দেবপ্রতিম সাহা
কুহেলি দত্তের প্রতিদিনের কাজ ছিল একঘেয়ে অথচ ভীষণ মনোযোগের—স্যাটেলাইট ডেটার অগণিত ছবি বিশ্লেষণ করা। দক্ষিণবঙ্গের জঙ্গল অঞ্চলের মানচিত্র সে তৈরি করছিল তার গবেষণার জন্য, বিষয় ছিল ভূ-পরিবেশ পরিবর্তনের প্রভাব। দিনের পর দিন চোখের সামনে আসছিল নদীর প্রবাহ বদলানো, বনাঞ্চলের সবুজ কমে যাওয়া কিংবা গ্রামের বিস্তার। কিন্তু সেদিন রাতের স্যাটেলাইট ছবিতে তার চোখ হঠাৎ স্থির হয়ে গেল। ঝাপসা একখণ্ড ফ্রেমে সে দেখতে পেল অদ্ভুত জ্যামিতিক রেখা—আয়তক্ষেত্র, অর্ধবৃত্ত আর সোজা প্রাচীরের মতো দাগ একসঙ্গে মিলেমিশে আছে। এগুলো প্রকৃতির তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা নেই, কিন্তু মানচিত্রে সে জায়গায় কোনো গ্রাম নেই, কোনো জনবসতি নেই, এমনকি সরকারি রেকর্ডেও নেই কোনো নির্মাণ। সে প্রথমে ভেবেছিল হয়তো সফটওয়্যারের ত্রুটি বা ডেটার কোনো বিকৃতি। কয়েকবার ছবিগুলো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে, আলোর কনট্রাস্ট বদলে, মাপজোক করে দেখার পরও সেই নকশাগুলো একইভাবে রয়ে গেল—যেন ঘন জঙ্গলের মধ্যে লুকোনো কোনো শহরের ছায়া। তার বুকের ভেতর কেমন যেন হালকা কাঁপুনি শুরু হলো। যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু কৌতূহল তাকে ছাড়ল না। সে জানত, এ আবিষ্কার একা তার সীমার মধ্যে রাখতে গেলে মাথা ফেটে যাবে।
তখনই সে ফোন করল অয়ন মুখার্জিকে। অয়ন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং প্রত্নতত্ত্ববিদ, যার জীবনের লক্ষ্য ছিল প্রাচীন সভ্যতার হারিয়ে যাওয়া ধ্বংসাবশেষ খুঁজে বের করা। বহুবার তাকে ঠাট্টা করে কুহেলি বলেছে—“তুমি সিনেমার মতো ভাবো, এ দেশে এমন কিছু নেই।” কিন্তু আজ নিজের চোখে দেখা ছবিগুলো পাঠিয়ে দিল অয়নকে। অয়ন ছবিগুলো খুলে চোখ কচলাতে লাগল। সোজা রেখাগুলো, বৃত্তাকার অংশ আর চৌকো ব্লকের বিন্যাস যেন নিখুঁত কোনো নগর পরিকল্পনার মতো। অয়নের মনে হলো, কোনো প্রাচীন নগরীর ভিত্তিরেখা হয়তো এতদিন জঙ্গলের নিচে চাপা পড়ে ছিল, যা প্রযুক্তির চোখে ধরা পড়ল। সে চুপ করে থাকল না—উত্তেজনায় গলা কাঁপতে লাগল, “কুহেলি, তুমি জানো তুমি কী দেখেছ? এ হয়তো আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার হতে পারে!” কুহেলি একটু সতর্ক সুরে বলল, “অয়ন, আমি এখনই নিশ্চিত কিছু বলছি না। ছবি মানেই প্রমাণ নয়। তবে হ্যাঁ, এই জায়গায় কিছু আছে। তোমার প্রত্নতত্ত্ববিদের চোখ যা ধরছে, সেটা হয়তো সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ।” দুই বন্ধু তখনই ঠিক করে নিল—তাদের দেখা দরকার এই জায়গাটা কাছ থেকে।
অভিযানের পরিকল্পনা শুরু হলো সেদিন রাতেই। কুহেলি স্যাটেলাইট কোঅর্ডিনেট লিখে রাখল, জঙ্গলের মানচিত্র মেলাল, আর অয়ন নিজের পুরোনো নোটবুক খুলে বসে গেল—যেখানে সে নানা প্রাচীন কাহিনি ও লোকগাথা লিখে রাখত। আশ্চর্যজনকভাবে কিছু লোকগাথায় ছিল “বনের ভেতর হারানো আলো” বা “অদৃশ্য নগরী”-র গল্প, যেটি কখনও মানুষকে ভেতরে ডেকে নিয়ে আর ফেরত পাঠাত না। এতদিন এসব সে কল্পকাহিনি ভেবেছিল, কিন্তু আজকের ছবির সঙ্গে সেসব কাহিনি এক অদ্ভুত যোগসূত্র তৈরি করল। কুহেলি যুক্তি আর বিজ্ঞানের মানুষ, তাই মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রমাণ ছাড়া সে কিছুই মানতে রাজি নয়; কিন্তু অয়ন স্বপ্নবাজ, অতীত আর রহস্যের গন্ধ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা দুজনেই জানল, এই যাত্রা সহজ হবে না—অরণ্যের ভেতরে প্রবেশ মানে সাপ-বাঘের ভয়, অজানা রোগ-বালাই, এমনকি স্থানীয় লোকেদের নিষেধাজ্ঞাও। তবু তাদের চোখের ভেতর তখন এক অদ্ভুত ঝিলিক—ভয় নয়, বরং এক অদম্য কৌতূহলের আলো। “স্যাটেলাইটের ছায়া” যেটা দেখিয়েছে, সেটা সত্যিই যদি শহরের অস্তিত্ব হয়, তবে সেই নগরী কত বছরের পুরোনো? কে বানিয়েছিল? কেন তা অদৃশ্য হয়ে গেল? এই প্রশ্নগুলোই তাদের অন্ধকারের ভেতরে আলো দেখাচ্ছিল, আর সেই আলোয় তারা পা বাড়াতে দ্বিধা করল না।
–
অয়ন আর কুহেলি যখন প্রথম সেই অদৃশ্য নগরীর স্যাটেলাইট ছবি নিয়ে পরিকল্পনা শুরু করল, তখন তারা দুজনেই জানত—এই অভিযানে কেবল দু’জন যথেষ্ট হবে না। তাদের দরকার হবে আরও কিছু দক্ষ মানুষ, যারা ভিন্ন ভিন্ন জ্ঞানের মাধ্যমে পুরো রহস্যটা উন্মোচনে সাহায্য করতে পারবে। সেই ভাবনা থেকেই দলে যুক্ত হলো অরিত্র সরকার, এক তরুণ প্রকৌশলী। পড়াশোনার ক্ষেত্র ছিল রোবোটিক্স আর সার্ভে টেকনোলজি, হাতে সবসময় ড্রোন ও নানা যন্ত্রপাতির ঝুলি। অরিত্রর স্বভাব ছিল রসিক ও উচ্ছল, কিন্তু তার এই চঞ্চল হাসির আড়ালে ছিল এক দগদগে ক্ষত—তার বড় ভাই কয়েক বছর আগে হঠাৎ হারিয়ে যায় এক রহস্যময় অভিযানে, আর কখনও ফিরে আসেনি। কেউ বলে সে বনে হারিয়ে গেছে, কেউ বলে পাচারকারীদের হাতে পড়েছিল, কিন্তু অরিত্র কখনও মেনে নেয়নি যে ভাই আর নেই। অদৃশ্য নগরীর গল্প শুনে তার মনে হলো, হয়তো উত্তরটা সেখানেই লুকোনো আছে। তাই অভিযানে যোগ দেওয়ার জন্য সে প্রথমেই রাজি হয়ে গেল, যদিও তার চোখে-মুখে খেলার ছলে কথাবার্তা থাকলেও ভেতরে ছিল এক অদৃশ্য অস্থিরতা।
এরপর দলে এলো মৌমিতা পাল, বয়সে সবার ছোট হলেও কৌতূহলে সবার চেয়ে এগিয়ে। বায়োটেকনোলজি-রিসার্চার মৌমিতার চোখে পৃথিবীর প্রতিটি অজানা উদ্ভিদ কিংবা অচেনা প্রাণী একেকটা নতুন আবিষ্কারের দরজা। অনেক সময় সে বিপদ ভুলে এগিয়ে যায় কেবল এই কৌতূহলের কারণে। কিন্তু তার কৌতূহলই তাকে অভিযানের অপরিহার্য সদস্য বানায়। অয়ন ভেবেছিল নগরী যদি সত্যিই প্রাচীন বা ভিনগ্রহী প্রযুক্তির ল্যাব হয়, তবে সেখানে জীববিজ্ঞান বা জেনেটিক্সের সঙ্গে সম্পর্কিত রহস্যও থাকতে পারে—এবং সেসব বোঝার জন্য মৌমিতা ছাড়া আর কেউ উপযুক্ত নয়। মৌমিতার উপস্থিতি দলে একটা আলাদা এনার্জি নিয়ে এল। তার চঞ্চল প্রশ্ন, দ্রুত নোট নেওয়া, আর এক মুহূর্তে বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ার স্বভাব সবাইকে অস্থির করলেও ভেতরে ভেতরে দলের মনোবল বাড়িয়ে দিচ্ছিল। অয়ন, কুহেলি আর অরিত্র বুঝতে পারল—প্রতিটি মানুষের আলাদা উদ্দেশ্য এই অভিযানের মেরুদণ্ড গড়ে তুলছে। ইতিহাস, বিজ্ঞান, ব্যক্তিগত অনুসন্ধান—সব মিলে দলটা যেন এক বহুমুখী অনুসন্ধানযাত্রার রূপ নিল।
তবু শহুরে চার তরুণ গবেষকের পক্ষে দক্ষিণবঙ্গের ঘন জঙ্গল চেনা সহজ কাজ ছিল না। সেই ফাঁক পূরণ করতে এল সুমন দাস। একেবারে স্থানীয় ছেলে, যে জন্ম থেকে বড় হয়েছে জঙ্গলঘেরা গ্রামে। বনের পথ, নদীর স্রোত, পশুপাখির শব্দ—সবই তার কাছে যেন বইয়ের মতো খোলা। সুমনের পরিবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে শুনে এসেছে সেই “হারানো আলো” আর “অদৃশ্য নগরী”-র কাহিনি, যেগুলো শহরের মানুষ ঠাট্টা করে লোককথা বলে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু সুমনের চোখে সেসব ছিল অদ্ভুত এক সতর্কবার্তা। প্রথমে সে অভিযানে যেতে রাজি হয়নি, কারণ তার দাদু সবসময় বলতেন—যে নগরীর নাম শোনা যায়, সেখানে পা রাখলে আর ফেরা যায় না। কিন্তু অয়ন আর কুহেলির জেদের কাছে শেষমেশ সুমন রাজি হলো, শর্ত রাখল—বনে তারা যা-ই দেখুক, গ্রাম্য বিশ্বাসকে অবহেলা করবে না। এইভাবে তৈরি হলো পাঁচজনের এক অসম্ভব দল—অয়ন ইতিহাস খুঁজছে, কুহেলি বিজ্ঞানের যুক্তি নিয়ে এগোচ্ছে, অরিত্র নিজের হারানো ভাইয়ের উত্তর খুঁজছে, মৌমিতা অচেনা প্রাণ ও জীবনের সন্ধানে আছে, আর সুমন বাঁচার পথ শেখাচ্ছে। প্রত্যেকের মনে ভিন্ন ভয়, ভিন্ন আকাঙ্ক্ষা, কিন্তু এক সুতোয় বাঁধা সেই কৌতূহল—অদৃশ্য নগরী সত্যিই আছে কি না। সেদিন রাতে তারা সবাই মিলে মানচিত্র খুলে বসে রুট ঠিক করল, ব্যাগে নোটবুক, ড্রোন, লেন্স, জিপিএস, মেডিক্যাল কিট ভরে রাখল, আর একে অপরের চোখে খুঁজে নিল এক আশ্চর্য প্রতিজ্ঞা—যে যা-ই খুঁজুক, এই অভিযানের মাধ্যমে সবাই কিছু না কিছু হারানো সত্যের সন্ধান পাবেই।
–
সকালবেলায় তারা যাত্রা শুরু করেছিল, গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে যখন দলে দলে পাখির ডাক আর বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো পড়ছিল, তখনও যাত্রার রোমাঞ্চে কারও মনে ভয় কাজ করছিল না। কিন্তু যত গভীরে তারা প্রবেশ করতে লাগল, ততই প্রকৃতির রূপ বদলাতে থাকল—গাছপালার ভিড়ে আকাশ প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেল, হাওয়ার গতি থেমে এল, চারদিকে শুধু সোঁদা গন্ধ আর একধরনের অস্বাভাবিক নীরবতা। সুমন এগিয়ে চলছিল সামনে, মাঝে মাঝে কানে হাত দিয়ে মাটির শব্দ শুনে পথ নির্ণয় করছিল, যেন বন তাকে ফিসফিস করে বলছে কোন দিকে যেতে হবে। অয়ন বিস্ময়ে লক্ষ্য করছিল চারপাশে অচেনা শ্যাওলা আর অদ্ভুত আকারের লতাগুল্ম, কুহেলি বারবার জিপিএস চেক করে যাচ্ছিল, কিন্তু যন্ত্রের তীর যেন তাদের একই জায়গায় ঘোরাতে চাইছে। হঠাৎই মৌমিতা চমকে উঠল—ঝোপের ভেতর থেকে এক অদ্ভুত নীলাভ আলো ভেসে উঠল, যেন বাতাসে ভাসমান কোনো শিখা। সেই আলো এক মুহূর্তে মিলিয়ে গেল, আর তার জায়গায় এল অদ্ভুত এক কম্পন—মাটির তলা থেকে গম্ভীর ঢাকের মতো আওয়াজ। সবাই থমকে দাঁড়াল, কেবল সুমনের ঠোঁটে মৃদু উচ্চারণ—“হারানো আলো…।” সে যেন গ্রাম্য কাহিনির ছায়া বাস্তবে এসে দাঁড়াতে দেখছিল।
যত এগোনো হচ্ছিল, ততই অস্বাভাবিকতার ঘনত্ব বাড়ছিল। বাতাসে কেমন যেন ধাতব গন্ধ, শ্বাস নিতে গিয়ে মনে হচ্ছিল ফুসফুসে ঠান্ডা কুয়াশা জমে যাচ্ছে। অরিত্র ড্রোন উড়িয়ে দেখতে চাইল সামনের পথটা, কিন্তু স্ক্রিনে কিছুই দেখা গেল না—শুধু অদ্ভুত বিকৃত রেখা, যেন যন্ত্র নিজেই বিভ্রান্ত। কুহেলি বলল, “এটা কোনো প্রাকৃতিক নয়, এখানে কিছু একটা চৌম্বকীয় শক্তি কাজ করছে।” অয়ন চারপাশে তাকিয়ে হাঁটছিল, তার চোখে একসঙ্গে ভয় আর মুগ্ধতা—যেন প্রতিটি গাছের আড়ালে ইতিহাসের কোনো অদৃশ্য দরজা লুকিয়ে আছে। হঠাৎ তারা সবাই একইসঙ্গে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখল—সামনের গাছগুলোর ফাঁকে ঝাপসা এক দেয়াল, যা প্রথমে কুয়াশার মতো লাগছিল, পরে দেখল সেটা যেন কোনো স্বচ্ছ প্রাচীর। মৌমিতা হাত বাড়িয়ে ছুঁতে গেল, কিন্তু আঙুল প্রাচীরের কাছে আসতেই যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। সে চিৎকার করে হাত টেনে নিল—“এটা দেয়াল নয়, এটা কিছু অন্যকিছু!” আলো আর ছায়ার দোলাচলে সেই প্রাচীর বারবার দৃশ্যমান ও অদৃশ্য হতে লাগল। সুমনের গলা কাঁপতে লাগল, “দাদু বলত, এই বনের মধ্যে এক অদৃশ্য দরজা আছে, যেটা পার হলে মানুষ আর ফিরে আসে না। তোমরা দেখছ, এটাই সেই জায়গা।”
সবার চোখে তখন ভয় আর কৌতূহলের এক মিশ্র ঝড়। অয়ন ফিসফিস করে বলল, “এই প্রাচীরই আমাদের গন্তব্য। স্যাটেলাইট ছবিতে যে নকশা দেখা গিয়েছিল, তার শুরু এখানেই।” কুহেলি যুক্তি খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিল, “হয়তো এটা কোনো প্রাকৃতিক গ্যাস লেয়ার, কিংবা তাপমাত্রার কারণে আলোর বিভ্রম।” কিন্তু নিজের কণ্ঠস্বরেও সে আত্মবিশ্বাস খুঁজে পাচ্ছিল না। অরিত্রর চোখে তখন অন্যরকম তৃষ্ণা—সে প্রাচীরের ভেতরে তাকিয়ে যেন কাউকে খুঁজে ফিরছে। মৌমিতা আবারও হাত বাড়াল, এবার তার তালুর ওপর দিয়ে ঠান্ডা তরঙ্গ বয়ে গেল, যেন সে মুহূর্তের জন্য শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছিল। প্রাচীরটা তখনও বারবার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে আর আবার ফিরে আসছে, যেন তাদের ডেকে নিচ্ছে। বাতাসে এক অজানা শব্দ গুঞ্জরিত হচ্ছিল—না মানুষের ভাষা, না পশুপাখির ডাক, বরং এমন কিছু যা কানে না শুনেও মনে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। সুমন তীব্র স্বরে বলল, “এখনো সময় আছে, ফিরে চল।” কিন্তু বাকিরা জানত, এই অদৃশ্য দরজা পার না হলে তাদের অভিযানের মানে থাকবে না। তাই পাঁচজন তরুণ দাঁড়িয়ে রইল সেই রহস্যময় প্রাচীরের সামনে, যার ওপারে হয়তো ইতিহাস, বিজ্ঞান, কিংবা মৃত্যুর সঙ্গে তাদের প্রথম মুখোমুখি হওয়ার অপেক্ষা।
–
দীর্ঘক্ষণ দ্বিধা আর পরীক্ষার পর অবশেষে কুহেলি আবিষ্কার করল—ঝাপসা প্রাচীরটা কেবল কোনো কুয়াশা বা আলো-ছায়ার খেলা নয়, বরং এক বিশেষ তরঙ্গমণ্ডল। যখন তারা নিজেদের যন্ত্রপাতির মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট এক ফ্রিকোয়েন্সি তৈরি করল, তখন সেই প্রাচীর অদ্ভুতভাবে তরঙ্গিত হতে শুরু করল, যেন অদৃশ্য জলাশয়ে ঢেউ উঠছে। অয়ন প্রথমে এগিয়ে গেল, কাঁপতে কাঁপতে হাত বাড়াল, আর মুহূর্তেই সে প্রাচীরের ভেতর দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। বাকিরা স্তব্ধ হয়ে তার নাম ডাকল, কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। কয়েক সেকেন্ড পরেই ভেতর থেকে অয়ন চিৎকার করল, “ভয় পেয়ো না, এপাশে সবকিছু অন্যরকম… কিন্তু নিরাপদ মনে হচ্ছে!” বাকিরা একে একে সাহস করে প্রাচীর অতিক্রম করল। যেন কানে চাপা দিয়ে গভীর জলে ডোবার অনুভূতি, গায়ে ঠান্ডা শিহরণ, তারপর এক ঝটকায় তারা অন্য এক জগতে প্রবেশ করল। চোখ খুলে তারা যা দেখল, তা বিশ্বাস করার মতো শক্তি কারও ভেতরে রইল না। চারপাশে এক বিস্তীর্ণ নগরী—যেন অর্ধেক দৃশ্যমান, অর্ধেক অদৃশ্য। অট্টালিকাগুলো আধা-স্বচ্ছ, সূর্যের আলো তার ভেতর দিয়ে যায়, আবার প্রতিফলিত হয় অচেনা ধাতব পৃষ্ঠে। প্রতিটি স্থাপত্য অজানা গণিতের সূত্রে বাঁধা, প্রতিটি দেয়াল যেন জীবন্ত এবং শ্বাস নিচ্ছে। তারা বুঝল, এটি শুধু এক নগরী নয়, বরং এক জীবন্ত পরীক্ষাগার, যেখানে প্রতিটি ইট, প্রতিটি শিলাস্তর কোনো এক অচেনা উদ্দেশ্যের জন্য সচল।
সুমন আতঙ্কিত চোখে চারদিকে তাকাচ্ছিল, তার মনে হচ্ছিল দাদুর বলা প্রতিটি গল্প এখানে হুবহু মিলে যাচ্ছে। কিন্তু শহরের নীরবতা তাকে আরও বেশি ভড়কে দিল—কোনো মানুষ নেই, কোনো কণ্ঠ নেই, অথচ সবকিছু যেন চলমান। এক জায়গায় তারা দেখল পাথরের মতো কিছু স্তম্ভ, যেগুলো মাঝেমধ্যেই আলোকিত হয়ে উঠছে, আবার নিভে যাচ্ছে, ঠিক যেন কোনো অজানা কম্পিউটার সার্কিট। অরিত্রর চোখে পড়ল এক অদ্ভুত ধাতু, যা সে আগে কখনও দেখেনি—স্পর্শ করলে মনে হয় একসঙ্গে বরফের মতো ঠান্ডা আর আগুনের মতো উষ্ণ। সে ফিসফিস করে বলল, “এগুলো নিশ্চয়ই ভিনগ্রহী উপাদান।” মৌমিতা meanwhile হাঁটু গেড়ে বসে এক অচেনা উদ্ভিদ পরীক্ষা করছিল—পাতা স্বচ্ছ, ভেতরে নীল আলোক রেখা বইছে, যেন জীবন্ত শিরা। সে মুগ্ধ স্বরে বলল, “এখানে প্রতিটি উদ্ভিদ যেন জৈবিক আর প্রযুক্তির মিশ্রণ।” কুহেলি meanwhile ডিভাইস দিয়ে রেকর্ড করতে শুরু করল, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে যন্ত্রের ডাটা বারবার বিকৃত হয়ে আসছিল—কোঅর্ডিনেট বদলে যাচ্ছে, ছবি কুয়াশাচ্ছন্ন হচ্ছে। অয়ন ধীরে ধীরে অনুভব করছিল, এই শহরের প্রতিটি অংশ এক অদৃশ্য বুদ্ধিমত্তার অধীনে কাজ করছে। সে মনে মনে বলল, “এটা শহর নয়, এক বিশাল ল্যাবরেটরি, যেখানে আমাদের উপস্থিতিই হয়তো কোনো পরীক্ষার অংশ।”
যতক্ষণ তারা শহরের ভেতরে হাঁটছিল, ততই বোঝা যাচ্ছিল—এখানে প্রতিটি স্থাপত্য যেন উদ্দেশ্যপূর্ণ। কোনো এক জায়গায় তারা দেখল স্ফটিকের মতো এক গোলক, যার ভেতরে তরল আলোর স্রোত ঘুরছে, যেন কোনো কোষের ভেতর নিউক্লিয়াস। আবার কোথাও দেখতে পেল সিঁড়ির মতো লম্বা করিডর, যা হঠাৎই শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। তাদের চারপাশে এক অভাবনীয় নিস্তব্ধতা—না মানুষের পদধ্বনি, না প্রাণীর শব্দ, শুধু দূর থেকে ভেসে আসা অচেনা স্পন্দন, যা কানে শোনা যায় না, কিন্তু হৃদপিণ্ডে অনুভূত হয়। সুমন ফিসফিস করে বলল, “এটা বনের আলো নয়, এটা অন্য জগতের ফাঁদ।” কিন্তু বাকিরা জানত, তারা এখন ফিরতে পারবে না। অরিত্রর মনে হচ্ছিল, হয়তো এই রহস্যের ভেতরেই তার ভাই হারিয়ে গেছে, আর মৌমিতা যেন প্রতিটি উদ্ভিদে মানুষের ভবিষ্যৎ টিকে থাকার সম্ভাবনা খুঁজে পাচ্ছিল। কুহেলির মনে হচ্ছিল, এই শহরই হয়তো বিজ্ঞানের নতুন ইতিহাস লিখতে যাচ্ছে, আর অয়ন দাঁড়িয়ে অনুভব করছিল—প্রাচীন কালের হারানো কিংবদন্তি আর আধুনিক বিজ্ঞানের মিলনস্থল তারা খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু অচেনা প্রযুক্তির এই নগরীর নীরবতা তাদের মনে এক প্রশ্নই জাগিয়ে রাখল—এখানে সত্যিই কেউ নেই, নাকি অদৃশ্য দৃষ্টির আড়ালে তাদের প্রতিটি পদক্ষেপই পর্যবেক্ষিত হচ্ছে?
–
নগরীর অদ্ভুত স্থাপত্য আর নিস্তব্ধতার ভেতর হঠাৎই দলটির চোখে পড়ল চলমান কিছু ছায়া। প্রথমে তারা ভেবেছিল এগুলো হয়তো আলোর প্রতিফলন, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই স্পষ্ট হলো—এরা জীবন্ত সত্তা। দূরে, আধা-স্বচ্ছ প্রাচীরের ফাঁক দিয়ে, কয়েকটি অবয়ব ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিল। অয়ন, কুহেলি, মৌমিতা, অরিত্র এবং সুমন হাঁপ ধরে দাঁড়িয়ে রইল। আলো-ছায়ার মধ্যে তাদের অবয়ব কখনো মানুষ মনে হচ্ছিল, আবার কখনো যেন কোনো বিকৃত জীব। যত কাছে আসছিল, তত স্পষ্ট হচ্ছিল—এরা মানুষের মতোই হাত-পা আর চোখ নিয়ে চলাফেরা করছে, কিন্তু দেহে অদ্ভুত পরিবর্তন। কারও শরীরের হাড় উজ্জ্বল ধাতব রেখায় বাঁধানো, কারও চোখ থেকে নীলচে আলো বের হচ্ছে, কারও দেহের শিরাগুলো স্বচ্ছ হয়ে ভেতরের আলোকস্রোত দৃশ্যমান। তারা সবাই নীরবে শহরের অলিগলি টহল দিচ্ছিল, যেন এই অদৃশ্য নগরীর প্রহরী। মৌমিতা বিস্মিত হয়ে ফিসফিস করে বলল, “এরা মানুষ হলেও পুরোপুরি মানুষ নয়… এদের দেহে স্পষ্ট জেনেটিক পরিবর্তনের ছাপ আছে।” কুহেলি শিউরে উঠল—এটা কোনো প্রাচীন সভ্যতার অবশিষ্ট নয়, বরং এক চলমান পরীক্ষার ফল।
সুমন ভয়ে পেছাতে চাইছিল, তার গলা কাঁপছিল, “এরা যদি আমাদের দেখে ফেলে?” কিন্তু অয়ন হাত তুলে সবাইকে থামাল, তার চোখে কৌতূহল ভয়কে ছাপিয়ে গিয়েছে। সে লক্ষ্য করছিল প্রহরীদের চলাফেরা—নির্দিষ্ট ছন্দে তারা হাঁটছে, মাঝে মাঝে থেমে আকাশের দিকে তাকাচ্ছে, আবার কোনো অদৃশ্য সংকেতের মতো একে অপরের দিকে দৃষ্টি বিনিময় করছে। মৌমিতা তাদের দেহভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করে বলল, “এরা সম্পূর্ণ রোবট নয়, আবার সাধারণ মানুষও নয়। হয়তো মানবদেহে এমন জিন সংযোজন করা হয়েছে যা তাদের শারীরিক সীমা অতিক্রম করিয়েছে।” হঠাৎই অরিত্রর চোখ আটকে গেল এক অবয়বে। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রহরীর চেহারায় কিছু যেন অদ্ভুত পরিচিতি ছিল—চোয়ালের গড়ন, চোখের কৌণিকতা, দাঁড়ানোর ভঙ্গি। তার বুক ধক করে উঠল। সে মনে মনে বলল, “এ কি সম্ভব? ওর মুখটা… আমার ভাইয়ের মতো।” অরিত্রর ভাই অরিন্দম কয়েক বছর আগে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়েছিল। তার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার সঙ্গে এই অদৃশ্য নগরীর কোনো যোগ আছে কি না—এই সন্দেহ তীব্রভাবে ফিরে এলো তার মনে।
মৌমিতা অরিত্রর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল কিছু একটা ওকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে। সে ধীরে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কাউকে চিনতে পারছ?” অরিত্র কোনো উত্তর দিল না, কিন্তু তার চোখ ভিজে উঠছিল, গলায় জমছিল চাপা ক্রোধ আর হতাশা। তার মনে হচ্ছিল, যদি সত্যিই অরিন্দম এই ভিনগ্রহী পরীক্ষার শিকার হয়ে থাকে, তাহলে সে এখন এই অদ্ভুত রক্ষকদের একজন—অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক অন্য কিছু। কুহেলি ধীরে ধীরে বিশ্লেষণ করছিল, “যদি এখানে মানুষের ওপর পরীক্ষা চলে, তবে তারা শুধু শহরটা ল্যাবরেটরি হিসেবে বানায়নি, বরং মানুষের দেহকেও পরীক্ষার যন্ত্রে পরিণত করেছে।” অয়ন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিল, এই নগরীর উদ্দেশ্য কী? এখানে কাদের তৈরি করা হচ্ছে—নতুন প্রজাতি? ভবিষ্যতের মানবজাতি? নাকি নিছক কোনো নির্দয় খেলা? সুমন তখনও আতঙ্কিত হয়ে চারদিকে তাকাচ্ছিল, তার মনে হচ্ছিল প্রতিটি প্রহরীর দৃষ্টি তাদের বুক ভেদ করে যাচ্ছে, যদিও তারা এখনও ধরা পড়েনি। নগরীর নীরবতার মাঝেও দলটার ভেতরে তখন এক ঝড় বয়ে যাচ্ছিল—ভয়ের, কৌতূহলের, আর ব্যক্তিগত বেদনার। অদৃশ্য নগরী কেবল ভিনগ্রহীদের ল্যাব নয়, বরং তাদের প্রত্যেকের অতীত, বিজ্ঞান আর ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক অনিবার্য সত্যের দরজা হয়ে উঠছিল।
–
নগরীর ভেতরে অদ্ভুত স্থাপত্যের আঁকাবাঁকা করিডর পেরিয়ে যখন অয়ন আর কুহেলি এগোচ্ছিল, তখন হঠাৎ এক প্রাচীরের ভেতর দিয়ে ক্ষীণ আলো তাদের চোখে ধরা দিল। আলোটা সাধারণ ছিল না, বরং ধুকপুক করা নীল স্পন্দনের মতো, যেন জীবন্ত কিছু শ্বাস নিচ্ছে। তারা দ্বিধায় থেমে গেল, কিন্তু কৌতূহল টেনে নিল আরও কাছে। অয়ন দেয়ালে হাত রাখতেই প্রাচীরটা তরল কাচের মতো কাঁপল, আর তার ভেতরে খুলে গেল এক গোপন পথ। নিঃশব্দে ভেতরে ঢুকে তারা হিমশীতল বাতাসের ঝাপটা অনুভব করল। ভেতরে ঢুকেই তাদের নিঃশ্বাস আটকে গেল—চোখের সামনে বিশাল এক কক্ষ, যার দেয়াল জুড়ে সারি সারি কাচের চেম্বার। প্রতিটি চেম্বারের ভেতরে শুয়ে আছে মানুষ—কেউ চোখ বন্ধ করে নিদ্রিত, কেউ শ্বাস নিচ্ছে দ্রুত, কারও মুখ বিকৃত যন্ত্রণায় কাঁপছে। কাচের ভেতরে বুদ্বুদের মতো আলো উঠছে-নামছে, যেন মানুষের জীবনীশক্তিকে টেনে নেওয়া হচ্ছে, আবার ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কুহেলি ফিসফিস করে বলল, “এগুলো তো ল্যাবরেটরি পড… এরা মানুষদের ওপর পরীক্ষা চালাচ্ছে।” অয়ন হেঁটে গেল এক চেম্বারের কাছে, যেখানে একজন যুবকের চোখ আধখোলা, ঠোঁট কাঁপছে যেন সে কিছু বলতে চাইছে। মুহূর্তের জন্য অয়ন ভেবেছিল লোকটা তাকে ডাকছে, কিন্তু কাচের মোটা প্রাচীর আর অদ্ভুত তরলের স্তর সব শব্দকে গ্রাস করে নিয়েছিল।
কক্ষের ভেতরটা নীরব হলেও সেখানে এক ভয়ংকর শব্দ লুকিয়ে ছিল—যে শব্দটা শোনা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায় হাড়ের ভেতর দিয়ে। যেন অচেনা কোনো যন্ত্র অবিরাম মানুষের ভেতরের শক্তি মেপে যাচ্ছে, টেনে নিচ্ছে আর পুনর্গঠন করছে। কুহেলি এক চেম্বারের ডাটা-প্যানেল পরীক্ষা করে দেখল অচেনা প্রতীক আর তরঙ্গচিত্র। তার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল, “ওরা শুধু দেহ নিয়েই পরীক্ষা করছে না, বরং মানসিক শক্তি, চেতনা আর আত্মার গভীর স্তরেও হস্তক্ষেপ করছে। এরা মানুষের শরীরকে নতুন এক জীবনের জন্য প্রস্তুত করছে।” অয়ন চারদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছিল, প্রতিটি চেম্বার একেকটা ভাগ্যের গল্প। কেউ শান্ত ঘুমে আচ্ছন্ন, যেন নতুন জন্মের প্রতীক্ষায়, আবার কেউ অস্থির, যেন নিজের মানবত্ব ধরে রাখতে লড়াই করছে। এক চেম্বারে দেখা গেল এক বৃদ্ধা, যার গায়ে ছড়িয়ে পড়েছে জ্বলন্ত রেখা, আরেক চেম্বারে এক কিশোর, যে কাচের ভেতর থেকে ঘুষি মারার চেষ্টা করছে, কিন্তু তার হাত থেমে যাচ্ছে মাঝপথে। অয়ন ধীরে ধীরে অনুভব করছিল, এই দৃশ্য কেবল কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা নয়, বরং গভীর নিষ্ঠুরতা। তার বুক ধক করে উঠছিল—যদি এই সারির মধ্যে কোনো পরিচিত মুখ লুকিয়ে থাকে? তার মনে পড়ছিল অরিত্রর ভাইয়ের নিখোঁজ হওয়ার কথা, আর সুমনের গ্রাম থেকে হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর রহস্য।
কুহেলি হঠাৎ এক স্থির চেম্বারের দিকে ইশারা করল। সেখানে শুয়ে থাকা মানুষটা একেবারেই নিস্তেজ, যেন প্রাণ নেই। কিন্তু কাচের গায়ে তখনও ক্ষীণ স্পন্দন দেখা যাচ্ছিল, মানে পরীক্ষা থেমে যায়নি। “তারা মৃত্যুকেও থামিয়ে রাখতে চাইছে,” কুহেলি গলা শুকিয়ে বলল, “এরা হয়তো চায় মানুষ মৃত্যুকে অতিক্রম করে এক নতুন প্রজাতিতে পরিণত হোক।” অয়ন দাঁত চেপে ফিসফিস করে উঠল, “কিন্তু এর মানে তো মানুষকে মানুষ না রেখে কিছু অন্যকিছু বানানো হচ্ছে।” তারা দুজন ধীরে ধীরে উপলব্ধি করছিল, এই অদৃশ্য নগরী আসলে ভিনগ্রহীদের এক বিশাল পরীক্ষাগার—যেখানে মানুষকে বিকল্প জীবনে প্রস্তুত করা হচ্ছে। হয়তো এমন এক ভবিষ্যৎ, যেখানে মানুষ আর মানুষ থাকবে না, বরং এক জীবন্ত যন্ত্র, এক মিশ্র সত্তা। অয়ন শিউরে উঠল, কিন্তু তার চোখে একই সঙ্গে ভয়ের সঙ্গে জেগে উঠল এক সংকল্প—এই সত্য সবাইকে জানাতে হবে। কুহেলির মনে হচ্ছিল, তারা হয়তো এখনো সময়মতো এসে গেছে, কিন্তু কতজন মানুষ ইতিমধ্যেই চিরকালের মতো এই পরীক্ষার ফাঁদে আটকে গেছে, তার কোনো হিসেব নেই। নিস্তব্ধ গোপন কক্ষে দাঁড়িয়ে তারা বুঝে গেল—এখানেই এই অভিযানের কেন্দ্রবিন্দু, এখানেই লুকিয়ে আছে মানুষের ভবিষ্যতের অন্ধকার রহস্য।
–
গোপন কক্ষের ভেতর অয়ন ও কুহেলি যখন সেই ভয়ংকর সত্যের ভারে প্রায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তখন হঠাৎই কক্ষের প্রবেশপথে আলো ঝলসে উঠল। ধাতব দরজার মতো কিছু ফাঁক হয়ে গেল, আর সেখানে উদ্ভাসিত হলো এক নারীর অবয়ব। বয়স চল্লিশের কোঠায়, সাদা ত্বক, তীক্ষ্ণ নীল চোখ, আর কাঁধে ঝুলছে এক অদ্ভুত যন্ত্রভর্তি ব্যাগ। তিনি দৃঢ় ভঙ্গিতে ভেতরে ঢুকলেন, যেন এই স্থান তার একান্ত পরিচিত। তাঁর ঠোঁটে ছিল এক রহস্যময় হাসি। অয়ন সঙ্গে সঙ্গে সজাগ হলো, কুহেলিও পিছিয়ে দাঁড়াল। নারীটি নিজেকে পরিচয় করালেন—“ড. হেলেন কার্ভার। আমি বহু বছর ধরে এই অঞ্চল পর্যবেক্ষণ করছি।” তাঁর কণ্ঠে ছিল আত্মবিশ্বাসের ঔদ্ধত্য, যেন তিনি একা সব রহস্যের চাবি নিজের হাতে ধরে আছেন। তিনি একপলকেই কক্ষের সারি সারি নিদ্রিত মানুষকে দেখে মাথা নেড়ে বললেন, “তোরা যা দেখছিস, সেটা ভিনগ্রহীদের কাজ নয়। এটা মানুষেরই তৈরি… মানুষের ভুলে যাওয়া এক প্রযুক্তি।” তাঁর কথায় কুহেলির শরীর কেঁপে উঠল। এতক্ষণ যাকে তারা ভিনগ্রহী সভ্যতার অবদান ভেবেছিল, সেটা যদি মানুষেরই সৃষ্টি হয়, তবে ইতিহাসের কোন অন্ধকার অধ্যায় থেকে এসেছে এই প্রযুক্তি?
ড. কার্ভার ধীরে ধীরে চেম্বারগুলোর কাছে এগিয়ে গেলেন, যেন পুরনো কোনো বন্ধুকে ছুঁতে চাইছেন। তাঁর চোখে অদ্ভুত উন্মাদনার ঝিলিক, গলায় উচ্ছ্বাস, “এটা একসময়ে মানুষের তৈরি মহাপরিকল্পনা ছিল। পৃথিবী বিপর্যয়ের মুখে পড়লে মানুষকে নতুনভাবে গড়ে তোলার প্রযুক্তি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তা হারিয়ে যায়, আর মানুষ ভুলে যায় নিজেরই অতীত। আমি সেই অতীতের সন্ধানেই বহু বছর ধরে এই বন, এই নগরী খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম।” কুহেলি অবিশ্বাসে ফিসফিস করে বলল, “কিন্তু এগুলো যদি মানুষেরই সৃষ্টি হয়, তাহলে কেন আজ পর্যন্ত কেউ জানে না?” ড. কার্ভার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে উত্তর দিলেন, “কারণ মানুষের সভ্যতা সবসময় নিজের ইতিহাসকে ধ্বংস করেছে, মুছে ফেলেছে। যে সভ্যতা এই নগরী বানিয়েছিল, তারা নিজেরাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আর এখন আমি এসেছি সেটাকে পুনর্জীবিত করতে।” অয়ন তাঁর চোখে সেই পরিচিত লোভ দেখতে পাচ্ছিল। হেলেন যা-ই বলুক, তাঁর আসল উদ্দেশ্য নিছক জ্ঞান নয়, বরং দখল—এই প্রযুক্তিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার বেপরোয়া বাসনা। তিনি বললেন, “এখানে যে শক্তি লুকিয়ে আছে, সেটা পুরো বিশ্বকে পাল্টে দিতে পারে। অমরত্ব, শক্তি, নতুন এক মানবজাতি—সবকিছু সম্ভব।” তাঁর কথায় কুহেলি শিউরে উঠল, কারণ তিনি বুঝতে পারছিলেন, এই প্রযুক্তি যদি ভুল হাতে যায়, তবে মানবজাতির অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে যাবে।
অয়ন দৃঢ় গলায় বলল, “আপনি এখানে কী করতে চাইছেন?” ড. কার্ভার ঠাণ্ডা হেসে উত্তর দিলেন, “যা কেউ সাহস করে করতে পারেনি। আমি এই প্রযুক্তিকে বাইরে নিয়ে যাব, আমার নিয়ন্ত্রণে আনব। তোরা যেটাকে বিপদ ভাবছিস, আমি সেটা ভাবছি ভবিষ্যতের সুযোগ হিসেবে।” তাঁর কণ্ঠে অহংকারের সঙ্গে হিংস্রতা মিশে ছিল। কুহেলি এগিয়ে এসে দৃঢ়ভাবে বলল, “কিন্তু এগুলো মানুষ—এদের ওপর পরীক্ষা চালানো মানে তো তাদের অধিকার কেড়ে নেওয়া। আপনি মানুষকে যন্ত্রে পরিণত করতে চাইছেন।” ড. কার্ভারের ঠোঁট বাঁকা হলো, “মানুষ সবসময়ই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। কৃষি, শিল্প, প্রযুক্তি—সবকিছু মানুষকে পাল্টে দিয়েছে। এটাই পরবর্তী ধাপ। যারা টিকতে পারবে, তারাই বাঁচবে। যারা পারবে না, তারা হারিয়ে যাবে।” অয়ন তখন স্পষ্ট বুঝতে পারছিল—এই নারী নিছক বিজ্ঞানী নন, বরং ইতিহাসের এক বিপজ্জনক চরিত্র, যে নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষায় পৃথিবীর ভবিষ্যৎকেই ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। নগরীর ঠান্ডা আলোয় ড. হেলেন কার্ভারের চোখ জ্বলছিল উন্মাদনায়, আর তাঁর আগমন দলের ভেতরে নতুন এক বিভাজন তৈরি করছিল। ভিনগ্রহীদের রহস্য উন্মোচনের লড়াই এখন আর শুধু অজানার বিরুদ্ধে নয়, বরং এমন এক মানুষের বিরুদ্ধে, যে নিজের স্বার্থে পুরো মানবজাতিকেই বলি দিতে প্রস্তুত।
–
ড. হেলেন কার্ভারের আগমন দলের ভেতরে যে অস্থিরতার বীজ বুনেছিল, তা অল্প সময়ের মধ্যেই দ্বন্দ্বে রূপ নিল। তাঁর কণ্ঠে ছিল এমন এক চৌম্বক টান, যা শুধু শব্দে নয়, বরং প্রতিশ্রুতির মোহে মানুষকে জড়িয়ে ফেলতে পারে। তিনি দলের দিকে তাকিয়ে ধীরস্বরে বললেন, “তোরা যদি আমার পাশে দাঁড়াস, আমি তোদের বিশ্বজুড়ে খ্যাতি এনে দেব। তোদের নাম লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায়। বিজ্ঞান, রাজনীতি, শক্তি—সবকিছুর কেন্দ্রে তোরা থাকবে।” তাঁর কণ্ঠস্বর জঙ্গল পেরিয়ে আসা বাতাসের মতো ঠান্ডা অথচ লোভনীয়। কুহেলি তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করল, “আমরা এখানে এসেছি সত্য খুঁজতে, ইতিহাস উদ্ধার করতে। আপনি যা চাইছেন তা হলো দখলদারি, লোভ।” কিন্তু অরিত্র তখন নীরব। ড. কার্ভার তার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলেন এবং বললেন, “তুই কি জানিস, তোর ভাই হয়তো এখানেই আছে? এই কক্ষগুলোর ভেতর, হয়তো অর্ধনিদ্রায়, হয়তো নতুন জীবনে রূপান্তরের পথে। আমাকে সাহায্য কর, আমি তোকে তার সঙ্গে মিলিয়ে দেব।” এই ইঙ্গিত অরিত্রর বুকের ভেতর ঝড় তুলল। এতদিন ধরে নিখোঁজ ভাইয়ের জন্য তার খোঁজাখুঁজি, রাতের অশ্রু, অন্তহীন হতাশা—সব একসঙ্গে মনে ভেসে উঠল। আর এখন যদি সত্যিই ভাইয়ের দেখা পাওয়া যায়, তবে কি সে কার্ভারের পাশে দাঁড়াবে? বাকিরা লক্ষ্য করছিল, অরিত্রর চোখে দ্বিধার ছায়া নেমে এসেছে। মৌমিতা চিৎকার করে উঠল, “অরিত্র, ওর কথা শুনিস না! এটা ফাঁদ।” কিন্তু অরিত্রর মনে তখন দ্বন্দ্বের আগুন জ্বলছিল, সত্য আর প্রতিশ্রুতির মাঝখানে সে দুলছিল।
এই মানসিক অস্থিরতার মধ্যেই হঠাৎ নগরীর চারদিক থেকে অদ্ভুত শব্দ ভেসে এল। গম্ভীর, ধাতব কণ্ঠস্বর, যেন কেউ অদৃশ্য ঘণ্টা বাজাচ্ছে। কুহেলি সজাগ হয়ে ফিসফিস করল, “রক্ষকরা জেগে উঠছে।” সত্যিই, মুহূর্তের মধ্যে চারপাশের বাতাস ঘন হতে লাগল, আর ধোঁয়ার মতো আচ্ছাদন থেকে উদ্ভাসিত হলো অদ্ভুত সত্তারা—অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক অন্যকিছু। তাদের চোখ জ্বলছিল অগ্নিশিখার মতো, দেহে খচিত ছিল ধাতব রেখা, আর হাতে অদ্ভুত অস্ত্রের মতো আলোকশলাকা। তারা একে একে দলের চারপাশ ঘিরে ফেলল। ড. কার্ভার ঠোঁট বাঁকিয়ে মৃদু হাসলেন, যেন এই দৃশ্য তিনি আগেই অনুমান করেছিলেন। তিনি উল্টো দলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “দেখছিস তো, তোরা আমার সঙ্গে এলে এগুলো তোদের রক্ষা করত। এখন এরা তোদের শত্রু।” অয়ন দাঁত চেপে বলল, “না, এরা আমাদের শত্রু নয়। এরা সেই মানুষেরই রূপান্তর, যাদের তুমি বন্দি করেছ।” কিন্তু যুক্তির সময় ছিল না। এক মুহূর্তের মধ্যে রক্ষকেরা ঝাঁপিয়ে পড়ল। আলো আর ছায়ার ভেতর শুরু হলো এক ভয়ঙ্কর সংঘর্ষ। অয়ন হাতে ধরা বৈজ্ঞানিক যন্ত্রকে অস্ত্রের মতো ব্যবহার করল, কুহেলি চেষ্টা করছিল রক্ষকদের প্রযুক্তি বোঝার, মৌমিতা তাদের গতি এড়িয়ে পাল্টা আঘাত করছিল। অরিত্র তখনও দ্বিধায়—সে কি রক্ষকদের থামাবে, নাকি কার্ভারের দিকে যাবে ভাইয়ের খোঁজে? এই দোদুল্যমানতার মাঝেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এক রক্ষক, আর সে শেষ মুহূর্তে সরে গিয়ে দেখল রক্ষকের চোখে এমন শূন্যতা, যা তাকে ভাইয়ের সম্ভাব্য রূপের কথা মনে করিয়ে দিল। তার বুক ফেটে চিৎকার বেরোল, কিন্তু সেই শব্দ সংঘর্ষের শোরগোলের ভেতর হারিয়ে গেল।
যুদ্ধের উত্তাপে নগরীর ভেতর ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে উঠছিল। অদৃশ্য দেয়ালগুলো কাঁপছিল, যেন গোটা শহর শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। ড. কার্ভার দূর থেকে তাকিয়ে দেখছিলেন, মুখে এক ঠাণ্ডা প্রশান্তি, যেন মানুষের লড়াই তাঁর কাছে নিছক এক নাটক। তাঁর চোখে প্রতিফলিত হচ্ছিল ক্ষমতার লালসা—যে কোনো মূল্যে এই প্রযুক্তিকে নিজের হাতে আনতেই হবে। এদিকে অয়ন বারবার চিৎকার করে অরিত্রকে ডাকছিল, “তুই আমাদের সঙ্গে থাক! সত্যটা রক্ষা কর!” কিন্তু অরিত্রর দৃষ্টি ততক্ষণে বদলে গেছে। ভাইয়ের খোঁজ, মায়ার টান, আর কার্ভারের প্রলোভন তাকে ভেতরে ভেতরে ভেঙে দিচ্ছিল। রক্ষকদের সঙ্গে যুদ্ধ যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে, তখন হঠাৎ এক রক্ষক মৌমিতার দিকে প্রাণঘাতী আঘাত আনল। সেই মুহূর্তে অরিত্র দ্বিধা ভেঙে এগিয়ে এসে রক্ষকটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। তবে তার চোখে তখনো অস্থিরতা, যেন সে এখনো জানে না কোন পথ তার। দলের বাকিরা একে অপরকে বাঁচাতে মরিয়া, কিন্তু বুঝতে পারছিল—শত্রু শুধু রক্ষক নয়, শত্রু আরও ভয়ঙ্কর, ভেতরের বিশ্বাসঘাতকতা। নগরীর দেয়ালে তখন অদ্ভুত প্রতীক জ্বলে উঠছিল, যেন শহর নিজেই যুদ্ধের সাক্ষী হয়ে উঠছে। সেই আলোয় স্পষ্ট হয়ে উঠছিল মানুষের সংগ্রাম, দুর্বলতা আর শক্তির লড়াই।
–
নগরীর ভেতরে লড়াই যত এগোতে থাকল, ততই দল অনুভব করল এই শহর নিছক কোনো স্থাপত্য নয়, এটি জীবন্ত সত্তা। চারপাশের দেয়াল, সেতু, টাওয়ার—সব যেন নিজেরাই শ্বাস নিচ্ছে, সাড়া দিচ্ছে, আবার প্রতিরোধ করছে। মৌমিতা, যার অন্তরে সবসময়ই এক ধরনের দৃঢ়তা ও দায়িত্ববোধ কাজ করত, বুঝতে পারল শুধুমাত্র রক্ষকদের সঙ্গে যুদ্ধ করেই তারা মুক্তি পাবে না। যতক্ষণ এই প্রযুক্তির কেন্দ্র অক্ষত থাকবে, ততক্ষণ নতুন রক্ষক জন্ম নেবে, নতুন পরীক্ষার শিকার তৈরি হবে। তাই সে সাহসী সিদ্ধান্ত নিল—নগরীর হৃদয়ে প্রবেশ করে শক্তির মূল প্রযুক্তি ধ্বংস করতে হবে। অয়ন ও কুহেলি আপত্তি করলেও মৌমিতা বলল, “আমরা সবাই যদি শুধু বাঁচার চেষ্টা করি, তাহলে এই দুঃস্বপ্ন কখনো শেষ হবে না। কাউকে না কাউকে এর মূলে হাত দিতে হবে।” তার চোখে দৃঢ় আলো জ্বলে উঠল। সে দৌড়ে ঢুকে গেল নগরীর এক বিশাল গম্বুজাকৃত কক্ষে, যেখানে দেয়ালে সারি সারি অদ্ভুত যন্ত্র জ্বলজ্বল করছিল, কাচের ভেতরে নিদ্রিত মানুষ নিঃশ্বাস নিচ্ছিল অন্য এক জীবনের মতো। মৌমিতার মনে হচ্ছিল সে যেন মানবতার কারাগারে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রতিটি কাচের ঘরে মুখগুলো পরিচিত অথচ অচেনা—কেউ হয়তো হারানো আত্মীয়, কেউ হয়তো পরীক্ষার শিকার সাধারণ মানুষ। তার বুক কেঁপে উঠলেও সে থামল না। কন্ট্রোল কনসোলের দিকে এগিয়ে গিয়ে সে হাত রাখল, ভেতরের যন্ত্রগুলো সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানাল—আলো লাল হয়ে জ্বলে উঠল, যেন শহর নিজেই বুঝে গেল ধ্বংস আসছে। সেই মুহূর্তে মৌমিতা নিজের শ্বাসের শব্দ শুনতে পেল, যেন শেষ লড়াইয়ের জন্য তাকে নিয়তি ডাকছে।
এদিকে সুমন, যে এতদিন কেবল দলের পথপ্রদর্শক হয়ে এসেছিল, হঠাৎ তার শোনা শৈশবের গল্পগুলো মনে পড়তে শুরু করল। গ্রামের প্রবীণরা বলত—জঙ্গলের গভীরে আছে “হারানো আলো”-র বন, আর সেখানে যে নগরী দাঁড়িয়ে আছে, তা টিকে আছে এক শক্তির কেন্দ্রকে ঘিরে। সেই কেন্দ্র ভেঙে দিলে শহর ভেঙে পড়বে। এতদিন সুমন এসব গল্পকে নিছক লোককথা ভেবেছিল, কিন্তু এখন চোখের সামনে নগরীর অস্থিরতা দেখে সে বুঝল—গল্প আসলে সত্যির ছায়া। যুদ্ধের বিশৃঙ্খলার মাঝেই সে চারপাশ লক্ষ্য করতে করতে সেই কেন্দ্রের পথ খুঁজে পেল। এক ফাটল ধরা মাটির নিচে লুকিয়ে ছিল গোলাকার গহ্বর, যেখান থেকে নিরন্তর আলো নির্গত হচ্ছিল। আলো এতটাই প্রখর ছিল যে, সরাসরি তাকানো যায় না। সুমনের মনে হল এটাই সেই শক্তি, যা পুরো শহরকে চালাচ্ছে। সে চিৎকার করে অয়ন ও কুহেলিকে ডাকল, “এটাই কেন্দ্র! যদি এটা ধ্বংস করা যায়, শহর ভেঙে পড়বে।” কিন্তু সমস্যাটা ছিল ভেতরে প্রবেশ করলে ফেরার পথ থাকবে না। আলো যেন এক অগ্নিগহ্বর, যার ভেতরে ঢুকলে মানুষ আর ফিরে আসে না। তবু সুমন দ্বিধা করল না। তার কণ্ঠ গম্ভীর হয়ে উঠল, “আমার গ্রাম বহু বছর ধরে এই ভয়ের ছায়ায় বেঁচে আছে। এখন সময় এসেছে আমি আমার ভূমির দায় শোধ করি।” তার এই সিদ্ধান্তে দলের বাকিরা স্তব্ধ হয়ে গেল। অয়ন তাকে থামাতে চাইলেও সুমন কেবল মৃদু হাসল, যেন মৃত্যুর মুখেও তার আত্মা শান্ত। সুমনের দেহ যখন ধীরে ধীরে আলোকগহ্বরে মিলিয়ে গেল, তখন শহরের ভেতর অদ্ভুত কম্পন শুরু হলো। যেন তার আত্মত্যাগ শহরের ভিত কাঁপিয়ে দিল।
অন্যদিকে অরিত্র তখনো ছুটে বেড়াচ্ছিল ভাইয়ের সন্ধানে। নগরীর এক অন্ধকার করিডরে সে হঠাৎ দেখল, এক কাচের ভেতর শুয়ে আছে পরিচিত চেহারার মানুষ—তার ভাই। কিন্তু ভাইয়ের দেহে ইতিমধ্যেই ভিন প্রযুক্তির ছাপ পড়ে গেছে, তার চোখ অচেনা আলোয় ঝলমল করছে, মুখে নেই কোনো মানবিকতার ছাপ। অরিত্র ভেঙে পড়ল, সে কাচের ওপরে আঘাত করতে লাগল, চিৎকার করে ডাকল, কিন্তু ভেতরের মানুষ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। ড. কার্ভারের কথাই সত্যি হলো—ভাই আর ফিরবে না। সে কেবল এক পরীক্ষার ফল, যাকে হারানো আলো গ্রাস করে নিয়েছে। অরিত্রর বুক ফেটে কান্না এলো, কিন্তু সেই কান্না তাকে দুর্বল করল না, বরং আরও দৃঢ় করল। সে বুঝল—যদি এই নগরী ধ্বংস না হয়, তবে আরও কত ভাই, কত বোন, কত পরিবার চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাবে। সে ফিরে এসে বাকিদের চোখে তাকিয়ে বলল, “আমার ভাই শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা যদি কিছু না করি, পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ এভাবে শেষ হয়ে যাবে। আমাদের শহরটা ধ্বংস করতেই হবে।” তখন অয়ন, কুহেলি ও মৌমিতা (যে ইতিমধ্যেই যন্ত্রপাতি ধ্বংস করতে শুরু করেছে) একসঙ্গে অনুভব করল—এটাই তাদের চূড়ান্ত যুদ্ধ। মৌমিতা কন্ট্রোল কনসোল ভেঙে দিল, সুমনের আত্মত্যাগ শক্তিকেন্দ্রকে অস্থির করে তুলল, আর অরিত্র তার চোখের জল মুছে শহরের দিকে তাকিয়ে বলল, “এটাই মুক্তির সময়।” নগরী তখন ধসে পড়তে শুরু করল। আলোর টাওয়ার ভেঙে ভেঙে পড়ল, ধাতব স্থাপত্য ধুলোর মতো ছড়িয়ে গেল, রক্ষকেরা একে একে আলো হয়ে মিলিয়ে গেল। বিশাল ধ্বংসযজ্ঞের মাঝে দাঁড়িয়ে ছিল এক ছোট দল, যাদের ত্যাগ আর সত্যের প্রতি দৃঢ়তা মানবতার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় রচনা করল।
–
শক্তিকেন্দ্র ভেঙে যাওয়ার পর মুহূর্তেই নগরীর ভেতর অদ্ভুত আলোছায়ার খেলা শুরু হলো। যেন আকাশে ঝড় উঠেছে, অথচ বাতাস নেই, কেবল আলোর তরঙ্গ ছুটে বেড়াচ্ছে চারপাশে। বিশাল টাওয়ারগুলো হঠাৎ কেঁপে উঠে দপদপে সাদা রঙে দীপ্ত হয়ে উঠল, আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ভেঙে গেল নীরব বিস্ফোরণে। সুমনের আত্মত্যাগ যে সত্যিই নগরীর শিকড় নাড়িয়ে দিয়েছে, তা সবাই স্পষ্ট বুঝতে পারছিল। অয়ন, কুহেলি, অরিত্র ও মৌমিতা চারজনই চারদিকে তাকিয়ে দেখছিল—যেন এক জীবন্ত দানব তার শেষ নিঃশ্বাস নিচ্ছে। দেয়ালগুলো স্বচ্ছ হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে, রাস্তা আর নেই, স্থাপত্যগুলো ধীরে ধীরে কুয়াশার মতো ভেসে যাচ্ছে আকাশে। তাদের চারপাশে অজস্র শব্দের প্রতিধ্বনি হচ্ছিল—মনে হচ্ছিল বহু হারানো কণ্ঠ একসাথে হাহাকার করছে, আবার মুক্তির গানও গাইছে। মৌমিতা হাতের তালুতে কেটে যাওয়া রক্তের দাগ মুছে নিতে নিতে ভাবছিল, সে নিজেই যেন ভেতরে মিশে যাচ্ছে এই আলোয়, তবু জীবনের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। অরিত্র অচল দাঁড়িয়ে শুধু তাকিয়ে রইল, কারণ তার মনে হচ্ছিল প্রতিটি আলোকরেখায় ভাইয়ের ছায়া মিলিয়ে যাচ্ছে, যেন বিদায় জানাচ্ছে। নগরী তখন নিভে যাওয়ার আগের আগুনের মতো দীপ্তি ছড়িয়ে শেষ আলোয় ভরিয়ে দিল চারদিক।
ধীরে ধীরে শহরের অস্তিত্ব হারাতে শুরু করল। যে প্রাচীর তাদের প্রথমে আটকে রেখেছিল, সেটিও গলে গিয়ে কুয়াশায় মিশে গেল। বিশাল ল্যাবরেটরির ভেতরে থাকা মানুষগুলোও একে একে আলোর বিন্দু হয়ে বিলীন হলো, যেন কখনো পৃথিবীতে তাদের অস্তিত্ব ছিল না। কুহেলির চোখ ভিজে উঠেছিল, সে ফিসফিস করে বলল, “এরা সবাই কোথায় গেল? এরা কি মুক্তি পেল, নাকি কেবল শূন্যতায় মিলিয়ে গেল?” অয়ন কিছুই বলল না, শুধু দৃঢ়ভাবে সুমনের নাম উচ্চারণ করল, যেন তার আত্মত্যাগকে সম্মান জানাচ্ছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুরো নগরী মুছে গেল—না কোনো ধ্বংসস্তূপ, না কোনো ধাতুর টুকরো, কেবল খালি জঙ্গল আর ভেজা মাটির গন্ধ। এমনকি স্যাটেলাইট থেকেও আর কোনো চিহ্ন ধরা পড়বে না, কারণ যা ঘটল, তা মানুষের প্রযুক্তির বাইরে। সবাই যখন ক্লান্ত শরীরে মাটিতে বসে পড়ল, তখন তারা অনুভব করল—শহর শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু তাদের ভেতরে রেখে গেছে এমন এক পরিবর্তন, যা সারাজীবন বহন করতে হবে। মৌমিতার চোখে এখন আর কোনো ভয় নেই, বরং শান্ত সাহস। অরিত্রর ভেতরে শোক থাকলেও সে জানে নিজের দায়িত্ব শেষ করেছে। আর কুহেলি বারবার আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলছিল, এই রহস্যকে হয়তো কোনোদিনই সে ব্যাখ্যা করতে পারবে না।
অবশেষে তারা জঙ্গলের পথ ধরে ফিরে এলো। কিন্তু জঙ্গলও যেন বদলে গেছে—যেখানে আগে প্রতিটি ছায়া ছিল হুমকি, এখন সেখানে নীরবতা গভীর শান্তির মতো নেমে এসেছে। বাইরে এসে তারা দেখল, আকাশে সূর্যের আলো স্বাভাবিক, বাতাস ঠান্ডা আর পাখির ডাক আবার শোনা যাচ্ছে। তবু তাদের চারজনের মন একেবারেই স্বাভাবিক হলো না। অয়ন মনে মনে ভাবছিল, সত্যিই কি শহরটা পুরোপুরি অন্তর্ধান করেছে? নাকি অন্য কোনো স্তরে, অন্য কোনো সময়ে, আবার অপেক্ষা করছে নতুন জীবনের জন্য? সে জানত, ইতিহাসে এই ঘটনার কোনো প্রমাণ থাকবে না—না কোনো ছবি, না কোনো চিহ্ন। কেবল তারাই জানবে, কী ঘটেছিল সেই জঙ্গলের গভীরে। কিন্তু এই গোপনীয়তা তাদের চারজনকেই বদলে দিয়েছে। তারা শুধু গবেষক বা অভিযাত্রী নয়, তারা এখন সাক্ষী এমন এক সত্যের, যা মানবসভ্যতার সীমানার বাইরে। কুহেলি নিজের নোটবুকে লিখল, “অদৃশ্য নগরী আমাদের ছেড়ে গেছে, কিন্তু হয়তো আবার ফিরে আসবে—যখন মানুষ প্রস্তুত হবে।” অরিত্র চোখ বন্ধ করে ভাইয়ের কণ্ঠ মনে করল, মৌমিতা ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে আকাশের দিকে তাকাল, আর অয়ন ফিসফিস করে বলল, “অদৃশ্য নগরী কখনো হারিয়ে যায় না, সে কেবল অপেক্ষা করে।” তাদের চারজনের নিঃশ্বাসে তখন একসাথে মিশে ছিল মুক্তি, শোক, আর এক অজানা ভবিষ্যতের প্রত্যাশা।
___




