অর্পিতা ঘোষ
১
শ্রেয়সীর ট্রেন যখন ধীরে ধীরে নতুন শহরের প্ল্যাটফর্মে থামল, তার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক টান অনুভূত হলো। এই শহরে তার আগে কখনও আসা হয়নি, এমনকি এই শহরের নামও শুধু সংবাদপত্র আর অফিসের নিয়োগপত্রে পড়েছে। ব্যস্ত রেলস্টেশনে নামতেই ভিড়, কোলাহল, হট্টগোল আর অচেনা চেহারার ভিড়ে নিজেকে একেবারে হারিয়ে ফেলল সে। এক হাতে ছোটো স্যুটকেস আর কাঁধে ল্যাপটপ ব্যাগ ঝুলিয়ে যখন রিকশাওয়ালাদের ডাক, ট্যাক্সিচালকদের জোরাজুরি সামলাতে গিয়ে হাঁসফাঁস করছে, তখন হঠাৎ মনে পড়ল—এখানে তাকে দেখার মতো বা নিতে আসার মতো কোনো পরিচিত মানুষ নেই। শহরের আকাশচুম্বী বিলবোর্ড, নতুন গন্ধের মিশ্রণ, রাস্তার ধুলোমাখা হাওয়া আর ছুটে চলা মানুষের ভিড়—সবকিছু যেন একসাথে তার ওপর চেপে বসছে। অফিস থেকে দেওয়া ফ্ল্যাটের ঠিকানাটা ফোনে বারবার দেখে নিয়ে সে অবশেষে একটি ক্যাবে উঠল, জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখতে লাগল শহরটা। রাস্তার দুই ধারে আলো-ঝলমলে দোকান, ছোটখাটো খাওয়ার হোটেল, হর্নের শব্দে কানে ঝনঝন—কিছুই তাকে আপন মনে হলো না। বরং প্রতিটি আলো আর প্রতিটি মুখ যেন তার নিঃসঙ্গতার কথাই তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল।
ফ্ল্যাটে পৌঁছে যখন দরজা খুলল, ভেতরে ঢুকেই এক অদ্ভুত নির্জনতা তাকে আচ্ছন্ন করল। আধুনিক সাজানো একটি একতলা ফ্ল্যাট—চকচকে মেঝে, সাদা রঙের দেওয়াল, একটি ছোটো বারান্দা আর স্যাঁতসেঁতে গন্ধমাখা ঘর। সবকিছু সুন্দর হলেও তাতে কোনো উষ্ণতা নেই। ঘরে কেউ নেই যে বলবে “চা খেয়ে নাও” কিংবা “তুমি ক্লান্ত হয়ে এসেছ, বিশ্রাম নাও।” ব্যাগ ফেলে দিয়ে যখন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সে শহরের রাতের আলো দেখতে লাগল, তার মনে হলো এই শহর কতটা অপরিচিত, অথচ একইসাথে কতটা অদম্য। ব্যস্ত রাস্তায় মানুষ ছুটছে, গাড়ির আলো একটার পর একটা ছুটে যাচ্ছে, দূরের কোনো হোটেল থেকে ভেসে আসছে গান, আর বারান্দার নিচে ভেজা মাটির গন্ধ—এসব কিছুর ভেতরও শ্রেয়সী খুঁজে পেল নিঃসঙ্গতার সুর। সে জানে এই শহরে তাকে নিজের জায়গা করে নিতে হবে, নতুন মানুষদের সাথে কাজ শিখতে হবে, সম্পর্ক গড়তে হবে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেই পথচলা কতটা কঠিন। বুকের ভেতর হালকা শূন্যতা তৈরি হলো, যেটা তাকে আরো বেশি অসহায় করে দিল।
হঠাৎ ফোন বেজে উঠল—মায়ের নাম ভেসে উঠলো স্ক্রিনে। ফোন ধরতেই মায়ের পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে তার চোখ ভিজে এলো। মা বললেন, “পৌঁছেছ ঠিকঠাক? ফ্ল্যাট ভালো আছে তো? খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করবে কিন্তু।” শ্রেয়সী নরম গলায় উত্তর দিল, “হ্যাঁ মা, সব ঠিক আছে।” কিন্তু এই কথার আড়ালে যে কতটা অস্বস্তি আর একাকীত্ব লুকিয়ে আছে, সেটা মা টের পেলেও দূরত্বের কারণে বুঝতে পারলেন না। মা সান্ত্বনা দিতে বললেন, “চিন্তা করিস না, কিছুদিনের মধ্যেই অভ্যস্ত হয়ে যাবি।” ফোন কেটে যাওয়ার পর ঘরে আবার সেই নির্জনতা নেমে এলো, যেন দেওয়ালগুলোও ফিসফিস করে বলছে—“তুই একা।” বিছানায় শুয়ে সে শহরের গুঞ্জন শুনতে লাগল, মাথার ভেতর ভবিষ্যতের নানা চিন্তা ভিড় করল। নতুন কাজ, নতুন মানুষ, নতুন চ্যালেঞ্জ—সবকিছু তাকে একসাথে শ্বাসরুদ্ধ করে তুলল। তবুও ভেতরে ভেতরে সে জানত, একদিন এই অচেনা শহরই হয়তো তাকে নতুন কোনো গল্প উপহার দেবে। সেই আশাতেই চোখের পাতায় অচেনা অন্ধকার নেমে এল, আর শ্রেয়সী নিজের অস্থির হৃদয়কে সান্ত্বনা দিয়ে ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ল।
২
সকালে অ্যালার্ম বেজে ওঠার অনেক আগেই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল শ্রেয়সীর। নতুন শহরের নতুন অফিস—সবকিছু যেন বুকের ভেতর এক অদ্ভুত ধড়ফড়ানি তৈরি করেছিল। জানালার বাইরে তাকিয়ে সে দেখল শহরটা তখনও পুরোপুরি জেগে ওঠেনি, কিন্তু দূরের রাস্তায় টুকটুক শব্দে অটো চলতে শুরু করেছে, দোকানের ঝাঁপ উঠছে, আর আকাশে ভেসে আসছে সকালের ধোঁয়া আর ভেজা হাওয়ার গন্ধ। সে ধীরে ধীরে প্রস্তুত হতে লাগল—গাঢ় নীল রঙের শার্ট, কালো প্যান্ট, আর পরিপাটি চুল বাঁধা; আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করল। “আজকের দিনটা আমাকে পার করতেই হবে,” মনে মনে বলল সে। অফিসে যাওয়ার পথে গাড়ির ভিড়, ব্যস্ত মানুষের ছুটোছুটি আর উঁচু ভবনের সারি যেন এক অদ্ভুত চাপ তৈরি করছিল। গাড়ির জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে সে দেখতে লাগল রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ফলওয়ালা, স্কুলে যাওয়া বাচ্চাদের দল, আর ফুটপাথে দ্রুত হেঁটে চলা চাকরিজীবীদের মুখে এক অদম্য তাগিদ। যেন সবাই এই শহরের বিশাল ছন্দে নিজের নিজের জায়গা করে নেওয়ার জন্য প্রাণপণ দৌড়াচ্ছে।
অফিসের দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই শ্রেয়সীর মনে হলো সে যেন অন্য এক জগতে এসে পড়েছে। চকচকে লিফট, উজ্জ্বল আলোকসজ্জা, দেয়ালে ঝুলন্ত অফিসের লোগো—সবকিছুতেই ছিল একটা জাঁকজমক। রিসেপশনে নিজের নাম বলতেই তাকে একটা ভিজিটর কার্ড দেওয়া হলো, আর সাথে এক হালকা হাসি। তবে ভেতরে ঢুকতেই বিশাল ফ্লোরের চারদিকে কম্পিউটারের শব্দ, মানুষের হাঁটাহাঁটি, আর ব্যস্ত কণ্ঠস্বর যেন একসাথে কানে বাজতে লাগল। তার মনে হলো সে যেন একটা বিশাল সমুদ্রে ভেসে এসেছে যেখানে স্রোত তাকে যে কোনো দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। সহকর্মীদের কেউ কেউ প্রথম দেখাতেই আন্তরিক হাসি দিয়ে অভ্যর্থনা জানাল, কেউ আবার কেবল মাথা নেড়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কেউ কৌতূহলভরা দৃষ্টি দিল—কে নতুন এল, কোথা থেকে এল, তার যোগ্যতা কী। এই অচেনা পরিবেশে দাঁড়িয়ে শ্রেয়সীর বুক কেঁপে উঠল; মনে হলো যেন সবাই তাকে মেপে দেখছে, বিচার করছে। তবুও ভেতরে ভেতরে নিজেকে শক্ত করে সে ডেস্কে বসে পড়ল, ল্যাপটপ খুলে কাজ শুরু করার ভান করল।
কিছুক্ষণ পর টিম মিটিং শুরু হলো। বড় কনফারেন্স রুমে গিয়ে সবাই জায়গা নিল, আর সেখানেই প্রথমবার শ্রেয়সীর আনুষ্ঠানিক দেখা হলো অর্ণবের সঙ্গে। ধূসর শার্ট, গম্ভীর অথচ উষ্ণ দৃষ্টি, আর সংযত ভঙ্গিতে কথা বলছিলেন তিনি—যেন অস্থির পরিবেশকেও শান্ত করতে জানেন। মিটিং চলাকালীন অর্ণব যখন নতুন প্রোজেক্টের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন, তার কণ্ঠে ছিল আত্মবিশ্বাস আর অভিজ্ঞতার ছাপ। শ্রেয়সী অবাক হয়ে দেখল, অফিসের ব্যস্ততা আর প্রতিযোগিতার মাঝেও তার মধ্যে কোনো অস্থিরতা নেই, বরং তিনি যেন চারপাশের অস্থিরতাকে শুষে নিয়ে স্থিরতার আবরণ ছড়িয়ে দিচ্ছেন। মিটিং শেষে অর্ণব হালকা হাসি দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি নতুন এসেছ তো? আমি অর্ণব, তোমার সিনিয়র। কোনো সমস্যায় পড়লে বলতে দ্বিধা কোরো না।” এত অচেনা মুখের ভিড়ে এই প্রথমবার শ্রেয়সীর মনে হলো কেউ তাকে সত্যিই বুঝতে চাইছে। সামান্য কয়েকটা কথা, অথচ তাতেই তার বুকের ভেতর একটা আশ্বাস জন্ম নিল। যদিও অফিসের প্রতিযোগিতামূলক বাতাস তাকে ভয় দেখাচ্ছিল, কিন্তু এই একটুকরো সংযত আশ্বাস যেন তাকে ধীরে ধীরে শ্বাস নিতে শেখালো। অচেনা শহরের ভিড়ে প্রথমবার শ্রেয়সী টের পেল—হয়তো এখানে কেউ একজন তার জন্য অপেক্ষা করছে।
৩
প্রথম কয়েকদিনের মধ্যেই শ্রেয়সী বুঝতে পেরেছিল, এই অফিসের পরিবেশ কেবল বাহ্যিক চাকচিক্যে ভরা নয়—এখানে প্রতিটি দিনই যেন এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতার মঞ্চ। নতুন কর্মী হওয়ায় তাকে প্রথম থেকেই নানা দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছিল, যার বেশিরভাগই প্রমাণ করার জন্য যে সে কতটা সক্ষম। সেদিন সকালে তার টিম লিডার হঠাৎই জানালেন, বিকেলের ক্লায়েন্ট মিটিংয়ে তাকে একটি প্রেজেন্টেশন দিতে হবে। খবরটা শুনেই শ্রেয়সীর বুক ধড়ফড় করতে শুরু করল। নতুন শহর, নতুন অফিস, আর প্রথমবার এত গুরুত্বপূর্ণ প্রেজেন্টেশন—সে যেন পুরোপুরি হতবাক হয়ে গেল। হাতে মাত্র কয়েক ঘণ্টা সময়, অথচ ডেটা অগোছালো, স্লাইডের ফর্ম্যাট ঠিক নেই, আর তার নিজের মনই অস্থিরতায় কাঁপছে। ডেস্কে বসে কীবোর্ডে আঙুল চালাতে গিয়েও বারবার ভুল করতে লাগল, মাঝে মাঝে চশমার ভেতর দিয়ে ঝাপসা হয়ে আসা চোখের জল সামলাতে হলো। সহকর্মীদের কেউ কেউ পাশ দিয়ে যেতে যেতে মুচকি হাসল, কেউ বা কটাক্ষ করল—“এত তাড়াহুড়ো করছে, দেখা যাক কেমন করে সামলায়।” চারপাশের শব্দ, চাপ আর কটাক্ষের ভেতর শ্রেয়সীর মনে হলো সে যেন অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে।
ঠিক তখনই অর্ণব পাশ দিয়ে হেঁটে আসছিলেন। তিনি থমকে দাঁড়ালেন, কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন শ্রেয়সীর অস্থির মুখের দিকে। তারপর শান্ত গলায় বললেন, “তুমি কি প্রেজেন্টেশন নিয়ে সমস্যায় আছো?” শ্রেয়সী দ্বিধাভরা চোখে তাকাল, উত্তর দেওয়ার আগেই তার গলা বুজে এল। অর্ণব চেয়ার টেনে তার পাশে বসলেন, ল্যাপটপের স্ক্রিনে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন, তারপর একেবারেই অল্প কথায় বললেন, “দেখো, তোমার মূল তথ্যগুলো ঠিক আছে, কিন্তু উপস্থাপনার ধরণটা সহজ করতে হবে। অতিরিক্ত ডেটা বাদ দাও, মূল পয়েন্ট তিনটে রাখো—এটাই যথেষ্ট। আর স্লাইডের ডিজাইন নিয়ে বেশি ভাববে না, শুধু পরিষ্কার রাখলেই হবে।” শ্রেয়সী বিস্মিত হয়ে দেখল, যেই কাজটা সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভেবে বের করতে পারছিল না, অর্ণব কয়েক মিনিটেই বুঝিয়ে দিলেন। তাছাড়া তার ভঙ্গিতে কোনো তাচ্ছিল্য নেই, নেই কোনো অহংকার—শুধু নিঃশব্দে সাহায্য করার আন্তরিকতা। শ্রেয়সীর মনে হলো, এই শহরে অন্তত একজন আছে যে তার অস্থিরতাকে বোঝে, যে তাকে ব্যর্থতার ভয় না দেখিয়ে বরং ভরসা দিচ্ছে।
বিকেলের মিটিং শুরু হলো। কনফারেন্স রুমে বসে থাকা ক্লায়েন্ট আর টিমের সিনিয়রদের সামনে দাঁড়িয়ে শ্রেয়সীর হাত কাঁপছিল, গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু অর্ণবের দেওয়া পরামর্শ মনে করে সে গভীর শ্বাস নিল। স্লাইড বদলাতে বদলাতে প্রতিটি পয়েন্ট সহজ করে ব্যাখ্যা করল, জটিল ভাষার বদলে ব্যবহার করল সহজ বাক্য, আর নিজের কণ্ঠে ঢালল আত্মবিশ্বাস। অবাক হয়ে সে নিজেই টের পেল—যে কাজটা সকাল পর্যন্ত অসম্ভব মনে হচ্ছিল, তা সে নিখুঁতভাবে করে ফেলল। প্রেজেন্টেশন শেষে ক্লায়েন্টরা প্রশংসা করল, টিম লিডার মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন, আর সহকর্মীদের কটাক্ষের জায়গায় এবার ভেসে উঠল খানিকটা অবাক দৃষ্টি। শ্রেয়সীর চোখ চলে গেল অর্ণবের দিকে—তিনি চুপচাপ বসে আছেন, ঠোঁটে হালকা হাসি। সেই হাসিতে ছিল না কোনো দাম্ভিকতা, বরং ছিল এক অদ্ভুত আশ্বাস, যেন তিনি আগে থেকেই জানতেন শ্রেয়সী পারবে। অফিস থেকে বের হয়ে শ্রেয়সীর মনে হলো, এই বিশাল অচেনা শহরটা হঠাৎ করেই একটু আপন হয়ে উঠেছে। কারণ আজ সে বুঝতে পারল—অন্তত একজন আছে, যে তাকে শুধু সহকর্মী নয়, মানুষ হিসেবেও বুঝতে পারে। আর এই অনুভূতিটাই তার কাছে ছোটো হলেও সবচেয়ে বড়ো প্রভাব ফেলল।
৪
সেদিন অফিসের কাজ শেষ হলো যথেষ্ট দেরিতে। ক্লান্ত শরীর আর ভেতরের চাপ নিয়ে শ্রেয়সী লিফট থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াল। সন্ধ্যার শহর তখনো ব্যস্ত—রাস্তায় গাড়ির ভিড়, হর্নের শব্দ, দোকানের উজ্জ্বল আলো আর মানুষের ভিড়ভাট্টা মিলেমিশে এক অস্থির পরিবেশ তৈরি করছিল। অফিসের ক্যান্টিনে খাওয়ার ইচ্ছে হয়নি, তাই হাঁটতে হাঁটতে সে রাস্তার ধারে একটা ছোট্ট ক্যাফেতে ঢুকে পড়ল। ক্যাফেটি তেমন চেনা নয়, তবে ভেতরের উষ্ণ আলো আর হালকা গানের সুর তাকে স্বস্তি দিল। জানালার পাশে বসে কফি অর্ডার করে সে ব্যাগ থেকে বই বের করল, যদিও পড়ায় মন বসছিল না। হঠাৎ করেই মনে হচ্ছিল এই শহরটা তার চারপাশে একটা খোল তৈরি করেছে, যেখানে সে শুধু একা একা নিঃশ্বাস ফেলে যাচ্ছে। কফি আসতেই সে চুমুক দিল, গরম ধোঁয়াটে কাপে যেন কিছুটা সান্ত্বনা খুঁজে পেল। ঠিক তখনই কানে এলো পরিচিত কণ্ঠ—“তুমি এখানে?” মাথা ঘুরিয়ে অবাক হয়ে দেখল অর্ণব দাঁড়িয়ে আছে, হাতে কফির কাপ, চোখে তার স্বভাবসিদ্ধ শান্ত দৃষ্টি। শ্রেয়সীর মনে হলো অজানা ভিড়ের ভেতর হঠাৎ করে পরিচিত কারও মুখ দেখা দেওয়ার মতো এক আশ্চর্য প্রশান্তি নেমে এসেছে।
অর্ণব বিনা দ্বিধায় সামনে চেয়ারে বসে পড়ল। দু’জনের মধ্যে কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছিল না, বরং তার ভঙ্গিতে ছিল একধরনের স্বাভাবিকতা, যেন তিনি এমনিতেই বসে গল্প শুরু করতে পারেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর তিনি হেসে বললেন, “তোমাকে খুব টেনশন নিতে দেখাচ্ছিল গত ক’দিন। কাজের চাপ সামলাতে কষ্ট হচ্ছে বুঝি?” শ্রেয়সী একটু ইতস্তত করে উত্তর দিল, “হ্যাঁ, নতুন জায়গা, নতুন মানুষ…সবকিছু মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগছে।” অর্ণব মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন, তারপর বললেন, “শুরুতে সবারই এমন হয়। এই শহরটা প্রথমে ভীষণ অচেনা মনে হবে, কিন্তু ধীরে ধীরে আপন হয়ে উঠবে।” তার কণ্ঠে এমন এক নিশ্চিন্ত ভরসা ছিল যে শ্রেয়সীর বুকের ভেতর জমে থাকা ভারী চাপ হালকা হয়ে এলো। অর্ণব নিজের কথা বলতে লাগলেন—কীভাবে কয়েক বছর আগে সেও নতুন করে এই শহরে এসেছিল, কিভাবে কাজ আর নিঃসঙ্গতার মধ্যে নিজের জায়গা তৈরি করেছিল। তার প্রতিটি কথা যেন শ্রেয়সীর নিঃসঙ্গ হৃদয়ে ছোট্ট আশ্বাসের মতো বাজছিল। শ্রেয়সী ভাবল, হয়তো মানুষ সত্যিই কথার মাধ্যমে কারও একাকীত্ব কমিয়ে দিতে পারে।
আলাপ চলতে চলতে তারা দু’জনের দূরত্ব অদৃশ্যভাবে কমতে শুরু করল। শ্রেয়সী জানাল নিজের শখের কথা—বই পড়া, ভ্রমণ, আর কফিশপে একা বসে সময় কাটানোর অভ্যাস। অর্ণব জানালেন তিনি সঙ্গীত পছন্দ করেন, মাঝে মাঝে গিটার বাজান, আর ফটোগ্রাফি তার নেশা। তাদের মধ্যে মিলও খুঁজে পাওয়া গেল—দু’জনেই ভিড়ভাট্টার ভেতর থেকেও নির্জনতা খুঁজে নিতে ভালোবাসে। সেই সন্ধ্যা কেটে গেল অচেনা শহরের গল্প, অতীতের ছোট্ট অভিজ্ঞতা আর ভবিষ্যতের স্বপ্নের আলাপচারিতায়। শ্রেয়সী প্রথমবার অনুভব করল, এই শহরটা হয়তো আর ততটা অচেনা নয়। কফির শেষ চুমুক দিয়ে যখন ক্যাফে থেকে বের হলো, বাইরে হালকা বাতাস বইছিল, রাস্তার আলোয় ঝলমল করছিল শহরের পথ। পাশে হাঁটছিল অর্ণব—চুপচাপ, তবে তার উপস্থিতিই শ্রেয়সীর নিঃসঙ্গ হৃদয়ে এক নতুন আলোর রেখা টেনে দিল। সে বুঝল, শহরের ভিড়ের ভেতরেও একজন মানুষ আছেন, যিনি তার নিঃশব্দ কষ্টটাকে পড়তে পারেন। আর এই উপলব্ধিই তাকে ধীরে ধীরে এই নতুন জীবনের পথে হাঁটার সাহস দিল।
৫
অফিসের প্রথম দিকের অচেনাভাব ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করল। শ্রেয়সী টের পাচ্ছিল, অর্ণবের উপস্থিতি যেন তাকে নিঃশব্দে সাহস জোগাচ্ছে। প্রোজেক্টের কাজে যখনই কোনো জটিল পরিস্থিতি আসত, অর্ণব অল্প কথায় পথ দেখিয়ে দিত, আর সে শিখত ধীরে ধীরে নিজের ওপর বিশ্বাস রাখতে। টিমের অন্যদের সঙ্গে শ্রেয়সীর সম্পর্ক গড়ে উঠছিল, কিন্তু তার মনে হচ্ছিল—এই প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে খুব বেশি মানুষ সত্যিকারের আন্তরিক নয়। তবে অর্ণব যেন এক অন্যরকম মানুষ, যেখানে কোনো হিসাব-নিকাশ নেই, নেই অকারণ কটাক্ষ বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে আলাপচারিতা কেবল কাজের গণ্ডি পেরিয়ে আরও স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে উঠল। দুপুরবেলায় লাঞ্চব্রেকে মাঝে মাঝে তারা একসঙ্গে বসে খেত, আর সেই সময়টা যেন অফিসের চাপ থেকে এক অদ্ভুত মুক্তি এনে দিত। শ্রেয়সী নিজের শৈশব, কলেজজীবনের কিছু স্মৃতি ভাগ করে নিত, আর অর্ণব তার জীবনের গল্প শোনাত। দু’জনেই উপলব্ধি করছিল, তারা ভিন্ন ভিন্ন দুনিয়া থেকে এসেও যেন কোথাও এক জায়গায় এসে মিশে গেছে।
কাজের বাইরে তাদের সময় কাটানোও শুরু হলো। একদিন অফিস শেষে অর্ণব হালকা ভঙ্গিতে বলল, “চল, আজ তোকে শহরটা একটু ঘুরিয়ে দেখাই।” প্রথমে শ্রেয়সী দ্বিধা করলেও পরে রাজি হলো। ক্যাব থেকে নেমে যখন তারা ব্যস্ত বাজার ঘুরে বেড়াল, শ্রেয়সীর মনে হলো সে যেন সত্যিই এই শহরের অংশ হয়ে যাচ্ছে। অর্ণব তাকে ছোট ছোট দোকান দেখাল, যেখানে সন্ধ্যার পর ভিড় জমে, তাকে স্থানীয় খাবারের স্বাদ নিতে বলল, এমনকি কিছু গলিপথও দেখাল যেগুলো শহরের প্রকৃত সৌন্দর্য লুকিয়ে রাখে। এক বিকেলে তারা নদীর ধারে গিয়ে বসেছিল—সূর্যাস্তের রঙিন আলো নদীর জলে ছড়িয়ে পড়ছিল, আর দূরে ভেসে আসছিল ভাঙা সেতুর ছায়া। সেই মুহূর্তে শ্রেয়সী নিঃশব্দে বলল, “তুমি না থাকলে হয়তো এই শহরটা কখনো বুঝতেই পারতাম না।” অর্ণব মৃদু হেসে শুধু উত্তর দিল, “শহরকে চেনার জন্য সময় লাগে, কিন্তু মানুষকে চেনা তার থেকেও কঠিন।” এই সরল কথাগুলোই শ্রেয়সীর মনে গভীর ছাপ ফেলল।
এইসব মুহূর্তে তাদের বন্ধুত্বের ভিত শক্ত হলো। অফিসে তাদের একসঙ্গে কাজ করার সময় টিমের অন্যরা মজার ছলে নানা মন্তব্য করলেও দু’জনেই সেগুলোকে হেসে উড়িয়ে দিত। শ্রেয়সী টের পাচ্ছিল, অর্ণবের সঙ্গে থাকলে তার ভেতরের একাকীত্ব আর ভয় যেন অনেকটাই কমে যায়। সে এখন শহরের ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যায় না, বরং শহরের প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি আলোকে নতুন চোখে দেখতে শেখে। দু’জনের মধ্যে হয়তো প্রেমের ভাষা তখনো স্পষ্টভাবে উচ্চারণ হয়নি, কিন্তু বন্ধুত্বের সেই অবিচল বাঁধনই ধীরে ধীরে একে অপরের জীবনে অপরিহার্য হয়ে উঠছিল। শ্রেয়সী বুঝতে পারল, এই শহরের অচেনাভাব ভাঙার মূল চাবিকাঠি শুধু সময় নয়, বরং একজন সত্যিকারের মানুষের সঙ্গ। আর সেই মানুষটি আপাতত অর্ণব ছাড়া আর কেউ নয়। তার নিঃশব্দ সঙ্গ আর নির্ভরযোগ্য উপস্থিতি শ্রেয়সীর জীবনে এমন এক আশ্বাস বুনে দিল, যা তাকে নতুন দিনের জন্য প্রস্তুত করে তুলল।
৬
দিন যত এগোতে লাগল, অফিসের চাপও ততই বাড়তে শুরু করল। নতুন প্রোজেক্টের কাজ হাতে আসতেই টিমের ভেতর অদ্ভুত একটা প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি হলো। কে বেশি দক্ষ, কার কাজ ক্লায়েন্টের নজরে পড়বে, কে ম্যানেজমেন্টের প্রশংসা কুড়োবে—এসব নিয়ে অঘোষিত এক লড়াই চলছিল প্রতিদিন। শ্রেয়সী নিজেকে প্রস্তুত করার চেষ্টা করছিল, কিন্তু মাঝে মাঝে সহকর্মীদের চোখে হিংসা আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা স্পষ্ট হয়ে উঠত। মিটিংয়ের সময় কারও মন্তব্য, আবার কারও সূক্ষ্ম ইঙ্গিত তার ভেতরে অস্বস্তি তৈরি করত। এত কিছুর মধ্যেও অর্ণব যেন এক আলাদা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকত। তিনি সবসময় শান্ত, সবার সঙ্গে সমানভাবে কথা বলেন, কারও সঙ্গে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে জড়ান না, বরং সবার কাজকে সহজ করার চেষ্টা করেন। তবুও শ্রেয়সীর মনে হতে লাগল—এমন একটা বিশাল প্রতিযোগিতার মাঝে অর্ণবের জন্য তার ভেতরে যে আলাদা টান তৈরি হচ্ছে, সেটা কি শুধুই পেশাগত কৃতজ্ঞতা, নাকি এর বাইরে অন্য কোনো অর্থ আছে? রাতে একা ঘরে ফিরে কাজের রিপোর্ট শেষ করার সময় হঠাৎ সে থেমে যেত, কানে যেন ভেসে আসত অর্ণবের কণ্ঠস্বর—সেই সরল, নিশ্চিন্ত ভরসা জাগানো স্বর। আর তখনই তার বুকের ভেতরে প্রশ্ন জাগত, এই অনুভূতি কি সত্যিই সহকর্মীর প্রতি?
প্রতিদিনের ছোট ছোট ঘটনাগুলো তার দ্বিধাকে আরও বাড়িয়ে তুলছিল। একদিন লাঞ্চে সবাই একসাথে বসেছিল। কাজের কথার মাঝেই অর্ণব হালকা মজা করে কিছু বলল, আর শ্রেয়সী অজান্তেই হেসে উঠল। চারপাশে সহকর্মীদের চোখ তখন দু’জনের দিকে ঘুরে গেল, কেউ মুচকি হাসল, কেউ আবার অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। সেই মুহূর্তে শ্রেয়সীর গাল লাল হয়ে উঠল, সে দ্রুত চোখ নামিয়ে নিল। সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পর বারবার সেই দৃশ্য মনে পড়ছিল—অর্ণবের একটুকরো মজা, তার নিজের অপ্রস্তুত হাসি, আর অন্যদের ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টি। আবার আরেকদিন, ক্লায়েন্টের সামনে যখন শ্রেয়সী জটিল প্রশ্নে আটকে গেল, অর্ণব খুব স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিয়ে পরিস্থিতি সামলে নিল। সবাই প্রশংসা করল, কিন্তু শ্রেয়সীর মনে হলো, অর্ণব কেবল সহকর্মী হিসেবেই তাকে সাহায্য করছে না, বরং তার প্রতি অদৃশ্য এক সুরক্ষা তৈরি করে রেখেছে। সেই রাতে ঘুমোতে গিয়ে তার মনে হলো, যদি অর্ণব না থাকত তবে হয়তো এই প্রতিযোগিতার পরিবেশে সে ভেঙে পড়ত। তবে কি তার এই নির্ভরতা কেবল পেশাগত? নাকি ভেতরে ভেতরে অর্ণব তার জীবনের অন্য মানেও বহন করছে?
এইসব অনিশ্চয়তা তাকে ভেতরে ভেতরে দোলাচলে ফেলছিল। একদিকে অফিসের চাপ, যেখানে প্রমাণ করতে হবে যে সে কেবলমাত্র যোগ্য কর্মী, কাউকে ভরসা করে টিকে থাকার মানুষ নয়। অন্যদিকে, নিজের অজান্তেই অর্ণবের উপস্থিতি তার দিনকে সহজ করে দিচ্ছে। শ্রেয়সী রাতে ডায়েরি খুলে লিখল—“এই শহরটা আমার কাছে এতদিন অচেনা ছিল। এখন ধীরে ধীরে পরিচিত হয়ে উঠছে। কিন্তু কেন মনে হচ্ছে, এর আসল কারণ শহর নয়, মানুষ?” কলম থেমে গেল, আর চোখের সামনে ভেসে উঠল অর্ণবের শান্ত মুখ। জানালার বাইরে তখন বৃষ্টি পড়ছিল, প্রতিটি ফোঁটা যেন অদৃশ্যভাবে তার ভেতরের প্রশ্নগুলোকে নাড়িয়ে দিচ্ছিল। শ্রেয়সী ভাবছিল—অর্ণব কি সত্যিই কেবল সহকর্মী, নাকি এই একাকী জীবনের নিঃশব্দ ফাঁকগুলোতে তিনি ধীরে ধীরে আরও বড়ো কোনো জায়গা করে নিচ্ছেন? উত্তর সে পায়নি, শুধু বুকের ভেতরে তৈরি হলো এক অদ্ভুত শূন্যতা, আর তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক নরম, অনিশ্চিত আকাঙ্ক্ষা।
৭
সেদিন সন্ধ্যায় অফিস শেষ হওয়ার পর শহরের ভিড় একটু কমে এসেছিল। চারদিকের কোলাহল ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছিল, যেন ব্যস্ত দিনের পর নগরীও একটু স্বস্তি খুঁজছে। শ্রেয়সী আর অর্ণব দু’জনেই অফিস থেকে বেরিয়েছিল, কিন্তু অদ্ভুত এক টানে তারা পা বাড়াল কাছের ক্যাফের দিকে। সাধারণত অফিসের বাইরের আলোচনায় হালকা হাসিঠাট্টাই হতো, কিন্তু সেদিন পরিবেশ যেন অন্য রকম ছিল। অর্ণব অস্বাভাবিকভাবে চুপচাপ, তার চোখে ক্লান্তি আর মুখে এক অদৃশ্য ভারের ছাপ। শ্রেয়সী প্রথমে ভেবেছিল অফিসের চাপের কারণেই এমন, কিন্তু চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে হঠাৎ অর্ণব নিজে থেকেই বলল, “জানো, সব মানুষই বাইরে থেকে যা দেখা যায়, ভেতরে তেমনটা থাকে না।” শ্রেয়সী অবাক হয়ে তাকাল, কারণ অর্ণবকে সে সবসময় দৃঢ়, শান্ত, সংযত মানুষ হিসেবেই চিনেছে। অথচ আজ সেই মানুষটিই ভেতরের অচেনা এক যন্ত্রণা শেয়ার করতে চাইছে। অর্ণব ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল—একটা দীর্ঘ সম্পর্কের গল্প, যেখানে ভালোবাসা ছিল, স্বপ্ন ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভাঙনও ছিল। অনেক বছরের পরিশ্রম আর বিশ্বাস ভেঙে গিয়েছিল একদিন, আর সেই আঘাত তাকে শিখিয়েছে কেমন করে একা থাকা যায়, নিজের ভেতরেই একটা দেয়াল তুলে রাখা যায়।
শ্রেয়সী শুনছিল, নিঃশব্দে, কোনো প্রশ্ন না করে। মাঝে মাঝে তার মনে হচ্ছিল, অর্ণবের প্রতিটি শব্দ যেন একেকটা অজানা কষ্টের দরজা খুলে দিচ্ছে। শহরের ঝলমলে আলোয়, মানুষের ভিড়ের মাঝেই একজন মানুষ কেমন করে এত নিঃসঙ্গ হয়ে থাকতে পারে, তা তার আগে বুঝতে পারেনি। অর্ণব বলছিল, “সবাই ভাবে আমি সব সামলে নিতে পারি। অফিসে কেউ টের পায় না আমি একা থাকি, রান্না থেকে শুরু করে ঘরের সব কাজ নিজেই করি। কিন্তু রাতে যখন বাড়ি ফিরি, চারদিকের নীরবতা অনেক বেশি চেপে বসে।” এই স্বীকারোক্তি শ্রেয়সীর ভেতরে এক অদ্ভুত আলোড়ন তুলল। সে বুঝতে পারল, অর্ণব কেবল তার মতোই একজন মানুষ—যে একা থাকার যন্ত্রণা চেনে, সম্পর্ক ভাঙার তীব্রতা অনুভব করেছে, অথচ বাইরের দুনিয়ার সামনে তার কিছুই প্রকাশ করে না। সেদিন শ্রেয়সী প্রথমবার মনে করল, অর্ণবের শক্ত মনের ভেতরেও নরম এক মানুষ লুকিয়ে আছে, যে ক্ষতচিহ্ন নিয়ে বেঁচে আছে। চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে শ্রেয়সীর মনে হলো, এই মানুষটিকে সে নতুন করে চিনছে, নতুন করে বুঝতে শিখছে।
ক্যাফের আলো তখন ধীরে ধীরে নিভে আসছিল, মানুষজন বেরিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু তাদের দু’জনের আলাপ যেন থামছিল না। অর্ণবের কণ্ঠে কোনো অভিযোগ ছিল না, বরং ছিল গভীর এক স্বীকারোক্তি—যেন এতদিনের জমে থাকা ভার ঝেড়ে ফেলতে চাইছে। শ্রেয়সী চোখ নামিয়ে শুনছিল, আর মনে হচ্ছিল তার নিজের একাকীত্ব আর অর্ণবের নিঃসঙ্গতা কোথাও গিয়ে এক হয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে তারা কেবল সহকর্মী নয়, কেবল বন্ধুও নয়—বরং দুই ভিন্ন মানুষের নিঃসঙ্গ জীবনের সেতুবন্ধ তৈরি হয়ে উঠছে। ক্যাফে থেকে বেরিয়ে আসার সময় শ্রেয়সী আকাশের দিকে তাকাল। রাত নেমেছে, চারদিকে ঝলমলে আলো জ্বলছে, অথচ ভেতরে এক অদ্ভুত প্রশান্তি তার মনে ভেসে উঠল। সে বুঝতে পারল, অর্ণবকে সে আর আগের চোখে দেখতে পারছে না। এই মানুষটা কেবল কাজের পরামর্শদাতা নয়, কেবল শহরে একটা পরিচিত মুখও নয়—সে এক জীবন্ত কাহিনি, যে নিজের যন্ত্রণা খুলে দিয়েছে তার সামনে, আর সেই খোলামেলাতাই তাকে একেবারে নতুন আলোয় ভরে তুলেছে। শ্রেয়সীর মনে এক নীরব প্রতিজ্ঞা তৈরি হলো—সে অর্ণবকে আর কখনো শুধু দূরের সহকর্মী ভেবে দেখবে না, বরং একজন মানুষ হিসেবে তার পাশে থাকতে চাইবে।
৮
শরতের শুরুর দিকে একদিন হঠাৎই শ্রেয়সী অসুস্থ হয়ে পড়ল। সকালবেলা অফিসে বেরোতে গিয়ে মাথা ঘুরে গেল, শরীর জ্বরে কাবু হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল সে। অচেনা শহরে, যেখানে এখনো তার পরিচিত মানুষ তেমন কেউ নেই, এমন অসুস্থতার সময় একাকীত্ব আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফোনে মা’র সঙ্গে কথা বলে কিছুটা সান্ত্বনা পেলেও মায়ের দূরে থাকার যন্ত্রণা তাকে আঘাত করতে থাকে। তখনই দরজায় বেল বাজল। অবাক হয়ে সে দেখল, দাঁড়িয়ে আছে অর্ণব, হাতে ওষুধ আর ফলের প্যাকেট। শ্রেয়সী প্রথমে ভেবেছিল হয়তো কাকতালীয় কোনো কারণে এসেছেন, কিন্তু অর্ণব শান্ত কণ্ঠে বলল, “শুনলাম তুমি অফিসে আসোনি। খোঁজ নিতে এলাম।” অর্ণবের স্বাভাবিক ব্যবহারের আড়ালে ছিল এক নিঃশব্দ আন্তরিকতা, যা শ্রেয়সীকে অবাক করে দিল। ব্যস্ত শহরে, যেখানে সবাই নিজের ছন্দে দৌড়োয়, সেখানে একজন মানুষ কেবল তার জন্য ছুটি নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল—এই উপলব্ধি তার ভেতরে অন্যরকম আলো জ্বেলে দিল।
অর্ণব সেদিন সারাদিন শ্রেয়সীর পাশে রইল। রান্নাঘরে গিয়ে হালকা খিচুড়ি বানিয়ে আনল, ওষুধের সময় মনে করিয়ে দিল, আর মাঝেমধ্যে নীরব বসে গল্প করল। তাদের কথোপকথনে কোনো অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা ছিল না, কিন্তু সেই নিঃশব্দ যত্নের ভেতরেই লুকিয়ে ছিল গভীর এক স্নেহ। শ্রেয়সী দুর্বল শরীর নিয়েও লক্ষ্য করছিল, অর্ণব কতটা মন দিয়ে তার ছোটো ছোটো প্রয়োজনের খেয়াল রাখছে। রাতে যখন জ্বর কিছুটা কমল, তখন অর্ণব বিছানার পাশে বসে বলল, “তুমি একা নও। এখানে যদি কোনো সময় অসুবিধা হয়, আমাকে বলবে।” এই একটি বাক্য যেন শ্রেয়সীর ভেতরের ভাঙাচোরা দেয়াল ভেঙে দিল। এতদিন ধরে সে এই শহরে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিল, ভেবেছিল কেউ তার খেয়াল রাখবে না, তার অসুস্থতা কারো কাছে বিশেষ কিছু নয়। অথচ সেই মুহূর্তে মনে হলো—সে সত্যিই আর একা নয়। শ্রেয়সীর চোখ ভিজে উঠেছিল, যদিও সে চেয়েছিল তা আড়াল করতে।
পরের দিন সকালে সূর্যের আলো জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ছিল, শরীর কিছুটা হালকা লাগছিল শ্রেয়সীর। সে তাকাল অর্ণবের দিকে, যিনি সোফায় রাত কাটিয়েছেন। ক্লান্ত অথচ প্রশান্ত মুখে তখনো ঘুমাচ্ছিলেন তিনি। সেই দৃশ্য দেখে শ্রেয়সীর মনে হলো, এ মানুষটি তার জীবনে ধীরে ধীরে এক বিশেষ জায়গা করে নিচ্ছেন—যে জায়গায় শুধুই বিশ্বাস আর ভালোবাসা জায়গা পায়। শহরের প্রথম দিনগুলিতে যে নিঃসঙ্গতা তাকে গ্রাস করে ফেলেছিল, সেই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার আলো হয়ে যেন উপস্থিত হয়েছেন অর্ণব। শ্রেয়সী বুঝতে পারল, তাদের বন্ধুত্ব এখন আর শুধু অফিস বা কফিশপের সীমায় আবদ্ধ নেই, বরং নিঃশব্দ যত্নে ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে অন্যরকম এক আবেগের বন্ধন। সেদিন থেকে দু’জনের মধ্যে হৃদয়ের দূরত্ব আর রইল না আগের মতো—তাদের সম্পর্ক নিঃশব্দে, অদৃশ্যভাবে, আরও গভীর হতে শুরু করল।
৯
সেদিন শহরের আকাশ ভোর থেকেই ভারী হয়ে উঠেছিল, দুপুর গড়াতে গড়াতে মেঘে ঢাকা রাস্তাগুলো ঝমঝমিয়ে ভিজে উঠল। শ্রেয়সী অফিস শেষে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল, বৃষ্টির ফোঁটায় অচেনা শহরের রাস্তা যেন আরও অপরিচিত, আবার অদ্ভুতভাবে আপনও লাগছিল। এ শহরেই তার একাকীত্ব জন্ম নিয়েছিল, আবার এই শহরই তাকে উপহার দিয়েছে এক মানুষকে—অর্ণবকে। হঠাৎই অর্ণব এসে বলল, “আজ বাসায় একা ফিরবে কেমন করে? চলো, কফিশপে বসি, বৃষ্টি থামলে ফিরব।” শ্রেয়সী চুপচাপ মাথা নাড়ল। দু’জন হেঁটে গেল ভেজা রাস্তায়, চারপাশে গাড়ির আলো, ভিজে মাটির গন্ধ, আর টুপটাপ ফোঁটার শব্দে ভরে উঠেছিল পরিবেশ। ছোট্ট ক্যাফেতে বসে তারা গরম কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে যেন বাইরের জগত থেকে আলাদা এক ভেতরের জগতে ঢুকে গেল। শ্রেয়সীর চোখে তখনো ছিল অচেনা ঝলক, অর্ণব বারবার তাকিয়ে আবার দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছিল—কিছু একটা বলতে চাইছে, কিন্তু সাহস পাচ্ছিল না।
কফিশপে আলো-আঁধারির মধ্যে বৃষ্টির শব্দ ক্রমে আরও প্রবল হতে লাগল। অর্ণব কফির কাপ নামিয়ে রেখে হঠাৎই গভীর নিঃশ্বাস নিল, তারপর নিচু গলায় বলল, “শ্রেয়সী… আমি অনেকদিন ধরে কিছু বলতে চাইছি।” শ্রেয়সী চমকে তার দিকে তাকাল, বুকের ভেতর হঠাৎ ধক করে উঠল। অর্ণবের চোখে ছিল এক অদ্ভুত দৃঢ়তা আর কুণ্ঠার মিশেল। “জানো, আমি যখন এই শহরে থাকি, তখন মনে হয় সবই যেন ধূসর… কিন্তু যেদিন থেকে তোমাকে চিনেছি, অফিসের প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত আলাদা হয়ে গেছে। তুমি ছাড়া এই শহরটাকে আর কল্পনা করতে পারি না।” কথাগুলো বলার সঙ্গে সঙ্গে তার গলা কেঁপে উঠল, যেন বুকের গভীরে জমে থাকা আবেগ অবশেষে স্রোতের মতো বেরিয়ে এল। শ্রেয়সীর মনে হচ্ছিল, সে হয়তো স্বপ্ন দেখছে। এতদিন ধরে যার যত্নে, যার নীরব উপস্থিতিতে সে নতুনভাবে বাঁচতে শিখেছে, আজ সেই মানুষটিই তার মনের গভীর কথাগুলো উচ্চারণ করছে।
শ্রেয়সীর চোখ ভিজে এল, অশ্রুর পর্দার আড়াল থেকে অর্ণবকে অস্পষ্ট দেখাচ্ছিল, অথচ হৃদয়ের ভেতর সে যেন স্পষ্ট হয়ে উঠছিল আগের চেয়ে বেশি। তার ঠোঁটে ধীরে ধীরে এক কোমল হাসি খেলে গেল। শ্রেয়সী নিচু স্বরে বলল, “অর্ণব, আমি ভেবেছিলাম এই শহরে আমি একা… কিন্তু তুমি এসে সব বদলে দিয়েছ। তোমার উপস্থিতি ছাড়া সত্যিই এ শহরটাকে কল্পনা করা যায় না।” কথাগুলো বলতেই দু’জনের মধ্যে নিঃশব্দ এক বোঝাপড়া গড়ে উঠল—যেন এই বৃষ্টি, এই কফিশপ, আর এই অচেনা শহর তাদের প্রথম স্বীকারোক্তির সাক্ষী হয়ে রইল। বাইরের বৃষ্টির ধারা তখনো থামেনি, বরং আরও জোরে ঝরছিল, কিন্তু তাদের ভেতরের আবেগের ঝড় সেই মুহূর্তে অদ্ভুত প্রশান্তি এনে দিল। জীবনের সমস্ত অনিশ্চয়তা, ভয়ের দেয়াল, অচেনা শহরের নিঃসঙ্গতা—সব কিছু গলে গিয়ে মিলিয়ে গেল এক মধুর উপলব্ধিতে। শ্রেয়সী ও অর্ণব দু’জনেই বুঝল, আজ থেকে আর কোনো দেয়াল নেই, নেই কোনো দূরত্ব—আছে শুধু একে অপরকে আঁকড়ে ধরা নতুন যাত্রার শুরু।
১০
সকালের আলো জানলার ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকছে, বাইরে শহরটা তখন ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। একসময় যে শহর শ্রেয়সীর কাছে ছিল ভীষণ অচেনা, ভীতিকর আর একাকীত্বের প্রতীক, আজ সেটাই যেন নতুনভাবে প্রাণ পেয়েছে। বাসে উঠতে গিয়ে আর অচেনা মনে হয় না ভিড়ের মুখগুলো, অফিসের কোলাহল আর ব্যস্ততাও আর শূন্যতায় ভরিয়ে তোলে না তার মনকে। তার চোখে এখন এই শহরের প্রতিটি মোড়, প্রতিটি ক্যাফে, প্রতিটি গলিই কোনো না কোনোভাবে অর্ণবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তার হাসি, তার যত্ন, তার গভীর দৃষ্টি—সব মিলিয়ে অচেনা শহরটাকে একেবারে নতুন রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে। শ্রেয়সীর মনে হয়, শহরের কংক্রিটের দেয়াল আর যান্ত্রিক জীবনযাত্রা তার জন্য এখন এক অদ্ভুত উষ্ণতায় মোড়া, কারণ সেখানে আছে একজন মানুষ, যে তার নিঃসঙ্গতাকে নিজের নীরব ভালোবাসায় ভেঙে দিয়েছে।
অফিসের চাপ, প্রতিযোগিতা, টানটান উত্তেজনা—সবকিছুই এখন ভিন্নভাবে ধরা দেয় শ্রেয়সীর চোখে। আগে যেখানে প্রতিটি দিন কেবল দায়িত্ব আর একাকী লড়াইয়ের মতো লাগত, এখন সেখানে আছে অর্ণবের সঙ্গে ছোট ছোট মুহূর্ত ভাগ করে নেওয়ার আনন্দ। কফির কাপে আলাপচারিতা, লাঞ্চ ব্রেকে হালকা ঠাট্টা, কিংবা কোনো প্রেজেন্টেশনের আগে উদ্বেগের মুহূর্তে তার নিশ্চুপ আশ্বাস—সবই তাকে শক্তি জোগায়। শ্রেয়সী বুঝতে পারে, অর্ণব শুধু তার সহকর্মী নয়, শুধু একজন বন্ধু নয়, সে তার জীবনকে অন্যরকম আলোয় ভরিয়ে দিয়েছে। তার উপস্থিতিই যেন প্রতিদিনের ক্লান্তি মুছে ফেলে, কাজের মধ্যে নতুন করে ডুবে থাকার অনুপ্রেরণা দেয়। সেই মানুষটা যে একদিন বলেছিল—“তুমি ছাড়া এই শহরটাকে কল্পনা করতে পারি না”—আজ শ্রেয়সী নিজেও একই সত্য অনুভব করছে, প্রতিটি নিঃশ্বাসে।
শ্রেয়সীর ভেতরে তাই এক গভীর উপলব্ধি জন্ম নেয়। জীবন যতই অচেনা হোক, শহর যতই দূরবর্তী মনে হোক, একজন মানুষের আন্তরিকতা আর ভালোবাসাই সেই অচেনাকে আপন করে তুলতে পারে। আজ তার মনে হয়, এই শহরকে আর ‘অচেনা’ বলার কোনো মানেই নেই। কারণ এখানে অর্ণব আছে—তার অচেনা শহরের ভিড়ে খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে আপন মানুষ। জানালার বাইরে তাকিয়ে শ্রেয়সী ধীরে ধীরে বলে ওঠে নিজের মনে, “এই শহরটা এখন আমার… কারণ এই শহরেই আছে তুমি।” আর সেই কথার মধ্যে মিশে যায় তার চোখের হাসি, যা নিঃশব্দে ঘোষণা করে—অচেনা শহরে সে অবশেষে খুঁজে পেয়েছে নিজের আলো, নিজের ঠিকানা, নিজের মানুষকে।
শেষ
				
	

	


