Bangla - রহস্য গল্প

অদৃশ্য ডাকপিয়ন

Spread the love

অনিরুদ্ধ পাল


পর্ব ১ : অচেনা খাম

কলকাতার রাত তখনও ভিজে আছে বৃষ্টির রেশে। অগণিত গলিপথের আলো ঝাপসা হয়ে আছে টলোমলো কুয়াশার মতো বাষ্পে। উত্তর কলকাতার প্রাচীন গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভাঙাচোরা এক ডাকবাক্সে কে আর খাম ফেলে যায় আজকাল? লাল রঙ চটকে গেছে, গায়ে শ্যাওলা জমেছে, ছিদ্র দিয়ে ইঁদুর ঢোকে আর বেরোয়। বহু বছর ধরে অচল পড়ে থাকা সেই বাক্সটা হঠাৎই যেন আজ তাকে ডাকছিল।

রুদ্র সেদিন রিপোর্টিং শেষে ফেরার পথে এক সিগারেট ধরাতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিল বাক্সটার সামনে। চোখে পড়ে অদ্ভুত এক খাম—মোটা বাদামি কাগজে মোড়া, তার নামটা লেখা একেবারে কালো কালি দিয়ে স্পষ্ট অক্ষরে: রুদ্র সেন”। বুকের ভেতর ধক করে উঠল। এই বাক্সে কেউ তার নামে চিঠি ফেলল কীভাবে? সে তো এই রাস্তার বাসিন্দা নয়, কাজের সূত্রে হঠাৎই এখানে আসা।

হাত কাঁপছিল, তবু খামটা তুলে নিল। খামটি যেন অদ্ভুতভাবে উষ্ণ, যেন কারও হাতের ছোঁয়া তখনও শুকোয়নি। সিগারেটটা ফেলে দিয়ে তাড়াহুড়ো করে খাম ছিঁড়ল। ভেতরে একটিই কাগজ। এক লাইনের লেখা—
তুমি ভেবেছিলে সেই রাত কেউ দেখেনি। কিন্তু ডাকপিয়ন সব দেখেছে।”

রুদ্রর বুকের ভেতর রক্ত হিম হয়ে গেল। কোন রাত? কোন ঘটনা? অদৃশ্য আতঙ্ক যেন গলায় চেপে বসল। সাংবাদিকতা করতে গিয়ে অনেক ফাইল ঘাঁটতে হয়, অনেক অন্ধকার গলি, অনেক মানুষ… কিন্তু এ তো তার নিজের অন্ধকার অতীতের আভাস দিচ্ছে!

চারপাশে তাকাল সে। গলির দুই পাশে অচেনা বারান্দা, আধখোলা জানালা, কোথাও ভিজে কাপড় দুলছে, কোথাও টিউব লাইট টিমটিম করছে। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। অথচ স্পষ্ট মনে হচ্ছিল, অদৃশ্য কারও দৃষ্টি তাকে বিদ্ধ করছে।

চিঠিটা পকেটে ভরে দ্রুত হেঁটে বেরোল রুদ্র। মনে হচ্ছিল, প্রতিটি পদক্ষেপে কেউ তাকে অনুসরণ করছে। পেছনে তাকানোর সাহস হচ্ছিল না। যেন পুরো শহর এক নিস্তব্ধ ফাঁদ, আর সেই ফাঁদের অদৃশ্য রক্ষক ডাকপিয়ন।

ফ্ল্যাটে ফিরে আলো জ্বালতেই দেয়ালে নিজের ছায়া কেঁপে উঠল। ঘাম ভেজা কপাল মুছে আবার চিঠিটা হাতে নিল। শব্দগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠছিল—ডাকপিয়ন সব দেখেছে।”

হঠাৎই মনে পড়ল সেই রাত। পাঁচ বছর আগের এক অন্ধকার গলির ঘটনা। একটা দুর্ঘটনা, যা সে গোপন রেখেছিল সারাজীবন। কেউ জানার কথা নয়। যদি সত্যিই কেউ দেখে থাকে, তবে সে এখনও বেঁচে আছে। আর যদি না থাকে, তবে কে এই খেলার নেপথ্যে?

রুদ্রর বুক ধড়ফড় করছিল। বাইরে তখনো ঝিরঝির বৃষ্টি। টেবিলের উপর ফেলা খামটার পাশে সিগারেটের ধোঁয়া পাক খাচ্ছিল, যেন আকাশ থেকে নেমে আসা অদৃশ্য ডাকপিয়নের সিলমোহর।

সেই রাতে ঘুম এল না আর। চোখ বন্ধ করলেই ভেসে উঠছিল এক ভয়ঙ্কর প্রশ্ন—এটাই কি প্রথম, নাকি আরও আসবে?”

পর্ব ২ : রহস্যময় চিঠি

শহর এক অদ্ভুত নীরবতায় ঢাকা পড়ে আছে, অথচ ভেতরে ভেতরে ভয় যেন ছড়িয়ে পড়ছে অজানা অগ্নিকুণ্ডের মতো। রুদ্র ভেবেছিল, হয়তো ওই একটি চিঠিই ভুলবশত এসেছে তার কাছে। কিন্তু পরদিন সকালে অফিসে ঢুকতেই আরেক সাংবাদিক, সহকর্মী মধুমিতা ফিসফিস করে বলল—

—“শুনেছো? পার্ক সার্কাসের সেই প্রোপার্টি ডিলার হঠাৎ কাল রাতে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে। নাকি চিঠি পেয়েছিল।”

রুদ্র চমকে উঠল। —“চিঠি? কীরকম চিঠি?”

মধুমিতা বলল—“কে যেন একটা বাদামি খামে লিখে দিয়েছিল তার পুরোনো জালিয়াতির গল্প। টাকা লুটের কেস। সে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়, তারপরেই আর বাঁচেনি।”

রুদ্রর শরীর হিম হয়ে গেল। তবে কি তার পাওয়া খামের সঙ্গে মিল আছে? অফিসের কোলাহল হঠাৎই কানে ঢুকছিল না। মনে হচ্ছিল, অচেনা ডাকপিয়ন শুধু তাকে নয়, গোটা শহরকেই নিশানায় রেখেছে।

কয়েকদিনের মধ্যে খবর আসতে লাগল একের পর এক। টালা পার্কের এক গৃহবধূ—চিঠি পেল তার স্বামীর পরকীয়া সম্পর্কে। পরিবার ভেঙে টুকরো টুকরো। বাগবাজারের এক অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ—চিঠি পেল এমন এক মামলা নিয়ে যা সে টাকা নিয়ে গোপন রেখেছিল। লজ্জায় গৃহবন্দি হয়ে পড়ল।

প্রতিটি খামের হাতের লেখা এক। কালো কালি, অদ্ভুত দৃঢ় অক্ষর। আর সব চিঠি মিলছে পুরোনো, অচল ডাকবাক্স থেকে। যে বাক্সগুলো শহর অনেক আগেই ভুলে গেছে।

রুদ্রর ভেতরে ভয় আর কৌতূহল একসাথে কাজ করছিল। রাত গভীর হলে সে সেই লালচে বাক্সগুলির সামনে দাঁড়িয়ে থাকত। কার হাত থেকে খাম পড়ে, তা দেখার জন্য। কিন্তু কখনো কাউকে দেখা যায় না। খাম হঠাৎ করেই ভেতরে এসে পড়ে।

এক রাতে কলেজ স্ট্রিটের গলিতে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ শুনল ভেতর থেকে কাগজের খসখস শব্দ। ছুটে গিয়ে ঢাকনাটা খুলে দেখল—মাঝে একটা খাম। প্রাপকের নাম লেখা: অরিন্দম দত্ত”। রুদ্র নামটা চিনল। অরিন্দম এক প্রভাবশালী আইনজীবী। তার সম্পর্কে অনেক গুজব আছে—মামলা মিটমাট করতে কালো টাকা নেওয়া, প্রতিদ্বন্দ্বীর ক্যারিয়ার নষ্ট করা।

চিঠিটা ছিঁড়ে পড়ার লোভ হচ্ছিল রুদ্রর। কিন্তু সাহস পেল না। এ খাম পৌঁছে যাবে ঠিক প্রাপকের কাছেই। কে পাঠাচ্ছে, কীভাবে পাঠাচ্ছে—সেই রহস্য আরও ঘনীভূত হচ্ছিল।

শহরজুড়ে এখন গুজব—অদৃশ্য ডাকপিয়ন প্রতিশোধ নিচ্ছে। যে যা লুকিয়েছে, তা খামে ভরে প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে। অনেকেই ডাকবাক্সের পাশ দিয়ে হাঁটতেও ভয় পাচ্ছে। পুরোনো, মরচেধরা বাক্সগুলো হঠাৎই যেন অভিশপ্ত হয়ে উঠেছে।

রুদ্র বুঝতে পারছিল, এটা শুধু সাংবাদিকতার খবর নয়—এ শহরের প্রতিটি মানুষের অন্ধকারকে টেনে তোলার এক ভয়ঙ্কর খেলা। আর সেই খেলার কেন্দ্রবিন্দুতে অচেনা কেউ, যে নিজেকে ডাকপিয়ন বলে দাবি করছে।

কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্নটা এখনও অমীমাংসিত—সে কীভাবে জানছে এতসব গোপন তথ্য?

সেদিন রাতে নিজের টেবিলে বসে রুদ্র আবার তার পাওয়া চিঠিটা বার করল। চোখে পড়ল একটা অদ্ভুত দাগ—কালির নিচে যেন আরেকটি হালকা লেখা চাপা পড়ে আছে। আলোয় ঘুরিয়ে দেখতে পেল একটা অস্পষ্ট লাইন—
প্রথম খামটা শুধু সতর্কবার্তা। এর পরে আসবে সত্য।”

রুদ্রর গলা শুকিয়ে গেল। তাহলে এর মানে, এটা কেবল শুরু। আর দ্বিতীয় চিঠি আসবেই।

পর্ব ৩ : তদন্তের শুরু

রুদ্র সেই রাতে ঘুমোতে পারল না। জানলার বাইরের বৃষ্টিভেজা কলকাতা তার চোখে যেন এক ভয়ঙ্কর মুখোশ পরে দাঁড়িয়ে আছে। টেবিলের উপর ফেলে রাখা বাদামি খামটার দিকে তাকিয়ে থাকল অনেকক্ষণ। বাক্যটা এখনও তার মাথায় ঘুরছে—প্রথম খামটা শুধু সতর্কবার্তা। এর পরে আসবে সত্য।”

সত্য মানে কী? কোন সত্য? আর কে লিখছে এইসব?

পরদিন অফিসে বসেই সে সিদ্ধান্ত নিল, এই রহস্যের তদন্ত শুরু করবে নিজে। সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা তাকে অনেক দরজা খুলে দিয়েছে, পুলিশের কাছে, পুরোনো নথিতে, শহরের গোপন গলিতে। তবে এবার খেলা আলাদা—এবার তার নিজের জীবন জড়িয়ে আছে তাতে।

প্রথমেই সে খোঁজ নিল শহরের পুরোনো ডাকবাক্সগুলোর। কলকাতা জুড়ে এখনও প্রায় একশোর মতো বাক্স দাঁড়িয়ে আছে—কারও রঙ চটকে গেছে, কারও মুখ মরচে খেয়েছে। ডাকবিভাগ বছর দশেক আগেই এগুলো অচল ঘোষণা করেছে। তবু আশ্চর্য, ঠিক এই মৃত বাক্স থেকেই নতুন খাম উঠে আসছে।

রুদ্র এক পুরোনো সূত্র ধরল—লালবাজারের এক অবসরপ্রাপ্ত ডাক কর্মী, নাম নৃপেন মল্লিক। মানুষটা অশীতিপর, তবু স্মৃতি টলমল চোখে ভাসে স্পষ্ট। রুদ্র তাকে গিয়ে ধরল একদিন বাগবাজারের গলিতে।

—“কাকু, পুরোনো ডাকবাক্স নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা চাই। শুনেছি এগুলো নাকি আর ব্যবহার হয় না।”

নৃপেন একটু হেসে বললেন—“ব্যবহার হয় না ঠিকই। কিন্তু মনে রেখো, প্রতিটি বাক্স একসময় মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ বয়ে নিয়ে যেত। এগুলো মৃত হলেও এর ভেতর অনেক চিঠি চাপা পড়ে আছে, যা কোনোদিন পৌঁছোয়নি।”

রুদ্রর গা শিউরে উঠল। —“না-পৌঁছনো চিঠি মানে?”

—“হ্যাঁ, দুর্ঘটনা, ভুল, কিংবা ইচ্ছে করেই। আর জানিস তো, এক ডাকঘরে একসময় আগুন লেগেছিল—সেই ঘটনায় মারা গিয়েছিল এক তরুণ কর্মচারী। সবাই বলে, তার আত্মা এখনও ডাকঘর আর ডাকবাক্সের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়।”

কথাগুলো শুনে রুদ্রর ভেতরে কেমন যেন ঠান্ডা শিরশিরে স্রোত বইতে লাগল। সে জানত, এগুলো নিছক কুসংস্কারও হতে পারে। কিন্তু এত মানুষের কাছে রহস্যময় খাম পৌঁছচ্ছে কীভাবে? তার তো কোনো যুক্তি নেই।

অফিসে ফিরে রুদ্র একটি ম্যাপ বানাতে শুরু করল। কোথায় কোথায় খাম পাওয়া গেছে, কোন কোন প্রাপকের কাছে গেছে। ধীরে ধীরে একটা অদ্ভুত চিত্র ফুটে উঠল—সব বাক্সই এক অক্ষরের মতো যুক্ত হয়ে একটা বৃত্ত তৈরি করছে। বৃত্তের কেন্দ্রে সেই পুরোনো ডাকঘর, যেটা অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে গিয়েছিল।

তারপর আরও অদ্ভুত কাকতাল। প্রতিটি প্রাপক কোনো না কোনোভাবে সেই ডাকঘর কর্মচারীর জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল। কেউ তার আত্মীয়কে ঠকিয়েছে, কেউ তার পরিবারকে অবহেলা করেছে, কেউ তার মৃত্যুকে তুচ্ছ করেছে।

রুদ্রর গলা শুকিয়ে এল। তাহলে কি সত্যিই প্রতিশোধ নিচ্ছে কেউ?

সেদিন রাতে ফেরার পথে আবারও সে দাঁড়াল কলেজ স্ট্রিটের ওই লালচে ডাকবাক্সের সামনে। ভেতরে উঁকি দিল—অন্ধকার, ভিজে গন্ধ, মাকড়সার জাল। হঠাৎই মৃদু শব্দ, যেন কাগজের খসখস। হাত ঢুকিয়ে টেনে আনল এক খাম।

খামের উপর এবার লেখা তারই নাম—রুদ্র সেন”

ভয় আর কৌতূহলে কাঁপতে কাঁপতে খামটা খুলল। একটিই বাক্য—
দ্বিতীয় খাম পৌঁছে গেল। এবার তুমি পালানোর উপায় খুঁজে দেখ।”

চারপাশে কেবল নিস্তব্ধতা। রাস্তার আলো ঝাপসা, বৃষ্টির ফোঁটা কপালে পড়ছে। রুদ্রর মনে হচ্ছিল, অদৃশ্য কেউ খুব কাছেই দাঁড়িয়ে আছে।

এবার তার কাছে আর কোনো সন্দেহ রইল না—অদৃশ্য ডাকপিয়নের খেলা কেবল শুরু হয়েছে। আর সে নিজেও এখন এই খেলায় এক প্রধান চরিত্র।

পর্ব ৪ : প্রথম মৃত্যু

শহর তখন এক অদ্ভুত উত্তেজনায় ফুঁসছে। একের পর এক রহস্যময় খাম মানুষকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। কোথাও সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে, কোথাও চুপচাপ কেলেঙ্কারি প্রকাশ হয়ে পড়ছে। কিন্তু মৃত্যুর গন্ধ তখনও চারদিকে ছড়িয়ে পড়েনি।

সেটা ঘটল হঠাৎই, এক গুমোট দুপুরে।

রুদ্র ফোন পেল পুলিশের এক পুরোনো বন্ধুর কাছ থেকে। লালবাজারের ক্রাইম ব্রাঞ্চের অফিসার সঞ্জয়। তার গলা চাপা, যেন শব্দ গোপন রাখতে চাইছে—

—“তুই কি সেই চিঠির ব্যাপারে কিছু জানিস, রুদ্র?”

রুদ্র থমকে গেল। —“কোন চিঠি?”

—“আজ সকালে এক কলেজ প্রফেসরের লাশ মিলেছে তার বাড়িতে। গলায় দড়ি। আত্মহত্যা মনে হলেও পাশে পড়ে থাকা বাদামি খামটা সব প্রশ্ন জাগাচ্ছে। চিঠিতে লেখা ছিল—‘তুই এক ছাত্রকে পরীক্ষার নাম্বার বাড়ানোর শর্তে জীবন ধ্বংস করেছিলি। তার মা মারা গিয়েছিল অপমানে। এবার তোর পালা।’”

রুদ্রর বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করতে লাগল। এটিই কি তবে প্রথম মৃত্যু?

অফিসের অজুহাত দিয়ে সে ছুটল সেই বাড়ির দিকে। উত্তর কলকাতার এক পুরোনো দোতলা বাড়ি, সিঁড়ির ধাপে ভিড় জমেছে। পুলিশের গার্ডলাইন দিয়ে ঢোকা বন্ধ। তবে সঞ্জয় তাকে ভেতরে নিয়ে গেল।

ঘরে ঢুকতেই কেমন যেন ঠান্ডা বাতাস আছড়ে পড়ল মুখে। কাঠের ফ্যান থেমে আছে, জানালার বাইরে ধুলো উড়ছে। বিছানার পাশে পড়ে আছে মাঝবয়সি মানুষের নিথর দেহ, মুখে আতঙ্কের ছাপ স্থায়ী হয়ে গেছে। টেবিলের উপর মোটা বাদামি খাম, কালো কালি দিয়ে লেখা নাম—প্রফেসর সমরেশ মিত্র”

চিঠির লাইনগুলো পড়তে পড়তে রুদ্রর হাত কেঁপে উঠছিল। এটা নিছক আত্মহত্যা নয়, এ যেন সাজানো মৃত্যুদণ্ড। যেন অদৃশ্য কোনো বিচারক শহরের ভিড়ে বসে আছে, যে গোপন অপরাধে শাস্তি দিচ্ছে।

পুলিশ ইতিমধ্যেই চাপে। সাংবাদিকরা বাইরে হৈচৈ করছে। কিন্তু সত্যিই তো এ কেসের পিছনে কী প্রমাণ আছে? এক খাম, কয়েকটা অক্ষর, আর আতঙ্কে মারা যাওয়া এক মানুষ।

রুদ্র বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে। বাইরের রোদ যেন আরও আঁধার হয়ে উঠেছে। গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটা পুরোনো ডাকবাক্সকে হঠাৎ ভীষণ অচেনা লাগছিল। লোহার গায়ে মরচে, তবু তার ফাঁক দিয়ে যেন অদৃশ্য চোখ তাকিয়ে আছে।

সেদিন রাতে রুদ্র নিজের ঘরে বসে বারবার চিঠিটার কপি পড়ছিল। মনের ভেতর একটাই প্রশ্ন ঘুরছিল—কীভাবে ডাকপিয়ন জানল এত ব্যক্তিগত, এত গোপন বিষয়? কোনো পুরোনো ফাইল, কোনো হারিয়ে যাওয়া ডায়েরি, না কি আরও ভয়ঙ্কর কিছু?

হঠাৎ দরজায় শব্দ হল। বুক ধড়ফড় করতে করতে গিয়ে দরজা খুলল। কেউ নেই। মেঝেতে পড়ে আছে আরেকটা বাদামি খাম।

আলতো করে তুলে নিল রুদ্র। কাগজ খুলতেই চোখ আটকে গেল প্রথম লাইনেই—
এবার তোরও অতীত প্রকাশ পাবে, রুদ্র সেন।”

তার গলা শুকিয়ে গেল। চারপাশ নিস্তব্ধ, অথচ মনে হচ্ছিল, দেয়ালের আড়ালে, ছাদের ওপর, বাতাসের ভেতর লুকিয়ে কেউ তাকে দেখছে।

এটাই প্রথম মৃত্যু, আর এখানেই খেলার শুরু।

পর্ব ৫ : ভয়ের শহর

কলকাতা শহর যেন আচমকাই বদলে গেল। একসময় যেখানে ডাকবাক্সের সামনে দাঁড়িয়ে চিঠি ফেলার জন্য ভিড় হত, সেখানে এখন মানুষ রাস্তা ঘুরে যাচ্ছে। স্কুল থেকে ফেরা বাচ্চারা ভয়ে মায়ের আঁচল আঁকড়ে ধরছে যদি পথে কোনো মরচেধরা লাল বাক্স পড়ে। রিকশাওয়ালারা বাক্সের পাশ দিয়ে গেলে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।

টেলিভিশনের চ্যানেলগুলো গরম খবর বানিয়ে তুলেছে ঘটনাগুলোকে। সংবাদপত্রের শিরোনাম—অদৃশ্য ডাকপিয়নের আতঙ্কে শহর”, চিঠির মৃত্যুর ছায়া”। অথচ পুলিশ অসহায়। কোনো সিসিটিভি ফুটেজ নেই, কোনো প্রত্যক্ষদর্শী নেই। খামগুলো যেন জাদুর মতো হাজির হয়ে যাচ্ছে মৃত বাক্সের ভেতর থেকে।

রুদ্র নিজের জীবনে চাপটা আরও স্পষ্ট টের পাচ্ছিল। অফিসে সহকর্মীরা তাকে চোখে চোখে রাখছে, কারণ প্রথম দিন থেকেই সে খবরটা কভার করছে। কেউ কেউ ফিসফিস করে বলছে, —“হয়তো ও-ই জানে কে এই ডাকপিয়ন।”

কিন্তু রুদ্র জানে, সে-ও শিকার। তার অতীতও এখন বিপন্ন। দ্বিতীয় খামের হুমকি যেন বুকের ভেতর কাঁটার মতো বিঁধে আছে।

শহরের চায়ের দোকান, অটো-স্ট্যান্ড, কলেজের ক্যান্টিন—সব জায়গায় শুধু একটাই আলোচনা।
—“ডাকপিয়ন নাকি আসলে প্রেতাত্মা।”
—“না, এটা নিশ্চিত কেউ পুরোনো ডাকঘরের ভেতর থেকে খাম পাঠাচ্ছে।”
—“তুই শুনিসনি? যাদের অন্যায় আছে শুধু তাদেরই খাম যাচ্ছে।”

এই গুজব ধীরে ধীরে শহরের রক্তে ছড়িয়ে পড়ছিল। মানুষ নিজের গোপন ভয় মনে মনে টের পাচ্ছিল—যদি হঠাৎ তার নামও একদিন বাদামি খামে লেখা থাকে?

এক রাতে রুদ্র বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাল। রাস্তা নিস্তব্ধ। সামনের খোলা ড্রেনের পাশে একটা ভাঙা ডাকবাক্স। চাঁদের আলোয় ঝলসে উঠল মরচেধরা লোহার খোল। হঠাৎই মনে হল, ভেতর থেকে যেন কারও আঙুল বেরিয়ে এল, তারপর মিলিয়ে গেল।

সে চোখ মুছে আবার তাকাল—কিছু নেই। কিন্তু কানে এল কাগজ ঘষার শব্দ। বুক ধড়ফড় করে উঠল।

আরও কিছুদিনের মধ্যে খাম পাওয়া আরও বেড়ে গেল। কারও কাছে পৌঁছচ্ছে এক গোপন প্রেমের গল্প, কারও কাছে ব্যবসায়িক প্রতারণার দলিল। পরিবারের ভেতর ভাঙন, বন্ধুত্বে বিশ্বাসঘাতকতা, অফিসে কলহ—সবকিছুই যেন সেই বাদামি খাম তৈরি করছে।

শহরটা যেন একটা অদৃশ্য বিচারের আসরে বসে আছে, আর বিচারককে কেউ চেনে না। শুধু জানে, তার নাম—ডাকপিয়ন।

রুদ্র বুঝল, এই ভয় যদি থামানো না যায়, তবে শহর পাগল হয়ে যাবে। আর তখন সে শুধু সাংবাদিক থাকবে না, হয়ে উঠবে অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে একমাত্র যোদ্ধা।

কিন্তু প্রশ্ন একটাই—সে কি সত্যিই এই খেলা থামাতে পারবে, নাকি একদিন তার নিজের নামও লেখা থাকবে শেষ খামের উপরে?

পর্ব ৬ : পুরোনো ডাকঘরের ছায়া

রুদ্রর মাথায় দিন কয়েক ধরে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল—সব খাম কি শুধু কাকতাল, না কি এদের উৎস এক জায়গা থেকে? শহরের মানচিত্রে যেসব জায়গায় খাম পাওয়া গেছে সেগুলো চিহ্নিত করতেই ধীরে ধীরে একটা অদ্ভুত নকশা তৈরি হচ্ছিল। সবক’টি বৃত্তাকারে ঘিরে রেখেছে এক জীর্ণ ভবনকে—উত্তর কলকাতার এক পুরোনো ডাকঘর, যেটি প্রায় পঁচিশ বছর আগে আগুনে পুড়ে গিয়েছিল।

এক সন্ধ্যায় সাহস করে রুদ্র গিয়ে দাঁড়াল সেই ডাকঘরের সামনে। দোতলা ভবন, অর্ধেক দেয়াল ভাঙা, জানালার কাঁচ ভাঙাচোরা, ভেতর থেকে ভিজে কাগজ আর পোড়া কাঠের গন্ধ বেরোচ্ছে। আশেপাশের লোকজন গা ছমছমে বলে জায়গাটা এড়িয়ে চলে। ভেতরে ঢোকার পথে ভাঙা সিঁড়ি, কোথাও গাছের শেকড় বেড়ে উঠেছে।

রুদ্র টর্চ জ্বালিয়ে ভেতরে ঢুকল। ভাঙা টেবিল, ছেঁড়া খাতা, মরচেধরা আলমারি—সব যেন অতীতের অন্ধকারে ডুবে আছে। হঠাৎই এক জায়গায় পায়ের নিচে কাগজের শব্দ পেল। নিচু হয়ে দেখল—একগাদা পোড়া চিঠি, যেগুলো আগুনে পুরোপুরি শেষ হয়নি। কিছু লাইন এখনও পড়া যায়।

—“প্রিয়তমা, আমি তোমাকে শেষবারের মতো লিখছি…”
—“মা, টাকা পাঠাতে পারিনি, চাকরি নেই…”

রুদ্র কাগজগুলো হাতে নিয়ে শিউরে উঠল। এগুলো না-পৌঁছনো চিঠি, যেগুলো আগুনে হারিয়ে গেছে। মনে হচ্ছিল, ভেতরে ভেতরে যেন অজানা যন্ত্রণার ধোঁয়া এখনও ভেসে আছে এই ঘরে।

হঠাৎই চোখে পড়ল দেয়ালের এক কোণে কালো কালি দিয়ে লেখা অদ্ভুত কয়েকটি শব্দ—
ডাকপিয়ন সব ফিরিয়ে দেবে।”

রুদ্রর হাত ঠান্ডা হয়ে এল। কে লিখেছিল এটা? পঁচিশ বছর আগের সেই কর্মচারী? যে আগুনে মারা গিয়েছিল?

কথাটা মনে পড়তেই বুকের মধ্যে একটা হাহাকার চাপল। শহরের গুজব মনে পড়ল—সেই কর্মচারীর নাম ছিল হরিদাস দত্ত। সে নাকি আগুন লাগার দিন অফিসে ছিল একা। বেরোতে পারেনি। আগুনের ভেতরেই পুড়ে গিয়েছিল।

রুদ্র ভাবছিল, যদি সত্যিই কেউ প্রতিশোধ নিচ্ছে, তবে কি হরিদাস মারা যায়নি? না কি তার আত্মা এই চিঠির মধ্যে ফিরে এসেছে?

দেয়ালের ছায়া হঠাৎ লম্বা হয়ে উঠল। টর্চ নেড়ে বুঝল, ওটা তার নিজের ছায়া নয়। যেন আরেকজন দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারে। রুদ্র চমকে উঠে পেছনে ঘুরল। কেউ নেই। শুধু ভাঙা জানালা দিয়ে আসা হাওয়ায় পুরোনো কাগজ উড়ছে।

ভবন থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে সে বুঝল, এখন আর শুধুই শহরের খবরের পেছনে দৌড়োচ্ছে না। এখন সে ঢুকে পড়েছে এক অভিশপ্ত ইতিহাসের কেন্দ্রে। আর সেই ইতিহাস তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে গভীর অন্ধকারে।

রুদ্র জানত, এ রহস্যের সমাধান না করা পর্যন্ত খাম আসতেই থাকবে। আর পরের খামটি হয়তো সরাসরি তার জন্যই অপেক্ষা করছে।

পর্ব ৭ : প্রতিশোধের খাম

কলকাতার শরৎ-সন্ধ্যা। আকাশে ধোঁয়াটে রোদ মিশে যাচ্ছিল ভিজে কুয়াশায়, রাস্তার গায়ে হালকা অন্ধকার নেমে এসেছে। শহর তখন অস্থির—প্রতিটি গলিতে গুজব, প্রতিটি চায়ের দোকানে ভয়, আর প্রতিটি পুরোনো ডাকবাক্সে যেন অদৃশ্য সন্ত্রাসীর উপস্থিতি।

রুদ্র তার নোটবুকে যত খামের খবর লিখেছে, তাতে স্পষ্ট একটা ধারা ফুটে উঠছিল। সব প্রাপক একে অপরের সঙ্গে অদ্ভুতভাবে যুক্ত। কারও শিকড় গিয়ে মিশছে সেই পুড়ে যাওয়া ডাকঘরের কর্মচারী হরিদাস দত্তের জীবনে।

একজন ব্যবসায়ী যিনি হরিদাসের জমি হাতিয়ে নিয়েছিলেন, এক স্কুলশিক্ষক যিনি তার মেয়েকে পরীক্ষায় ফেল করিয়ে অপমান করেছিলেন, এক পুলিশ অফিসার যিনি আগুনের কেসটাকে দুর্ঘটনা বলে চাপা দিয়েছিলেন। প্রত্যেকের দিকেই পৌঁছে যাচ্ছে বাদামি খাম।

রুদ্র একরকম আঁকড়ে ধরল এই সূত্রটা। মানচিত্রে সব নাম, সব জায়গা লিখে রেখেই হঠাৎ অনুভব করল—এই লিস্টের পরবর্তী নামটা হয়তো তারই কাছাকাছি। আর যদি সেটাই সত্যি হয়, তবে সামনে আরও মৃত্যুর খবর অপেক্ষা করছে।

সঞ্জয়, লালবাজারের অফিসার, একদিন রাতে তাকে ডেকে পাঠাল। থানার গোপন ফাইলে এক ধুলো ধরা কাগজ দেখাল। সেটা ছিল হরিদাস দত্তের পরিবারের অভিযোগপত্র, যেটা কোনোদিন গুরুত্ব পায়নি। কাগজে লেখা—আমার স্বামীকে ইচ্ছাকৃতভাবে ফাঁসানো হয়েছে। তার সহকর্মীরা লোভে মিথ্যে কথা বলে তাকে একা ফেলে রেখেছিল।”

রুদ্র কাগজটা হাতে নিয়ে শিউরে উঠল। তাহলে এ প্রতিশোধ নিছক কাকতাল নয়। প্রতিটি খাম যেন একেকটা বিচারের কোর্ট-অর্ডার।

কিছুদিন পরেই আবার খবরে এল নতুন শোক। বিখ্যাত আইনজীবী অরিন্দম দত্ত—যার নাম রুদ্র খামের বাইরে দেখেছিল—হঠাৎ তার অফিসে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। টেবিলে পড়ে আছে বাদামি খাম। তাতে লেখা—তুই টাকা নিয়ে এক নির্দোষকে ফাঁসিয়েছিলি। এখন ন্যায় ফিরল।”

অরিন্দম আর বাঁচল না।

রুদ্র শহরের আতঙ্ককে এখন নিজের শিরায় টের পাচ্ছিল। এই খেলাটা থামছে না। বরং ক্রমশ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। আর এবার সে আঁচ করতে পারছে, এই প্রতিশোধের আগুন একদিন তার দিকেও ছুটে আসবে।

সেদিন রাতে ফেরার পথে, হঠাৎই গলির মোড়ে একটা ডাকবাক্সের সামনে দাঁড়াল সে। পায়ের কাছে ঠক করে পড়ে গেল একটা খাম। কাগজে কালি ঝাপসা হয়ে লেখা নাম—রুদ্র সেন।”

শ্বাসরুদ্ধ হয়ে খুলল খামটা। ভেতরে মাত্র কয়েকটি শব্দ—
তুইও সেই তালিকায় আছিস। প্রস্তুত হ।”

হাওয়া কেমন ঠান্ডা হয়ে এল। গলির ল্যাম্পপোস্টের আলো নিভে গেল এক মুহূর্তে। চারপাশে নীরবতা। মনে হচ্ছিল, হরিদাস দত্তের অদৃশ্য চোখ ঠিক তার পিঠের ওপর টকটকে লাল দৃষ্টি ফেলে রেখেছে।

রুদ্র বুঝল, প্রতিশোধের খেলা এখন একেবারে তার দোরগোড়ায়।

পর্ব ৮ : রুদ্রের পালা

শহরের আকাশে তখন কুয়াশার চাদর। বাতাস ভারী, রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো যেন অকারণে ঝাপসা আলো ছড়াচ্ছে। রুদ্র সেদিন নিজের ফ্ল্যাটের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে খামের ভেতরের কথাগুলো বারবার পড়ছিল—তুইও সেই তালিকায় আছিস। প্রস্তুত হ।”

হৃদস্পন্দন প্রতিবারই বেড়ে যাচ্ছিল। এতদিন পর্যন্ত সে শুধু খবরে লিখত, অন্যের জীবনে ঘটে যাওয়া আতঙ্ক কাগজে ধরত। এখন সেই আতঙ্ক তার বুকের ভেতর কাঁটার মতো বিঁধে আছে।

অতীতটা ভেসে উঠছিল ধীরে ধীরে। পাঁচ বছর আগের সেই রাত—এক দুর্ঘটনা, যা সে সাংবাদিকের চোখে কভার করলেও আসল সত্যিটা গোপন রেখেছিল। এক নিরপরাধ ছেলেকে ফাঁসানো হয়েছিল মিথ্যে কেসে, আর রুদ্র তখন নিজের ক্যারিয়ার বাঁচাতে সত্যি গোপন করেছিল। আজ সেই গোপনই কি ফিরে আসছে তার শাস্তি হয়ে?

পরের দিন অফিসে ঢুকতেই মধুমিতা তাকে কড়া চোখে দেখল। —“তুই কেমন অদ্ভুত হয়ে গেছিস রে। কিছু লুকাচ্ছিস না তো?”

রুদ্র এড়িয়ে গেল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে জানত, খামের হুমকি এখন আর ব্যক্তিগত নয়, এটা শহরের গোপন অন্ধকারকে টেনে তুলছে। আর এবার তার নামও সেই অন্ধকারে উন্মোচিত হতে চলেছে।

রাতে ফ্ল্যাটে ফেরার পথে সে লক্ষ্য করল, এক ছায়ামূর্তি বারবার তাকে অনুসরণ করছে। মোড় ঘোরার সঙ্গে সঙ্গেই মিলিয়ে যাচ্ছে। আবার দূরে দেখা যাচ্ছে। সাহস করে ডাকল—“কে ওখানে?” কোনো উত্তর নেই। কেবল একখানা ভাঙা ডাকবাক্সের পাশ থেকে ঝিরঝির শব্দ এল।

বুক ধড়ফড় করতে করতে এগিয়ে গেল। সত্যিই, বাক্সের ভেতর রাখা একটি খাম। তার নাম স্পষ্ট লেখা।

খামটা খুলে দেখল—
তুই পাঁচ বছর আগে যা লুকিয়েছিলি, সেটাই প্রকাশ পাবে। সেদিন যে ছেলেটার জীবন তুই ধ্বংস করেছিলি, তার মা এখনও কান্না করে। ডাকপিয়ন সব জানে।”

রুদ্রর হাতে ঘাম জমল। চোখে ভেসে উঠল সেই ছেলেটির মুখ, যার চোখে প্রতিশোধ আর বঞ্চনার ছাপ ছিল। সে কি এখনও বেঁচে আছে? না কি ডাকপিয়ন তার হয়ে কথা বলছে?

সেই রাতে বিছানায় শুয়েও ঘুম এলো না। দেয়ালের অন্ধকারে যেন খামের কালো অক্ষরগুলো নাচছিল।

ভোর হতে না হতেই সে সঞ্জয়কে ফোন করল। —“আমাকে আর লুকোতে দিলে চলবে না। আমি সত্যিটা তোমাকে বলতে চাই। হয়তো আমার নামও এই তালিকার ভেতর।”

সঞ্জয়ের গলা ভারী হয়ে এল—“তুই যদি জড়িত থাকিস, তাহলে সাবধানে থাক। ডাকপিয়ন কাউকেই ক্ষমা করছে না।”

রুদ্র বুঝল, সময় এসে গেছে। এবার তাকে নিজের অপরাধের মুখোমুখি দাঁড়াতেই হবে। কারণ পরবর্তী খাম শুধু তার দোরগোড়ায় নয়, হয়তো তার জীবনের শেষ সত্য উন্মোচন করতে চলেছে।

পর্ব ৯ : মুখোমুখি

রুদ্রর শরীরজুড়ে তখন ভয় আর উত্তেজনার এক অদ্ভুত মিশেল। দিনরাত খামের ছায়া তাকে তাড়া করছে। প্রতিটি মোড়ে, প্রতিটি ল্যাম্পপোস্টের নিচে তার মনে হচ্ছিল অদৃশ্য কেউ দাঁড়িয়ে আছে, অন্ধকার থেকে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে।

অবশেষে সে ঠিক করল—এই খেলায় লুকিয়ে থাকার সময় শেষ। যদি ডাকপিয়ন সত্যিই থাকে, তবে তার মুখোমুখি দাঁড়াতেই হবে। আর সেই মুখোমুখি হওয়ার একমাত্র জায়গা, পুড়ে যাওয়া পুরোনো ডাকঘর।

সেদিন গভীর রাতে, হাতে টর্চ আর বুকের ভেতর প্রচণ্ড ধুকপুকানি নিয়ে রুদ্র পৌঁছল সেখানে। ভাঙা গেটের ভেতর ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বাতাস যেন আরও ঠান্ডা হয়ে গেল। চারপাশে পুড়ে যাওয়া কাঠের গন্ধ এখনও লেগে আছে, যেন আগুন মাত্র কিছুক্ষণ আগেই নেভানো হয়েছে।

ভবনের ভেতরে ঢুকতেই অদ্ভুত নীরবতা। দেয়ালের গায়ে মাকড়সার জাল, ছেঁড়া কাগজ মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। হঠাৎ টর্চের আলোয় এক কোণে দেখা গেল অদ্ভুত কিছু—গাদা গাদা বাদামি খাম, সুন্দর করে স্তূপ করে রাখা। প্রতিটিতে নাম লেখা, অনেকগুলো ইতিমধ্যেই শহরে পৌঁছে গেছে।

রুদ্র এগিয়ে গেল। তখনই অন্ধকারের ভেতর থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
—“অবশেষে চলে এলে, রুদ্র সেন।”

গলা শোনামাত্র বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। কণ্ঠে এমন এক শীতল দৃঢ়তা, যা ভেতর থেকে হাড় পর্যন্ত জমিয়ে দেয়।

—“কে তুমি?” রুদ্রর গলা শুকনো।

অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল এক ছায়ামূর্তি। লম্বা দেহ, অর্ধেক মুখ আলোয়, অর্ধেক অন্ধকারে। চোখে অদ্ভুত ঝলক। হাতে ধরা মোটা খাতা, যার পাতায় নামের তালিকা।

—“তুমি আমাকে ডাকপিয়ন বলেই চিনেছ। কিন্তু আসল পরিচয় লুকিয়ে নেই। আমি হরিদাস দত্তের ছেলে—অর্ক দত্ত। সবাই ভেবেছিল, ডাকঘরের আগুনে আমি মারা গেছি। অথচ আমি বেঁচে গিয়েছিলাম, ভেতর থেকে সবকিছু দেখেছি।”

রুদ্র হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নামটা যেন বুকের ভেতর হাতুড়ির মতো আঘাত করল। অর্ক! সেই ছেলেটি, যাকে নিয়ে ফাইল ঘাঁটার সময় একবার পড়েছিল সে। ছোট্ট একটা নাম, যেটা শহর ভুলে গিয়েছিল।

অর্কর চোখে অদ্ভুত দহন—
—“আমার বাবাকে সবাই বিশ্বাসঘাতকতা করে মেরে ফেলেছিল। পুলিশ, আইনজীবী, শিক্ষক—যারা সমাজে মাথা উঁচু করে ঘুরছে, তারা-ই তার মৃত্যুর আসল কারণ। আমি শপথ নিয়েছিলাম, প্রত্যেককে সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করাব।”

রুদ্রর গলা কাঁপছিল—“কিন্তু খাম দিয়ে ভয় দেখানো? মৃত্যু ঘটানো? এটা ন্যায় নয়, প্রতিশোধ।”

অর্ক হেসে উঠল, সেই হাসি গলির ভাঙা দেয়াল ভেদ করে কানে বাজতে লাগল।
—“ন্যায় আর প্রতিশোধের মধ্যে পার্থক্য থাকে না যখন অপরাধীরা শাস্তি ছাড়া বেঁচে থাকে। আমি শুধু খামের ভেতরে সত্য লিখি। বাকি কাজ তারা নিজেরাই করে।”

রুদ্র বুঝতে পারল, সে এক দুঃসহ সত্যের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার—অর্কর তালিকায় তার নামও আছে।

অর্ক ধীরে ধীরে এগিয়ে এল। হাতে আরেকটা বাদামি খাম। রুদ্রর নাম লেখা।
—“তোর পালা এসে গেছে, রুদ্র সেন। এবার শহর জানবে, তুই কী গোপন করেছিলি।”

টর্চের আলো কাঁপছিল রুদ্রর হাতে। বাইরের হাওয়ায় মরচেধরা গেট ঠকঠক আওয়াজ করছিল। চারপাশে অন্ধকার যেন ঘনিয়ে আসছিল আরও।

এই প্রথমবার অদৃশ্য ডাকপিয়নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রুদ্র বুঝল—এটা কেবল খাম নয়, এ এক জীবন্ত অভিশাপ।

 

পর্ব ১০ : শেষ চিঠি

অন্ধকার ঘরে নিস্তব্ধতা জমে ছিল ধুলোর মতো। রুদ্রর হাতে টর্চ কাঁপছিল, আলো বারবার দিক পাল্টাচ্ছিল ভাঙা দেওয়ালে। সামনে দাঁড়িয়ে অর্ক দত্ত, সেই অদৃশ্য ডাকপিয়ন, যার খামের ভেতরে লুকিয়ে ছিল শহরের শিরদাঁড়া কাঁপানো সব সত্য।

অর্কর চোখে আগুনের মতো দীপ্তি। তার হাতে ধরা বাদামি খামটা রুদ্রর নাম লেখা।
—“তুই ভাবছিস এখনও বাঁচতে পারবি? এই শহর জানবে, রুদ্র সেনও অপরাধী। তুই মিথ্যে লুকিয়েছিস, তুই নিরপরাধের জীবন ধ্বংস করেছিস।”

রুদ্রর গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সে জানত, পালানোর পথ নেই। হয় সত্যি স্বীকার করতে হবে, না হলে শহরের সামনে চূর্ণ হতে হবে।

—“হ্যাঁ, আমি সত্যিটা চাপা দিয়েছিলাম।” রুদ্রর কণ্ঠ কেঁপে উঠল। “পাঁচ বছর আগে, সেই মামলায় আমি ভয়ে চুপ করেছিলাম। কারণ আমার রিপোর্ট ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে পারত। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি কাউকে মারিনি, কাউকে ফাঁসাইনি। আমি শুধু নীরব থেকেছিলাম।”

অর্কর ঠোঁটে হালকা এক টানটান হাসি।
—“নীরবতা-ই তো সবচেয়ে বড় অপরাধ। আমার বাবার মৃত্যুর সময়ও সবাই নীরব ছিল। তাই আমি খাম পাঠাই—নীরব মানুষদের মুখোশ খুলতে।”

রুদ্র এক পা এগোল। —“অর্ক, তুই যা করছিস তা প্রতিশোধ ছাড়া আর কিছু নয়। তুই যাদের মেরে ফেলছিস, তারা হয়তো অপরাধী, হয়তো না। কিন্তু এভাবে শহরকে আতঙ্কে ডোবানো… এটা শেষ পর্যন্ত তোকে-ই গ্রাস করবে।”

অর্কর চোখে এক মুহূর্তের জন্য দ্বিধা ফুটল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সে খামটা মাটিতে ছুঁড়ে দিল।
—“শেষ চিঠি লিখে ফেলেছি আমি। সকালে এটা ছাপা হবে সব কাগজে। সবাই জানবে রুদ্র সেনের অপরাধ।”

রুদ্র ঝুঁকে খামটা তুলে নিল। ভেতরে কাগজে লেখা—
রুদ্র সেন পাঁচ বছর আগে সত্য গোপন করে এক নিরপরাধকে জেলে পাঠাতে সাহায্য করেছিল। তার কারণে এক মা মরেছিল অপমানে।”

কাগজটা হাতে নিয়েই রুদ্র হোঁচট খেল। সত্যিই তো, সেই ছেলেটি জেলে গিয়েছিল। তার মা আত্মহত্যা করেছিল লজ্জায়। আর সে? সে তখন নীরব থেকে শুধু নিজের চাকরি বাঁচিয়েছিল।

চোখের সামনে যেন ভেসে উঠল সেই মায়ের মুখ, ভাঙা দরজা, কাঁপতে থাকা প্রদীপ। বুকের ভেতর হাহাকার জমল।

রুদ্র মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। —“আমি দোষী, অর্ক। কিন্তু আমাকে মারলে সত্যি কি বদলাবে? তুইও তো তখন আমার মতোই হয়ে যাবি।”

নীরবতা। ভাঙা জানালা দিয়ে হাওয়া ঢুকছে। অর্ক দাঁড়িয়ে আছে স্থির, যেন ভেতরে ভেতরে দ্বন্দ্ব চলছে।

বাইরে হঠাৎ পুলিশের সাইরেন বেজে উঠল। সঞ্জয় হয়তো রুদ্রর দেওয়া তথ্য থেকে এখানে এসেছে।

অর্ক শেষবারের মতো রুদ্রর দিকে তাকাল। চোখে অদ্ভুত ঝলক—না রাগ, না শান্তি, কেবল এক অসহ্য ক্লান্তি।
—“শেষ চিঠি আমি লিখেছি। বাকিটা শহর বিচার করবে। আমাকে আর থামানো যাবে না।”

এরপর সে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। পুলিশের আলোয় খালি ঘর জেগে উঠল, কেবল মেঝেতে ছড়িয়ে রইল বাদামি খামগুলোর স্তূপ।

রুদ্রর হাতে তখনও ধরা সেই শেষ খাম। কাগজের অক্ষর যেন আগুন হয়ে জ্বলছিল তার চোখে।

সে জানত, এই গল্প এখানেই শেষ নয়। হয়তো ডাকপিয়ন পালিয়ে গেল, হয়তো আবার ফিরবে। আর তার নিজের জীবন—এখন থেকে কেবল প্রশ্নে ভরা।

শেষ চিঠি সে পড়ে ফেলেছে। কিন্তু আসল সত্য—এখনও শহরের বুকেই অদৃশ্য হয়ে আছে।

সমাপ্ত

WhatsApp-Image-2025-09-05-at-4.04.45-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *