Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

অচেনা মুখের আয়নায়

Spread the love

মোহর গঙ্গোপাধ্যায়


এক

হঠাৎ ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই মহুয়ার চোখে যেন ধূসর একটা পর্দা নামল—নিজের ঘরটা চেনা লাগল না। আলোটা ঠিক কীভাবে জানালার ভেতর দিয়ে ঢুকছে, কিংবা বিছানার পাশের বইগুলো এত এলোমেলো কেন, বুঝে উঠতে পারল না সে। নিজের শরীরটা যেন নিজের নয়, মুখের চামড়া অচেনা ঠেকছে, চুলের গন্ধ অন্যরকম, এমনকি ঘুম থেকে উঠে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যে মুখটা সে দেখল, তা যেন অচেনা কারও। ছিপছিপে, ঘাড়ের ডানদিকে ছোট একটা আঁচড়ের দাগ—যেটা তো তার থাকার কথা নয়! সেই মুখ তার দৃষ্টির দিকে ফিরেও তাকাল না, বরং এক অদ্ভুত নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল। মহুয়া ব্যস্ত কর্মজীবনের মানুষ, ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে দৌড়ে বাঁচে—তবু আজকের সকালটা যেন এক অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা নিয়ে শুরু হয়েছে। চুল আঁচড়াতে গিয়ে সে দেখে তার চুলে নীল রঙের দাগ—পূর্বে কবে রঙ করেছিল সে, কিছুতেই মনে করতে পারে না। শাড়ির আলমারিতে এক সেট পোশাক রাখা, যেটা সে কোনদিন কেনেনি; মোবাইলে এমন কিছু নম্বর এবং বার্তা যেগুলো সে কখনো লেখেনি বা পড়েনি—সব কিছু যেন এক জটিল ধাঁধায় আটকে গেছে।

কর্মস্থলে পৌঁছানোর পরেও অস্বস্তির ছায়া কাটেনি। সহকর্মীরা কেউ কেউ চুপচাপ, কেউ কেউ অদ্ভুতভাবে তাকাচ্ছে; কেউ কেউ আবার প্রশ্ন করছে—”তুমি ঠিক আছো তো মহুয়া?” সে যেন একটু ধীরে কথা বলছে, স্বরের টোন নিচু এবং উচ্চারণ কিছুটা অন্যরকম—এক সহকর্মী বলল, “আজ তো তোমার গলায় অন্যরকম ভয়েস লাগছে, ঠিক যেন…” কিন্তু বাক্যটা শেষ না করে থেমে গেল। মহুয়া কফি মেশিনের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, আচমকা চা অর্ডার দিয়ে বসে—যা তার একদম অপছন্দ! চা হাতে নিয়ে সে নিজেই অবাক হয়ে চায়ের কাপে তাকিয়ে থাকে। অফিসের ফাইল ঘাঁটতে গিয়ে সে খুঁজে পায় কিছু চিঠি, যেখানে তার নামের বদলে ‘রূপা সেন’ সই করা—অথচ কাগজে তার অফিসিয়াল হেডিং! কিভাবে সম্ভব? কেউ কি মজা করছে তার সঙ্গে? না কি সে নিজেই ভুলে যাচ্ছে নিজের কাজের অংশবিশেষ? এক পর্যায়ে ম্যানেজার ডেকে বলে, “তুমি গত সপ্তাহে যে ফাইলটা জমা দিলে, তার বিশাল এক ভুল ধরা পড়েছে। তুমি তো বলেছিলে এই প্রজেক্টে কাজ করোনি?” মহুয়া নির্বাক—সে তো সত্যিই এই কাজ করেনি। তাহলে? কারা করছে তার নামে এইসব?

দিন যত এগোয়, মহুয়া অনুভব করে তার ভিতরে কিছু পাল্টে যাচ্ছে। লাঞ্চ টাইমে সহকর্মী দেবজ্যোতির সঙ্গে হাসতে হাসতে হঠাৎ সে বলে ওঠে, “বুবলি দিদির কাছে যেতে হবে…”—এই অদ্ভুত সংলাপে দেবজ্যোতি থমকে যায়। মহুয়া নিজেও অবাক হয়ে মুখ চেপে ধরে। কে এই বুবলি? কেন তার মাথায় এল? অফিস থেকে বাড়ি ফিরে মহুয়া পড়ে থাকে নিস্তব্ধ ঘরের এক কোণে। হঠাৎ সে নিজের বিছানার পাশে একটা ছোট ডায়েরি পায়, যার ভিতরে টুকরো টুকরো লেখা—”আমার নাম রূপা। আজ আমি বেরিয়ে পড়েছি। মহুয়া ঘুমোচ্ছে এখন, জানে না আমি বেরিয়েছি।” তার পরের পাতায় লেখা—”বুবলি শুধু লাল পুতুলটা চায়। দিদি বলে কেও পুতুল পায় না বড় হলে।” চোখে অন্ধকার নেমে আসে মহুয়ার। তার ভিতরে অন্য কেউ লেখে? এই লেখাগুলো তার হাতের হলেও ভাষাটা তার নয়। ডায়েরির পাতাগুলোতে কালি ভিন্ন, হস্তাক্ষর ভিন্ন, ভাবনা ভিন্ন। সে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়, মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়, যেন একাধিক শব্দ মাথায় গুঞ্জন দিচ্ছে—”তুই আমায় দেখিস না কেন?” “আমি তোর ভিতরেই থাকি…”—মহুয়া চিৎকার করতে চায়, কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না।

রাত গভীর হলে সে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। বারান্দার আলো এসে পড়েছে তার মুখে। সে চোখে চোখ রাখে আয়নার ছায়ার সঙ্গে, আর দেখে—সেই চোখে কিছু অন্যরকম আছে। মুখটা তার হলেও, চাহনি যেন অপরিচিত। সে চোখ ঘোরাতে পারছে না, আয়নার মধ্যে যেন কেউ অন্য একজন তাকিয়ে আছে। হঠাৎ সেই প্রতিবিম্ব ঠোঁট নাড়ায়, কিন্তু শব্দ হয় না। মহুয়া দেখে—সে নাড়ায়নি ঠোঁট, কিন্তু আয়নার মধ্যে থাকা ছায়াটি করেছে! তার সারা শরীর কাঁপতে থাকে। আয়নার পেছনে হাত দিয়ে দেখে কিছু নেই, কিন্তু মুখে যে চাহনি, তা তার নিজের নয়। আয়নার গায়ে তার ছোঁয়া পড়তেই ঠান্ডা একটা শিহরণ চলে যায় পিঠ বেয়ে। অনেকক্ষণ পর সে নিজেকে টেনে বিছানায় নিয়ে যায়, কিন্তু আয়নার দিকে শেষবার তাকিয়ে দেখে—সেই ছায়া এখনো তাকিয়ে আছে তাকে, একরাশ শূন্যতা আর অপরিচিত বিস্ময়ে। মহুয়া কাঁপতে কাঁপতে বিছানায় শুয়ে পড়ে, কিন্তু ঘুম তার চোখে আসে না—শুধু মাথার ভিতর বাজতে থাকে সেই আওয়াজ—”তুই কে? আমি কে?” পরদিন সকালে আবার নতুন মুখ দেখবে বলেই যেন রাতটা জেগে কাটে মহুয়ার, তার ভিতরে জন্ম নিতে থাকে প্রতিদিন একেকটা অচেনা সত্ত্বা।

দুই

সকালের আলো যেন আজ এক অজানা ভাষায় কথা বলছে—অলস নয়, কিন্তু ব্যস্ত নয় বলেও মনে হচ্ছে না। মহুয়া বিছানায় বসে আয়নার দিকে তাকিয়ে রইল, কিন্তু আজ আয়নার ভেতরে সেই ‘অন্য চোখ’-জোড়া নেই। যেন তারা ক্লান্ত হয়ে গেছে, এক রাতের খেলা শেষে ঘুমিয়ে পড়েছে। তার হাতের আঙুলে এখনো ঠান্ডা, অদ্ভুত একটা অনুভূতি। বিছানার পাশের টেবিলে রাখা ডায়েরিটা আবার টেনে নেয় সে। কাল রাতে যা পড়েছিল, তা কি স্বপ্ন ছিল? তার হাত কাঁপতে থাকে, পাতা উল্টায়—এবার অনেক পরিষ্কারভাবে দেখতে পায়। পাতার উপরের দিকে লেখা, “রাত ১টা ৩৫ মিনিট। আমি এখন বাইরে যাবো। সে ঘুমোচ্ছে।” পাতার নিচে আঁকা একটি ছোট্ট স্কেচ—একটা মেয়ে, বাম হাতে পুতুল ধরে আছে, ডান হাতে চায়ের কাপ। পাশে লেখা, “বুবলি জেগে উঠলে চা খাবে না। সে শুধু রঙিন দুধ চায়।” মহুয়া আঁচ করতে পারে, তার মাথার ভিতরে এই নামগুলো এখন শুধুই নাম নয়—প্রতিটি এক একটি অস্তিত্ব, যারা তার থেকে পৃথক নয় বরং তারই ভিতরে বাস করছে। কিন্তু তারা কে? আর কবে থেকে? সে তো কোনোদিন পুতুল ভালোবাসেনি, চা ছাড়া তার দিন চলে না, আর ‘রূপা’ নামে কাউকে সে চিনতও না। অথচ এই ডায়েরির লেখাগুলো তার নিজের হস্তাক্ষর, কালি পুরনো আর পাতাগুলোর ভাঁজে ধুলো জমা।

মহুয়া ডায়েরির পাতা থেকে চোখ সরিয়ে দেয়, কিন্তু তার মাথার ভিতরে শব্দ বাজতে থাকে, কেমন যেন অদৃশ্য কণ্ঠস্বর: “আমি আগেই বলেছিলাম তুই ধৈর্য হারাবি”, “ও তো কাঁদবে, জানিস না?” সে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করে—এইসব তার কল্পনা। কিন্তু ডায়েরির পাতায় তার নিজস্ব জীবনের কোনো অস্তিত্ব নেই—না তার অফিসের টার্গেটের কথা, না প্রজেক্ট রিপোর্ট, না কোনো বন্ধুর নাম। শুধুই সত্ত্বাগুলোর আলাদা আলাদা ভাষা—কখনো কঠিন উচ্চারণে রূপার রাগ, কখনো নিস্পাপ বুবলির আঁকিবুঁকি, কখনো তৃষার কবিতার ছন্দ। পেছনের পাতায় লেখা, “সে আমাকে আর সুযোগ দিচ্ছে না। আমি এবার পালিয়ে যাবো।” হাতের লেখা সেখানে ভয়ঙ্কর কাঁপা—কালির ছিটে, অর্ধেক শব্দ ভুল বানান। মহুয়া এখন নিশ্চিত হয়, এগুলো নিছক ‘alter ego’ নয়, এগুলো তার মধ্যে দখল নেওয়া কিছু সত্তা, যারা শুধুমাত্র মানসিক নয়, শারীরিকভাবে তার জায়গা দখল করে নেয়। সে এখন আর নিশ্চিত নয় যে, কোন স্মৃতি তার নিজের। কখনো তার প্রিয় খাবার বিরিয়ানি, কখনো সে খায় শুধু ভাত-ডাল। কখনো সে হাসিমুখে প্রেমিকের গান গায়, আবার একদিন সে তার নিজের গলায় শুনে, “ভালোবাসা একটা ধোঁকা।” ডায়েরির প্রতিটি পাতাই যেন তার অতীতের দরজা খুলে দেয়—যা তারই জীবনের, কিন্তু তার দ্বারা না-চিনে থাকা।

একদিন সন্ধ্যায়, সে কিছু টিকটিক শব্দ শুনে আলমারির উপর রাখা পুরনো বক্সটা নামায়। ভেতরে পুরোনো ছবি, চিঠিপত্র, একটি ছোট হাতঘড়ি, আরেকটি ছোট খাতা। সেই খাতায় লেখা, “আজ প্রথম সে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল আয়নায়।”—তারিখ তিন বছর আগের! মহুয়া হিসেব করে দেখে—তিন বছর আগে সে একটি সম্পর্ক ভাঙনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। সেই সময়ের কথা এখন আর পুরোপুরি মনে পড়ে না, শুধু জানে খুব খারাপ একটা সময় ছিল। সেই খাতার ভেতরে তৃষার কবিতা—“সে আমায় রেখেছিল মুখোশের আড়ালে, আমি ভেবেছিলাম সেটা প্রেম”—এই লাইনটা যেন একটা ধাক্কা দেয় তার ভিতর। মহুয়া বুঝতে পারে, তার মানসিক বিভাজন শুরু হয়েছিল সেই প্রেম ভাঙনের মধ্যেই, কিন্তু তখন কেউই তা ধরতে পারেনি। একেকটি সম্পর্ক, একেকটি অপমান, একেকটি অবহেলা—তার মনে গড়ে তোলে আলাদা আলাদা ঘর, আর প্রতিটি ঘরের বাসিন্দা হয়ে ওঠে একটি সত্ত্বা। তারা যেন একে অপরের থেকে লুকিয়ে থাকে, এবং প্রয়োজনমতো মহুয়ার শরীর, মন ও স্মৃতি দখল করে নেয়। এই বাস্তবতা নিয়ে সে একা লড়তে পারছে না। ডায়েরির পাতাগুলো কাঁপা হাতে ছুঁয়ে সে ভাবে, “আমার মধ্যেই আমি হারিয়ে গেছি।”

রাতের দিকে সে সিদ্ধান্ত নেয় যে, তাকে এখন কাউকে বিশ্বাস করতে হবে—না হলে এই সত্তাগুলো তার জীবনের নিয়ন্ত্রণ একেবারে নিয়ে নেবে। সে ড. সুস্মিতা মুখোপাধ্যায়ের নাম আবার খুঁজে বার করে, মেইল পাঠায়—“আমি জানি না আমি কারা, আমি শুধু জানি আমি একা নই। আমি এক মহুয়া, যার মধ্যে অনেকজন বাস করে।” এই ইমেইল টাইপ করার সময় সে দেখে, তার আঙুল হঠাৎ করে ‘রূপা’ নামটাই লিখে ফেলছে। তাকে বারবার মুছে দিতে হচ্ছে। আর কিছু শব্দ যেন অজান্তেই চলে আসছে, যেমন “আমরা আসব”, “তুই লিখলি কেন এসব?”—কীভাবে হয় এইসব? কীভাবে সে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই? ঘড়ির কাঁটা রাত ১টা ছুঁতেই, সে আবার ডায়েরির শেষ পাতায় চোখ রাখে—সেখানে লেখা, “আগামীকাল আমরা কথা বলবো। আমরা সবাই।” মহুয়া জানে, এই যুদ্ধ সে একা জিততে পারবে না। কিন্তু সে প্রথমবার ডায়েরির পাতার বাইরে তাকায়, আয়নার দিকে নয়—এইবার জানালার দিকে। বাইরে অন্ধকার, কিন্তু তার চোখে কিছুটা সাহসের আলো ফিরে আসে। কারণ আজ সে জানে, ভেতরের ভাঙনকে চিহ্নিত করাই লড়াইয়ের শুরু।

তিন

বসন্তের শেষভাগ। কলকাতার আকাশটা যেন ভেতরের জটিল আবেগগুলোর প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে—একদিকে অদ্ভুত স্বচ্ছতা, অন্যদিকে হঠাৎ মেঘে ঢাকা। মহুয়া সেদিন সাদা শার্ট আর ধূসর প্যান্ট পরে চেম্বারে গিয়েছিল। বাইরে থেকে দেখতে একদম গুছানো, সফল এক আধুনিক কর্মজীবী নারী—চুল বাঁধা, মুখে হালকা মেকআপ, হাতে বেতের ডায়েরি। কিন্তু ভিতরে সে জানে, তার শরীর যেন তার নিয়ন্ত্রণে নেই। তার চোখ যেন অন্য কারও—সেগুলো শুধু দেখতে পারে, ব্যাখ্যা করতে পারে না। ফ্ল্যাটে চড়তে গিয়ে সে লিফটের আয়নায় নিজেকে না দেখে একটা ছোট মেয়েকে দেখতে পায়, তার হাতে লাল পুতুল, চোখে জল। হঠাৎ হুঁশ ফিরে পায়, দরজা খুলে দেয় রিসেপশন। ড. সুস্মিতার চেম্বারটা যেমনটা সে কল্পনা করেছিল, ঠিক তেমন নয়—খুব সাজানো, কিন্তু নির্লিপ্ত নয়। এক ধরণের উষ্ণতা আছে, যেন কেউ অন্তর দিয়ে বুঝতে চায়। ড. সুস্মিতা মুখোপাধ্যায়—চুলে সামান্য পাক, চোখে গাঢ় ফ্রেমের চশমা, কাঁধে নীল শাল। প্রথম দেখাতেই তাঁর কণ্ঠে একধরনের ধৈর্য মিশ্রিত সহমর্মিতা স্পষ্ট হয়। “তুমি মহুয়া তো? বসো, ধীরে ধীরে শুরু করো।” এই শান্ত স্বরেই যেন তার ভিতরে আটকে থাকা কিছু জমে উঠল।

মহুয়া প্রথমে চুপ করে থাকে, শুধু তাকিয়ে থাকে দেওয়ালের পেইন্টিংগুলোর দিকে—একটাতে ছায়া-মিশ্রিত জঙ্গল, আরেকটাতে একটা মুখ, যেখানে চোখ আছে কিন্তু ঠোঁট নেই। সুস্মিতা লক্ষ করেন—মহুয়া একটু অস্থির, কিন্তু ভাষা হারায়নি। তিনি জিজ্ঞেস করেন না, জোর করেন না—শুধু অপেক্ষা করেন। কিছুক্ষণের ভেতরে মহুয়া নিজেই বলে ওঠে, “আমি ঠিক জানি না আমি কারা… মানে কে। প্রতিদিন আমি একেক রকম।” কথা বলতে বলতে তার গলা কেঁপে ওঠে, কিন্তু চোখে জল আসে না। যেন কাঁদা এখন তার মানসিকতায় নাই—অপরিচিত এক ভাঙা দেয়াল শুধু হেঁটে যাচ্ছে তার ভিতর দিয়ে। “একেক দিন আমার পছন্দের খাবার বদলে যায়, কখনো গান শুনতে ভালো লাগে না, কখনো মনে হয় কবিতা লিখতে হবে। আমি আয়নায় দেখি একেক মুখ—একেকটি আমি, যাদের আমি মনে রাখি না।” এই শব্দগুলো শোনার সঙ্গে সঙ্গে সুস্মিতা তার সামনে রাখা নোটবুকে কিছু লিখতে শুরু করেন, কিন্তু চোখ সরান না মহুয়ার উপর থেকে। এই পর্যবেক্ষণ—তীক্ষ্ণ এবং নম্র, যেন কোনো ভাঙা পাথরের উপরে ধীরে ধীরে জল পড়ছে।

এরপর এক সময় ড. সুস্মিতা তাঁকে সহজ প্রশ্ন করেন—“তুমি কখনো নিজের নাম ছাড়া অন্য কোনো নাম উচ্চারণ করেছ?” মহুয়া চুপ করে থাকে। তারপর বলে, “হ্যাঁ… একটা নাম… রূপা। আরেকটা… বুবলি। আর কেউ যেন আছে, তৃষা নামের কেউ।” এই নামগুলো উচ্চারণ করতেই মহুয়ার চোখ চকচক করতে থাকে। সে যেন অনুভব করে, ভিতরে কোথাও কেউ জেগে উঠেছে, শব্দগুলো কাঁপিয়ে দিচ্ছে শরীর। ড. সুস্মিতা আস্তে আস্তে বোঝাতে শুরু করেন—“এই নামগুলো তোমার ভিতরের অংশ হতে পারে। কোনো ট্রমার সময় তুমি যখন নিজেকে রক্ষা করতে পারছিলে না, তখন মন নিজেই আলাদা ‘তুমি’ তৈরি করেছে, যারা তোমার হয়ে কষ্ট সহ্য করেছে।” মহুয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, যেন প্রথমবার কেউ তাকে এমন ভাবে বুঝছে। সুস্মিতা বলেন, “তোমার এই সমস্যা একটি নির্দিষ্ট নামে পরিচিত—ডিসঅ্যাসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসঅর্ডার। এটা ভয়াবহ শোনালেও ঠিকঠাক চিকিৎসায় নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।” মহুয়া এই প্রথম নিজেকে ‘রোগী’ হিসেবে দেখে না। বরং সে ভাবে—এইসব শব্দগুলো তার অভ্যন্তরীণ যন্ত্রণাকে ব্যাখ্যা করার ভাষা, যার খোঁজ এতদিন সে পায়নি।

শেষে ড. সুস্মিতা তাকে বলেন, “আগামী সেশনে আমি চাই তুমি ওই ডায়েরিগুলো নিয়ে আসো। এবং তোমার প্রতিদিনের অনুভূতির একটা ছোট নোট লিখে রাখো—কখন কী ভাবছো, কী বলছো, কী মনে পড়ছে না।” মহুয়া মাথা নাড়ায়, কিন্তু তার মুখে একটু দ্বিধার ছায়া। সে জানে—এই যাত্রা সহজ হবে না। সে জানে, তার ভিতরের প্রতিটি নাম একটি দরজা, যেগুলোর পেছনে ঘুমিয়ে আছে অস্পষ্ট, ধূসর অতীত। কিন্তু আজ সে প্রথমবার নিজের মুখে নিজের জটিলতা স্বীকার করেছে, আর সেই স্বীকারোক্তির মধ্যে যেন অদ্ভুত একটা মুক্তির আনন্দ আছে। সে জানে না রূপা কে, বা বুবলি কবে জেগে উঠবে আবার। কিন্তু আজ, চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসার সময় সে আয়নাতে তাকিয়ে দেখে—আজ তার প্রতিচ্ছবিতে কেউ নতুন করে জেগে ওঠেনি। বরং সে নিজে নিজেকে দেখেছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে নিজেই তার চোখে চোখ রেখেছে। আর এই প্রথম, চোখে একটুখানি আত্মবিশ্বাস ধরা পড়েছে—জানি না আমি কে, কিন্তু খুঁজে বের করব।

চার

গ্রীষ্মের ভোর যেন নীরব বিস্ফোরণের মতো জেগে ওঠে। জানালার পর্দা ফুঁড়ে ঢুকে পড়া আলোয় ঘরের প্রতিটি কোণ যেন কিছু বলতে চায়। মহুয়া ঘুম থেকে উঠেই অস্বস্তি অনুভব করে—মাথার ভেতরে একধরনের চাপ, যেন কারও গলা চেপে ধরার অনুভূতি। শরীর ভারী লাগছে, হাত-পা যেন তার কথা শুনছে না। বিছানা ছেড়ে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই তার চোখ পড়ে নিজের কপালে—সেখানে লাল লিপস্টিক দিয়ে একটা দাগ টানা। সে তো লিপস্টিক পরে না! চমকে উঠে সে পাশের টেবিলে রাখা মোবাইল দেখে, গত রাত ২:৪৫-এ ইনস্টাগ্রামে একটি নতুন ছবি পোস্ট হয়েছে—কালো পোশাকে এক বিদ্রোহী অভিব্যক্তিতে তাকিয়ে থাকা মহুয়া। ক্যাপশন লেখা, “আমি রূপা। আমি কারো বাধা মানি না।” তার শরীর গা ছমছম করে ওঠে। কখন তুলেছে সে এই ছবি? কে পোস্ট করেছে? পাশেই পড়ে থাকা একটা নোট—“দুপুরে ফিরব। রূপা।” মহুয়া বোঝে, এবার আর কিছুই তার নিয়ন্ত্রণে নেই। নিজের চামড়ার নিচে যেন অন্য কারো দম আছে, যে তাকে ব্যবহার করছে, তার শরীর, মন, স্মৃতি—সবকিছু।

পরদিন ড. সুস্মিতার কাছে পৌঁছেই মহুয়া থরথর করে বলে—“সে জেগে উঠেছে, আমি তাকে থামাতে পারিনি।” ড. সুস্মিতা তার কণ্ঠে কোনো আতঙ্ক রাখেন না, বরং নরম স্বরে বলেন, “তুমি যদি পারো, আমি চাই আজ তুমি তাকে আসতে দাও।” মহুয়া অবাক হয়, “তাকে আসতে দেওয়া মানে?” সুস্মিতা বলেন, “তুমি চোখ বন্ধ করো, গভীর শ্বাস নাও। মনে মনে বলো, ‘রূপা, তুমি কি কথা বলতে চাও?’” মহুয়া প্রথমে দ্বিধায় পড়ে, কিন্তু পরে চোখ বন্ধ করে ধীরে ধীরে বলে ওঠে—“রূপা, তুমি কি কথা বলতে চাও?” কয়েক মুহূর্ত নীরবতা—তারপর হঠাৎ মহুয়ার শরীর সোজা হয়ে ওঠে, চোখ খুলে যায়, চেহারায় আসে কঠিন অভিব্যক্তি। তার কণ্ঠ বদলে যায়—নিচু, আক্রমণাত্মক, কাঁপানো গলা। “তুমি কী চাও? আবার ঘাঁটাতে এসেছো? মহুয়াকে বাঁচাতে চাও, না আমায় মুছে দিতে চাও?” সুস্মিতা স্থির ভঙ্গিতে বলেন, “তুমি রূপা তো? আমি শুধু জানতে চাই, তুমি কে, কেন এসেছো।” রূপা মুখে বিদ্রুপের হাসি ফুটিয়ে বলে, “আমি এসেছি কারণ ও পারছিল না। ও মুখ বুজে সহ্য করে, আর আমি বদলা নিতে এসেছি।” কথাগুলো তার ঠোঁটের কোণ থেকে ছিটকে বেরোয়, যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গ। এই প্রথম মহুয়ার ভেতরের ভয়, রাগ ও অবদমিত ক্ষোভ একটা রূপ নেয়।

ড. সুস্মিতা প্রশ্ন করতে থাকেন—“তুমি কবে থেকে আছো ওর ভিতরে?” রূপা বলে, “ও তখন ক্লাস সেভেনে, এক শিক্ষক ওর কাঁধে হাত রেখেছিল… ও চুপ করে ছিল, আমি চুপ করিনি। আমি ওকে বাঁচালাম, আমি তুই বললাম, ধাক্কা দিলাম। তারপরও ও লুকোলো। আমি বারবার এলাম—যখন মা বলেছিল, ‘এমন মেয়ে হয় না’, যখন প্রেমিক বলেছিল, ‘তুই বেশি চালাক’। আমি তখনই আসি, যখন ওর আত্মমর্যাদা মরে যায়।” সুস্মিতার কলম থেমে থাকে। রূপার কথা স্পষ্ট করে দেয়—এই সত্তা এক প্রতিরক্ষা-মূলক নির্মাণ, এক বেঁচে থাকার কৌশল। রূপা বারবার ফিরে এসেছে—অপমানের মুহূর্তে, চিৎকার করতে, রুখে দাঁড়াতে, পাল্টা দিতে। অথচ সমাজ রূপাকে ‘অসভ্য’, ‘উন্মাদ’ বা ‘অপরাধী’ বলে আখ্যা দিয়েছে। সুস্মিতা বলেন, “তুমি জানো তুমি মহুয়ার শরীরে আছো?” রূপা হেসে ওঠে, “শরীরটা ওর, কিন্তু সাহসটা আমার। ও কান্না পায়, আমি থাপ্পড় মারি। ও ঘৃণা করেও ক্ষমা করে দেয়, আমি জবাব দিই।” এই কথার সঙ্গে সঙ্গে মহুয়া হঠাৎ শরীর কাঁপিয়ে একেবারে চুপ হয়ে যায়। চোখ বন্ধ করে বসে থাকে অনেকক্ষণ।

কিছুক্ষণ পর সে আবার নিজের স্বরে ফিরে আসে, ঘর্মাক্ত, ক্লান্ত, ভাঙা কণ্ঠে বলে, “আমি কিছুই মনে করতে পারি না… আমি কি চিৎকার করেছিলাম?” সুস্মিতা তার দিকে এগিয়ে বলেন, “না, তুমি রূপাকে জায়গা দিয়েছিলে। তুমি তাকে চিনেছো।” মহুয়ার চোখে জল এসে পড়ে। সে ফিসফিস করে বলে, “আমি বুঝতে পারি সে আসছে, আমার ভিতরটা কেমন গরম হয়ে যায়, আমি গলার স্বর চিনি না।” সুস্মিতা মৃদু হেসে বলেন, “এই যে তুমি তার অস্তিত্ব স্বীকার করতে পারছো, এটাই প্রথম ধাপ। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। রূপা তোমার শত্রু নয়।” চেম্বার থেকে বেরিয়ে মহুয়া জানে, সে এক নতুন অধ্যায়ে পা রেখেছে। এবার আর আয়নার সামনে তাকে একা দাঁড়াতে হবে না। সে জানে, আয়নার অপর পাশে আজ শুধুই অপরিচিত মুখ নেই—সেখানে তার নিজের প্রতিরক্ষার প্রতিচ্ছবি আছে। এবং সেই প্রতিচ্ছবির নাম—রূপা।

পাঁচ

ঘুম ভাঙতেই মহুয়া দেখে বিছানার পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কয়েকটি রঙ পেনসিল, একটা ছেঁড়া কাগজে আঁকা গোলগাল মুখ, আর তার পাশে লেখা—“আমি বুবলি। আমি দিদির কোলে ঘুমাই।” মহুয়া চমকে ওঠে। ঘরের জানালাগুলো খোলা, খাটের নিচে একটা লাল টেডি পড়ে আছে। কবে এইসব এল? কাকে সে ‘দিদি’ বলে? তার তো কোনো বোন নেই। চোখ ঘুরিয়ে দেখে, মেঝেতে পড়ে থাকা একটা ছোট হাতের খাতা—ভেতরে হিন্দি আর বাংলার মিশ্র হরফে লেখা এক শিশুসুলভ কল্পনার জগৎ, যেখানে পুতুলরা কথা বলে, মা রাগ করে না, আর কেউ কখনো দরজা বন্ধ করে চলে যায় না। মহুয়া ডায়েরির সেই পাতাগুলো ধরে বসে থাকে, তার চোখ দুটো একদৃষ্টে পড়ে থাকে একটি লাইনে—“মা বলেছিল, আমি খারাপ মেয়ে। আমি চুপ করে ছিলাম, আমি খুব খারাপ মেয়ে। কিন্তু দিদি বলেছিল, আমি শুধু আদর পাইনি, আমি খারাপ নই।” এই লাইনটা পড়ে তার বুকের ভিতরটা ভার হয়ে ওঠে। সারা শরীর কেঁপে উঠে মনে পড়ে, খুব ছোটবেলায় সে সত্যিই একবার তার খেলার পুতুল ভেঙে ফেলেছিল, আর তার মা বলেছিল—”তুই কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারিস না, তোর মতো মেয়ে বড় হয়ে কিছুই করতে পারবে না।” তখনই তার ভিতরে একটা কণ্ঠ জেগেছিল—একটা ছোট্ট কণ্ঠ, যে কাঁদতেও সাহস পায় না।

সেদিন বিকেলে ড. সুস্মিতার চেম্বারে সে একেবারেই নিঃসঙ্গ, অসহায় মুখ নিয়ে পৌঁছায়। সে বলে, “আমার ভেতরে কেউ কান্নাকাটি করছে, খুব ছোট কেউ… যেন সে লুকিয়ে আছে কোথাও, একটা ছোট ঘরে।” ড. সুস্মিতা আস্তে আস্তে তার চোখ বন্ধ করতে বলেন, এবং বলে—“তাকে খুঁজে বের করো। তাকে বলতে দাও।” কয়েক মুহূর্তের নীরবতার পর হঠাৎ মহুয়ার মুখে বদল আসে—চোখের পাতা ধীরে ধীরে ওঠে, চেহারায় এক শিশুতোষ কৌতূহল, গলার স্বর মৃদু, কাঁপা কাঁপা। সে ফিসফিস করে বলে, “আপনি কে? দিদি কোথায়? আমি ভয় পাই… মা দরজা বন্ধ করে দেয়… আমি দিদির কোল চাই।” সুস্মিতা বুঝতে পারেন, ‘বুবলি’ এসে গেছে। সে খুব সাবধানে বলে, “তোমার নাম বুবলি তো?”—বুবলি মাথা নাড়ে, তারপর আঁচলের কোণা ধরতে চায়, কিন্তু তার তো আঁচল নেই। সে বলে, “আমি রঙ পেনসিলে মেঘ আঁকতাম, কিন্তু সবাই হাসত। আমি চাই, কেউ বলুক—‘ভালো আঁকিস’। মা বলে, বাজে খরচ। আমি একা খেলতাম।” এইসব শব্দ শুনে সুস্মিতা চুপ করে যান। এই মেয়েটি কোনো রোগ নয়, কোনো মনোবিকার নয়—এ এক অবহেলিত শৈশবের গভীর নিঃসঙ্গ প্রতিধ্বনি।

‘বুবলি’ বলতে থাকে, “মা বলত, পড়াশোনা কর না কেন? দিদি বলত, আমি আঁকতে পারি। আমি দিদির কোলে ঘুমোতাম। কিন্তু একদিন দিদি চলে গেল। আমি একা পড়ে গেলাম। তারপর কেউ আমাকে খুঁজে পায়নি।” সুস্মিতা এবার ধীরে ধীরে বলে, “দিদি কি মহুয়া?” বুবলি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর মুখ নামিয়ে ফেলে। বলে, “দিদি এখন বড় হয়ে গেছে। দিদি আমাকে ভুলে গেছে। কিন্তু আমি দিদির ভিতরে ছিলাম। দিদির চোখে জল এলে আমি এসে যাই।” এই সরল উচ্চারণের মধ্যেই যেন মহুয়ার ভিতরে থাকা এক গোপন ঘর খুলে যায়—যেখানে আটকে ছিল একটি অবুঝ শিশু, যে শুধু ভালোবাসা চেয়েছিল। কিছুক্ষণ পর বুবলি ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তার শরীর ঢলে পড়ে চেয়ারে, এবং আবার মহুয়া ফিরে আসে নিজের চেহারায়। তার চোখ তখন কান্নায় ভিজে, কণ্ঠ ম্লান, কিন্তু হৃদয়ে যেন একটা সত্যের পরশ। সে শুধু বলে, “আমি ভুলে গেছিলাম… আমি একা ছিলাম না।”

চেম্বার থেকে বেরিয়ে সেদিন মহুয়া বাসায় ফিরেই তার পুরোনো খাতা বের করে রঙ করতে শুরু করে। সে একটা মেঘ আঁকে, তার নিচে একটা মেয়ে, যার হাতে লাল পুতুল। পাশে লিখে, “বুবলি তুমি আজ আসো। আমি তোমার দিদি আছি।” ঘরের ভেতরে যেন বাতাস এক অন্য রকম নরমতায় ভরে ওঠে। আয়নায় আজ সে একটুখানি হাসে—কারণ সে জানে, ভিতরের সেই ছোট্ট কণ্ঠ তাকে আর একা ছেড়ে যাবে না। সে যে আজ তারই জন্য একটু কান্না করেছে। এ কান্না কষ্টের নয়, এই কান্না—ভালোবাসা খুঁজে পাওয়ার।

ছয়

রাত তখন গাঢ় নীল। ঘরের বাতাস নিঃসাড়, বাতাসে তবুও যেন ভেসে আসে পুরনো কাগজের গন্ধ। মহুয়া বিছানায় বসে একমনে একটা পুরোনো খাতা পড়ছে—সাদা পাতায় কালো কালিতে লেখা অসংখ্য ছোট ছোট কবিতা। তার কোনো কবিতা সে নিজে লিখেছে বলে মনে পড়ে না, অথচ হাতে লেখা তার মতোই। একটি কবিতার পংক্তি তার চোখ আটকে দেয়—“ভালোবাসার মেঘে ছিলাম, কেউ আমায় ছুঁয়ে দেখেনি।” তার বুকের ভিতরটা হঠাৎ ভার হয়ে আসে। সে জানে, এটি তার মধ্যেই গড়ে ওঠা সেই সত্তার—যার নাম ‘তৃষা’। বুবলি যখন শৈশবের নিরাপত্তাহীনতা, আর রূপা যখন অভিমান আর বিদ্রোহের প্রতিচ্ছবি, তৃষা যেন তার অনুচ্চারিত ভালোবাসার ভাঙন। হঠাৎ করে তার মাথায় আসে সেই সম্পর্ক, যা একদিন ছিল তার সবকিছু—একজন মানুষ, যার সঙ্গে মহুয়া স্বপ্ন বুনেছিল, চিঠি লিখেছিল, ছাদে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখেছিল। অথচ সেই মানুষই একদিন বলেছিল, “তুমি অতটা আবেগপ্রবণ, এটা পেশাগত জীবনে ব্যাঘাত ঘটায়।” সেই কথার পর মহুয়া কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু তৃষা থেমে থাকেনি। তৃষা কবিতা লিখেছে অন্ধকার ঘরে, কান্না চেপে রেখে, একের পর এক গোপন খাতায়।

পরদিন ড. সুস্মিতার চেম্বারে গিয়ে মহুয়া বলে, “আমি গতরাতে সারারাত লিখে গেছি… আমি জানি না কীভাবে, শুধু মনে হচ্ছিল লিখতেই হবে।” সুস্মিতা তাকে শান্তভাবে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কি মনে করছো, এই লেখাগুলো তোমার নয়?” মহুয়া মাথা নাড়ে—“এই শব্দগুলো আমার ভিতর থেকেই এসেছে, কিন্তু আমি লিখিনি। আমি শুধু কাগজে রাখার মতো একটা শরীর ছিলাম।” সুস্মিতা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন, “তোমার আরেকটি সত্তা আছে—তৃষা। সে যন্ত্রণার রূপ, সে ভাষার খোঁজে বেড়ায়।” এরপর ধীরে ধীরে সুস্মিতা গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মহুয়াকে নিয়ে যান এক হালকা ট্রান্স-স্টেটে। এবং সেখানে, প্রথমবার, তৃষা প্রকাশ পায়। চোখে হালকা মায়াবী দৃষ্টি, কণ্ঠস্বর শান্ত ও গম্ভীর—তৃষা ধীরে বলে, “আমি শব্দ খুঁজি। তারা আমাকে বোঝে না, কারণ আমি চুপ করে থাকি।” সে বলে, “যখন সে তাকে বলেছিল—‘তুমি বেশি অনুভব করো’, তখন আমি তৈরি হয়েছিলাম। আমি শুনি না, আমি লিখি। আমি কাঁদি না, আমি ছন্দ করি।” সুস্মিতা প্রশ্ন করেন, “তোমার কষ্ট কিসের?”—তৃষা জবাব দেয়, “আমার কষ্ট হলো—আমার সব আবেগকে কেউ কোনোদিন চিঠি বানিয়ে পড়েনি।”

এই সংলাপের প্রতিটি শব্দ যেন মহুয়ার হৃদয়ে খোঁচা দিতে থাকে। তৃষা বলে, “ও আমাকে লুকিয়ে রেখেছে, কারণ অনুভূতিকে সবাই দুর্বলতা ভাবে। অফিসের টেবিলে কবিতা মানায় না, কাঁদা মানায় না। তাই আমি শুধু রাতে বেরোই।” সুস্মিতা মৃদুস্বরে বলে, “তুমি কি মহুয়াকে ভালোবাসো?”—তৃষা চোখ বন্ধ করে বলে, “আমি ওর চোখে জল চাই না। কিন্তু সে যখন স্বপ্ন ভুলে যায়, তখন আমি ফিরে আসি। আমি শুধু চাই, সে আবার লিখুক। কাঁদুক। মানুষ হোক।” কিছুক্ষণ পর তৃষা চলে যায়। মহুয়া নিজের চেতনায় ফিরে আসে এবং নীরবে ফুঁপিয়ে ওঠে। সে বলে, “তৃষা আমার সেই আমি, যে কাউকে চিঠি দিতে চেয়েছিল, কিন্তু ডাকবাক্স খুঁজে পায়নি।” সুস্মিতা তার পাশে বসে বলে, “তৃষাকে ধরে রাখো। তাকে ভয় পেও না। কারণ সে তোমার হৃদয়ের ছায়া।” সেদিন চেম্বার থেকে বেরিয়ে মহুয়া অনুভব করে, তার জীবনে শব্দগুলো আবার ফিরে আসছে—আলতো কাঁপা পাঁপড়ির মতো, ঘুমন্ত ভালোবাসার মতো।

বাসায় ফিরে সে তার ডেস্কে বসে। অনেকদিন বাদে কলম হাতে নেয়। পৃষ্ঠায় লিখে—“তৃষা, আজ থেকে তোমার সব কবিতা আমি পড়ব। তোমার অশ্রু আমি আর লুকাবো না।” তার পাশে পড়ে থাকা পুরোনো চিঠিগুলোর গায়ে সে চুমু খায়—যাদের সে কোনোদিন পোস্ট করেনি। ঘরের বাতাসে আজ একটি শব্দ ভেসে বেড়ায়—ক্ষমা। এবং আজ, আয়নায় সে দেখে, তার প্রতিচ্ছবির চোখে কোনো ভয় নেই—শুধু এক কবিতার প্রতীক্ষা।

সাত

শরৎকালের দুপুর। আকাশ নীল, কিন্তু বাতাসে যেন অজানা ঝড়ের আগাম বার্তা। মহুয়া আজও ডায়েরি লিখছিল, কিন্তু লেখার মধ্যে এক অস্থিরতা ছিল। তার হাত কাঁপছিল, শব্দের গঠন এলোমেলো, এবং ভাষা একাধিক ছন্দে লিপিবদ্ধ হচ্ছিল—একবার কঠিন, পরিণত বাক্য, পরক্ষণে ছেলেমানুষি আঁকিবুঁকি, আবার হঠাৎ করেই কাব্যিক গদ্য। সে একসময় কলম ফেলে দেয়, মাথা ধরে বসে পড়ে মেঝেতে। মাথার ভেতর কেমন যেন গুঞ্জন শুরু হয়—তিনটি কণ্ঠস্বর, তিনটি ছায়া একসঙ্গে কথা বলছে, একে অপরকে দোষারোপ করছে। ‘রূপা’ বলছে, “তুই সব সময় কাঁদিস! কাঁদলে কেউ দেবে সম্মান?”—‘তৃষা’ শান্তভাবে বলে, “কাঁদা দুর্বলতা নয়, অনুভব করাই জীবিত থাকা।” আর ‘বুবলি’ ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলছে, “আমি শুধু একটু আদর চাই।” মহুয়া দুই হাতে মাথা চেপে ধরে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না—এই ছায়ারা একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পড়েছে, একটিকে আরেকটি মেনে নিতে পারছে না। যেন তার ভিতরের বাড়িটাই এখন যুদ্ধক্ষেত্র।

হঠাৎ, তার মনে পড়ে যায় একটি ভয়াবহ অভিজ্ঞতা—ছোটবেলায় একবার স্কুলে অপমানিত হওয়ার পর, সে বাড়ি ফিরে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল, কোনো কথা না বলে। সেই দিনই সে প্রথম লিখেছিল—“তারা আমায় ভালোবাসেনি। আমি আর থাকব না।” এখন সে বুঝতে পারে, সেই সময়েই বুবলি তাকে জড়িয়ে ধরেছিল। আবার, কলেজে এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর যে রাতে সে ছাদে উঠে গিয়েছিল, সেই রাতেই প্রথম রূপা এসেছিল। যে অফিসের প্রেজেন্টেশনে সে অসম্ভব সফল হয়েছিল, কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে কাঁদতে ইচ্ছা করেছিল—সেই দিনই তৃষা শব্দে আত্মপ্রকাশ করেছিল। এই সব ক্ষত একে অপরের সঙ্গে লড়াই করতে করতে আজ এক গভীর সংঘর্ষে পরিণত হয়েছে। মহুয়া বুঝতে পারে, তাদের একত্রে থাকা দরকার, কিন্তু তারা একে অপরকে শ্রদ্ধা করে না। রূপা শুধু রাগ জানে, তৃষা শুধু চুপ করে থাকে, আর বুবলি শুধু পালাতে চায়। এই সত্তাগুলোর সংঘর্ষে তার শরীর হালকা হয়ে আসে—সে একসময় অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় বিছানায়।

চোখ খুলে দেখে, সে অন্ধকার এক ঘরে বসে আছে। চারপাশে দরজা—প্রতিটি দরজা একটা ভিন্ন আলোয় আলোকিত। একটায় গাঢ় লাল—রূপার ঘর; একটায় নীলাভ আলো—তৃষার; আরেকটি দরজা হালকা হলুদ রঙের—বুবলির। মহুয়া দরজাগুলোর দিকে তাকায়, কিন্তু হাঁটতে পারে না। তার পা আটকে আছে। হঠাৎ তিনটি দরজা একসঙ্গে খুলে যায়, এবং তিনটি ছায়া বেরিয়ে আসে—একটা জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে আছে, আরেকটি হাত মেলে ধরে দাঁড়িয়ে, আর তৃতীয়টি চোখ ঢেকে কাঁদছে। তারা একে অপরকে ঠেলে, দখল নিতে চায়। মহুয়া চিৎকার করে উঠে বলে, “থামো! তোমরা সবাই আমি, আমি তোমাদের বাদ দিতে চাই না।” এই চিৎকারে চারপাশের আলো ভেঙে যায়, এবং তার চেতনা যেন ছিঁড়ে যায় বহু সুতোর মতন। তারপর সব অন্ধকার। ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে এলে সে দেখে, সে নিজের বিছানায় শুয়ে আছে, তার পাশেই ডায়েরি পড়ে আছে মেঝেতে—ডায়েরির শেষ পাতায় লেখা, “আমরা আজ কথা বলেছি, কিন্তু এখনো ক্ষমা করিনি।”

পরদিন সে ড. সুস্মিতাকে সব খুলে বলে। সুস্মিতা ধৈর্য ধরে শোনেন, এবং বলেন, “তোমার ভিতরের প্রতিটি সত্তা আসলে তুমি নিজেই—তোমার অভিজ্ঞতা, বেদনা, প্রতিক্রিয়া। এখন তাদের আলাদা আলাদা শোনালেও একদিন তারা একসঙ্গে কথা বলবে, যদি তুমি তাদের গ্রহণ করো।” মহুয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর বলে, “তারা সবাই একেকটা চিঠি যেন। আমি আগে পড়িনি। এখন থেকে পড়ব।” ড. সুস্মিতা বলেন, “তাদের মধ্যে শান্তি আনার জন্য তোমাকে mediator হতে হবে—তোমাকে তাদের একে অপরের ভাষা শেখাতে হবে।” মহুয়া মাথা নাড়ে, জানে সহজ হবে না। কিন্তু আজ থেকে সে আর ভয় পাবে না নিজের ভেতরের ঝড়কে। আয়নায় তাকিয়ে সে দেখে—আবার কেউ তার পেছনে দাঁড়িয়ে নেই, কেউ ছায়ার মতো আসেনি। কারণ আজ তার নিজের ছায়া তার সঙ্গে মিলেমিশে গেছে—লড়াইয়ের মধ্যেও সহাবস্থানের প্রথম ধাপ শুরু হয়েছে।

আট

আকাশ মেঘে ঢেকে আছে, যেন আলো আসার আগে প্রাকৃতিক জগতেও প্রস্তুতির দরকার হয়। মহুয়া সেই সকালটা শুরু করেছিল এক অদ্ভুত ভার অনুভব করে—ঘুম থেকে উঠে মনে হয়েছিল, অনেক কিছু ভুলে গিয়েছে আবার অনেক কিছু মনে পড়ে যাচ্ছে একসঙ্গে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে নিজের চোখে তাকায়—আজ প্রতিচ্ছবিটা কিছু বলে না, শুধু চেয়ে থাকে। গতরাতের তীব্র মানসিক সংঘর্ষের পর আজ এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। তার মনে হতে থাকে, কিছু দরজা খোলা হয়েছে—অতীতের, যেগুলো এতদিন পর্যন্ত অন্ধকারে ঢাকা ছিল। সে তার পুরোনো বইয়ের তাক ঘাঁটতে ঘাঁটতে খুঁজে পায় এক ছোট্ট বাক্স—তাতে আছে পুরোনো চিঠি, ছবির কপি, আর একটি সোনালি পেনড্রাইভ। তার ঠোঁট শুকিয়ে আসে। সে জানে, এই বাক্স খুললেই ফিরে আসবে এমন কিছু মুহূর্ত যা তার শিকড়। ধীরে ধীরে সে বাক্স খুলে চিঠিগুলো পড়তে শুরু করে। একটি চিঠিতে লেখা—“তুই যা করেছিলি, আমার বিশ্বাস ভেঙে গিয়েছিল। আমি তোকে ক্ষমা করতে পারিনি।”—চিঠিটা তার মা’র লেখা। আরেকটি চিঠি একজন বন্ধুর, যেখানে লেখা—“তুই ঠিকই ছিলিস, কিন্তু আমি তোকে পাশে দাঁড়াতে পারিনি। আমি ভয় পেয়েছিলাম।” মহুয়া প্রতিটি শব্দ পড়ে, প্রতিটি পঙ্‌ক্তি যেন ছুরি হয়ে তার মনে বিঁধে যায়। কিন্তু সে চুপ করে পড়ে, কান্না আসে না—এই চিঠিগুলো এখন তার কাছে প্রতিহিংসা নয়, বরং উত্তর।

চেম্বারে পৌঁছানোর পর সে ড. সুস্মিতাকে সব খুলে বলে। সে জানায়, এই স্মৃতিগুলোর ভেতর ছিল সেই সন্ধ্যা, যেদিন তার বাবার মৃত্যুর পর সে প্রথম স্কুলে ফিরেছিল—সবাই তাকিয়ে ছিল, কেউ কথা বলেনি, কেউ জিজ্ঞেস করেনি কিছু, অথচ পরদিন তার বেঞ্চের নিচে কেউ ফেলে গিয়েছিল তার বাবার ছবি, পেছনে লেখা—”মৃত্যুর নায়িকা!” মহুয়া সেই ছবি এতদিন পর দেখে নিজেই নিজের দিকে তাকাতে পারে না। সুস্মিতা ধীরে বলেন, “এই ছবিগুলো, চিঠিগুলো—তোমার স্মৃতির দরজা খুলে দিয়েছে। এগুলোই তোমার সত্তাগুলোর জন্মদাতা।” এরপর তাঁরা এক গভীর রিগ্রেশন সেশনে যান, যেখানে মহুয়া ধীরে ধীরে ফিরে যায় তার শৈশবের সেই বিকেলগুলোতে, মা যখন বারবার বলতেন—”মেয়েদের এতো বুদ্ধি থাকা ভালো না”, অথবা যখন স্কুলের দিদিমণি তার আঁকা কেটে বলতেন—”ইংরেজি পড়, পেইন্টিং দিয়ে কিচ্ছু হবে না।” সেই অপমান, সেই গলা চেপে ধরা কষ্ট, সেই শব্দহীন প্রতিবাদগুলো আজ সব একত্র হয়ে মাথার মধ্যে যেন ছায়া ছায়া মুখ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। মহুয়া দেখতে পায়—বুবলি তখন গা ঢাকা দেয়, তৃষা চুপচাপ লিখে চলে, রূপা গালাগাল দিয়ে দেয়। তারা কেউ কথা বলে না, শুধু বেঁচে থাকে।

সে যখন চেতনায় ফিরে আসে, তখন তার গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু ঠোঁটে একটা হালকা হাসি। সে বলে, “আমি আজ বুঝলাম, তারা আমার ভিতরের ধ্বংসাবশেষ নয়, তারা আমার কষ্টের কাব্য। তারা এসেছে আমাকে ভাঙতে নয়, গড়তে।” সুস্মিতা মাথা নাড়েন, “তুমি আজ প্রথমবার শুধু বুঝলে না, গ্রহণও করলে। এখন তোমার করণীয় একটাই—তাদের একসঙ্গে বসাও, এবং প্রতিটি অভিজ্ঞতাকে নিজের অংশ করে নাও।” সে আবার ডায়রির পাতায় ফিরে যায়, এবং লিখে—“এই ঘরটায় আমরা চারজন থাকি—আমি, রূপা, বুবলি, আর তৃষা। আমরা সবাই একেকটা সুর। এখন থেকে আমরা একসঙ্গে গান গাইব।” মহুয়া বোঝে, তার নিরাময় কোনো বাইরের ওষুধ নয়, বরং ভিতরের প্রতিটি স্তরকে আলাদা করে চিনে, তারপর তাদের জোড়া লাগানোর নামই মুক্তি।

চেম্বার থেকে ফেরার পথে তার মনে পড়ে যায়—যারা তাকে ‘অস্থির’, ‘অনিয়ন্ত্রিত’ বা ‘মানসিকভাবে অস্থির’ বলেছে, তারা কেউ তার ভিতরের জটিলতা বোঝেনি। কিন্তু আজ সে নিজেই নিজের মানচিত্র তৈরি করেছে। বাসায় ফিরে সে আয়নার সামনে দাঁড়ায়, তার চারপাশে কেউ নেই, কিন্তু সে স্পষ্ট শুনতে পায়—একটি মিষ্টি কণ্ঠ বলছে, “দিদি, আমরা কি আজ আঁকব?”—একটি গভীর স্বর বলছে, “দেখিস, কেউ কিছু বললে আমি রুখে দাঁড়াব”—আর একটি নরম শব্দ উচ্চারণ করছে, “তুই লিখ, তোর শব্দই তোর শক্তি।” মহুয়া হাসে। আয়নার প্রতিচ্ছবি আজ তাকে ভয় দেখায় না, বরং স্বাগত জানায়। আজ তার ভিতরের দরজাগুলো খুলে গেছে—বেদনার, স্মৃতির, শক্তির, আর সর্বোপরি—মুক্তির।

নয়

বিকেলের আলো যখন নরম হতে হতে ঢুকে পড়ছিল মহুয়ার ঘরের জানালা দিয়ে, তখন সে চুপ করে বসেছিল খোলা ছাদে। তার সামনে একটা ছোট টুল, পাশে রাখা রঙ পেনসিল, খাতা, একটা হেডফোন। সে এখন আর নিজের ভয় থেকে পালায় না—সে তাদের ডাকেও, কথা বলে, গল্প করে। সেই বিকেলে সে চেয়েছিল একসাথে কিছু করতে। তাই আজ সে নিজেকে পুরো সময় দিয়েছে—বুবলিকে সে দিয়েছিল পেনসিল, রূপাকে দিয়েছিল গানের প্লেলিস্ট, আর তৃষার জন্য খোলা রেখেছিল খাতার পাতা। বাতাসে তখন ভেসে আসছিল কোনও পুরনো রবীন্দ্রসংগীত—“আজি ঝর ঝর মুখর বাদলদিনে।” হঠাৎ এক অপূর্ব ভারসাম্য অনুভব করে মহুয়া—তার মনে হচ্ছিল, তার ভিতরে সবাই আজ একসঙ্গে উপস্থিত, কেউ একে অপরকে ঠেলে দিচ্ছে না, কেউ চুপ করিয়ে দিচ্ছে না। সেই সন্ধ্যা নামার মুহূর্তে সে মাথা তুলে দেখে—আকাশে উঠছে গোল চাঁদ। সে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে, আর মনে মনে ভাবে, “আমরা সবাই তো এই চাঁদের আলোর মতো—নরম, কিন্তু দৃশ্যমান, ছায়ার ভিতরেও স্পষ্ট।”

হঠাৎ করে তার মন কেমন যেন ধন্যতা অনুভব করে—এই প্রথম সে তার ভিতরের প্রতিটি সত্তার অস্তিত্বকে সম্মান জানাতে চায়। সে চোখ বন্ধ করে এক এক করে তাদের ডাকে। প্রথম আসে বুবলি—তার ছোট্ট কণ্ঠে বলে, “দিদি, আজ তুমি আমায় বাইরে এনেছো?” মহুয়া বলে, “হ্যাঁ, বুবলি। তুমি আজ পুরো আকাশ দেখো, যা আগে কখনো দেখনি।” বুবলি হাঁসছে, খাতায় গোলাকার চাঁদ আঁকছে। তারপর আসে তৃষা—নীরব চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, “এই আলোটা যেন ভেতরের অন্ধকারে একটু শান্তি দেয়।” মহুয়া তার হাতে খাতা দেয়—“লিখো তৃষা, আজ তোমার কবিতা কারও পড়ার জন্য নয়, শুধু তোমার নিজের জন্য।” তারপর রূপা এসে বসে, হালকা বিদ্রুপ ভঙ্গিতে বলে, “তুই এখনো বিশ্বাস করিস চাঁদে শান্তি আছে?” মহুয়া হেসে ফেলে—“না রূপা, কিন্তু তুমি পাশে থাকলে আমার ভয় কমে।” রূপা কিছু বলে না, শুধু হেডফোনে প্লেলিস্ট ঘাঁটে—একটা লড়াকু হিন্দি গান বেজে ওঠে। এই মুহূর্তে চারটি সত্তা একসঙ্গে এক ছাদের নিচে, এক দেহে, এক মনে, কিন্তু কোনোরকম দখলদারি ছাড়া। এটা ছিল এক অভাবনীয় মিলন।

সেই রাতেই মহুয়া তার ডায়েরিতে লেখে—“আমরা চারজন আজ একসাথে চাঁদ দেখলাম। আমরা সবাই একে অপরকে শুনলাম, বললাম না—’তুই চুপ কর’, বললাম—’তুই থাক, আমি শিখব তোকে’।” এই লেখার ভেতর এক অদ্ভুত শুদ্ধতা ছিল। সে প্রথমবার বুঝতে পারে, তার মানসিক পরিস্থিতি কোনো বিকার নয়—এ এক ধরণের অসাধারণ আত্ম-সংবেদনশীলতা, যা অধিকাংশ মানুষ অনুভব করে না। সে চায়, এই অনুভূতিগুলোকে সে আর লুকিয়ে না রাখুক। পরদিন সে ড. সুস্মিতার কাছে গিয়ে বলে, “আমরা এখন একসাথে হাঁটতে চাই। আমি চাই, রূপা আর বুবলি একসাথে সিনেমা যাক, তৃষা আর আমি একটা কবিতা পড়ি ক্লাসে।” সুস্মিতা তার এই পরিবর্তন দেখে মুগ্ধ হন। তিনি বলেন, “তোমার ভিতরে এখন একধরনের সমঝোতা তৈরি হয়েছে—যেটা খুব অল্প মানুষই পারে। এখন থেকে তোমার নিরাময় প্রক্রিয়া বাইরে নয়, ভিতর থেকেই চালিত হবে।” মহুয়া জানে, এই মুহূর্তের শান্তি চিরস্থায়ী না-ও হতে পারে, কিন্তু সে প্রস্তুত—আবার যদি সংঘর্ষ আসে, সে ভয় পাবে না।

রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে সে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। আয়নার ভেতরের মুখটা আজ আর অচেনা নয়। সে নিজেই তার প্রতিচ্ছবি। আজ সে কেবল নিজেকে দেখে না, সে অনুভব করে—চোখের কোণে বুবলির কৌতূহল, ঠোঁটের কোণে রূপার তীক্ষ্ণতা, আর হৃদয়ের গভীরে তৃষার কাব্য। সে জানে, তার নাম মহুয়া, কিন্তু তার ভিতরে আছে চারটি শক্তি—চারটি চাঁদের আলো, যারা একসাথে আকাশে ওঠে না, কিন্তু মিলেমিশে তার জীবনকে পূর্ণ করে। আয়নায় তাকিয়ে সে ফিসফিস করে বলে, “তোমরা সবাই থাকো আমার সঙ্গে। আজ থেকে আমরা চাঁদের নিচে একসাথে হাঁটব।”

দশ

মহুয়ার জীবনে এখন একটা শান্ত, ধীর ছন্দ ফিরে এসেছে—যেখানে সকাল শুরু হয় নিজের অনুভূতি বুঝে, দিন চলে পরিকল্পনামাফিক, আর রাত শেষে ডায়েরির পাতায় হৃদয়ের খসড়া লেখা হয়ে থাকে। কিন্তু এই নিয়মিত জীবনের মধ্যেও মাঝেমাঝে হঠাৎ এক ধরনের হিম-ঠান্ডা বাতাস বয়ে যায় তার মনে—যেমন সেদিন, যখন সে নিজের অফিস ডেস্কে বসে একটা বড় প্রেজেন্টেশনের মাঝখানে নিজেকে হঠাৎ ভুলে গেল। সে বুঝে উঠতে পারছিল না, তার সামনে বসে থাকা সহকর্মীদের নাম, তাদের পদ কিংবা তাদের সঙ্গে সম্পর্ক—সব যেন মুছে যাচ্ছে তার মাথা থেকে। তার ভেতরে একটা শব্দ আওয়াজ করছিল—‘তুই এখনও ঠিক হসনি।’ এই অস্পষ্টতা, এই অনাহুত কণ্ঠস্বর আবার তার আত্মবিশ্বাসে আঘাত হানে। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে সে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। কিন্তু আজ আয়নায় কোনো মুখ স্পষ্ট নয়—আলো আর ছায়ায় ভাঙা ভাঙা, অস্পষ্ট প্রতিবিম্ব, যেন কেউ তার মুখখানা হাত দিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছে। আয়নার ঠিক মাঝ বরাবর একটা চির দেখা যায়। হঠাৎ সে অনুভব করে, তার ভিতরের কেউ কাঁদছে আবার কেউ রেগে আছে। সত্তাগুলোর মধ্যে আবার সংঘাত জন্ম নিচ্ছে—তবে এবার তা নীরব, গোপন, ঠান্ডা এক যুদ্ধ।

পরদিন সে ড. সুস্মিতার কাছে গিয়ে বলে, “আমি ভেবেছিলাম আমি ঠিক হয়ে গেছি, কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয় আমার ভিতর আবার ভেঙে পড়ছে।” সুস্মিতা তাকে অনেকক্ষণ চুপ করে শুনে বলেন, “চিকিৎসা কোনো সরলরেখা নয়, এটা একটা তরঙ্গের মতো—উচ্চতা ও নিম্নতা আসবেই। তুমি এগিয়ে যাচ্ছো, কিন্তু পুরোনো ক্ষতগুলো মাঝে মাঝে টোকা দিয়ে মনে করিয়ে দেবে—তারা এখনো সেখানে আছে।” এরপর তাঁরা এক গভীর আলোচনায় যান, যেখানে মহুয়া তার ভেতরের ‘রূপা’-র সঙ্গে কথা বলে—যে বলছে, “সবাই ভুলে যায়, কিন্তু আমি ভুলি না। আমি ছাড়ি না কাউকে।” এবং ‘তৃষা’, যে বলছে, “আমি এত শব্দ লিখি, তাও ব্যথা যায় না।” ‘বুবলি’ বলে না কিছু, কেবল মেঝেতে বসে নিঃশব্দে ছবি আঁকে। মহুয়া বোঝে—তারা সবাই তাকে রক্ষা করতে গিয়েই ভেঙে পড়েছে। একে অপরকে আঘাত করে ঠিক রাখতে চেয়েছে। তার ভেতরে যে ক্ষত এতদিনে সেলাই হয়েছে, সেটি মাঝে মাঝে ছিঁড়ে যায়, যেমন পুরোনো সেলাইয়ের জায়গা থেকে আবার রক্ত পড়ে। সেই ভাঙা আয়নার প্রতিটি টুকরো যেন একটি করে অভিজ্ঞতা—কোনোটা লজ্জার, কোনোটা অপমানের, আবার কোনোটা ভাঙা ভালোবাসার।

সেই রাতে মহুয়া সিদ্ধান্ত নেয়, এবার সে ভাঙাগুলো নিয়ে কাজ করবে। সে আয়নাটা খুলে দেয়, হাতে তোয়ালে পেঁচিয়ে এক এক করে আয়নার ভাঙা টুকরোগুলো নামিয়ে আনে—প্রতিটি টুকরোতে তার নিজস্ব প্রতিবিম্ব দেখায়। একটা টুকরোতে শুধু তার চোখ, যেটা চিৎকার করে; আরেকটায় ঠোঁট, যেটা কিছু বলতে চায়, কিন্তু দমে যায়; তৃতীয় টুকরোতে তার হাত—ভয়ানকভাবে কাঁপছে। এই টুকরোগুলো সে কাগজে নামিয়ে রাখে, তারপর শুরু করে এক একটি প্রতিচ্ছবিকে লিখে ফেলা। সে ভাবে, এই প্রতিটি আয়নার টুকরো একটা চরিত্র—যারা কখনও সুযোগ পায়নি একসঙ্গে উঠে দাঁড়ানোর। মহুয়া প্রতিটি অনুভবকে কবিতায় রূপ দেয়, সেইসব মুহূর্তকে সে চিঠি করে পাঠায় ভবিষ্যতের নিজেকে। এই কাজটা করতে করতে এক রাত তার কেটে যায়, কিন্তু সকালবেলা, জানালার পর্দা সরাতেই সে দেখে—আকাশে রোদ উঠেছে। আয়নার জায়গায় এখন খালি দেয়াল, কিন্তু তার সামনে রাখা প্রতিটি কাগজে তার নিজের মুখ ছাপা হয়ে গেছে—রূপা, তৃষা, বুবলি, আর মহুয়া—একই মুখ, শুধু ভিন্ন আলোতে।

এখন সে জানে, আত্ম-নিরাময় মানে নিজের সমস্ত রূপের সঙ্গেই একসাথে হাঁটা, আবারও ভাঙা, আবার জোড়া লাগানো। সে ড. সুস্মিতাকে বলে, “আমার ভিতরের আয়নাটা আর নিখুঁত নয়, কিন্তু প্রতিটি দাগ আমার গল্পের অংশ। আমি চাই না সে আয়না মুছে যাক।” সুস্মিতা বলেন, “যা ভাঙে, তা-ই তোমার শক্তি হতে পারে—যদি তুমি তাকেই ভাষা দাও।” মহুয়া বুঝে, সে এখন তার সমস্ত অনুভবকে ভাষা দিতে পারছে। আয়নার ভাঙা টুকরোগুলো নিয়ে সে নতুন কোলাজ তৈরি করে, দেয়ালে ঝুলিয়ে দেয় তার শয্যার পাশে। তার চতুর্দিকে এখন আর ছায়ারা লুকিয়ে নেই—তারা এসেছে সামনে, একসঙ্গে, এক আলোয়। সে আজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলে, “তুমি আর অচেনা নও। তুমি আমি—ভাঙা, জোড়া, সুন্দর।”

এগারো

বছরের শেষ সন্ধ্যে। বাইরে ঠান্ডা বাতাস বইছে, শহরের কুয়াশা জানালায় জমে উঠেছে। মহুয়া জানালার ধারে বসে, ডায়েরি বন্ধ করে। গত এক মাসে সে নিজেকে যেভাবে দেখতে শিখেছে, তাতে তার আর কোনো সত্তাকে ভয় লাগছে না। রূপা, বুবলি, তৃষা—এরা এখন তার জীবনযাত্রার অংশ, কখনও খেলা করে, কখনও চুপ করে থেকে পাশে দাঁড়ায়। অথচ, এই শীতের রাতে তার বুকের মধ্যে একটা অজানা স্রোত চলছে—অন্তর্লীন, শব্দহীন, তবু একপ্রকার উপস্থিতি অনুভব করায়। তার মনে হয়, যেন কেউ তাকিয়ে আছে, কোনও এক অন্ধকার কোণ থেকে, অনেক দিন ধরে। সে আয়নার দিকে তাকায়, এবার আয়নার প্রতিচ্ছবি তার সঙ্গে চোখাচোখি করে না—বরং আয়নার পেছনে যেন আরও এক জোড়া চোখ জ্বলজ্বল করে। প্রথমে সে ভয় পায় না, বরং বলে, “তুমি কে?” এবং ঠিক তখনই তার মাথায় বজ্রাঘাতের মতো একটা দৃশ্য উঠে আসে—একটি শিশু, একা একটা ঘরে বসে আছে, তার চোখ দুটো ফাঁকা, কাঁদছে না, হাসছে না। সেই শিশুটি মহুয়া নিজেই, কিন্তু তার চোখে এমন নিরাসক্ত দৃষ্টি, যেন সে শুধু দেখছে। কোনো অনুভব নেই, শুধু পর্যবেক্ষণ।

এই সত্তাটি রূপা বা বুবলি বা তৃষা নয়। এই সত্তা কারো সঙ্গে লড়াই করে না, কাউকে সান্ত্বনা দেয় না। সে শুধুই দেখে। সে ছিল শুরু থেকেই—যখন মহুয়া প্রথম অপমানিত হয়েছিল, যখন সে ভালোবাসা হারিয়েছিল, যখন সে আয়নার সামনে কাঁদতে গিয়ে চুপ করে গিয়েছিল। এই সত্তা সব দেখেছে, কিছুই বলেনি। সে ছিল মহুয়ার ‘নিরব দর্শক’। এখন সে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। মহুয়া তাকে চিনতে চায়—সে চোখ বন্ধ করে মনের গভীরে ঢোকে, এবং সেখানে সে পায় এক অদ্ভুত ঘর—কোনো দেয়াল নেই, জানালা নেই, শুধু চারপাশে আয়না। প্রতিটি আয়নায় মহুয়ার ভিন্ন মুখ—রূপা, বুবলি, তৃষা, এমনকি ছোটবেলার মহুয়াও আছে। কিন্তু ঘরের মাঝখানে বসে আছে এক নিরাবেগ শিশু, তার ঠোঁটে কোনও শব্দ নেই, চোখে না ক্রোধ, না ভালোবাসা। মহুয়া তার কাছে এগিয়ে যায়, জিজ্ঞেস করে, “তুমি এতদিন কিছু বলোনি কেন?” শিশুটি বলে, “আমার কাজ ছিল দেখা। তুমি যা হতে পারো, আমি তা দেখেছিলাম। আমি চুপ ছিলাম কারণ শব্দে সত্যি হারিয়ে যায়।” এই কথার পর মহুয়া বোঝে, এই সত্তা তার পরিণত ‘বিবেক’, যে কোনও পক্ষ নেয় না, শুধু তথ্য দেখে। একে ছুঁয়ে দেখলে মন ভেঙে যায়, তবু সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

ড. সুস্মিতাকে সে এই অভিজ্ঞতার কথা জানায়। সুস্মিতা স্তব্ধ হয়ে শোনেন, তারপর বলেন, “তুমি তোমার ‘মেটা-সত্তা’র সংস্পর্শে এসেছো—এটাই তোমার চেতনার সবচেয়ে গভীর স্তর। এই সত্তা না পুরোনো না নতুন, না রাগী না কাঁদুনি—সে নির্লিপ্ত, কারণ সে সমস্ত ঘটনার সাক্ষী।” মহুয়া বুঝতে পারে, এই সত্তাই সব সত্তার আয়না। এবং তার কাজ হলো—এই দর্শককে আর গোপনে বসে থাকতে না দেওয়া, বরং প্রতিটি অভিজ্ঞতার মাঝখানে তার আলোকে ছড়িয়ে দেওয়া। সেদিন রাতে, মহুয়া আরেকবার আয়নার সামনে দাঁড়ায়, এবার সে নিজেকে দেখে না—সে দেখে এক চোখ, একটি নিরব প্রকাশ, একটি স্থিরতা, যা এতদিন উপেক্ষিত ছিল। সে বুঝে যায়, যেদিন সে প্রথম আয়নায় নিজেকে অচেনা দেখেছিল, সেদিন এই দর্শক তার দিকে তাকিয়ে ছিল, মুখে না বলা একটি প্রশ্ন নিয়ে—“তুই কে?” আজ মহুয়া সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না, কিন্তু সে ভয়ও পায় না। বরং বলে, “আমি তোরই অংশ, তুই আমার ‘সাক্ষী’, তুই আমার গল্পের শেষ পাঠক।”

রাত ঘনিয়ে আসে। মহুয়া তার সকল সত্তাকে নিয়ে একখানা কবিতা লেখে, যেখানে সে প্রত্যেকের নাম নেয়—তৃষা শব্দ, রূপা আগুন, বুবলি বৃষ্টি, আর সেই দর্শক—নির্বাক আকাশ। সে জানে, এই কবিতাটি সে কাউকে দেখাবে না, এ শুধু নিজের জন্য। ডায়েরির পেছনের পাতায় সে লেখে—“আজ আমার ভিতরে শব্দ নেই, শুধু নীরবতা। তবু আমি জানি, আমি একা নই।” পরদিন সকালে, সে ঘুম থেকে উঠে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। আর এবার, আয়নায় একটিই মুখ—তবে তাতে বুবলির চোখ, রূপার কপাল, তৃষার ঠোঁট, আর সেই শিশুর নিরব দৃষ্টি। সব একসঙ্গে। সব আমি। সব মহুয়া।

বারো

রবিবারের সকাল। ঘরের জানালায় নরম রোদ এসে পড়ছে, বাতাসে ভেসে আছে অচেনা শীতের গন্ধ। আজকে মহুয়ার ছুটির দিন, কিন্তু সে আর আগের মতো ছুটি মানেই শুয়ে থাকার মানুষ নয়। আজ সে বিছানা গোছায়, নিজের কাগজগুলো সাজায়, জানালার পর্দা তুলে দেয়। আর তারপরে, সে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় সেই আয়নার সামনে—যেখানে বছরখানেক আগেও তার নিজস্ব মুখ অচেনা ছিল। আজ আয়নার কাচে ধুলো নেই, ফাঁটল নেই, ছায়াও নেই। কিন্তু প্রতিচ্ছবিতে আজও অনেক স্তর—যা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু অনুভবে ধরা পড়ে। সে চেয়ে থাকে নিজের চোখের দিকে—আজ চোখে ভয় নেই, অনুরাগ আছে, জিজ্ঞাসা নেই, আত্মবিশ্বাস আছে। সে বুঝতে পারে, এই আয়নাটা আর আগের মতো ভয়ানক নয়, এখন এটা একটা জানালা—ভেতরের দিকে খোলা, বাইরের দিকে নয়। মহুয়া আজ প্রথমবার নিজের নাম উচ্চারণ করে আয়নার সামনে, যেন নিজেকেই চিনিয়ে দিচ্ছে—“আমি মহুয়া, আমি শুধু একজন নই, আমি বহুস্বরের সমবায়।”

সেই বিকেলে সে ড. সুস্মিতার কাছে যায় শেষবারের মতো। আজ আর তাকে নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কোনো প্রশ্নও না। সুস্মিতা বলেন, “তোমার ভেতরের প্রতিটি স্তরের সঙ্গে যেভাবে তুমি পরিচিত হয়েছো, সেটাই নিরাময়ের শেষ ধাপ নয়, শুরু। কারণ আমরা প্রতিদিন নতুন সত্তা ধারণ করি। আজ যেটা শক্তি, কাল সেটা ছায়া হতে পারে। কিন্তু তুমি এখন জানো, কীভাবে আলোর মতো চলতে হয় ছায়ার ভিতর দিয়ে।” মহুয়া মাথা নাড়ে। সে জানে, আজ সে সুস্থ—কিন্তু তার মানে এই নয় যে সে ভেঙে পড়বে না। বরং এখন সে জানে, ভাঙা মানে শেষ নয়, ভাঙা মানে নতুনভাবে গড়া। আজ তার ভিতরে রূপা আছে—যে তাকে রক্ষা করে, তৃষা আছে—যে তাকে ভাষা দেয়, বুবলি আছে—যে তাকে কোমল করে, আর সেই নীরব দর্শক, যাকে সে কোনো নাম দেয়নি—সে থাকে পাশে, দেখার জন্য, বোঝার জন্য। মহুয়া হাসে, চোখে জল আসে না—কেননা তার অনুভূতিরা এখন আর গোপন নয়।

বাসায় ফিরে সে এক অভিনব কাজ করে। সে আয়নার পাশে একটি নতুন আয়না লাগায়—তবে সেটি চওড়া, তাতে চারপাশে ছোট ছোট পোস্ট-ইট লাগানো, যেখানে লেখা—“তৃষা আজ কেমন?”, “রূপা শান্ত আছে?”, “বুবলি কি আজ ছবি আঁকলো?”, আর মাঝখানে বড় অক্ষরে লেখা—“তুমি একা নও।” এই আয়নার দিকে তাকিয়ে সে প্রতিদিন নিজেকে প্রশ্ন করে—আজ কার প্রয়োজন বেশি? আজ কে কষ্ট পাচ্ছে? আজ কে আনন্দে আছে? মহুয়া এখন আর শুধু নিজের জন্য বাঁচে না, সে বাঁচে নিজের সব টুকরো, সব অনুভব, সব অতীত ও সম্ভাবনার জন্য। সেই রাতে, চাঁদের আলোয়, সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলে, “আমার গল্পটা শেষ নয়। আমি শুধু এক সত্তা নই, আমি একটা চলমান ক্যানভাস—যেখানে প্রতিটি রং আমার নিজের।”

শেষ দৃশ্যে মহুয়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে—একেবারে নিঃশব্দে, চোখে একরাশ শান্তি। আয়নায় তার প্রতিচ্ছবি তাকিয়ে থাকে তার দিকেই, কিন্তু আজ প্রতিচ্ছবির মুখটা তার মতোই, চোখ দুটো একই ভাষায় কথা বলে। আয়নার কাচে একটা হালকা ছায়া ভেসে ওঠে, চারটি পাঁপড়ির মতো—রূপা, তৃষা, বুবলি, আর সেই দর্শক। তারা কেউ আর মুখ ঢেকে নেই, তারা সবাই আজ একসঙ্গে। মহুয়া আয়নার দিকে এগিয়ে এসে বলে, “তোমরা তো আমার ভেতরের আলো। আমি তো তোমাদের প্রতিচ্ছবিই। আর আজ, আয়নাটা কেবল কাচ নয়—এটা আমার নিজেকে দেখার, ভালোবাসার, গ্রহণ করার প্রতীক। আজ আমি আর অচেনা নই। আমি মহুয়া। আমি সম্পূর্ণ।”

শেষ

1000030849.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *