অরিন্দম মুখোপাধ্যায়
পর্ব ১: সুরের প্রথম রাত
দুর্গাপুরের সেই কারখানাটা শহরের বাইরে, গঙ্গার ধারে, ঝোপঝাড়ে ঢেকে গেছে আজ। ইট-সিমেন্ট ভাঙা, জানালার কাচগুলো শূন্য চাহনির মতো তাকিয়ে থাকে। রাতের বেলা লোকজন ওদিক মাড়ায় না—কেউ বলে শিয়াল-কুকুর আছে, কেউ বলে ভুত আছে।
সেই রাতে অরূপ, শহরের এক সাংবাদিক, হঠাৎ শুনতে পেল খবর—
“দাদা, কারখানার ভেতরে আবার বাঁশির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।”
একজন চা-ওয়ালা বলছিল। গলাটা ফিসফিসে, চোখে ভয়।
অরূপ সঙ্গে সঙ্গে খুঁটিয়ে জানতে চাইল।
চা-ওয়ালা কাঁপা গলায় বলল,
“আগের বার শুনেছিল যে, সে নাকি তিন দিনের মধ্যে নিখোঁজ হয়ে গেছে। এ বার আবার বাজছে, কাল রাত থেকেই।”
অরূপের ভেতর সাংবাদিকের কৌতূহল জেগে উঠল। পুরনো নথি ঘেটে সে জানল—১৯৭৪ সালে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছিল এই কারখানায়। বয়লার বিস্ফোরণে ২১ জন শ্রমিক মারা যায়। তাদের মধ্যে একজন ছিল নিত্যানন্দ, সে রাতে বাঁশি বাজাতে বাজাতে কাজ করছিল।
লোকমুখে শোনা যায়, সেই বাঁশির সুরই নাকি এখনো বাজে, আর যেই শোনে, সে ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়।
অরূপ ঠিক করল, সে নিজেই কারখানার ভেতরে যাবে। সত্যিই বাঁশির সুর বাজে কিনা, না কি এগুলো শুধু গুজব।
রাত দশটার সময় টর্চ আর ক্যামেরা নিয়ে সে ঢুকে পড়ল কারখানার ধ্বংসস্তূপে। ভাঙা গেটের নিচ দিয়ে ঢুকতেই কেমন একটা ঠাণ্ডা হাওয়া লাগল গায়ে।
নীরবতার মধ্যে হঠাৎ—
মৃদু, টানা একটা বাঁশির সুর ভেসে এল।
অরূপ থমকে দাঁড়াল। গলা শুকিয়ে এল, অথচ কলমে নোট নিল—
“হ্যাঁ, শব্দ সত্যি আছে।”
কিন্তু সুরটা যত এগোতে লাগল, তার মনে হলো, যেন কেউ ঠিক তার পেছনেই দাঁড়িয়ে বাজাচ্ছে। সে ঘুরে তাকাল—শুধু অন্ধকার আর ভাঙা দেয়াল।
বাঁশির সুর এবার ভেতরের হলঘর থেকে ভেসে আসছে।
অরূপ এগোতে লাগল। পায়ের শব্দ প্রতিধ্বনির মতো বাজছে। হলঘরে ঢুকতেই হঠাৎ বাতাস ভারি হয়ে গেল। ভাঙা মেশিনগুলোর ফাঁকে, এক কোণে, আলো-আঁধারি জায়গায়, কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সে।
ম্লান আলোয় মনে হলো, একজন শ্রমিক, হাতে বাঁশি।
অরূপ কেঁপে উঠল—
কিন্তু চোখ সরাতেও পারল না।
সেই মুহূর্তে বাঁশির সুর থেমে গেল।
নিঃশব্দ হলঘরে শুধু অরূপের হৃদস্পন্দন শোনা যাচ্ছিল।
পর্ব ২: অদৃশ্য দর্শক
অরূপ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। দূরের কোণে যে মানুষটার ছায়া সে দেখেছিল, সেটি কি সত্যিই একজন মানুষ, নাকি চোখের ভুল? তার টর্চের আলো ভাঙা দেয়ালের গায়ে পড়তেই খালি ইট আর লোহার মরচেধরা যন্ত্রাংশ ছাড়া আর কিছু দেখা গেল না। অথচ কিছুক্ষণ আগেও সে স্পষ্ট দেখেছিল—একজন বাঁশিওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে।
তার শরীর কেঁপে উঠল। কিন্তু ভয়ের চেয়ে কৌতূহল বেশি। সে এগিয়ে গিয়ে ক্যামেরা তুলল, কিছু ছবি নিল। ফ্ল্যাশে মুহূর্তিক আলোর ঝলকানিতে দেখা গেল দেয়ালের ওপর অদ্ভুত দাগ, যেন পুরনো রক্তের দাগ শুকিয়ে গাঢ় হয়ে গেছে।
এবার আবার বাঁশির সুর ভেসে উঠল। এবার আগের চেয়ে পরিষ্কার, দীর্ঘ।
অরূপ অনুভব করল—সুরটা যেন সরাসরি তার কানের ভেতর ঢুকে মাথার ভেতরে প্রতিধ্বনি করছে। শরীরে হিমেল একটা কাঁপুনি বইতে লাগল।
সে ক্যামেরা নামিয়ে চারপাশে তাকাল। কারখানার ছাদ ফাঁকফোকর দিয়ে চাঁদের আলো ঢুকছে। কেবল ঝোপে-ঢাকা ভাঙাচোরা যন্ত্রপাতি আর মরচে ধরা লোহার গন্ধ। কিন্তু সুর থামছে না।
হঠাৎ টর্চ নিভে গেল। অরূপ অন্ধকারে ঢেকে গেল।
চোখের সামনে ঘন ছায়া। আর সেই ছায়ার ভেতর থেকে যেন একদল শ্রমিক বেরিয়ে আসছে—কেউ হেলমেট পরে, কারও হাতে বাঁশি, কারও চোখ পুড়ে গিয়েছে। তারা সবাই নিঃশব্দে তার দিকে এগিয়ে আসছে।
অরূপ ঘাবড়ে গিয়ে টর্চ আবার চালু করল। আলো জ্বলতেই সব গায়েব। কেবল ভাঙা মেশিন আর মরচে ধরা লোহা।
তার বুক ধড়ফড় করছে। কানে এখনও বাঁশির সুর। যেন সেই সুর তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কন্ট্রোল রুমের দিকে।
সে নিজেকে সামলাতে না পেরে পা বাড়াল।
কন্ট্রোল রুমে ঢুকতেই এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখল—
সব যন্ত্রপাতি নিজে থেকে চালু হয়ে উঠেছে। লাইট টিমটিম করছে, সুইচবোর্ডে লাল-সবুজ আলো ঝলমল করছে। অথচ বিদ্যুৎ সংযোগ তো বহু বছর আগেই কেটে দেওয়া হয়েছে।
সেই আলো-আঁধারির মধ্যে, ঘরের কোণে, কেউ বসে আছে। মাথা নিচু, হাতে বাঁশি।
অরূপের গলা শুকিয়ে গেল। ঠোঁট থেকে ফিসফিসিয়ে বেরোল—
“তুমি কে?”
কোনো উত্তর নেই। শুধু বাঁশির সুর থেমে গিয়ে হঠাৎ কাঁপা-কাঁপা হাসির মতো শব্দ শোনা গেল।
অরূপ পিছিয়ে যেতে চাইলো, কিন্তু দেখল দরজাটা অদৃশ্য কোনো শক্তি দিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে।
পর্ব ৩: লাল আলোয় ছায়া
অরূপ দরজায় হাত দিল, কিন্তু নড়ল না। কাঠের মতো শক্ত হয়ে আছে। ভেতরটা অদ্ভুত গরম হয়ে উঠেছে, অথচ বাইরে তখনো শীতের রাত।
হঠাৎ কন্ট্রোল রুমের আলো সবুজ থেকে টকটকে লাল হয়ে গেল। অরূপের চোখ ঝলসে উঠল। দেয়ালজোড়া যন্ত্রগুলো যেন আগুনের মতো জ্বলতে শুরু করল।
ঘরের কোণে বসে থাকা মানুষটা ধীরে ধীরে মাথা তুলল। চাঁদের আলোয় অরূপ দেখতে পেল—চোখ দুটো ফাঁকা গর্তের মতো, কেবল শূন্যতা। ঠোঁট শুকনো, অথচ বাঁশি হাতে শক্ত করে ধরা।
অরূপ কাঁপা গলায় বলল,
“তুমি কি… নিত্যানন্দ?”
নিঃশব্দ। তারপর আচমকা বাঁশির সুর শুরু হল। এবার আর মৃদু নয়—বুক ফাটানো তীক্ষ্ণ, লম্বা সুর।
অরূপের মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। মনে হলো, চোখের সামনে সবকিছু দুলছে।
সে টলতে টলতে যন্ত্রপাতির ওপর ভর দিল। ক্যামেরা তার হাত থেকে পড়ে গেল মাটিতে।
কিন্তু সেই ক্যামেরা হঠাৎ নিজে থেকেই ক্লিক করতে লাগল। আলো ঝলকাচ্ছে একের পর এক। যেন কেউ ছবিগুলো তুলছে।
অরূপ আতঙ্কে দেখল, প্রতিটি ছবির ফ্ল্যাশে কয়েকটা ছায়া ধরা পড়ছে—একটা, দুটো নয়, বিশজন শ্রমিক। পুড়ে যাওয়া মুখ, ছাইভরা চোখ, কেউ হেলমেটহীন, কেউ হাত কেটে যাওয়া। তারা সবাই বাঁশিওয়ালার চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে।
অরূপ দম নিতে পারছিল না। বুকের ভেতর শূন্যতা জমে যাচ্ছে। তবুও গলা শুকনো গলায় চিৎকার করল,
“আমি শুধু জানতে এসেছি! কেন ডাকছো আমাকে?”
বাঁশিওয়ালা এবার ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে উঠল। তার শরীর মাটিতে ছায়ার মতো ভেসে রইল, অথচ পা নেই। সে এগিয়ে এল অরূপের দিকে।
সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভেতর বাতাস ভারি হয়ে গেল, যন্ত্রপাতি কেঁপে উঠল। অরূপ বুঝল, সে পালাতে পারবে না।
ঠিক তখনই বাঁশিওয়ালা বাঁশি ঠোঁটে তুলল, আর এক অন্যরকম সুর বাজাল। এবার সুরটা কোমল, কিন্তু অদ্ভুত মায়াময়।
অরূপের চোখ ধীরে ধীরে ঝাপসা হতে লাগল। যেন সে কোনো গভীর ঘুমে ডুবে যাচ্ছে।
শেষবার তার চোখে ভেসে উঠল লাল আলোয় দাঁড়িয়ে থাকা মৃত শ্রমিকদের ভিড়—আর তারপর সব অন্ধকার।
পর্ব ৪: হারিয়ে যাওয়া নথি
অরূপ হঠাৎ টের পেল সে অন্য কোথাও আছে। চোখ খুলতেই দেখল, সে একটা পুরনো অফিসরুমে বসে আছে। টেবিল ভর্তি ফাইল, আলমারি অর্ধেক খোলা, সব নথি এলোমেলো।
কিন্তু কেমন যেন অদ্ভুত। ফাইলগুলোর কাগজগুলো নতুনের মতো, যেন গতকালই লেখা হয়েছে। অথচ দুর্গাপুরের কারখানা তো চল্লিশ বছর ধরে বন্ধ।
সে কাগজগুলো হাতে তুলে দেখল—সবই ১৯৭৪ সালের শিফট রিপোর্ট। এক জায়গায় বড় করে লাল কালিতে লেখা—
“অগ্নিকাণ্ড: ২১ জন মৃত।”
অরূপের হাত কেঁপে উঠল। সে চোখ বোলাল নামের তালিকায়। সবার শেষে লেখা—
“নিত্যানন্দ পাল (শ্রমিক, বাঁশি বাজানোর অভ্যাস)।”
ঠিক তখনই দরজা খোলার শব্দ। অরূপ ঘুরে দেখল, কালো ইউনিফর্ম পরা এক বৃদ্ধ দরোয়ান ঢুকছে। মুখে গভীর রেখা, চোখ অস্বাভাবিক রকম উজ্জ্বল।
বৃদ্ধ চেয়ে রইল অরূপের দিকে। তারপর হঠাৎ বলল,
“তুমি এখানে কেমন করে এলে? ওরা যাকে ডাকবে, সে আর বাঁচে না।”
অরূপ কেঁপে উঠে বলল,
“ওরা? মানে?”
দরোয়ান ফিসফিস করে উত্তর দিল,
“যারা সেই রাতে পুড়ে মরেছিল। তারা এখনও বাঁশির সুরে বেঁচে আছে। তারা নতুন সঙ্গী খোঁজে। আজ তুমি এসেছ, কাল তোমাকেই নিয়ে যাবে।”
অরূপের মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। সে বলল,
“আমি সাংবাদিক। আমি সত্যিটা খুঁজতে এসেছি। মানুষকে জানাতে চাই।”
দরোয়ান হেসে উঠল। সেই হাসি ছিল শুষ্ক, ফাঁপা।
“সত্যি? তাহলে শোনো—যারা একবার বাঁশির সুর শুনেছে, তারা তিন দিনের বেশি টিকে না। তুমি ইতিমধ্যেই ওদের ছায়ার মধ্যে ঢুকে পড়েছ।”
অরূপ বুকের ভেতর ধকধক অনুভব করল। তার মনে হলো যেন বাতাস ঘন হয়ে আসছে।
ঠিক তখনই হঠাৎ ঘরের ভেতর আবার সেই সুর ভেসে উঠল। বাঁশির মিষ্টি অথচ কষ্টকর টান। কাগজগুলো বাতাসে উড়ে গিয়ে চারদিকে ঘুরতে লাগল।
ফাইলের ভেতর থেকে একটা ছবি মাটিতে পড়ল। অরূপ কাগজটা তুলে নিল।
ছবিটাতে দেখা যাচ্ছে—একদল শ্রমিক কারখানার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝখানে নিত্যানন্দ, হাতে বাঁশি।
কিন্তু সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার—ছবির এক কোণে অরূপ নিজেকেও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল।
পর্ব ৫: ছবির ভেতরের মানুষ
অরূপের হাত কাঁপছিল। ছবিটার দিকে সে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। কাগজের হলদে ছাপে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে—সে নিজেই দাঁড়িয়ে আছে শ্রমিকদের ভিড়ে। তার গায়ে আধুনিক জামাকাপড়, হাতে নোটবুক, যেন সত্যিই কারখানার দুর্ঘটনার আগেই সেখানে উপস্থিত ছিল।
“এটা কীভাবে সম্ভব?” অরূপ বিড়বিড় করে বলল।
বৃদ্ধ দরোয়ান তখনো তার দিকে তাকিয়ে। তার ঠোঁটে মৃদু কাঁপা-কাঁপা হাসি।
“ওরা যাকে বেছে নেয়, সে আগেই ছবিতে থাকে। অতীত আর বর্তমানের ফারাক এখানে মুছে যায়। তুমি এখন তাদের একজন।”
অরূপ ছবিটা মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলল। গলার শিরা টনটন করছে।
“না… আমি মরিনি, আমি এখনো বেঁচে আছি!”
হঠাৎ ঘরের বাতাস ঘূর্ণির মতো ঘুরতে শুরু করল। ফাইল, কাগজ, আলমারির দরজা সব একসাথে কাঁপতে লাগল। বাঁশির সুর আবার ভেসে উঠল—এবার আরও কাছে, আরও স্পষ্ট।
অরূপ বুঝল, নিত্যানন্দ এসেছে।
সে ছুটে দরজার দিকে গেল, কিন্তু দরজাটা যেন দেয়ালের মতো শক্ত। দরোয়ান হঠাৎ হাত বাড়িয়ে তার কাঁধ চেপে ধরল। চোখে এক অদ্ভুত আলো।
“পালাতে পারবে না। ওরা ইতিমধ্যেই তোমাকে বেছে নিয়েছে।”
ঠিক তখনই ঘরের ভেতরে অন্ধকার জমতে শুরু করল। সেই অন্ধকারের ভেতর থেকে একে একে বেরিয়ে এলো শ্রমিকদের ছায়া। চোখ শূন্য, শরীর জ্বলসানো, মুখে কোনো শব্দ নেই। কেবল নিত্যানন্দ এগিয়ে এলো সামনে, হাতে বাঁশি।
অরূপ চিৎকার করে উঠল,
“তোমরা আমাকে কেন চাইছো? আমি তো অপরাধী নই!”
নিত্যানন্দ বাঁশি ঠোঁটে তুলল। সুর ভেসে উঠল—দুঃখে ভরা, দীর্ঘশ্বাসের মতো। আর সেই সুর শুনতে শুনতে অরূপের শরীর ভারী হয়ে এল। তার মনে হলো যেন সে টেনে নেওয়া হচ্ছে ছবির ভেতরে।
হঠাৎ করে ছবিটা আবার মাটিতে ঝলসে উঠল। তাতে এবার স্পষ্ট দেখা গেল—অরূপ শ্রমিকদের ভিড়ে দাঁড়িয়ে আছে, চোখ শূন্য, ঠোঁটে ফাঁকা হাসি।
ঘরের বাতাস থেমে গেল। দরোয়ান নিচু গলায় বলল,
“এখন থেকে তুমিও বাঁশির সুরের অঙ্গ।”
অরূপের ঠোঁট কেঁপে উঠল, অথচ তার নিজের গলা দিয়ে ভেসে উঠল বাঁশির সুর।
পর্ব ৬: তিন দিনের ছায়া
ভোরের আলোয় কারখানার বাইরে স্থানীয় কয়েকজন কৌতূহলী মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল। তারা আগের রাতের বাঁশির আওয়াজ শুনেছিল। কারও কারও কানে এখনও যেন বাজছে সেই সুর। কিন্তু অরূপকে আর বের হতে দেখেনি কেউ।
পরের দিন সকালে শহরের কাগজে তার কোনো খবর নেই। অথচ তার মোবাইল ফোনটা পাওয়া গেল কারখানার গেটের পাশে, কাদায় ভিজে। স্ক্রিনে শেষ রেকর্ডিং চালু ছিল—শুধু বাঁশির টানা সুর আর ভাঙাচোরা মেশিনের শব্দ।
অরূপের সহকর্মী রীনা খবরটা পেয়ে ছুটে এল। সে সবসময় অরূপকে সতর্ক করত—“এমন জায়গায় যেও না, যেখান থেকে মানুষ ফেরে না।” কিন্তু সাংবাদিকের কৌতূহল তাকে টেনে নিয়েছিল।
রীনা গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে ভেতরে তাকাল। দিনের আলোয় কারখানা দেখতে নিরীহ, শুধু ধ্বংসস্তূপ। অথচ বাতাসে কেমন অদ্ভুত ভারি গন্ধ—মরচে আর পোড়া লোহা মিশে আছে।
সে দরোয়ানের খোঁজ করল, কিন্তু কেউ জানত না এমন কেউ আছে। কারও মুখে নামও শোনা যায়নি। যেন লোকটা শুধুই অরূপের চোখে ধরা দিয়েছিল।
রীনা ফাইলঘরে ঢুকতে চাইল, কিন্তু ভেতরে যেতে না যেতেই বুক ভারী হয়ে উঠল। মনে হলো বাতাসে চাপ জমছে। হঠাৎ কানে ভেসে এল টানা বাঁশির আওয়াজ। সে দম নিতে পারছিল না, তাই দৌড়ে বেরিয়ে এল।
সন্ধেয় সে অরূপের বাসায় গিয়ে টেবিলের ওপর রাখা তার ডায়েরি খুঁজে পেল। শেষ পাতায় লেখা—
“আজ আমি নিত্যানন্দকে দেখেছি। সত্যি, সে আছে। ছবির ভেতরে আমাকেও পেয়েছি। যদি তিন দিনের মধ্যে আমি নিখোঁজ হই, তবে জানবে—সুর আমাকে নিয়ে গেছে।”
রীনার শরীর শিউরে উঠল।
সে মনে মনে গুনল—আজ প্রথম দিন।
রাত নামতেই বাঁশির সুর আবার বাজতে শুরু করল। দূর থেকে, খুব ক্ষীণ। কিন্তু ধীরে ধীরে সুরটা যেন তার জানালার সামনে এসে থামল।
রীনা কাঁপা গলায় ফিসফিস করে বলল—
“অরূপ… তুমি কি সত্যিই চলে গেছ?”
পর্ব ৭: বাঁশির ডাক
রীনা পরের দিন সকালেই অফিসে গিয়ে সহকর্মীদের জানাল। কেউ শুনে হেসে উড়িয়ে দিল—“ভূতের গল্প লিখতে গেছিল, এবার নিজেই ভূত হয়ে গেল।” কেউ আবার মুখ গম্ভীর করে বলল—“কারখানার নাম শুনলেই গায়ে কাঁটা দেয়, ওখানে যাওয়া উচিত হয়নি।”
কিন্তু রীনার মনের ভেতর দোলাচল থামল না। গত রাতের বাঁশির আওয়াজ সে খুব স্পষ্ট শুনেছে। যদি ওটা সত্যিই অরূপ হয়?
দুপুরে সে লাইব্রেরিতে গিয়ে পুরনো কাগজপত্র খুঁজতে লাগল। ১৯৭৪ সালের দুর্ঘটনার রিপোর্ট সে হাতে পেল। শিরোনামে লেখা—
“বয়লার বিস্ফোরণে ২১ শ্রমিক নিহত।”
নিচে ছবি: সারি সারি মৃতদেহ, মুখে ছাই, পোড়া কাপড়।
একটা নাম বারবার চোখে পড়ল—নিত্যানন্দ পাল।
লোকজন লিখেছিল, মৃত্যুর আগে সে বাঁশি বাজাচ্ছিল। বিস্ফোরণের সময়ও সেই বাঁশির সুর শোনা গিয়েছিল বলে সাক্ষীরা জানিয়েছিল।
রীনা কাঁপতে কাঁপতে পাতা উল্টাল। হঠাৎ কাগজের ভেতর একটা হলদে ছবি খসে পড়ল।
ছবিটায় অদ্ভুত কিছু আছে। একদল শ্রমিক কারখানার ভেতর দাঁড়িয়ে। মাঝখানে নিত্যানন্দ, হাতে বাঁশি। আর পেছনে—অরূপ!
রীনার বুক ধড়ফড় করতে লাগল।
“এটা কীভাবে সম্ভব? ছবিটা তো চল্লিশ বছরের পুরনো!”
ঠিক তখনই লাইব্রেরির ভেতর অদ্ভুত ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করল। বইয়ের পাতাগুলো ফটাফট উল্টে যেতে লাগল। চারপাশে নিস্তব্ধতা, শুধু ফিসফিসে একটা সুর—বাঁশির।
রীনা ছবিটা আঁকড়ে ধরে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল। বাইরে এসে দেখল, আকাশে মেঘ জমছে। সূর্যের আলো হঠাৎ ম্লান হয়ে গেছে।
সে জানল, তিন দিনের ছায়া সত্যি। আজ দ্বিতীয় দিন।
রাতে ফের বাঁশির সুর ভেসে এল। এবার আরও কাছে। মনে হলো জানলার ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে বাজছে।
রীনা সাহস করে জানলা খুলল। কিন্তু বাইরে শুধু অন্ধকার। তারপর হঠাৎ মাটির ওপর চোখ পড়তেই তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো—
মাটিতে পড়ে আছে ভাঙা একটা বাঁশি।
পর্ব ৮: বাঁশির ফিসফিস
মাটিতে পড়ে থাকা বাঁশিটা রীনা কাঁপা হাতে তুলে নিল। কাঠটা ঠান্ডা, অথচ অদ্ভুতভাবে ভেজা, যেন ঘামে ভিজে আছে। গায়ে হালকা দগদগে দাগ, যেন আগুনে পোড়ার পর বেঁচে গেছে।
সে বাঁশিটা হাতে নিয়েই বুঝল—এটা কেবল বস্তু নয়, এর ভেতরে কিছু আছে। কান পাততেই মনে হলো বাঁশির শরীরের ভেতর ফিসফিস করছে কেউ।
“রীনা…”
সে আঁতকে উঠল। গলা শুকিয়ে এলো। ফিসফিসানি আবার শোনা গেল—
“রীনা… আমি অরূপ। আমাকে বাঁচাও।”
রীনার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। বাঁশিটা শক্ত করে ধরে সে চিৎকার করে উঠল,
“অরূপ! তুমি কোথায়?”
কিন্তু চারপাশ নিস্তব্ধ। কেবল দূরে, খুব ক্ষীণ, বাঁশির টানা সুর ভেসে এলো।
রীনা বুঝল, সত্য খুঁজে বের করতে হলে তাকে ফের কারখানায় যেতে হবে। ভয় থাকলেও আর কোনো পথ নেই।
মধ্যরাতে টর্চ, ক্যামেরা আর সেই বাঁশিটা নিয়ে সে ঢুকল পরিত্যক্ত কারখানায়। ভেতরটা আগের চেয়েও ভারি, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। ভাঙা হলঘরে পা রাখতেই বাঁশির সুর গর্জনের মতো বাজতে শুরু করল।
সুরটা এবার বাইরে থেকে নয়, ভেতর থেকে বাজছে। চারপাশে শ্রমিকদের ছায়া জমে উঠল—জ্বলসানো মুখ, পোড়া গন্ধ, চোখ ফাঁকা। তারা সবাই তাকিয়ে আছে রীনার দিকে।
সামনে এগিয়ে এল নিত্যানন্দ। হাতে বাঁশি, মুখে শূন্য হাসি। তার পেছনে দাঁড়িয়ে অরূপ—চোখ ফাঁকা, ঠোঁটে এক অদ্ভুত বাঁকা রেখা।
রীনার বুক থেমে গেল। সে কাঁপা গলায় বলল,
“অরূপ… তুমি কি আমায় চিনতে পারছো?”
অরূপ কিছু বলল না। কেবল এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিল। তার আঙুল ছিল বরফের মতো ঠান্ডা।
নিত্যানন্দ বাঁশি ঠোঁটে তুলল। সুর উঠতেই চারপাশ অন্ধকারে ঢেকে গেল। বাতাসে শুধু পোড়া লোহা আর ছাইয়ের গন্ধ।
রীনা বুঝল, আজই তৃতীয় রাত। আজ সিদ্ধান্ত হবে—সে ফিরতে পারবে, নাকি সেও ছবির ভেতরে বন্দি হয়ে যাবে।
পর্ব ৯: শেষ রাতের খেলা
রীনার চারপাশে অন্ধকার নেমে এসেছে। টর্চের আলো নিভে গেছে অনেকক্ষণ আগে। কেবল লালচে অগ্নির আভা যেন ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। শ্রমিকদের শূন্য চোখ তাকে ঘিরে ধরেছে।
অরূপ সামনে দাঁড়িয়ে, কিন্তু সে আর অরূপ নেই—চোখ ফাঁকা, ঠোঁট নীলচে। যেন তার শরীরের ভেতর থেকে প্রাণটা শুষে নিয়েছে বাঁশির সুর।
রীনা মরিয়া হয়ে কাঁপা গলায় বলল,
“অরূপ, শোনো! তুমি এখনও আমার বন্ধু। তুমি সাংবাদিক, তুমি সত্য খুঁজতে এসেছিলে। নিজেকে ওদের হাতে তুলে দিও না।”
কিন্তু অরূপের ঠোঁট নড়ল না। কেবল নিস্তব্ধতায় বাঁশির সুর আরও জোরে বাজতে লাগল।
নিত্যানন্দ ধীরে ধীরে এগিয়ে এল। তার চোখে কোনো অনুভূতি নেই, কেবল শূন্যতা। বাঁশিটা ঠোঁটে তুলতেই সুর ভেসে উঠল—এইবার রীনা অনুভব করল তার বুকের ভেতর থেকে শক্তি বেরিয়ে যাচ্ছে, পা যেন মাটিতে আটকে যাচ্ছে।
সে হঠাৎ আঁকড়ে ধরল নিজের হাতে থাকা ভাঙা বাঁশিটাকে—যেটা অরূপ রেখে গিয়েছিল। আর অবাক হয়ে দেখল, ওটার ভেতর থেকে মৃদু আলো বেরোচ্ছে।
শ্রমিকদের ছায়ারা মুহূর্তে পিছু হটল। নিত্যানন্দ থমকে দাঁড়াল।
রীনার কানে আবার ফিসফিস শোনা গেল—
“রীনা… বাজাও… বাঁশিটা বাজাও…”
সে জানে না কেমন করে, কিন্তু ঠোঁটে বাঁশিটা তুলে দিল। শ্বাস নিতে না নিয়েই ফুঁ দিল।
অদ্ভুত এক সুর ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে—ভয় নয়, শান্তি। অগ্নির আভা মিলিয়ে যেতে লাগল, শ্রমিকদের মুখে ভেসে উঠল অদ্ভুত প্রশান্তি। তারা একে একে অদৃশ্য হতে লাগল।
নিত্যানন্দের মুখ কেঁপে উঠল। তার চোখে হঠাৎ জ্বলে উঠল আগুন, তারপর ধীরে ধীরে নিভে গেল। বাঁশিটা হাত থেকে পড়ে গেল মাটিতে, ভেঙে ধুলো হয়ে গেল।
অরূপ কাঁপতে কাঁপতে রীনার দিকে এগোল। চোখে আবার ঝলসে উঠল পরিচিত আলো।
“রীনা… তুমি আমায় ফিরিয়ে আনলে…”
ঠিক তখনই কন্ট্রোল রুমের ভেতর প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ হলো। দেয়াল কেঁপে উঠল, ছাদের ফাটল থেকে ধুলো ঝরে পড়ল।
অরূপ চিৎকার করে উঠল,
“তাড়াতাড়ি বেরোও! সময় নেই!”
রীনা দৌড়ে গেটের দিকে ছুটল। অরূপ তার পেছনেই। কিন্তু ঠিক গেটের কাছে এসে রীনা ঘুরে তাকাল—
অরূপ কোথাও নেই।
পর্ব ১০: সুরের সমাপ্তি
রীনা থমকে দাঁড়াল গেটের সামনে। বুক ধড়ফড় করছে, নিঃশ্বাস গলায় আটকে যাচ্ছে। অরূপ তো সবে তার পেছনে ছিল—হঠাৎ কোথায় গেল?
কারখানার ভেতর থেকে ধোঁয়া উঠছে। ভাঙাচোরা দেয়ালগুলো যেন আগুনে লাল হয়ে আছে। বাঁশির সুর এবার খুব ক্ষীণ, কিন্তু এখনও ভেসে আসছে।
রীনা গেটের বাইরে পা রাখতে যাচ্ছিল, তখনই কানে ফিসফিস ভেসে এল—
“ফিরে যেও না, রীনা…”
সে ঘুরে তাকাল। কারখানার অন্ধকারে অরূপ দাঁড়িয়ে আছে। মুখ শান্ত, চোখে অদ্ভুত প্রশান্তি।
“আমি আর ফিরতে পারব না। ওরা আমাকে বেছে নিয়েছে। কিন্তু তুমি পারবে। তুমি বেঁচে থাকো, লেখো… সবার কাছে সত্যিটা পৌঁছে দাও।”
রীনার চোখ ভিজে গেল।
“না! আমি তোমাকে একা রেখে যাব না।”
অরূপ হালকা হাসল।
“তুমি আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছ। ওটাই যথেষ্ট। এখন আমি তাদের সঙ্গী।”
তার শরীর ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে যেতে লাগল, ছাইয়ের মতো মিশে গেল কারখানার অন্ধকারে। বাঁশির সুরও এক মুহূর্তে থেমে গেল।
রীনা চিৎকার করে উঠল, কিন্তু শব্দ বেরোল না। তারপর দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এল। গেট পেরিয়ে রাস্তার আলোয় এসে দাঁড়াতেই কারখানাটা যেন নিস্তব্ধ, নিরীহ—কোনো সুর নেই, কোনো ছায়া নেই।
কিন্তু মাটির ওপর পড়ে আছে একটা কাগজ। রীনা কাঁপা হাতে তুলল। সেটা সেই পুরনো ছবিই। শ্রমিকদের ভিড়, মাঝখানে নিত্যানন্দ। আর এবার পাশে দাঁড়িয়ে অরূপ—চোখে শান্তি, ঠোঁটে একটুকরো হাসি।
ছবিটার নিচে নতুন করে একটা দাগ জ্বলে উঠল—
“সুর শেষ হয়নি, শুধু পথ বদলেছে।”
রীনা হাঁটতে হাঁটতে দূরে চলে গেল। তার কানে আর বাঁশির সুর বাজছিল না, কিন্তু বুকের ভেতরে গভীর শূন্যতা রয়ে গেল।
দুর্গাপুরের সেই কারখানা আজও পরিত্যক্ত। কেউ আর ভেতরে যায় না। কিন্তু শহরের লোকেরা বলে—কখনো কখনো পূর্ণিমার রাতে, বাতাসে ভেসে আসে মৃদু বাঁশির সুর।
কেউ জানে না সেটা নিত্যানন্দের, না অরূপের।
সমাপ্ত