রোহিত মণ্ডল
অধ্যায় ১: রাতের আতঙ্ক
গ্রামের নাম শান্তিপুর, চারপাশে সবুজ ধানক্ষেত, বাঁশঝাড় আর মাঝখানে কুঁড়েঘর ঘেরা এক উঠোন। দিনের বেলায় এখানে হাসি, আড্ডা আর পাখির কলতান শোনা যায়, কিন্তু রাতে পরিবেশ বদলে যায় সম্পূর্ণ। রাত যত গভীর হয়, ততই নীরবতা যেন জমাট বাঁধে; কেবল ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর দূরের শেয়ালের হুক্কাহুয়া শব্দ ভেসে আসে। সেই রাতে, পূর্ণিমার আলো মেঘে ঢাকা থাকলেও গ্রামটায় এক অদ্ভুত অস্বস্তি ছড়িয়ে ছিল। ভোরের দিকে প্রথম আলো ফোটার আগেই অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখা গেল—গ্রামের মাঝের উঠোন জুড়ে লম্বা লম্বা মানুষের পায়ের ছাপ। যেন কেউ রাতভর হাঁটাহাঁটি করেছে, কিন্তু সেই পায়ের ছাপ কোথাও গিয়ে শেষ হয়নি, আবার শুরু হয়নি। এগুলো যেন শূন্য থেকে জন্ম নিয়েছে আর হঠাৎ করেই মিলিয়ে গেছে মাটির বুকে। গ্রামের বৃদ্ধা গঙ্গাদেবী ভোরে উঠেই প্রথম লক্ষ্য করলেন এগুলো। তিনি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ডাকাডাকি শুরু করলেন, আর একে একে সবাই ঘর থেকে বের হয়ে এ দৃশ্য দেখে হতভম্ব হয়ে গেল।
প্রথমে কেউই বুঝতে পারছিল না কীভাবে সম্ভব হলো এটা। পদচিহ্নগুলো এত স্পষ্ট, যেন ভেজা মাটিতে পায়ের ছাপ পড়েছে, অথচ আগের রাতে কোনো বৃষ্টি হয়নি। আরও অদ্ভুত বিষয় হলো—পদচিহ্নগুলোর আকার অস্বাভাবিক বড়, সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেকটাই লম্বা এবং চওড়া। গ্রামবাসীরা একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওি করতে লাগল। কেউ ফিসফিস করে বলল, “এটা নিশ্চয় ভূতের কাজ।” আবার কেউ যুক্তি দিল, “না, ভূত হলে কি এমন স্পষ্ট ছাপ থাকবে?” আতঙ্ক বাড়তে লাগল যখন দেখা গেল পদচিহ্নগুলো উঠোনের মাঝে ছড়িয়ে থাকলেও কোথাও শুরু বা শেষ নেই—না কোনো ঘর থেকে এসেছে, না কোনো পথের দিকে গেছে। যেন কেউ হাওয়ায় ভেসে এসে হঠাৎ মাটিতে পা রেখেছে, আবার মিলিয়ে গেছে অদৃশ্য হয়ে। গ্রামের বাচ্চারা কান্নাকাটি শুরু করল, নারীরা দরজার আড়ালে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে রইল, আর পুরুষরা ছায়ার মতো স্থির হয়ে কী করা উচিত তা ভেবে উঠতে পারল না।
কিছুক্ষণ পর গ্রামের মন্দিরের ঘণ্টা বাজল, যেন অশুভ কিছু ঘটেছে বোঝাতে। প্রবীণরা বলল, বহু বছর আগে এই গ্রামে হঠাৎ করে একজন অচেনা ভ্রমণকারী নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল। সেই ঘটনার পর আর কখনো তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, তবে গুজব ছড়িয়েছিল সে অভিশাপ দিয়ে গিয়েছিল গ্রামকে। তাই এখন সবাই বিশ্বাস করল, সেই অভিশাপ আবার ফিরে এসেছে। আতঙ্ক এতটাই তীব্র হয়ে উঠল যে কেউ আর সাহস পেল না উঠোনের মাঝের সেই পায়ের ছাপের কাছে যেতে। গ্রামের প্রধান লোকগুলো মিটিং ডাকল, কিন্তু মিটিংয়ের আগেই ভয় আর গুজব ছড়িয়ে পড়ল প্রতিটি ঘরে। কেউ বলল, “অদৃশ্য মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে,” আবার কেউ বলল, “এটা আসলে কোনো শয়তানের চিহ্ন।” যাই হোক না কেন, সেই ভোরের পদচিহ্ন গ্রামের স্বাভাবিক শান্তি ভেঙে দিল, আর রাতের আঁধারে যেন অচেনা অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।
অধ্যায় ২: মানুষের ভিড়
ভোর গড়িয়ে সূর্য ওঠার আগেই খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল—শান্তিপুরে রাতের আঁধারে অদৃশ্য মানুষের পদচিহ্ন দেখা গেছে। আশেপাশের পাড়ার মানুষও খবর শুনে ছুটে এল। মুহূর্তের মধ্যে উঠোন ভরে গেল কৌতূহলী, আতঙ্কিত আর অবিশ্বাসী মানুষের ভিড়ে। বৃদ্ধরা চোখ কুঁচকে ছাপের মাপ মাপতে লাগল, যুবকেরা দূর থেকে তাকিয়ে হাসি চাপার চেষ্টা করল, কিন্তু মনের গভীরে তাদেরও ভয় কুঁকড়ে ধরল। মহিলারা চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে, দূর থেকে আঙুল উঁচিয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে ফিসফিস করতে লাগল। গ্রামীণ পরিবেশে এমন ঘটনার কথা কেউ কখনো শোনেনি। মানুষজন কেউ বলল, “এটা শয়তানের খেলা,” আবার কেউ বলল, “না, নিশ্চয় কোনো চালাক লোক ভুয়া পদচিহ্ন বানিয়েছে।” কিন্তু ছাপের দিকনির্দেশ দেখে সবাই অবাক হলো—এগুলো কোনো ঘরে প্রবেশ করেনি, কোনো পথ ধরে বের হয়নি, শুধু মাঝখানে ছড়িয়ে আছে। যেন কেউ অদৃশ্য হয়ে মাটি ছুঁয়ে আবার মিলিয়ে গেছে।
ধীরে ধীরে ভিড়ের মধ্যে বিতর্ক শুরু হলো। একদল বলল এটা ভৌতিক ব্যাপার, অন্যরা যুক্তি দিল হয়তো কোনো অচেনা লোক গ্রামের মধ্যে ঢুকে গেছে আর অদ্ভুতভাবে নিজেকে আড়াল করেছে। একজন কৃষক বলল, “আমি সারারাত ক্ষেতে ছিলাম, কারও হাঁটার শব্দ শুনিনি।” সঙ্গে সঙ্গেই অন্য কেউ বলে উঠল, “তাহলে ছাপগুলো কোথা থেকে এল?” চারদিকে উত্তেজনা বাড়তে লাগল। কেউ কেউ সাহস করে ছাপগুলোর উপর পা রাখতে চাইলো, কিন্তু তখনই বৃদ্ধারা আর মহিলারা চিৎকার করে উঠল, “না, ওগুলো ছোঁও না! অশুভ শক্তি লেগে যাবে।” আতঙ্কে সবাই আবার পিছু হটল। কিছু যুবক ভিড়ের পেছন থেকে ঠাট্টা করতে চাইলো, কিন্তু তাদের চোখে-মুখেও লুকোনো ভয়ের ছাপ ছিল স্পষ্ট। এভাবে গ্রামের মানুষ একদিকে কৌতূহল আর অন্যদিকে আতঙ্কের দোলাচলে দুলতে থাকল, কেউ কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারল না।
ঠিক তখনই গ্রামের মোড়ল হাজির হলেন। তিনি দীর্ঘ দাড়িওয়ালা, প্রভাবশালী একজন মানুষ, যিনি সাধারণত গ্রামের সমস্যার সমাধান করেন। তিনি দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, “এটা নিছক কাকতালীয় কিছু নয়। আমাদের সতর্ক হতে হবে। গ্রামকে রক্ষা করতে হলে সবাইকে এক থাকতে হবে।” কিন্তু তাঁর কথায়ও ভয় কমল না, বরং সবাই আরও গম্ভীর হয়ে উঠল। অনেকে বলল, গ্রামের মন্দিরে বিশেষ পূজা দিতে হবে, আবার কেউ বলল, পুলিশ ডাকতে হবে। এভাবেই সেই পদচিহ্ন ঘিরে মানুষের ভিড় জমে গেল—কেউ প্রশ্ন তুলল, কেউ গুজব ছড়াল, কেউ ভয় পেল, আবার কেউ কৌতূহল সামলাতে না পেরে আরও কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সেদিন সকাল থেকেই শান্তিপুর গ্রাম আর শান্ত থাকল না; মানুষের চোখেমুখে অচেনা এক আতঙ্ক, অস্থিরতা আর সন্দেহের ছাপ আঁকা হয়ে রইল, যেন এই পদচিহ্ন এক রাতেই পুরো গ্রামকে অদৃশ্য এক রহস্যের জালে জড়িয়ে ফেলেছে।
অধ্যায় ৩: বয়স্কদের গল্প
মানুষের ভিড় যখন একটু শান্ত হলো, তখন গ্রামের সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তি—নব্বই ছুঁইছুঁই রঘুনাথ কাকু—বেতের লাঠি ঠুকতে ঠুকতে এগিয়ে এলেন। তাঁর চোখে বয়সের ক্লান্তি থাকলেও কণ্ঠে ছিল এক ধরনের ভারী সুর, যেন অতীতের অনেক অজানা ইতিহাস তিনি নিজের ভেতর বহন করছেন। তিনি পদচিহ্নগুলোর দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ নীরব রইলেন, তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “এটা নতুন কিছু নয়। এর আগে এমন ঘটনা ঘটেছে, যদিও তোমাদের অনেকেরই জানা নেই।” সবাই হকচকিয়ে তাঁর দিকে তাকাল। কৌতূহল গ্রাস করল ভিড়কে, আর মুহূর্তেই চারপাশে পিনপতন নীরবতা নেমে এল। রঘুনাথ কাকু গলা খাঁকারি দিয়ে বলতে শুরু করলেন, “চল্লিশ বছর আগে এই গ্রামেই এক অচেনা ভ্রমণকারী এসেছিল। রাতে হঠাৎ সে নিখোঁজ হয়ে গেল। পরদিন সকালে গ্রামের মাটিতে পাওয়া গিয়েছিল এমনই কিছু অদ্ভুত ছাপ, যার শুরু কিংবা শেষ কোথাও ছিল না।”
তাঁর কথায় বাতাস ভারী হয়ে উঠল। গ্রামবাসীদের চোখে ভয়ের ঝিলিক স্পষ্ট হলো। তিনি আরও বললেন, “শুধু তাই নয়, সেই ঘটনার পর থেকে অদ্ভুত দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে—একজন কৃষক হঠাৎ ধানক্ষেতে মারা যায়, এক গৃহবধূ বৃষ্টির রাতে হারিয়ে যায়, আর কখনোই তাদের খোঁজ মেলেনি। তখনকার প্রবীণরাও বলেছিলেন, এটা অশরীরী কোনো শক্তির কাজ। হয়তো সেই ভ্রমণকারীর আত্মা শান্তি পায়নি, তাই সে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়।” ভিড়ের মধ্যে চাপা স্বরে ফিসফিস শুরু হলো। কেউ বলল, “হায় হায়! তবে কি অভিশাপ আবার ফিরে এসেছে?” কেউ আবার শিউরে উঠে বলল, “এই পদচিহ্ন হয়তো অদৃশ্য মানুষের, যে বছরের পর বছর পর আবার আমাদের সামনে এসেছে।” ভয় গ্রাস করতে লাগল সকলকে, যদিও শিক্ষিত আর যুক্তিবাদী কিছু যুবক মুখ টিপে হাসতে লাগল।
কিন্তু গ্রামের মহিলারা এবং শিশুদের চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ ক্রমশ গভীর হচ্ছিল। তারা বিশ্বাস করল, গ্রাম যেন আবার পুরনো অশুভ ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছে। বয়স্কদের গল্প মানুষকে যেন আরও ভয় পাইয়ে তুলল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সিদ্ধান্ত হলো মন্দিরে বিশেষ পূজা দিতে হবে, যাতে অশরীরী শক্তিকে শান্ত করা যায়। মোড়লও সেই প্রস্তাব সমর্থন করলেন, আর ভিড়ের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে পড়ল আগুনের মতো—“ভূত ফিরে এসেছে, আর এবার হয়তো বড় কোনো বিপদ ঘটতে চলেছে।” ভোরের আলোয় গ্রামবাসীদের চোখেমুখে তখন অদ্ভুত এক ছায়া—অতীতের ভয়ের স্মৃতি, বর্তমানের রহস্য, আর অজানার আতঙ্ক মিলেমিশে শান্তিপুরকে এক অস্থির অন্ধকারে ডুবিয়ে দিল।
অধ্যায় ৪: যুক্তির কণ্ঠস্বর
ভোর গড়িয়ে যখন সূর্য উঠল আর চারপাশের গ্রামে দৈনন্দিন কাজকর্ম শুরু হলো, তখনও শান্তিপুরের মানুষ পদচিহ্ন ঘিরে আতঙ্কে আচ্ছন্ন। সেই ভিড়ের ভেতর থেকে উঠে দাঁড়ালেন অরিন্দম, গ্রামের এক তরুণ স্কুলশিক্ষক। তিনি শহরে পড়াশোনা করে গ্রামে ফিরে এসেছেন, আর সবসময় যুক্তির কণ্ঠস্বর তোলার জন্য পরিচিত। গ্রামের কুসংস্কার আর ভৌতিক বিশ্বাসকে তিনি কখনোই আমলে নেননি। এবারও তিনি সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমরা ভয় পাচ্ছো, কারণ তোমরা ভূতের কথা ভাবছো। কিন্তু ভেবে দেখেছো কি—এই পদচিহ্ন যদি সত্যিই কোনো ভূতের হয়, তবে কেন এত স্পষ্ট? ভূত অদৃশ্য হলে তার ছাপ কি মাটিতে থাকবে?” তাঁর কথায় অনেকেই ফিসফিস করে মাথা নাড়ল, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ চোখ ফিরিয়ে নিল। ভয়কে তারা এত সহজে কাটিয়ে উঠতে পারছিল না।
অরিন্দম আরও বললেন, “এটা নিশ্চয় কোনো মানুষের কাজ। হয়তো কেউ ইচ্ছে করে এই গ্রামে আতঙ্ক ছড়াতে চাইছে। তোমরা কি ভেবেছো, এর মধ্যে কোনো চোর বা অপরাধীর ফাঁদ থাকতে পারে? আমরা যদি ভয় পেয়ে ঘরবন্দি হয়ে যাই, তবে সেই অপরাধী আরও সুবিধা পাবে।” তাঁর যুক্তিতে কিছু যুবকের সাহস বাড়ল। তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “হয়তো সত্যিই অরিন্দমদার কথায় যুক্তি আছে।” কিন্তু অন্যদিকে বয়স্করা রুষ্টভাবে মাথা নাড়িয়ে বলল, “তুমি শহরে পড়েছো, তাই গ্রামের অভিজ্ঞতা বোঝো না। ভূত বলে জিনিস আছে, আর এই পদচিহ্ন সেই প্রমাণ।” যুক্তি আর কুসংস্কারের সংঘাত যেন ভিড়ের ভেতরেই ফেটে পড়ল। কেউ শিক্ষকের পাশে দাঁড়াল, আবার কেউ তাঁকে তাচ্ছিল্য করে উপহাস করল।
কিন্তু তর্ক যতই চলল, ভয় ততই ঘন হয়ে উঠল। কারণ যুক্তি দিয়ে সব ব্যাখ্যা করা গেলেও, পদচিহ্নগুলোর রহস্য রয়ে গেল অমীমাংসিত। এগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়ে হঠাৎ শেষ হয়েছে, আর সেই জায়গায় কোনো মানুষের লুকিয়ে থাকার চিহ্নও নেই। অরিন্দম বারবার বললেন, “আমাদের খুঁজে বের করতে হবে সত্যিটা। ভয় পেয়ে পালিয়ে গেলে কোনো সমাধান হবে না।” কিন্তু তাতে গ্রামবাসীর ভীতি পুরোপুরি কাটল না। বরং কেউ কেউ মনে মনে ভাবতে লাগল, যদি সত্যিই ভূত না হয়, তবে এর পেছনে কোন মানুষের ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে? আর সেই মানুষটা কে? যুক্তি আর ভয়ের এই দ্বন্দ্বে শান্তিপুর গ্রামের বাতাস যেন আরও অস্থির হয়ে উঠল। পদচিহ্ন শুধু মাটিতে নয়, যেন মানুষের মনের ভেতরেও অদৃশ্য আতঙ্কের ছাপ এঁকে দিল।
অধ্যায় ৫: নিখোঁজ মানুষের খোঁজ
দিন গড়িয়ে দুপুর নামতেই গ্রামজুড়ে আরেকটি খবর ছড়িয়ে পড়ল, যা সবার আতঙ্ককে দ্বিগুণ করে তুলল। পাশের মাঠে কাজ করা কৃষকরা জানাল, গ্রামের প্রান্তে যে কলাবাগানটা আছে, সেখানকার এক শ্রমিক হরিপদ সকালে থেকে আর দেখা যাচ্ছে না। হরিপদ ভোরে কাজ করতে বেরিয়েছিল, কিন্তু দুপুর পর্যন্ত ফিরে আসেনি, এমনকি খেতেও আসেনি। তার স্ত্রীর কান্নাকাটি ছড়িয়ে পড়তেই গ্রামের মানুষ আবার ভিড় জমাল। কেউ কেউ বলল, “হায় হায়, এই অভিশপ্ত পদচিহ্নই হরিপদকে টেনে নিয়ে গেছে।” অন্যরা চুপচাপ মাথা নেড়ে চোখ নামিয়ে নিল। ভয়ে সবার বুক কাঁপছিল, কারণ নিখোঁজ হওয়ার খবর পদচিহ্নের রহস্যকে আরও ঘনীভূত করে তুলল। অরিন্দম শিক্ষক আবারও বললেন, “এমনটা হতে পারে না। এটা কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। নিশ্চয় কেউ হরিপদকে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে বা ফাঁদে ফেলেছে।” কিন্তু তাঁর যুক্তিকে তেমন কেউ বিশ্বাস করতে পারল না।
গ্রামের প্রধান লোকেরা এবার সভা ডাকল। উঠোনের মাঝখানে বাঁশের মাচা পেতে সবাই জড়ো হলো। একদল প্রস্তাব দিল হরিপদকে খুঁজতে দল পাঠাতে হবে, কিন্তু অন্যরা তীব্র আপত্তি জানাল—“পদচিহ্ন যেখানে শেষ হয়েছে, ওখানে গেলে অশুভ শক্তি গ্রাস করবে।” এই ভয়ে গ্রামের মহিলারা কান্নায় ভেঙে পড়ল। হরিপদের স্ত্রী বারবার অনুরোধ করতে লাগল, “আমার মানুষটাকে খুঁজে দাও, সে এমন হাওয়া হয়ে যেতে পারে না।” কিন্তু কেউই তার সান্ত্বনা দিতে পারল না। আতঙ্কে মানুষ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেল—একদল যুক্তির পক্ষে, আরেকদল ভয়ের কাছে বন্দি। তর্ক-বিতর্ক চলতেই থাকল, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে আসা গেল না। গ্রামের ভেতর এক অদ্ভুত অস্থিরতা নেমে এল, যেন পদচিহ্নের ছায়া সবাইকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
ঠিক সন্ধ্যার আগে কয়েকজন সাহসী যুবক সিদ্ধান্ত নিল নিজেরাই হরিপদকে খুঁজতে যাবে। হাতে লাঠি আর মশাল নিয়ে তারা কলাবাগানের দিকে রওনা দিল। অন্যরা ভয়ে দূরে দাঁড়িয়ে রইল। যুবকেরা যখন বাগানের ভেতর ঢুকল, তারা দেখল মাটিতে ভাঙা পাতার চিহ্ন, কিন্তু হরিপদের কোনো খোঁজ নেই। কেবল বাতাসে এক অদ্ভুত শীতলতা বইছিল, আর গাছের পাতায় অকারণ সড়সড় শব্দ হচ্ছিল। তারা ভয়ে পিছু হটে এল, কিন্তু গ্রামে ফিরে এসে বলল, “হরিপদ নেই, তবে কিছু একটা অস্বাভাবিক আছে।” এই খবর গ্রামজুড়ে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল। এবার সবাই নিশ্চিত হলো—অদৃশ্য মানুষের পদচিহ্ন শুধু ভয় দেখায় না, কাউকে কাউকে গ্রাসও করে নেয়। হরিপদের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা শান্তিপুরের মানুষের মনে এমন এক আতঙ্কের জন্ম দিল, যা তাদের স্বাভাবিক জীবন থেকে অনেক দূরে ঠেলে দিল। পদচিহ্ন যেন এখন শুধু রহস্য নয়, রক্তমাংসের এক ভয়ের ছায়া হয়ে গ্রামটাকে গ্রাস করতে শুরু করল।
অধ্যায় ৬: গোপন অনুসন্ধান
হরিপদের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার পর গ্রাম যেন এক অদৃশ্য আতঙ্কে আবদ্ধ হয়ে পড়ল। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই সবাই দরজা জানালা বন্ধ করে ঘরের ভেতর আটকে থাকল। কিন্তু ভয়ে কাঁপলেও কিছু যুবকের মনে দুঃসাহসের আগুন জ্বলতে শুরু করল। তারা ঠিক করল, এভাবে বসে থাকলে চলবে না, রহস্য উদ্ঘাটন করতে হবে। অরিন্দম শিক্ষক তাদের সাহস দিলেন, বললেন, “সত্যকে জানার একটাই পথ আছে—সামনে গিয়ে দেখা। ভয়কে জয় না করলে এই পদচিহ্ন চিরকাল আমাদের পিছু তাড়া করবে।” সেই রাতেই গ্রামের পাঁচজন যুবক হাতে মশাল আর লাঠি নিয়ে বেরোল। তাদের লক্ষ্য ছিল পদচিহ্ন অনুসরণ করা। গ্রামের মাঝের উঠোনে যেসব ছাপ সকালে দেখা গিয়েছিল, সেগুলো এখনও টিকে ছিল। চাঁদের ফ্যাকাশে আলোয় ছাপগুলো যেন আরও ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছিল।
তারা ধীরে ধীরে ছাপগুলো অনুসরণ করতে শুরু করল। প্রথমে সবকিছু স্বাভাবিক মনে হলেও কিছুদূর যেতেই তারা বুঝতে পারল, পদচিহ্নগুলো কোনো নির্দিষ্ট পথ অনুসরণ করছে না। কখনো এদিক, কখনো ওদিক ঘুরছে, যেন কেউ অকারণে হাঁটছিল। যুবকেরা অস্থির চোখে একে অপরের দিকে তাকাল, তারপরও এগোতে থাকল। পদচিহ্নগুলো একসময় তাদের নিয়ে গেল কলাবাগানের কিনারে, যেখানে হরিপদকে শেষবার দেখা গিয়েছিল। চারদিক এত নিস্তব্ধ যে নিজের হৃদস্পন্দনও তারা শুনতে পাচ্ছিল। হঠাৎ করেই দেখা গেল, পদচিহ্নগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে—যেন মাটি গিলে ফেলেছে শেষ দাগ। কোথাও কোনো চলার চিহ্ন নেই, গাছপালার ভেতরও কোনো ভাঙা ডাল নেই। সবাই থমকে দাঁড়াল। একজন সাহস করে বলল, “এখানেই হরিপদ গায়েব হয়েছে।” বাকিদের শরীর কেঁপে উঠল, কিন্তু তারা পিছিয়ে আসতে চাইল না।
তারা চারদিক খুঁজল, মশালের আলো গাছপালার ভেতর ঘুরল, কিন্তু কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। শুধু মনে হলো যেন অন্ধকারের ভেতর কেউ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ এক ঝাপটা ঠান্ডা হাওয়া এসে মশালগুলো প্রায় নিভিয়ে দিল। যুবকেরা ভয় পেয়ে গেল, তবুও তারা দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইল। শেষমেশ যখন আর কোনো সূত্র মিলল না, তারা ফিরে এল গ্রামে। কিন্তু এই অনুসন্ধানই গ্রামে আরও বড় আতঙ্ক ছড়িয়ে দিল। কারণ তারা গ্রামবাসীকে জানাল—“পদচিহ্নগুলো এক জায়গায় গিয়ে হঠাৎ থেমে গেছে। যেন মানুষ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।” এই কথায় গ্রামের ভেতর আরও ভীতি জন্ম নিল। মানুষজন বুঝে গেল, রহস্যটা কেবল অদৃশ্য মানুষের পদচিহ্ন নয়, বরং এমন এক শক্তি, যা মানুষকেও উধাও করে দিতে পারে। আর সেই রাত থেকে শান্তিপুরের আকাশে অজানা ভয়ের মেঘ আরও ঘন হয়ে জমল।
অধ্যায় ৭: আতঙ্কের বিস্তার
পদচিহ্নের অনুসন্ধান ব্যর্থ হয়ে ফেরার পর শান্তিপুর গ্রামে আতঙ্ক এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ল, যেন প্রতিটি ঘর অদৃশ্য কোনো ছায়ায় ঢেকে গেছে। রাত নামলেই গ্রাম নিস্তব্ধ হয়ে যেত। মুরগি ডাকলেও বা কুকুর হঠাৎ চিৎকার করলে মানুষ আঁতকে উঠত। শিশুরা কান্না থামাতে চাইত না, মহিলারা মন্ত্র জপতে জপতে দরজায় লাল সুতো বাঁধতে লাগল, আর পুরুষরা সশস্ত্র হয়ে বসে থাকলেও তাদের চোখেমুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট ছিল। প্রতিটি উঠোনে আলো জ্বালানো শুরু হলো, যেন আলো অশুভ শক্তিকে ঠেকাতে পারবে। অথচ সেই আলোও মানুষের ভেতরের অন্ধকার ভীতিকে সরাতে পারছিল না। গুজব এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল যে পাশের গ্রাম থেকেও মানুষ এসে গল্প শোনে ভয় পেতে শুরু করল। কেউ বলল, “অদৃশ্য মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে, সে কাউকে টেনে নিয়ে যায়।” আবার কেউ দাবি করল, “আমি রাতে অদ্ভুত শব্দ শুনেছি, যেন শূন্যে কেউ হাঁটছে।”
এই গুজব গ্রামকে আরও অস্থির করে তুলল। দিনে কাজকর্ম স্বাভাবিক থাকলেও মানুষের চোখে-মুখে ছিল অবসাদ, ক্লান্তি আর আতঙ্কের রেখা। ধানক্ষেতে কাজ করতে গিয়েও শ্রমিকেরা বারবার পেছনে তাকাত, যেন কেউ অদৃশ্য থেকে তাদের অনুসরণ করছে। শিশুরা স্কুলে যেতে ভয় পেত, নারীরা জল আনতে একা যেতে চাইত না। সন্ধ্যা নামলেই সবাই একে অপরের ঘরে জড়ো হয়ে বসত, আলো জ্বালিয়ে ভয়ের গল্প করত। সেই গল্পগুলো গুজবকে আরও বাড়িয়ে তুলত, আর প্রতিটি মানুষ মনে মনে বিশ্বাস করতে শুরু করল—গ্রামের চারপাশে কোনো অদৃশ্য শক্তি ঘুরে বেড়াচ্ছে, যে মানুষের পদচিহ্ন ফেলে যায়, আবার মানুষকেও গ্রাস করে। অরিন্দম শিক্ষক যতই যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করতেন, ততই গ্রামবাসীরা তাঁর কথায় আস্থা হারিয়ে বলত, “ভূত না হলে হরিপদ কোথায় গেল?”
এক রাতে পরিস্থিতি এতটাই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল যে গ্রামের মাঝখানের মন্দিরে মানুষ ভিড় জমাল। পূজারি বললেন, বিশেষ যজ্ঞ করতে হবে, তবেই অশুভ শক্তি দূর হবে। সেদিন সবাই মিলে ধূপ, প্রদীপ জ্বালাল, মন্ত্র পড়ল, ঘণ্টা বাজাল। কিছু সময়ের জন্য মানুষের মনে ভরসা ফিরল বটে, কিন্তু রাত গভীর হতে না হতেই আবার ভয় চেপে ধরল। জানালার বাইরে পাতার সড়সড় শব্দও তখন কারও কাছে বাতাসের আওয়াজ নয়, বরং অদৃশ্য মানুষের হাঁটার শব্দ মনে হতে লাগল। ধীরে ধীরে আতঙ্ক শুধু একটি গ্রামের ভেতরেই সীমাবদ্ধ রইল না, চারপাশের গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ল। শান্তিপুরের নাম হয়ে উঠল এক অশুভ জায়গার প্রতীক, যেখানে রাতের আঁধারে অদৃশ্য মানুষের পদচিহ্ন ভেসে ওঠে।
অধ্যায় ৮: সত্য উদ্ঘাটনের সূত্র
অতঙ্কে পাগলপ্রায় গ্রামবাসীরা যখন প্রায় নিশ্চিত হয়ে বসেছিল যে শান্তিপুরে অশরীরী শক্তিই ঘুরে বেড়াচ্ছে, তখন হঠাৎ এক রাতেই ঘটল অন্যরকম এক ঘটনা। সেই রাতে গ্রামের আকাশ মেঘে ঢাকা ছিল, চাঁদের আলো ফিকে হয়ে নেমে এসেছিল ধূসর অন্ধকার। হঠাৎই দেখা গেল নতুন করে উঠোনে পায়ের ছাপ ভেসে উঠছে। এবার আর ভোরে নয়, একদম সবার চোখের সামনে। ভয়ে কেউ এগোতে সাহস পেল না, তবে অরিন্দম শিক্ষক নিঃশব্দে সবকিছু লক্ষ্য করতে লাগলেন। তিনি দেখলেন, ছাপগুলো একটার পর একটা পড়ছে, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার—কোনো মানুষ চোখে পড়ছে না। গ্রামবাসী চিৎকার করে বলল, “দেখেছো! ভূতই পদচিহ্ন ফেলছে।” কিন্তু অরিন্দমের চোখ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। তিনি লক্ষ্য করলেন, পদচিহ্নগুলো পড়ার সময় মাটিতে মৃদু দাগ পড়ছে, যেন কোনো ভারী জিনিস চাপ দিচ্ছে। তাঁর মনে হলো, এটার ভেতরে কোনো চালাকি লুকিয়ে আছে।
অরিন্দম সাহস করে এগিয়ে গেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, অদৃশ্য কেউ নেই, বরং অন্ধকারের আড়ালে একজন মানুষই ছাপগুলো ফেলছে। দূরে এক ঝলক আলোয় তিনি দেখলেন—একটা ছায়া দ্রুত সরছে। সেই ছায়া পায়ে বাঁধা কোনো অদ্ভুত কাঠের খাপ ব্যবহার করছে, যার আকার মানুষের পায়ের চেয়ে বড়। এই খাপ দিয়ে মাটিতে অদ্ভুত ছাপ তৈরি করা সম্ভব। অরিন্দম তাৎক্ষণিকভাবে বুঝে গেলেন, গ্রামের আতঙ্ককে ব্যবহার করে কেউ ইচ্ছে করেই বিভ্রান্ত করছে। তিনি চিৎকার করে বললেন, “ভূত নয়! এটা মানুষের কাজ।” কিন্তু ভিড়ের মধ্যে তাঁর কথা ডুবে গেল আতঙ্কের চিৎকারে। গ্রামবাসীরা ভয়ে এদিক-ওদিক পালাতে লাগল, আর ছায়াটা সেই সুযোগে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
তবে অরিন্দম হাল ছাড়লেন না। তিনি কয়েকজন সাহসী যুবককে ডেকে সবকিছু খুলে বললেন। সবাই প্রথমে সন্দেহ করলেও পরে যুক্তি মেনে নিল। তারা ঠিক করল, পরেরবার ছাপ পড়তে শুরু করলে একসাথে নজরদারি করবে। এই সিদ্ধান্ত গ্রামে নতুন এক স্রোত বইয়ে দিল। যাঁরা এতদিন ভূতের আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছিলেন, তাঁদের মনে এবার জন্ম নিল সন্দেহ—হয়তো সত্যিই ভূত নয়, কোনো মানুষই এই নাটক সাজাচ্ছে। যদিও ভয় পুরোপুরি কাটেনি, তবুও গ্রামবাসীর মনে প্রথমবারের মতো একটুখানি আশার আলো জ্বলে উঠল। সত্য উদ্ঘাটনের প্রথম সূত্র পাওয়া গেল সেই রাতেই, যখন অরিন্দম প্রমাণ করতে পারলেন যে অদৃশ্য মানুষের পদচিহ্ন আসলে অদৃশ্য নয়, বরং কৌশলে তৈরি।
অধ্যায় ৯: মুখোশ উন্মোচন
অরিন্দমের চোখে ধরা পড়া সেই অদ্ভুত ছায়া গ্রামে নতুন আলোচনার জন্ম দিল। যুবকেরা আর দমে থাকল না, তারা ঠিক করল এবার সত্যিটাকে প্রকাশ্যে আনতেই হবে। পরের রাতেই অরিন্দমের পরিকল্পনায় কয়েকজন সাহসী তরুণ গ্রামের চারপাশে ওঁৎ পেতে রইল। মশাল নিভিয়ে, নিঃশব্দে অন্ধকারের আড়ালে লুকিয়ে তারা অপেক্ষা করল, কখন আবার পদচিহ্ন দেখা দেবে। রাত গড়াল, আকাশ ভরে উঠল ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দে, হঠাৎ করেই দেখা গেল আবারও মাটিতে ভেসে উঠছে সেই অদ্ভুত ছাপ। এবার আর মানুষ ভিড় করেনি, কারণ গ্রামবাসীদের বড় অংশকে অরিন্দম বুঝিয়ে ঘরে থাকতে বলেছিলেন। যুবকেরা শ্বাস আটকে লক্ষ্য করল—অন্ধকারে এক ব্যক্তি ধীরে ধীরে এগোচ্ছে, তার পায়ে বাঁধা কাঠের খাপে খোদাই করা মানুষের পায়ের ছাপ, যেটা মাটিতে পড়তেই সবাইকে বিভ্রান্ত করছে।
হঠাৎই সবাই একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ল। অন্ধকার ভেদ করে মশালের আলোয় ধরা পড়ল সেই মানুষটা—সে আর কেউ নয়, গ্রামেরই ধূর্ত লোক রমেশ। চোরাইপথে চাল-ডাল চুরি আর বেআইনি ব্যবসার জন্য কুখ্যাত ছিল সে, কিন্তু এতদিন কেউ তার আসল রূপ ধরতে পারেনি। এবার বোঝা গেল, হরিপদের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাও তারই কীর্তি। আসলে হরিপদ রমেশের অপরাধ দেখে ফেলেছিল, তাই তাকে ভয় দেখিয়ে সরিয়ে ফেলা ছিল রমেশের উদ্দেশ্য। পদচিহ্নের ভৌতিক খেলা সাজিয়ে সে পুরো গ্রামকে আতঙ্কিত করেছিল, যাতে তার আসল অপরাধ কেউ টের না পায়। মানুষ ভূত-ভূতের ভয়ে দিন কাটাবে, আর সে নির্বিঘ্নে নিজের কাজ চালিয়ে যাবে।
রমেশ ধরা পড়তেই গ্রামবাসীর ভেতর জমে থাকা ভয় রাগে রূপ নিল। যারা এতদিন আতঙ্কে কেঁপে ছিল, তারাই এবার গলা উঁচু করে চিৎকার করল। কেউ কাঠি, কেউ লাঠি নিয়ে রমেশকে শাস্তি দিতে এগিয়ে গেল। মোড়ল কঠোর কণ্ঠে বললেন, “এই লোক গ্রামকে অন্ধকারে ডুবিয়েছে, আমাদের আতঙ্ককে ব্যবহার করেছে নিজের স্বার্থে। এমন অপরাধ ক্ষমার নয়।” সবাই মিলে রমেশকে বেঁধে ফেলল, আর ঠিক হলো তাকে গ্রামের আদালতে শাস্তি দেওয়া হবে। সেই মুহূর্তে শান্তিপুরের আকাশে যেন এক অদ্ভুত স্বস্তির হাওয়া বইল—যেখানে এতদিন ভয় ছিল, সেখানে এবার সত্য প্রকাশ পেল। অদৃশ্য মানুষের পদচিহ্নের মুখোশ খুলে গেল, আর গ্রামের মানুষ বুঝল, ভয়ের আড়ালে লুকিয়ে ছিল মানুষের লোভ আর প্রতারণা।
অধ্যায় ১০: রহস্যের পরিসমাপ্তি
রমেশকে ধরে আনার পর শান্তিপুর গ্রামে যেন নতুন করে প্রাণ ফিরল। এতদিন যে আতঙ্ক প্রতিটি মানুষের চোখে-মুখে ছাপ ফেলেছিল, তা ধীরে ধীরে রূপ নিতে লাগল স্বস্তি আর নিশ্চিন্ততায়। গ্রামবাসীরা একত্রিত হয়ে গ্রামের মাঝখানে মশাল জ্বালাল, সবার সামনে বাঁধা রমেশকে দাঁড় করানো হলো। লোকজন ক্ষোভে ফুঁসছিল, কেউ চিৎকার করে বলছিল, “আমাদের সন্তানদের ভয় দেখিয়েছে, ঘরে ঘরে অশান্তি ছড়িয়েছে।” আবার কেউ বলল, “হরিপদকে উধাও করেছে, মানুষ হত্যা করার মতো অপরাধও করতে দ্বিধা করেনি।” মোড়ল কঠিন গলায় ঘোষণা করলেন, “রমেশ শুধু চোর নয়, সে আমাদের বিশ্বাস ভেঙেছে। ভূতের ভয়ে আমাদের অন্ধকারে ঢাকতে চেয়েছিল, যাতে নিজের অপরাধ ঢেকে যায়।” গ্রামের সিদ্ধান্ত হলো—রমেশকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হবে, যাতে আইনের বিচারে তার শাস্তি হয়।
অরিন্দম শিক্ষক তখন সবার সামনে দাঁড়িয়ে শান্তভাবে বললেন, “আজকের ঘটনা আমাদের একটা বড় শিক্ষা দিল। ভয় যতই শক্তিশালী হোক, সত্য তার থেকেও শক্তিশালী। অদৃশ্য মানুষের পদচিহ্ন আসলে মানুষের লোভ আর অপরাধ ছাড়া কিছু নয়। আমরা যদি যুক্তিকে আঁকড়ে ধরি, তবে কোনো কুসংস্কারই আমাদের বিভ্রান্ত করতে পারবে না।” তাঁর কথায় গ্রামবাসীর মনে দৃঢ়তা এল। মহিলারা কান্না থামাল, শিশুরা আবার হাসতে শুরু করল, আর পুরুষরা বুঝল, অন্ধকার যত গভীরই হোক, তাকে ভেদ করার সাহস মানুষের ভেতরেই আছে। সেই রাতেই গ্রামের মন্দিরে ঘণ্টা বাজানো হলো, তবে এবার ভয় দূর করার জন্য নয়, সত্যকে উদ্যাপন করার জন্য।
পরদিন সকাল থেকে শান্তিপুর গ্রাম আবার তার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে শুরু করল। ধানক্ষেতে মানুষ কাজ করতে গেল, নদীর ঘাটে মেয়েরা জল তুলতে গেল, আর উঠোনে শিশুদের খেলা ভেসে উঠল। তবে এই ঘটনার স্মৃতি মুছে গেল না। পদচিহ্নের ভৌতিক ছায়া আর অদৃশ্য আতঙ্ক হয়তো আর কখনো ফিরে আসবে না, কিন্তু তার গল্প রয়ে গেল মানুষের মনে। বছর বছর সেই কাহিনি শোনানো হবে—কীভাবে এক রাতে অদৃশ্য মানুষের পদচিহ্ন গ্রামকে আতঙ্কে ডুবিয়ে দিয়েছিল, আর কীভাবে সাহস আর যুক্তি মিলেই সত্যকে উদ্ঘাটন করেছিল। শান্তিপুরের মানুষ বুঝল, ভয় কেবল মনের সৃষ্টি, আর সত্যিকারের অদৃশ্য মানুষ হলো মানুষের ভেতরের লোভ, যা যদি লাগাম ছাড়া চলে, তবে অন্ধকারের মতো গ্রাস করে নেয় সবকিছু।