সোনালী দেব
১
রায়চৌধুরী বাড়ি যেন ইতিহাসের এক প্রাচীন দলিল, যার প্রতিটি দেয়ালে লুকিয়ে আছে গৌরব ও ক্ষয়ের মিলেমিশে থাকা কাহিনি। বিশাল ফটক পেরোলেই চোখে পড়ে দোতলা প্রাসাদের মতো বিশাল বাড়ি—উঁচু খিলানওয়ালা জানালা, বারান্দার লোহার গ্রিলের কাজ, আর সিঁড়ির মাথায় শ্বেতপাথরের সিংহমূর্তি। একসময় এ বাড়ির জমিদারি ছড়িয়েছিল আশেপাশের বহু গ্রামে, ঘোড়ার গাড়ি, হস্তিদল, পালকি, এবং শত শত কৃষকের আনাগোনায় মুখর থাকত এই প্রাসাদ। এখন অবশ্য সময়ের সঙ্গে তার অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে, কিন্তু ছায়াঘেরা আঙিনা আর খসে পড়া দেওয়ালগুলো এখনো অতীতের গৌরবের সাক্ষী। সন্ধ্যা নামলেই যেন এই বাড়ি চারপাশের অন্ধকারকে গিলে নেয়; ঝুলে থাকা পুরোনো ঝাড়বাতি, কড়কড়ে দরজা আর বাতাসে ভেসে আসা পুরোনো কাঠের গন্ধে বাড়িটা যেন ভৌতিক সৌন্দর্যে ভরে ওঠে। অরিন্দম রায়চৌধুরী, বর্তমান কর্তা, চেষ্টা করেন ঐতিহ্যের ধ্বংসাবশেষটুকু আঁকড়ে ধরে রাখতে। পুরোনো দালানে মেরামত চললেও এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা যেন প্রতিটি কোণায় জমে থাকে—যেন এই প্রাসাদই নিজের অতীতের ছায়ায় আবদ্ধ।
এই ঐতিহ্যবাহী প্রাসাদের মধ্যমণি হলেন মধুরিমা রায়চৌধুরী, বয়স মাত্র তেইশ। মধুরিমা যেন এই পুরোনো প্রাসাদের অন্ধকারে এক আলোকরেখা। তার বড় বড় চোখে অদ্ভুত কৌতূহল আর স্বপ্নের ঝিলিক, আর চুলগুলো কালো মেঘের মতো ঢালু হয়ে নামে কাঁধে। সে কখনোই রাজকীয় ভান বা বিলাসিতার মোহে বুঁদ হয়নি; বরং পুরোনো লাইব্রেরিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটায়, পড়তে ভালোবাসে ইতিহাস আর পুরোনো দলিলপত্র। তার শখ, জমিদারবাড়ির বংশলতিকা আঁকড়ে সেই ইতিহাস খুঁজে বের করা, যা সবাই ভুলে গেছে। গ্রামের মানুষের কাছে সে রাজকন্যার মতো, কিন্তু মধুরিমার কাছে নিজেকে কখনো রাজকন্যা মনে হয়নি। বাইরে থেকে অভিজাততার আভা থাকলেও ভেতরে ভেতরে সে ছিল সহজ, স্নিগ্ধ আর স্বাধীনচেতা। কিন্তু সেই স্বাধীনতা কখনো পুরোপুরি মেলে ধরতে পারেনি—কারণ রায়চৌধুরী বাড়ির দেয়ালের মধ্যেই যেন লুকিয়ে ছিল এক অদৃশ্য বাঁধন।
যতই দিন গড়াচ্ছে, মধুরিমা অনুভব করছিল এই বাড়ির ভেতরে কিছু একটা গোপন রহস্য কাজ করছে। রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চাঁদের আলোয় যখন পুরোনো আমগাছের ছায়া নড়াচড়া করত, তার মনে হতো—এই বাড়ির প্রতিটি ইট-পাথরের ভেতরে যেন চাপা পড়ে আছে অতীতের হাহাকার। মাঝেমাঝে সে শুনত দূরের করিডরে অদ্ভুত ফিসফিসানি, কিংবা নিঃসঙ্গ লাইব্রেরিতে বইয়ের পাতা উল্টে যাওয়ার শব্দ। সবাই বলত, এ শুধু তার কল্পনা, কিন্তু মধুরিমা জানত এ কল্পনা নয়। বরং এই অস্বস্তি যেন প্রতিদিন তাকে আরও গভীরভাবে জড়িয়ে ধরছিল। প্রাসাদের প্রতিটি কোণায় সে এক অদৃশ্য উপস্থিতি টের পেত—যেন কেউ চুপচাপ তাকে লক্ষ্য করছে। অরিন্দম রায়চৌধুরী হয়তো বুঝতেন না, কিন্তু মধুরিমা জানত, জমিদারবাড়ির ঐতিহ্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে অনেক গোপন অন্ধকার, যার রহস্য এখনো উন্মোচিত হয়নি।
এই অদ্ভুত পরিবেশে মধুরিমার দিনযাপন যেন এক দোলাচলে ভরপুর। বাইরে থেকে সমাজ তাকে দেখত অভিজাত কন্যা হিসেবে—যার হাতে সোনার চুড়ি, যার ঘরে রঙিন পর্দা, আর যে ভবিষ্যতে একদিন বিশাল সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হবে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে ছিল বন্দি, এক অদৃশ্য ছায়ার কবলে। তার বন্ধু অভিরূপ ছাড়া আর কেউই সত্যিকারের তাকে বুঝতে পারত না। অভিরূপের সঙ্গে সে ভাগ করে নিত নিজের দুঃশ্চিন্তা, নিজের ভয়ের কথা। তবে প্রাসাদের বাইরের মানুষদের কাছে এসব কেবল অলীক গল্প মনে হতো। আসলেই কি জমিদারবাড়ির ভেতরে লুকিয়ে আছে কেবলই ইতিহাস, না কি সত্যিই সেখানে আছে এক ষড়যন্ত্রের ছায়া? সময় তখনো তার উত্তর দেয়নি। কিন্তু সেই ছায়া যে একদিন মধুরিমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে, তার আভাস যেন প্রথম থেকেই লুকিয়ে ছিল এই জমিদারবাড়ির ঘন অন্ধকারে।
২
প্রভাতী আলোয় জমিদারবাড়ির উঠোন যেন এক অদ্ভুত নির্জনতায় ভরে গিয়েছিল। প্রতিদিন ভোরেই মধুরিমাকে দেখা যেত বারান্দায় দাঁড়িয়ে শিউলি গাছের নিচে পড়া ফুল কুড়োতে, তারপর হাঁটতে হাঁটতে পুরোনো লাইব্রেরির দিকে যেত। কিন্তু সেদিন সকালটা ছিল ভিন্ন—মধুরিমার ঘর খোলা, বিছানা গোছানো, টেবিলে আধখানা চিঠি আর অর্ধেক খাওয়া চায়ের কাপ পড়ে আছে। সারা বাড়িতে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ল। দাসীরা ফিসফিস করতে শুরু করল, অরিন্দম রায়চৌধুরী কপালে হাত ঠেকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলেন, কোথায় গেল তার মেয়ে। প্রথমে মনে হয়েছিল হয়তো বাগানের দিকে গেছে বা পুকুরপাড়ে বসে আছে, কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা খুঁজেও যখন তাকে পাওয়া গেল না, তখন আতঙ্ক বাড়ল। প্রাসাদের করিডর জুড়ে শোরগোল—“মধুরিমা দিদিমণি নেই! মধুরিমা দিদিমণি নেই!” এই চিৎকারে ঘুম ভাঙল সবার, আর রায়চৌধুরী বাড়ির প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে পড়ল এক অস্বস্তিকর আতঙ্ক।
খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল গ্রাম ও শহরে। জমিদারবাড়ির একমাত্র কন্যা হঠাৎ অদৃশ্য—এ ঘটনা যেন সমাজের জন্য এক প্রকার বিস্ফোরণ। লোকজন বলতে শুরু করল, “এ আর এমন কী? মেয়েটি তো অনেক দিন ধরেই অভিরূপের সঙ্গে মেলামেশা করত।” কেউ আবার বলল, “জমিদারের ঘরের মেয়ে প্রেমে পড়েছে সাধারণ এক ছেলের—এ তো পরিবারের মানহানি!” গুজব দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল, বাজারের দোকান থেকে শুরু করে চায়ের আড্ডা, এমনকি মন্দিরের সিঁড়িতেও সবাই একসুরে বলতে লাগল—মধুরিমা প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়েছে। এই কুৎসা যেন অরিন্দম রায়চৌধুরীর মাথায় আঘাত করল। সমাজ যাকে এতদিন ভদ্রলোক, জমিদার হিসেবে সম্মান দিয়েছে, সেই সমাজ আজ এক নিমেষে তার কন্যাকে অপবাদে ডুবিয়ে দিল। অথচ সত্যটা কী, কেউ জানে না।
অভিরূপের ওপর সমস্ত দোষ চাপল। গ্রামবাসী তাকে দোষারোপ করতে শুরু করল—“ওই ছেলেই মধুরিমাকে ফুঁসলিয়েছে!” অভিরূপের বাড়ির সামনে ভিড় জমল, মানুষ গালাগাল করল, কেউ কেউ হাত তুলতেও উদ্যত হলো। অথচ অভিরূপ বারবার বলতে লাগল, “আমি জানি না, আমি কিছুই জানি না।” কিন্তু কে শোনে তার কথা? সমাজ তো এমনিতেই গল্প বানাতে ভালোবাসে, আর জমিদারবাড়ির কন্যার অন্তর্ধান তো তার জন্য একেবারে সোনার খনি। তবে এই পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি আঘাত করল অরিন্দম রায়চৌধুরীকে। মেয়ের হঠাৎ অন্তর্ধানে তিনি যেন অসহায় হয়ে পড়লেন। বাইরের কঠোরতা ভেঙে পড়ে ভিতরে এক ভয়ার্ত বাবার মুখ ফুটে উঠল—যিনি জানেন না, তার কন্যা কোথায়, কেমন আছে। বাড়ির ভেতরে একদিকে গুজব আর কুৎসার ঝড়, অন্যদিকে নিস্তব্ধতার ভেতরে জমে থাকা উদ্বেগ—এই দ্বন্দ্বই রায়চৌধুরী বাড়িকে শ্বাসরুদ্ধ করে তুলল।
কিন্তু আসল রহস্যটা যে আরও গভীরে, তা কেউ তখনও ভাবেনি। মধুরিমা কোথায় গেল, কাকে সঙ্গে নিয়ে গেল, আদৌ কি সে স্বেচ্ছায় কোথাও গেছে—নাকি তাকে জোর করে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে? এসব প্রশ্ন অজানা থেকে গেল। সবাই শুধু সহজ উত্তরটাই গ্রহণ করল—সে প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়েছে। অথচ টেবিলে পড়ে থাকা আধখানা চিঠি আর অর্ধেক খাওয়া চায়ের কাপ বলছিল অন্য কথা। যে মেয়ে প্রতিদিন সকালবেলা ফুল কুড়োনোর সময়ও নীরব গান গুনগুন করে, সে কি এত হঠাৎ সব ফেলে পালিয়ে যেতে পারে? তার ডায়েরি, তার অসমাপ্ত লেখাগুলো, তার চোখে অদৃশ্য ভয়ের ছায়া—এসবই ইঙ্গিত করছিল অন্য কিছুর দিকে। কিন্তু সেই সত্যের পথে এগোনোর মতো সাহসী কেউ তখনও মঞ্চে আসেনি। সমাজের চোখ শুধু দেখতে চাইছিল একটাই ছবি—অভিজাত পরিবারের কন্যা পালিয়েছে সাধারণ প্রেমিকের সঙ্গে। অথচ জমিদারবাড়ির অন্ধকার করিডরে সেদিন থেকেই শুরু হয়েছিল এক অদৃশ্য ষড়যন্ত্রের খেলা, যার রেশ ছড়িয়ে পড়বে পরবর্তী প্রতিটি ঘটনায়।
৩
ঘটনার খবর পৌঁছেছিল শহরের সংবাদমাধ্যমে ঝড়ের মতো। জমিদারবাড়ির কন্যা নিখোঁজ—এই খবরের রসালো দিকগুলো সমাজের কাছে হয়ে উঠেছিল বিনোদন, কিন্তু তরুণী সাংবাদিক ঈশা সেনের কাছে এটি ছিল এক ভিন্ন ধরণের চ্যালেঞ্জ। শহরের একটি প্রখ্যাত দৈনিক পত্রিকায় কাজ করে ঈশা, বয়স মাত্র ছাব্বিশ, তীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক আর নির্ভীক প্রশ্ন করার ক্ষমতাই তাকে অল্পদিনেই আলাদা করে তুলেছে। বস তাকে প্রথমে এই নিখোঁজের খবরে কাভারেজ করতে পাঠালেন গসিপ প্রতিবেদনের মতো করে, কিন্তু ঈশার ভেতরে সাংবাদিকতার এক অদম্য তাগিদ ছিল—সে জানত, গুজবকে শুধু ছাপা নয়, সত্য উদ্ঘাটন করাই আসল কাজ। তাই কলম, নোটবুক আর ক্যামেরা নিয়ে সে রওনা দিল রায়চৌধুরী প্রাসাদের দিকে, যেখানে চারপাশে ইতিমধ্যেই জমে উঠেছে মানুষের ভিড়, কৌতূহলী চোখ, আর ভাঙাচোরা মন্তব্যের ঢল। ঈশা সবার আগে লক্ষ্য করল—এখানে যা ঘটেছে, তা সাধারণ প্রেমঘটিত পালানোর কাহিনি হতে পারে না। জমিদারবাড়ির মুখ বন্ধ, অরিন্দম রায়চৌধুরী সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন না, অথচ ছায়াঘেরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রতিটি মানুষ যেন আতঙ্কে গিলে নিচ্ছে নিজেকে।
প্রথমেই ঈশা গেল মধুরিমার ঘরে। ঘরটি ছিল পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি—কোনো অগোছালো হাবভাব নেই, যেন সে একেবারেই হুট করে পালিয়ে যায়নি। টেবিলে অর্ধেক খাওয়া চায়ের কাপ এখনো পড়ে আছে, ঠান্ডা হয়ে জমে গেছে, পাশে কিছু বই খোলা, বুকমার্ক লাগানো অবস্থায়। ঈশার সাংবাদিকসুলভ দৃষ্টি খেয়াল করল—এই বইগুলো সাধারণ উপন্যাস নয়, বরং জমিদারবাড়ির ইতিহাস, পুরোনো দলিলপত্র আর পারিবারিক কাহিনি নিয়ে লেখা কিছু গ্রন্থ। এমনকি একপাশে রাখা ছিল অ্যালবামের মতো মোটা খাতা, যেটি মধুরিমা নিজের হাতে লিখেছে—বংশলতিকা, স্মৃতি, আর অজানা সব নোট। পাতাগুলো উল্টে দেখেই ঈশা বুঝল, মধুরিমা নিছক রোমান্টিক মেয়ে নয়, বরং অনুসন্ধিৎসু মন যার আগ্রহ ছিল বাড়ির অদ্ভুত অতীত ঘিরে। আরও অদ্ভুত লাগল বিছানার পাশে পড়ে থাকা এক পুরোনো চিঠি—যেটি সম্ভবত অর্ধেক লেখা, কিংবা কারো উদ্দেশ্যে অসমাপ্ত বার্তা। কালি ফিকে হয়ে গেছে, কিন্তু তাতে কিছু অদ্ভুত বাক্য ছিল: “তুমি যদি সত্যিই জানতে চাও, তবে রাতের আঁধারে সেই কক্ষের তালা খুলো…।” বাকিটা অস্পষ্ট, যেন কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে মুছে দিয়েছে বা অসম্পূর্ণ রেখেছে।
ঈশা বুঝতে পারছিল, এ নিখোঁজের ঘটনা সরল নয়। সে বাড়ির ভেতরে আরও অনুসন্ধান চালাতে লাগল। করিডরের প্রতিটি কোণে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেখল—পুরোনো দেয়ালে আঁকা রঙ খসে পড়েছে, কিন্তু কিছু জায়গায় যেন সাম্প্রতিক আঁচড়ের দাগ, যেন কেউ ইচ্ছে করে লুকাতে চাইছে কিছু। মধুরিমার ডায়েরি থেকে একাধিক সূত্র মেলে। একটি পাতায় সে লিখেছিল—“আমার চারপাশে যে ছায়াগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের আমি চিনি না, কিন্তু তাদের দৃষ্টি আমাকে বন্দি করে রেখেছে।” আবার আরেক পাতায় উল্লেখ আছে—“সম্পত্তির হিসাব যেন এক ভয়ংকর জালে আমাকে বেঁধে ফেলছে। আমি চাই মুক্তি, কিন্তু কোথায় যাব?” ঈশা এই লেখা পড়েই আঁচ করল—এখানে প্রেমঘটিত পালানো নয়, বরং জমিদারবাড়ির সম্পত্তি আর উত্তরাধিকারকে ঘিরে এক ভয়ংকর ষড়যন্ত্র কাজ করছে। বাইরে তখন গ্রামবাসী অভিরূপকে দোষারোপ করছে, কিন্তু ঈশা ভেতরে ভেতরে নিশ্চিত হচ্ছিল—অভিরূপ হয়তো সহজ টার্গেট, আসল খেলাটা অন্য কারও হাতে।
ঘটনাস্থল থেকে বেরিয়ে ঈশা ঠাণ্ডা মাথায় সব বিশ্লেষণ করতে লাগল। সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা তাকে শিখিয়েছে—প্রথম যে ব্যাখ্যাটা সমাজ দেয়, সেটাই সাধারণত ভুল। এখানে সমাজ চটজলদি প্রেমঘটিত গল্প বানিয়ে ফেলেছে, অথচ বাস্তব আরও গভীর। মধুরিমার চিঠি, ডায়েরি আর অসমাপ্ত সূত্র তাকে টেনে নিচ্ছে প্রাসাদের অন্ধকার করিডরের ভেতরে, যেখানে প্রতিটি দরজার আড়ালে লুকিয়ে আছে কোনো না কোনো গোপন রহস্য। বাড়ির চাকর-চাকরানিদের সঙ্গে কথা বলে ঈশা আরও কিছু ইঙ্গিত পেল। তারা ভয় পেয়ে কিছু বলতে চাইছিল না, কিন্তু কারও চোখেমুখে আতঙ্ক স্পষ্ট ছিল। ঈশার মনে হচ্ছিল, এ বাড়ির ভেতরে যারা আছে, তারা অনেক কিছু জানে, কিন্তু কেউ মুখ খোলার সাহস পাচ্ছে না। সত্যিই কি মধুরিমাকে নিজের ইচ্ছেতে পালাতে হয়েছে? নাকি তাকে অদৃশ্য করে দেওয়া হয়েছে, যাতে জমিদারবাড়ির উত্তরাধিকার অন্য কারও হাতে চলে যায়? এই প্রশ্নগুলোই তখন ঈশার মাথায় ঝড় তুলছিল। সে বুঝল, এ কাহিনি এত সহজ নয়, আর সত্য খুঁজে বের করা এখন তার ব্যক্তিগত দায়িত্বে পরিণত হলো। সাংবাদিক হিসেবে নয়, বরং এক সত্যসন্ধানী মানুষ হিসেবে ঈশা সিদ্ধান্ত নিল—মধুরিমার অন্তর্ধানের রহস্য উদ্ঘাটন করতেই হবে।
৪
রূপেশ রায়ের আচরণ দিন দিন এমনভাবে পরিবর্তিত হচ্ছিল যে ঈশার মনে অস্বস্তি জন্ম নিচ্ছিল। প্রথমে সে ভেবেছিল হয়তো জমিদারবাড়ির বিশাল সম্পত্তি, পুরোনো অন্দরমহল আর ভগ্নপ্রায় অথচ ঐতিহ্যবাহী অট্টালিকার ইতিহাস নিয়ে আলোচনায় রূপেশ শুধু কৌতূহলবশতই আগ্রহী। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ঈশা লক্ষ্য করল, সে আর শুধু শুনছে না—বরং সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। পরিবারের অন্য সদস্যরা হয়তো অভ্যস্ত হয়ে গেছে কিংবা তার দৃঢ় স্বভাব দেখে আপত্তি তুলতে ভয় পাচ্ছে, কিন্তু ঈশার চোখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল, রূপেশ যে আগ্রহ দেখাচ্ছে তা নিছক পারিবারিক দায়িত্ববোধ নয়। তার কথাবার্তা, হাঁটাচলা, এমনকি সামান্য ইঙ্গিতেও ফুটে উঠছিল একধরনের আধিপত্যের ছায়া। বিশেষত যখন সে জমিদারবাড়ির আঙিনা মেরামত বা পুরোনো আসবাব বিক্রি করার প্রসঙ্গ তুলত, তখন তার স্বর আরও বেশি জোরালো হয়ে উঠত। ঈশার মনে হচ্ছিল, রূপেশ যেন ধীরে ধীরে জমিদারবাড়ির ভবিষ্যৎ একাই নিজের মুঠোয় নিতে চাইছে।
এই সন্দেহের বীজ আরও গভীর হয় এক দুপুরে। পরিবারের সবাই বসেছিল উত্তরমুখী বারান্দায়, যেখানে পুরোনো কাঠের দোলনা এখনও দুলত। আলোচনার বিষয় ছিল জমিদারবাড়ির পুরোনো জমি আর তার আইনি দলিল। ঈশা দেখল, রূপেশ সব কথা কেটে দিয়ে নিজেই জোর দিয়ে বলছে—“এই জমির মালিকানা নির্দিষ্টভাবে না করলে, ভবিষ্যতে অনেক সমস্যা হবে। আর সেই মালিকানার ভাগ নিয়ে দ্বিধা থাকলে আমি দায়িত্ব নেব।” তার কণ্ঠে ছিল একরকম দৃঢ়তা, কিন্তু ঈশার কাছে তা অহংকারের মতো শোনাল। অন্যরা প্রথমে চুপ করে থাকলেও ধীরে ধীরে বোঝা যাচ্ছিল, তারা তার প্রভাবের নিচে চলে যাচ্ছে। ঈশার চোখে চোখ রাখতেই রূপেশ একরকম কটাক্ষময় হাসি দিল, যেন জানে—ঈশা তার উদ্দেশ্য বুঝে ফেলেছে। সেই মুহূর্তে ঈশার বুকের ভেতর অজানা শঙ্কা বাজতে শুরু করল।
ঈশা তখন থেকে রূপেশের প্রতিটি কাজকর্ম খুঁটিয়ে লক্ষ্য করতে লাগল। সে দেখল, রূপেশ প্রায়ই বাড়ির পুরোনো অংশে একা একা ঘোরে। অন্ধকার করিডোরে কিংবা তালাবন্ধ ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। কখনও আবার পরিবারের সবার অগোচরে গোপন আলাপ করে গ্রামের কয়েকজন মধ্যস্থতাকারীর সঙ্গে, যারা জমি কেনাবেচার কাজে যুক্ত। ঈশা এই দৃশ্য একদিন আচমকা চোখে পড়ে যায়—রূপেশ বারান্দার এক কোনায় দাঁড়িয়ে কানে কানে কথা বলছে, আর তার হাতে ধরা কাগজে কিছু জমির দলিলের নকশা ফুটে উঠছে। ঈশা চমকে ওঠে, কিন্তু চুপ করে যায়। সে বুঝতে পারে, সরাসরি প্রশ্ন করলে রূপেশ হয়তো মিথ্যে বলবে অথবা আরও ভয়ঙ্করভাবে তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। তাই সে আপাতত নীরব থেকে পর্যবেক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তার ভেতরে সন্দেহের ছায়া আরও ঘনীভূত হতে থাকে।
দিন যত গড়ায়, ঈশা তত বুঝতে পারে—এটা শুধু সম্পত্তি নিয়ে দখলদারিত্বের বিষয় নয়, এর পেছনে লুকিয়ে আছে আরও কিছু। রূপেশের চেহারায় এখন একধরনের লোভ আর অধিকারবোধ স্পষ্ট। তার চোখে জমিদারবাড়ি যেন ইতিহাস বা উত্তরাধিকার নয়, বরং এক বিশাল সম্পদ—যা দিয়ে সে হয়তো নিজের প্রভাব বিস্তার করতে চায়। ঈশার মনে হতে থাকে, এই বাড়ির অন্দরে শুধু প্রাচীন কাহিনি বা স্মৃতি নয়, হয়তো অজানা ষড়যন্ত্রও লুকিয়ে আছে। সন্দেহের ছায়া ধীরে ধীরে তাকে পেয়ে বসে, আর সে অনুভব করতে থাকে—যদি সত্যিই রূপেশের ইচ্ছা পূর্ণ হয়, তবে শুধু বাড়ির ইতিহাস নয়, তাদের পারিবারিক বন্ধনও ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। এই ভয়ে ঈশা মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে, কারণ সে জানে—একদিন তাকে সরাসরি রূপেশের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে, আর সেই দিনটা হয়তো খুব দূরে নয়।
৫
অভিরূপের নাম বারবার চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সবাই বলছিল, মধুরিমার নিখোঁজ হওয়ার পেছনে ওর হাতই সবচেয়ে বড়। ঘনিষ্ঠজনেরা মনে করছিল, ওর হঠাৎ করে বাড়িতে আসা, রাতে বারান্দায় ফিসফিস করে কারও সঙ্গে ফোনে কথা বলা কিংবা মেয়েটির প্রতি অতিরিক্ত আগ্রহ—এসবই সন্দেহকে বাড়িয়ে তুলেছে। পাড়ার প্রবীণরা একেবারে চূড়ান্ত রায় দিয়ে দিয়েছিল—“মধুরিমা নিশ্চয়ই ওই অভিরূপের সঙ্গে পালিয়েছে।” সংবাদমাধ্যমও গরম খবর বানাতে ছাড়ল না। কিন্তু ঈশা—যে গোটা ঘটনাটার খুঁটিনাটি প্রথম থেকেই খতিয়ে দেখছিল—মনে মনে কিছুতেই মানতে পারছিল না যে অভিরূপ একেবারে খলনায়ক। ওর চোখে অভিরূপ কখনো ভীতিকর মনে হয়নি, বরং একরকম অসহায়। তাই এক সন্ধ্যায়, সবাই যখন বারান্দায় বসে গুজব রটাচ্ছে, ঈশা চুপচাপ খোলা মাঠের ধারে গিয়ে অভিরূপকে খুঁজে বের করল। মুখটা অস্বাভাবিক ক্লান্ত, চোখে রাতের জেগে থাকার ছাপ। ঈশা সোজাসুজি বলল, “তুই কি সত্যিই মধুরিমাকে নিয়ে গেছিস?” অভিরূপ কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর ধীরে ধীরে খুলে বলল নিজের কথাগুলো—যা শুনে ঈশা বুঝতে পারল, সব কিছুই এত সহজ নয়।
অভিরূপ জানাল, সে বরং মধুরিমাকে পালাতে সাহায্য করতে চেয়েছিল। তার ভাষায়, “ও ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ছিল, ঈশা। হাসিমুখে সবার সঙ্গে কথা বলত বটে, কিন্তু ঘরের ভেতরে এসে আমার সঙ্গে অনেকবার বলেছে, ‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না।’ মধুরিমা একেবারে ভয় আর আতঙ্কে ডুবে যাচ্ছিল। সে বলেছিল, বিয়ের পাত্র ঠিক করার নামে ওকে এক অদ্ভুত খাঁচার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তার ওপর বাড়ির ভেতরে এক অদৃশ্য চাপ—যা কাউকে বলা যায় না, কাউকে বোঝানো যায় না। আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতাম, সে যেন ক্রমেই নিজের অস্তিত্ব হারাচ্ছে।” অভিরূপের গলায় কাঁপন ছিল, আর ঈশার মনে হচ্ছিল এই কথাগুলো মিথ্যে নয়। হয়তো সত্যিই মধুরিমা কোথাও নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পালাতে চেয়েছিল। ঈশা ভাবল, এটা প্রেমের গল্প নাকি ষড়যন্ত্রের—সেটাই এখন প্রশ্ন। অভিরূপ কি শুধু বন্ধুত্বের জায়গা থেকে সাহায্য করছিল, নাকি তার ভেতরে অন্য কিছু উদ্দেশ্য লুকিয়ে ছিল?
সন্ধ্যার ম্লান আলোয় মাঠে বসে দুজনের কথোপকথন দীর্ঘ হলো। অভিরূপ জানাল, মধুরিমা তাকে কয়েকবার চিঠি লিখে দিয়েছে, যেখানে স্পষ্টভাবে লেখা ছিল—“আমাকে যদি বাঁচতে হয়, তবে পালাতে হবে।” ঈশা চিঠিগুলো দেখতে চাইল। অভিরূপ ব্যাগ থেকে কাগজের টুকরোগুলো বের করে দিল। সেগুলোতে আঁকাবাঁকা হস্তাক্ষর, চোখে পড়ার মতো তাড়াহুড়ো। প্রতিটি বাক্যে এক ধরনের আতঙ্ক স্পষ্ট—যেন ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে লেখা। ঈশা পড়তে পড়তে অনুভব করল, এই রহস্য আরও গভীর। এখানে শুধু ব্যক্তিগত প্রেম নয়, বরং এক অদৃশ্য জালের ইঙ্গিত আছে। হয়তো পরিবার, হয়তো বাইরের কেউ, হয়তো অন্য কোনো অচেনা শক্তি—যে মধুরিমাকে বন্দি করে রেখেছিল। অভিরূপের প্রতি ঈশার মন একটু নরম হয়ে এলো। তবু ও বলল, “কিন্তু তোকে সবাই সন্দেহ করছে। তুই যদি সত্যিই নির্দোষ হোস, তাহলে এত গোপনীয়তার দরকার কী?” অভিরূপ উত্তর দিল, “কারণ যদি খোলাখুলি কিছু বলতাম, তবে মধুরিমাকে আটকানোর আয়োজন আরও শক্ত করে দেওয়া হতো। আমি চাইনি ওর উপর আরও চাপ পড়ুক।”
ঈশা যখন সেদিন বাড়ি ফিরল, তার ভেতরে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব চলছিল। একদিকে সবাই অভিরূপকে অভিযুক্ত করছে, তার চরিত্রহীনতা, লোভ, ষড়যন্ত্র—সবকিছু নিয়ে আলাপ করছে। অন্যদিকে অভিরূপের বলা কথাগুলো একেবারেই মিথ্যে মনে হচ্ছে না। মধুরিমার আতঙ্কিত চিঠি ঈশার চোখে ভাসছে। মেয়েটির হাসিখুশি মুখের আড়ালে কি সত্যিই এতটা দুঃসহ যন্ত্রণা লুকিয়ে ছিল? ঈশা জানে, পরের পদক্ষেপ হবে খুবই কঠিন। তাকে ঠিক করতে হবে—এটা কি প্রেমের টান, যেখানে অভিরূপ শুধুই সাহায্য করেছে? নাকি সবটাই নিখুঁতভাবে সাজানো ষড়যন্ত্র, যেখানে অভিরূপই আসল চালক? প্রশ্নগুলো মাথার ভেতর ধাক্কা মারতে লাগল, আর সেই রাত থেকে ঈশা ঠিক করল—সে সত্যের কাছে না পৌঁছানো পর্যন্ত থামবে না। কারণ এই রহস্য এখন আর শুধু মধুরিমার নিখোঁজ হওয়া নয়, বরং প্রেম আর ষড়যন্ত্রের মাঝখানে এক ভয়ঙ্কর দোলাচল।
৬
প্রাচীন সিংহ-রায় বাড়ির অন্ধকারাচ্ছন্ন করিডরে সেদিন সন্ধ্যায় এক অদ্ভুত গাম্ভীর্য ছড়িয়ে ছিল। জানালার কাঁচে বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ, বাইরে ঝড়ো হাওয়ার হাহাকার আর ভেতরে যেন এক চাপা উত্তেজনা। শুভায়ন সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে দিল, আর দীপ ম্যানেজার প্রভাত মুখার্জীর দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে রইল। প্রভাত, বয়সে প্রায় সত্তরের কাছাকাছি, পাকা চুল আর কুঁচকানো মুখে এখনও এক ধরণের দৃঢ়তার ছাপ আছে। তবে তার চোখে ভয়ের ছায়া স্পষ্ট। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে অবশেষে সে গলা নামিয়ে বলল, “সাহেবরা, এতদিন যা লুকিয়ে রেখেছিলাম, আর পারছি না। সত্যিটা বলতেই হবে।” তার কণ্ঠে কম্পন থাকলেও এক ধরণের স্থিরতা ছিল। সে বলতে শুরু করল, কীভাবে রূপেশ—বাড়ির ছোট ছেলে—বিগত কয়েক মাস ধরে বাড়ির পুরোনো দলিলপত্রে ডুবে থেকেছে। মাঝরাতে, সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর, প্রভাত তাকে প্রায়ই লাইব্রেরিতে দলিল আর নথি উল্টেপাল্টে দেখতে দেখেছে। সেগুলির মধ্যে ছিল জমি বিক্রির পুরোনো চুক্তিপত্র, বন্ধক দেওয়া বাড়ির খতিয়ান, এমনকি কলকাতার বিভিন্ন প্রভাবশালী মানুষের সঙ্গে গোপন চিঠিপত্রও। রূপেশ সবকিছু এমনভাবে ঘাঁটছিল যেন এক বিশাল ষড়যন্ত্রের ভিত গড়ে তুলছে। প্রভাতের কথায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, এটা নিছক কাগজপত্র পড়া নয়, এর পেছনে ছিল এক অন্ধকার উদ্দেশ্য।
প্রভাতের স্বীকারোক্তি শুনে দীপ হেলান দিয়ে চুপচাপ তার সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ঠোঁটে একটুকরো রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে তুলল। সে জানল, এই দলিলগুলো নিছক জমি বা সম্পত্তির বিষয় নয়, বরং এর পেছনে আরও গভীর জটিলতা লুকিয়ে আছে। প্রভাত বলল, একবার সে সাহস করে রূপেশকে জিজ্ঞাসা করেছিল, এত রাতে সে ঠিক কী করছে। তখন রূপেশ ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে উত্তর দিয়েছিল, “এই বাড়ির আসল ইতিহাস জানার দরকার আছে, প্রভাতকাকা। বাইরে যেটা সবাই দেখে, সেটা সত্য নয়।” সেই উত্তরে প্রভাতের গায়ে কাঁটা দিয়েছিল। এরপর থেকে সে আর কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস করেনি। কিন্তু যা দেখেছে, তা মনে গেঁথে গেছে। সে দেখেছে, রূপেশ গোপনে বাইরের কিছু অচেনা লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। মাঝেমধ্যেই বাড়ির পিছনের ছোট গেট দিয়ে তারা আসত, আর ভেতরে কয়েক ঘণ্টা বসে থাকত। তাদের চেহারায় একধরনের ভয়ানক কঠোরতা। প্রভাত বিশ্বাস করে, এরা কোনো সাধারণ ব্যবসায়ী নয়, বরং অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িত। তার কাছে মনে হয়েছিল, রূপেশ কিছু বড়সড় চুক্তি করছে, যা পুরো সিংহ-রায় পরিবারের উপর কালো ছায়া ফেলতে পারে।
শুভায়ন এইসব শুনে অস্থির হয়ে সোজা হয়ে বসল। সে দীপের দিকে তাকিয়ে বলল, “মানে, রূপেশ ইচ্ছে করেই সবকিছু পরিকল্পনা করছিল? তবে কি পরিবারের কারও ক্ষতি করার চেষ্টা করছে ও?” প্রভাত চুপ করে রইল কিছুক্ষণ, তারপর গলা নামিয়ে বলল, “আমি নিশ্চিত করে বলতে পারব না, তবে আমি দেখেছি ওর হাতে কয়েকবার বিদেশি মদের বোতল আর বড়সড় নগদের বান্ডিল। একবার তো খোলাখুলি ফোনে কাউকে বলছিল, ‘চুক্তি হয়ে গেছে, এখন শুধু কাগজে সই বাকি।’” প্রভাতের এই বয়ান যেন ঘরে জমে থাকা নীরবতার ওপর বজ্রাঘাত করল। দীপ এবার ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বাইরে মেঘের গর্জন হচ্ছিল, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। তার চোখে যেন আলোর ঝলকানি লেগে উঠল। সে বুঝতে পারল, রহস্যের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে রূপেশ—যে কেবল একটি পরিবারের অবাধ্য সন্তান নয়, বরং এক অদৃশ্য জালের সক্রিয় অংশীদার। প্রভাতের স্বীকারোক্তি অনেক প্রশ্নের উত্তর দিলেও, আরও অনেক অজানা রহস্য তৈরি করে গেল।
এই স্বীকারোক্তির পর পরিবেশ আরও ভারী হয়ে উঠল। শুভায়ন নার্ভাসভাবে আবার সিগারেট ধরাল, আর প্রভাত নিজের কপাল মুছতে লাগল। তার চোখে জল ভরে উঠেছিল, যেন সে নিজের কর্তব্য আর অপরাধবোধের ভারে চূর্ণ হয়ে পড়েছে। সে কাঁপা কণ্ঠে বলল, “বাবু, আমি সারা জীবন এই বাড়ির প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এই বাড়ির দেয়ালের ভেতর এমন অন্ধকার লুকিয়ে আছে যা আমার পক্ষে একা সামলানো সম্ভব নয়।” দীপ ধীরে ধীরে তার দিকে ফিরে তাকাল। তার গলায় শীতল দৃঢ়তা, “প্রভাতকাকা, আপনার এই তথ্য আমাদের জন্য অমূল্য। আপনি আজ সাহস করে যা বলেছেন, সেটাই হয়তো এই মামলার চাবিকাঠি হয়ে দাঁড়াবে।” কথাটা শুনে প্রভাত চোখ নামিয়ে নিল, কিন্তু তার শরীর কাঁপছিল। দীপ এবার নিজের মনে বলল, “খেলা আসলেই গভীরে ঢুকছে। রূপেশ শুধু উত্তরাধিকারীর লড়াই করছে না, এর পেছনে আরও অন্ধকার শক্তি আছে।” আর সেই অন্ধকার শক্তিকে সামনে আনার জন্যই এখন শুরু হবে প্রকৃত তদন্তের দ্বিতীয় অধ্যায়। ঘরের ভেতরে এক অদ্ভুত চাপা উত্তেজনা তৈরি হল—যেন ঝড়ের আগে গাঢ় নীরবতা। দীপ জানল, ঝড় আসতে দেরি নেই।
৭
বাড়ির গ্রন্থাগারের গাঢ় অন্ধকারে ঢুকে পড়েছিল ঈশা। জানালার বাইরে রাতের আকাশে ঝড়ো হাওয়া গর্জন করছিল, মাঝে মাঝে বজ্রপাতের আলো বইয়ের তাকগুলোয় ছায়ার খেলা সৃষ্টি করছিল। ধুলো-ঢাকা তাকগুলোর গায়ে হাত বোলাতেই সে বুঝল বহু বছর ধরে এখানে কেউ প্রবেশ করেনি। তার মনে হচ্ছিল এ ঘরেই লুকিয়ে আছে সেই গোপন সত্য, যার খোঁজে সে এতদিন অস্থির হয়ে উঠেছিল। কাঠের ভারী আলমারির ভেতরে থাকা দলিলপত্রগুলো বের করে একে একে পড়তে গিয়ে ঈশার কপালে ঘাম জমল। কাগজের গন্ধ, শ্যাওলার দাগ আর অক্ষরের বিবর্ণতা যেন সময়ের সাক্ষ্য বহন করছিল। হঠাৎই একটি হলুদ হয়ে যাওয়া নথি চোখে পড়ল—চওড়া কালো কালি দিয়ে লেখা কয়েকটি বাক্য, যেখানে স্পষ্ট করে বলা ছিল, মধুরিমাই বাড়ির একমাত্র বৈধ উত্তরাধিকারী। কিন্তু সেই সাথে দলিলের শেষে এমন একটি শর্ত লেখা ছিল যা ঈশাকে স্তম্ভিত করে দেয়—“যদি মধুরিমা নিখোঁজ হন বা মৃত্যুবরণ করেন, তবে সমস্ত সম্পত্তি স্বয়ংক্রিয়ভাবে রূপেশের হাতে চলে যাবে।”
ঈশার মনের ভেতর তোলপাড় শুরু হলো। এতদিন যেসব অদ্ভুত ঘটনাকে সে কেবল কাকতালীয় ভেবেছিল, হঠাৎই সবগুলো এক সূত্রে গেঁথে যেতে লাগল। মধুরিমার হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, রূপেশের অস্বাভাবিক আগ্রহ আর বারবার তার উপর অদ্ভুত চাপ সৃষ্টি করা—সব যেন এই দলিলের রহস্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ঈশা টেবিলের ওপর দলিলটি রেখে গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগল। মধুরিমা হয়তো সত্যিই বিপদের মধ্যে পড়েছেন, আর সেই বিপদের পিছনে রূপেশের হাত থাকার সম্ভাবনা ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠছিল। চারদিকের নীরবতায় শুধু বইয়ের পাতা উল্টোনোর শব্দ শোনা যাচ্ছিল, যেন গ্রন্থাগার নিজেই তার কাছে গোপন কথা ফিসফিস করে বলছে। ঈশার বুকের ভেতর ধকধক শব্দ হচ্ছিল, তবু সে কাগজগুলো গুছিয়ে নিয়ে সাবধানে ব্যাগে ভরে ফেলল—কারণ এগুলোই হতে পারে সত্য উদ্ঘাটনের চাবিকাঠি।
কিন্তু দলিল হাতে পাওয়ার সাথে সাথেই তার মনে এক ভয়ানক প্রশ্ন ভেসে উঠল—এখন যদি রূপেশ বুঝে যায় যে সত্যিটা সে জেনে ফেলেছে, তবে কি সে ঈশাকেও মধুরিমার মতো অদৃশ্য করে দেবে? এই ভাবনায় তার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। গ্রন্থাগার থেকে বেরোনোর পথে সে বারবার দরজার বাইরে তাকাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল কেউ যেন অন্ধকারের আড়াল থেকে তাকে নজর করছে। ঘরের প্রতিটি কড়ির শব্দ, প্রতিটি পর্দার নড়াচড়া যেন আতঙ্ক বাড়িয়ে তুলছিল। ঈশা জানত এখন তার একমাত্র কাজ হলো এই দলিল নিরাপদে পৌঁছে দেওয়া, এমন কারও হাতে, যে সত্য প্রকাশ করতে পারবে। হয়তো পুলিশের কাছে যাওয়া দরকার, অথবা কোনো নির্ভরযোগ্য বন্ধুর কাছে—কিন্তু কাকে বিশ্বাস করা যায়? এই বাড়িতে প্রতিটি মুখেই যেন কোনো না কোনো ছদ্মবেশ লুকিয়ে আছে।
রাত গভীর হয়ে এলে ঈশা তার ঘরে ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে বসে রইল। আলো নিভিয়ে মোমবাতির ক্ষীণ আলোয় আবার দলিলগুলো খুঁটিয়ে পড়তে লাগল। প্রতিটি অক্ষর যেন তাকে নতুন করে কাঁপিয়ে তুলছিল। সে বুঝতে পারছিল এই নথিই প্রমাণ করতে পারে যে মধুরিমা শুধুই কোনো হারিয়ে যাওয়া মানুষ নন, বরং এক বিশাল ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু। আর রূপেশের সমস্ত লোভ-লালসার নেপথ্যে এই দলিলই মূল কারণ। মোমবাতির আলো নিভে এলে ঈশা জানালার দিকে তাকাল—ঝড় তখনও থামেনি। দূরের বজ্রপাত তার মনে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা এনে দিল। সে জানল, যাই হোক না কেন, তাকে এই সত্য প্রকাশ করতেই হবে। আর এই দলিলই হবে সেই অস্ত্র, যা রূপেশের সমস্ত মুখোশ খুলে দেবে। তবে তার আগে বেঁচে থাকা জরুরি, কারণ অন্ধকারে শিকারি সবসময় কাছেই থাকে।
৮
ঈশা বুঝতে পারছিল, তার তদন্ত যত গভীরে প্রবেশ করছে, অজানা এক অন্ধকার ছায়া ততই তাকে ঘিরে ধরছে। হাসপাতালের পুরোনো নথি, শালিমার ইয়ার্ডের কনটেইনারে পাওয়া দেহ, আর সেই ২০৪০ সালের মেডিকেল রিপোর্ট—সবকিছুর মধ্যে যেন এমন কিছু গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে যা প্রকাশ পাওয়ার আগেই কেউ তা মুছে দিতে চাইছে। রাতের শহরে একা ফেরার পথে সে বারবার অনুভব করছে, কেউ যেন তার পেছনে পা টিপে টিপে হাঁটছে। প্রথম দিন সে ভেবেছিল এটা কাকতালীয়, হয়তো কল্পনা মাত্র। কিন্তু টানা তিনদিন ধরে একই ঘটনা ঘটায় ঈশা আর নির্ভুলভাবে বুঝতে ভুল করল না। কানে যেন ভেসে আসছিল শিসের মতো হাওয়া কেটে যাওয়ার শব্দ, গাড়ির হেডলাইট নিভে হঠাৎ আবার জ্বলে ওঠা, কিংবা একেবারে নির্জন গলিতে অচেনা মানুষের চোখে ঠান্ডা দৃষ্টি—সবকিছুই তাকে অদ্ভুত সঙ্কেত দিচ্ছিল। তবু ঈশা পিছিয়ে আসার মেয়ে নয়। সত্যের কাছে পৌঁছনো ছাড়া তার লক্ষ্য পূর্ণ হবে না, আর এই কেসের পেছনে কে বা কারা জড়িত, কেন এত বছর পর লাশের সঙ্গে ভবিষ্যতের নথি জুড়ে দেওয়া হলো—এই প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত তার শান্তি নেই।
হুমকি প্রথম স্পষ্ট রূপ নেয় এক অচেনা ফোনকলের মাধ্যমে। গভীর রাতে ফোন বেজে উঠল, অপর প্রান্ত থেকে ভারী ও কৃত্রিমভাবে বদলানো এক কণ্ঠ বলল—“তুমি যা খুঁজছো তা তোমার জন্য নয়, ঈশা। যদি জীবন ভালোবাসো, তবে এখানেই থেমে যাও।” কল শেষ হওয়ার পর ফোনের স্ক্রিনে এক মুহূর্তের জন্য ঝলসে উঠল এক অদ্ভুত কোড—যেন কোনও ডিজিটাল সিগন্যাল, যা স্রেফ ভয় দেখানোর জন্য নয়, বরং প্রযুক্তির মাধ্যমে নজরদারির ইঙ্গিত। ঈশা ঠান্ডা মাথায় বারবার বার্তাটি বিশ্লেষণ করতে লাগল। সে জানত, এই ফোনকল কেবল শুরু মাত্র। পরদিন অফিস থেকে ফেরার পথে হঠাৎ দু’জন হুডি পরা লোক তার গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। এক জন জানালা ঠুকরে কষে বলল—“তদন্ত বন্ধ করো, না হলে তোমার নামও হয়তো পরের কনটেইনারে লেখা থাকবে।” তারা তড়িঘড়ি অদৃশ্য হয়ে গেল ভিড়ের মধ্যে, কিন্তু ঈশার চোখে তাদের ঠান্ডা হুমকির ছাপ স্পষ্ট থেকে গেল। শহরের ব্যস্ততা আর চিৎকার-চেঁচামেচির মধ্যে লুকোনো এই গোপন সতর্কবার্তা যেন তার প্রতিটি শিরায় ছড়িয়ে পড়ল, তবু তার মন শক্ত হয়ে উঠল—কারণ ভয়ই তো প্রমাণ করছে যে সে সঠিক পথে হাঁটছে।
হুমকির ঘনঘটা যত বাড়ছিল, ঈশা ততই তদন্তে ঝুঁকছিল অদম্য একাগ্রতায়। সে পুরোনো হাসপাতালের আর্কাইভে খুঁজতে লাগল, ফাইল, ডকুমেন্ট, এমনকি ধূলোমলিন রেজিস্টার—যা থেকে জানা গেল কিছু রোগী রহস্যজনকভাবে “হারিয়ে গেছে” বহু বছর আগে। তাদের নাম আর বর্তমান অস্তিত্বের মধ্যে কোনও যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। আশ্চর্যের বিষয়, সেইসব রোগীদের কয়েকজনের চিকিৎসা রেকর্ডে ২০৪০ সালের মতো ভবিষ্যতের তারিখ জড়িয়ে রয়েছে। এর মানে, কেউ বা কারা এমন এক প্রকল্প চালাচ্ছে, যেখানে সময়কেই যেন বিকৃত করে ফেলা হচ্ছে। ঈশার সামনে স্পষ্ট হলো, শুধু খুন নয়, এর মধ্যে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, আর এক ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র মিশে আছে। কিন্তু এরই মধ্যে চাপও বেড়ে গেল বহুগুণে। অচেনা গাড়ি তার বাড়ির সামনে ঘুরতে লাগল, সোশ্যাল মিডিয়ায় হ্যাকিং করে তার ছবির নিচে লেখা হলো—“শিগগিরই তোমাকে সবাই মনে রাখবে।” প্রতিদিনের জীবন যেন পরিণত হলো এক দুঃস্বপ্নে। তবে যতই অন্ধকার তাকে গ্রাস করতে চাইছিল, ততই ঈশার সংকল্প দৃঢ় হচ্ছিল। সে জানত, যে শক্তি এত বড় ঝুঁকি নিয়ে হুমকি দিচ্ছে, তাকে ভয় না দেখিয়ে বরং সত্য থেকে আড়াল করতেই চাইছে।
অবশেষে এক রাতে ঈশা নিজেকে সামলে সিদ্ধান্ত নিল, ভয় পেয়ে থেমে থাকলে চলবে না। সে সিগারেট ধরাল জানলার পাশে দাঁড়িয়ে, ধোঁয়ার কুণ্ডলী যেন অন্ধকার রাতের মধ্যে এক অদৃশ্য প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠল। তার চোখে ভেসে উঠল মায়ের হাসি, পিতার স্মৃতি, আর শৈশবের সেই শিক্ষার কথা—“সত্যের জন্য লড়তে হয়, যতই বিপদ আসুক।” সেই মুহূর্তে ঈশা বুঝল, হুমকি কেবল তাকে ভাঙার জন্য দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু সে যদি লড়ে যায়, তবে এই খেলায় জয় তারই হবে। নিজের নোটবুক খুলে সে নতুন করে প্ল্যান সাজাল—কার সঙ্গে দেখা করতে হবে, কোথায় গিয়ে অনুসন্ধান চালাতে হবে, আর কাদের প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। রাত যত গভীর হচ্ছিল, ঈশার মধ্যে ততই এক নতুন আগুন জ্বলে উঠছিল। সে জানত সামনে আরও কঠিন পথ অপেক্ষা করছে, হয়তো আরও প্রাণঘাতী হুমকি আসবে, কিন্তু পিছু হটার সুযোগ তার নেই। কারণ এখন তার তদন্ত কেবল একটি লাশের রহস্য উন্মোচনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি এক বিশাল ষড়যন্ত্র উন্মোচনের লড়াই—যেখানে নিজের জীবন বাজি রেখেই তাকে এগোতে হবে।
৯
ঈশার হাতে ধরা ছোট্ট একটি ডায়েরি যেন এই মামলার গতিপথ পাল্টে দিল। বহুদিন ধরে জট পাকানো ঘটনাগুলো একে একে স্পষ্ট হতে শুরু করল। ইন্সপেক্টর জয়ন্তর সামনে দাঁড়িয়ে ঈশা কণ্ঠে দৃঢ়তা নিয়ে বলল, “স্যার, এটাই সেই আসল প্রমাণ। এই ডায়েরিতে মধুরিমার আতঙ্ক, তার সন্দেহ, এমনকি তাকে কীভাবে ঘরের বাইরে যেতে দেওয়া হতো না—সবই লেখা আছে।” জয়ন্ত চোখ নামিয়ে ডায়েরির পাতাগুলো পড়তে লাগলেন। শব্দগুলোর মধ্যে ফুটে উঠছিল এক বন্দি নারীর দুঃখ, এক অনাগত সত্যের কাহিনি। এই মুহূর্তে উপস্থিত সবাই একধরনের অদ্ভুত নীরবতায় নিমগ্ন হয়ে পড়েছিল। প্রভাত ধীর কণ্ঠে বলল, “আমি চোখে দেখেছি, মধুরিমাদি অনেকবার বাইরে যেতে চাইতেন, কিন্তু তাঁকে আটকে দেওয়া হতো। ওঁর চিৎকার, কান্না, সবই আমি শুনেছি।” এই স্বীকারোক্তি যেন মামলার ভিত্তিকে আরো দৃঢ় করে দিল। জয়ন্ত গম্ভীরভাবে মাথা নাড়িয়ে বললেন, “এবার আর কোনো সন্দেহ নেই, সত্যের জাল ভেদ করে আলোর সামনে আসছে আসল অপরাধী।”
অভিরূপ তখন এগিয়ে এল। এতদিন নীরব থাকা ছেলেটি এবার সাহস সঞ্চয় করল। তার হাতে একটি পেনড্রাইভ, যেখানে রূপেশের একাধিক আর্থিক লেনদেনের প্রমাণ মজুত। অভিরূপ বলল, “আমার বাবা একেবারেই জানতেন না রূপেশ কাকা কী করছেন। তিনি শুধু পারিবারিক ব্যবসার নাম ব্যবহার করে একের পর এক ফাঁকিবাজি চালাতেন। এখানে তাঁর সমস্ত নথি আছে।” পেনড্রাইভটি কম্পিউটারে লাগাতেই খুলে গেল অসংখ্য ডকুমেন্ট, যেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল—রূপেশ ধীরে ধীরে উত্তরাধিকারের পুরো সম্পত্তি নিজের নামে করে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। মধুরিমা ছিলেন এই খেলার সবচেয়ে বড় অন্তরায়। আর তাই তাঁকে নিঃশব্দে অদৃশ্য করে দেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছিল। ঈশা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রতিটি কাগজের দিকে তাকাল, তার চোখে যেন একটা আগুন জ্বলছিল। সে বলল, “এখন বোঝা যাচ্ছে কেন তাঁকে জোর করে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। মৃত্যুর আড়ালে নয়, জীবন্ত অবস্থাতেই কারাগারে বন্দি ছিলেন তিনি।” জয়ন্তর কণ্ঠে তখনো সেই দৃঢ়তা, “এবার আইনই দেবে রূপেশকে প্রাপ্য শাস্তি।”
ঘরে তখন উত্তেজনা চরমে। ঈশা নিজের ভেতরের সমস্ত শঙ্কা ঝেড়ে ফেলে জয়ন্তর দিকে তাকাল। এতদিন ধরে যে রহস্য তাকে তাড়া করছিল, আজ তার সমাধান মিলছে। প্রভাতের চোখ ভিজে উঠেছে, সে বলল, “আমি যদি আগে সাহস করে বলতাম, হয়তো দিদিকে এত কষ্ট ভোগ করতে হতো না।” ঈশা শান্ত কণ্ঠে বলল, “ভয়ই সবচেয়ে বড় শত্রু, প্রভাত। কিন্তু তুমি আজ সত্য প্রকাশ করেছ, এটাই সবচেয়ে বড় বিষয়।” অভিরূপও দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলল, “আমি পরিবারকেই বিশ্বাসঘাতকতা করতে বাধ্য হয়েছি, কারণ সত্যের কাছে রক্তের সম্পর্কও ছোট।” এই কথাগুলো ঘরের ভেতরে এমন এক ভারি পরিবেশ তৈরি করল, যা উপস্থিত প্রত্যেককে স্পর্শ করল। জয়ন্ত সবার কথা শুনে চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর ধীর কণ্ঠে বললেন, “এখন সময় এসেছে অভিযুক্তকে আইনের হাতে তুলে দেওয়ার।”
রূপেশকে সামনে আনার মুহূর্ত যেন এক নাটকীয় দৃশ্য। তাঁকে ঘিরে পুলিশের নজরদারি, চারপাশে সাক্ষীদের উপস্থিতি। ঈশা এগিয়ে এসে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “আপনি ভেবেছিলেন, সত্য চিরকাল আড়ালে লুকিয়ে থাকবে। কিন্তু মধুরিমা দেবীর যন্ত্রণা, তাঁর ডায়েরির অক্ষর, প্রভাতের চোখে দেখা ঘটনাগুলো আর অভিরূপের সাহস—সবকিছুই আজ প্রমাণ করছে আপনি দোষী।” রূপেশ প্রথমে পাল্টা তর্ক করার চেষ্টা করল, কিন্তু প্রমাণের ভারে তার কণ্ঠ ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে এল। জয়ন্ত ঘোষণা করলেন, “রূপেশ সিংহ, আপনাকে আইনের নামে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। উত্তরাধিকার নিজের কুক্ষিগত করার জন্য একজন মানুষকে জীবন্ত বন্দি রাখা—এ অপরাধের কোনো ক্ষমা নেই।” উপস্থিত সকলের মনে তখন এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি—সত্য উদ্ঘাটনের আনন্দ, কিন্তু সেইসঙ্গে দীর্ঘদিনের অমানবিকতার যন্ত্রণা। ঈশার মনে যেন নতুন এক দৃঢ় বিশ্বাস জন্ম নিল—অন্ধকার যত গভীরই হোক, একদিন সত্যই আলো হয়ে ফিরে আসে।
১০
শেষ পর্যন্ত পুলিশের দীর্ঘ অভিযান যেন এক নাটকীয় সমাপ্তি এনে দিল। কলকাতার উপকণ্ঠে একটি ভাড়া করা বাড়িতে বহুদিন ধরে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল মধুরিমাকে। খবর পেয়ে বিশেষ টিম সেখানে হানা দেয়। ভেতরে ঢুকেই চোখে পড়ে আঁধার ঘরে এক মেয়ে—ভয়ে, অশ্রুতে, ক্লান্তিতে প্রায় নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল। সেই মেয়েই মধুরিমা। তার নিস্তেজ চোখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট হলেও মুক্তির আশা যেন ক্ষীণ আলোর মতো জ্বলজ্বল করছিল। পুলিশের ঝটিকা অভিযানে মুহূর্তের মধ্যেই ভেঙে পড়ে রূপেশের সমস্ত প্রতিরক্ষা। লোকচক্ষুর আড়ালে কতটা হিসেবি, কতটা নৃশংস খেলা চালাচ্ছিল সে, তা প্রকাশ্যে এলো। তাকে গ্রেপ্তার করার সময়ও রূপেশের চোখে ছিল এক অদ্ভুত উন্মাদনা—যেন সে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিশ্বাস করছিল, ক্ষমতার জোরে সব আড়াল করা সম্ভব। কিন্তু সেদিন ভাগ্য আর সমাজ—দুটোই তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। মধুরিমার মুক্তির মুহূর্তে উপস্থিত প্রত্যেক পুলিশ অফিসারের চোখে এক অদৃশ্য স্বস্তি ছিল, কারণ তারা জানত, এক তরুণীর জীবনকে অন্ধকার থেকে ফিরিয়ে আনা মানে শুধুই একটি পরিবারকে নয়, একটি সমাজকেও বাঁচানো।
অরিন্দম যখন খবর পেলেন যে মধুরিমাকে পাওয়া গেছে, তখন তার বুকের ভেতরে জমে থাকা দীর্ঘদিনের আতঙ্ক এক নিমেষে ভেঙে পড়ে। হাসপাতালে ছুটে গিয়ে তিনি যখন কন্যাকে বুকে টেনে নিলেন, তখন সেই দৃশ্য যেন সমগ্র উপস্থিত জনতার মনে চিরস্মরণীয় হয়ে রইল। মধুরিমা কাঁদছিল, আর অরিন্দম বারবার বলছিলেন, “তুই আবার আমার কাছে ফিরে এলি, বাবা।” চারপাশে শূন্যতা ভেদ করে যেন পিতৃস্নেহের উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ল। শুভায়ন, যিনি অরিন্দমের পাশে সারাক্ষণ ছিলেন, নিঃশব্দে সিগারেট ধরালেন আর চোখের জল আড়াল করতে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। সেই মুহূর্তে তাদের বুঝতে আর বাকি রইল না—সত্যকে যতই চেপে রাখা হোক না কেন, সততার ওপর ভরসা রাখলে তা অবশেষে জয়ী হয়। আর মধুরিমার হাসির ঝলক, অশ্রুসিক্ত হলেও, যেন প্রতীক হয়ে উঠল জীবনের জয়যাত্রার। এই মুহূর্ত শুধু একজন বাবার জন্য নয়, সমগ্র মানবসমাজের জন্যও যেন এক নতুন বার্তা দিল—যে পরিবার হারাতে বসেছিল আশা, তারা ফিরে পেল তাদের প্রিয়তম ধন।
রূপেশের গ্রেপ্তারের পর সমাজে আলোচনার ঝড় উঠল। যিনি এতদিন নিজের ক্ষমতা, টাকার জোর, আর প্রভাব খাটিয়ে মানুষকে ভয় দেখিয়ে এসেছেন, তিনিই আজ আইনের ফাঁদে আটক। তার মুখোশ খুলে গেল, প্রকাশ পেল আসল রূপ—লোভ, প্রতারণা, আর নির্মমতার। চারপাশের মানুষ বুঝল, যতই ক্ষমতা থাকুক না কেন, অন্যায় চিরকাল টিকতে পারে না। আদালতে রূপেশকে নিয়ে যাওয়া হলে মিডিয়ার ক্যামেরা ঝলসে উঠল, সংবাদপত্রের শিরোনামে ছড়িয়ে পড়ল খবর। সমাজের প্রভাবশালী মহলও কেঁপে উঠল, কারণ তারা বুঝল, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে এক নতুন দৃষ্টান্ত গড়ে গেল। মানুষ আর চুপ করে থাকল না, বরং তারা বিশ্বাস করতে শুরু করল যে ন্যায়বিচারের আলো একদিন না একদিন ফুটবেই। সেই আলো হয়তো দেরিতে আসে, কিন্তু আসে নিশ্চিতভাবে।
অবশেষে আদালতের রায়ে অরিন্দম কেবল কন্যাকে ফিরে পেলেন না, ফিরে পেলেন নিজের সম্মান, নিজের উত্তরাধিকার। তাঁর লড়াই প্রমাণ করল, সততা কখনো ভাঙে না, তা পরীক্ষায় পড়ে আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মধুরিমা ধীরে ধীরে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে লাগল—কিন্তু এই ঘটনা তার ভেতরে এক দৃঢ় মানসিকতা তৈরি করল। সে ঠিক করল, জীবনে আর কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নোয়াবে না। অরিন্দম তাঁর মেয়েকে দেখে বুঝলেন, প্রকৃত উত্তরাধিকার আসলে টাকার, জমিজমার, ক্ষমতার নয়—বরং সত্য আর সাহসের। সমাজে ছড়িয়ে পড়ল সেই শিক্ষা। মানুষ বলাবলি করতে লাগল, “অরিন্দমবাবু দেখালেন, অন্যায় যতই শক্তিশালী হোক, ন্যায় একদিন না একদিন জয়ী হবেই।” আর এই ঘটনার পর কলকাতার অলিগলি, শালিমারের ইয়ার্ড, কিংবা সাধারণ মানুষের আড্ডায়—সব জায়গায় একটি বাক্যই ঘুরতে লাগল: সত্য যতই চাপা থাকুক, একদিন তা ভোরের আলোয় প্রকাশ হবেই।
সমাপ্ত
				
	

	


