Bangla - প্রেমের গল্প

অজানার টানে

Spread the love

পৌলমী বসু


এক

সকালের প্রথম আলোয় যখন ঘুম ভাঙে, তখন থেকেই সোমার দিন শুরু হয় দায়িত্বের দীর্ঘ তালিকা নিয়ে। রান্নাঘরে চায়ের কেটলি চড়ানো, টিফিনের বাক্স সাজানো, মৌয়ের স্কুলব্যাগ গুছিয়ে দেওয়া, কাপড় কাচা—সবই যেন একটা অভ্যাসের অংশ। কিন্তু এই অভ্যাসের ভেতরে কোথাও এক অদৃশ্য শূন্যতা দিন দিন গভীর হচ্ছে। জানলার ফাঁক দিয়ে আসা আলো তার চোখে পড়ে, কিন্তু সেই আলো তাকে আনন্দ দেয় না। বরং মনে হয়—এই আলোও যেন কেবল আরেকটা রুটিনকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। রান্নাঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে সোমা যখন নুন-মশলার অনুপাতে তরকারি কষে, তখন তার ভেতরে ভেসে ওঠে প্রশ্ন—এটাই কি তবে তার জীবন? রান্নাঘরের কড়া গন্ধ, চায়ের ফুটন্ত বুদবুদ, কিংবা মৌয়ের দ্রুত তাড়া—“মা, স্কুলে দেরি হয়ে যাবে”—সব মিলিয়ে প্রতিদিনের সকাল একটা নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা। সেই ছক ভাঙার মতো কোনো নতুনত্ব নেই। দীপ তখনও টেবিলের পাশে বসে অর্ধেক চোখ বন্ধ করে চশমা খুঁজছে, আর টোস্টে হালকা কামড় দিয়ে খবরের কাগজের পাতায় চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে। কোনো কথা নেই, কোনো হাসি নেই—শুধু প্রয়োজনীয় নির্দেশ আর উত্তর। যেন সংসার নামক এই কাঠামো তাদের দুজনকেই নিঃশব্দ যন্ত্রে পরিণত করেছে।

দুপুরের সময়ে সোমা একা থাকে ঘরে। মৌ স্কুলে, দীপ অফিসে। ঘরের নীরবতা যেন অনেক সময় শ্বাসরোধ করে। টেবিলের উপর পড়ে থাকা কফির কাপ, মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা খেলনার টুকরো, কিংবা আলমারির উপর ধুলো—সব কিছুই যেন তাকে মনে করিয়ে দেয়, সে এখানে একজন যত্নশীল গৃহিণী হিসেবে নিযুক্ত। কিন্তু তার নিজের নাম, নিজের সত্ত্বা কোথায় হারিয়ে গেল? টেলিভিশনের সিরিয়ালের চেঁচামেচি তার কাছে কেবল কানে লাগা শব্দ। কখনও কখনও সে পুরনো অ্যালবামের দিকে তাকিয়ে ভাবে—কোথায় হারিয়ে গেল সেই দীপ, যে একসময় কবিতা লিখে তাকে শুনাতো, ছোট ছোট কারণে অবাক করে দিতো, কিংবা মাঝরাতে হঠাৎ হাত ধরে বলতো, “তুই ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ।” এখন সেই দীপ যেন হারিয়ে গেছে চাকরির ফাইলের নিচে, অফিসের টার্গেটের চাপের মধ্যে। দুপুরের নির্জনতায় সোমা বুঝতে পারে—সংসারের একঘেয়ে দিনযাপন তাকে ধীরে ধীরে ক্লান্ত করে দিচ্ছে, কিন্তু সে এই ক্লান্তি প্রকাশ করার মতো ভাষা খুঁজে পায় না। তার হাসি এখন কেবল বাচ্চাকে খুশি রাখার জন্য, তার ব্যস্ততা কেবল সংসার নামক যন্ত্রের চাকা সচল রাখার জন্য।

সন্ধ্যায় দীপ যখন অফিস থেকে বাড়ি ফেরে, তখনও সেই যান্ত্রিকতার ছাপ স্পষ্ট। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে তার হাতে থাকে মোবাইল, মাথায় থাকে ক্লায়েন্টের ডেডলাইন আর আগামীকালের মিটিংয়ের তালিকা। সোমা টেবিলে খাবার সাজায়, মৌ হোমওয়ার্কের খাতা খুলে বসে। টেবিলের আলোয় তারা তিনজন পাশাপাশি বসে থাকলেও, মনে হয় যেন প্রত্যেকেই আলাদা একেকটা দ্বীপে বসবাস করছে। কথোপকথন সীমাবদ্ধ—“ভাতটা দাও”, “লবণটা কম হয়েছে”, “মৌ, পড়া শেষ করো”—এর বাইরে কোনো আবেগ নেই, কোনো হাসি নেই। রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভেতরে যেন আরও এক স্তর নীরবতা জমে ওঠে। সোমা জানলার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখে, কিন্তু আকাশেও তার কাছে কোনো নতুনতা নেই। দীপ টেলিভিশনের সামনে বসে খেলার স্কোর দেখে, মাঝেমধ্যে মোবাইল স্ক্রল করে। তারা একই ছাদের নিচে থেকেও যেন ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। এই নিঃশব্দ দূরত্ব, এই অচেনা শূন্যতা—সব মিলিয়ে সংসারের একঘেয়ে দিনযাপন তাদের সম্পর্ককে ধীরে ধীরে নিস্তেজ করে দিচ্ছে। তবু বাইরের চোখে তারা একদম স্বাভাবিক দম্পতি, দায়িত্ববান বাবা-মা। কিন্তু অন্তরের গভীরে সোমা ও দীপ দু’জনেই যেন অচেনা অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে—যেখানে ভালোবাসা, আকাঙ্ক্ষা আর উষ্ণতা কেবল স্মৃতির অংশ হয়ে রয়ে গেছে।

দুই

সেদিন বিকেলে মৌ tuition-এ গেলে সোমা বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিল। আকাশে হালকা মেঘ ভেসে যাচ্ছে, বাতাসে শরতের আভাস। ঠিক তখনই সুবর্ণা আসে—কলেজের বন্ধু, আজও যার সঙ্গে কথা বললে সোমার ভেতরে এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাস জেগে ওঠে। সুবর্ণা হাসিখুশি, প্রাণবন্ত, সংসারী হলেও নিজের জন্য সময় বের করতে জানে। চা হাতে বসে গল্প করতে করতে হঠাৎ সে বলে উঠলো, “জানিস সোমা, সংসার মানে শুধু দায়িত্ব না। তুই সারাদিন বাচ্চা, ঘর আর রান্নাঘরে আটকে থাকিস, কিন্তু তোকে তো নিজেকেও বাঁচাতে হবে। নিজের জন্য আলাদা জীবন না বানালে, তোকে কেউ এসে হাতে তুলে দেবে না।” কথাটা প্রথমে হালকা মনে হলেও সোমার বুকের ভেতরে যেন ঢেউ তুলল। সত্যিই তো—সে কি আর নিজেকে চিনতে পারে? বিয়ের আগে যে সোমা গান গাইতে ভালোবাসত, কবিতা লিখত, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারত—সে আজ কোথায়? তার সমস্ত সত্তা যেন মিশে গেছে সংসারের খুঁটিনাটি দায়দায়িত্বে। সুবর্ণা গল্প করতে করতে বলল, ও মাঝে মাঝে একা সিনেমা দেখতে যায়, হঠাৎ কোথাও ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে, কিংবা রাত জেগে নিজের পছন্দের বই পড়ে। সোমা অবাক হয়ে ভাবে—সে কি এসব করতে পারত? সে কি নিজের জীবনকে এইভাবে সাজাতে পারত, যেখানে দায়িত্ব থাকবে, আবার নিজের জন্যও একটুকরো আলোর জায়গা থাকবে? কথোপকথনের শেষে সুবর্ণা হেসে বলে, “দীপকে আবার নতুন করে চিনিস না কেন? হয়তো তোর কাছেই আছে সব উত্তরের চাবি।” কথাটা শুনে সোমা চুপ হয়ে যায়, কিন্তু মনে অদ্ভুত আলোড়ন তোলে।

রাত নামার পর, ঘরে সবাই নিজ নিজ কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও, সুবর্ণার বলা কথাগুলো সোমার মাথা থেকে যাচ্ছিল না। ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজানোর সময়, দীপ যখন মোবাইল স্ক্রল করতে করতে ভাত খাচ্ছিল, তখন হঠাৎ তার দিকে তাকিয়ে সোমার মনে হল—এটাই কি সেই মানুষ, যে একসময় তাকে কবিতার খাতায় আঁকত, চুপিচুপি চিঠি দিত? একসময় দীপের দৃষ্টির ভেতরে যে টান ছিল, সেই উজ্জ্বলতা কোথায় মিলিয়ে গেল? সংসারের দীর্ঘ দায়িত্ব কি দু’জনকে একে অপরের থেকে এভাবে দূরে সরিয়ে দিল? সোমা মনে মনে প্রশ্ন করে, “আমাদের সম্পর্ক কি শুধুই এখন প্রয়োজন আর দায়িত্বের বন্ধনে দাঁড়িয়ে আছে? নাকি ভেতরে ভেতরে এখনও লুকিয়ে আছে সেই পুরনো আকর্ষণ?” মৌ হোমওয়ার্ক শেষ করে টেলিভিশনের সামনে বসে পড়ল, আর দীপ অফিসের মেইল চেক করতে ব্যস্ত। সোমা চুপচাপ জানলার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে লাগল। শূন্যতার ভেতরে হঠাৎ মনে হল—তার জীবনে কী যেন নেই, কী যেন হারিয়ে গেছে। কিন্তু সেটা ঠিক কী? সেই উত্তর খুঁজে বের করার মতো শক্তি তার ভেতরে এখনও নেই। শুধু মনে হচ্ছে, সুবর্ণার কথার ভেতরে কোনো সত্য লুকিয়ে আছে, যেটা সে এড়িয়ে যাচ্ছে।

পরদিন ভোরে ঘুম ভাঙতেই আবার সেই একই রুটিন—চায়ের কেটলি, টিফিনের বাক্স, মৌয়ের স্কুলব্যাগ। সব একই ছকে বাঁধা, কিন্তু এখন আর তা আগের মতো যান্ত্রিক মনে হচ্ছে না। কোথাও না কোথাও প্রশ্ন জেগে উঠছে—“এভাবে কি সারাজীবন চলবে? নাকি এর বাইরে অন্য কোনো পথ আছে?” রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে সোমা হঠাৎ কল্পনা করে—যদি একদিন দীপকে নিয়ে হঠাৎ কোথাও চলে যায়, যদি আবার দু’জনে নতুন করে একে অপরকে চিনতে শুরু করে, তবে কেমন হবে? তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে কলেজের দিনগুলো, দীপের প্রথম ভালোবাসার স্বীকারোক্তি, বিয়ের প্রথম দিকের উচ্ছ্বাস। সে ভাবে, হয়তো সবকিছু হারিয়ে যায়নি, হয়তো শুধু ধুলোর আস্তরণ জমে গেছে, যেটা ঝেড়ে ফেললেই আবার বেরিয়ে আসবে সেই দীপ্তি। কিন্তু আবারই ভেতরের ভয় তাকে টেনে ধরে—দীর্ঘ সংসারজীবনের শৃঙ্খল ভাঙা কি এত সহজ? দীপ কি তার মতোই একই প্রশ্ন করছে ভেতরে ভেতরে? নাকি সে একেবারেই হারিয়ে গেছে যান্ত্রিকতার ভেতরে? অজানা প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই সোমার ভেতরে এক অদ্ভুত আলোড়ন তৈরি হয়। মনে হয়—শূন্যতার অন্ধকারে হয়তো সত্যিই কোথাও আলো আছে, শুধু তাকানোর সাহস থাকতে হবে।

তিন

রাতের খাবারের টেবিলে প্রতিদিনের মতোই একই দৃশ্য। টেবিলের এক পাশে মৌ হোমওয়ার্কের খাতা সরিয়ে বসে, অন্য পাশে দীপ তার মোবাইল রেখে খাবার শুরু করে। সোমা খাবার পরিবেশন করে, মাঝেমধ্যে মৌকে বলে দেয়—“ভাতটা শেষ কর, কাল পরীক্ষা আছে।” ডিনার টেবিল যেন এক নিঃশব্দ লেনদেনের জায়গা হয়ে গেছে, যেখানে কথাবার্তা সীমাবদ্ধ থাকে শুধু দরকারি তথ্যেই—কোন জিনিস বাজার থেকে আনতে হবে, বাচ্চার টিফিনে কী দেওয়া যাবে, স্কুলে ফি জমা দেওয়ার শেষ তারিখ কবে, কিংবা অফিসে দীপের পরের দিন মিটিং আছে কি না। এর বাইরে আর কোনো কথাই হয় না। অথচ সোমা মনে মনে জানে, এই টেবিলেই একসময় তারা দু’জনে বসে কত কথা বলত, কত হাসত। দীপ চোখে চোখ রেখে তার দিনের গল্প শুনত, সোমা শুনত দীপের অফিসের দুঃখ-সুখ। এখন সেই চোখে চোখ রাখার অভ্যাসটাই যেন হারিয়ে গেছে। দীপের চোখ ব্যস্ত শুধু প্লেট আর মোবাইল স্ক্রিনে। সোমা টেবিলের ওপারে বসে মনে মনে ভাবে—এ কেমন বদল? যে মানুষটার চোখ একদিন তার কাছে ছিল পৃথিবীর সব আলো, সেই চোখই আজ কেন এত নির্লিপ্ত, এত শীতল?

মৌ খাবার খেয়ে উঠে পড়লে টেবিলে থেকে যায় নিস্তব্ধতা আর অস্বস্তির চাপা শব্দ। সোমা চুপচাপ ভাত খায়, মাঝে মাঝে দীপকে কিছু বলতে ইচ্ছে করে, কিন্তু কথাগুলো ঠোঁটে এসে আটকে যায়। মনে হয়, বললেও কোনো উত্তর আসবে না—শুধু এক-আধ শব্দের সাড়া, অথবা নীরব মাথা নেড়ে দেওয়া। এই অস্বস্তি তার বুকের ভেতরে যেন ধীরে ধীরে জমাট বাঁধে। সে ভাবে—কীভাবে এ সম্পর্ক এত নিঃশব্দ হয়ে গেল? একসময় যে কথোপকথনের ঝর্ণা অনর্গল বয়ে যেত, আজ সেখানে শুধু খরস্রোতের জায়গায় শুকনো নদী। দীপ কি বুঝতে পারে না, তার এই নীরবতা কতটা কষ্ট দেয়? নাকি দীপও তার মতোই ভেতরে ভেতরে ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্ত, আর তাই কিছু বলতে ইচ্ছে করে না? সোমা ভাবে, যদি সে হঠাৎ করে কোনো হালকা প্রসঙ্গ তোলে—যেমন পুরনো দিনের স্মৃতি, কিংবা কোনো সিনেমার আলোচনা—তবে কি দীপ আগের মতো হাসবে, নাকি কেবল অনিচ্ছুক ভঙ্গিতে তাকাবে? এই দোটানায় সে চুপ করে থাকে, আর সেই চুপ করাই সম্পর্কের ভেতরে আরও এক পরত নীরবতা যোগ করে।

খাবার শেষে দীপ টেলিভিশনের সামনে গিয়ে বসে খবর দেখে বা মোবাইলে ডুবে যায়, আর সোমা প্লেট ধুতে ধুতে একরকম নিঃসঙ্গতার মধ্যে তলিয়ে যায়। ঘরের চারপাশে তাকালে শুধু দায়িত্বের চিহ্ন—কোথাও অর্ধেক শুকনো কাপড়, কোথাও মৌয়ের ছড়িয়ে রাখা বই, কোথাও ডাস্টবিনে জমে থাকা আবর্জনা। কিন্তু কোথাও নেই সেই উষ্ণতা, যে উষ্ণতা একসময় সংসারের প্রতিটি কোণে বিরাজ করত। সোমা মনে করে—একসময় রাতের খাবারের পর তারা একসঙ্গে ছাদে হেঁটে বেড়াত, বা জানালার পাশে বসে চা খেত। আজ আর কিছুই নেই। এখনকার জীবনটা যেন কেবল একই নাটকের পুনরাবৃত্তি, যেখানে সংলাপ নেই, শুধু দৃশ্য আছে। আর এই নিঃশব্দ দূরত্ব, এই অভ্যন্তরীণ ফাঁক ধীরে ধীরে তাদের সম্পর্কের শিকড়কে ক্ষয়ে দিচ্ছে। সোমা জানে, এই নীরবতার ভেতরে লুকিয়ে আছে অসংখ্য প্রশ্ন—সে কি আর দীপের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ নয়? নাকি দীপের ভেতরে কোনো অনুভূতি বেঁচে নেই? কিন্তু সে প্রশ্ন উচ্চারণ করার সাহসও খুঁজে পায় না। ফলে প্রতিটি রাত একইভাবে শেষ হয়—দু’জন এক ছাদের নিচে থেকেও অচেনা হয়ে শুয়ে থাকে, যেখানে দূরত্বটা শারীরিক নয়, মানসিক। আর এই মানসিক দূরত্বই ধীরে ধীরে তাদের ভেতরের আলো নিভিয়ে দিচ্ছে।

চার

অ্যালবামের পাতাগুলো ধীরে ধীরে উল্টাতে উল্টাতে সোমার মনে হচ্ছিল, যেন সে সময়ের পাতা উল্টাচ্ছে। বহু বছর ধরে যে অ্যালবামটা আলমারির গভীরে চাপা পড়ে ছিল, হঠাৎ সেই রাতে হাতের কাছে চলে আসে। ঘরটা ছিল নিস্তব্ধ, বাইরে হালকা বাতাসে জানালার কাঁচে টুপটাপ শব্দ তুলছিল। অ্যালবামের পাতায় প্রথমেই ধরা দিল বিয়ের পরের ছবি—সাজঘরে দীপের হাসিমাখা মুখ, পাশে লাজুকভাবে বসে থাকা সোমা। দীপের চোখে যে উষ্ণতা, তাতে ছিল এক অদ্ভুত ভরসা, যেন তিনি কথা না বলেও বলে যাচ্ছিলেন—“তুমি ভয় পেও না, আমি আছি।” ছবির চোখদুটো যেন প্রাণবন্ত হয়ে সোমার বুকের ভেতর নাড়া দিয়ে গেল। মনে হল সেই দীপ আর আজকের দীপ—দুজন দুই ভিন্ন মানুষ। কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সেই হাসি, সেই চাউনি, সেই আপন করে নেওয়ার ভঙ্গি। পুরনো ছবির আলোর ফাঁকে সোমা যেন আবার ফিরে যাচ্ছিল সেই প্রথম দিনগুলিতে, যখন সবকিছুই ছিল নতুন, অচেনা অথচ সুন্দর। দীপ তাকে সিনেমা দেখতে নিয়ে যেতেন, রাস্তার ধারের চায়ের দোকানে বসে দু’জনে ভাগ করে চা খেতেন, আর রাত জেগে গল্প করতে করতে হঠাৎ হেসে উঠতেন। সেই দিনগুলো কত সহজ, কত নিখাদ ছিল—আজকের ক্লান্ত, নীরস বাস্তবতার সাথে তার কোনো মিলই নেই।

অ্যালবামের পরের পাতায় ধরা দিল মধুচন্দ্রিমার ছবি—পাহাড়ি পথ, ঝরনার সামনে দু’জনে দাঁড়িয়ে আছেন। দীপের কাঁধে রাখা সোমার হাতের ভঙ্গিটা যেন বলছিল—এটাই তার নিরাপদ আশ্রয়। দীপের চোখে তখন ছিল এক ধরনের স্বপ্নবাজি, যেন পৃথিবীর সব সৌন্দর্য তিনি শুধু সোমাকে ঘিরেই দেখতে পাচ্ছেন। ছবির দিকে তাকিয়ে সোমার চোখ ভিজে উঠল। দীর্ঘ বছরের সংসার, টানাপোড়েন, দায়িত্ব, অভিমান—সব মিলে সেই চোখের দীপ্তি কোথায় যেন ম্লান হয়ে গেছে। দীপ আজও আছে, কিন্তু তিনি যেন অন্য এক মানুষ হয়ে উঠেছেন—ক্লান্ত, নির্লিপ্ত, যেন চারপাশের রঙিন দুনিয়ার প্রতি তার আর কোনো আগ্রহ নেই। সোমা ভেবে দেখল, সে-ই বা কতটা পাল্টে গেছে! সেই হাসিখুশি, স্বপ্নময় তরুণী এখন সংসারের যন্ত্রণা, বাচ্চার পড়াশোনা, অর্থকষ্ট, সমাজের চাপ—সব মিলিয়ে এক অচেনা চরিত্রে বাঁধা পড়ে আছে। অথচ ছবির পাতায় যখন দু’জনকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, মনে হয় এরা হয়তো কোনো গল্পের চরিত্র, যাদের জীবন কেবল রঙিন মুহূর্তে ভরা। হঠাৎই মনে হল—সেই দীপকে সে হারিয়েছে, যে একদিন তার হাত ধরে বলেছিল—“আমি কখনও তোমাকে একা ফেলব না।” আজ ঘরের ভেতর দীপ থাকলেও সেই দীপকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। স্মৃতি তাকে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে, বুকের ভেতরে এক অদ্ভুত কষ্ট তৈরি করে।

সোমা অ্যালবামটা বন্ধ করতে পারল না। পাতার পর পাতা উল্টে চলল, প্রতিটি ছবিই যেন গল্পের মতো। প্রথম বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা, নতুন আসবাবপত্র সাজানোর আনন্দ, দীপের হাসিখুশি মুখ—সব একসাথে মনে ভিড় করে এল। হঠাৎ মনে হল, সময়ের স্রোতে ভেসে যেতে যেতে কত কিছু হারিয়ে গেছে অজান্তে। হয়তো দু’জনের মধ্যে আর আগের মতো কথা হয় না, হয়তো জীবনের দায়-দায়িত্বই মানুষটাকে পাল্টে দিয়েছে, কিন্তু কোথাও তো সেই দীপ আছে, যে তাকে ভালোবেসেছিল, যে হাসি দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরত। বুকের ভেতরে কেমন একটা খালি জায়গা তৈরি হল—যেন স্মৃতি তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সেই আলো-ছায়ার দিনগুলির কাছে, আবার ফিরিয়ে আনছে বর্তমানের নিরসতায়। অ্যালবামের পাতায় দীপকে দেখে যতবার সোমার মনে হচ্ছিল—এটাই তার সত্যিকারের মানুষ, ততবারই সে বুঝতে পারছিল বাস্তবের দীপকে হারিয়ে ফেলেছে। চোখের জল মুছে অ্যালবাম বুকে চেপে ধরল সোমা। মনে হল, স্মৃতিই তাকে বাঁচিয়ে রাখছে, আর সেই স্মৃতিই আবার তাকে ছিন্নভিন্ন করে তুলছে। রাতের নির্জনতায়, ছবির নিঃশব্দ হাসিতে সে যেন খুঁজে পাচ্ছিল নিজের হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসাকে—যেটি কেবল অ্যালবামের পাতাতেই রয়ে গেছে, জীবনের পাতায় আর নেই।

পাঁচ

সন্ধ্যার আকাশে লালচে আভা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে, শহরের ওপরে নেমে আসছে এক ধরণের অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। সেই সময় দীপ ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল, হাতে জ্বলন্ত সিগারেট, ধোঁয়া বাতাসে ভেসে যাচ্ছিল। মনের ভেতর দিনের পর দিন জমে থাকা ক্লান্তি আর অনিশ্চয়তা যেন ধোঁয়ার মতোই ধীরে ধীরে উড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু একই সঙ্গে ভেতরে অস্থিরতার এক অদৃশ্য কুণ্ডলী পাক খাচ্ছিল। ঠিক তখনই পাশে এসে দাঁড়ায় সোমা—চোখে ক্লান্তি, ঠোঁটে অচেনা একরকম দ্বিধা। এতদিনের নীরবতার পর, এতদিনের ঠাণ্ডা দূরত্বের পর তাদের মাঝে যেন হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে তৈরি হয় এক অদৃশ্য সেতু। দীপ সিগারেটের ছাই ফেলে তাকাল তার দিকে, তারপর হালকা হেসে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল—“মনে আছে আমাদের কলেজের দিনগুলো?” প্রশ্নটি শুনে সোমা প্রথমে চুপ করে থাকে, যেন ভাবছিল উত্তর দেবে কিনা। কিন্তু সেই মুহূর্তে তার চোখে পড়ে দীপের ভেতরের লুকোনো নরম অংশটুকু, যে মানুষটা কেবল বাইরের খোলস নয়, বরং স্মৃতির ভেতর লুকিয়ে থাকা নির্ভরযোগ্য, সহজ-সরল দীপ। ধীরে ধীরে তার ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে—অচেনা হলেও অনেকটা পুরনো দিনের মতো। আর সেই হাসিই বরফ ভাঙার প্রথম ইঙ্গিত দেয়। তারা যেন হঠাৎই ফিরে গেল সেই দিনগুলোয়, যখন কলেজের বারান্দায় বসে দুপুর গড়িয়ে যেত, যখন আড্ডার ফাঁকে স্বপ্নের গল্প বোনা হতো, আর ছোট্ট বিষয় নিয়েও মন খুলে হাসা যেত।

হাসিটা যেন দুজনের ভেতর জমে থাকা অচেনা দেয়াল ভেঙে দিল। দীপ মনে করল, কেমন করে সোমা সেই সময় প্রশ্নের পর প্রশ্ন করত, নতুন বই হাতে নিলেই তর্কে মাতত, আর ক্যান্টিনের টেবিলে বসে এক কাপ চায়ের জন্য লড়াই পর্যন্ত করে ফেলত। স্মৃতিগুলো এত স্পষ্টভাবে ভেসে উঠল যে, মুহূর্তের জন্য সে ভুলেই গেল এখনকার দূরত্বটা। সোমাও চুপচাপ শুনছিল, মাঝে মাঝে মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছিল, কখনও হালকা হেসে ফেলছিল। তার মনে হচ্ছিল, এতদিন ধরে এই মানুষটাকে সে দূরে সরিয়ে রেখেছিল, অথচ তার ভেতরে যে এত উষ্ণতা আছে, তা যেন নতুন করে আবিষ্কার করছে। কথার পর কথায় চলে আসে ছোট ছোট গল্প—একদিন হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজে ফেলা, পরীক্ষার আগের রাতে একসাথে নোট খুঁজে বেড়ানো, কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে হুল্লোড়ের মাঝে চুপচাপ দুজনে দাঁড়িয়ে থাকা। এইসব ক্ষুদ্র অথচ বুনটের মতো জড়িয়ে থাকা স্মৃতিই তাদের একে অপরের কাছে টেনে আনছিল। দীপ সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলল—“সেই দিনগুলোয় আমরা কোনো চিন্তা করতাম না, সোমা। শুধু বাঁচার আনন্দটা ছিল।” এই কথা শুনে সোমার চোখে হালকা আর্দ্রতা ঝলমল করে উঠল। সে আস্তে বলে উঠল—“হয়তো তাই। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সব বদলে যায়।” তবে এবার তার কণ্ঠে কোনো অভিযোগ ছিল না, ছিল মেনে নেওয়ার প্রশান্তি। মনে হচ্ছিল, যেন দীর্ঘদিনের গোপন ক্ষতগুলোর ওপরে এখন ধীরে ধীরে শান্তির প্রলেপ পড়ছে।

আলাপচারিতা যত এগোতে থাকে, দীপ আর সোমার মাঝে থাকা শীতল দেয়াল গলে যেতে থাকে। যে দূরত্ব এতদিন ধরে তাদের মধ্যে বেড়ে উঠেছিল, তা ধীরে ধীরে একরকম উষ্ণতায় পরিণত হয়। শহরের আলো একে একে জ্বলে ওঠে, দূরে গাড়ির শব্দ ভেসে আসে, কিন্তু তাদের দুজনের দুনিয়া যেন সীমাবদ্ধ হয়ে যায় এই ছাদের খোলা আকাশে। দীপ সিগারেট শেষ করে ছাইদানি পাশে রেখে দাঁড়াল সোমার দিকে কিছুটা কাছাকাছি। তার চোখে তাকিয়েই বোঝা যাচ্ছিল, এই মানুষটা কথার মাধ্যমে আবারও জীবনের সেই সহজ জায়গাটায় ফিরতে চাইছে, যেখানে জটিলতা ছিল না, কেবল বন্ধুত্ব আর বোঝাপড়ার সম্পর্ক ছিল। সোমাও সেই দৃষ্টিকে এড়িয়ে গেল না, বরং কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থেকে হেসে দিল—সেই হাসিতে ছিল অনেকদিন পরের স্বাভাবিকতা, ছিল এক ধরনের নির্ভরতার ছোঁয়া। তাদের কথোপকথন যেন থামতেই চাইছিল না। পুরনো দিনের স্মৃতির সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল বর্তমানের ক্লান্তি, আর তাতেই তৈরি হচ্ছিল নতুন এক সমঝোতার জায়গা। রাত যত গাঢ় হচ্ছিল, ছাদে তাদের আলাপ তত গভীর হচ্ছিল। সেই রাতেই প্রথমবার দীপ আর সোমা বুঝতে পারল—কখনও কখনও অতীতের স্মৃতিই ভবিষ্যতের বন্ধুত্ব গড়ে দেয়। এবং ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই তাদের দুজনের সম্পর্কের গলিত বরফ নতুনভাবে জমে উঠতে শুরু করল—আর তার ভেতরে লুকিয়ে থাকল এক অদ্ভুত প্রশান্তি, এক অদৃশ্য বোঝাপড়া, যা হয়তো আরও অনেক দূর পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাবে তাদের।

ছয়

সন্ধ্যার আলো তখন ধীরে ধীরে ঢলে পড়ছে শান্তিনিকেতনের পথের ওপর। চারপাশে যেন এক অদ্ভুত প্রশান্তি নেমে এসেছে—শাল-সেগুন গাছের ফাঁক দিয়ে গোধূলির হাওয়া বইছে, দূরে ডাহুকের ডাক শোনা যাচ্ছে। সোমা আর দীপ অনেকটা নীরব থেকে পাশাপাশি হাঁটছিল। তাঁদের চোখের সামনে ছড়িয়ে থাকা প্রান্তরের রঙিন আকাশ যেন তাঁদের ভিতরের আবেগকে নতুন করে রঙে ভরিয়ে তুলছিল। বেশ কিছুদিন ধরে তাঁরা নানা ঘটনার ভেতর দিয়ে গেছেন—ভয়, রহস্য, অনিশ্চয়তা—সব মিলিয়ে এক ঘন কুয়াশার মতো পরিবেশে ছিলেন। আজ সেই কুয়াশা যেন একটু একটু করে সরছে। দীপ হঠাৎ খেয়াল করে সোমার হাঁটার ভঙ্গি—সে যেন হালকা শাড়ির আঁচল আঁকড়ে ধরেছে, চোখ নামিয়ে রেখেছে মাটির দিকে, আর হালকা হাসি লুকোনো মুখে। এই মুহূর্তে দীপের মনে হলো—যদি কোনোদিন সে হারিয়ে ফেলে তবে ঠিক এভাবেই কাউকে খুঁজবে, যেমন সে সোমাকে খুঁজেছে নিজের জীবনের ভেতরে। এমন সময় একেবারেই অপ্রত্যাশিতভাবে সে হাত বাড়িয়ে সোমার হাত ধরে ফেলল। প্রথমে সোমা আঁতকে উঠল, যেন হঠাৎ কেউ তার একান্ত নিজস্ব জায়গায় প্রবেশ করেছে। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই সেই স্পর্শে তার বুকের ভেতর জমে থাকা দীর্ঘ দিনের শূন্যতা ভরে উঠল। দীপের হাতের উষ্ণতা যেন তাকে মনে করিয়ে দিল—এতদিন যে ভালোবাসা সে হারিয়েছে, আজ সেই ভালোবাসার নতুন সূচনা হচ্ছে। গোধূলির আলো, নিস্তব্ধতা আর তাদের নীরব পথচলা একসঙ্গে মিশে গিয়ে এক অদ্ভুত জাদু তৈরি করল।

সোমা ধীরে ধীরে দীপের দিকে চোখ তুলল। তার চোখে ভাসছিল অগণিত প্রশ্ন, আবার উত্তরহীন নিশ্চুপতা। দীপ কিছু বলল না, শুধু হাতটা শক্ত করে ধরে রাখল। সেই নীরবতাই যেন হয়ে উঠল হাজারো কথার সমান। জীবনে কতবার তারা নিজেদের হারিয়েছে, কতবার ভুল বোঝাবুঝির অন্ধকার তাদের ঘিরে ধরেছে—সবই যেন এই মুহূর্তে মিলিয়ে গেল। সোমা অনুভব করল, তার হৃদয়ের গভীরে এতদিন যা চেপে ছিল, আজ তা মুক্তি পেল। দীপের হাত ধরতে গিয়ে সে বুঝল, তাদের সম্পর্ক কোনো এক পুরোনো গাছের শেকড়ের মতো—যে শেকড় কখনও শুকিয়ে যায় না, মাটির গভীরে সবসময় বেঁচে থাকে। শুধু জলসিঞ্চনের অপেক্ষা থাকে, আর সেই সিঞ্চনই আজ ঘটেছে। তাদের হাঁটার গতি ধীরে হয়ে এল। হঠাৎ দীপ সিগারেট বার করে ধরাল, ধোঁয়ার পাক খেতে খেতে তাকাল সোমার চোখের দিকে। সেই ধোঁয়ার ফাঁক দিয়ে যেন ফুটে উঠছিল তাদের সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায়—যেখানে কোনো ভয় নেই, শুধু বিশ্বাস আর একে অপরকে হারানোর আতঙ্ক। সোমার মনে হলো, এতদিন যা সে নিজের ভিতরে একা বয়ে বেড়িয়েছে, আজ থেকে সে তা ভাগ করতে পারবে দীপের সঙ্গে। এই সহজ অথচ গভীর অনুভূতি তার গলা পর্যন্ত ভিজিয়ে দিল। কণ্ঠরোধ হয়ে গেল, তবু ঠোঁটে এক অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল।

দীপ হঠাৎ থেমে দাঁড়াল। আকাশ তখন রঙিন হয়ে উঠেছে, লাল, কমলা আর বেগুনির মিশেলে এক স্বপ্নীল ক্যানভাস। দূরে মাঠে কিছু গ্রাম্য ছেলে ক্রিকেট খেলছে, তাদের হাসির আওয়াজ বাতাস ভরিয়ে তুলেছে। কিন্তু এই ভিড়ের মাঝেও তাঁদের দুজনের চারপাশে যেন এক অদৃশ্য আবরণ তৈরি হলো, যেখানে অন্য কারো প্রবেশাধিকার নেই। দীপ ধীরে ধীরে বলল, “সোমা, হয়তো আমাদের গল্পটা অনেক আগেই শেষ হয়ে যেত… কিন্তু জানো, আমি সবসময় ভেবেছি—শেষ মানেই শেষ নয়। কোথাও না কোথাও আবার শুরুর অপেক্ষা থাকে।” সোমা কোনো উত্তর দিল না, শুধু দীপের হাতটা আরও শক্ত করে ধরল। তার চোখে জল জমে উঠছিল, কিন্তু সেই জল ছিল না দুঃখের—তা ছিল মুক্তির, তা ছিল নতুন করে বাঁচার ইচ্ছার। তাদের সামনে যে পথটা প্রসারিত হয়ে আছে, তা অজানা, অদ্ভুত, হয়তো আবারও বিপদের। তবু সেই পথে হাঁটার সাহস তারা খুঁজে পেল একে অপরের ভেতরে। এই মুহূর্তে তাদের কাছে সবকিছু গৌণ হয়ে গেল—গ্রামের রহস্য, অতীতের দুঃখ, অমীমাংসিত প্রশ্ন—সব কিছুর ওপরে উঠে দাঁড়াল কেবল এক সহজ সত্য: তারা আবার একে অপরকে খুঁজে পেয়েছে। আর সেই খোঁজই তাদের সম্পর্ককে নতুন জন্ম দিল—এক জন্ম, যেখানে স্পর্শই ভাষা, নীরবতাই প্রতিশ্রুতি, আর ভালোবাসাই একমাত্র দিশা।

সাত

দীর্ঘদিনের সংসারের ক্লান্তি, অফিসের চাপ, সন্তানের দায়িত্ব—সবকিছুর মাঝেই যেন অরিন্দম আর নন্দিতার সম্পর্ক একটু যান্ত্রিক হয়ে উঠেছিল। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা হত, কিন্তু তা প্রায়শই মৌকে নিয়ে বা ঘরের খরচ, বাজার, দায়িত্ব বা অফিসের ঝামেলা নিয়ে। একদিন নন্দিতা হঠাৎই বলেছিল, “আমাদের একটু বাইরে ঘুরে আসা দরকার। মৌকে যদি কয়েকদিন দিদার কাছে রেখে আসি, আমাদেরও একটা ছুটি হয়ে যাবে।” অরিন্দম চুপ করে তাকিয়ে ছিল তার স্ত্রীর দিকে। নন্দিতার চোখে এক ধরনের আকুতি আর ক্লান্তির ছাপ সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল। দীর্ঘদিন পর সে বুঝল, এই সম্পর্ককে আরও টেকসই করতে হলে তাদের দরকার নিজেদের জন্য কিছু সময়। অবশেষে মৌকে তার দিদার কাছে রেখে দু’জনে ঠিক করল পাহাড়ে যাবে। ট্রেনের জানালা দিয়ে গাছপালা, নদী, ছোট্ট ছোট্ট গ্রাম আর ফাঁকা মাঠ পেছনে চলে যাচ্ছিল, আর তারা দু’জন যেন সেই মুহূর্তে ফিরে যাচ্ছিল তাদের প্রথম দাম্পত্যদিনগুলিতে। পাহাড়ের হাওয়া, ট্রেনের দুলুনি আর দু’জনের একান্ত সঙ্গ তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাস ফিরিয়ে আনল। নন্দিতা জানলার ধারে বসে চুল উড়তে দিচ্ছিল বাতাসে, অরিন্দম তাকিয়ে ছিল তার সেই চেনা অথচ আজ যেন নতুন মনে হওয়া মুখের দিকে। মনে হচ্ছিল, জীবনের সমস্ত ক্লান্তি মুছে গিয়ে নতুন করে প্রেম জন্ম নিচ্ছে।

হোটেলের ঘরে ঢোকার পর দু’জনের নিঃশ্বাস যেন আরাম পেতে শুরু করল। বাইরে পাহাড়ের সবুজ, হিমেল হাওয়া আর ঘরের ভিতরে নিঃশব্দ একান্ততা—সবকিছু মিলিয়ে যেন এক নতুন জগৎ। তারা বুঝতে পারল, সংসারের ব্যস্ততা থেকে দূরে এই সময় তাদের কাছে অমূল্য। একসঙ্গে হাঁটাহাঁটি, একসঙ্গে ক্যামেরায় মুহূর্তগুলো ধরে রাখা, ছোট্ট রেস্টুরেন্টে গরম চা খাওয়া—সবই যেন তাদের দু’জনকে কাছে টেনে আনছিল। নন্দিতা কখনও হাত বাড়িয়ে অরিন্দমের আঙুল চেপে ধরছিল, অরিন্দম হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে থাকত। তারা একে অপরকে নতুন করে আবিষ্কার করছিল, যেন বহুদিনের বন্ধুত্বের ভেতর হঠাৎ আবার প্রেমের রঙ ফুটে উঠেছে। রাতে হোটেলের বারান্দায় বসে তারা পাহাড়ি অন্ধকারের ভেতরে ঝলমলে আলো দেখতে দেখতে নিজেদের পুরোনো দিনের কথা তুলল। প্রথমবার কলেজে দেখা, প্রথম ডেট, প্রথম প্রেমের চিঠি—সবকিছু যেন আবার জীবন্ত হয়ে উঠল। এই আলো-আঁধারি সময়ে তাদের মধ্যে জমে থাকা অস্বস্তি, অবহেলা কিংবা ভুল বোঝাবুঝি গলে গিয়ে জায়গা করে নিল আন্তরিকতা। সেই রাতের নিঃশব্দতায় দু’জনের চোখের ভাষা অনেক কিছু বলেছিল, যা মুখে উচ্চারণ করার প্রয়োজন পড়েনি। অরিন্দমের হাত নন্দিতার কাঁধে যখন নেমে এল, নন্দিতা মাথা রাখল তার বুকে—সেই অনুভূতি যেন বহুদিনের তৃষ্ণা মিটিয়ে দিল।

কয়েকদিনের সেই ছুটি তাদের সম্পর্ককে এক অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিল। তারা বুঝল, দাম্পত্য মানে শুধু দায়িত্ব বা অভ্যাস নয়, এর ভেতরে আছে প্রেম, আকাঙ্ক্ষা, আর শরীরের পাশাপাশি মনের গভীর সংযোগ। সকালে পাহাড়ি পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে, দুপুরে একসঙ্গে কোনো নির্জন জলপ্রপাতের পাশে বসে কিংবা রাতে শীতল বাতাসে একে অপরের কাছে জড়িয়ে—প্রতিটি মুহূর্তে তারা খুঁজে পেল নতুন রসায়ন। সেই দিনগুলোয় তারা শুধু স্বামী-স্ত্রী ছিল না, ছিল প্রেমিক-প্রেমিকা, যারা একে অপরের স্পর্শে, চাহনিতে আর উষ্ণতায় খুঁজে পায় জীবনের অর্থ। নন্দিতা মনে মনে ভাবল, এত বছর পরেও তার অরিন্দমকে সে নতুন করে চিনতে পারছে, যেন প্রেমের রং আরও গাঢ় হচ্ছে। অরিন্দমও উপলব্ধি করল, সংসারের চাপের ভেতর যতই সম্পর্ক ক্লান্ত হয়ে পড়ুক, একান্ত মুহূর্তই পারে সেই সম্পর্ককে আবার জীবন্ত করে তুলতে। ছুটির শেষ দিন সকালে বারান্দায় দাঁড়িয়ে যখন তারা পাহাড়ি কুয়াশার দিকে তাকাচ্ছিল, দু’জনের মনেই একই ভাবনা—এ অভিজ্ঞতা তারা কখনো ভুলতে পারবে না। একে অপরকে নিঃশব্দে প্রতিশ্রুতি দিল, যত ব্যস্ততাই আসুক জীবনে, মাঝে মাঝে এমনই নিজেদের জন্য সময় বের করবে। এই ছুটি তাদের জীবনে শুধু আনন্দের স্মৃতি নয়, তাদের সম্পর্কের ভিতকে আরও দৃঢ় করার এক অপরিসীম অভিজ্ঞতা হয়ে থেকে গেল।

আট

প্রথমে তাদের মধ্যে যে কথোপকথন চলছিল, তার ভেতরে লুকিয়ে ছিল অনেক অপ্রকাশিত ব্যথা, শূন্যতা আর আকাঙ্ক্ষা। দীপ দীর্ঘদিন ধরে শুধু দায়িত্ব আর সমাজের চাপে নিজেকে বেঁধে রেখেছিল—তার ভাবনা ছিল, সম্পর্ক মানেই সুরক্ষার ছাতা, ভালোবাসা মানেই একধরনের দায়িত্ব পালন। কিন্তু সেই রাতের নীরবতায়, যখন সোমা তার চোখের দিকে গভীরভাবে তাকাল, দীপ হঠাৎ অনুভব করল শরীরের ভেতর এক নতুন উষ্ণতা। এই উষ্ণতা কোনো দায়িত্বের নয়, কোনো বাধ্যবাধকতার নয়, বরং এক অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণের, যা তাদের দু’জনকে এক অদৃশ্য সুতোর মতো টেনে আনছিল কাছাকাছি। সোমার মুখে স্নিগ্ধ আলো, চোখে লুকোনো বহুদিনের এক গোপন আকাঙ্ক্ষা দীপকে কাঁপিয়ে দিল। তাদের আলাপ ধীরে ধীরে রূপ নিল অঙ্গভঙ্গিতে—চোখে চোখ রাখা, হাত ছোঁয়া, নিশ্বাসের ভেতরে অনুরণিত হওয়া অদ্ভুত স্পন্দনে। কথার বাইরে গিয়ে এই দেহী টানই যেন প্রমাণ করল, মানুষের হৃদয় শুধু দায়িত্বে নয়, ভালোবাসার স্পর্শেও জীবিত হয়ে ওঠে।

সোমার ভেতরে দীর্ঘদিন ধরে ঘুমিয়ে থাকা নারীসত্ত্বা আস্তে আস্তে জেগে উঠছিল। সংসারের যন্ত্রণা, দমবন্ধ করা শূন্যতা, সমাজের কঠোর চোখ—সবকিছুই তাকে আড়াল করে রেখেছিল এক নিঃসঙ্গ খোলসে। কিন্তু দীপের কাছে এসে হঠাৎ সে বুঝল, তার ভেতরে এখনো আছে অনুভব করার শক্তি, ভালোবাসার ক্ষমতা, আকাঙ্ক্ষার ঝড়। দীপের কণ্ঠের দৃঢ়তা, চোখের আন্তরিকতা, আর শরীরের উষ্ণতা তাকে মনে করাল যে সে কেবল এক মেয়ে নয়, সে নারী—যে ভালোবাসতে পারে, পেতে পারে, দিতে পারে। দীপের আঙুল তার চুলে ছুঁয়ে গেলে সে মনে করল যেন বহু বছর ধরে হারিয়ে ফেলা এক অমূল্য সম্পদ ফের ফিরে এসেছে। তার মনে হলো, এটাই সেই মুহূর্ত, যখন সে আবার নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাবে। এ শুধু শারীরিক স্পর্শ নয়, বরং নিজের ভেতরে চাপা পড়ে থাকা জীবনীশক্তির পুনর্জন্ম।

এই আবিষ্কারের যাত্রায় দীপ ও সোমা দু’জনই যেন একে অপরের আয়না হয়ে দাঁড়াল। দীপ বুঝতে পারল, তার জীবনের গাম্ভীর্য আর একাকিত্বে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, সেটি পূর্ণ করতে পারে না কোনো দায়িত্বের সাফল্য বা সমাজের স্বীকৃতি। তার প্রয়োজন ছিল একজন মানুষ, যার চোখে সে নিজের সত্যিকারের অস্তিত্ব দেখতে পাবে। সোমার কাছে এসে সে দেখল, ভালোবাসা মানে আত্মসমর্পণ নয়, বরং পরস্পরের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা সত্ত্বাকে জাগিয়ে তোলা। অন্যদিকে, সোমা খুঁজে পেল নিজের শক্তি—সে জানল, তার নারীসত্ত্বা কখনোই নিঃশেষ হয়ে যায়নি, বরং অপেক্ষা করছিল সঠিক মুহূর্তের। তাদের এই মিলনে তাই কেবল শরীর নয়, মনেরও পুনর্জন্ম ঘটল। তারা আবিষ্কার করল—আকাঙ্ক্ষা কোনো পাপ নয়, বরং মানুষের ভেতরে বেঁচে থাকার এক অমূল্য শক্তি। এই শক্তিই তাদের নতুন করে পথ দেখাবে, নতুন করে জীবনকে ভালোবাসতে শেখাবে।

নয়

দাম্পত্য জীবনের দীর্ঘ কয়েক বছর পার করার পর অর্পিতা ও সোহমের জীবন একসময় যেন ছকবাঁধা হয়ে গিয়েছিল। সকালে অফিস, দুপুরে দায়িত্ব, সন্ধ্যায় সন্তান সামলানো আর রাতে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় ঢলে পড়া—এই রুটিনেই আটকে গিয়েছিল তাদের সম্পর্ক। মাঝেমধ্যে মনে হতো, প্রেমটা যেন কোথাও চাপা পড়ে গেছে, দায়িত্বের বোঝা তাকে ঢেকে দিয়েছে। তবুও একদিন হঠাৎ করেই তারা বুঝতে পারে, সংসার মানেই একঘেয়েমি নয়; বরং এর ভিতরেই আছে এক নতুন প্রেম খুঁজে পাওয়ার পথ। তাদের ছোট ছেলে স্কুলে গিয়েছে, বাড়ি ফাঁকা, আর এই নিস্তব্ধতার মাঝেই তারা প্রথমবারের মতো পরস্পরের দিকে তাকিয়ে বুঝেছিল—কিছু একটা হারিয়ে গিয়েছে, আবার সেটাই ফিরে পেতে হবে। সোহম চায়ের কাপ হাতে বসে বলেছিল, “তুমি খেয়াল করেছ? আমরা অনেকদিন একসাথে গল্পই করিনি, শুধু দু’জনের।” অর্পিতা তখন হেসে ফেলেছিল, যেন সে নিজের অজান্তেই সেই শূন্যতা টের পাচ্ছিল। সেই মুহূর্ত থেকে ধীরে ধীরে তারা শিখতে শুরু করল কীভাবে দায়িত্বের ভেতরেও সম্পর্ককে আলাদা জায়গা দেওয়া যায়, কীভাবে প্রেম আবার নতুন রূপে ফিরে আসে যখন দুইজন মানুষ সেটিকে খুঁজতে চায়।

এরপরের দিনগুলোতে ছোট ছোট অভ্যাসে বদল আনতে শুরু করল তারা। সোহম অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত হলেও অর্পিতাকে জিজ্ঞাসা করত, “আজ তোমার দিন কেমন গেল?”—যে প্রশ্ন আগে কখনো হয়তো তেমন গুরুত্ব পেত না। অর্পিতাও রান্নার ফাঁকে হঠাৎ সোহমের পছন্দের গান চালিয়ে দিত, আর তারা একসাথে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে গুনগুন করত। ছেলের হোমওয়ার্ক শেষ হয়ে গেলে তিনজন মিলে বসে লুডো খেলত, কিন্তু খেলার মাঝেই অর্পিতা আর সোহমের মধ্যে সেই পুরোনো ঠাট্টা-তামাশা আবার ফিরে আসতে শুরু করল। তারা বুঝল, সংসারের বোঝা বয়ে নেওয়ার পাশাপাশি যদি নিজেদের জন্য একটু সময় আলাদা করে রাখা যায়, তাহলে সেই সময়ই সম্পর্কের নতুন রূপ দেয়। একদিন রাতে, জানলার ধারে বসে, সোহম হঠাৎ অর্পিতার হাত ধরে বলেছিল, “আমরা কি আবার প্রথম দিনের মতো হতে পারি?”—অর্পিতার চোখ ভিজে উঠেছিল, কিন্তু তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠেছিল। এই মুহূর্তগুলো প্রমাণ করছিল, সংসার শুধু দায়িত্ব নয়, বরং প্রতিদিনের ভেতরেই প্রেমকে নতুনভাবে খুঁজে নেওয়ার যাত্রা।

ক্রমশ তারা শিখতে শুরু করল, ভালোবাসা মানে শুধু রোমান্টিক মুহূর্ত নয়, বরং প্রতিদিনের সঙ্গও। একসাথে বাজার করা, বৃষ্টির দিনে ভিজে ভিজে ছাতার নিচে হাঁটা, কিংবা স্রেফ রবিবার বিকেলে ছাদে বসে এক কাপ চা খাওয়া—এসব ছোট ছোট মুহূর্ত তাদের সম্পর্ককে ভিন্ন আলোয় দেখাতে শিখিয়েছিল। সন্তান, পরিবার, দায়িত্ব সব রয়ে গেল, কিন্তু তার ভেতরে তারা নিজেদের জন্য আলাদা এক কোণ খুঁজে নিল। সেই কোণে ছিল হাসি, ছিল নীরবতা, ছিল পুরোনো দিনের স্মৃতি আর নতুন দিনের পরিকল্পনা। অর্পিতা ভাবত, “এই জায়গাটা আমাদের দু’জনের, কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।” আর সোহম মনে করত, “প্রেম আসলে শেষ হয় না, শুধু তার রূপ বদলায়।” তাদের সম্পর্ক যেন এক নদী, যার স্রোত কখনো শান্ত, কখনো উত্তাল, কিন্তু নদী কখনো শুকিয়ে যায় না। তারা শিখল—সংসারের ভেতরেও প্রেমকে নতুন করে খুঁজে পাওয়া যায়, যদি দু’জনেই সেই চেষ্টা করে। আর এই রূপান্তরের মধ্য দিয়েই তারা আবিষ্কার করল—প্রেম মানে একসাথে থাকা, প্রতিদিনের ভেতরে নতুনকে খুঁজে নেওয়া, আর জীবনের শেষ অবধি একে অপরকে বারবার নতুন করে চিনে নেওয়া।

দশ

সন্ধ্যার আলো ধীরে ধীরে অন্ধকারের দিকে ঝুঁকছিল। জানালার কাচে বৃষ্টির ফোঁটা জমে তৈরি হচ্ছিল এক অদ্ভুত নকশা। সোমা চুপচাপ বসে ছিল বারান্দায়, হাতে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা, আর তার চোখের ভেতর যেন লুকিয়ে ছিল বহুদিনের অনুচ্চারিত প্রশ্ন। দীপ পাশেই দাঁড়িয়ে সিগারেটে টান দিচ্ছিল, ধোঁয়া ভেসে যাচ্ছিল অন্ধকারের দিকে। এতদিনের সংসার জীবনে তারা একসাথে থেকেছে, দায়িত্ব ভাগাভাগি করেছে, খুঁটিনাটি ঝগড়া আর মিষ্টি মুহূর্তের ভিড়ে দিন কেটেছে। তবুও মাঝে মাঝে মনে হতো—কোথাও একটা শূন্যতা থেকে যাচ্ছে। সেই শূন্যতার নামই তারা দু’জন মনের ভেতরে দিয়েছিল “অজানা।” দীপ ভেবেছিল হয়তো সোমার মনে অন্য কারও জন্য জায়গা তৈরি হচ্ছে, আর সোমা ভেবেছিল দীপের দৃষ্টি কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ সেই অজানা ছিল না বাইরের কারও উপস্থিতি, বরং তাদের দু’জনের ভেতরে জমে থাকা দূরত্ব, যেটা তারা এতদিন বুঝতে পারেনি। আজকের রাতে, বৃষ্টির শব্দ আর কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া যেন তাদের মনে এক নতুন উপলব্ধি জাগিয়ে তুলল—অজানার টান মানে বাইরে নয়, ভেতরে; একে অপরকে নতুন চোখে দেখার টান।

সোমা এক মুহূর্তের জন্য দীপের দিকে তাকাল। তার চোখে ক্লান্তি থাকলেও সেখানে লুকিয়ে ছিল এক অদ্ভুত কোমলতা। দীপ হয়তো বুঝতে পারছিল, এই মুহূর্তে কোনো এক অদৃশ্য সুতো তাদের দু’জনকে একসাথে বেঁধে ফেলছে। বহু বছর আগে প্রথমবার যখন তারা একে অপরকে চিনেছিল, সেই প্রথম দেখার বিস্ময়, কিশোরসুলভ আকর্ষণ আর উচ্ছ্বাস যেন আবার ফিরে আসছিল। দীপ ধীরে ধীরে সোমার হাতটা ধরল—যে হাতের সঙ্গে একসময় অসংখ্য প্রতিজ্ঞা, স্বপ্ন আর ভালোবাসা জড়িয়ে ছিল, কিন্তু সময়ের দৌড়ে যেটা অনেকদিন ধরে নিঃশব্দে শক্ত হয়ে গিয়েছিল। সোমা সেই স্পর্শে চমকে উঠল, আবার হাসলও। এই হাসির ভেতরেই লুকিয়ে ছিল স্বস্তি, স্বীকৃতি আর পুরোনো প্রেমের সজীবতা। তারা বুঝতে পারল, দাম্পত্য জীবনের আসল শক্তি বাইরের প্রলোভন এড়িয়ে চলায় নয়, বরং একে অপরকে বারবার নতুন করে খুঁজে পাওয়ায়। বাইরের পৃথিবী যতই বদলাক, যতই টান আসুক, সত্যিকারের প্রেমের টান সবসময় ভেতর থেকেই জন্ম নেয়। আর সেই প্রেম যখন আবার বন্ধুত্বের সঙ্গে মিশে যায়, তখন তা হয়ে ওঠে জীবনের এক অনন্য মুক্তি।

রাত যখন গভীর হলো, বাড়ির ভেতর শুধু ঘড়ির টিকটিক শব্দ আর বৃষ্টির থেমে থেমে পড়া ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। সোমা আর দীপ একসাথে বসেছিল সোফায়, হাত ধরে, যেন নতুন করে পরিচয় ঘটছে তাদের। দু’জনেই মনে মনে অনুভব করছিল—এই যাত্রা আবার শুরু হলো। হয়তো আগামী দিনে নতুন সমস্যাও আসবে, অজানা ভয়ও সামনে দাঁড়াবে, কিন্তু আজকের এই মুহূর্ত তাদের মনে করিয়ে দিল—অজানার টান বাইরের কাউকে খোঁজার নয়, বরং একে অপরের চোখে নতুন আলো আবিষ্কার করার। তাদের চোখে চোখ রেখে যে নিঃশব্দ প্রতিজ্ঞা বিনিময় হলো, সেটাই ছিল সত্যিকার প্রেমের পুনর্জন্ম। বহুদিনের দাম্পত্য জীবনে আবারও প্রেমের উচ্ছ্বাস, আকাঙ্ক্ষা আর বন্ধুত্ব খুঁজে পাওয়া—এটাই হয়ে উঠল তাদের জীবনের আসল জয়, তাদের সত্যিকারের মুক্তি।

শেষ

1000060525.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *