Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

অদম্য

Spread the love

নিবেদিতা বসু


অনন্যার শৈশবটা অন্য সবার থেকে আলাদা ছিল। যেখানে বেশিরভাগ মেয়েরা পুতুল সাজাতে, রান্নাবান্না খেলতে কিংবা চকচকে চুলের ফিতেতে মেতে থাকে, সেখানে অনন্যার চোখ জ্বলে উঠত ব্যাট-বলের নাম শুনলেই। পাঁচ-ছয় বছর বয়স থেকেই তার খেলার সঙ্গী ছিল পাশের গলির ছেলেরা। তারা যখন ক্রিকেট খেলতে মাঠে নামত, অনন্যা কাঁধের ব্যাট ঝুলিয়ে দৌড়ে যেত। প্রথমে ছেলেরা তাকে নিতেই চাইত না, “মেয়েরা খেলতে পারে নাকি?”—এমন ঠাট্টা-বিদ্রুপ হতো নিয়মিত। কিন্তু অনন্যার চোখে এক অদ্ভুত জেদ ছিল, যেন প্রতিটি অবহেলার উত্তর সে ব্যাটের শব্দে দিতে চায়। খেলার সুযোগ না পেলেও সে গলি মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে সবার খেলা দেখত। কারও ব্যাটিং ভেঙে পড়লে, কারও শট মিস হলে তার মনে হতো—“আমি হলে এভাবে খেলতাম না, আমি ভালো করতে পারতাম।” এই বিশ্বাস থেকেই জন্ম নিল তার প্রথম স্বপ্ন—একদিন সবার স্বীকৃতি পাওয়া, নিজের হাতে খেলার জগতে নাম তৈরি করা।

বাড়ির ভেতরে অবশ্য এই খেলাধুলা একেবারেই প্রশ্রয় পেত না। মা কাবেরী মাঝে মাঝে হেসে বলতেন, “এত ছেলে-ছোকরার সাথে মাঠে দৌড়াদৌড়ি করে কী হবে? পুতুল খেলো, পড়াশোনা করো।” বাবা অরিন্দম ছিলেন আরও কঠোর; তিনি মনে করতেন মেয়ে হয়ে রোদে-জলে মাঠে নেমে খেলাধুলা মানে লজ্জার ব্যাপার। তবে এসব কথায় অনন্যা দমে যেত না। অল্প বয়সেই সে বুঝতে শিখেছিল—স্বপ্ন সবসময় সহজ পথে পাওয়া যায় না। তাই ঘরের ভেতরে কেউ সমর্থন না দিলেও, গলির মাঠ ছিল তার মুক্তির জায়গা। ছোট্ট ব্যাটটা হাতে পেলেই যেন পৃথিবীর সব দুঃখ-অবহেলা ভুলে যেত। ধুলোয় ভরা মাঠ, কোলাহলমুখর গলি আর ছেলেদের হাসিঠাট্টার ভিড়ে সে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে নিত। তার প্রতিটি শটের শব্দে বুক ভরে যেত এক ধরনের অদম্য আত্মবিশ্বাসে, যেন সেই ছোট্ট মাঠটাই একদিন তাকে নিয়ে যাবে অনেক দূর, যেখানে তার কণ্ঠস্বর আর স্বপ্ন কেউ উপেক্ষা করতে পারবে না।

তবে সমাজের চোখ সবসময় সহজ ছিল না। প্রতিবেশীরা প্রায়ই কটাক্ষ করত—“মেয়ে মানুষ হয়ে ছেলেদের সাথে খেলছে! কালকে পড়াশোনায় ফেল করবে, তারপর বিয়ের বয়স হলে এইসব খেলা দিয়ে কি সংসার চলবে?” অনন্যা এসব কথা শুনলেও মুখে কিছু বলত না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার স্বপ্ন আরও দৃঢ় হয়ে উঠত। যখন অন্য মেয়েরা নতুন জামা বা পুতুল নিয়ে উৎসাহিত হতো, অনন্যার চোখ জ্বলজ্বল করত ক্রিকেট বলের চকচকে চামড়া দেখে। সেই বয়সেই সে স্বপ্ন দেখতে শিখল—একদিন শুধু গলির খেলোয়াড় নয়, দেশের হয়ে খেলবে। তার কল্পনায় ভেসে উঠত বিশাল স্টেডিয়াম, আলো ঝলমলে গ্যালারি, আর হাজারো দর্শকের করতালিতে ঘেরা মঞ্চ। ছোট্ট অনন্যা বুঝত না সমাজ তাকে কতটা বাঁধা দেবে, কতটা হাসিঠাট্টা সইতে হবে, কিন্তু সে জানত—তার ছোট্ট ব্যাটটাই একদিন হবে স্বপ্নের সিঁড়ি। আর সেখান থেকেই শুরু হলো অনন্যার অদম্য যাত্রা, যা তাকে একদিন গলির মাঠ থেকে টেনে নিয়ে যাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মঞ্চে।

***

অরিন্দম সেন ছিলেন একেবারে মধ্যবিত্ত মানসিকতার মানুষ। প্রতিদিন সকালে অফিসে বেরোন, বিকেলে ক্লান্ত হয়ে ফেরেন, আর সংসারের হিসেব মেলাতে গিয়ে সারাক্ষণ অস্থির থাকেন। তার কাছে জীবন মানে নিরাপত্তা, স্থিরতা আর সামাজিক সম্মান। তাই যখন দেখেন ছোট মেয়ে অনন্যা গলির ছেলেদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলছে, রোদে পুড়ে কালো হয়ে যাচ্ছে, বইখাতা ফেলে বল-বাট হাতে ছুটে বেড়াচ্ছে—তখন তার ভেতরে এক অদ্ভুত ক্ষোভ জমে ওঠে। তিনি মনে করেন, মেয়ে হয়ে এসব খেলাধুলায় মেতে থাকা মানে সংসার থেকে বিচ্যুতি। মেয়ের ভবিষ্যৎ বলতে তিনি বোঝেন পরীক্ষায় ভালো ফল করা, উচ্চশিক্ষা নিয়ে একটা চাকরি পাওয়া, তারপর ভালো বাড়িতে বিয়ে হয়ে যাওয়া। তার চোখে ক্রিকেট কেবল সময় নষ্ট, আর সেটা মেয়ে মানুষ করলে আরও বড় অশান্তির কারণ। তাই অনন্যাকে প্রায়ই ধমক দিয়ে বলেন, “এতে কিছু হবে না, খেলা খেয়ে কেউ বাঁচে? তার উপর মেয়ে হয়ে মাঠে নামবি, সমাজ কি চুপ করে বসে থাকবে? পড়াশোনা কর, সংসারে মা’কে সাহায্য কর।” অরিন্দমের এই কঠিন কথাগুলো ছোট্ট অনন্যার মনে দাগ কাটলেও, সে কাউকে বোঝাতে পারত না তার অন্তরের আগুন কতটা তীব্র।

অন্যদিকে মা কাবেরী ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বভাবের। তিনি জানতেন তার মেয়ে অন্য সবার থেকে আলাদা। অনন্যার চোখে যে জেদ, যে স্বপ্নময় উচ্ছ্বাস তিনি দেখেছেন, তা সহজে উপেক্ষা করার নয়। তাই তিনি কখনো কখনো মেয়েকে খেলার মাঠে যেতে দেন, গোপনে খেলার জন্য কাপড় ধুয়ে দেন, এমনকি অল্প পয়সা জমিয়ে একটি নতুন বল কিনে দেন। কিন্তু তবু তিনি পুরোপুরি মুক্ত মনে অনন্যাকে খেলতে দিতে পারেন না। সংসারের চাপ তাকে শিকল পরিয়েছে। মাসের শেষে বাজারের খরচ মেলানো, বাচ্চাদের পড়াশোনার খরচ জোগানো, স্বামীর কড়া মনোভাব সহ্য করা—সব মিলিয়ে তার বুক ভরে থাকে দুশ্চিন্তায়। তিনি ভালো করেই জানেন সমাজ কীভাবে তাদের দিকে আঙুল তুলবে যদি মেয়ে ক্রিকেটে বেশি নামডাক করতে থাকে। তবুও যখন দেখেন মাঠ থেকে ফেরা অনন্যার চোখে ঝলমলে আনন্দ, তখন তার নিজের ভেতর দ্বন্দ্ব শুরু হয়। একদিকে তিনি চান মেয়েটির হাসি বজায় থাকুক, অন্যদিকে ভয় পান, হয়তো এই স্বপ্নটাই একদিন ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবে তাকে।

এই দুই মেরুর টানাপোড়েনের মাঝেই অনন্যার প্রতিদিনের জীবন চলতে থাকে। একদিকে বাবার তিরস্কার, অন্যদিকে মায়ের অর্ধেক সমর্থন, আর চারপাশের সমাজের বিদ্রুপ—সব মিলিয়ে যেন তাকে এক অনন্ত পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করায়। অনেক রাতেই সে চুপচাপ পড়ার টেবিলে বসে থাকে, বইয়ের পাতা সামনে খোলা, কিন্তু মন চলে যায় মাঠের দিকে। জানালার বাইরে অন্ধকার গলি দেখে কল্পনা করে নিজের ব্যাটের শটের শব্দ, নিজের জয়োল্লাস। তখনই ভেতরে ভেতরে সে প্রতিজ্ঞা করে—যা-ই হোক না কেন, সে ক্রিকেট ছাড়বে না। কিন্তু পর মুহূর্তেই বাবার কঠিন মুখ আর মায়ের নিরুপায় দৃষ্টি মনে পড়ে, আর বুকের ভেতর কেমন একটা শূন্যতা জন্মায়। তবুও সেই শূন্যতা ভরাট করে দেয় তার জেদ, তার বিশ্বাস—একদিন সে প্রমাণ করবেই যে ক্রিকেট শুধু ছেলেদের খেলা নয়, মেয়েরাও পারে মাঠে নিজেদের অধিকার কায়েম করতে। আর এই বিশ্বাসই তার শৈশবের দ্বিতীয় অধ্যায়কে পরিণত করে অন্তহীন টানাপোড়েনের গল্পে, যেখানে বাবার চোখে শঙ্কা আর মায়ের দ্বন্দ্ব তার স্বপ্নকে আরও দৃঢ় করে তুলতে থাকে।

***

সেদিনটা অনন্যার জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। কয়েক মাস ধরে সে গলির খেলায় নিজের দক্ষতা বাড়িয়েছে, আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে বড় মাঠে নামবে। অবশেষে স্থানীয় ক্লাবের খেলোয়াড় বাছাইয়ের দিন এলো। ব্যাটটা বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে অনন্যা মাঠে ঢুকতেই চারপাশে কেমন একটা গুঞ্জন উঠল। গ্যালারির এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু কিশোর হেসে উঠল—“এ আবার নতুন ঝামেলা, মেয়ে ক্রিকেট খেলবে!” মাঠের এক সিনিয়র খেলোয়াড় চোখ কুঁচকে তাকিয়ে বলল, “দেখিস, দুই বলে আউট হয়ে যাবে।” সেই কথায় সবাই হো-হো করে হেসে উঠল। অনন্যার কানে শব্দগুলো বাজতে থাকল, বুকের ভেতর চাপা কষ্ট জমতে লাগল, কিন্তু সে কাউকে উত্তর দিল না। বরং মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল, যেন ব্যাটই তার একমাত্র ভরসা। গলির মাঠের পর এটি তার প্রথম আসল সুযোগ, আর এই সুযোগ নষ্ট করলে হয়তো চিরদিন তাকে “মেয়ে” তকমার আড়ালে আটকে থাকতে হবে।

খেলা শুরু হলো। অনন্যাকে প্রথমে ফিল্ডিংয়ে দাঁড় করানো হলো, তাও এমন জায়গায় যেখানে খুব একটা বল আসবে না। অনেকটা যেন ইচ্ছে করেই তাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। তার চোখে পড়ল দলের ছেলেরা একে অপরকে কটাক্ষ করছে, কেউ কেউ বলছে, “এটা খেলোয়াড় নাকি বোঝা?” তবু সে থেমে থাকেনি। প্রতিটি বলে নজর রাখছিল, প্রতিটি রান গোনার মতো করে হিসেব করছিল। অবশেষে তার হাতে ব্যাট ধরার সুযোগ এলো। প্রথম বলে বোলার ইচ্ছে করেই শর্ট পিচ বল ছুড়ে দিল, যেন ভয় দেখাতে চায়। কিন্তু অনন্যা ভীত হলো না। দৃঢ় হাতে ব্যাট ঘোরাতেই বল সোজা গ্যালারির দিকে উড়ে গেল—একটি দারুণ বাউন্ডারি। মাঠে মুহূর্তের জন্য স্তব্ধতা নেমে এলো। যারা কিছুক্ষণ আগেও ঠাট্টা করছিল, তারাই এখন বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। কিন্তু অবজ্ঞার সুর তখনও পুরোপুরি মুছে যায়নি। এক সিনিয়র ফিসফিস করে বলল, “এটা ভাগ্য, বেশিক্ষণ টিকতে পারবে না।” অনন্যা তাদের কথায় কান দিল না। বরং প্রতিটি বলে নিজেকে প্রমাণ করার চেষ্টা চালিয়ে গেল, আর তার প্রতিটি শটে স্পষ্ট হয়ে উঠল—সে শুধু মেয়ে হয়ে খেলার জন্য মাঠে আসেনি, খেলতে এসেছে নিজের যোগ্যতা নিয়ে।

গ্যালারির এক কোণে দাঁড়িয়ে সবকিছু লক্ষ্য করছিলেন রাহুল বসু। বয়স চল্লিশের কোঠায়, শরীর চওড়া, চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। তিনি এই ক্লাবের প্রাক্তন খেলোয়াড়, এখন কোচ হিসেবে তরুণ প্রতিভা খুঁজে বের করা তার দায়িত্ব। অনন্যার প্রথমে অবহেলিত অবস্থান, তারপর দৃঢ়তায় ভরা ব্যাটিং দেখে তিনি বিস্মিত হলেন। তিনি বুঝলেন, এই মেয়েটির মধ্যে আলাদা কিছু আছে—অন্যদের বিদ্রুপ উপেক্ষা করার শক্তি, ব্যর্থ হলেও আবার লড়াই করার ইচ্ছা, আর সবচেয়ে বড় জিনিস, খেলাটাকে ভালোবাসার এক অদম্য তৃষ্ণা। খেলা শেষ হওয়ার পর মাঠে নামলেন তিনি। অনন্যাকে ডেকে বললেন, “তুই শুধু মেয়ে বলেই সবাই তোকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। কিন্তু আমি তোর মধ্যে প্রতিভা দেখছি। যদি সত্যি ক্রিকেট খেলতে চাস, তাহলে কঠোর অনুশীলনের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।” সেই মুহূর্তেই অনন্যার চোখ ভরে উঠল আলোয়। এতদিন সে কেবল উপহাস শুনেছে, তিরস্কার শুনেছে, কিন্তু প্রথমবার একজন অভিজ্ঞ কোচ তার স্বপ্নকে স্বীকৃতি দিলেন। অপমানের দিনটা তাই অনন্যার কাছে পরিণত হলো নতুন শক্তির সূচনায়, যেখানে প্রথমবার সে বুঝল—তার লড়াই কেবল সমাজ বা পরিবারের সঙ্গে নয়, বরং নিজের ভেতরের ভয়কে জয় করে স্বপ্নকে বাস্তব করার এক দীর্ঘ যাত্রা।

***

রাহুল বসুর অধীনে অনন্যার নতুন জীবনের সূচনা হলো। তার কাছে ক্রিকেট আর খেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল না, এটি হয়ে উঠল কঠোর শৃঙ্খলার এক অনন্য পাঠশালা। ভোরের অন্ধকার ভেদ করে প্রতিদিন সকাল পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠতে হতো তাকে। তখনও পাড়ার বাড়িগুলো ঘুমে আচ্ছন্ন, চারপাশ নিস্তব্ধ, কেবল শীতল হাওয়া আর পাখির ডাক মিলেমিশে এক ভোরের আবহ তৈরি করে। সেই সময়েই অনন্যা ব্যাগ কাঁধে তুলে মাঠের পথে বেরিয়ে পড়ত। প্রথম দিনগুলো ছিল অত্যন্ত কষ্টকর। শরীর ভেঙে যেত, পা টনটন করত, হাতে ব্যথা জমে উঠত, শ্বাসকষ্টে বুক ধড়ফড় করত, তবু সে দম দিত না। রাহুল বসু তাকে শিখিয়েছিলেন, “শরীরের ব্যথা সাময়িক, কিন্তু খেলার প্রতি ভালোবাসা যদি সত্যি হয়, তবে কোনো ব্যথাই বাধা হতে পারে না।” এই কথাগুলো অনন্যার ভেতরে এক অদম্য শক্তি জাগিয়ে তুলত। প্রতিদিন ভোরের প্রথম আলোতে দৌড় শুরু করে, ঘামে ভিজে মাঠে ফিটনেস ট্রেনিং করা, এরপর ব্যাট-বল হাতে কঠোর অনুশীলন—এসবই তাকে ধীরে ধীরে নতুন রূপে গড়ে তুলতে লাগল।

কিন্তু এই পথ সহজ ছিল না। সমাজের চোখরাঙানি প্রতিদিন তাকে তাড়া করে ফিরত। সকালে মাঠের দিকে ছুটে যাওয়া দেখে প্রতিবেশীরা ফিসফিস করত, “এভাবে ছুটোছুটি করে কী হবে? মেয়েদের কাজ হলো সংসার সামলানো।” কেউ বিদ্রুপ করে বলত, “এ তো পড়াশোনা ছেড়ে খেলোয়াড় হতে চাইছে, পরে বিয়ে দেবে কোন বাড়ি?” এইসব তীর্যক কথাগুলো তার কানে বাজলেও সে উপেক্ষা করতে শিখেছিল। তবু ভেতরে ভেতরে আঘাত লাগত, কারণ তার স্বপ্নকে সবাই এত হালকাভাবে নিচ্ছিল। এমনকি বাড়িতেও বাবা অরিন্দম মাঝে মাঝে কঠিন কণ্ঠে বলে দিতেন, “এইসব খেলাধুলায় সময় নষ্ট করে পড়াশোনায় মন না দিলে জীবনে কিছুই হবে না।” মা কাবেরী অর্ধেক সমর্থন দিতেন, কিন্তু তিনিও প্রায়ই চিন্তিত হয়ে বলতেন, “শরীর ভেঙে ফেলিস না তো?” এই দ্বন্দ্ব আর চাপের মধ্যে থেকেও অনন্যা শুধু একটাই বিষয় আঁকড়ে ধরে বাঁচত—তার খেলার স্বপ্ন। প্রতিদিন সকালে মাঠে গিয়ে যখন সে ব্যাট হাতে দাঁড়াত, তখন যেন সমাজের সব কটূক্তি, বাবার শাসন, মায়ের শঙ্কা মিলিয়ে যেত। ব্যাট আর বলের শব্দ তার কাছে হয়ে উঠেছিল এক ধরনের মুক্তি, যেখানে সে নিজের প্রকৃত সত্ত্বা খুঁজে পেত।

ধীরে ধীরে অনন্যার শরীর বদলাতে শুরু করল। একসময় যে মেয়েটি একটু দৌড়ালেই হাঁপিয়ে যেত, সে এখন সহজেই কয়েক কিলোমিটার ছুটে যায়। একসময় যে হাত ক্লান্ত হয়ে ব্যাট ধরতে চাইত না, সেই হাতেই এখন শক্তি জমে উঠছে। রাহুল বসু প্রতিদিন তাকে নতুন কৌশল শেখাতেন—শট প্লেসমেন্ট, ফুটওয়ার্ক, বোলারের গতি বুঝে নেওয়া, ফিল্ডিংয়ের ক্ষিপ্রতা—সব কিছুতেই তিনি কঠোর ছিলেন। কখনো কখনো অনন্যা ক্লান্ত হয়ে মাটিতে বসে পড়ত, চোখে পানি চলে আসত, মনে হতো আর পারবে না। তখন রাহুল বসু সামনে দাঁড়িয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলতেন, “তুই যদি হাল ছেড়ে দিস, তবে যারা তোকে নিয়ে হাসাহাসি করছে তারা জিতবে। তুই খেলবি তাদের হারানোর জন্য, নাকি নিজের স্বপ্নের জন্য?” এই প্রশ্নগুলো অনন্যার রক্তে আগুন জ্বালিয়ে দিত। প্রতিদিনের অনুশীলন শুধু তার শরীরকে শক্ত করছিল না, তার মানসিকতাকেও ইস্পাতের মতো দৃঢ় করে তুলছিল। এখন আর ঠাট্টা-বিদ্রুপ তাকে ভেঙে দিতে পারে না, বরং প্রতিটি অপমানকে সে নিজের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করতে শিখেছে। আর সেখান থেকেই শুরু হলো তার প্রকৃত রূপান্তর—একজন স্বপ্নবাজ কিশোরী থেকে অদম্য খেলোয়াড় হয়ে ওঠার যাত্রা।

***

কঠোর অনুশীলনের দিনগুলোতে অনন্যা অনেক সময়েই ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ছিল। ভোরের ঠান্ডা হাওয়া, শরীরের ব্যথা, সমাজের বিদ্রুপ, বাবার রাগ—সব মিলে কখনো কখনো তার মনে হতো, এই লড়াই সে একা সামলাতে পারবে না। ঠিক সেই সময়েই তার জীবনে এল মীনা দত্ত। মীনা ছিল প্রাণচঞ্চল, হাসিখুশি আর মজার এক মেয়ে, যে একই ক্লাবে অনুশীলন করতে আসত। প্রথম পরিচয় হয় এক ভোরে, যখন অনন্যা ক্লান্ত হয়ে মাঠের এক কোণে বসে হাঁপাচ্ছিল। মীনা তখন এগিয়ে এসে হাসিমুখে বলল, “এই ব্যাটটা ধর, তোর মুখটা দেখে মনে হচ্ছে ব্যাটটাই তোর থেকে হালকা।” অনন্যা প্রথমে অবাক হলেও পরে হেসে ফেলল। সেই হাসিই যেন তাদের বন্ধুত্বের সূচনা। সেদিন থেকে মীনা হয়ে উঠল তার খেলার সঙ্গী, মনের সঙ্গী, আর এক কথায় আশ্রয়।

মীনার স্বভাব ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। সে সবসময়ই চনমনে, হাস্যরসিক, আর কখনোই কোনো কষ্টকে নিজের উপর চাপিয়ে রাখতে চাইত না। মাঠে দীর্ঘ অনুশীলনের সময় যখন সবাই ক্লান্ত হয়ে যেত, মীনা কোনো না কোনো মজার গল্প বলে সবাইকে হাসিয়ে তুলত। অনন্যার জন্য এই বিষয়টা ছিল বিশেষ। কারণ, যখন তার শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ত বা মন ভেঙে যেত, তখন মীনার হালকা রসিকতা তাকে আবার প্রাণবন্ত করে তুলত। একদিন অনন্যা একটি শট মিস করে হতাশ হয়ে মাঠের বাইরে গিয়ে বসে পড়েছিল। তখন মীনা এগিয়ে এসে বলল, “শটটা মিস করেছ বলে মন খারাপ করছ? আমার তো প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠলেই শট মিস হয়, মা বকাঝকা করে। তাই বলে কি আমি খেলা ছেড়ে দিয়েছি?” অনন্যা হাসতে হাসতে আবার ব্যাট হাতে নিয়েছিল। এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই তাদের বন্ধুত্বকে অটুট করেছিল। মীনা শুধু অনুশীলনের মাঠে নয়, মাঠের বাইরেও তার পাশে থাকত। অনন্যা যখন বাবার বকুনি বা সমাজের বিদ্রুপে মন খারাপ করত, তখন মীনা ফোন করে তাকে উজ্জীবিত করত, বলত—“তুই শুধু খেল, তোর নাম একদিন পত্রিকার শিরোনামে উঠবে।”

তাদের বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে হয়ে উঠল অনন্যার সবচেয়ে বড় শক্তি। একসময় যে অনন্যা ভেবেছিল লড়াইটা তাকে একাকী লড়তে হবে, মীনা তাকে বোঝাল—বন্ধু থাকলে লড়াইয়ের পথটা অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। অনুশীলনের দিনগুলোতে মীনা শুধু আনন্দের সঙ্গী ছিল না, প্রতিযোগিতার ময়দানেও সে অনন্যাকে মানসিকভাবে চ্যালেঞ্জ দিত। দু’জনের মধ্যে প্রায়ই হালকা প্রতিযোগিতা হতো—কে বেশি রান করবে, কে বেশি ভালো ফিল্ডিং করবে। কিন্তু সেই প্রতিযোগিতা কখনোই শত্রুতা তৈরি করেনি, বরং দু’জনকে আরও উন্নতির দিকে ঠেলে দিত। অনন্যা বুঝল, এই যাত্রা শুধু একার নয়, মীনার মতো বন্ধু থাকলে সংগ্রামটা সহজ হয়ে যায়। মীনা যেন তাকে শিখিয়ে দিয়েছিল—অদম্য হতে হলে শুধু জেদ নয়, হাসি-আনন্দও প্রয়োজন। তাই প্রতিটি কঠিন মুহূর্তে, প্রতিটি দুঃখে, অনন্যা ভরসা করত মীনাকে। এবং হয়তো সেই কারণেই, জীবনের ঝড়ঝাপটার মাঝেও অনন্যা নিজেকে সামলে রাখতে পারছিল, কারণ সে জানত—তার পাশে আছে এক সত্যিকারের বন্ধু, যে কেবল সতীর্থ নয়, বরং তার স্বপ্নযাত্রার সহযাত্রী।

***

অনুশীলনের মাঠে যতই অনন্যা নিজের ভেতরের শক্তি খুঁজে পাক না কেন, ঘরে ফিরে এলেই তাকে পড়তে হতো এক ভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রের মুখোমুখি। বাবা অরিন্দম প্রায়ই কঠোর গলায় বলে উঠতেন, “পড়াশোনায় মন দাও, খেলা ছেড়ে দাও। ক্রিকেট খেয়ে পেট ভরবে না। চাকরি ছাড়া জীবনে কোনো ভবিষ্যৎ নেই।” সেই কথাগুলো বারবার অনন্যার কানে ঘুরে বেড়াত। বাবা কখনো তার হাতে বই গুঁজে দিতেন, কখনো জোর করে টিউশনি ক্লাসে পাঠানোর চেষ্টা করতেন। অনন্যার পড়াশোনার ফল খারাপ ছিল না, কিন্তু ক্রিকেটের প্রতি টান তাকে বইয়ের পাতার বাইরে টেনে নিয়ে যেত। অরিন্দম যখন দেখতেন মেয়ে পড়াশোনার সময়টুকু নিয়েও খেলার মাঠে ছুটছে, তখন তার চোখে যেন হতাশার আগুন জ্বলে উঠত। তার ধারণা ছিল, অনন্যা পরিবারের সম্মান নষ্ট করছে, সমাজে তাদের নিয়ে কটাক্ষ বাড়াচ্ছে। বাবার এই দৃষ্টিভঙ্গি অনন্যার বুক ভেঙে দিত, কারণ সে চাইত—একটু বোঝাপড়া, সামান্য সমর্থন, হয়তো একটা আশ্বাস যে সে যা করছে তাতে ভুল নেই। কিন্তু বাবার মুখে সে কখনো এমন শব্দ খুঁজে পেত না।

মা কাবেরীর অবস্থানও সহজ ছিল না। সংসারের হিসাব মেলানো, বাজার-খরচ সামলানো, বিদ্যুতের বিল, স্কুলের ফি—সবকিছু তার কাঁধেই এসে পড়ে। তাই যখন দেখতেন অনন্যার জন্য বাড়তি খরচ হচ্ছে—নতুন ব্যাট, নতুন জুতো, ট্রেনিংয়ে যাওয়া-আসার ভাড়া—তখন তিনি কষ্টে বলে ফেলতেন, “তুই কি বুঝিস সংসার চালানো কত কঠিন? এত খরচ কই থেকে আসবে? আমরা তোকে পড়াশোনা করাতে গলা পর্যন্ত ঋণ করছি, এখন আবার খেলাধুলার বাড়তি চাপ?” মায়ের কণ্ঠে রাগ থাকলেও অনন্যা জানত এর ভেতরে আছে অসহায়ত্ব। অনেক রাতেই কাবেরী রান্নাঘরে বসে কাঁদতেন, কেবল কেউ শুনতে পেত না। অনন্যা মাঝে মাঝে সেই কান্না টের পেত, আর বুকের ভেতর অপরাধবোধে ভরে উঠত। তবু তার ভেতরের স্বপ্ন তাকে দমিয়ে রাখত না। সে জানত—মায়ের দুঃশ্চিন্তা বাস্তব, কিন্তু তার নিজের ভালোবাসাটাও সত্যি। মায়ের মুখের রাগী কথা তাকে আঘাত করলেও, ভেতরে ভেতরে সে বুঝত মা তাকে একেবারেই খেলতে নিষেধ করতে চান না, বরং শুধু ভয় পান ভবিষ্যতের জন্য।

এই দ্বন্দ্বে ভরা পরিবেশে অনন্যার দিন কাটত চোখের জলে ভিজে। অনেক রাতেই পড়ার টেবিলে বসে বই খুলে কেঁদে ফেলত, ভেবে যে তার পরিবার তাকে বুঝতে পারছে না। কখনো বাবার চিৎকারে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিত, আবার কখনো মায়ের কঠিন কথায় মনে হতো সব ছেড়ে দেবে। কিন্তু প্রতিবারই কান্নার ফাঁকে মনে পড়ত সেই মাঠের মুহূর্তগুলো—ব্যাটে বল লাগার শব্দ, কোচ রাহুলের দৃঢ় কণ্ঠ, মীনার হাসি। তখন সে নিজেকে সামলে নিত, চোখের পানি মুছে আবার প্রতিজ্ঞা করত—“না, আমি হাল ছাড়ব না।” হয়তো বাবার চোখে সে এখনও অপরাধী, মায়ের চোখে সে এক অতিরিক্ত বোঝা, সমাজের চোখে সে বিদ্রুপের খোরাক, কিন্তু নিজের চোখে সে জানত—সে একজন যোদ্ধা। ঘরের ভেতরের এই প্রতিদিনের লড়াই তাকে ভেঙে দিচ্ছিল না, বরং আরও শক্ত করে তুলছিল। কারণ অনন্যা বুঝতে শিখেছিল—যে স্বপ্ন সত্যিই জীবনের, তার জন্য লড়াই কেবল মাঠেই হয় না, সবচেয়ে বড় লড়াই হয় ঘরের চার দেয়ালের ভেতরেই।

***

রাতটা যেন অনন্যার জন্য এক দীর্ঘ পরীক্ষা। ঘড়ির কাঁটা বারবার এগোচ্ছে, অথচ ঘুম যেন কোনোভাবেই আসছে না। বিছানায় শুয়ে থাকা অবস্থায় তার বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়ে যাচ্ছিল, যেন প্রতিটি মুহূর্তে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। নির্বাচনী ম্যাচটা শুধু একটা খেলা নয়, এটা যেন তার জীবনের সবচেয়ে বড় বাঁক। যদি এই ম্যাচে ভালো খেলে, তবে জাতীয় দলে তার নাম ঘোষণা হতে পারে। আর যদি ব্যর্থ হয়, তবে হয়তো বাবার কঠিন কথা চিরদিনের মতো সত্যি হয়ে দাঁড়াবে—“এতে কিছু হবে না।” মাথার ভেতর একটার পর একটা চিন্তা আসছিল—সমাজের ঠাট্টা, মায়ের নীরব দৃষ্টি, বাবার রাগী মুখ, কোচ রাহুলের প্রত্যাশা। অনন্যা বারবার মনে করার চেষ্টা করছিল যে ক্রিকেট তার কাছে আনন্দ, তার স্বপ্নের মঞ্চ, কিন্তু ভয় যেন তার বুকের ভেতর শেকড় গেড়ে বসেছিল। বাইরে থেকে বাতাস আসছিল জানালার ফাঁক দিয়ে, কিন্তু সেই ঠান্ডা হাওয়া তার ভেতরের উত্তাপকে শান্ত করতে পারছিল না। বারবার মনে হচ্ছিল—এই এক রাতই হয়তো তার ভাগ্য লিখে দেবে।

বাড়ির ভেতরও এক অদ্ভুত পরিবেশ। বাবা অরিন্দম সারা সন্ধ্যা চুপচাপ ছিলেন, একবারও অনন্যার দিকে তাকালেন না। তবে তার নীরবতায় চাপা রাগ ফুটে উঠছিল। তিনি যেন স্পষ্ট করে বোঝাতে চাইছিলেন, অনন্যার আগামী দিনের ব্যর্থতা তার কথার প্রমাণ হয়ে দাঁড়াবে। মা কাবেরীও সেদিন বিশেষ কিছু বলেননি। সারা সন্ধ্যা রান্নাঘরে কাজ সেরে এসে চুপচাপ বসে ছিলেন। মায়ের এই নীরবতা অনন্যার বুককে আরও ভারী করে তুলেছিল। অনন্যা বুঝতে পারছিল—মা আসলে দ্বিধায় আছেন। তিনি হয়তো মেয়ে যাতে জেতে সেই প্রার্থনা করছেন, আবার একইসঙ্গে ভয় পাচ্ছেন—যদি ব্যর্থ হয় তবে সংসারের ভেতরে আরও ঝড় উঠবে। প্রতিবেশীরাও কেমন যেন বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছিল। জানালার ফাঁক দিয়ে আসা শব্দে শোনা যাচ্ছিল কারও ফিসফিসানি—“দেখি কাল মেয়ে কেমন খেলে, মুখ রক্ষা হয় কিনা।” এই বিদ্রুপের পরিবেশে অনন্যা মনে করছিল যেন পুরো সমাজটাই তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার বুকের ভেতর ভয় আর প্রত্যাশা মিলেমিশে এক অস্থির স্রোত তৈরি করেছিল।

এমন সময় ফোন এল কোচ রাহুলের। অনন্যা দ্বিধাগ্রস্ত গলায় ফোন ধরতেই রাহুলের দৃঢ় কণ্ঠ ভেসে এল, “শুধু খেল, অন্য কিছু ভাবিস না।” এই চারটে শব্দ যেন জাদুর মতো কাজ করল। রাহুল বললেন, “তুই যা অনুশীলন করেছিস, মাঠে সেটাই দেখাস। সমাজ, বাবা, মা—কেউকেই ভাবিস না। ক্রিকেট তোর স্বপ্ন, তোর লড়াই। খেলায় মন দে, জয়-পরাজয় তার নিজের জায়গায় আসবে।” এই কথাগুলো শুনে অনন্যার বুক হালকা হয়ে এল। সে জানল, অন্তত একজন মানুষ আছে, যে নিঃশর্তভাবে তার খেলোয়াড়সত্তাকে বিশ্বাস করে। ফোন রাখার পর অনন্যা চুপচাপ ব্যাটটা হাতে নিল। সেটার ওজন তার কাছে হঠাৎই হালকা মনে হলো, যেন ভেতরের সমস্ত ভয় মুছে গেছে। জানালার বাইরে রাত আরও গভীর হচ্ছিল, কিন্তু সেই অন্ধকারের ভেতরেও অনন্যা দেখতে পাচ্ছিল এক আলো—যে আলো তাকে ডাকছে আগামী দিনের মাঠের দিকে। চোখে তখনও ঘুম আসেনি, কিন্তু বুকের ভেতর জন্ম নিচ্ছিল এক নতুন দৃঢ়তা, এক অদম্য শক্তি। আগামীকালের লড়াইয়ের জন্য অনন্যা প্রস্তুত হচ্ছিল—শুধু একজন ক্রিকেটার হিসেবে নয়, একজন স্বপ্নবাজ মানুষ হিসেবে, যে জানে—এটাই তার জীবনের আসল যুদ্ধক্ষেত্র।

***

ম্যাচের সকালটা শুরু হয়েছিল অনন্যার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক উত্তেজনা আর শঙ্কার মিশ্রণে। জাতীয় দলের নির্বাচনী ম্যাচ মানেই এক বিশাল চাপ, আর তার ওপরে বাবার রাগী নীরবতা, মায়ের চোখে ভাসমান অজানা ভয়, প্রতিবেশীদের বিদ্রূপ—সব মিলিয়ে যেন বুকের ওপর পাহাড় চাপা। মাঠে ঢোকার আগে তার পা দুটো বারবার কাঁপছিল। সতীর্থরা ব্যস্ত নিজেদের জায়গায় গুছিয়ে নিচ্ছে, কোচ রাহুল কড়া গলায় নির্দেশ দিচ্ছেন, আর অনন্যা চেষ্টা করছে মাথার ভেতর জমে থাকা ঝড়কে সামলাতে। প্রথম ব্যাট হাতে নামার সময় গ্যালারি থেকে শিস, খিলখিল হাসি আর বিদ্রুপ মিশ্রিত কণ্ঠ ভেসে আসছিল—“মেয়েমানুষ দিয়ে ক্রিকেট হবে না।” সেই শব্দগুলো কানে লেগে যেন তাকে আরও অস্থির করে তুলছিল। প্রথম কয়েক বলের মুখোমুখি হতেই নার্ভাসনেস তাকে গ্রাস করল। ব্যাট বারবার বল মিস করল, একবার প্রায় আউট হয়ে ফিরতে বসেছিল। গ্যালারির হাসির শব্দ আরও জোরালো হয়ে উঠল। মাথার ভেতর বাবার সেই কঠিন মুখটা ভেসে উঠল, মায়ের নীরবতা মনে পড়ল, মনে হলো সব শেষ হয়ে যাবে। সে মুহূর্তে অনন্যা নিজেকে ভীষণ ছোট লাগছিল, মনে হচ্ছিল এই ম্যাচটা হয়তো তার জন্য এক ভয়ঙ্কর ব্যর্থতার প্রতীক হয়ে থাকবে।

কিন্তু হঠাৎই, এক মুহূর্তে ভেতরের সমস্ত ভেঙে পড়া অনুভূতি উল্টে গিয়ে যেন নতুন এক শক্তিতে রূপ নিল। কোচ রাহুলের কণ্ঠ মনে পড়ল—“শুধু খেল, অন্য কিছু ভাবিস না।” অনন্যা ব্যাটটা শক্ত করে ধরল, দাঁতে দাঁত চেপে স্থির হলো। এবার তার চোখ শুধু বলের দিকে, গ্যালারির শিস বা প্রতিপক্ষের কটাক্ষ যেন মিলিয়ে গেল চারপাশ থেকে। বলার মতো কিছু নেই, শুধু প্রতিটি ডেলিভারির সঙ্গে এক অদম্য মনোযোগ। প্রথমে ধীরে শুরু করলেও হঠাৎই তার ভেতর যেন ঝড় বয়ে গেল। একের পর এক কভার ড্রাইভ, পুল শট, স্ট্রেট ড্রাইভ—প্রতিটি শটে বল ছুটে গেল বাউন্ডারির দিকে। প্রতিপক্ষের বোলাররা অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিল। তাদের পরিকল্পনা ভেঙে পড়ছিল অনন্যার ব্যাটিংয়ের সামনে। তার ভেতরের ভয় ধীরে ধীরে গলে গিয়ে জায়গা নিচ্ছিল প্রবল আত্মবিশ্বাসে। প্রতিটি ছক্কায়, প্রতিটি চারে গ্যালারির নীরবতা ভেঙে গিয়ে বিস্ময়ে ভরে উঠছিল। যারা আগে বিদ্রুপ করছিল, তারা এখন দাঁড়িয়ে চোখ মেলছিল তার দিকে। অনন্যা আর তখন সেই নার্ভাস মেয়েটি নয়; সে যেন মাঠের রাণী, যার ব্যাটের শব্দ প্রতিপক্ষকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে।

শেষ দিকে অনন্যা যেন এক ঝড় হয়ে উঠেছিল। বল আর তার ব্যাটের মাঝখানে যেন অদৃশ্য এক বোঝাপড়া তৈরি হয়েছিল। প্রতিপক্ষের অধিনায়ক বারবার বোলার বদল করছিলেন, কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হচ্ছিল না। প্রতিটি শটে মাঠ যেন বিস্ফোরিত হচ্ছিল উল্লাসে। অনন্যা নিজেও বিশ্বাস করতে পারছিল না, এত চাপ, এত ভয়, এত বিদ্রুপের মাঝেও সে এমনভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। তার খেলার মধ্যে যে আত্মবিশ্বাস ফুটে উঠছিল, তা দেখে গ্যালারির দর্শকরা দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে শুরু করল। কারও কারও চোখে বিস্ময়, কারও চোখে গর্ব। কোচ রাহুল দূরে দাঁড়িয়ে নীরবে হাসছিলেন, আর অনন্যা মনে মনে বলছিল—“এই তো আমি, এটাই আমার উত্তর।” ম্যাচ শেষে মাঠ ছাড়ার সময় তার কান ভরে যাচ্ছিল করতালির শব্দে। যাদের চোখে এতদিন সে ছিল এক ‘অযথা স্বপ্নবাজ মেয়ে’, আজ তাদের চোখে সে এক নায়িকা। বাবার রাগী নীরবতা, মায়ের দ্বিধা, সমাজের বিদ্রুপ—সবকিছুর উত্তর যেন সে দিয়ে দিয়েছে ব্যাট দিয়ে। ঝড়ের মতো সেই ব্যাটিং শুধু একটি ম্যাচ জেতায়নি, বরং প্রমাণ করে দিয়েছে যে অনন্যা নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্যই জন্মেছে।

***

সেই দিনটার সকালটা যেন অনন্যার জীবনে নতুন ভোর নিয়ে এল। টেলিভিশনে সরাসরি জাতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রেস কনফারেন্স হচ্ছিল। কোচ রাহুল আগেই বলেছিলেন—“আজ তোর নাম উঠবেই, আমি নিশ্চিত।” তবুও বুকের ভেতর অনন্যার ধুকপুকানি থামছিল না। সোফার কোণে সঙ্কুচিত হয়ে বসেছিল সে, পাশে মা কাবেরী দাঁড়িয়ে—চোখে উদ্বেগ আর প্রত্যাশার মিশেল। বাবা অরিন্দম সেদিনও ভ্রূকুটি কুঁচকে পত্রিকা নিয়ে বসেছিলেন, যেন কোনো আগ্রহ নেই, কিন্তু তার চোখ যে অল্প অল্প টেলিভিশনের দিকে তাকাচ্ছে, তা অনন্যা খুব ভালোভাবেই ধরতে পারছিল। নাম ঘোষণা শুরু হলো। একে একে পরিচিত সব খেলোয়াড়দের নাম পড়া হচ্ছিল, আর অনন্যার বুক কেঁপে উঠছিল প্রতিটি মুহূর্তে। তারপর হঠাৎই ঘোষকের কণ্ঠ গম্ভীর স্বরে উচ্চারণ করল—“এবং নতুন মুখ হিসেবে দলে সুযোগ পেল অনন্যা সেন।” শব্দটা কানে আসতেই যেন সময় থেমে গেল। অনন্যার বুক ভরে উঠল এক অসীম আলোয়, মনে হলো—এই মুহূর্তটাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

মুহূর্তের ভেতরেই মায়ের চোখ ভিজে উঠল। কাবেরী এতদিন ধরে মনের ভেতরে লুকিয়ে রাখা সমস্ত ভয় আর দ্বিধাকে চোখের জলে ভাসিয়ে দিলেন। তিনি এগিয়ে এসে অনন্যাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন, যেন বুকে চেপে ধরে বলছেন—“তুই পেরেছিস মা, তুই আমাদের সব লড়াইয়ের উত্তর দিয়ে দিয়েছিস।” অনন্যা সেই আলিঙ্গনে ভিজে যাচ্ছিল মায়ের উষ্ণতায়। দীর্ঘদিন ধরে যে মেয়ে সংসারের তর্ক, সমাজের বিদ্রুপ, বাবার রাগ—সব কিছুর বিরুদ্ধে লড়ে এসেছে, আজ তার সেই প্রতিটি ক্ষত যেন মায়ের চোখের জলের ভেতর ধুয়ে যাচ্ছিল। বাবা প্রথমে চুপচাপ ছিলেন। টেলিভিশনের দিকে একবার তাকালেন, তারপর ধীরে ধীরে উঠে এসে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। কোনো কথা বললেন না, কিন্তু সেই নীরব স্পর্শে ভেসে উঠল তার ভেতরের স্বীকৃতি, গর্ব, আর ভালোবাসা। এতদিন যিনি মনে করেছিলেন ক্রিকেট শুধু সময় নষ্ট করা, তিনি আজ নিজের মেয়ের অর্জনের সামনে নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। অনন্যা চোখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল—“বাবা, আমি পারলাম।” আর অরিন্দমের ঠোঁটের কোণে সেদিন এক ক্ষীণ হাসি খেলে গেল, যা হয়তো তার জীবনের প্রথম গোপন স্বীকৃতি।

এই খবর ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগেনি। কিছুক্ষণ পরেই প্রতিবেশীরা দলে দলে এসে হাজির। যাদের ঠোঁটে এতদিন ছিল বিদ্রুপ আর অবজ্ঞা, আজ তাদের মুখ ভরে উঠল প্রশংসায়। “আমাদের পাড়ার মেয়ে, জাতীয় দলে খেলবে!”—এই বাক্যটা যেন গর্বের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছিল চারদিকে। যে আঙিনায় এতদিন উপহাস ছিল, সেখানে হঠাৎই উল্লাস আর করতালির ঢেউ উঠল। অনন্যা দেখল, সমাজের চোখে বদলে গেছে তার পরিচয়। আগে সে ছিল শুধু এক অবাধ্য মেয়ে, যে পড়াশোনা ছেড়ে খেলার স্বপ্ন দেখে; আজ সে এক প্রেরণা, এক গর্ব। কোচ রাহুল ফোন করে বললেন—“এখন লড়াইটা আরও কঠিন হবে, কিন্তু আজকের আনন্দটা মনে রাখিস, এটা তোকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে।” অনন্যা চুপচাপ আকাশের দিকে তাকাল। মনে হলো—এই আকাশই আজ তার জন্য একটু বেশি নীল, একটু বেশি উজ্জ্বল। সে জানে, পথটা এখানেই শেষ নয়, বরং এখান থেকেই শুরু হলো তার আসল যাত্রা। কিন্তু আজকের দিনটা, এই মুহূর্তটা—এটাই তার সবচেয়ে বড় জয়।

***

বিমানবন্দরের সেই সকালটা যেন অনন্যার জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়ে উঠল। ভোর থেকেই ঘরে এক অদ্ভুত ব্যস্ততা, মা কাবেরী তার জন্য শেষ মুহূর্তের কাপড় গুছিয়ে দিচ্ছিলেন, আর বাবা অরিন্দম একেবারেই চুপচাপ বসে ছিলেন, কিন্তু সেই নীরবতায়ও এক গভীর গর্ব লুকিয়ে ছিল। অনন্যা সেদিন প্রথমবারের মতো জাতীয় দলের জার্সি হাতে নিল—যেটা তার কাছে শুধু একটা কাপড় নয়, বরং লড়াইয়ের প্রতীক। সে জার্সিটা বুকের কাছে চেপে ধরতেই মনে পড়ল সেই সমস্ত রাতের কথা, যখন ঘুম ছেড়ে অনুশীলন করেছে, সেই সমস্ত সকাল, যখন সমাজের দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে মাঠে নেমেছে, আর সেই সমস্ত মুহূর্ত, যখন নিজের অশ্রুকে শক্তিতে রূপান্তর করেছে। বিমানবন্দরে পৌঁছনোর পথে গাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে সে দেখছিল, শহরের প্রতিটি মোড়ে, প্রতিটি রাস্তায় যেন তার শৈশবের স্মৃতি ভেসে উঠছে। গলির সেই ছোট্ট মাঠ, প্রতিবেশীদের কটূক্তি, মায়ের নিরব সমর্থন, বাবার কঠিন দৃষ্টি—সব যেন এক সিনেমার মতো তার চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যাচ্ছিল।

বিমানবন্দরে পৌঁছেই অনন্যা নতুন এক পৃথিবীর মুখোমুখি হলো। চারদিকে সাংবাদিকদের ভিড়, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, মাইক্রোফোন এগিয়ে আসছে তার দিকে। প্রশ্নবাণে ছুটে এল—“প্রথমবার জাতীয় দলে, কেমন লাগছে?”, “কাদের কথা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে?”, “আপনার লক্ষ্য কী?”—অনন্যা স্থির কণ্ঠে বলল, “এটা শুধু আমার নয়, প্রতিটি মেয়ের লড়াইয়ের জয়। আমি মাঠে শুধু ব্যাট হাতে নামব না, আমি নামব স্বপ্ন আর বিশ্বাসকে সঙ্গে নিয়ে।” এই উত্তর শোনার পর ভিড় থেকে হাততালি উঠল। কোচ রাহুল পাশে দাঁড়িয়ে মৃদু হাসি দিলেন, যেন চোখের ভাষায় বললেন—“এটাই তোকে আমি সবসময় বিশ্বাস করেছি।” আর সেই মুহূর্তে অনন্যা বুঝল—এখন সে আর শুধু নিজের জন্য খেলছে না, সে খেলছে দেশের জন্য, সেই অসংখ্য মেয়ের জন্য যারা সমাজের বাঁধা উপেক্ষা করে স্বপ্ন দেখে। বাবা-মা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, ভিড়ের মধ্যেও অনন্যা স্পষ্ট দেখতে পেল মায়ের ভিজে চোখ, আর বাবার ঠোঁটে লুকোনো হাসি। সেই হাসিটাই তার কাছে সবচেয়ে বড় পুরস্কার হয়ে উঠল।

বিমানে বসার পর জানালার বাইরে তাকাল অনন্যা। মেঘগুলো ধীরে ধীরে পেছনে ফেলে আসছিল, ঠিক যেমন সে পিছনে ফেলে আসছে তার সমস্ত কষ্ট, অপমান, আর দুঃস্বপ্ন। কিন্তু সেই অতীত তার শত্রু নয়, বরং শক্তির উৎস হয়ে তাকে নতুন করে গড়ে তুলেছে। ব্যাট হাতে মাঠে নামার আগে এই যাত্রাই তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে—সে কেবল একজন ক্রিকেটার নয়, সে এক যোদ্ধা। বিমানের কাচে প্রতিফলিত নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে সে ফিসফিস করে বলল, “আমি শুধু একজন ক্রিকেটার নই, আমি অদম্য।” এই চারটে শব্দ যেন তার বুকের ভেতর প্রতিধ্বনি তুলল। সামনে যত ঝড়ই আসুক, যত বাঁধাই আসুক, সে জানে—তার ভেতরের শক্তিকে আর কেউ আটকাতে পারবে না। এই বিমানের যাত্রা কেবল একটা ম্যাচ খেলার জন্য নয়, বরং এক অদম্য যাত্রার সূচনা, যা তাকে নিয়ে যাবে আরও দূরে, আরও উচ্চতায়, আর যা ইতিহাসের পাতায় লিখে দেবে—এক মেয়ের স্বপ্নের জয়গাথা।

____

 

1000054210.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *