল,
—“ডিএসপি অঞ্জনা সেন। আর্মিতে থাকাকালীন আমি তাকে চিনতাম। যদি কেউ ফাইলটা সত্যিকারের প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে, তিনি পারবেন।”
ভোরের আলো ফোটার আগেই তারা পৌঁছাল শহরের এক প্রান্তে ডিএসপি’র বাংলোয়। অর্ণব দরজায় টোকা দিল। ভেতর থেকে কড়া গলা—
—“কে?”
অর্ণব উত্তর দিল,
—“পুরনো বন্ধু।”
দরজা খুলে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে অঞ্জনা সেন—কড়া চেহারা, চোখে দৃঢ়তা। অর্ণবকে দেখে চমকে উঠলেন, তারপর মৃদু হাসলেন।
—“অর্ণব দত্ত! তুমি এখানে?”
অর্ণব ফাইল এগিয়ে দিল।
—“এই শহরের ভবিষ্যৎ এর ভেতর লুকানো। আর এর জন্য ইতিমধ্যেই খুন হয়েছে।”
অঞ্জনা ফাইল হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলেন। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তার চোখে ভয় আর ক্রোধ মিলেমিশে গেল।
—“ওরা এত বড় ষড়যন্ত্র করছে? এটা থামাতেই হবে।”
অর্ণব গম্ভীর গলায় বলল,
—“কিন্তু তোমাকে সতর্ক থাকতে হবে। তোমার চারপাশেও ওদের লোক আছে।”
অঞ্জনা মাথা নেড়ে বললেন,
—“আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছে ওরা। কিন্তু এবার যুদ্ধ হবে।”
অর্ণব শান্ত গলায় বলল,
—“যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।”
বাইরে তখন সূর্য উঠছে। চন্দ্রপুর শহর জেগে উঠছে। কিন্তু শহরের অচেনা আকাশে অদৃশ্য যুদ্ধের প্রথম রক্তপাত ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।
পর্ব ৬ : যুদ্ধের প্রস্তুতি
ডিএসপি অঞ্জনা সেনের বাংলোর ভেতর বাতাস ভারী হয়ে আছে। টেবিলের ওপর রাখা ফাইলের পাতাগুলো আলোয় ঝলমল করছে। ভোরের আলো জানালা দিয়ে ঢুকেছে, কিন্তু ঘরের ভেতর আলোয় নেই কোনো শান্তি। অঞ্জনা ফাইল উল্টেপাল্টে দেখছেন, তাঁর কপাল কুঁচকে আছে। অর্ণব দাঁড়িয়ে আছেন জানালার কাছে, বাইরের রাস্তায় নজর রাখছেন। সুব্রত চুপচাপ কোণের চেয়ারে বসে আছে, চোখে ক্লান্তি আর আতঙ্ক।
অঞ্জনা অবশেষে ফাইল বন্ধ করলেন।
—“তুমি যা এনেছো, এটা বিস্ফোরক। শুধু শহর নয়, পুরো রাজ্য নড়বড়ে হয়ে যাবে যদি এটা প্রকাশ্যে আসে।”
অর্ণব শান্ত গলায় বলল,
—“সেই কারণেই খুন হয়েছে। ওরা চায় না কেউ এই প্রমাণ দেখুক।”
অঞ্জনা গভীর নিঃশ্বাস ফেললেন।
—“প্রজেক্ট সানরাইজ—বিদেশি অস্ত্র কোম্পানি আর স্থানীয় রাজনীতিবিদদের আঁতাত। আমি শুনেছিলাম গুজব, কিন্তু এত প্রমাণ আগে হাতে পাইনি।”
সুব্রত ভয়ে ভয়ে বলল,
—“তাহলে আমরা এখন নিরাপদ?”
অঞ্জনা মাথা নাড়লেন।
—“না, বরং এখন তোমরা আরও বড় বিপদে। ওরা জানে তোমাদের কাছে ফাইল আছে। তোমাদের শেষ করতে ওরা কোনো কিছু বাদ দেবে না।”
অর্ণব ঠান্ডা স্বরে বলল,
—“তাহলে পাল্টা আঘাত করতে হবে।”
অঞ্জনা উঠে দাঁড়ালেন।
—“আমার দফতরে কিছু অফিসার আছে যাদের আমি বিশ্বাস করি। সংখ্যায় কম, কিন্তু ওরা সৎ। আমাদের একটা দল গঠন করতে হবে। সরাসরি আক্রমণ করলে জেতা যাবে না, তাই প্রথমে প্রমাণগুলো জনসমক্ষে আনতে হবে।”
অর্ণব মাথা নেড়ে বলল,
—“ঠিক। কিন্তু ফাইলই একমাত্র প্রমাণ নয়। আমাদের আরও দরকার। গুদামঘরের ছবির মতো, খুনের সাক্ষ্য।”
সুব্রত কেঁপে উঠল।
—“আমিই তো সাক্ষী।”
অঞ্জনা দৃঢ় গলায় বললেন,
—“হ্যাঁ, কিন্তু তোমাকে বাঁচিয়ে রাখা সবচেয়ে কঠিন কাজ। যদি তুমি মরে যাও, ফাইলটাও অর্থহীন হয়ে যাবে।”
অর্ণব বলল,
—“তাহলে আমাদের পরিকল্পনা দু’ভাগে ভাগ করতে হবে। এক, সুব্রতকে লুকিয়ে রাখা। দুই, ওদের আসল কেন্দ্র ভেঙে প্রমাণ আরও সংগ্রহ করা।”
অঞ্জনা কিছুক্ষণ ভেবে মাথা নেড়ে রাজি হলেন।
—“আমি সুব্রতকে নিরাপদে রাখব। তুমি আর আমি যাব ওই কেন্দ্রের খোঁজে।”
দিন গড়াল। অঞ্জনা তাঁর বিশ্বস্ত চারজন অফিসারকে গোপনে ডেকে আনলেন। একজন ছিলেন ইন্সপেক্টর সমরেশ—দৃঢ়চেহারা, গম্ভীর। আরেকজন সাব-ইন্সপেক্টর নাসির, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আছে। বাকি দু’জন কনস্টেবল, যারা ছোটবেলা থেকেই অঞ্জনার সঙ্গে কাজ করছে।
অফিসাররা ফাইল দেখে স্তম্ভিত। সমরেশ বলল,
—“ম্যাডাম, যদি এটা সত্যি হয়, তাহলে শহরের অর্ধেক নেতা-মন্ত্রী জড়িত।”
অঞ্জনা গম্ভীর গলায় বললেন,
—“সেই কারণেই আমাদের সাবধানে এগোতে হবে। সরাসরি ধরা দিলে আমরা শেষ।”
অর্ণব টেবিলে হাত রাখলেন।
—“আজ রাতে খামারঘরে আরেকটা চালান যাবে। আমি ভেতরে ঢুকে আরও প্রমাণ আনব। তোমরা বাইরে প্রস্তুত থাকবে।”
নাসির চিন্তিত গলায় বলল,
—“কিন্তু যদি ধরা পড়ে যান?”
অর্ণব ঠান্ডা গলায় বলল,
—“ধরা পড়তে আমি শিখিনি। ধরা দিতে হলে ওদের আগে মরতে হবে।”
ঘরে মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধতা। সুব্রত অবাক হয়ে তাকাল, অর্ণবের চোখে কোনো ভয় নেই। শুধু অদ্ভুত এক শান্ত দৃঢ়তা।
সন্ধ্যা নামল। শহরে পুজোর আলোর মতো রঙিন বাতি জ্বলছে, কিন্তু অন্ধকার গলি ভরে গেছে সন্দেহে। অঞ্জনা তাঁর বাংলো থেকে সুব্রতকে অন্যত্র পাঠালেন। সমরেশ আর নাসির তাকে নিরাপদ জায়গায় রাখবে।
অর্ণব আর অঞ্জনা প্রস্তুত হলেন অভিযানের জন্য। অর্ণব কোমরে পুরনো সার্ভিস পিস্তল রাখল, যেটা আর্মি ছাড়ার সময় সে সঙ্গে এনেছিল। অঞ্জনার হাতেও রিভলভার।
দু’জন নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন পুরনো সেতুর দিকের খামারঘরে।
খামারঘর এবার আরও শক্ত পাহারায় ঘেরা। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে অন্তত পনেরো জন। ট্রাকগুলো লোড হচ্ছে। কালো কোটওয়ালার গাড়িও সেখানে দাঁড়িয়ে। অন্ধকারে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু উপস্থিতির আভা চারদিকে ছড়িয়ে আছে।
অর্ণব ফিসফিস করে বলল,
—“আমাদের ঢোকার পথ একটাই—ছাদের ভাঙা দিক।”
দু’জনে গোপনে পেছনের দিক দিয়ে উঠতে লাগলেন। লোহার সিঁড়ি ভাঙা, কিন্তু অর্ণব সাবলীলভাবে এগোল। অঞ্জনাও পিছনে এলেন। তারা ছাদের ভাঙা অংশ দিয়ে ভেতরে তাকালেন।
ভেতরে বড় টেবিলের ওপর কয়েকটা ফাইল, সঙ্গে কিছু অস্ত্রের নকশা। চারপাশে লোকজন পাহারা দিচ্ছে। কালো কোটওয়ালা টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে কারো সঙ্গে ফোনে কথা বলছে।
—“হ্যাঁ, চালান ঠিক সময়ে বেরোবে। আগামী সপ্তাহে বিদেশি ক্রেতারা আসছে। প্রজেক্ট সানরাইজ তখন আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে।”
অঞ্জনার চোখ রাগে জ্বলছে।
—“এই নোংরা লোকগুলো…”
অর্ণব শান্ত গলায় বলল,
—“আমাদের প্রমাণ চাই। ছবি তুলতে হবে।”
অঞ্জনা পকেট থেকে ছোট ক্যামেরা বের করলেন। দু’জনে নিঃশব্দে ভেতরের দৃশ্য রেকর্ড করতে লাগলেন। সব প্রমাণ ধরা পড়ছে—অস্ত্রের চালান, বিদেশি কোম্পানির নাম, স্থানীয় রাজনীতিবিদদের উল্লেখ।
হঠাৎই এক পাহারাদার উপরে তাকাল। তার চোখে পড়ল ছাদের ফাঁক।
—“ওইখানে কে?”
অর্ণব ঝাঁপিয়ে পড়ল। ছাদ থেকে সোজা নিচে নেমে এসে লোকটাকে আছাড় মারল। মুহূর্তেই চারদিকে চিৎকার শুরু হলো। বন্দুক তোলা হলো।
অঞ্জনাও নিচে লাফ দিলেন। দু’জন মিলে আড়াল নিয়ে গুলি চালালেন। গুদামঘর ভরে গেল গুলির শব্দে। কাঠের বাক্স ভাঙল, আলো নিভে গেল।
কালো কোটওয়ালা পেছনে সরে গেল, চিৎকার করে বলল,
—“ওদের বাঁচতে দিও না!”
অর্ণব বিদ্যুতের মতো নড়ল। একে একে তিনজনকে ফেলে দিল। কিন্তু শত্রুরা সংখ্যায় অনেক। অঞ্জনা সাহসের সঙ্গে লড়ছেন, কিন্তু চারদিক থেকে গুলি আসছে।
অর্ণব তার হাত ধরে ফিসফিস করে বলল,
—“এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে মরব। আমাদের বেরোতে হবে।”
তারা দৌড়ে বেরিয়ে এল পেছনের দরজা দিয়ে। পেছনে শত্রুরা তাড়া করছে। বাইরে ট্রাকগুলোর হেডলাইট জ্বলছে।
অর্ণব দৌড়ে একটি ট্রাকে উঠে ইঞ্জিন চালু করল। অঞ্জনাও উঠে এলেন। গিয়ার চেপে ট্রাককে সামনে ছুটিয়ে দিল। বন্দুকের গুলি কাঁচ ভেদ করে ঢুকল, কিন্তু তারা ছুটে চলল অন্ধকার রাস্তায়।
রাতের রাস্তায় ট্রাক ছুটছে। সুব্রত নিরাপদ জায়গায়, সমরেশ ও নাসির পাহারা দিচ্ছে। আর অর্ণব ও অঞ্জনা মৃত্যুর মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে।
অঞ্জনা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
—“আজকের প্রমাণ যথেষ্ট। কিন্তু যুদ্ধ কেবল শুরু হলো।”
অর্ণব চোখ সরু করে বলল,
—“হ্যাঁ। কালো কোটওয়ালা জানে আমরা ওর পেছনে আছি। এবার সে আরও হিংস্র হবে। যুদ্ধ আসলেই শুরু হলো।”
দূরে শহরের আলো জ্বলছে। কিন্তু সেই আলোয় নেই কোনো নিরাপত্তা। আছে কেবল অদৃশ্য শত্রুর ছায়া।
পর্ব ৭ : ডানার নীচে তলপাত্র
তারা তিনদিন ধরে ঘুমোয়নি—অল্প কয়েক ঘণ্টার ঝিমে ভোর হয়ে ওঠে আর কাজ শুরু হয়। শহরের অচেনা কফিহাউসে আড্ডা, টেবিলে ছড়িয়ে থাকা নকশা আর ফাইল-পেপার—এই অদ্ভুত মিশ্রণই এখন তাদের যুদ্ধ কৌশল। অঞ্জনা সেন, অর্ণব দত্ত, ইন্সপেক্টর সমরেশ—তিনজনের মধ্যে রণনীতির হাতুড়ি চলে যাচ্ছে। শহরের যাকে–কে দেখা যায় এমন ছোট ছোট লোকজনদের কাছে তারা খবর জোগাড় করেছে, রাতের চালান কারা চালায়, গুদামে কোন ট্রাকে কী বোঝাই হয়—সবই তালিকা করা হয়েছে।
সমরেশ বলল,
—“ওরা চারটি প্রধান চালান রুট ব্যবহার করে: দক্ষিণ সেতু, পূর্বের খাল, উত্তর পয়েন্ট আর পুরনো থানা পাথ। আমরা যদি একটায় হানা দিতে পারি, ওদের লজিস্টিক কাটা যাবে।”
অর্ণব ঘাড় টিপে বলল,
—“পছন্দ করছি—নদীর দক্ষিণ সেতু। ওই পথ থেকে রাতের অন্ধকারে বড় চালান চলে। আমরা সেখানে ওদের কেড়ে নিতে পারি—একটু ভেতরের গুদাম, আর ওদের রেজিস্ট্রেশন লেজার যেখানে থাকে।”
অঞ্জনা কণ্ঠ স্বল্প করে বলল,
—“তুমি জানো, রাজনীতিবিদের নামও এই ডকুমেন্টে আছে। যদি আমরা সেদিকে এগিয়ে যাই, এটি কেবল একটি অপরাধী নেটওয়ার্ক ভাঙবে না—জাতীয় স্তরের কেলেঙ্কারি ফেটে পড়তে পারে।”
তাদের চোখে দৃশ্য রেখা—আছে নৈতিকতার আভাস, আছে ভয়ও। কিন্তু সবাই রাজী। কারণ আর সুযোগ ছিল না: যারা ক্ষমতার গায়ে লেগেছে তারা এখন অস্ত্র বানাচ্ছে, মানুষের জীবনকে ব্যবসার অলংকার বানাচ্ছে।
রাত নেমে এলো। পরিকল্পনা স্পষ্ট: অঞ্জনা একটি দল লোক নিয়ে সরাসরি বাহিরে থেকে নজর রাখবে, সমরেশ একটি টিম নিয়ে সেতুর কাছে ফাঁকি মেরে পুল কেটে রাখবে, আর অর্ণব ও দুই জন আলাদা রুট ধরে গুদামের পিছন থেকে ঢুকবে। এ বার তারা শুধু ফাইল বা নকশাই নয়—চালান লোডিং লিস্ট, বিদেশি সংস্থার কাগজ, এবং যাদের নাম উল্লিখিত—সব কিছুর প্রমাণ পাবার চেষ্টা করবে।
অর্জিত অন্ধকারে তারা কেবল ছায়া। নদীর ওপারে গাঢ় কালচে ট্রাক সারি, পাহারাদার খুঁজি অবস্থায়। গুদামটি ছিল একেবারে নদী ধারের পাকা মাচা—ওখান থেকে সরাসরি লঞ্চে করে ইলিগ্যাল চালান তোলা হতো।
অর্ণব প্রথমে এসে দাঁড়াল নির্দিষ্ট ভাঙা সিলিন্ডারের কাছে; তার চোখ ছোট করে সে সব চিহ্ন পড়ল—টায়ার ছাপ, কনটেইনার নম্বর, বদলে যাওয়া তালা ব্যান্ডের দাগ। তার হাতে এখন আগে করা কিছু ছবি ও নকশা। ঝোপের ভেতর থেকে সমরেশ ইশারা করল—পুজার আলো জ্বলছে না, তাদের পালা সুবিধাজনক।
তারা ঢুকলে ভেতর থেকে শব্দ—টিনের কড়া, মানুষের চড়ক, কারওর হাসি—কিন্তু সবাই ব্যস্ত। অর্ণব অচেনা পথে এগোয়, নীরবতা ধরে। তার দিকে এসে সে দেখে একটি ছোট অফিস কেবিন—ফাইলগুলোর শেষ স্থান। দাঁড়িয়ে থাকা পাহারাদারের পকেটে ফোন, তালার কাছে সেই একই লাল স্টিকার—“Project Sunrise”–এর চিহ্ন।
অর্ণব আরেকবার কানে আন্দাজ করে শুনল—দু’জন পালক বাইরে রেকর্ড করছে, একলা লোক অফিসে বসে কাগজ জোটাচ্ছে। নিয়মিত ভিড় কমছে—সঠিক সময়।
হঠাৎ লোকটি উঠে গেল টেবিল থেকে। অর্ণব আড়ালে লুকিয়ে ধীরে ধীরে নেমে এসে তার কাঁধে হাত রাখল—হিমাগারে ভিজে মাছের মতো ছোঁয়া—আর লোকটি থমকে গেল। অর্ণব শান্ত কণ্ঠে বলল,
—“শান্ত থাকুন। আপনি ব্যবসায়ী নন—আপনি কেবল নাম্বার-রেকর্ডার।”
লোকটির চোখে ভয়ের উল্কি দেখা গেল। সে ফিসফিস করে বলল,
—“কিছু জানি না… শুধু অন্যদের চলতি নাম-নাম্বার পাঠাই।”
অর্ণব বলল,
—“তুমি আমাদের কথা বলো—তুমি বাঁচো।”
সে নাম ও সাপ্লাই লিস্ট কথা খুলে দিল—কোথা থেকে কি আসে, কোন রাতগুলো সব যায়, কাদের কাছে পৌঁছে—সবই। অর্ণব চুপচাপ নোট করল। তারপর লোকটিকে চুপ করিয়ে রেখে কেবিনের তালা খুলে ফেলল।
কেবিনে ঢুকে অর্ণবের চোখ পড়ল ম্যানিফেস্টে—একটি লিস্ট যার প্রতিটি সারিতে বিদেশি কোম্পানির নাম, পণ্য কোড, এবং একটি নাম বারবার—“মালব্যা হোল্ডিংস”। পাশাপাশি একটি ছোট খামে দরকারি নথি—একটি ব্যাংক ট্রান্সফার রশিদ যার মধ্যে উল্লেখিত কর্তৃপক্ষের নামগুলি স্পষ্ট। অর্ণব দ্রুত সেই কাগজগুলোর ছবি তুলল। ফোনের ফ্ল্যাশ কেবলমাত্র কেবলমাত্র—সেই ফ্ল্যাশই তাদের জীবনরেখা হতে পারে।
ঠিক তখনই বাইরে ভাঙা কাচে প্রতিধ্বনি—পাতালের কোনা থেকে গাম্ভীর্যের আওয়াজ—পালকরা সন্দেহ করল। ঘটনাচক্রে বাইরে রুমের আলো জ্বলল। সমরেশের টিম সম্ভবত বাহিরে কিছুকাল ধরে নজর দিচ্ছে—তারা সঙ্কেত দিল।
অর্ণব জানল, এখান থেকে বেরোনো ঝুঁকিপূর্ণ হবে। সে নীরবে কাগজগুলি কাঁধে সোনার মতো চেপে ধরল—আর ততক্ষণে দরজার দিকে ধ্বনি বেশি জোরে এলো। চারপাশে লোকেরা গুঞ্জন করতে শুরু করল।
হঠাৎই ব্যাকডোর থেকে একটি ছায়া ছুটে এসে প্রবেশ করল—সে ছিল কোর্ট-চেহারার এক লম্বা ব্যক্তি, মার্জিত কোট, ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি—কালো কোটওয়ালাই। তার চোখ তাদের পেছনে ভাসছে।
—“তোমরা খুব সাহসী,” সে বলল, “কিন্তু সে সাহসটা আজ তোমাদের বিনাশ করবে।”
অর্ণব ঘুরে দাঁড়াল—তার হাতে নথি, তার গলা শীতল।
—“তাই হলে দেখাও।”
তখনই বাইরে তীব্র শব্দ—কারো গাড়ি থামল না, বরং হর্ন নেই; বারান্দায় কেউ এসে বলতে থাকল—“এই দিকে! এখানে চোর!”
বহুবিধ কণ্ঠ, বহুবিধ পদক্ষেপ—এ যেন ডানার নীচে থাকা তলপাত্র থেকে গরম বুদবুদ ফুটে উঠছে—সব কিছুই এখন ফেটে পড়বে।
অর্ণব হাতে তুলে কাগজের মুখ দেখাল। কালো কোটওয়ালার ঠোঁট কুঁচকে উঠল।
—“আজ তুমি জানলে ভালো হলো,” সে বলল, “কিন্তু জানাটা আর ডাকাটা এক নয়।”
সমরেশ কণ্ঠ করে—“এবারই আমরা তাদের ঘাড়ে চেপে দিই।”
তারা জানে—এ লড়াইয়ের পর আর ফিরে যাওয়ার পথ থাকবে না। যেকোনো দিকে ঝাঁপ দিলেই বাৎসরিক শক্তি পুড়িয়ে দেবে। অঞ্জনা ঝুঁকে ছবি কিলেক করে তুলছে—চেয়ার, টেবিল, ব্যাঙ্ক রসিদ—সবই ক্যামেরায় ঢুকে পড়ছে।
আর ভেতরের অন্ধকারে, ডানার নীচে তলপাত্রে চাপা থাকা সব গল্প—এবার ধীরে ধীরে উপরে উঠে আসছে।
পর্ব ৮ : ফাটল
ঘরের ভেতরকার হট্টগোল কানে আসার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশে অর্ধেক লোক মিশে গেল—চেয়ারের কণ্ঠ, কাগজের খসখসানি, মানুষের সমস্ত ভাঙচুর। অর্ণব ঘাড় শক্ত করে দাঁড়াল, হাতে চেপে থাকা কাগজগুলো নির্দেশবাহী—ব্যাংকের রসিদ, বিদেশি ঠিকানাসমূহ, এবং সেই লাল সিলটা, যা এখন আর গুটিয়ে রাখা যাবে না। কালো কোটওয়ালা তার খাস্তা কণ্ঠে বলল, “তুমি যদি এই কাগজগুলো মিডিয়াগুলোতে ছড়িয়ে দাও, তোমাদের আর কোনো শহর থাকবে না।” অর্ণব কোনো উত্তর দিল না—তার কণ্ঠে কোনো অভিযো্গ নেই, শুধুই বাস্তবতার ঠাণ্ডা সত্য। তিনি জানতেন কথা কম বললেই ভালো; কাজ বেশি করলেই ফল পাওয়া যায়। কাজটা তখনই দরকার—ক্যামেরার ভিতরে ঢুকে পড়া অঞ্জনার চিত্রগুলো, সমরেশের দল বাইরে প্রস্তুত—সব কিছুকে একসাথে মিলিয়ে দাঁড়াতে হবে।
ঘরের দরজা ভেঙে বাইরে চিৎকার—“চোর! হাততালি! পুলিশ!”—এ কথা যেন আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল। অন্ধকারের ভেতর থেকে মেশিনের শব্দের মতো পা চলল। অর্ণব দ্রুত কাগজগুলোর এক সেট নিজের জ্যাকেটে ভরে নিল, আর অন্য সেট অঞ্জনার হাতে ধরাল। অঞ্জনার মুখ কড়া, চোখে ক্ষুধা নয়; আছে কাজ সম্পন্ন করার বিষয়ে এক মিশিত দৃঢ়তা। সে দ্রুত ক্যামেরার মেমরি কার্ড বের করে কাগজের ছবি খুঁটিয়ে দেখে নিল। ছবিগুলো নরমালি পরপর যাচ্ছিল—প্রতিটি লাইন, প্রতিটি নাম, প্রতিটি ট্রান্সফার—সবই ক্যাপচার হয়ে গেছে।
তাদের পরিকল্পনা ছিল গোপনে নীরবে বেরিয়ে আসার; কিন্তু পরিকল্পনা কখনই পুরোপুরি ঝুঁকি মুক্ত হয় না। কেবিনের বাইরে শোরগোল বাড়ছে। কালো কোটওয়ালা একহাতে ফোন চেপে বলছিল—“সিড়ি বন্ধ করে দিতে বলো; বাইরে থেকে কারও ঢোকা বন্ধ রাখতে হবে।” কিন্তু বাইরে সমরেশের মানুষের এক ঝাঁক ইতিমধ্যে এক পালা সেতুর দিকে ঘিরে ফেলেছে। তাদের সঙ্কেত এলে অর্ণব জানল যে বারান্দায় থাকা গাড়ি একগোপন সংকেত পাঠায়—এখনই পিছু হটো।
অল্পের জন্য তারা বেরিয়ে এল—দু’জন দু’জন করে, গভীর ছায়ায় মিশে। নদীর কিরণ দূরে টলমলে লাগছিল, শহরের আলো মাল্লার মতো ঝলমল করছে। একসঙ্গে ছুটে ছুটে তারা পৌঁছাল গাড়িতে; সমরেশের টিম তাদের জন্য সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে। ট্রাক স্টার্ট করল; কিন্তু যতদূর গেল, তত বেশিই মনে হলো—কেউ তাঁদের পাঠিয়ে দিয়েছে না, কেউ তাদের অপেক্ষায় ছিল না; তারা একা ছুটছে শহরের মধ্য দিয়ে, হাতে এমন প্রমাণ যা যদি বিতর্কিত হয়নি, তাহলে হয়ত কেউ বিশ্বাসও না করত।
পরের দিন সকাল-সকাল চন্দ্রপুর সিবিধানে এক অচেনা গহ্বর ফেটে গেল—একটি সাংবাদিক পত্রিকা ছবিগুলি ছাপল, হেডলাইন বড় আকারে—“প্রজেক্ট সানরাইজ: অস্ত্র কিন্ডারগার্ডি?” পত্রিকার পাতায় নামগুলো ছাপা হল, রশিদগুলো প্রকাশিত হল, এবং সেই সঙ্গে একটি ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হল—অঞ্জনার ক্যামেরায় ধারণকৃত, যেখানে একজন উচ্চপদস্থ লোক বিদেশি কোম্পানির প্রতিনিধির সঙ্গে ফোনে হাসছেন। শহর জেগে উঠল। কালো কোটওয়ালার লোকজন শুরু করল প্যানিক; যে শক্তির ওপর তারা নির্ভর করছিল, তারই একজন তার আঙুল তুলল—“ফাঁকা হবে না, কাউকে ছাড়ব না।”
অন্তত জনমানসে ঝটকা লাগল। বাজারে মানুষ আলোচনা করতে শুরু করল। রাজনীতিবিদদের কড়া চাহনি। কিন্তু এই গণআন্দোলনই ছিল তাদের সেরা অস্ত্র—যদি তারা পারত পেতে মিডিয়াকে, জনগণকে, আইনের চোখে সত্যটা রাখত। অঞ্জনা জানতেন এটা—তাই তিনি হুমকির মুখে বাড়তি সাহস পেয়েছিলেন। তিনি থানায় গিয়ে সেইসব কাগজের একটি কপি জমা দিলেন উচ্চতর দফতরে, যেখানে ক্ষমতার হাত কম কিছুটা ছোঁয়ার শক্তি ছিল।
কিন্তু কালো কোটওয়ালার নেটওয়ার্ক পাল্টা আঘাত করতে পিছপা হল না। রাতেই একটি আচমকা হামলা হল—ডিএসপি অঞ্জনার বাংলোর সামনে। দু’একটা অজ্ঞাত গাড়ি এসে দাঁড়াল, কাঁচ ভাঙা হলো, কয়েকজন বন্দুকধারী ঢুকল। তারা খুঁজতে লাগল—“অর্ণব ও সুব্রত কোথায়?”—প্রশ্নটি ছিল স্পষ্ট, তাই-ই ছিল তাদের লক্ষ্য। অঞ্জনা তার অফিসারদের দিয়ে দ্রুত লুকোচুরি করালেন, কিন্তু জানা গেল একটি লিক হয়েছে—কোনো ডিটেইল জারি হয়েছে, এবং তারা জানে ঠিক কোথায় সন্ধান করতে হবে।
অর্ণব বুঝলেন—কেউ পুলিশের ভেতরেই তথ্য ফাঁস করছে। সমরেশের চোখে তখনই সন্দেহ জাগল; তিনি যে নির্বিকার চেহারা দেখান, হঠাৎই তিনি গোলমাল ছুঁড়লেন—“কেউ আমাদের ট্রেস করছে। থামব না, কিন্তু এখন সাবধান হতে হবে।” অর্ণব জানতেন এই ধরণের বঁটায় বলা সহজ—কিন্তু যা করতে হবে, তা কঠোর ছিল। তিনি জানতেন একটাই পথ—বাইরের হাতে থাকা মিডিয়া আর ভিতরের বিশ্বাসী অফিসারদের মিলে তাদের হাত শক্ত করাতে হবে।
সেইই রাতের ভোরে যখন তারা কেবল বিশ্রাম নিল, সুব্রত বাথরুম থেকে জামা খুলে বেরোতে গিয়েই লক্ষ্য করল কাঁধে একটা ছাপা দাগ—কেউ তাঁকে রাতেই তাড়া করেছিল। সে কাঁপতে কাঁপতে জানাল—“কারো একটা ছায়া ছিল—চশমা পরা, নামাজি সাদার টুপি পরে—আমি চিনতে পারিনি।” অর্ণব কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে দেখি—এই তথ্যটি যে পুলিশের ভিতর থেকেই আসতে পারে, তা তাঁর ধারণাকে আরও শক্ত করে দিল।
পরদিন শহরের খবরপত্রিকাগুলো জোরে উঠল—কেউ বড় মাপের মোবাইল ফোন হ্যাক করে এমন কিছু বার্তা সংগ্রহ করছে যেখানেই দেখিয়েছে যে এক কনস্টেবল, স্থানীয় থানার একজন, নিয়মিত একটি ফোন নম্বরে রিপোর্ট পাঠায়। নামটি ছিল ছোট্ট, কিন্তু সিগনেচার দেখে বোঝা গেল—কথা সত্যি। সমরেশ জানতে পারলেন যে পুলিশের ভিতরেই কেউ কাজ করছে—আর সেই লিকেই বড় মালিকরা সক্রিয় হচ্ছে।
অর্ণব আর অঞ্জনা বসে একসঙ্গে টেবিলে দেখলেন—চেয়ারে থাকা কাগজগুলোর ওপর শহরের মানচিত্র, উদ্ধারকৃত ফাইলের কপি, এবং ফোনের কল-রেকর্ড। অঞ্জনা বলেন, “ফাটল গেঁথে গেছে—আমরা সেই ফাটলে ঢুকে না করলে সবই ছাপ খাবেই।” অর্ণব ধীরে বলল, “এখনই দরকার নতুন কৌশল: ভেতরের মানুষকে বের করে আনা, আর বাইরে মিডিয়ার চাপ। কিন্তু আগে—যে পুলিশ আমাদের মধ্যে বিশ্বাস করে, তাকে খুঁজে বের করতে হবে।”
আর সেই সন্ধিক্ষণে, অর্ণব চুপচাপ জানাল—“আমি এক জনকে চিনি—একজন সাবেক সিআইডি অফিসার, নাম হেমন্ত রায়। তিনি এখন অবসরে, কিন্তু কায়দা জানেন। যদি তিনি আমাদের সাথে থাকেন, তাহলে লিক ট্রেস করা সহজ হবে।” অঞ্জনা গতানুগতিক ভরসা পেলেন না; কিন্তু তিনি জানতেন—কখনও কখনও পুরনো জ্ঞানই সবচেয়ে শক্তিশালী।
শহরের আকাশে অন্ধকার বড়, ছাদের কোলাহল থেমে গেছে; কিন্তু মাটির ভেতরে ফাটলের আওয়াজ এখন বাড়ছে—বড় রক্তক্ষরণ, বড় অনিচ্ছাকৃত প্রকাশ। অর্ণব জানতেন, এই ফাটল একবার বড়ো হলে আর ঢেকে যাবে না। আর তাদের কাজটি ছিল সেই ফাটলকে আরও বিস্তার করা—ততক্ষণে কালো কোটওয়ালার নেটওয়ার্ক ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া।
তারা তিনজন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল—আগামী রাতে হেমন্তকে খোঁজা হবে, পুলিশ ভেতরকার বিশ্বাসী কাউকে খুঁজে বের করে ঐ বাতাসে ছড়ানো সব চেইন কাটতে হবে। কিন্তু অর্ণবের ভেতরে একটা আলাদা সেঁধ এসেছে—সত্যি লড়াই শুরু হলে যে কয়টা বন্ধন কেটে যাবে, তা আর ফিরবে না। তিনি সেই ভাঙনের প্রথম খিলান দেখতে পাচ্ছিলেন—এবং জানতেন, সেখানে আর পিছনে ফিরে যাওয়ার রাস্তা নেই।
পর্ব ৯ : হেমন্তের সাইরেন
শহরের সকাল ধীরে ধীরে ঘনীভূত কুয়াশায় মিলিয়ে যাচ্ছিল। অর্ণব, অঞ্জনা আর সমরেশ—তিনজনই জানল আজকের দিনগুলো তাদের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দিনের তালিকায় থাকবে। ফাইল ছড়িয়ে পড়েছে, মিডিয়া সক্রিয়, আর পুলিশের ভেতর ফাঁক আছে। এখন তাদের দরকার কেবল এক মুঠো পুরনো জ্ঞান ও একটি বিশ্বাসযোগ্য হাত — হেমন্ত রায়।
হেমন্ত ছিল সেই ধরনের মানুষ—অবসর নেওয়ার পরেও চোখে সেই সাদা ধোঁয়া, ঠোঁটে ক্ষুরধার চটক; একাধারে ঠাণ্ডা ও আশ্চর্যজনক স্মৃতি। অর্ণব জানে, এই মানুষটা কেবল কোর্টরুমের কাগজপত্র নয়—সে গোয়েন্দাগিরির পুরনো কায়দা জানে, লোক খুঁজে বের করার ট্যাকটিক, হ্যাকিং নয় অথচ ফোন-ট্রেসের মতো কাজটা কিভাবে করা হয়, তা বোঝে।
তারা হেমন্তকে খুঁজে পেলেন শহরের এক নীরব আবাসিক এলাকার এক পুরনো ফ্ল্যাটে—কম আলো, বইয়ের গুঁড়া, আর কফির কাপ। দরজা ঘড়ঘড় করে খুলতেই হেমন্তের চোখ দুই ছায়ায় ভেসে উঠল; মুখে অচেনা এক মৃদু হাসি।
—“অर्णব? এত বছর পর?” সে বলেই কিচ্ছু বললেন না, শুধু দৌড়ে এসে দুজনকে জড়িয়ে নিল। আগাগোড়া পরিচয়-পরিচয় না দিয়েই অর্ণব সরাসরি লোভ টেনে দিল:
—“হেমন্ত, আমাদের দরকার তোমার। একটা সিস্টেম আছে—প্রজেক্ট সানরাইজ—ব্যাপারটা বড়, নথি আছে, কিন্তু পুলিশের ভিতর কেউ ফাঁস করছে। তোমাকে চাই ফাঁস ধরতে।”
হেমন্ত প্রথমে চোখ উঁচিয়ে দেখলেন, তারপর নীরবে ঝাড়লেন সিগারেটের ছাই। তিনি চুপি চুপি একটা সিগারেট ধরালেন, ধোঁয়া ধীরে করে উপরের দিকে উঠল।
—“কেন তোমরা এসে আমার নাকের নীচে দুর্গন্ধ ছড়িয়েছো?” হেমন্ত জিজ্ঞেস করলেন। তারপর বেঁকে হেসে বললেন, “তুমি জানো, আমি আর নিয়মিত অফিস করছি না। কিন্তু বেশ—তোমাদের কাহিনি শুনি।”
তারা সবাই বসে গেল। অঞ্জনা ফাইল বের করে দিলেন—তাদের সংগ্রহ করা প্রমাণ, কাগজের কপি, রেজিস্ট্রেশন নং, ট্রান্সফার রশিদ। হেমন্ত চুপচাপ তা দেখলেন, প্রতিটি পাতায় চোখ বুলিয়ে একেকটা মন্তব্য করলেন—“এই ব্যাঙ্কটার লেজার ঠিক আছে”, “এই নামটা এখানে কখনও আসে না, এটা বাইরে থেকে ঢোকানো”। তিনি এক একটা জিনিস চিনতে পারলেন—একটি ধরণ ছিল, একটি সিগনেচার।
—“তুমি কি জানো,” হেমন্ত বললেন, “কেউ যদি পুলিশের ভেতর থেকে তথ্য ছড়ায়, তার ট্রেস সাধারণ কোনো আইনি রুটে পাওয়া যায় না। কিন্তু একটা দুর্বলতা থাকে—ট্রান্সমিশনলগ। কেউ যদি বারবার একই ফোন নম্বর থেকে রিপোর্ট পাঠায়, তার প্যাটার্ন পড়ে; আর প্যাটার্ন মানে লোক।” তিনি কাগজগুলি টেবিলে রেখে দিলেন।
সমরেশ কণ্ঠ করলেন—“আমাদের কাছে একই নাম এসেছে—কনস্টেবল রফিক। ফোন রেকর্ডে একটি নম্বর বারবার উঠে আসে। কিন্তু আমাদের কোন প্রমাণ নেই যে সে সরাসরি ফাঁস করছে।”
হেমন্ত চোখ ভাঁট করে বললেন, “প্রমাণই তৈরি করতে হবে। আমি তোমাদের সঙ্গে যাব। কিন্তু আমার শর্ত একটাই—আমি ড্রাইভিং, আমি ট্রেস, এবং কেউ আলোকচিত্র তুললে সেটা পরবর্তী আইনগত কাজের জন্য সুরক্ষিত থাকবে।” তিনি তাদের দিকে তাকিয়ে এক বিট কথায় লাফ দিলেন—“আর তুমি অর্ণব, তোমার কাজ লুকিয়ে রাখা, কোনো সন্দেহ ছড়াবে না।”
তারা প্রস্তুত হল। হেমন্ত ফোন দিলেন, ট্যাবলেট বের করলেন, অচেনা কয়েকটা সার্ভিস অ্যাক্সেস করে নিলেন—সেগুলো ছিল পুরনো কায়দা, আইনিভাবে নয়, বরং ‘কমর্পপ্রসিদ্ধ’ কৌশল। অঞ্জনা মৃদু কণ্ঠে বললেন—“সতর্ক থাকুন। আমরা চাই না আমাদের এই কৌশলগুলো ফাঁস হোক।” হেমন্ত হেসে বললেন—“আমি গোপন রঙ্গভূমির অনুশীলন করি।”
রাত নেমে এলো। অন্ধকার যেন শহরের বুকে একটা ঘা। তারা পৌঁছল সেই থানার কাছে—যেখানে সন্দেহ ছিল। হেমন্ত প্রথমেই বললেন, “আমি ফোন লগ করতে যাচ্ছি। তোমরা বাইরে থেকে আমাকে কোড সিগন্যাল দেবে।” সমরেশ আর অঞ্জনা প্রস্তুত। অর্ণব দূরে থেকে চোখ রাখবে।
হেমন্ত ধীরে ধীরে থানা ভবনের নিকটবর্তী একটি ছোট ক্যাফেরিয়ায় বসে গেলেন, ল্যাপটপ খুললেন। তিনি জানেন কিভাবে ছোট ছোট প্যাকেটগুলোকে টেনে আনা যায়—ইন্টারনেটে থাকা সিগনাল ট্রেসিংয়ের কৌশল, ফোন কোম্পানির রাউটিং পাথ খুঁজে বের করা। তিনি যখন কীবোর্ডে হাত রাখলেন, পুরো কক্ষের বাতাস বদলে গেল—নীরবতা ছলছল, এক ধরনের কেন্দ্রীয় প্রস্তুতি।
গণনা শুরু হলো—লগগুলো, পিং, আইপি, কনেকশন টাইমস্ট্যাম্প। হেমন্ত মৃদু বললেন—“এখানেই একটা প্যাটার্ন আছে। রফিক রাতে একই সময়ে লগইন করে একটি নির্দিষ্ট আইপি ব্যবহার করে তথ্য পাঠায়।” তিনি কিছু কোড রান করালেন, চোখে ঝিলিক। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তিনি বলে দিলেন—“আইপি এই, এড্রেস এ-৫৭-২৩—লোকাল নোড। আর তার সঙ্গে সংযুক্ত ফোন নম্বরটা এই—৯৮৭৬৫৪৩২১০।”
সমরেশ মৃদু অভিব্যক্তি করলেন—“এই নম্বর আমাদের লিস্টে আছে। কিন্তু এটা কিভাবে সম্পৃক্ত?” হেমন্ত উত্তর দিলেন—“এটাই দেখুন।” তিনি আরো খানিকক্ষণ ট্যাবলেটে কাজ করলেন। তারপর হঠাৎ টেবিলের কোণে রাখা মোবাইল রিং করল—একটি অজানা নম্বর। হেমন্ত অচেতনভাবে ফোন ধরলেন—এক মিনিটের ভেতরেই তার চেহারা বদলে গেল; সে ফোনটা থামিয়ে তাদের দিকে দাঁড়িয়ে বললেন, “ওরা জানে। আমরা ট্রেস করছি—কিন্তু এখন শত্রু সক্রিয়। কেউ পুলিশের ভেতরে সতর্ক করা হয়েছে।”
অর্ণব কণ্ঠ করলেন—“তাদের ধরা দরকার, এখনই।” হেমন্ত কাঁধ টিপে বললেন—“তোমরা যেতে পারো, কিন্তু সাবধানে। আমি তোমার পেছনে রয়েছি—এটা আরেক ধাপ। আমাদের দরকার বাস্তব হাতে প্রমাণ—কনস্টেবল রফিকের ফোনে থাকা মেসেজ, লগ। আর সেটা তুলতে হলে আমাদের তার মোবাইল এক্ষুণি কনফিসকেট করতে হবে—কিন্তু পুলিশ স্টেশন সেখানে আছে।”
অঞ্জনার চুমুক উঠল। “মানে?” হেমন্ত কণ্ঠে কড়া এক লাইন বললেন—“তার জন্য তোমাদের দরকার হবে টোপ-ড্রপ—একটি ভদ্রভাবে ইনফিলট্রেট করা অফিসার, যিনি রফিকের কাছাকাছি যেতে পারবে। হয়তো একটি হরাইজন্টাল কভার, হয়তো কাউকে সাংবাদিক বলে পাঠানো—কিন্তু আমি বলি, আমরা যদি আইন ধরতে চাই, আমরা আগে ভিতরের লুকোচুরি কাটাতে হবে।”
সমরেশ ভেবেবিচার করে বললেন—“আমাদের যেখানে বিশ্বাস আছে, ওঁইলেই কাজ হবে। আমি নাসিরকে পাঠাচ্ছি—সে সেই থানার লোকেদের সঙ্গে কাজ করেছে পুরনো কালে।” অঞ্জনা সম্মতি দিলেন। এবং অর্ণব নিজের মনেই বলল—“আমি রফিককে জিইয়ে ধরব।”
রাতটা যত এগোলো, ততেই শত্রুরা তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। হেমন্তের স্ক্রিনে আগমন-সংকেতগুলো লাইন ধরে বাড়তে লাগল। কোথাও না কোথাও একটু দূরে—কেউ তাদের কর্মক্ষেত্র ঘিরে তুলছে। অর্ণব জানল, এখন থেকে আর ভুলের কোনো জায়গা নেই; তাদের প্রত্যেকটি পদক্ষেপ ছিল কাঁচের মতো ভঙ্গুর—একটুখানি ভুলে সব ভেঙে পড়বে।
হেমন্ত ধীর কণ্ঠে বললেন—“শুরু করতে দাও।” তিনি হয়তো জানতেন, যেটা শুরু হবে, সেটা আর থামবে না—একবার সাইরেন বাজবে, চন্দ্রপুর উথালপাথাল হয়ে উঠবে।
পর্ব ১০ : সাইরেনের গর্জন
রাতের আবরণ কাটা মেঘে ঢাকা। শহর অচল, যেন নিঃশ্বাস থামিয়ে দাঁড়িয়েছে। হেমন্ত রায়ের অল্প আলোধরা ল্যাপটপের ফিড ঝড় তুলছে—আইপি পাথ, লগস্ট্যাম্প, কল-রাউটিং। তিনি নীরবে কাজ করছেন, পাটা ধীর, চোখে একটুখানি হঠাৎ উন্মাদনা। অঞ্জনা, সমরেশ ও অর্ণব এক কনিভারে দাঁড়িয়ে আছে—চশমার তলায় চোখগুলো ঝাপসা হলেও মন আগুনে পোড়া।
নাসির মাঠে ঢুকেছে কভার হিসেবে। সে একটা রিল গৃহীত কাগজপত্র নিয়েই থানায়। তার কাজ—রফিকের কাছে ঢোকে আর তাকে আস্তে করে টেনে আনে। নাসির চুপচাপ, কাজের মানুষ। সমরেশ তার দিকে একবার হাত নেড়ে বোঝাল—সময়।
হেমন্ত এক কথায় বলল, “রেড লাইন আরেকবার নেমেছে। রফিকের নম্বরটা active হচ্ছে—এটাই এখন আমরা ধরব।” তিনি কুরুক্ষেত্রের মতো চুপচাপ হচ্ছেন। অঞ্জনা কণ্ঠে বলল, “এবারই আমরা ধরি—এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় সুযোগ।”
তারা তিনটাও ভাগ্যে হাঁটল। প্রত্যেকের মুখে কোনো ভয় নেই; প্রত্যেকের ভেতরে আছে সেই স্বাভাবিক কড়া নির্দিষ্ট লক্ষ্য। অর্ণব বাইরে দাঁড়িয়ে সোয়েটার্-হুডটা ঝাকিয়ে নিলেন; ঠান্ডা বাতাসে তাকে শান্ত রাখে।
নাসির থানার ভেতর ঢুকতেই রফিককে খুঁজে পেয়েছে—ছোট কক্ষের এক কোণে বসে, চা গরম, মোবাইলে চট করে কিছু টাইপ করছে। রফিকের চোখে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি পেন্সিল দিয়ে কাগজে কিছু লিখছেন—কারো খাতা। নাসির ধীরে এগোরে, হালকা কণ্ঠে বলল, “রফিক ভাই, বাইরে একটা অনানুষ্ঠানিক মিটিং আছে—এক্সট্রা রিপোর্ট নেওয়ার জন্য একটু সাহায্য দরকার।” রফিকহাসি দিলেন, মাথা নেড়ে বললেন, “ঠিক আছে, চলে আসো।”
নাসির জানত—এখানেই ঝুঁকি। যদি রফিক সুকৌশলে কিছু টের পেয়ে যায়, সব ধ্বংস। কিন্তু তিনি চলবে। তার পকেটে এক সিগনাল যন্ত্র—হেমন্ত পাঠানো—চট করে অন্জনাকে জানাবে।
রফিক দাঁড়ালেন। নাসির ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে দিল। হেমন্ত শুঁকড়ে বলল, “এখন। মোবাইল জব্দ করো।” সমরেশ দ্রুততার সঙ্গে রফিকের মোবাইল তুলে নিলেন—চিন্তাতে না থেমে। রফিক প্রথমে কিছু বলল, প্রতিক্রিয়া দেখালেন—কিন্তু সমরেশ শান্ত।
হেমন্ত ল্যাপটপে কাজ শুরু করলেন। তিনি ফোনের মেসেজ, এ-মেইল, লগ—একটার পরে একটা টেনে আনছেন। “এটা দেখো,” তিনি বললেন, “এখানে একটি নাম বারবার এসেছে—একটি স্থানীয় একাউন্ট, এবং কনফিগারেশন হয়েছে ওই আইপি থেকে।” তিনি স্ক্রিন শো করে দেখালেন। নামটা সাধারণ—কোনো বড় রাজনীতিবিদের নামের চারদিকে নয়—কিন্তু তার কাছেই গেলে বোঝা যায়, সে নামের আড়ালে বড় শক্তি কাজ করে।
রাজনৈতিক নাম? অঞ্জনার কণ্ঠ কড়া হয়ে উঠল—“এটাই ওদের প্যাঁচ। এই সংবাদটা যদি আমরা সামনে আনতে পারি, ওরা ধ্বংস হবে।” হেমন্ত মাথা নাড়ে বলল, “কিন্তু প্রথম ধাপটা হল—রফিকের ফোন থেকে সরাসরি সেই SMS-লগ, সে যে নম্বরকে বারবার মেসেজ পাঠায়, সেই নম্বরের কল-রেকর্ড।” সমরেশ জবাব দিলেন, “আর তা হলে আমরা কোর্টে দাগিয়ে দিতে পারব।”
ঘণ্টা কেটে যাচ্ছে। বাইরে শহরের কোথাও কুকুর কানে চেঁচিয়ে ওঠে। হেমন্ত ধীর কণ্ঠে বললেন—“লগ কপি নিলাম। কিন্তু এখনই ওদের জানানো যাবে না। আগে আমাদের মিডিয়া-স্ট্র্যাটেজি করা দরকার—কৌঁসুলি বানিয়ে দাবী পেশ করতে হবে যাতে ওরা পালাতে না পারে।”
অপেক্ষা, আর অপেক্ষা। উন্মাদনাটা হেডফোনে। অর্ণব জানল—এভাবে বসে থাকা ভালো না। তিনি বাইরে গেলেন বলে একটা ঘনেস নেই। সালোক জ্বলজ্বল করছে। কোনো ক্ষণার্থে একটি মোবাইল ভাঙন্ত শব্দ—অভিযান শুরু।
বাইরে অন্ধকারের ভেতর তিনটি গাড়ি এসে দাঁড়ায়—একটা কভার হিসেবে। হেমন্ত ফোনে আভাস দিলেন—“এখন।” তিনি জানে—এটাই সেরা মুহূর্ত। নাসির কাঁধে হালকা চিহ্ন দিয়ে দরজা খুলল। রফিককে বললেন, “তুমি একজন আরেক অফিসারকে চিনি? আমরা চাই তোমার সহযোগিতা।” রফিক প্রথমে মন খারাপ করে, তারপর থরথর—সে বুঝে গেল।
রফিক কাঁপতে কাঁপতে বলল, “আমি তো…আমি তো…” তার কণ্ঠ ঘোলা। সবাই চুপ। সমরেশ থাম করে বললেন, “তুমি যদি সত্যি সাহায্য করতে চাও, ফোনটা আমরা কনফিসকেট করবো। মেসেজ বের করে নেবো। তারপর তোমার অংশ আমরা লিগ্যালভাবে কভার করবো।” রফিকের চোখে স্বল্প এক কাঁপ। তিনি অবশেষে ফোনটা তুলে দিলেন। নাসির সেটি সেফ বক্সে রাখলেন।
হেমন্ত তৎক্ষণাৎ ল্যাপটপ খুললেন। তিনি ফোনের ডাটা মাইক্রো-ইমেজ করে বাইরে হার্ডড্রাইভে কপি করলেন—অফলাইন কপি। ফোনে থাকা মেসেজগুলো পড়লেন। একটার পর একটা—কোডেড শব্দ, টাইমস্ট্যাম্প, একটা লিঙ্ক যা একটি দূরবর্তী নম্বরে নিয়মিত পাঠানো হচ্ছে। নামগুলো ঝুলছে—লজিস্টিক কোঅর্ডিনেট। হেমন্ত কন্ঠে বললেন, “এই হল। এই নম্বরটাই তাদের হাব। কল-রেকর্ড নিচ্ছি।”
বাইরেও আন্দোলন। সমরেশের টিম এখনই থানায় ঢুকছে। সমরেশ ভেতরে গড়িয়ে গিয়ে চশমার নিচে কড়া হয়ে বললেন—“এখানে মিডিয়া, ধরো, আর রফিক—তোমার সাথেই আমরা কাজ করব।” তিনি যেন জানতেন—এখানে খেলা বড়।
ঠিক তখনই হঠাৎ ফোনটা বাজল—একটা অচেনা নাম। হেমন্ত স্ক্রিন দেখে চোঁচে উঠলেন—“ওরা টপ করলো।” তিনি জোরে বললেন, “বাইরে শনিবারের মতো একটা জরুরি হর্ন বেজেছে—ওরা এখনই রেসপন্ড করছে।”
এক সেকেন্ড—সবাই হালকা কাঁপল। হেমিক টেবিল অবচেতন। সমরেশ চেয়ে দেখলেন—“ওরা আমাদের থামাতে চাইছে। আমরা এখনি মিডিয়া কন্টাক্টকে জানাবো।” অঞ্জনা দ্রুত তার ফোনে একটি সংবাদ সংস্থার এডিটরের নাম ডায়াল করলেন—তার কণ্ঠে কাঁপ নেই; সে কেবল তথ্য দিল, প্রমাণ পাঠানো হবে।
ওই মুহূর্তে আরেক দরজার বাইরে ধাক্কা। গলার আওয়াজ—“থানায় হামলা আছে। বাইরে কেউ সন্ত্রাসী ঢুকেছে।” যে সাউন্ডটা এসেছে, তা ছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত—পালানোর জন্য উপযুক্ত কভার।
হেমন্ত ঠাণ্ডা হাসি দিলেন—“তারা খেলেছে। কিন্তু আমরা প্যাঁচে ঢুকেছি।” তিনি একটি ব্যাকআপ কপি দূর এক সার্ভারে আপলোড করলেন—ব্যাকিং—আর এক মুহূর্তে সংবাদ সংস্থার ই-মেইলে ফাইলটি পাঠিয়ে দিলেন। “পাঠালো,” তিনি বললেন।
সেকেন্ড কয়েক পরে, বাইরে সাইরেন—দূরে দুটি গাড়ি এসে থামল না, বরং তাদের হর্ন বেজে উঠল। থানার বাইরে লোক জড়ো হতে শুরু করল। ফোনে, মেইলে, সোশ্যাল—প্রমাণ ছড়িয়ে পড়ল। কালো কোটওয়ালার নেটওয়ার্ক প্রথমবারের মতো দেখল—তাদের কাঠামো অচলায়তন হচ্ছে।
কিন্তু পাল্টা আঘাত তাতেই আসল। বাইরে থেকে বন্দুকের গুঁঞ্জ। কাঁচ ভাঙার শব্দ। কেউ দরজায় কড়া দিয়ে বলছে—“আরে, খুলে দাও, পুলিশের কাহিনি চলছে।” অঞ্জনা হাপাঁ করে উঠে, বন্দুক হাতে স্পষ্ট নির্দেশ দিলেন—“সবাই নিচে!”
অর্ণব জানে—এখানে যেখানে তারা দাঁড়িয়েছে, ফিরে যাওয়ার পথ নেই। তিনি তার পুরনো অভ্যাস মতো শান্ত, চোখ স্থির। হেমন্ত মাথা কুঁচকিয়ে বললেন—“তারা আমাদের ঘিরে ফেলছে। বাইরে থেকে কয়েকটি ইউনিট আসছে—কিন্তু মিডিয়া এখনই লাইভ।” তিনি মৃদু হাসি দিলেন, “এখানে আসল ফোর্সটা—জনগণ।”
সাইরেনের শব্দ বাড়ছে। কণাগুলো জমছে। রফিক, নাসির, সমরেশ—সবাই জানে একটাই কথা: ভূয়সী লড়াই আর সামনে। আকাশের ওপর কালো রঙের মেঘ ঘুরছে। শহরের হৃৎপিণ্ডে এখন গর্জন।
অর্ণব ঠোঁটে এক লহমা হাসি নিয়ে বলল, “আসবে তারা—তবে এবার আমরা জানি কোথায় আঘাত করতে।” তার হাত ধীরে অস্ত্রের দিকে নড়ল। দরজার ওপারে কড়া লাথি ভেসে এলো—একটা নতুন অধ্যায়ের শুরু।
পর্ব ১১ : শেষের আগের কেল্লাফতি
ঘরের ভেতরে বাতাস কাটা—সাইরেনের গর্জন বাইরে, কাঁচ ভাঙার শব্দে থানা আশেপাশে কাঁপছে। অঞ্জনা বন্দুক ধরে দাঁড়িয়ে আছে দরজার পাশে, চোখে দৃঢ় এক অগ্নিশিখা। হেমন্ত ল্যাপটপ থেকে উঠে, মুখে ঠাণ্ডা পরিকল্পনার রেখা। সমরেশ কাঁধে রিভলভার, নাসির দরজার কাছে পাহারা দিচ্ছে। অর্ণব—সে যেন পুরো ঘটনার নীরব কাঁধ, চুপচাপ, কিন্তু জলের নিচে বিবর্ণ আগুন।
বাইরে ক্রমশ শক্তি বাড়ছে—এক দিকে পুলিশের একটি অংশ, অন্যদিকে কালো কোটওয়ালার লোকজন। কিন্তু মিডিয়ার লাইভ রিপোর্ট ব্যাখ্যা করে দিচ্ছে: এখানে কেবল অগণিত শখ—এখানে একটি বড় ষড়যন্ত্র উন্মোচিত হয়েছে। মানুষ পড়ছে, ফোনে ট্রেন্ড হচ্ছে, আর শহরের রাজনৈতিক তাবড়দের চোখ এখন কড়া অঁকে ওঠে। কালো কোটওয়ালার পেছনে যার যে হাত—তাদের নড়া-চড়া শুরু।
কিন্তু সে শক্তিও আছে—তাদের হাতে অস্ত্র, টাকা, এবং ভয়ে মানুষকে দমিয়ে রাখার ক্ষমতা। বর্তমানে পরিস্থিতি এমন একটি মোড় নিল যেখানে গণমাধ্যম আর আইন—দুইয়ের সংঘাতেই সুদীর্ঘ লড়াই লুকিয়ে আছে।
অঞ্জনা নির্দেশ দিলেন—“সমরেশ, তুমি মেইন গেটে লাগো। নাসির, জানালা থেকে যেকোনো লোক ঢুকলে নজর দাও। অর্ণব, তুমি অন্দরেই থেকো—তুমি যদি বেরোতে পারো, সুব্রতকে বাঁচিয়ে নিয়ে যা।”
অর্ণব কেবল মাথা নেড়ে নেয়। সে জানে, সুব্রত এখন কোথায়—একটি নির্দিষ্ট নিরাপদ বাসা যেখানে সমরেশের লোকেরা রেখেছিল। কিন্তু আজকের লড়াইয়ে সে আর একা নয়—এখানে এখন বহু মানুষ, এবং প্রতিটি পদক্ষেপ একটা ঝুঁকি।
বাইরে লোক চড়া শুরু হলো। ধাক্কাধাক্কি, কাঁচ ভাঙা, কণ্ঠে কড়া আদেশ—“খোলা! পুলিশ আদেশ!” একগুচ্ছ লোক প্রবেশের চেষ্টা করল, কিন্তু অঞ্জনার ছোটো দল প্রতিরোধ করে। দরজা খুলে গেল, ধোঁয়া এল। একবারে চারপাশ মোটে রক্তক্ষরণ হলে তারা হতাশ হবে—এই ভয়টা কাজ করছে।
হেমন্ত ল্যাপটপ থেকে উঠে গিয়ে অঞ্জনার কানে বলল—“মিডিয়া লাইভে এখনই এই অংশগুলো দেখাচ্ছে—তারা একদম লাইভ রোজ করেছে। আমাদের দরকার এই: আজকে আইনগতভাবে দাবি করতে হবে। আমি ব্যাকআপ কপি দিয়ে দিলাম—আরও কিছু মিডিয়া হাউস এখন রিপোর্ট পাচ্ছে।” অঞ্জনা মাথা নেড়ে বলল—“ঠিক আছে—আমি এখনই এন মামলা চলাবো।”
কিন্তু সেই মাঝেই—একটা বিস্ফোরক খবর এল: গেটের বাইরে দাঁড়ানো একটি গাড়ি থেকে একটি পুরনো ফ্ল্যাশড্রাইভ উদ্ধার করা হয়েছে, সেখানে একটি ভিডিও আছে—এক রাজনীতিবিদের ফোনালাপ যেখানে সে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি নিশ্চিত করছে। মিডিয়া তা দেখিয়ে দিল। শহরের মানুষ চেঁচিয়ে উঠল—এই তথ্যের অর্থ ছিল কেবল একটি জোরালো আবেগ নয়; এটি ছিল বিচারপতিদের সামনে পেশ করার মতো এক কেস।
কালো কোটওয়ালার লোকেরা পিছু হটল একটু—তারা বুঝেছে যে সামনা-সামনি লড়াই আর কাজ দফতরে চাপ সৃষ্টি করল। কিন্তু তাদের ঐক্য এখন ভাঙতে শুরু করেছে—কেউ পালাচ্ছে, কেউ লুকোচ্ছে। তাদের মধ্যে ভয় জমে গেল।
এক মুহূর্তে ঘটে গেল বিপরীত ঘটনা—একটি গোষ্ঠী বন্দুকধারী কাঁধে করে ডান হস্তে ধাক্কা করে দরজায় প্রবেশ করল। কিন্তু তাদের লক্ষ্য শুধু গুপ্তকর্মী নয়; তারা আসছিল অঞ্জনাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য—কারণ তিনি পুরো ঘটনার মুখ। সামান্য হঠাৎ করেই অঞ্জনা সামনে দাঁড়ালেন। তিনি তার রিভলভার মুখ করে বললেন—“চাইলে ধরা দাও।”
তাদের মধ্যে বুগল বাজল—শব্দটা ছিল একটা পুরোনো যুদ্ধের স্মৃতি। অর্ণব ঝাঁপ দিয়ে পড়ে গেল প্রথম দলে, আর লড়াই শুরু হল ঘরের ভেতর। কাঁধে কাঁধে সংঘাত, ছাতুরিয়া এমনিতেই ছড়া। অঞ্জনা নীরবভাবে চাল করে গুলি ঠেকালেন, হেমন্ত ল্যাপটপ ঘেঁটে ঝুঁকছেন—সে রিলেক্ট লীলায় কাজ করে যাচ্ছেন যাতে সব ডকুমেন্ট অন-লাইনে নিরাপদ থাকে। সমরেশ বাইরে গিয়ে ধাক্কা করে কড়া প্রহরীকে থামাচ্ছে।
তবে লড়াই শুধুই বাহ্যিক নয়—এখানে মনে মনে ভাঙছে আবেগের শিরা। রফিক, যে প্রথমে ভয় পেয়ে ফোন দিয়েছে, সে নিজের জীবনের ভুল উপলব্ধি শুরু করল। সে এখন বোঝল কিভাবে সে ছোট্ট কাজ দিয়ে বড় অপরাধে সহযোগী হয়েছে। সে কাঁদতে কাঁদতে বলল—“আমি কি ভুল করিনি?” অঞ্জনা তার মুখে সাবলীলতা দিয়ে বলল—“তুমি এখন সাহায্য করছো—তাই তুমি বাঁচবে।”
ঘন্টা কেটে যাচ্ছিল। বাহিরে হকাররা, দেলে-ভরা মানুষ—সবার দৃষ্টি থানার ওপর। সোশ্যাল মিডিয়ায় হ্যাশট্যাগ উঠে এসেছে। কোর্টের ফোন আসছে। কেন্দ্রীয় আধিকারিকের দিকে থেকে নির্দেশ আসছে—“স্থিতি নিয়ন্ত্রনে রাখতে হবে।” আর সেই নির্দেশের মধ্যে লুকিয়ে আছে উচ্চস্তরের রাজনীতিবিদের হাত সাফ করার চেষ্টা।
এই মুহূর্তে অর্ণব একটি সিদ্ধান্ত নিল—সে জানে কালো কোটওয়ালার মূল শক্তি কোথায়: শহরের বাইরে একটা রিমোট হাউজ, যেখানে চালানগুলো লুকানো হয়। যদি তারা ওখানেই আঘাত করে এবং মালব্যা হোল্ডিংসের নামের ওপর সরাসরি প্রমাণ জোড়ায়, তাহলেই পুরো নেটওয়ার্ক ধসে যাবে। কিন্তু এই অভিযানে অর্ণব একা যাবে না—তার পালা এখন এক সম্মুখ যাত্রা দেখিয়ে দেওয়া।
সে হেমন্তকে কাছে টেনে বলল—“আমি যাবো। তুমি মিডিয়া-প্রমাণ অটুট রাখো, অঞ্জনা আদালতে যাবি। সমরেশ, তুমি শহরে যেন সব নিরাপদ রাখো।” হেমন্ত ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল—“আমি তোমায় ট্রেস করে দিব। কিন্তু মনে রেখো—এটা এক পথের যাত্রা। ফিরে আসা সহজ হবে না।”
অর্ণব কাঁধে বন্দুক বেঁধে নিলেন। সমরেশ চীৎকার করে বললেন—“তুমি একা গেলে এবং যদি কিছু ঘটে—তাহলে আমরা তোমার পেছনে আছি। কিন্তু তুমি এক টা কথা মনে রেখো—তুমি আমাদের জন্য লড়ছো না, পুরো শহরের জন্য লড়ছো।” অর্ণব ছোটো একটা হাসি দিল—“আমি জানি।”
রাত্রির শেষ দিকে যখন সব কিছু একটু শান্ত মনে হলো, অর্ণব আর একটি ছোট দল বেরিয়ে পড়ল শহরের বিপরীত দিক—রাস্তাঘাট ফাঁকা, গাড়ি কয়েকটা টর্চ ছিটাচ্ছে। তাদের কাছে নেই বিশেষ সহযোগী—কিছু সমরেশের লোক, নাসির, আর দু’জন সাব-ইনফিলট্রেটর। তাদের হাতে আছে কম লাইট, ছোট মানের ব্ল্যাংকেট, আর একটি পুরনো মানচিত্র যেখানে রিমোট হাউজের কুড়ে জায়গা চিহ্ন করা আছে।
রাস্তায় তারা ছুটল—নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, কেবল গাড়ির হেডলাইট আর রাস্তার বাতি মিলেমিশে। কিন্তু অর্ণব জানে—এবারই চূড়ান্ত লড়াই। এই লড়াইয়ে হারলে তারা কেবল ব্যক্তিগত নয়; শহর হারাবে। আর হারলে—কেউ আর ফিরে পাবেনা।
তারা পৌঁছাবে রিমোট হাউজ—সেই জায়গা যেখানে আগামী পর্বে সব শেষের অবশেষি ঘটবে: মুখোমুখি কালো কোটওয়ালার, তার অস্ত্রচালিত বাহিনী, আর অরণ্যের মতো কড়া সিদ্ধান্ত। কিন্তু এখানেই শেষ নয়—শেষের আগে একটা বড় কেল্লাফতি আছে—যেখানে জীবন ও মৃত্যু, বিশ্বাস ও বিশ্বাসঘাতকতার মধ্যে শেষ সংঘাত শুরু হবে।
পর্ব ১২ : শেষ কেল্লা
রাত ছিল গোটা আকাশ ঢেকে নেওয়া, এমন গভীর অন্ধকার যে চোখে পড়ার মতো কোনো চিহ্নই ঠিকঠাক দেখা যাচ্ছিল না। অর্ণব দত্ত, সমরেশ, নাসির আর দু’জন ইনফিলট্রেটর—মোট পাঁচজন—ধীরে ধীরে রিমোট হাউজের কাছে নামল। গাড়ির হেডলাইট তারা আগে থেকেই নিভিয়ে রেখেছিল; শুধু কাঁধে টর্চ, মুখ ঢাকা স্কার্ফ আর গা-ঢাকা কালো পোশাক। দূরের ওই কুঁড়েঘরটা মানচিত্রে যত ছোট, বাস্তবে তত বড়: লোহার ফেনস, ভাঙা গেট, বারান্দায় এক জোড়া হালকা বাতি—পাহারার চিহ্ন। তাদের মনে ছিল—এই ঘরটা কেবল মালভ্যর চালান রাখে না; এখানে নরমালি তথ্য, দরদাম, সিদ্ধান্ত সবই হয়। এখানেই শেষ কৌটকোচ চলবে।
অর্ণব একটি দরজার ফাঁক দেখে নীল আলোয় খুঁজে নিল নিরাপদ পথ। সময়টা এখন—সবকিছু নিঃশব্দে করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নাসির প্রথমে গেটের কাছে ঢুকল, হাতে ছোট কাঁটা দিয়ে তালা খোলার কৌশল। সে বাঁধা ছলেই দুর্বল মিশরীয় শব্দের মতো তালা খুলে দিল। ভেতরে ঢুকতেই লোকের স্পর্শ—অল্প হাঁটু গলানো ক্যামেরা, লাইট, কাগজের ঝুড়ি আর কয়েকটা ব্যাগ। কিন্তু ধৈর্য ধরতে হবে; প্রথম যে দরজা তাদের জন্য ফাঁকি, তাতে ঝাঁপ দিলে বিপদ।
তারা ভেতর থেকে সোজা কিচেনে ঢুকল। কিচেনের এক কোণে টেবিল, টেবিলেই চা-কাপ পড়ে আছে—ইংরেজি টাইপ টেবিল, ওপরের কাগজে ট্রান্সপোর্ট লিস্ট। অর্ণব হাতে নেমে সেগুলো ঝুঁকির মাঝে তুলে নিল, ওদের চোখে সেভিং করল সব চিহ্ন। সহচররা একলা-একলা ঘর ঘর স্ক্যান করছিল—বেডরুম, ছোটকক্ষ, পেছনের গুদাম। গুদামে ঢুকতেই তাদের সামনে ছিল কনটেইনারের খামার—টিকিট, চালান কাগজ, বিদেশি লেবেল। নাসির কিছুই নড়াচড়া না করেই কণ্ঠে হালকা বলে দিল—“এটাই তারা ট্রান্সপোর্ট করে।” অর্ণব শুধু মাথা নেড়ে বলল, “ফোটো নাও, আর কপি করো।”
ঠিক তৎক্ষণাৎ বারান্দার পেছন থেকে একটি পেসিভ আলো জ্বলল—সাইফারের মতো বিউটিফুল যেন। কেউ আশ্চর্য করে না; তারা আলোর দিকে তাকালেই দেখতে পেলেন ছায়া ছিটকে উঠছে—কয়েকজন দেখে মনে হচ্ছে পাহারা বেড়াচ্ছে। অর্ন্তদৃষ্টি বলে দিল—এরা তাদের দিকে তৎক্ষণাৎ নজর দিয়েছে। সমরেশ চেঁচিয়ে বলল—“ডান দিকে, চলে যাও।” কিন্তু ভেতরের এক দরজা আচমকা খুলে গেল এবং বের হলো কালো কোটে মোড়ানো এক মানুষ—চৌকস হাঁটু, চকচকে কোট, টেবিলে মৃদু ঠোঁটের খাঁজ। তিনি চিনতে সময় না নিয়ে বললেন—“অর্ণব দত্ত?” দরজার পেছন থেকে আরও লোক বেরোতে শুরু করল—বন্দুক উঁচু, চোখে কটাক্ষ।
অর্ণব দাঁড়াল। তার পার্শ্বে সমরেশের কণ্ঠ কড়া—“টেনে নেয়।” কিন্তু কেবল কথায় কাজ হবে না; হঠাৎই ভেতর থেকে তিনটি গুলি ছুটলো—ঘরের পাশের ফাঁক ভেঙে কাচের টুকরো উড়ে গেল। অর্ণব ঝাঁপ দিল প্রথমটি নেয়ার জন্য; পুরনো অভ্যাসে তার হাতে বন্দুকটা টেনে নিল। তিনি লক্ষ্য করে আঘাত করলেন—এক বন্দুকধারী পিছলে গেল; দুইজন হাতাহাতিতে মুড়ে পড়ল। লড়াই হল ঘরে ভেঙে খুনি কাহিনী—চলার পথ ছিন্ন হয়ে যাবে।
কালো কোটওয়ালা, সেই মানুষটির কণ্ঠ ছিল শান্ত, কিন্তু চোখে ছিল উন্মাদ—“তোমরা ভাবলে এই খেলাটা সহজ, তুমি ভুল করেছো।” অর্ণব উত্তর দিল না; সে লড়াই করছিল—বাঁচাবার রাস্তাটা একেবারেই সরল নয়। সে জানে, এখানে প্রতিটা সেকেন্ডে টান পড়ে। সে সমরেশের দিকে চেয়ে একটি সংকেত দিল—পিছনের গুদামের দরজা বন্ধ করা। নাসির ঠিকই বুঝে গিয়ে এক কাঠ বোঝা ধাক্কা দিয়ে গুদামের দরজা আটকে দিল।
ভাগ্য তাদের সহায় হল—গুদামের ভিতর পুরোনো মেশিনের নীচে লুকানো একটি লম্বা তামার পাইপ ছিল। অর্ণব তা নিয়ে প্রথমে পালটা আঘাত করে বেঁধে দিল কোটওয়ালার এক হাতে। শত্রু চিৎকার করে পড়ে গেল। কিন্তু তখনই—বাইরে থেকে হর্নের আওয়াজ, হেডলাইট জ্বলে উঠল; কালো কোটওয়ালার লোকেরা জানলো ট্র্যাপ। অবস্থা খারাপ হয়ে এলো।
অর্ণব জানত—এখানে আর বেশি সময় নেই। সে গদি করে নিল কাগজের একটি কপি নিজের জ্যাকেটে। তার মস্তিষ্কে তখন কেবল একটাই লক্ষ্য—ফাইল যেন বাইরে চলে যায়। সমরেশ তৎক্ষণাৎ ব্যাকডোরে গেলেন, নাসির দুই দিক থেকে পাহারা দিলেন। হামলাকারীরা বাড়ছে, কিন্তু হেমন্তের তৎপরতায় মিডিয়া লাইভে সারাদিন ধরে প্রচার চলছে—তাই খলনায়কের পালা কঠিন।
এমন সময় কোটওয়ালার মুখটা খুলে গেল—তিনি নাম বললেন, দাবি করলেন যে তার পেছনে যে রাজনৈতিক ভার আছে তা এত গভীর যে তারা আর হারতে দেয় না। কিন্তু ঠিক তখনই, বাইরের রাস্তায় কড়া আলো পাক খেয়ে উঠল: পুলিশের উচ্চস্তরের ইউনিট এসেছে, যারা মিডিয়ার রিপোর্ট দেখে এসেছিল—কেউ তাদের ছাড়া করে দিল না। প্রধান কন্ট্রোল রুম থেকে আসে—“ড্যাম, এখন গ্রেপ্তার করো।” হরতাল। কালো কোটওয়ালা চমকে গেল—তারাই ছিলো অপারেশনকে কভার করে রেখেছিল; এখন সে দাঁড়িয়ে ছিল, জালে ফাঁদে।
একেকজনকে গ্রেপ্তার করা হলো। কাগজ, ব্যাঙ্ক ট্রান্সফার, বিদেশি রশিদ—সব হাওয়া হয়ে গেল—আর মিডিয়া লাইভে সব দেখানো। কালো কোটওয়ালা সেদিন ধরে নেওয়া না গেল; তিনি শেষ চেষ্টা করে জানালার ক্যানভাস ভেঙে পালানোর চেষ্টা করলেন—কিন্তু সমরেশের একটি কিক তাকে মাটি দেখিয়ে দিল। পরে জানা গেল, তাকে গ্রেপ্তার করে নেওয়া হয়েছে; আর তার পেছনে যাদের নাম ছিল—সেই নামগুলোও এখন তদন্তের টেবিলে।
কয়েক ঘণ্টা পর, সূর্য ওঠার আগে, রিমোট হাউজ ভরে গেল পুলিশের ডিবি লোক, ফোরেনসিক টিম আর সংবাদদেবতা। অর্ণব, সমরেশ, নাসির—তিনজন মুদ্রা কাঁপানো হাতে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা দেখলো, শহর ধীরে ধীরে জেগে উঠছে—মানুষের দাবি, বিরূপচিহ্ন, আর সেই ক্ষত যা কখনও মুছানো যাবে না। তারা জানত, যারা হারিয়েছে, তারা শুধুই ব্যক্তিক নয়; তাদের হারানো ছিল বিশ্বাস—যেটা এখন পুনরুদ্ধার করা কঠিন।
সুব্রত শহরে ফিরল; অঞ্জনা আদালতে সাক্ষ্য দিলেন, হেমন্ত প্রমাণগুলো হাতে রেখেই মিডিয়াকে হাতে-কলমে দিয়েছিলেন; আদালত ব্যবস্থা নিলো—মালব্যা হোল্ডিংসের লেনদেন আটকানো হল। রাজনীতিবিদদের মধ্যে কয়েকজন ওপর থেকে নাম কাটতে শুরু করল। শহর ধীরে ধীরে স্বস্তি পেল—একটা দীর্ঘ নিশ্বাসের মতো। কিন্তু অর্ণব জানে, এই শান্তি ক্ষণস্থায়ী। সে চুপচাপ এক সকালে, কারও অজান্তে, তার ব্যাগ নিয়ে শহর ছেড়ে দিল।
ডিপো রোডের সেই পুরনো স্টেশনে লোকেরা ভোরের ট্রেনে ওঠে-নেমে গেলো। অর্ণব এক প্যাঁচে দাঁড়িয়ে চা খেয়ে নিল, তারপর তারপরার মতো ধীরে ধীরে ট্রেনের দরজায় কাজল খায়ে উঠল—তার ব্যাগে অল্প পরিত্যক্ত ছাপ, চোখে অল্প ক্লান্তি। রেল প্ল্যাটফর্মের কোলাহল তার জন্য নীরব গান—শহর বেঁচে আছে, কিন্তু তার বেঁচে থাকার মানে হলো নতুন দিনের চাহিদা, নতুন ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করা।
ট্রেন ছুটে গেল। চন্দ্রপুরের কোল গলে গেল ধীরে ধীরে তার পেছনে; অর্ণব জানে—জ্বালা থেকে মুক্তি নেই; তবে একটুকু কাজে খুশি আছে—তিনি বাঁচিয়েছে যে মানুষগুলোকে, তারা হয়তো আজ সকালে বাজারে দাঁড়িয়ে হাসবে। সে জানে, এক সময় আবার কোথাও দাঁড়াবে—কারণ এমন মানুষরা থামেন না। তিনি ছিল এক যোদ্ধা, আর এখনও সেই পথেই হাঁটছেন—অচেনা শহরের ছায়ায় খোঁজে থাকা অন্যায় থামাতে।
শেষ