Bangla - রহস্য গল্প

অদৃশ্য ছায়া

Spread the love

অরিন্দম মুখোপাধ্যায়


পর্ব ১ – অদ্ভুত চিঠি

শহরের ভেতরে এমন সব গলি আছে যেগুলোতে সূর্যের আলো পৌঁছতে চায় না, আর চাইলেও পৌঁছতে পারে না। পুরনো ইমারত, একটার গায়ে আরেকটা ঠেসে দাঁড়িয়ে আছে, জানলার গ্রিলগুলো মরচে পড়ে ক্ষয়ে গেছে, ভাঙা তার ঝুলে আছে রাস্তায়। সেই অন্ধকার গলির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে একটা বিশাল বারো তলা বাড়ি, যেটাকে আশপাশের মানুষ শুধু “ছায়ার বাড়ি” বলে ডাকে। কারণ এই বাড়ির জানলাগুলোতে গত দশ বছর ধরে কোনো আলো জ্বলে উঠতে দেখা যায়নি। তবুও মাঝেমাঝে অনেকে বলে থাকে, রাত বারোটার পর ওই বাড়ির ছাদে নাকি একটা অস্পষ্ট ছায়া দেখা যায়, কিন্তু কাছে গিয়ে কিছু বোঝা যায় না। সেই বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল অরুণ চক্রবর্তী, শহরের পরিচিত এক অপরাধ সাংবাদিক। তার হাতে সিগারেট, ধোঁয়ার কুণ্ডলী রাতের কুয়াশার মধ্যে মিশে যাচ্ছে, কিন্তু চোখের ভেতর গাঢ় উত্তেজনা। সে জানে আজ রাতটা অন্যরকম হতে চলেছে, কারণ গত এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন ভোরবেলায় তার ফ্ল্যাটের দরজার নিচ দিয়ে অদ্ভুত চিঠি ঢুকে আসছে।

প্রথম দিন ভেবেছিল কোনো পাঠকের মজা, দ্বিতীয় দিন মনে হয়েছিল হয়তো কোনো হুমকি, কিন্তু যখন তৃতীয় ও চতুর্থ দিনেও একই রকম চিঠি এলো, তখন অরুণের ভেতরে কৌতূহল জেগে উঠল। প্রতিটি চিঠির কাগজ সাদা হলেও অদ্ভুত দাগ পড়েছিল, যেন পুরনো কালি দিয়ে লেখা। শব্দগুলো সব একই— “সত্যকে খুঁজতে চাইলে অদৃশ্য ছায়ার পথে এসো। তোমাকে অপেক্ষা করছে।” শুরুতে এই কথাগুলো পড়েই সে চমকে উঠেছিল, কারণ এখানে সরাসরি তার নাম লেখা ছিল না, তবু বাক্যগুলো যেন তাকে উদ্দেশ্য করেই লেখা। যেন কেউ তার মনস্তত্ত্ব জানে, তার জীবনের ভেতরে কী কাজ করে, সেটাও বোঝে। অরুণ যে সাধারণ সাংবাদিক নয়, সেটা পুরো শহরই জানে। সে এমন সব অপরাধের হদিশ বের করেছে, যেগুলো পুলিশও বছর বছর ধরে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিল। ফলে তাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা নতুন কিছু নয়। কিন্তু এই চিঠিগুলো আলাদা—এখানে ভয়ের বদলে আহ্বান আছে।

আজকের চিঠিতে ঠিকানাও দেওয়া হয়েছে— গলফক্লাব লেন, ৩৪/বি, ছাদতলা। অরুণ সকাল থেকেই দ্বিধায় ছিল, যাওয়া উচিত কি না। কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকে বুকের ভেতরে এক অজানা কৌতূহল ঘুরপাক খেতে লাগল। রাত আটটা বাজতেই সে ব্যাগে টর্চ আর ছোট্ট ভাঁজ করা ছুরি ঢুকিয়ে রওনা দিল। ভেবেছিল গলিটা খুব একটা আলাদা হবে না, কিন্তু পৌঁছে দেখে চারপাশে এমন এক শূন্যতা, যা তাকে মুহূর্তের মধ্যে অস্বস্তি এনে দিল। কোথাও কোনো মানুষ নেই, কেবল একদল কুকুর ভাঙা ডাস্টবিন ঘেঁটে যাচ্ছে। হাওয়ায় একটা পুরনো স্যাঁতসেঁতে গন্ধ ভেসে আসছে।

অরুণ সিঁড়ি ভাঙতে লাগল। সিঁড়ির প্রতিটি ধাপে কর্কশ শব্দ উঠছে, যেন কারও হাড় ভাঙছে। অন্ধকার এত ঘন যে টর্চ ছাড়া কিছুই বোঝা যায় না। সে উপরে উঠতে উঠতে ভাবতে লাগল, যদি এই সব চিঠি কোনো খুনির ফাঁদ হয়? যদি কেউ তাকে টেনে আনার জন্যই এই নাটক সাজিয়ে থাকে? এমন প্রশ্ন তার মাথায় এলেও সাংবাদিকের তীক্ষ্ণ কৌতূহল তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারল না।

তিনতলার মাথায় পৌঁছতেই হঠাৎ এক শীতল হাওয়া কানে বাজল। শব্দটা ছিল অস্বাভাবিক, যেন ফিসফিসানি। অরুণ চমকে উঠে চারদিকে আলো ফেলল। কোনো মানুষ নেই, কেবল দেয়ালের প্লাস্টার খসে পড়ছে। ঠিক তখনই সে দেখল করিডরের এক কোণে ধুলো জমে থাকা একটা খাম পড়ে আছে। কাগজের ওপর অদ্ভুতভাবে অক্ষরগুলো ঝকঝক করছে— “অরুণ চক্রবর্তীর হাতে দেবার জন্য।”

তার বুকের ভেতর হঠাৎ ধুকপুকানি বেড়ে গেল। খাম খুলতেই ভেতরে একটি কাগজ, তাতে কেবল কয়েকটি লাইন— “অপরাধ লুকোনো যায়, ছায়া নয়। কাল রাত বারোটায় ছাদে দাঁড়াও। তুমি দেখবে যেটা কেউ কখনও দেখেনি।”

অরুণ মুহূর্তে থমকে দাঁড়াল। এ কেমন খেলা? কে জানে সে এখানে এসেছে? কে এমনভাবে খাম ফেলে রেখে যায়? হঠাৎ তার মনে হলো, যেন কেউ অদৃশ্য থেকে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। সে দ্রুত চারপাশে আলো ফেলল, কিন্তু শূন্য করিডর ছাড়া কিছুই নেই।

চিঠিটা পকেটে ভরে আবার উপরে উঠতে শুরু করতেই সে স্পষ্ট শুনতে পেল পায়ের শব্দ। কেউ যেন তার থেকে এক তলা ওপরে থেকে ধীরে ধীরে নামছে। অরুণ দাঁড়িয়ে গেল। নিস্তব্ধতার ভেতর শব্দটা প্রতিধ্বনির মতো ভেসে আসছে—ঢপ… ঢপ… ঢপ…। টর্চের আলো ছড়িয়ে দিল সে, কিন্তু আলো কেবল ধুলোয় মোড়া সিঁড়ির গায়ে পড়ল। কোনো মানুষ নেই। অথচ শব্দ ক্রমশ কাছে আসছে।

হঠাৎ করে এক ঝলক বাতাস এসে তার টর্চের আলো নিভিয়ে দিল। মুহূর্তে চারপাশ আঁধারে ডুবে গেল। অরুণ হাতড়ে টর্চ আবার জ্বালাতে গিয়ে বুঝতে পারল, কোথাও থেকে এক অদ্ভুত ঠাণ্ডা শ্বাস ফেলছে কেউ। যেন তার কানের পাশ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে নিঃশ্বাস।

তার মনে হল, এই বাড়ির দেয়ালগুলো কথা বলছে। শূন্য করিডরের ছায়াগুলো যেন হাত বাড়িয়ে তাকে ডেকে আনছে। বুকের ভেতর একটা প্রশ্ন জ্বলে উঠল— কে তাকে ডাকছে? আর কেন?

পর্ব ২ – ছাদের ডাক

অরুণ চক্রবর্তী নিজের ঘরে ফিরেও রাতটা ঘুমোতে পারল না। জানলার পর্দা টেনে রাখলেও মনে হচ্ছিল বাইরের অন্ধকার তাকে ভেদ করে ঢুকে পড়ছে। মাথার মধ্যে ঘুরছিল সেই খাম, সেই অদ্ভুত চিঠি। কে পাঠাতে পারে? কোনো অপরাধী চক্র, নাকি কেউ তাকে ধোঁকা দিতে চাইছে? কিন্তু কেন তার নাম ধরে ডাকবে?

অরুণ বহুবার এমন মামলায় জড়িয়েছে যেখানে পুলিশও হাত গুটিয়ে নিয়েছিল। তার কলম অনেক বড় বড় মানুষকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। তাই চিঠিটা কেবল হুমকি নয়, এটা নিশ্চিত। এখানে অন্য কিছু আছে, এমন কিছু যা অদৃশ্য অথচ বাস্তব।

ভোর চারটের সময়ও তার চোখে ঘুম এল না। একসময় জানলা খুলে বাইরে তাকিয়ে সে হঠাৎ বুঝল, চারপাশের নিস্তব্ধতায় একটা কণ্ঠ যেন ভেসে আসছে। মৃদু, অস্পষ্ট, কিন্তু কানে বাজল স্পষ্ট তিনটে শব্দ— “ছাদে এসো… ছাদে এসো…”। অরুণ চমকে উঠল। ফ্ল্যাটের ওপরতলায় কেউ থাকে না, অথচ শব্দটা এল উপর থেকেই।

পরের দিন সকাল থেকে সে নিজেকে ব্যস্ত রাখল, খবরের কাগজের জন্য দু’টো রিপোর্ট লিখল, কয়েকটা ফোন করল, কিন্তু মনের ভেতরের টান কাটাতে পারল না। সন্ধ্যা হতে না হতেই বুকের ভেতর অস্বস্তি জমে উঠল। আর রাত নামতেই সে আবার গলফক্লাব লেনের দিকে হাঁটা দিল।

রাস্তা ভুতুড়ে নিস্তব্ধ। দূরে পুলিশ ভ্যানের হালকা সাইরেন বাজল, কিন্তু দ্রুত মিলিয়ে গেল। ছায়ার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সে বুঝল, গত রাতের থেকেও পরিবেশ বেশি চাপা। এবার সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে মনে হচ্ছিল যেন দেয়ালগুলো তার দিকে তাকিয়ে আছে।

প্রতিটি ধাপে উঠতে উঠতে সে খেয়াল করল, বাতাস ক্রমশ ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। পঞ্চম তলায় পৌঁছতেই হঠাৎ টর্চের আলোতে কিছু লিখন ভেসে উঠল দেয়ালের ওপর। সাদা চক দিয়ে লেখা কয়েকটা অক্ষর— “সত্য মানে মৃত্যু।”

অরুণের বুকের ভেতর হিম হয়ে গেল। কিন্তু সে থামল না। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল উপরদিকে। অষ্টম তলায় এক জায়গায় মেঝেতে একটা পুরনো ট্রাঙ্ক রাখা, ঢাকনা খোলা। ভেতরে কেবল ছেঁড়া খবরের কাগজ। টর্চ ফেলে সে দেখল, সব কাগজের হেডলাইন অদ্ভুতভাবে তার নিজের লেখা রিপোর্ট। যেন কেউ বছরের পর বছর ধরে তার লেখা কেটে কেটে জমিয়ে রেখেছে।

সে গিলে ফেলল আতঙ্ক। কে হতে পারে এমন? কোন অদৃশ্য পাঠক, যে প্রতিদিন তার কলমের ছাপ জমাচ্ছে?

অবশেষে রাত বারোটার কাঁটা ছুঁতেই সে ছাদে উঠল। চারদিক ঘন কুয়াশা। দূরের শহরের আলো দেখা যাচ্ছে, কিন্তু এখানে দাঁড়ালে মনে হয় সময় থেমে গেছে।

ছাদের একপ্রান্তে একটা চেয়ারের ওপর বসে আছে একটা ছায়ামূর্তি। অরুণ টর্চ ফেলতেই দেখা গেল, মুখ ঢাকা কালো কাপড়ে। কিন্তু শরীর নড়ছে না। সে ধীরে ধীরে এগোল। গলা শুকিয়ে আসছে।

ঠিক তখনই ছায়ামূর্তির মাথা সামান্য নড়ল। গলার গভীর থেকে বেরোল কর্কশ শব্দ— “তুমি দেরি করেছ, অরুণ।”

অরুণ কেঁপে উঠল। সে প্রশ্ন করল, “তুমি কে? আমার নাম জানো কীভাবে?”

ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। কাপড়ের আড়াল থেকেও তার চোখ দুটো যেন জ্বলজ্বল করছিল। সে বলল, “সত্যকে খুঁজতে চাইলে নিজেকে খুঁজতে হয়। তুমি যাদের উন্মোচন করেছ, তাদের থেকেও ভয়ঙ্কর এক ছায়া এই শহরে আছে। তুমি প্রস্তুত তো সেটা দেখার জন্য?”

অরুণ থেমে গেল। মনের মধ্যে সাংবাদিকের স্বভাবসুলভ কৌতূহল লড়ছে এক অনিবার্য আতঙ্কের সঙ্গে। “কিসের ছায়া? কাকে বোঝাচ্ছ?”

ছায়ামূর্তি কোনো উত্তর দিল না। সে ধীরে ধীরে হাতে কিছু বাড়িয়ে দিল। অরুণ আলো ফেলতেই দেখল, সেটা একটা পুরনো ছবি। ছবিটাতে ভাঙা বাড়ির ভেতরে চারজন মানুষ বসে আছে। আর আশ্চর্যজনকভাবে, টেবিলে রাখা কাগজে অরুণের নিজের নাম লেখা।

সে স্তম্ভিত। ছবিটা পুরনো, অন্তত পনেরো বছরের আগের। অথচ তার নাম তখনও এত পরিচিত ছিল না।

ছায়ামূর্তি গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “তুমি ভাবছো সাংবাদিক হিসেবে অপরাধের গল্প খুঁজছো। আসলে তোমাকে বেছে নেওয়া হয়েছে। কিছু দেখার, কিছু জানানোর। কিন্তু সাবধান—একবার এই ছায়ার ভেতর পা রাখলে আর ফেরার রাস্তা থাকে না।”

কথাটা বলেই ছায়ামূর্তি আচমকা হাওয়া হয়ে গেল। চেয়ারে কেবল পড়ে রইল সেই ছবিটা।

অরুণ টর্চ জ্বালিয়ে চারদিক খুঁজল। কেউ নেই। যেন কিছুক্ষণ আগেও যে মানুষটা দাঁড়িয়ে ছিল, সে আদৌ ছিলই না।

তার মাথার ভেতর এখন কেবল গর্জন করছে একটাই প্রশ্ন—
কে তাকে বেছে নিয়েছে? আর কেন এত পুরনো ছবিতে তার নাম লেখা?

পর্ব ৩ – পুরনো ছবির রহস্য

অরুণ চক্রবর্তী সেই রাতের পর আর আগের মতো স্বাভাবিক থাকতে পারল না। ছাদের অদ্ভুত ছায়ামূর্তি, তার হাতে পাওয়া পনেরো বছরের পুরনো ছবি—সবকিছু মিলে যেন বাস্তব আর অবাস্তবের সীমারেখা ঘুলিয়ে দিল। ছবিটা টেবিলের ওপর রেখে বহুবার খুঁটিয়ে দেখল সে। চারজন মানুষ বসে আছে, তাদের মুখ অস্পষ্ট, ধোঁয়াটে, হয়তো পুরনো প্রিন্টের কারণে। কিন্তু টেবিলে রাখা কাগজের ওপর তার নাম স্পষ্ট লেখা—“অরুণ চক্রবর্তী”—যেন সেদিনের ছবির মানুষগুলো জানত ভবিষ্যতে এই নামের একজন সাংবাদিক আসবে, লিখবে, এবং তাদের সঙ্গে কোনোভাবে যুক্ত হবে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন ভিড় করছিল তার মাথায়—এটা কি ফোটোশপের কারচুপি? কিন্তু ছবির কাগজ, তার গন্ধ, ফিকে রং—সবই প্রমাণ করছিল এটা একেবারেই পুরনো ছবি।

পরদিন সকালে অফিসে গিয়েও মাথা ভার লাগছিল। সম্পাদক তাকে নতুন একটি রাজনৈতিক দুর্নীতির রিপোর্ট করতে বলল, কিন্তু তার মাথা শুধু ঘুরপাক খাচ্ছিল সেই ছবির চারপাশে। দুপুরে কফি খেতে বেরিয়ে হঠাৎ সে সিদ্ধান্ত নিল, ছবিটাকে নিয়ে যাবে চেনা এক ফটো-অ্যানালিস্টের কাছে। বৌবাজারের সরু গলির ভেতরে শান্তনু নামের সেই মানুষ বহু বছর ধরে ফটো টেস্টিং করে আসছে, আদালতের নানা মামলায় প্রমাণ খতিয়ে দেখে সে রিপোর্ট দিয়েছে।

শান্তনুর দোকানটা ছোট, দেওয়ালে ক্যামেরার অংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অরুণ ছবিটা টেবিলে রাখতেই শান্তনু ভুরু কুঁচকাল। “আরে, এ তো বেশ পুরনো। অন্তত পনেরো-ষোলো বছরের তো হবেই। কোথায় পেলেন?”

অরুণ এড়িয়ে গেল প্রশ্নটা। শুধু বলল, “আমাকে জানাতে হবে এটা আসল না নকল।”

শান্তনু মাইক্রোস্কোপে ছবি পরীক্ষা করছিল। অনেকক্ষণ পর সে চুপ করে মাথা তুলল। “শোনো অরুণদা, এ ছবিতে কোনো এডিট নেই। একেবারে অরিজিনাল প্রিন্ট। কিন্তু একটা জিনিস অদ্ভুত লেগেছে।”

“কী?”

“টেবিলের ওপর তোমার নামটা—কালিটা ছবির বাকি অংশের থেকে অনেক বেশি টাটকা। বুঝতেই পারছো, ছবির বাকি অংশ অন্তত পনেরো বছরের পুরনো। কিন্তু নামটার কালি যেন গত কয়েক মাস আগেই লেখা।”

অরুণের শরীর কেঁপে উঠল। “মানে কী? কেউ পুরনো ছবির ওপর আমার নাম বসিয়েছে?”

শান্তনু মাথা নেড়ে বলল, “না, বসানো নয়। এটা ছবির ভেতরেই মিশে গেছে। যেমন সাধারণ ফটোগ্রাফে হয়, তেমনই। শুধু সময়টা আলাদা। যেন সময় নিজেই ভাগ হয়ে গেছে।”

অরুণ কোনো উত্তর দিল না। ছবিটা আবার ভাঁজ করে ব্যাগে রেখে দিল। বেরোনোর সময় শান্তনু ফিসফিস করে বলল, “অরুণদা, সাবধান। এই ছবিতে সময়ের খেলা আছে। এ জিনিস ভালো নয়।”

অরুণ বাইরে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবল, যদি সময় সত্যিই ভেঙে যায়, তবে কে এমন কাজ করতে পারে? আর কেন তার নাম ওই ছবির ভেতর ঢুকে গেল?

রাত নামতেই অরুণ আবার গলফক্লাব লেনের বাড়িটার দিকে গেল। এবার ভেতরে ঢুকে সে লক্ষ্য করল, সিঁড়ির গায়ে নতুন কিছু লেখা উঠেছে। কালো কয়লায় লেখা— “ছবির মানুষরা তোমার অপেক্ষায় আছে।”

তার বুকের ভেতর ধকধক শুরু হয়ে গেল। সে উপরে উঠল, কিন্তু এবার ছাদে পৌঁছে কিছু পেল না। চেয়ারটা খালি, কোনো ছায়ামূর্তি নেই। কেবল মেঝেতে পড়ে ছিল একটা ফাইল। অরুণ ফাইল খুলে দেখল, ভেতরে আছে কয়েকটা পুরনো কাগজপত্র, যেখানে খুনের রিপোর্ট কেটে রাখা—সবই কলকাতার গত কুড়ি বছরের কিছু অমীমাংসিত খুনের মামলা। প্রতিটি রিপোর্টে লাল কালি দিয়ে একটা অক্ষর ঘেরা—‘অ’।

অরুণের বুক কেঁপে উঠল। সব রিপোর্টে একই অক্ষর কেন? তার নিজের নামও তো সেই অক্ষর দিয়ে শুরু।

ঠিক তখনই ছাদের এক কোণ থেকে হঠাৎ ফিসফিস শব্দ ভেসে এল। “তুমি আমাদের খুঁজছো, কিন্তু আসলে আমরা-ই তোমাকে খুঁজছি।”

অরুণ ঝট করে ঘুরল। কুয়াশার ভেতর দিয়ে যেন কারও অস্পষ্ট ছায়া এগিয়ে আসছে। টর্চ ফেলতেই কিছু দেখা গেল না। কিন্তু তার পায়ের কাছে ফাইলের ভেতর থেকে উড়ে এল এক পাতলা নোট— “যদি সত্যি জানতে চাও, আগামীকাল রাত বারোটায় শিয়ালদহ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এসো। ৯ নম্বর বেঞ্চে।”

অরুণের বুকের ভেতর কৌতূহল আর আতঙ্ক মিলেমিশে ছড়িয়ে পড়ল। কে তাকে এমনভাবে পরিচালনা করছে? কেমন করে? সে জানে না, তবু সাংবাদিকতার সেই অদম্য স্বভাব তাকে টেনে নিচ্ছিল এক গভীর রহস্যের দিকে।

সেদিন রাতে ঘরে ফিরে ছবিটা আর ফাইলের পাতাগুলো টেবিলে ছড়িয়ে রাখল। তার চোখে ঘুম এল না। মনে হচ্ছিল, প্রতিটি রিপোর্টের অক্ষর, প্রতিটি ছবি, প্রতিটি ফিসফিস যেন মিলে একটা বিশাল অদৃশ্য ছায়ার ছবি আঁকছে, আর সেই ছবির কেন্দ্রবিন্দুতেই দাঁড়িয়ে আছে সে নিজে।

পর্ব ৪ – শিয়ালদহের রাত

শহরকে অনেকেই রাতের পর ঘুমন্ত ভাবে, কিন্তু অরুণ চক্রবর্তী জানে, এই শহরের অন্ধকারই আসল মুখ। দিনের কোলাহল ঢাকা পড়ে গেলে রাতের নীরবতা ফাঁস করে দেয় লুকোনো কণ্ঠস্বর। সেই কণ্ঠস্বরের পিছু নিতেই আজ সে শিয়ালদহ স্টেশনে এসেছে। ঘড়ির কাঁটা এগোচ্ছে রাত বারোটার দিকে। প্ল্যাটফর্মের বাতি নিভু নিভু, দোকানগুলো বেশিরভাগই বন্ধ, কেবল দু-একটা চায়ের দোকান এখনও গরম দুধে চা বানাচ্ছে। ভিখারিরা গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে, আর মাঝে মাঝে ট্রেনের হুইসেল হাওয়া কেটে যাচ্ছে।

অরুণ ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্ম ৯-এর দিকে এগোল। মাথার ভেতর বারবার বাজছে সেই নোটের লাইন— “৯ নম্বর বেঞ্চে।” সাংবাদিকের কৌতূহল তাকে টানছিল, কিন্তু বুকের ভেতরে ছিল এক অদ্ভুত ধকধকানি। যেন কেউ তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক অজানা ফাঁদের দিকে।

বেঞ্চটা ফাঁকা। অরুণ বসে পড়ল। চারপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগল, কে আসতে পারে। মিনিট পেরিয়ে গেল, কিন্তু কিছু হল না। হঠাৎ পেছন দিক থেকে ভেসে এল গম্ভীর গলা—“দেরি করেছ।”

সে ঘুরে তাকাল। এক লম্বা চাদরে ঢাকা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মুখ দেখা যাচ্ছে না, শুধু অন্ধকারের ভেতর থেকে চোখ দুটো জ্বলছে। অরুণ জিজ্ঞেস করল, “তুমি কে? আমাকে ডাকছ কেন?”

লোকটা কোনো উত্তর দিল না। কেবল একটা কাগজ তার দিকে বাড়িয়ে দিল। অরুণ কাগজটা হাতে নিতেই লোকটা যেন মিলিয়ে গেল। কেবল বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ বাকি রইল। অরুণ থতমত খেয়ে চারপাশে তাকাল—কেউ নেই। যেন লোকটা বাস্তব ছিলই না।

কাগজ খুলে দেখল, তাতে একটা নাম লেখা—“মায়া চৌধুরী”—আর পাশে একটা ঠিকানা। নিচে কাঁপা হাতে আঁকা একটা বাক্য— “সে জানে অদৃশ্য ছায়ার গল্প।”

অরুণের মাথায় যেন বাজ পড়ল। এই নামটা তার অচেনা, কিন্তু এর সঙ্গে নিশ্চয় কোনো পুরনো রহস্য জড়িয়ে আছে। সে ঠিকানাটা দেখে মনে করার চেষ্টা করল—এটা পুরনো উত্তর কলকাতার এক পাড়ার।

কাগজটা ভাঁজ করতে না করতেই হঠাৎ তার কানে বাজল এক মেয়েলি গলার হাহাকার। অরুণ ঘুরে দেখল, দূরে একটা পুরনো সিঁড়ির কাছে সাদা শাড়ি পরা এক নারী দাঁড়িয়ে আছে। তার চুল মুখ ঢেকে রেখেছে। সে কাঁপা গলায় বলল, “তুমি কেন এসেছ? এটা তোমার জন্য নয়।”

অরুণ উঠে দাঁড়াল। “তুমি কে? মায়া?”

নারী কোনো উত্তর দিল না। তার হাত থেকে সাদা কাপড়টা খুলে পড়ল মাটিতে। মুহূর্তে শরীরটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। শুধু রইল কাপড়টা।

অরুণ ধীরে ধীরে কাপড়টা তুলল। কাপড়ের ভেতরে গুঁজে রাখা একটা ছোট ডায়েরি। অরুণ তা খুলতেই ভেতরে লেখা—

“যদি সত্যি জানতে চাও, তবে সতর্ক থেকো। কারণ ছায়া শুধু তোমাকে ডাকছে না, তোমার জীবনকেও ঘিরে ফেলেছে। সত্য মানে মৃত্যু।”

অরুণের বুক হিম হয়ে গেল। ঠিক তখনই প্ল্যাটফর্মে ঢুকল একটা লোকাল ট্রেন। তার আওয়াজে চারদিক কেঁপে উঠল। লোকজনের ভিড় নামতে শুরু করল। অরুণ ডায়েরিটা ব্যাগে গুঁজে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল।

বাড়ি ফিরে ডায়েরিটা খুলে পড়তে লাগল সে। ভেতরে খসখসে অক্ষরে লেখা আছে মায়া চৌধুরীর জীবনকথা। কয়েকটা পাতা ছিঁড়ে গেছে, কিন্তু বাকি অংশে স্পষ্ট বোঝা গেল—সে ছিল একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্রী। হঠাৎ করেই একদিন সে দাবি করেছিল, তার চারপাশে অদৃশ্য ছায়া ঘুরে বেড়ায়। বন্ধুরা ভেবেছিল মানসিক সমস্যা। কিন্তু পরে জানা গেল, একের পর এক রহস্যমৃত্যুর সঙ্গে মায়ার নাম জড়িয়ে যাচ্ছে। একদিন হঠাৎ সে নিখোঁজ হয়ে যায়। আর তার কাহিনি চাপা পড়ে যায় শহরের অন্য খবরের ভিড়ে।

ডায়েরির শেষ পাতায় লেখা— “যে আমার নাম খুঁজে পাবে, সে আমার অদৃশ্য ছায়ার উত্তরাধিকারী হবে।”

অরুণ টের পেল বুকের ভেতর কেমন ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। কে তাকে টেনে আনছে এই খুন, রহস্য আর ছায়ার ফাঁদে? কেন তার নাম জড়িয়ে পড়ছে পুরনো ছবি আর মৃত মানুষের ডায়েরির সঙ্গে?

রাতটা তার কাটল না। বারবার মনে হচ্ছিল, কেউ যেন জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। পর্দার ফাঁক দিয়ে ছায়ামূর্তি নড়ছে, যদিও আলো ফেললে কিছু দেখা যায় না।

ভোর হতে না হতেই সে সিদ্ধান্ত নিল, ঠিকানাটা খুঁজে বের করবে। মায়া চৌধুরীর পাড়া কোথায়, সেটা দেখতে হবে। কারণ যতই ভয় লাগুক, সাংবাদিক অরুণ জানে—যতক্ষণ না সে রহস্যের মূলে পৌঁছবে, ততক্ষণ তার কলম শান্ত হবে না।

কিন্তু সে জানে না, এই পথে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই তার জীবন বদলে যাবে। কারণ অদৃশ্য ছায়া এখন শুধু তাকে ডাকছে না, তার ছায়ার ভেতরে ঢুকে পড়েছে।

পর্ব ৫ – মায়ার বাড়ি

পরদিন বিকেলেই অরুণ বেরিয়ে পড়ল। হাতে মায়া চৌধুরীর দেওয়া ঠিকানা—উত্তর কলকাতার পুরনো এক পাড়া, যেখানে সময় আটকে আছে। ছোট গলি, কাঠের বারান্দা, খসে পড়া রঙ, আর ঘরগুলোর ভেতরে পুরনো ইতিহাসের গন্ধ। সে গলির ভেতর দিয়ে হেঁটে চলল, আর প্রত্যেকটা মোড়ে মনে হচ্ছিল, কেউ তার পিছু নিচ্ছে। কতবারই বা ফিরে তাকাল—শূন্য রাস্তা, কেবল বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ।

অবশেষে পৌঁছল ১৩/ডি নম্বর বাড়ির সামনে। বিশাল লোহার গেট মরচে ধরে আটকে আছে, তবু ঠেলে খোলা যায়। উঠোনে ঢুকতেই অরুণ থমকে দাঁড়াল। জায়গাটা এমন নিস্তব্ধ, যেন বহু বছর কেউ পা রাখেনি। শুকনো পাতা মাটিতে জমে পাহাড় হয়ে গেছে, এক কোণে ভাঙা কূপ, আর বারান্দার ওপর ঝুলছে জালের স্তর।

দরজাটা আধখোলা। অরুণ সাহস করে ভেতরে ঢুকল। অন্ধকারের মধ্যে টর্চের আলো ফেলতেই সে দেখল, দেওয়ালে সারি সারি পুরনো ছবি। ছবিগুলোতে মানুষের মুখ অস্পষ্ট, অনেকটা সেই রহস্যময় ছবির মতো যেটা সে ছাদে পেয়েছিল। কিন্তু প্রতিটি ছবির নিচে একটা নাম লেখা—সবাই মেয়েমানুষ, আর প্রতিটি নামের পাশে লেখা মৃত্যুর বছর।

তার বুক ধড়ফড় করে উঠল। ডায়েরির কথা মনে পড়ল—মায়া চৌধুরীর নাম জড়িয়ে ছিল বহু রহস্যমৃত্যুর সঙ্গে। তাহলে এই ছবিগুলো কি সেই সব মৃত মেয়েদের?

সে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল। হঠাৎই কাঠের মেঝে কড়কড়ে শব্দ করল। মনে হল ওপরতলা থেকে কারও পদশব্দ আসছে। অরুণ সিঁড়ির কাছে গিয়ে টর্চ ফেলল। ধুলোয় মোড়া সিঁড়ি, কিন্তু পায়ের ছাপ স্পষ্ট। কারও ভারী পা পড়ে আছে ঠিক ক’মুহূর্ত আগেই।

সে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল। একটা ঘরের দরজা আধখোলা। ভেতরে ঢুকতেই হঠাৎ ঝাপটা হাওয়া এসে দরজাটা বন্ধ করে দিল। অরুণ টর্চ জ্বালিয়ে চারদিকে তাকাল। ঘরের মাঝখানে একটা কাঠের টেবিল, তার ওপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাগজপত্র। সে এগিয়ে গিয়ে একটা কাগজ তুলল। কাগজে লেখা—

“অদৃশ্য ছায়ার উত্তরাধিকারীরা মারা যায় না। তারা শুধু ছায়ায় মিশে যায়। নতুন উত্তরাধিকারী জন্মায়।”

অরুণ কাগজটা পড়তেই বুকের ভেতর অদ্ভুত শীতলতা ছড়িয়ে পড়ল। যেন কেউ তাকে পেছন থেকে তাকিয়ে আছে। সে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখল, ঘরের কোণায় দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণী। তার চোখ বড় বড়, ফ্যাকাশে মুখ, সাদা পোশাক। সে চুপচাপ তাকিয়ে আছে অরুণের দিকে।

অরুণ গলা শুকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “তুমি… মায়া?”

মেয়েটা কোনো উত্তর দিল না। ধীরে ধীরে এগিয়ে এল। তার ঠোঁট নড়ল—কিন্তু কোনো শব্দ বেরোল না। অরুণ টর্চ ফেলতেই মেয়েটার মুখ ঝাপসা হয়ে গেল, যেন আলো তার গায়ে পড়লেই ভেঙে যাচ্ছে। মুহূর্তে সে মিলিয়ে গেল।

অরুণ হোঁচট খেয়ে বসে পড়ল। মাথার ভেতর বাজতে লাগল একটা অদ্ভুত ফিসফিস— “তুমি এসেছ ঠিক জায়গায়, কিন্তু প্রস্তুত নও। ছায়ার খেলাটা বুঝতে হলে তোমাকে মূলে পৌঁছতে হবে।”

সে নিজেকে সামলে আবার টেবিলের কাগজপত্র ঘাঁটতে লাগল। একটা পুরনো ডায়েরি পেল। মলাট ছেঁড়া, পাতায় ফিকে কালি। ডায়েরির প্রথম পাতায় লেখা—“মায়া চৌধুরী, ১৯৯৮।”

অরুণ পড়তে শুরু করল—

“আমি জানি, আমি আর আমি নেই। ছায়ারা আমাকে ঘিরে ধরেছে। আমি যা দেখি, তা অন্য কেউ দেখে না। মানুষ ভাবে আমি পাগল, কিন্তু আমি জানি সত্যিটা। এই শহরে কিছু আছে, যারা ছায়ার আড়ালে বেঁচে থাকে, আর যাদের দরকার হয়, তাদের বেছে নেয়। আমি বেছে নেওয়া মানুষ। একদিন আমার পরে কেউ আসবে, সে-ই আমার ছায়ার উত্তরাধিকারী হবে।”

অরুণের হাত কেঁপে উঠল। ডায়েরির লাইনগুলো যেন সরাসরি তাকে উদ্দেশ্য করেই লেখা। তার নাম না থাকলেও, প্রতিটি বাক্যে সে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছিল।

ঠিক তখনই হঠাৎ নিচতলা থেকে দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ এলো। কেউ ঢুকেছে। অরুণ তাড়াতাড়ি ডায়েরিটা ব্যাগে ঢুকিয়ে টর্চ বন্ধ করে অন্ধকারে চুপ করে দাঁড়াল। পায়ের শব্দ ভেসে আসছে—ভারী, ধীর। কেউ ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠছে।

অরুণ নিঃশ্বাস আটকে অপেক্ষা করতে লাগল। অন্ধকার ঘরের ভেতর, কেবল হাওয়ার শব্দ, আর সেই ভারী পদশব্দ। একসময় দরজার সামনে এসে থামল। অরুণের মনে হল, দরজার ওপারেই কেউ দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু দরজা খুলল না। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা। তারপর আবার পদশব্দ সরে গেল।

অরুণ জানল, এই বাড়ি আর নিরাপদ নয়। সে যত দ্রুত সম্ভব নীচে নেমে বাইরে বেরিয়ে এল। কিন্তু গেট দিয়ে বেরোতেই বুঝল, রাত অনেকটা কেটে গেছে। ঘড়ি দেখল—রাত দুটো।

রাস্তা ফাঁকা, তবু মনে হচ্ছিল, অদৃশ্য ছায়ারা তার পিছু নিচ্ছে। বাড়ি ফিরে এসে দরজা বন্ধ করেও শান্তি পেল না। ঘরের ভেতরেও মনে হচ্ছিল, ছায়ারা তাকে ঘিরে আছে।

ডায়েরির শেষ পাতায় চোখ পড়তেই বুক কেঁপে উঠল। সেখানে লেখা— “যখন নতুন উত্তরাধিকারী প্রস্তুত হবে, তখন সব ছায়া তার ভেতর দিয়ে বাঁচবে। তাকে খুঁজে নেবে, তাকে গ্রাস করবে।”

অরুণ বুঝল, এখন সে আর সাধারণ সাংবাদিক নেই। সে জড়িয়ে গেছে এমন এক অদৃশ্য জালে, যেখান থেকে আর ফেরার পথ নেই।

পর্ব ৬ – ছায়ার তৃতীয় মুখ

অরুণ চক্রবর্তীর জীবন যেন প্রতিদিন বদলে যাচ্ছিল। সকালে অফিসে বসে অন্যদের মতো রাজনীতি, অপরাধ বা দুর্নীতি নিয়ে লেখা জমা দিচ্ছিল সে, কিন্তু মাথার ভেতর ক্রমাগত ঘুরছিল সেই ডায়েরি, সেই পুরনো ছবি আর রহস্যময় ছায়ারা। তার সহকর্মীরা টের পাচ্ছিল, অরুণ এখন অস্থির, মনোযোগ হারিয়েছে। কিন্তু অরুণ নিজেই জানত, এই অস্থিরতা কেবল কাগজে লেখার নয়, জীবনের ভেতর ঢুকে গেছে।

ডায়েরির পাতাগুলো বারবার পড়ছিল সে। মায়া চৌধুরীর লেখা প্রতিটি লাইন যেন তার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল। “আমি জানি, আমি আর আমি নেই। ছায়ারা আমাকে ঘিরে ধরেছে।” এই বাক্যটা পড়লেই অরুণের গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। কারণ সেও এখন এমন কিছু অনুভব করছিল, যা শব্দে বোঝানো যায় না। ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে থাকা অন্ধকার ছায়া, খোলা জানলার বাইরে অস্পষ্ট আকার—সবই যেন তাকে লক্ষ্য করছে।

একদিন বিকেলে অফিস থেকে বেরিয়ে সে রওনা দিল কলেজ স্ট্রিটের পুরনো লাইব্রেরির দিকে। মনে হল, হয়তো সেখানে মায়ার কোনো সূত্র পাওয়া যেতে পারে। লাইব্রেরির ভেতরে ধুলো জমা বইয়ের স্তূপ, কাঠের আলমারি, ম্লান আলো। অরুণ বইপত্র ঘাঁটতে লাগল। হঠাৎই এক কোণে একটা পুরনো রেজিস্টার পেল। পাতাগুলো হলদে, কিন্তু তাতে স্পষ্ট নাম লেখা—“মায়া চৌধুরী, ইতিহাস বিভাগ, ১৯৯৭ ব্যাচ।”

অরুণ বুক ধড়ফড় করে পড়তে লাগল। রেজিস্টারে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতির তালিকা আছে। মায়ার নাম প্রথমে নিয়মিত, কিন্তু শেষ দিকে হঠাৎ একেবারে উধাও। পাশে শিক্ষকের নোটে লেখা— “অস্বাভাবিক আচরণ, মানসিক চিকিৎসার পরামর্শ।”

অরুণ হিম হয়ে গেল। তাহলে মায়াকে সবাই পাগল ভেবেছিল? কিন্তু সে যা লিখেছিল, তা যদি সত্যি হয়?

ঠিক তখনই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক বৃদ্ধ লাইব্রেরিয়ান চুপচাপ বলল, “তুমি মায়ার নাম খুঁজছো?”

অরুণ চমকে তাকাল। “আপনি মায়াকে চিনতেন?”

বৃদ্ধ ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। “চিনতাম। অদ্ভুত মেয়ে ছিল। বলত, ওর চারপাশে ছায়ারা ঘুরে বেড়ায়। প্রথমে আমরা হাসতাম, পরে ভয় পেতে শুরু করি। ওর সঙ্গে যারা মিশত, তাদের অনেকেই অদ্ভুতভাবে মারা গেল। তারপর একদিন মায়া নিজেই হারিয়ে গেল।”

অরুণ প্রশ্ন করল, “আপনি কি জানেন সে কোথায় গিয়েছিল?”

বৃদ্ধ ফিসফিস করে বলল, “মায়া বিশ্বাস করত, এই শহরের উত্তর প্রান্তে একটা গোপন আস্তানা আছে—ছায়াদের তৃতীয় মুখ। সেখানে গিয়ে নাকি মানুষ আর মানুষ থাকে না। শুধু ছায়ায় মিশে যায়। আমি আর কিছু জানি না।”

অরুণের ভেতর দিয়ে শীতল হাওয়া বয়ে গেল। “ছায়ার তৃতীয় মুখ”—শব্দটাই কাঁপিয়ে দিল তাকে।

সেদিন রাতে সে বাড়ি ফিরেও শান্তি পেল না। ঘড়ি তখন রাত একটা। হঠাৎ দরজায় টোকার শব্দ। অরুণ সাবধানে দরজা খুলল। বাইরে কেউ নেই। কিন্তু মেঝেতে পড়ে আছে একটা খাম। সে খুলে দেখল, ভেতরে একটা ছোট কাগজে লেখা— “তুমি সত্যের পথে আছো। কিন্তু তৃতীয় মুখে পা রাখার আগে জানতে হবে—সত্য মানেই মৃত্যু।”

অরুণ হঠাৎ দেখল, কাগজের ভেতরে একটা ফটোও রাখা আছে। সে অবাক হয়ে গেল। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, সে নিজে একটা নির্জন বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে—কিন্তু ছবিটার তারিখ আজকের দিন সকাল। অথচ সে জানে, আজ সকাল সে অফিসে ছিল। কে এমন ছবি তুলল? কেমন করে?

সে ভেতরে ফিরে এসে বারবার ছবিটা খুঁটিয়ে দেখল। বাড়িটা তার চেনা নয়, কিন্তু মনে হল কোথাও দেখা। জানলার গ্রিল, দেয়ালের ভাঙা প্লাস্টার—সব মিলিয়ে যেন উত্তর কলকাতার কোনো গলির।

সে ঠিক করল, পরদিন সকালে বেরিয়ে পড়বে খুঁজতে। কিন্তু রাতেই ঘটল অদ্ভুত ঘটনা। টেবিলের ওপর রাখা ডায়েরিটা হঠাৎ নিজে থেকে খুলে গেল। পাতাগুলো হাওয়ায় উল্টে যেতে লাগল, থেমে গেল মাঝের এক পাতায়। সেখানে লেখা—

“যে-ই আমার উত্তরাধিকারী হবে, তার সামনে আমি আবার আসব। অদৃশ্য থেকে দৃশ্য হবো। কারণ ছায়া কখনও পুরো অদৃশ্য হয় না।”

ঠিক তখনই অরুণের ঘরে আলো নিভে গেল। জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে যেন কেউ তাকিয়ে আছে। অরুণ টর্চ জ্বালাল, কিন্তু আলো ফেলতেই দেখল, ছায়ার মতো এক নারী দাঁড়িয়ে। সাদা মুখ, অদ্ভুত চোখ। সে কাঁপা গলায় বলল, “আমি মায়া।”

অরুণ স্তম্ভিত হয়ে গেল। “তুমি… বেঁচে আছো?”

নারী ধীরে ধীরে এগিয়ে এল। তার শরীর যেন অর্ধেক আলো, অর্ধেক ছায়া। সে বলল, “বেঁচে নেই, আবার মরে যাইনি। আমি ছায়ার তৃতীয় মুখে আটকে আছি। তুমি ডাক পেয়েছো। তুমি আর ফিরতে পারবে না।”

অরুণ কেঁপে উঠল। “কেন আমাকে বেছে নিয়েছো?”

মায়া এক অদ্ভুত হাসি হাসল। “কারণ তোমার কলম সত্যকে খোঁজে। আর সত্য মানেই মৃত্যু। তুমি সেই উত্তরাধিকারী।”

কথাটা বলেই মায়ার শরীর মিলিয়ে গেল। কেবল ঠান্ডা হাওয়া ঘরে ছড়িয়ে পড়ল। অরুণ বুঝল, সে এখন এমন এক জালে জড়িয়ে গেছে, যেখান থেকে পালানোর কোনো রাস্তা নেই।

সেদিন রাতে তার ঘুম এল না। বারবার মনে হচ্ছিল, ঘরের কোণায় কেউ বসে আছে। জানলার কাচে প্রতিফলিত হচ্ছে ছায়ার মুখ। আর মাথার ভেতরে বাজছে সেই কথাটা—“ছায়ার তৃতীয় মুখ।”

অরুণ জানে, তাকে যেতেই হবে। যত ভয়ই হোক, রহস্যের মূল খুঁজতে তাকে পৌঁছতেই হবে সেখানে।

পর্ব ৭ – মৃত্যুপুরীর দরজা

পরের দিন সকালেই অরুণ রওনা দিল। মায়ার ছায়ার মুখোমুখি হওয়ার পর থেকে তার ভেতর যেন এক অদ্ভুত শক্তি জেগে উঠেছে। ভয় আছে, আতঙ্ক আছে, কিন্তু সেই আতঙ্ক তাকে থামাতে পারছে না। তার হাতে এখনও সেই অদ্ভুত ছবি—যেখানে দেখা যাচ্ছে সে নিজে দাঁড়িয়ে আছে এক ভাঙাচোরা বাড়ির সামনে। ছবিটার সূত্রেই সে খুঁজতে শুরু করল জায়গাটা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘোরার পর অবশেষে সে পৌঁছল শহরের এক কোণে, যেখানে রাস্তার আলো প্রায় নেই, গলি ভাঙা, আর কুকুরেরা কেবল হিংস্র চোখে তাকিয়ে আছে।

ছবিতে দেখা বাড়িটার সামনে দাঁড়াতেই অরুণের বুক ধড়ফড় করে উঠল। এটাই সেই জায়গা। বিশাল ফটক ভেঙে পড়েছে, দেওয়ালে শ্যাওলা জমেছে, ভেতর থেকে ভেসে আসছে অদ্ভুত ঠান্ডা। সে গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গেই বুঝল, এখানে সময় অন্যরকম। চারপাশে নিস্তব্ধতা, এমনকি পাখির ডাকও নেই।

বাড়ির ভেতরে ঢুকে সে টর্চ ফেলল। মেঝে জুড়ে পুরনো প্রতীক আঁকা—বৃত্ত, ত্রিভুজ, আর কিছু অচেনা চিহ্ন। মনে হল, এগুলো কোনো তান্ত্রিক রীতির চিহ্ন। হঠাৎই কানে বাজল মৃদু ফিসফিস—“স্বাগতম, উত্তরাধিকারী।”

অরুণ টর্চ ঘুরিয়ে দেখল, ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে কালো পোশাকে ঢাকা কয়েকজন মানুষ। তাদের মুখ কাপড়ে ঢাকা, চোখ শুধু জ্বলজ্বল করছে। অরুণ সাহস করে প্রশ্ন করল, “তোমরা কারা? মায়া কোথায়?”

একজন এগিয়ে এল। গলা কর্কশ—“আমরা ছায়ার তৃতীয় মুখের প্রহরী। মায়া আমাদের অংশ হয়ে গেছে। এবার তোমার পালা।”

অরুণ দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আমি সাংবাদিক। আমি কেবল সত্য খুঁজতে এসেছি।”

প্রহরীরা একসঙ্গে হেসে উঠল। হাসির শব্দ যেন দেয়াল ভেদ করে প্রতিধ্বনি তুলল। একজন বলল, “সত্য মানে মৃত্যু। তুমি তা জানো না? মায়া তা বুঝেছিল। তাই সে মিলিয়ে গেছে। এবার তুমি।”

ঠিক তখনই ঘরের মাঝখানে আগুন জ্বলে উঠল। আগুনের ভেতরে ভেসে উঠল মায়ার মুখ। ফ্যাকাশে, অর্ধেক ছায়া, অর্ধেক আলো। সে অরুণের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করল, “পালাতে পারবে না। এ দরজা একবার খোলার পর ফেরার পথ থাকে না।”

অরুণের শরীর কেঁপে উঠল, কিন্তু সে সাহস করে এগিয়ে গেল। “মায়া, তুমি যদি বেঁচে না থেকেও এখানে আছো, তবে আমাকে বলো, কেন আমি? কেন আমাকে টেনে আনা হচ্ছে?”

মায়ার চোখে অদ্ভুত আলো। “কারণ তুমি সেই মানুষ, যে ভয় পেয়েও থামে না। ছায়ারা এমন মানুষই চায়। তুমি উত্তরাধিকারী।”

অরুণ মাথা নাড়ল। “না, আমি উত্তরাধিকারী নই। আমি কেবল সত্য প্রকাশ করতে চাই। মানুষের সামনে আনতে চাই এই ছায়াদের গল্প।”

প্রহরীরা একসঙ্গে চিৎকার করল। হঠাৎ ঘরের প্রতীকগুলো জ্বলতে শুরু করল। মেঝে কেঁপে উঠল। অরুণ অনুভব করল, সে যেন টেনে নেওয়া হচ্ছে ভেতরের অন্ধকারে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে অদ্ভুত দৃশ্য—অসংখ্য মুখ, যাদের কেউ মানুষ, কেউ ছায়া, সবাই ফিসফিস করছে।

সে প্রাণপণে ডায়েরিটা ব্যাগ থেকে বের করে ধরল। ডায়েরির পাতাগুলো বাতাসে উল্টে যেতে লাগল। শেষ পাতায় থেমে গেল—লেখা আছে, “তৃতীয় মুখ খুলবে তখনই, যখন উত্তরাধিকারী সত্য উচ্চারণ করবে।”

অরুণ বুঝতে পারল, তাকে কিছু বলতে হবে। বুকের ভেতর ধুকপুকানি নিয়ে সে চিৎকার করে বলল, “আমি অরুণ চক্রবর্তী। আমি মায়ার উত্তরাধিকারী নই। আমি মানুষের উত্তরাধিকারী। আর আমি সত্যকে অন্ধকারে আটকে রাখব না!”

মুহূর্তে আগুন নিভে গেল। ঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেল। প্রহরীরা একে একে মিলিয়ে গেল, যেন হাওয়ায় ভেসে গেল। মায়ার মুখও ধীরে ধীরে অদৃশ্য হলো।

অরুণ হাঁপাতে লাগল। চারপাশে শুধু নিস্তব্ধতা। কিন্তু ঠিক তখনই দেওয়ালের ভেতর থেকে ভেসে এল কর্কশ হাসি। “তুমি ভেবেছো মুক্তি পেয়েছো? না, অরুণ। তুমি দরজা খুলেছো। এখন মৃত্যুপুরী তোমাকে চিনে ফেলেছে।”

অরুণ হঠাৎ টের পেল, মেঝের প্রতীকগুলো আবার জ্বলে উঠছে। এবার সেগুলো বৃত্ত নয়, যেন মানুষের চোখ। শত শত চোখ তাকিয়ে আছে তার দিকে।

সে আর দেরি না করে ছুটে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। বাইরে বেরোতেই বুঝল, রাত অনেক কেটে গেছে। রাস্তা ফাঁকা, আকাশে পূর্ণচাঁদ। কিন্তু তার ছায়া মাটিতে পড়ছে না। সে আতঙ্কে নিচে তাকাল—হ্যাঁ, শরীর আছে, কিন্তু কোনো ছায়া নেই।

অরুণের মাথায় বাজ পড়ল। ছায়ারা কি তার ভেতর ঢুকে পড়েছে? নাকি তার ছায়া হারিয়ে গেছে সেই মৃত্যুপুরীর অন্ধকারে?

সে টলতে টলতে বাড়ির দিকে ফিরল। নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই বুক হিম হয়ে গেল। আয়নায় প্রতিফলন আছে, কিন্তু সেটা তার নিজের নয়। ফ্যাকাশে মুখ, জ্বলজ্বলে চোখ—মায়ার প্রতিচ্ছবি দাঁড়িয়ে আছে।

অরুণ পেছনে ঘুরল—কেউ নেই। আবার আয়নার দিকে তাকাল—মায়া হাসছে। ঠোঁট নড়ে উঠল—“এবার তুমিই ছায়ার তৃতীয় মুখ।”

পর্ব ৮ – ছায়াহীন মানুষ

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অরুণ বুঝতে পারছিল না, সে কি জেগে আছে, নাকি এক দুঃস্বপ্নের ভেতরে আটকে গেছে। প্রতিফলনে সে নয়, মায়ার মুখ—ফ্যাকাশে ঠোঁট, জ্বলজ্বলে চোখ, ঠান্ডা হাসি। অথচ ঘুরে দাঁড়ালে ঘরে সে একা। যেন আয়না এখন আর প্রতিফলন দেখাচ্ছে না, বরং অন্য কোনো জগতের জানালা হয়ে উঠেছে। জানালা, যার ওপাশে ছায়ারা বাস করে।

অরুণ আতঙ্কে আয়নাটা ভেঙে ফেলল। টুকরো টুকরো কাচ মেঝেতে ছড়িয়ে গেল। কিন্তু কাচের প্রতিটি টুকরোয় মায়ার মুখ ভেসে উঠল। প্রতিটি মুখ ফিসফিস করে বলল—“তুমি ছায়াহীন মানুষ হয়ে গেছো।”

সে হঠাৎ বুঝল, সত্যিই তাই। শরীর আছে, কিন্তু মাটিতে তার কোনো ছায়া পড়ছে না। বুকের ভেতর অদ্ভুত শূন্যতা। মনে হচ্ছে, কিছু যেন তাকে ভেতর থেকে ছিঁড়ে নিয়ে গেছে।

সকালে অফিসে গেলেও কেউ খেয়াল করল না যে তার ছায়া নেই। যেন এটা শুধু তার চোখেই ধরা দিচ্ছে। কিন্তু অরুণ অনুভব করল, সহকর্মীদের চোখে একটা অস্বাভাবিক দৃষ্টি। যেন তারা সবাই দূর থেকে তাকে লক্ষ্য করছে, অথচ সরাসরি কিছু বলছে না।

দুপুরে সম্পাদক তাকে ডাকলেন। “অরুণ, তুমি কি ঠিক আছো? তোমাকে কেমন যেন লাগছে।”

অরুণ গলা শুকিয়ে বলল, “আমি ঠিক আছি।”

কিন্তু বেরোতে গিয়েই দেখল, টেবিলের ওপর রাখা দিনের খবরের কাগজে শিরোনাম— “অপরাধ সাংবাদিক অরুণ চক্রবর্তী রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ।” সে স্তব্ধ হয়ে গেল। খবরের কাগজে তার নিজের ছবি, আর নিচে লেখা, গতকাল রাত থেকে তার খোঁজ নেই।

সে কাঁপা হাতে খবরের কাগজটা তুলে নিল। এটা কীভাবে সম্ভব? সে তো নিজেই এখানে দাঁড়িয়ে আছে। না কি সত্যিই সে নিখোঁজ হয়ে গেছে—মানুষদের চোখে নয়, বাস্তবেই?

হঠাৎ চারপাশের মানুষগুলো ফিসফিস করতে শুরু করল। শব্দটা প্রথমে অস্পষ্ট, তারপর পরিষ্কার—“ছায়াহীন… ছায়াহীন…”। অরুণ আতঙ্কে দৌড়ে বেরিয়ে এল।

বিকেলে সে শিয়ালদহের দিকে হাঁটতে হাঁটতে আবার মনে করল, মায়ার ডায়েরির কথা। সেখানে লেখা ছিল—“ছায়ার উত্তরাধিকারী মানুষের জগত থেকে হারিয়ে যায়। কেউ তাকে আর খুঁজে পায় না।”

অরুণ বুঝল, এখন সে সেই অবস্থাতেই দাঁড়িয়ে। শহরের ভিড়ে হাঁটলেও সে একা, অদৃশ্য। মানুষ তাকে দেখছে, অথচ সত্যিই দেখছে না।

রাত ন’টা নাগাদ সে ফিরে এল সেই ভাঙা বাড়িটার কাছে—মৃত্যুপুরীর দরজা। ভেতরে ঢুকতেই আবার সেই প্রতীকগুলো জ্বলে উঠল। এবার কিন্তু প্রহরী নেই, মায়াও নেই। কেবল অদৃশ্য কণ্ঠস্বর বলল, “তুমি ছায়াহীন মানুষ। তুমি আর ফিরে যেতে পারবে না।”

অরুণ চিৎকার করে উঠল, “আমি ফিরে যাব! আমি মানুষ!”

অদৃশ্য কণ্ঠস্বর হাসল। “মানুষের কি কোনো ছায়া ছাড়া বাঁচা সম্ভব? তুমি তো আর মানুষ নও।”

হঠাৎ চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেল। অরুণ টের পেল, তার ভেতর থেকে স্মৃতিগুলো মুছে যাচ্ছে। শৈশবের দিন, বাবা-মায়ের মুখ, প্রথম প্রেম, সাংবাদিক জীবনের প্রথম রিপোর্ট—সব যেন ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে।

সে হাঁপাতে হাঁপাতে মাটিতে বসে পড়ল। ঠিক তখনই তার কানে মায়ার ফিসফিস—“যদি বাঁচতে চাও, তবে সত্য লিখে যাও। যতক্ষণ লিখছো, ততক্ষণ ছায়ারা তোমাকে পুরো গ্রাস করতে পারবে না।”

অরুণ ব্যাগ থেকে খাতা বের করল। কাঁপা হাতে লিখতে শুরু করল—যা কিছু সে দেখেছে, মায়ার গল্প, ছায়ার তৃতীয় মুখ, মৃত্যুপুরীর দরজা। প্রতিটি শব্দ লিখতে লিখতে তার মনে হল, বুকের ভেতরের শূন্যতা কিছুটা ভরছে।

হঠাৎ আলো ফিরে এল। সে দেখল, তার ছায়া মাটিতে পড়েছে—কিন্তু সেটা তার নিজের নয়। ফ্যাকাশে মুখ, বড় বড় চোখ—মায়ার ছায়া তার শরীরের সঙ্গে লেগে আছে।

অরুণ হিম হয়ে গেল। “তাহলে আমি কি এখন তোমার অংশ?”

ছায়া যেন মাথা নেড়ে সায় দিল।

অরুণ জানল, সে যতক্ষণ সত্য লিখবে, ততক্ষণ মানুষদের চোখে সে থাকবে। কিন্তু একবার থেমে গেলে, পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যাবে।

সে ফিরে এল নিজের ফ্ল্যাটে। টেবিলে বসে লিখতে লাগল। বাইরে তখন রাত গভীর, হাওয়ার শোঁ শোঁ শব্দ, জানলার কাচে ছায়ার প্রতিচ্ছবি। আর খাতার পাতায় কালি ছড়িয়ে লিখে চলেছে অরুণ—“আমি ছায়াহীন মানুষ। আমি সত্য লিখছি, যাতে মানুষ জানে—অদৃশ্য ছায়ারা বাস্তব।”

তার চোখের কোণে জল ভেসে উঠল। কারণ সে জানে, এ লেখা আর সাংবাদিকতার রিপোর্ট নয়। এ হচ্ছে বেঁচে থাকার শর্ত।

পর্ব ৯ – শবের শহর

অরুণ চক্রবর্তী এখন আর আগের মতো নেই। সে জানে, তার ছায়া তার নিজের নয়—মায়ার ছায়া তার শরীরের সঙ্গে আটকে আছে। বাইরে থেকে দেখলে সে একজন সাধারণ মানুষ, কিন্তু ভেতরে সে জানে, সে আর মানুষ নয়, আবার পুরোপুরি ছায়াও নয়। এক অদ্ভুত মধ্যবর্তী অবস্থায় সে বেঁচে আছে। তার রাতগুলো এখন নির্ঘুম। টেবিলের ওপর খাতা খুলে সে লিখে চলে—যা কিছু দেখছে, যা কিছু অনুভব করছে। কারণ মায়ার কণ্ঠ তাকে সতর্ক করে দিয়েছে—“লিখতে থাকো, নইলে হারিয়ে যাবে।”

কিন্তু লেখার মধ্যেও আতঙ্ক ঘিরে থাকে। একদিন ভোরে খাতা বন্ধ করতে না করতেই হঠাৎ আলো নিভে গেল। ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। দেয়ালে টর্চ ফেলতেই দেখল, দেয়ালের ছায়াগুলো নড়ছে। তার নিজের ছায়া নয়, অচেনা মুখগুলো ফিসফিস করছে। একসঙ্গে শত শত গলা বলছে—“এসো… এসো…”।

অরুণ কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞেস করল, “কোথায়?”

শব্দগুলো একসঙ্গে উত্তর দিল—“শবের শহরে।”

পরদিন বিকেলে সে খবরের সূত্র ধরে পৌঁছল শহরের উপকণ্ঠে, যেখানে আছে পুরনো একটি কবরখানা। লোকেরা বলে, বহু বছর আগে এখানে এক মহামারিতে হাজার হাজার মানুষ কবর দেওয়া হয়েছিল। এখন জায়গাটা পরিত্যক্ত, কেউ আসে না। কবরখানার গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই সে টের পেল, বাতাসে অদ্ভুত গন্ধ—আর্দ্র মাটি, পচা ফুল, আর ভাঙা সমাধির ধুলো।

অরুণ ধীরে ধীরে হাঁটছিল। প্রতিটি কবরের ওপর অদ্ভুত প্রতীক আঁকা, যেগুলো সে আগেও সেই মৃত্যুপুরীর ঘরে দেখেছিল। মনে হল, সব কিছু এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা। হঠাৎই কানে এল মায়ার কণ্ঠ—“এখানেই আমি লুকিয়ে আছি।”

সে থমকে দাঁড়াল। চারপাশে কেবল কবর, শুকনো ঘাস, আর কাকের ডাক। অথচ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সেই কণ্ঠ। সে এগিয়ে গিয়ে এক ভাঙা সমাধির সামনে দাঁড়াল। সমাধির ওপর খোদাই করা নামটা মুছে গেছে, কিন্তু ম্লান আলোয় বোঝা গেল—“মায়া…”

অরুণের বুক কেঁপে উঠল। কবরের সামনে দাঁড়িয়ে সে ফিসফিস করে বলল, “তুমি এখানে?”

মুহূর্তেই চারদিকের বাতাস কেঁপে উঠল। সমাধির মাটি ফেটে উঠল, আর সেখান থেকে বেরিয়ে এল ফ্যাকাশে এক ছায়া। মায়ার মুখ, চোখে আগুনের মতো আলো। সে চুপচাপ তাকিয়ে রইল অরুণের দিকে।

অরুণ ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি মৃত?”

মায়া ধীরে ধীরে বলল, “মৃত নই, আবার জীবিতও নই। আমি আটকে আছি এই শবের শহরে। তুমি এসেছো আমাকে মুক্তি দিতে।”

অরুণ স্তব্ধ হয়ে গেল। “কীভাবে?”

মায়া হাত বাড়িয়ে বলল, “তোমাকে আমার জায়গায় দাঁড়াতে হবে। আমি যদি মুক্তি চাই, তবে তোমাকে ছায়ার সঙ্গে মিশতে হবে।”

অরুণ মাথা নাড়ল। “না, আমি সাংবাদিক। আমার কাজ সত্যি খুঁজে বের করা, তোমার জায়গা নেওয়া নয়।”

মায়া হেসে উঠল। “সত্যি? তুমি কি জানো, সত্যি কী? সত্যি হলো ছায়া। মানুষ ভাবে মৃত্যু মানেই শেষ। কিন্তু মৃত্যু হলো কেবল ছায়ার নতুন জন্ম। তুমি যখন লিখছো, তখনও ছায়ারা তোমার কলমে বেঁচে থাকছে।”

অরুণ বুক ধড়ফড় করে উঠল। হঠাৎ কবরখানার চারদিক থেকে অসংখ্য ছায়া ভেসে এল। তারা সবাই ফিসফিস করছে—“উত্তরাধিকারী… উত্তরাধিকারী…”।

অরুণ বুঝল, আর সময় নেই। সে খাতা খুলে লিখতে শুরু করল—“আমি শবের শহরে দাঁড়িয়ে আছি। আমার সামনে মায়া। সে মৃত নয়, জীবিতও নয়। সে চাইছে আমি তার জায়গা নেই।”

লিখতে লিখতেই সে টের পেল, তার শরীর হালকা হয়ে আসছে। যেন ধীরে ধীরে মাটির ওপর থেকে ভেসে উঠছে। মায়ার চোখে এক অদ্ভুত শান্তি। সে ফিসফিস করে বলল, “হ্যাঁ, এভাবেই।”

ঠিক তখনই অরুণের মাথায় বাজ পড়ল। যদি সে এখন থেমে যায়, তবে ছায়ারা তাকে পুরোপুরি গ্রাস করবে। তাই সে কলম চালিয়ে গেল। লিখল প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি শব্দ। লিখতে লিখতে হঠাৎ খেয়াল করল, খাতার পাতায় কালি নয়, রক্ত বেরোচ্ছে। তার নিজের আঙুল ফেটে যাচ্ছে, রক্ত খাতায় মিশে যাচ্ছে।

সে ব্যথায় চিৎকার করে উঠল, কিন্তু লেখা থামাল না। রক্তে ভিজে উঠল প্রতিটি অক্ষর। আর প্রতিটি অক্ষরে ছায়াগুলো একে একে মিলিয়ে যেতে লাগল। কবরখানার নিস্তব্ধতা আবার ফিরে এল।

মায়া ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল। শেষ মুহূর্তে সে বলল, “তুমি আমাকে মুক্তি দিলে। কিন্তু মনে রেখো, এখন তুমিই ছায়ার অংশ।”

অরুণ হাঁপাতে হাঁপাতে মাটিতে বসে পড়ল। চারপাশে আর কোনো ছায়া নেই। কিন্তু তার শরীর ঠান্ডা, হাত কাঁপছে। খাতার পাতায় লেখা আছে রক্তের অক্ষরে—“আমি শবের শহরের সাক্ষী।”

সে জানে, এবার আর ফেরার পথ নেই। কারণ এই শহরের ছায়ারা তাকে চিনে ফেলেছে। আর একবার ছায়াহীন মানুষকে চিনে ফেললে, তারা কখনও তাকে ছাড়ে না।

পর্ব ১০ – শেষ আলো

শবের শহর থেকে ফেরার পর অরুণ চক্রবর্তী বুঝল, সে আর আগের মতো মানুষ নেই। রক্তে ভেজা সেই খাতার প্রতিটি অক্ষর যেন তার শরীরে খোদাই হয়ে গেছে। ঘরে ফেরার পর আয়নায় তাকাতেই দেখল, তার মুখ ফ্যাকাশে, চোখ গভীর কালো হয়ে উঠেছে। আর আশ্চর্যের বিষয়—তার ছায়া আবার ফিরেছে, কিন্তু সেটা তার নিজের নয়। ছায়াটা মায়ার মতো।

সে জানত, যতক্ষণ লিখছে, ততক্ষণ বাঁচবে। কিন্তু প্রতিটি শব্দ লেখার সঙ্গে সঙ্গে মনে হচ্ছিল, সে আস্তে আস্তে মৃত্যুর দিকে হাঁটছে। যেন কলম আর খাতা এখন তার প্রাণ। লিখতে থামলেই সব শেষ।

তিনদিন ধরে টানা লিখছিল সে। বাইরে বেরোয়নি, ফোন ধরেনি, কারও সঙ্গে দেখা করেনি। প্রতিবেশীরা ভেবেছিল, অরুণ হয়তো কোনো বড় রিপোর্ট লিখছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে লিখছিল নিজের মৃত্যুপুরীর কাহিনি। প্রতিটি পাতায় লিপিবদ্ধ হচ্ছিল ছায়াদের ফিসফিস, শবের শহরের সমাধি, মৃত্যুপুরীর দরজা।

চতুর্থ রাতে, হঠাৎ দরজায় টোকার শব্দ। অরুণ আতঙ্কে খাতা আঁকড়ে ধরল। বাইরে থেকে কণ্ঠ ভেসে এল—“অরুণদা, দরজা খুলুন। আমরা পুলিশ।”

অরুণ ধীরে ধীরে দরজা খুলল। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন অফিসার। তারা বলল, “আপনার নামে অভিযোগ এসেছে, আপনি কয়েকদিন ধরে নিখোঁজ। আপনার অফিসেও খবর গেছে। আমাদের ভেতরে ঢুকতে দিন।”

অরুণ দ্বিধায় ভুগল। যদি তারা খাতাটা দেখে ফেলে? যদি বুঝে ফেলে, সে আর পুরোপুরি মানুষ নেই? কিন্তু অফিসাররা জোর করে ভেতরে ঢুকে পড়ল। ঘরের মাঝখানে টেবিলের ওপর রাখা খাতা দেখে তারা অবাক হয়ে গেল। পাতাগুলো রক্তে ভেজা, অক্ষরগুলো ভয়ানক।

একজন অফিসার কাঁপা গলায় বলল, “এ সব কী? আপনি কি নিজের রক্ত দিয়ে লিখেছেন?”

অরুণ উত্তর দিল না। শুধু চুপচাপ তাকিয়ে রইল। তখনই হঠাৎ আলো নিভে গেল। ঘর অন্ধকারে ডুবে গেল। অফিসাররা টর্চ জ্বালাতেই দেখল—দেয়ালে অসংখ্য ছায়া নড়ছে।

একজন অফিসার চিৎকার করে উঠল, “ওখানে কে?”

অরুণ শান্ত গলায় বলল, “তোমরা দেখতে পাচ্ছো না? এরা হলো অদৃশ্য ছায়া। এরা এখন আমার অংশ।”

অফিসাররা আতঙ্কে পিছিয়ে গেল। হঠাৎ মেঝে কেঁপে উঠল। খাতার পাতাগুলো হাওয়ায় উল্টে যেতে লাগল। প্রতিটি পাতার অক্ষর ছায়ার মতো ঘর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল।

এক অফিসার দরজা দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল, আরেকজন অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। অরুণ একা দাঁড়িয়ে রইল ছায়াদের ভিড়ে।

সে খাতা তুলে নিল, লিখতে লাগল—“আজ পুলিশ এল। তারা ছায়াদের দেখল। তারা ভয় পেল। কিন্তু আমি ভয় পাই না। আমি জানি, সত্যি মানে মৃত্যু।”

ঠিক তখনই তার কানে মায়ার কণ্ঠ ভেসে এল। “অরুণ, তুমি শেষ পরীক্ষায় পৌঁছে গেছো। এখন তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—মানুষ হয়ে বাঁচবে, নাকি ছায়ার সঙ্গে মিশে যাবে।”

অরুণ কলম থামাল। চারপাশ নিস্তব্ধ। তারপর সে ফিসফিস করে বলল, “আমি সাংবাদিক। আমি মানুষ। আমি সত্য লিখব। কিন্তু ছায়ার অংশ হয়ে নয়।”

মুহূর্তে খাতা আগুনে জ্বলে উঠল। অক্ষরগুলো ধীরে ধীরে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল এক ঝলক তীব্র আলো। সেই আলোর ভেতরে মায়ার মুখ দেখা গেল—শান্ত, মুক্ত। সে হাসল। “তুমি আমাকে মুক্তি দিলে, অরুণ। ধন্যবাদ।”

আলো মিলিয়ে গেল। ঘর আবার অন্ধকার। খাতা এখন ছাই।

অরুণ আয়নার সামনে দাঁড়াল। প্রতিফলনে এবার কেবল সে নিজে। মায়া নেই, অন্য কোনো ছায়া নেই। আর মাটিতে পড়েছে তার নিজের ছায়া—সেই পুরনো, সাধারণ ছায়া।

কিন্তু বুকের ভেতরে একটা শূন্যতা রয়ে গেল। সে জানে, এই মুক্তি সাময়িক। ছায়ারা তাকে ছেড়ে গেছে কি না, সে নিশ্চিত নয়। শুধু মনে হচ্ছে, একদিন আবার তারা ফিরবে।

সেদিন রাতেই সে একটি শেষ নোট লিখল—

“আমি অরুণ চক্রবর্তী। আমি ছায়াদের দেখেছি। আমি শবের শহরে গেছি। আমি জানি, সত্য মানে মৃত্যু। কিন্তু কেউ তো সত্য লিখবে। যদি এই লেখাটা কারও হাতে পৌঁছয়, জেনে রেখো—অদৃশ্য ছায়ারা আছে। তারা আমাদের ভেতরেই বেঁচে থাকে।”

শেষ অক্ষর লিখেই অরুণ খাতাটা বন্ধ করল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বাইরে ভোরের আলো ফুটছিল। পাখির ডাক ভেসে আসছিল।

শহর তখন জেগে উঠছিল নতুন দিনের জন্য। কিন্তু অরুণ জানত, তার ভেতরের দিন আর রাত চিরকাল ছায়ায় ঢাকা থাকবে।

শেষ

WhatsApp-Image-2025-08-21-at-11.32.32-AM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *