নীহারিকা চক্রবর্তী
১
নয়নার জন্মের পর থেকেই তার চোখে ছিল অদ্ভুত এক শূন্যতা, যদিও ডাক্তাররা বলেছিল মেয়েটির দৃষ্টি একদম ঠিক আছে—কিন্তু রঙের জগৎ তার কাছে ধোঁয়াটে, অচেনা। জন্মগতভাবে বর্ণান্ধ এই মেয়েটির জন্য লাল আর সবুজ ছিল একই ধূসর ছায়া, আর নীল আর বেগুনির মধ্যে কোনো তফাত তার চোখে ফুটত না। প্রথম প্রথম সে বুঝেই উঠতে পারত না, রঙের জগৎ যে এতটা বিস্তৃত আর বর্ণিল হতে পারে। মা যখন শাড়ি বদলাতেন, নয়না শুধুই আঁচল ছোঁয়ার নরমতা টের পেত, কিন্তু তার জন্য সেই রঙের লালিমা ছিল শুধুই গল্পে শোনা এক রহস্যময় জিনিস। স্কুলের ছবি আঁকার ক্লাসে শিক্ষকরা যখন বলতেন—‘আকাশ নীল করো, গাছের পাতা সবুজ করো’—নয়নার ক্যানভাসে শুধু ফিকে আর বিবর্ণ দাগ দেখা যেত। সহপাঠীরা হাসাহাসি করত, তাকে বলত ‘রঙের পাগল’, অথচ নয়না কষ্ট পেত না, বরং ভিতরে ভিতরে অনুভব করত—রঙ হয়তো কেবল চোখে দেখার জিনিস নয়, বরং মনে অনুভব করার, বাতাসে গন্ধের মতো বা নদীর ঢেউয়ের শব্দের মতো। এই অদ্ভুত উপলব্ধিটাই তাকে বাঁচিয়ে রাখত; সে ভাবত, যদি সে চোখ দিয়ে রঙ দেখতে না-ও পারে, হয়তো অন্যভাবে সেই রঙকে অনুভব করতে পারে। তাই সে কান পেত নদীর কলকল শব্দে, গন্ধ শুঁকত বৃষ্টির মাটিতে, স্পর্শ করত ভিজে পাতা, আর সেই অনুভূতিকে রঙের ভাষায় ফুটিয়ে তুলতে চাইত। মা-বাবা প্রথমে ভেবেছিলেন, হয়তো মেয়েটা এই একরোখা চেষ্টা ছেড়ে দেবে, কিন্তু নয়নার মধ্যে এক অদ্ভুত জেদ ছিল, যেটা তাকে রঙের বাইরে এক নতুন জগৎ খুঁজে পেতে প্ররোচিত করত।
এভাবেই নয়নার আঁকার জগৎ ধীরে ধীরে তৈরি হতে থাকে—শব্দ, গন্ধ আর স্পর্শের রঙে। যখন অন্যরা রঙের নাম মনে রাখত, নয়না মনে রাখত একেকটা গন্ধ, একেকটা শব্দের কম্পন। পুরনো বইয়ের পাতা উল্টানোর গন্ধ তার কাছে ছিল একরকম ফিকে বাদামি রঙের মতো, আর শীতের সকালে ঘাসের ওপর শিশির ফোটার শব্দ ছিল সাদা রঙের মতো স্বচ্ছ। সেইসব অনুভূতি দিয়ে নয়না ছবি আঁকত, আর অদ্ভুতভাবে সেই ছবিগুলো মানুষের মনে স্পর্শ করত। কেউ বলত, নয়নার ছবিতে তাকিয়ে তারা হারানো শৈশবের গন্ধ পায়; আবার কেউ বলত, তাদের বুকের ভিতর অজানা এক কাঁপুনি ধরে যায়। নয়নার ছবির প্রদর্শনী হতো না তখনও, কিন্তু শহরের ছোট্ট গলির দোকানগুলোতে, চায়ের দোকানের দেয়ালে, বা বন্ধুর বাসার বৈঠকখানায় তার আঁকা ছবির কদর বাড়তে লাগল। মানুষ অবাক হয়ে ভাবত, এই মেয়েটি যা চোখে দেখে না, তা কীভাবে ক্যানভাসে এমন স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলে। নয়না জানত, এই প্রশ্নের সহজ উত্তর নেই; কারণ সে সত্যিই দেখতে পায় না, সে কেবল অনুভব করে—আর অনুভব থেকেই তার তুলির টানগুলো বুনে ওঠে এক অদৃশ্য রঙের গল্প।
তবু নয়নার নিজের মনে এক ধরণের শূন্যতা ছিল, যে শূন্যতা সে কারও সাথে ভাগ করে নিতে পারত না। কখনও কখনও রাতে, একলা বিছানায় শুয়ে, সে নিজের আঁকা ছবি ছুঁয়ে দেখত, স্পর্শ করে অনুভব করত—সেই রঙগুলো কি আসলেই আছে? নাকি ওগুলো কেবল তার মনেরই সৃষ্টি? আর তখনই সে অনুভব করত, হয়তো মানুষ যেমন চোখ দিয়ে রঙ দেখে, নয়না তার সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে সেই রঙ অনুভব করে। এই অনুভূতি তাকে সাহস দিত, আর সেই সাহসে ভর করেই নয়না আরও গভীর, আরও জটিল ছবি আঁকত। কখনও একটা মৃদু বৃষ্টির দিনের গন্ধে আঁকা ক্যানভাস, কখনও ভোরের পাখির ডানার শব্দে আঁকা আরেকটা ছবি—যা মানুষকে হাহাকার আর শীতল শান্তি দুই-ই এনে দিত। নয়না জানত না, এই ক্ষমতা আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ; শুধু জানত, রঙের ভাষা যে কেবল চোখ দিয়ে বোঝা যায় না, সেটা তার জীবন দিয়ে প্রমাণ করার দায়িত্ব যেন স্বয়ং নিয়েছে সে।
২
নয়নার আঁকার ঘরটা বাইরে থেকে দেখতে খুব সাধারণ, একটা পুরনো কাঠের টেবিল, রঙের টিউব ছড়ানো, মেঝেতে শুকনো রঙের দাগ আর জানালার পাশে রাখা কয়েকটা ছোট গাছ। কিন্তু সেই ঘরের মধ্যে ঢুকলেই টের পাওয়া যেত, এখানে যেন কেবল চোখে দেখা জগৎ নেই—এখানে আছে অদৃশ্য এক জগৎ, যা শুধু নয়নার ইন্দ্রিয় দিয়ে তৈরি। জানালার ধারে বসে নয়না তার তুলিতে প্রথম ছোঁয়া দেয়, কিন্তু রঙ বাছাইয়ের জন্য সে চোখের ওপর ভরসা করে না; সে শুঁকে দেখে কোন রঙ থেকে কেমন গন্ধ আসছে, হাতের আঙুলের স্পর্শে টের নেয় রঙের টেক্সচার। প্যালেটের এক কোনায় জমে থাকা তিক্ত গন্ধের কালো রঙ নয়নার মনে করায় ভোররাতের ভেজা রাস্তাঘাট, আর অন্য প্রান্তের মিষ্টি গন্ধের রঙটা মনে করায় গ্রীষ্মের দুপুরের কাঁচা আমের গন্ধ। এইভাবে নয়নার ক্যানভাস ভরে যায় এমন সব রঙে, যা মানুষ চোখে দেখে না, কিন্তু মনে অনুভব করতে পারে। বাইরে থেকে দেখলে কেউ বলতে পারত, এই মেয়েটা পাগলের মতো রঙ শুঁকছে, আঙুল বোলাচ্ছে; কিন্তু নয়নার কাছে এটাই তার আসল ভাষা—রঙের গন্ধ, রঙের স্পর্শ আর রঙের অদৃশ্য শব্দই তার কাছে রঙের অর্থ তৈরি করে।
নয়না যখন ছবি আঁকে, তখন সে একা থাকে না; তার সাথেই থাকে বাতাসে ভেসে থাকা সুর, গাছের পাতায় লুকোনো হাওয়ার শিস, বা দূরের ট্রামের ঘণ্টার টুংটাং আওয়াজ। এই সব শব্দ নয়নার মনে একেকটা আবেশ তৈরি করে—কখনও শান্ত, কখনও অস্থির। সেই আবেশই নয়নার তুলির টানে ঢেউ তোলে। একবার, এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় নয়না একটি ছবি আঁকছিল যেখানে শুধু আকাশের গন্ধ আর বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ ব্যবহার করেছিল। সে জানত না কেন, কিন্তু সেই ছবিটা শেষ হতে না হতেই তার মধ্যে এক ধরনের শূন্যতা আর কান্না জেগে উঠেছিল, মনে হয়েছিল যেন সেই বৃষ্টির মধ্যে হারিয়ে গেছে কারও অপেক্ষা। পরে সেই ছবিটা যখন তার বন্ধু রোহিণী দেখতে এলো, রোহিণীর চোখ ভিজে উঠেছিল। সে বলেছিল, ‘নয়না, এই ছবিটা দেখতে গিয়ে আমার মনে হচ্ছে আমি কারও জন্য অপেক্ষা করছি, অথচ জানি না সে কে।’ নয়না সেই দিন প্রথম অনুভব করেছিল, তার তুলির টানে আসলে শুধু রঙ নয়, মানুষের গভীর মন আর অচেতন ইচ্ছার ছোঁয়া থাকে। ছবির মধ্যে লুকানো সেই অদ্ভুত শক্তিটা যেন নয়নাকেও কাঁপিয়ে দেয়, আর সে বুঝতে পারে এই শক্তি সে নিজেও পুরোপুরি বোঝে না।
তবে নয়না কখনও ইচ্ছে করে মানুষের মনে দুঃখ বা কান্না আনতে চায়নি। তার কাছে ছবি আঁকা মানে নিজের ভেতরের অদৃশ্য রঙগুলোর কথা বলা, যেগুলো কারও চোখে ধরা দেয় না। কিন্তু ধীরে ধীরে নয়না বুঝতে পারে, তার ছবিগুলোতে এক রহস্যময় প্রভাব কাজ করছে—যা শুধু সৌন্দর্য নয়, মানুষের গোপন যন্ত্রণা, অজানা স্মৃতি, আর অবদমিত অনুভূতিগুলোও টেনে তোলে। এই উপলব্ধি নয়নাকে কৌতূহলী করে, ভয়ও দেখায়। সে ভাবতে থাকে, যদি ছবি মানুষের মনে এমনভাবে ঢুকে যেতে পারে, তবে সে কি এই শক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারবে? তার তুলির টান যদি মানুষের মনে আলো জ্বালাতে পারে, আবার অন্ধকারও ছড়াতে পারে না তো? এই দ্বন্দ্ব নয়নাকে তাড়িয়ে বেড়ায়, কিন্তু তবু সে তুলিটা নামিয়ে রাখতে পারে না; কারণ সে জানে, এই অদৃশ্য রঙের ভাষাই তার সত্যিকার সত্তা, আর এই ভাষায় কথা না বললে নয়না নিজেকেই চিনতে পারবে না। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, গন্ধ আর শব্দের জগতে ডুবে নয়না নতুন ছবি আঁকে, আর প্রতিটা ছবির ভেতর দিয়ে নিজের অজানা এক রহস্যের দিকে এগিয়ে চলে।
৩
নয়নার ছবিগুলো এতদিন ছোট্ট চায়ের দোকান, বন্ধুদের বসার ঘর বা পাড়ার গ্যালারির দেয়ালেই সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু হঠাৎই একদিন শহরের একটি বিখ্যাত আর্ট গ্যালারি থেকে খবর এল—তারা নয়নার একক প্রদর্শনী করতে চায়। খবরটা প্রথমে নয়না বিশ্বাসই করতে পারেনি; সে ভাবল, নিশ্চয়ই কোনো ভুল হয়েছে। কিন্তু যখন আনুষ্ঠানিক চিঠি এল, তখনও তার হাত কাঁপছিল। প্রদর্শনীর দিন এগিয়ে আসতে না আসতেই নয়নার মনে এক অদ্ভুত আতঙ্ক আর উত্তেজনা মিলে মিশে এক অচেনা স্রোত তৈরি করল। সে ভেবেছিল, যদি লোকে তার ছবিতে কিছুই না পায়? যদি তারা বুঝতেই না পারে যে এই ছবির রঙগুলো চোখের জন্য নয়, বরং মনের জন্য আঁকা? তবু নয়না জানত, এই ভয় থেকে পালিয়ে গিয়ে কোনো লাভ নেই; তাকে ছবিগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরতেই হবে। শেষ রাতে যখন সে নিজের আঁকার ঘরে বসে রঙের টিউবগুলো গন্ধে গন্ধে আলাদা করত, তখন হঠাৎ অনুভব করত তার দম বন্ধ হয়ে আসছে—এ যেন শুধু প্রদর্শনী নয়, নিজের সমস্ত ভিতরের জগতকে নগ্ন করে সবার সামনে দাঁড় করানোর মতো অনুভূতি।
প্রদর্শনীর দিন সকালেই নয়নার বন্ধুরা তার পাশে এসে দাঁড়াল, কিন্তু নয়না অনুভব করল, এই লড়াইটা শেষ পর্যন্ত একাই তাকে লড়তে হবে। গ্যালারির দেয়ালে তার আঁকা ছবিগুলো যখন ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছিল, নয়না চুপচাপ এক কোণে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। তার ছবির সামনে মানুষের ভিড় বাড়ছিল ধীরে ধীরে। কেউ থমকে দাঁড়াচ্ছে, কারও চোখে বিস্ময়, কারও মুখে প্রশ্ন, কেউ বা অদ্ভুতভাবে যেন অন্য জগতে হারিয়ে যাচ্ছে। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক নয়নার এক ছবির সামনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থাকলেন, তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “আমি জানি না কেন, এই ছবিটা দেখতে গিয়ে আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল।” আরেকজন তরুণী চোখ ভিজিয়ে ফিসফিস করে বলল, “এত বছর পর হঠাৎ কেন যেন বাবার কথা মনে পড়ল, অথচ ছবিতে তো বাবা নেই।” নয়নার কানে এই কথাগুলো ঢুকে যায়, আর তার বুকের ভেতরে এক অদ্ভুত কৃতজ্ঞতা আর ভয় একসাথে ভর করে—কারণ সে অনুভব করে, তার ছবির মধ্যে লুকিয়ে থাকা সেই অদৃশ্য শক্তিটা মানুষকে ছুঁয়ে যাচ্ছে।
প্রদর্শনীর এক কোণে নয়নার চোখে পড়ল এক অচেনা মানুষকে—একজন মধ্যবয়স্ক সমালোচক, যিনি নাকি শহরের শিল্প জগতের খুবই প্রভাবশালী মানুষ। লোকটা গম্ভীর মুখে একেকটা ছবি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিল, আর নোট লিখছিল। প্রদর্শনীর শেষে নয়নার সঙ্গে দেখা করে সে বলল, “তোমার ছবিগুলো শুধু ছবি নয়, যেন মানুষের ভিতরে লুকোনো কোনো দরজা খুলে দেয়।” নয়না বুঝতে পারছিল না, এটা কি প্রশংসা নাকি সতর্কবার্তা। সমালোচকের চোখে কেমন যেন ভয়ের ছায়া ছিল, আর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে রহস্যময় হাসি। রাতে নয়না যখন ঘরে ফিরল, তার মনে হচ্ছিল আজ যেন নতুন করে বুঝতে পেরেছে—তার ছবিগুলো কেবল রঙ আর আঁকায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং মানুষের অচেতন মন পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে। এ শক্তি আশীর্বাদ, নাকি অভিশাপ—তা জানে না, কিন্তু সে জানে, এই পথ থেকে আর ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। নয়নার আঁকা অদৃশ্য রঙের ক্যানভাস মানুষকে শুধু রঙ দেখায় না, মনে করিয়ে দেয় ভুলে যাওয়া অনুভূতি, লুকানো ব্যথা আর হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি, আর এটাই তার শিল্পের আসল জাদু।
৪
প্রদর্শনীর কয়েক দিন পর থেকেই নয়নার ছবিগুলোর আশেপাশে অদ্ভুত সব খবর ভেসে আসতে লাগল, যা প্রথমে কেবল গুজব বলেই মনে হয়েছিল। এক দর্শক, যিনি নয়নার সেই “বৃষ্টিভেজা প্রতীক্ষা” নামের ছবিটার সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন, নাকি হঠাৎ করেই নিজের পরিবার ছেড়ে শহরের এক ভগ্নপ্রায় বাড়িতে গিয়ে থাকতে শুরু করেছেন। তার স্ত্রী কান্নায় ভেঙে পড়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “আমি জানি না, ওর কী হয়েছে; যেন কোন অদৃশ্য হাত ওকে টেনে নিয়ে গেছে সেই পুরনো স্মৃতির মধ্যে।” আরেকজন দর্শক, এক বয়স্ক মহিলা, নয়নার আঁকা “মৌন নদী” ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন, আর ছবি থেকে চোখ সরাতে পারছিলেন না; পরে তার পরিবার জানিয়েছিল, সেই ছবিটা দেখার পর বৃদ্ধা তার ছোটবেলায় হারিয়ে যাওয়া ভাইয়ের কথা অবিরাম বলতে শুরু করেছেন। নয়না যখন এইসব শুনতে পেল, তার বুকের ভেতর শীতল একটা স্রোত বয়ে গেল—কারণ সে কখনোই এমন কিছু করতে চায়নি; তার ছবি মানুষকে দুঃখ বা পাগলামির দিকে ঠেলে দেবে, এমনটা তো সে কল্পনাও করেনি। তবু এক অদ্ভুত টান ছিল তার মধ্যে—যা তাকে ভাবাতো, এই ছবিগুলোতে সত্যিই কী এমন আছে যা মানুষের মনে এত গভীর প্রভাব ফেলে?
নয়না রাতে একা বসে নিজের আঁকা ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকত। অন্ধকার ঘরে মোমবাতির আলোয় ছবিগুলোর ছায়া যেন আরো রহস্যময় আর জীবন্ত মনে হতো। সে তুলির টানগুলো স্পর্শ করে টের পেত, এ শুধু ক্যানভাস নয়, যেন তার নিজের মন আর স্মৃতির এক টুকরো। কিন্তু নয়না ভেবেই পেত না, এই অনুভূতিগুলো কেমন করে অন্য মানুষের মনে ঢুকে যায়! এক রাতে ভয়ে তার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল—সে স্বপ্ন দেখেছিল, তার আঁকা ছবির মধ্যে থেকে অচেনা সব মুখ তাকে ডাকছে, কেউ কাঁদছে, কেউ হাসছে, আর কেউ চাপা স্বরে তাকে সতর্ক করছে। সকালে ঘুম ভাঙতেই নয়নার মনে হচ্ছিল, তার ছবিগুলো শুধু ছবি নয়, যেন জীবন্ত স্মৃতির দরজা। সেইদিন থেকেই নয়নার মধ্যে এক ভয় জন্ম নিল—যদি এই শক্তি একদিন তার হাতের বাইরে চলে যায়? যদি তার আঁকা ছবি মানুষের মনে অন্ধকার আর যন্ত্রণা টেনে আনে? তবু ভয়ের পাশাপাশি এক ধরনের দায়িত্ববোধও তাকে তাড়া করত; মনে হতো, এই শক্তির উৎস তাকে খুঁজতেই হবে—না হলে সে নিজেও একদিন এই অজানা প্রভাবের শিকার হতে পারে।
নয়না সিদ্ধান্ত নিল, সে এই রহস্যের উৎস খুঁজবে। পুরনো অ্যালবাম আর নোটবুক ঘাঁটতে গিয়ে সে পেয়েছিল মায়ের লেখা কিছু টুকরো নোট—যেখানে লেখা ছিল, “আমাদের বংশে নাকি এক সময় এমন কেউ ছিল, যে অদৃশ্য রঙের ছোঁয়া দেখতে পেত, আর তার আঁকা ছবিতে মানুষের মন পাল্টে যেত।” নয়না অবাক হয়ে ভাবল, এ কী কেবল কাকতালীয়? নাকি তার ভেতরে বয়ে চলা কোনো অজানা উত্তরাধিকার? সে যখন এই নোটগুলো পড়ছিল, তখন তার মনে স্পষ্ট মনে পড়ল দাদুর একটা ছোট বাক্সের কথা—যেটা নয়না ছোটবেলায় একবার খুলতে গিয়েছিল, কিন্তু দাদু রেগে গিয়ে বলেছিলেন, “ওখানে যা আছে, তা এখনো তোমার দেখার বয়স হয়নি।” নয়নার বুকের ভেতর তীব্র কৌতূহল আর শঙ্কা একসাথে জমে উঠল। যদি সেই বাক্সেই লুকিয়ে থাকে তার এই শক্তির আসল রহস্য? সেই রাতে নয়না ঠিক করল, সে দাদুর ঘরের পুরনো আলমারি থেকে সেই বাক্স একদিন খুঁজে বের করবে, কারণ এই অজানা প্রভাবের উৎস তাকে জানতেই হবে—না হলে সে আঁকা বন্ধ করতে পারবে না, আর যদি আঁকা বন্ধও করে, তাতেও এই প্রভাব থামবে না।
৫
নয়না এক বিকেলে একাই চলে গেল দাদুর পুরনো ঘরে, সেই ঘরটা বছরের পর বছর তালাবদ্ধ পড়ে আছে, ধুলো আর মাকড়সার জালে ভর্তি। ছোটবেলায় এই ঘরটাকে ভয় পেত, কারণ ঘরজুড়ে অদ্ভুত গন্ধ, জানালায় ভাঙা কাচ আর ছাদের খাম্বা বেয়ে নামা বুনো লতাগুলোর ছায়া দেখলে মনে হতো যেন কোনো অচেনা চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। তবু আজ নয়নার মনে কোনো ভয় নেই, বরং তীব্র কৌতূহল আর অদ্ভুত টান তাকে ভেতরে টেনে নিল। আলমারির এক কোণ থেকে পিতলের তৈরি সেই ছোট বাক্সটা অবশেষে বের করল; বাইরের ধুলো ঝেড়ে স্পর্শ করতেই নয়নার আঙুল কেঁপে উঠল, যেন বাক্সের গায়ে লুকিয়ে আছে পুরনো দিনের শ্বাস। ধীরে ধীরে ঢাকনাটা খুলল—ভেতরে মুড়িয়ে রাখা কাগজ, শুকনো হয়ে যাওয়া রঙের টিউব, আর একজোড়া ছোট ব্রাশ। কাগজগুলো খুলে দেখতে দেখতে নয়নার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, কারণ সেগুলোতে আঁকা ছিল কিছু অবিকল তার নিজের মতো ছবি—যেখানে রঙের বদলে লেখা আছে শব্দ আর গন্ধের বর্ণনা। যেমন, “সন্ধ্যার বাতাসের গন্ধ—রং: সুনীল ধোঁয়া,” বা “ভিজে মাটির ঘ্রাণ—রং: গাঢ় হাহাকার”। নয়না অবাক হয়ে ভাবল, এ কি তবে দাদুরই লেখা? নাকি আরও আগের কোনো পূর্বপুরুষের? মনে পড়ল মায়ের নোটের কথা—“আমাদের বংশে অদৃশ্য রঙের ছোঁয়া দেখতে পেত এমন কেউ ছিল”—হয়তো সেই অজানা পূর্বপুরুষের শিল্পের উত্তরাধিকারই নয়নার রক্তে বয়ে চলেছে।
কাগজের তলার দিকে একটা চিঠির খাম পেল নয়না। খুলে দেখে হাতের লেখা কাঁপা, কিন্তু তাতে স্পষ্ট লেখা: “যদি এই বাক্স কোনোদিন তোমার হাতে পড়ে, জানবে তুমি একা নও। আমরা যারা এই অদৃশ্য রঙের শক্তি পেয়েছি, তারা সবাই অনুভব করেছি—এ শক্তি শুধু আশীর্বাদ নয়, অভিশাপও। যা আঁকবে, তা মানুষের মনে ঢুকবে; যা স্পর্শ করবে, তা তাদের অচেতন ইচ্ছা আর ভয়কে জাগিয়ে তুলবে। সাবধান থেকো, কারণ এই রঙ দিয়ে আলো আঁকতে পারো, আবার আঁকতে পারো গভীর অন্ধকারও।” নয়না চিঠিটা বারবার পড়ছিল, আর পড়তে পড়তে তার গলা শুকিয়ে এল; কারণ চিঠির শেষে লেখা ছিল, “সবচেয়ে বড় শত্রু তোমার নিজের ভিতরের অন্ধকার।” নয়না জানত, এই বাক্য শুধু সাবধানবাণী নয়, বরং এক ধরনের উত্তরাধিকারী দায়িত্বও, যা তাকে বইতেই হবে। তখনই নয়না অনুভব করল, এই শক্তি থেকে পালিয়ে যাওয়া আর সম্ভব নয়; তাকে এই শক্তির মুখোমুখি হতেই হবে, বুঝতে হবে এর সীমা, না হলে একদিন এই রঙই তাকে গ্রাস করবে।
সেই রাতেই নয়না তার আঁকার ঘরে ফিরল, বাক্সটাকে নিজের টেবিলের পাশে রাখল, আর এক নতুন ক্যানভাস বের করল। চোখ বন্ধ করে সে কান পেত হাওয়ার শব্দে, রাতের পাখির ডাক, দূরের ট্রাফিকের হালকা গুঞ্জন—সবকিছু একসাথে মিলে গোপন এক সুরের মতো বেজে উঠছিল নয়নার মনে। তারপর আঙুল দিয়ে রঙ ছুঁয়ে টের পেল সেই পুরনো টিউবগুলোতে লুকানো গন্ধ—এ যেন প্রাচীন কোনো স্মৃতির ঘ্রাণ, যা সে চোখে দেখে না, কিন্তু স্পর্শে আর গন্ধে অনুভব করে। নয়না তুলির টানে আঁকতে লাগল, আর সেই টান যেন ক্যানভাসের মধ্যে শুধু ছবি নয়, তার নিজের ভয়, অভিশাপ আর আশা—সব একসাথে বুনে দিচ্ছে। আঁকতে আঁকতে নয়না বুঝল, এই অদৃশ্য রঙের ক্ষমতা তার রক্তের মধ্যে বয়ে চলা এক গল্প, যা তাকে শুধু শিল্পী নয়, এক সেতুবন্ধক করে তুলেছে—মানুষের অচেতন মনে লুকিয়ে থাকা আলো আর অন্ধকারের মধ্যে। আর সে অনুভব করল, এই পথ শুরু হয়েছে অনেক আগেই, আর শেষ হবে সেই দিন, যেদিন নয়না নিজের ভেতরের অন্ধকারকে দেখতে শিখবে, আর সেই অন্ধকার থেকে রঙের আলো তুলে আনতে পারবে।
৬
নয়নার ক্যানভাসের সামনে রাতের পর রাত কেটে যাচ্ছিল, আর সেই রাতগুলোয় যেন সময় অন্য রকম হয়ে যেত—চারপাশের সব শব্দ মিলিয়ে গিয়ে শুধু তার হৃদস্পন্দন আর তুলির টানের শব্দ শোনা যেত। কিন্তু এই আঁকার মধ্যেই নয়না অনুভব করছিল এক অদ্ভুত ভার; যেন সে শুধু ছবি আঁকছে না, বরং নিজের ভিতরের কোনো গভীর অন্ধকারের মুখোমুখি হচ্ছে। প্রতিটা টান যখন ক্যানভাসে বসত, তখনই নয়নার মনে হতো তুলিটা তার মন থেকে টেনে বের করে আনছে সেইসব অনুভূতি, যেগুলোকে এতদিন সে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিল। প্রথমে হালকা আঁচড়, তারপর ক্রমশ গাঢ় টান—এভাবে নয়নার আঁকা ছবি হয়ে উঠছিল নিজেরই ভেতরের গল্পের আয়না। এক রাতে যখন সে এক নতুন ছবি আঁকছিল, হঠাৎ চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল নোনা জল; সে আঁকতে আঁকতেই কাঁদছিল, কিন্তু থামল না। কান্না যেন ছবি আঁকারই এক অংশ হয়ে গেল। সে টের পেল, এ কান্না শুধু দুঃখের নয়, বরং একরকম মুক্তির; নিজের অজানা ভয়, লুকানো ব্যথা আর গভীর দায়িত্ববোধের ভার থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা।
কিন্তু নয়নার জন্য এই আঁকা আর সহজ ছিল না; প্রতিটা ক্যানভাস শেষ হওয়ার পর তার শরীর আর মন ভেঙে পড়ত। একবার এক রাতে নতুন একটা ছবি আঁকার পর এমন কাঁপুনি ধরল, যে সে অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছিল। সকালে জেগে উঠে ক্যানভাসের দিকে তাকিয়ে ভয়ে শিউরে উঠেছিল; ছবিটার মধ্যে সে নিজেকেই দেখতে পেয়েছিল—কিন্তু সেই চোখে ছিল এক অচেনা দৃষ্টি, যেটা নয়না কোনোদিন নিজের মধ্যে দেখেনি। সেটা যেন তারই মতো, অথচ সম্পূর্ণ ভিন্ন; যেন তার ভিতরে লুকিয়ে থাকা আরেকজন নয়না তাকিয়ে আছে তার দিকেই। সেই দৃষ্টি কাঁপিয়ে দিয়েছিল তাকে—কারণ সে বুঝতে পেরেছিল, তার ছবির মধ্যে লুকিয়ে থাকা অন্ধকার শুধু অন্যের মনে প্রভাব ফেলে না, বরং তাকে নিজেকেও গ্রাস করতে পারে। তবু নয়না জানত, আঁকা বন্ধ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়; এ যেন নিঃশ্বাস ফেলার মতোই স্বাভাবিক, আবার একই সঙ্গে ব্যথার উৎসও।
ধীরে ধীরে নয়না বুঝতে পারল, কান্না আর ক্যানভাসই তার যাত্রার সঙ্গী। প্রতিটা আঁকায় সে আরও গভীরভাবে নিজের অদৃশ্য রঙের শক্তিকে চিনতে লাগল। সে বুঝতে পারল, এই শক্তি শুধু মানুষকে কাঁদায় না, বরং তাদের লুকোনো সত্যি দেখায়, যা হয়তো তারা নিজেরাই জানত না। নয়না অনুভব করল, যদি সে নিজেই নিজের অন্ধকার আর আলোকে দেখতে পারে, তাহলে হয়তো এই শক্তিকে শুধু অভিশাপ নয়, আশীর্বাদ হিসেবেও ব্যবহার করতে পারবে। সেই রাতে, যখন জানালার বাইরে নিঃশব্দ বৃষ্টি পড়ছিল, নয়না প্রতিজ্ঞা করল—সে শুধু নিজের নয়, অন্যের মনকেও মুক্তি দেবে তার আঁকা দিয়ে। কান্না হবে না দুর্বলতার চিহ্ন, বরং সেই কান্না থেকেই জন্ম নেবে এমন ছবি, যা মানুষের ভেতরে আলো জ্বালাবে। আর এই প্রতিজ্ঞাই নয়নাকে শক্তি দিল, নতুন করে তুলির টান শুরু করতে।
৭
নয়নার আঁকা এক বিশেষ ছবির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল সে এক রাতে, যখন শহরের আলো নিভে গিয়েছিল, আর জানালার কাঁচে পড়ছিল হালকা কুয়াশা। এই ছবিটা অন্য সব ছবির মতো নয়; এখানে সে শুধু নিজের অদৃশ্য রঙ দিয়ে নয়, নিজের সবটুকু ভয় আর ব্যথা ঢেলে দিয়েছিল। ছবির মাঝখানে অর্ধেক মুখ আঁকা, মুখের একপাশ স্পষ্ট আর একপাশ অন্ধকারে ঢাকা; নয়না জানত এ মুখ তারই, তবু এক অচেনা নয়না যেন তাকিয়ে আছে তার দিকেই, চোখে প্রশ্ন, ঠোঁটে চাপা হাসি। ছবির ছায়া পড়েছিল দেয়ালে, আর সেই ছায়াটা কাঁপছিল বাতাসের টানে; নয়নার মনে হচ্ছিল, ছায়াটাই তার সত্যিকারের রূপ—যেটা সে দিনের আলোতে লুকিয়ে রাখে, কিন্তু আঁকার সময় বেরিয়ে আসে। যতবার সে সেই ছবির দিকে তাকাত, ততবারই মনে হতো নিজের ভেতরের অজানা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে, আর সেই মুখ তার চোখে চোখ রেখে বলছে, “তুমি কি আমায় সত্যি চিনতে পেরেছ?” নয়নার বুক কেঁপে উঠত, কারণ উত্তরটা সে জানত না।
তবে এক রাতে, অদ্ভুত এক শান্তি আর সাহস নিয়ে নয়না সেই ছবিটার সামনে বসেছিল, চোখ বন্ধ করে গভীরভাবে শ্বাস নিয়েছিল, আর মনে মনে বলেছিল, “হয়তো তুমিই আমি, আর আমিই তুমি।” সেই স্বীকারোক্তির পর নয়না টের পেল, তার মনে যে অন্ধকার আছে, সেই অন্ধকারেরও দরকার আছে; কারণ অন্ধকার না থাকলে আলো চেনা যায় না। ছবির ছায়ায় নয়না দেখেছিল নিজেরই অসম্পূর্ণতা, লুকানো কষ্ট আর গোপন ইচ্ছা, যা এতদিন সে স্বীকার করতে ভয় পেয়েছিল। এই স্বীকারোক্তির মধ্যেই নয়না নিজের শক্তির আসল অর্থ বুঝতে পারল—তার অদৃশ্য রঙ দিয়ে কেবল সৌন্দর্য নয়, সত্যিটাও আঁকা যায়। সত্য, যা হয়তো তীব্র, যন্ত্রণাদায়ক, কিন্তু মুক্তি দেয়। সেই রাতেই নয়না প্রতিজ্ঞা করল, তার আঁকা ছবিগুলো আর কখনও শুধু বাহ্যিক রঙের খেলায় থামবে না; সে আঁকবে মানুষের মন, স্মৃতি আর স্বপ্নের গভীর অন্ধকার আর আলোকে।
পরের দিন নয়না সেই ছবিটা প্রদর্শনীর জন্য প্রস্তুত করল, আর ছবির নাম দিল “ছায়ার আমি”। প্রদর্শনীর দিন যারা ছবিটা দেখতে এসেছিল, তাদের অনেকেই থমকে দাঁড়িয়েছিল, কিছুক্ষণের জন্য নিঃশব্দ হয়ে গিয়েছিল। কেউ বলেছিল, ছবিটা দেখে নিজের ভিতরটাকে চিনতে পারছে; কেউ বলেছিল, এতদিন যা লুকিয়ে রেখেছিল, তা যেন হঠাৎ চোখের সামনে চলে এসেছে। নয়না দেখছিল মানুষের চোখের ভেতর জন্ম নেওয়া অজানা আবেগ আর ভয়ের ছায়া, কিন্তু এবার সে আর ভয় পায়নি; বরং সে বুঝেছিল, এই ছবির ছায়াই মানুষের সত্যিকারের গল্পকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। নয়না নিজের চোখে প্রথমবারের মতো সেই ছায়াকে দেখেছিল, যে ছায়া আসলে তারই অংশ—আর সেই দিনই নয়না নিজের শিল্পী সত্তাকে সত্যিকার অর্থে খুঁজে পেয়েছিল।
৮
নয়না যখন সেই শেষ ছবিটার দিকে তাকিয়েছিল, তখন তার মনে হয়েছিল যেন নিজের জীবনের মানচিত্রটা চোখের সামনে খুলে গেছে—সব আলো, অন্ধকার, ব্যথা আর আনন্দ একসাথে। এতদিন ধরে যে অদৃশ্য রঙের শক্তি তাকে দ্বিধায় ফেলে দিয়েছিল, ভয় দেখিয়েছিল, সেই শক্তিকেই এবার নয়না গভীরভাবে স্বীকার করে নিয়েছিল নিজের অংশ হিসেবে। সে বুঝতে পেরেছিল, মানুষের চোখে না দেখা এই রঙগুলো আসলে মানুষের মনের গভীরতম ইচ্ছা, স্মৃতি আর না বলা কথার রঙ—যা কোনো প্যালেটে নেই, কোনো বইতে লেখা নেই। এই রঙই মানুষকে তার নিজের কাছে ফিরিয়ে দেয়, পুরনো স্মৃতি, ভোলা যন্ত্রণা, অজানা আনন্দ—সব মনে করিয়ে দেয়। নয়না টের পেয়েছিল, এই শক্তিকে শুধু ভয়ের চোখে দেখলে হবে না; বরং বুঝতে হবে, এই শক্তিই মানুষের অজানা অনুভূতিগুলোর ভাষা, যা কেবল তার তুলির মধ্যে জীবিত থাকে।
প্রদর্শনীর শেষ দিনটায় নয়না নিজেই মানুষের ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল, চোখ বন্ধ করে শুধু তাদের নিঃশ্বাস, ফিসফিস আর কণ্ঠের কাঁপুনি শুনছিল। সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল—কেউ নিজের হারানো মানুষকে মনে করছে, কেউ পুরনো ভুলের জন্য কাঁদছে, আবার কেউ নিজের অজানা স্বপ্নের কথা ভাবছে। নয়না অনুভব করেছিল, তার আঁকা ছবি কেবল দেখার জিনিস নয়, বরং অনুভবের দরজা—যা খুললে মানুষ নিজের কাছে ফিরে যেতে পারে। সেই রাতে, প্রদর্শনী শেষের পর নয়না গ্যালারির ফাঁকা ঘরে বসে ছিল একা। জানালা দিয়ে ঢুকে আসা ঠান্ডা বাতাস, দূরের ট্রাফিকের ক্ষীণ শব্দ আর নিজের হৃদয়ের স্পন্দন মিলে এক অদ্ভুত সঙ্গীতের মতো মনে হচ্ছিল তার কাছে। নয়না বুঝতে পেরেছিল, এই সঙ্গীতই তার রঙের ভাষা; যেটা সে চোখে দেখতে পায় না, তবু সারা শরীর দিয়ে অনুভব করে।
নয়না শেষবারের মতো নিজের আঁকা ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখেছিল; এবার আর সেগুলোকে সে ভয়ের চোখে দেখেনি, বরং একরকম স্নেহ আর গর্ব নিয়ে দেখেছিল। কারণ এই ছবিগুলো শুধু মানুষকে কাঁদায়নি, বরং তাদের মনে লুকিয়ে থাকা সত্যিটা দেখিয়েছে—যা থেকে মানুষ হয়তো অনেকদিন পালিয়ে বেড়িয়েছিল। নয়না বুঝতে পেরেছিল, অদৃশ্য রঙের অর্থ আসলে এই সত্যকে স্পর্শ করা, তাকে অস্বীকার না করে আঁকায় জীবন্ত করে তোলা। সেই দিন রাতেই নয়না প্রতিজ্ঞা করেছিল, সে আর শুধু ছবি আঁকবে না; সে আঁকবে মানুষের মনের গভীর আলো আর অন্ধকার, ব্যথা আর প্রেম, হাহাকার আর মুক্তি—সব একসাথে। সেই অদৃশ্য রঙেই মানুষ নিজেকে চিনবে নতুনভাবে, আর নয়নার তুলির টানে তাদের হৃদয়ের অজানা দরজাগুলো খুলে যাবে। নয়না জানত, এ পথ সহজ নয়, তবু এটাই তার সত্যিকারের পথ—যেখানে চোখে দেখা যায় না, কিন্তু মন ছুঁতে পারে সেই অদৃশ্য রঙ।
সমাপ্ত