প্রাপ্তি দাস
১
জীবন যেন একঘেয়েমি স্রোতে ভেসে চলছিল অন্বেষার। সকালবেলা চোখ মেললেই রান্নাঘরের ধোঁয়া, বয়স্ক মায়ের বকুনি আর সমাজের অলিখিত নিয়মের চাপ তাকে ঘিরে ধরত। বইয়ের তাক ভর্তি অসংখ্য খাতা, ডায়েরি, অর্ধলিখিত গল্প—সবকিছু যেন নিঃশব্দ সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার দমিয়ে রাখা কণ্ঠের। লেখার হাত তার থেমে গেছে, অথচ ভেতরে জমে থাকা শব্দেরা ক্রমাগত কড়া নাড়ছে। মায়ের একটাই কথা—“এত পড়াশোনা করেছ, কিন্তু লিখে কী হবে? সংসার সামলানোই আসল কাজ।” বাইরে প্রতিবেশীদের কটাক্ষ, আত্মীয়স্বজনদের দৃষ্টি—সবই যেন তাকে বোঝাতে চায়, লেখালিখি কোনো জীবিকা নয়, এটা নিছক খেয়াল। অথচ অন্বেষা জানত, তার কলমের ভেতরে লুকিয়ে আছে তার সত্যিকারের জীবন, এক নতুন পৃথিবী। কিন্তু নিজের কণ্ঠস্বর প্রকাশ করার সাহস সে পাচ্ছিল না। দিনের পর দিন একই চক্রে আটকে থেকে তার মনে হচ্ছিল, যেন জীবন ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিনের কাজকর্মে শরীর ব্যস্ত থাকলেও মনটা ছিল শূন্য, কোথাও কোনো উচ্ছ্বাস নেই, নেই কোনো প্রেরণা।
এমনই এক নিরানন্দ বিকেলে ডাকপিয়ন এসে গেল দরজায়। অন্বেষা তেমন গুরুত্ব না দিয়েই খামটা হাতে নিল। তার নাম লেখা আছে সুন্দর হাতের লেখায়, কিন্তু প্রেরকের নাম অজানা। অবাক হয়ে সে খামের ভাঁজ ছিঁড়ে খুলল। ভেতরে একখানা সাদা চিঠি—অচেনা কালি, অচেনা গন্ধ। অক্ষরগুলো যেন আলোর রেখার মতো ঝিলমিল করছে। চিঠিতে খুব বেশি কিছু লেখা নেই, কয়েকটি লাইন মাত্র, কিন্তু সেই লাইনগুলো তাকে যেন এক অদ্ভুত শক্তি দিল। সেখানে লেখা ছিল— “তুমি যে গল্পগুলো লিখতে ভয় পাও, সেগুলোই তোমার সত্যিকারের গল্প। কলম তোমার হাতেই আছে, তুমি যদি লিখতে না পারো তবে তোমার নীরবতা তোমাকে একদিন গ্রাস করবে।” এই কয়েকটি শব্দ যেন তার বুকের ভেতর জমে থাকা সব শূন্যতাকে এক মুহূর্তে ভেঙে দিল। চোখ বন্ধ করতেই সে অনুভব করল, কত বছর ধরে সে নিজের ভেতরের কণ্ঠকে চাপা দিয়ে রেখেছে। কে লিখল এই চিঠি? কেনই বা তার কাছে পাঠাল? কোনো উত্তর সে জানত না, কিন্তু চিঠিটা যেন তাকে এক নতুন দিগন্তের সামনে দাঁড় করাল।
চিঠি পড়ার পরপরই অন্বেষা হঠাৎ বুঝতে পারল, তার চারপাশের সীমাবদ্ধতার দেয়াল আসলে যতটা মজবুত মনে হচ্ছিল, ততটা নয়। মা তখনও রান্নাঘর থেকে ডাকছে—“চা বানাও, এতক্ষণ ধরে কী করছ?”—কিন্তু তার কণ্ঠস্বর অন্বেষার কানে পৌঁছাল না। সে যেন অন্য জগতে ডুবে গেল, সেই অক্ষরের আলোয়। জানলার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে সে প্রথমবারের মতো অনুভব করল, বাতাসের প্রতিটি ঝাপটা, আকাশের প্রতিটি রঙ যেন তাকে নতুন করে ডাকছে। তার মনে হলো, এতদিন যে জীবনকে সে স্থির ভেবেছিল, তা হয়তো এক নতুন মোড় নিতে চলেছে। এক রহস্যময় চিঠি এসে তার কলমকে আবার জীবিত করেছে। যে কলম এতদিন অবহেলায় শুকিয়ে পড়েছিল, আজ যেন আবার কাঁপতে শুরু করল। আর পরিবারের চাপ, মায়ের বকুনি, সমাজের বাঁধন—সবকিছু সত্ত্বেও অন্বেষা বুঝল, সে আর আগের মতো থাকবে না। অচেনা এই আগমনই হয়তো তার জীবনের প্রথম সত্যিকার মুক্তির ডাক।
২
রাত নামার পরও অন্বেষার ঘুম আসছিল না। মায়ের স্নিগ্ধ নাকডাকার শব্দ, ঘড়ির কাঁটার টিকটিক আর জানলার ফাঁক দিয়ে আসা কাঁচা চাঁদের আলো তার ঘরে ছড়িয়ে ছিল, কিন্তু তার চোখ শুধু সেই অচেনা চিঠির লাইনগুলোই খুঁজে ফিরছিল। খামটা টেবিলের ওপরে রাখা, অথচ বারবার তার হাত বাড়িয়ে নিচ্ছিল, যেন প্রতিবার নতুন কিছু আবিষ্কার করবে। সে ভেবেছিল, হয়তো কোনো পুরোনো পাঠক, কিংবা একসময়কার কোনো সহপাঠী তার ঠিকানায় চিঠি পাঠিয়েছে, আবার হয়তো পুরো ব্যাপারটাই কাকতালীয়—কিন্তু যখনই সে সেই শব্দগুলো মনে করছিল, বুকের ভেতরে কেমন যেন কাঁপন তৈরি হচ্ছিল। এতদিন তার গল্পগুলো কাগজের মাঝে চাপা পড়ে ছিল, অনেক সময় ডায়েরির পাতায় লিখেই ছিঁড়ে ফেলেছে, যেন কেউ যেন পড়ে না ফেলে। কিন্তু আজ হঠাৎ মনে হলো, সেই গল্পগুলো তার জীবন থেকে আলাদা নয়; বরং সেই গল্পই তার নিজের বেঁচে থাকার একমাত্র সাক্ষ্য। দীর্ঘদিনের অবসাদ আর ভয়ের সঙ্গে লড়াই করে তার ভেতরে একধরনের ছোট্ট সাহস জন্ম নিচ্ছিল, তবে সেই সাহসের সঙ্গে আবার দ্বিধাও জড়িয়ে রইল। লিখলে যদি পরিবার জানতে পারে? সমাজ যদি তাকে দোষারোপ করে? নিজের মনের কথাই বা সে কিভাবে অন্যের সামনে উন্মুক্ত করবে? তবুও, চিঠির শেষ লাইন— “তোমার নীরবতা তোমাকে গ্রাস করবে”—একটা অদ্ভুত দৃঢ়তা তার মনে রোপণ করেছিল।
পরের দিন দুপুরে তার একমাত্র সত্যিকারের বন্ধু মৃণালীর সঙ্গে দেখা হলো। কলেজের পর থেকে তারা দু’জনেই আলাদা জীবন কাটালেও সম্পর্কটা টিকে ছিল মনের সংযোগে। চা-দোকানের ছোট্ট বেঞ্চে বসে অন্বেষা চিঠির কথা প্রথমবার শেয়ার করল। মৃণালী মন দিয়ে শুনল, তারপর এক চুমুক চা নিয়ে হেসে বলল, “তুই বুঝলি না, এ তোকে থামাতে নয়, এগোতে বলছে। এতদিন তোর গল্প তোকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছিল, এখন দেখ, চিঠি এসে সেই ভয়টাকেই অস্ত্র বানিয়ে দিল।” অন্বেষা চুপচাপ বসে রইল, কিন্তু বন্ধুর চোখে সে স্পষ্ট দেখতে পেল উৎসাহ আর দৃঢ়তা। মৃণালী আরও বলল, “তুই লিখে দেখ, হয়তো কারও নাম করতে হবে না, হয়তো গল্পের আড়ালে তোর মনের কথাই থাকবে। কিন্তু তুই যদি একবার শুরু করিস, তাহলে বুঝবি আসলে তুই কী করতে পারিস।” সেই কথাগুলো যেন চিঠির বার্তাকে আরও দৃঢ় করে তুলল। অন্বেষার মনে হলো, এতদিন যে সে একা লড়ছিল, অন্তত একজন আছে যে তার স্বপ্নের পাশে দাঁড়াবে। কথোপকথনের মাঝেই অন্বেষা অনুভব করল, তার বুকের ভেতরে জমে থাকা শব্দেরা যেন একে একে মুক্তির পথ খুঁজছে।
সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে কলম হাতে নিল অন্বেষা। প্রথমে হাত কাঁপছিল, কলমের নিব খাতার ওপর ছোঁয়াতেই যেন মনের ভেতরে ঝড় বয়ে গেল। অনেকক্ষণ ধরে কিছু লিখতে পারছিল না, তারপর একসময় নিজেকে প্রশ্ন করল—“কী লিখব?” সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে উত্তর এল—“সত্যি যা, সেটাই।” আর সেই মুহূর্তে যেন বাঁধ ভেঙে গেল। লিখতে শুরু করল তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা—মায়ের কঠোরতা, সমাজের তিরস্কার, তার ভয়, তার শূন্যতা। শব্দগুলো কাগজে আঁকাবাঁকা হলেও বুকের ভেতরের ভার যেন হালকা হয়ে আসছিল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই একটা ছোট গল্প দাঁড়িয়ে গেল—না, হয়তো পুরোপুরি গল্প নয়, বরং আত্মকথার মতো কিছু, কিন্তু এতদিন যে অনুভূতিগুলো তার ভেতরে শিকড় গেড়েছিল, সেইগুলো আজ প্রথমবারের মতো মুক্তির স্বাদ পেল। চিঠি টেবিলের ওপরে রাখা, যেন সে নীরবে তাকিয়ে আছে তার প্রতিটি শব্দে। অন্বেষা বুঝল, হয়তো চিঠির লেখককে সে কোনোদিন খুঁজে পাবে না, কিন্তু তার প্রভাব এত গভীর যে তাকে নতুন করে গড়ে তুলছে। সেদিন রাতে সে এক অদ্ভুত শান্তি নিয়ে ঘুমাল—দীর্ঘদিন পর যেন তার স্বপ্নগুলো আবার জেগে উঠল, কলমের নিবে আলো জ্বলল।
৩
চিঠির শব্দগুলো অন্বেষার জীবনে যে অদ্ভুত আলো নিয়ে এসেছে, তার রেশ কয়েকদিন পর্যন্ত তাকে ছুঁয়ে থাকল। প্রতিদিন সকালে খামটা হাতে নিয়ে সে কিছুক্ষণ বসে থাকত, অক্ষরগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে পড়ত, যেন নতুন কিছু বেরিয়ে আসবে। ধীরে ধীরে তার মনে কৌতূহল জেগে উঠল—কে লিখেছে এই চিঠি? কেমন করে তার ঠিকানা পেল? লেখক হয়ে ওঠার বাসনা যতই প্রবল হচ্ছিল, রহস্যটাও ততই গভীর হচ্ছিল। প্রথমে ভেবেছিল হয়তো কোনো পুরনো বন্ধু বা কলেজের শিক্ষক, কিন্তু ভাষা আর হাতের লেখার ভঙ্গি যেন সে চেনে না। খামের ডাকটিকিটও শহরের সাধারণ পোস্ট অফিসের, বিশেষ কোনো সূত্র নেই। সন্ধ্যায় জানলার পাশে বসে সে খাতায় সম্ভাব্য নামগুলো লিখে যাচ্ছিল—শৈশবের বান্ধবী, অচেনা পাঠক, অথবা হয়তো কেউ যার সঙ্গে কখনো সরাসরি পরিচয়ই হয়নি। অদ্ভুতভাবে এই খোঁজাখুঁজিই তাকে একধরনের উচ্ছ্বাস এনে দিল। রহস্যটা সমাধান করতে না পারলেও সে অনুভব করছিল, অচেনা লেখক যেন অদৃশ্যভাবে তার হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে নতুন পথে, তার কলমের প্রতিটি রেখায় অনুপ্রেরণা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
কিন্তু পরিবারের কাছে অন্বেষার এই পরিবর্তন অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠল। মা লক্ষ্য করল, মেয়েটি বারবার এক খাম হাতে নিয়ে বসে থাকে, আবার মাঝরাতে আলো জ্বেলে কিছু লিখে চলে। “কি হচ্ছে তোর? কার সঙ্গে লুকোচুরি চলছে?”—মায়ের কণ্ঠে উদ্বেগের সঙ্গে দোষারোপের সুরও মিশে ছিল। অন্বেষা প্রথমে চুপ করে গেল, তারপর বলল, “কিছু না মা, শুধু লিখছি।” কিন্তু উত্তরটা মাকে সন্তুষ্ট করল না। তার চোখে লেখালিখি মানে সময় নষ্ট, সংসারের দায়িত্ব এড়ানো। বাবাও কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, “চিঠিপত্র নিয়ে এত আগ্রহ কেন? এসব তো তোর জন্য নয়।” অথচ পরিবারের সেই অবজ্ঞা অন্বেষার মনকে আরও জেদী করে তুলল। সে বুঝতে পারল, এই অচেনা চিঠি শুধু কোনো বার্তা নয়, বরং তার জীবনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সাহসের উৎস। পরিবার যতই তাকে আটকে রাখতে চাইছিল, তার কলম ততই সহজে প্রবাহিত হচ্ছিল, যেন ভেতরের বাঁধ ভেঙে গেছে।
এক রাতে একা ঘরে বসে আবার চিঠিটা হাতে নিল অন্বেষা। বারবার পড়তে পড়তে তার মনে হলো, অচেনা লেখক যেন তাকে শুধু লিখতে বলছে না, বরং নিজের ভিতরের অচেনা দিকগুলো আবিষ্কার করতে বলছে। প্রতিটি অক্ষর তার কাছে ফিসফিস করে বলছিল—“তুমি যে গল্পগুলো লুকিয়ে রেখেছ, তারাই তোমার আসল শক্তি।” সেই মুহূর্তে অন্বেষা বুঝল, রহস্যের সমাধান হয়তো তার কাছে ততটা জরুরি নয় যতটা জরুরি নিজের কণ্ঠ খুঁজে পাওয়া। কে লিখেছে, কেন লিখেছে—এসব প্রশ্ন তাকে ভাবাচ্ছিল বটে, কিন্তু চিঠি তাকে যে দিক নির্দেশনা দিচ্ছে, সেটাই আসল। এই উপলব্ধি তার মনে এক নতুন উন্মাদনা জাগাল। সেদিন রাতেই সে ডায়েরির পাতায় লিখল, “আমি হয়তো কখনো জানব না, কে আমাকে এই পথে ঠেলে দিল, কিন্তু এই পথেই আমি খুঁজে পাব আমার আসল আমি।” অচেনা চিঠি তার কাছে তখন আর কেবল রহস্য নয়, বরং আত্মআবিষ্কারের দরজা খুলে দেওয়া এক অদৃশ্য চাবি।
৪
অন্বেষার দিনযাপন ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করল। আগে যেখানেই সে বইয়ের তাকের সামনে দাঁড়িয়ে কেবল ধুলো ঝাড়ত, এখন প্রতিদিন সকালে খাতা খুলে বসে যায়। কলমের নিবের নিচে জমে থাকা অক্ষরগুলো যেন দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর মুক্তি পেতে শুরু করল। প্রথমে সে ছোট ছোট বাক্যে লিখত—নিজের অনুভূতির টুকরো টুকরো খণ্ডাংশ। তারপর আস্তে আস্তে সেই টুকরোগুলো মিলিয়ে গেল গল্পের আকারে। চরিত্রগুলো জন্ম নিল তার কল্পনায়—কেউ তার মতো সমাজের বাঁধনে আটকে থাকা নারী, কেউ আবার সেই বন্ধন ছিঁড়ে মুক্তির পথে ছুটে চলা সাহসী মানুষ। লেখার সময় সে নিজেকে ভুলে যেত, তার চারপাশের পৃথিবী যেন থেমে থাকত, কেবল অক্ষর আর কল্পনা ভর করে থাকত। সেই প্রথমবার সে অনুভব করল, লেখালিখিই আসলে তার প্রকৃত আশ্রয়, তার প্রথম স্বাধীনতা। শব্দের ভেতর দিয়ে সে এক নতুন জগৎ তৈরি করছে, যেখানে সে স্বাধীন, যেখানে তার কথা কেউ থামাতে পারে না। প্রতিটি চরিত্র যেন তার অন্তরের চিত্র, প্রতিটি ঘটনার ভেতরেই লুকিয়ে আছে তার নিজের যন্ত্রণা আর স্বপ্ন।
মৃণালী তার এই পরিবর্তন সবচেয়ে স্পষ্টভাবে বুঝতে পারল। বন্ধুর চোখে জ্বলজ্বল করা আলো, খাতার পাতায় ছড়িয়ে থাকা শব্দ দেখে সে গর্বে ভরে উঠল। একদিন দেখা করতে এসে মৃণালী বলল, “তুই জানিস, তোকে দেখে আমার মনে হচ্ছে তুই যেন শিকল ভেঙে বেরিয়ে আসছিস। এতদিন তুই চুপ করে ছিলি, এখন তুই যেন কণ্ঠ খুঁজে পাচ্ছিস।” অন্বেষা হেসে উত্তর দিল, “চিঠিটাই হয়তো আমাকে চোখ খুলে দিয়েছে। তুই না থাকলে হয়তো আমি সাহসই পেতাম না।” মৃণালী দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “সাহসটা তো তোর ভেতরেই ছিল, শুধু দরজাটা খোলার প্রয়োজন ছিল।” সেই কথাগুলো অন্বেষার আত্মবিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করে দিল। বন্ধুর সমর্থন তাকে মনে করিয়ে দিল, সে একা নয়; অন্তত একজন তো আছে, যে তার কলমের আলোকে মূল্য দিচ্ছে। বন্ধুত্ব আর চিঠির মিলিত প্রভাব তার মনে এমন এক শক্তি জাগাল, যা আগে সে কল্পনাও করতে পারেনি।
কিন্তু পরিবারের চোখে এই পরিবর্তন খুব একটা স্বস্তির কারণ হয়ে উঠল না। মা লক্ষ্য করল, অন্বেষা রান্নাঘরে আগের মতো সময় দেয় না, বরং একা ঘরে বসে কাগজ-কলম নিয়ে কাটিয়ে দেয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। “কি হচ্ছে তোর? সারাদিন লিখলেই সংসার চলবে?”—মায়ের বিরক্ত কণ্ঠ শোনা গেল বারবার। বাবাও গম্ভীর গলায় বলল, “মেয়েরা এত লেখালিখি করলে সংসারের ক্ষতি ছাড়া আর কিছু হয় না।” পরিবার বুঝতে পারল, মেয়েটির ভেতরে কিছু একটা বদলে যাচ্ছে, কিন্তু তারা সেই পরিবর্তনকে স্বীকৃতি দিতে পারল না। অন্বেষা অবশ্য চুপ করে শুনত, কখনো প্রতিবাদ করত না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে জানত, এই প্রতিবন্ধকতাই তাকে আরও দৃঢ় করে তুলছে। তার মনে হচ্ছিল, প্রথমবারের মতো সে নিজের জীবনকে নিজের হাতে নিচ্ছে। পরিবারের বিরক্তি তাকে ভয় দেখাতে পারল না; বরং সেটা যেন প্রমাণ করে দিল, সে সত্যিই অন্যরকম কিছু শুরু করেছে। অচেনা চিঠি যে পথে ঠেলে দিয়েছিল, সেই পথে পা বাড়িয়েই অন্বেষা খুঁজে পেল তার প্রথম স্বাধীনতা।
৫
অন্বেষার জীবনে তখন যেন দুটি সমান্তরাল নদী বইছিল—একদিকে তার ভেতরের লেখক সত্তা, যে প্রতিদিন নতুন গল্প আর নতুন চরিত্র জন্ম দিচ্ছে; অন্যদিকে পরিবারের অবিরাম চাপ, যা তাকে আবার পুরোনো খাঁচার ভেতর ফেরত নিয়ে যেতে চাইছে। মায়ের কণ্ঠ প্রতিদিন যেন আরও কড়া হয়ে উঠছিল, “মেয়েদের এসব গল্প লিখে কি হয়? সংসার সামলাতে জানিস না, আবার লিখে কী প্রমাণ করবি?” বাবার চোখের কঠোরতা, আত্মীয়স্বজনের কটাক্ষ—সব মিলিয়ে অন্বেষার চারপাশটা আবার ভারী হয়ে উঠল। অথচ যখন সে কলম হাতে বসত, চারপাশের সব শব্দ যেন হারিয়ে যেত, শুধু গল্পের ভেতরেই সে শান্তি খুঁজে পেত। কিন্তু সেই শান্তি টিকত না বেশি সময়। রাতে আলো জ্বেলে লিখতে বসলে মা দরজা খুলে তাকাতেন সন্দেহের চোখে, খাতা টেনে নিয়ে বলতেন, “এসব অশান্তি আমাদের বাড়িতে চলবে না।” তখন অন্বেষার বুকের ভেতরে হাহাকার জমত, তবু সে প্রতিবাদ করত না। চুপ করে ভাঁজ করে রাখত খাতা, কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে আগুন জ্বলছিল তা আর নিভে যেত না। এই দ্বন্দ্বই তার দিনগুলোকে ছিন্নভিন্ন করে তুলেছিল—একদিকে কর্তব্য, অন্যদিকে নিজের স্বপ্ন।
ঠিক তখনই অচেনা চিঠিটা যেন বারবার তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল, তার নীরবতাই আসল শত্রু। প্রতিবার চিঠির লাইনগুলো পড়লে মনে হতো, লেখক যেন অদৃশ্যভাবে তার পাশে দাঁড়িয়ে বলছে, “ভয়কে ভেঙে দাও, নয়তো সে তোমাকে গ্রাস করবে।” অন্বেষা বুঝতে পারছিল, সে যদি থেমে যায়, তবে শুধু গল্পই হারাবে না, বরং নিজের অস্তিত্বও হারিয়ে ফেলবে। তাই দ্বন্দ্ব যত গভীর হচ্ছিল, ততই তার ভেতরে সাহস জন্ম নিচ্ছিল। সে ভাবছিল, হয়তো পরিবার কোনোদিন তার স্বপ্নকে বুঝবে না, হয়তো সমাজ তাকে নিয়ে আঙুল তুলবেই—কিন্তু তার শব্দগুলো যদি নিঃশব্দে মরে যায়, তবে সে নিজেকেই বিশ্বাসঘাতকতা করবে। চিঠিটা বারবার তাকে নিজের ভেতরের আলো দেখাচ্ছিল, যে আলোকে চেপে রাখার চেষ্টা করছে সবাই। কখনো কখনো রাতে একা বসে সে ডায়েরিতে লিখত, “আমি কারও শত্রু নই, শুধু নিজের মতো বাঁচতে চাই। কেন সেটা অপরাধ?” সেই প্রশ্নের উত্তর কেউ দিত না, তবু চিঠির অনুপ্রেরণায় সে ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিল—উত্তরটা তাকে একদিন নিজেকেই লিখে দিতে হবে।
কিন্তু পরিবারও হাল ছাড়ছিল না। মা প্রতিদিনই নতুন নতুন যুক্তি খুঁজে আনতেন—“এখনো বিয়ের বয়স হলো, লেখালিখি করলে পাত্রেরা মুখ ফিরিয়ে নেবে।” আত্মীয়রা এসে বলত, “মেয়েদের এত স্বাধীনতা মানায় না।” বাবার মুখে রাগ জমে থাকত, যেন একদিন বিস্ফোরিত হবে। অন্বেষা কখনো মনে করত, যদি সব ছেড়ে দিয়ে আবার আগের মতো সংসারকেন্দ্রিক জীবন শুরু করে, তাহলে শান্তি ফিরে আসবে। কিন্তু সেই শান্তি আসলেই শান্তি হবে তো? অচেনা চিঠির প্রতিটি অক্ষর যেন তাকে ঠেলে দিচ্ছিল সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে। প্রতিবার যখন কলম ছুঁয়ে সে লিখতে শুরু করত, মনে হতো এই লেখা তার নিঃশ্বাস, যা ছাড়া সে বাঁচতেই পারবে না। দ্বন্দ্বের মাঝেই সে ধীরে ধীরে শিখছিল, স্বাধীনতার পথ কখনো সহজ নয়—এখানে লড়াই করতে হয়, প্রিয়জনদের বিরুদ্ধেও। আর এই লড়াই যতই তাকে ক্লান্ত করুক না কেন, তবুও সে জানত, একদিন এই পথেই সে খুঁজে পাবে নিজের সত্যিকারের মুক্তি।
৬
অন্বেষার কলম তখন আর থেমে থাকেনি। সে বুঝতে পারল, লিখে যাওয়াই তার সবচেয়ে বড় মুক্তি। তাই ভয়কে সরিয়ে রেখে একদিন সে তার লেখা গল্পগুলো একত্র করে এক প্রকাশনায় পাঠিয়ে দিল। কাগজের খামে গুঁজে পাঠানো সেই লেখাগুলো যেন তার নিজের হৃদয়ের টুকরো, ভেতরে ভেতরে আতঙ্ক হচ্ছিল—যদি কেউ পছন্দ না করে? যদি সবাই হাসাহাসি করে? কিন্তু সাথে সাথে এক অদ্ভুত শান্তিও ছিল—যেন নিজের বুকের ভেতর জমে থাকা দমবন্ধ করা ভার সে বাইরে ছুড়ে ফেলল। প্রতিটি শব্দই তার কাছে স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। বাড়ির ঘরের অন্ধকারে, সবার চোখ এড়িয়ে, সেই লেখা পাঠানোর মুহূর্তে সে যেন নিজের প্রথম বড় শ্বাস নিল। এই আত্মপ্রকাশে তার মনে হলো, সে আর বন্দী নয়। পাঠকরা তার লেখা পড়বে কি না, সেটা তখন আর জরুরি মনে হলো না, কারণ সে জানত—এই লেখা প্রকাশ করা মানেই নিজের সত্যকে বিশ্বের সামনে দাঁড় করানো। তার ভেতরের শিকল ভাঙার আসল শুরু হয়েছিল সেদিন।
এই কঠিন যাত্রায় মৃণালী ছিল তার সবচেয়ে বড় সমর্থন। অন্বেষা যখন দ্বিধায় কাঁপছিল, তখন মৃণালী তাকে মনে করিয়ে দিত, “তুই যে সাহস দেখাচ্ছিস, সেটা শুধু তোর জন্য নয়, আরও অনেকের জন্য আলো হয়ে উঠবে।” সে অন্বেষাকে প্রকাশনার ঠিকানা খুঁজে দিতে সাহায্য করল, খসড়াগুলো পড়ে মতামত দিল, এমনকি কখনো কখনো নিজের হাতে টাইপ করে দিল, যাতে অন্বেষার কাজ সহজ হয়। বন্ধুর এমন সহানুভূতি আর সমর্থন অন্বেষার কণ্ঠকে আরও দৃঢ় করে তুলল। মৃণালীর চোখে সে দেখতে পেত একরাশ গর্ব, যা তাকে মনে করিয়ে দিত—সে ভুল পথে হাঁটছে না। যখন অন্বেষা প্রথম প্রকাশকের কাছ থেকে সাড়া পেল, মৃণালীই প্রথম ছুটে এসে তার হাত ধরে বলেছিল, “দেখলি তো, তোর শব্দগুলো অন্ধকার ভেদ করতে শুরু করেছে।” সেই মুহূর্তে অন্বেষার চোখ ভিজে উঠেছিল—কৃতজ্ঞতায়, ভালোবাসায়, আর আত্মবিশ্বাসে।
এবং প্রতিটি ধাপে, অচেনা সেই চিঠিটাই ছিল তার ভেতরের আলো। প্রকাশনার জবাব পাওয়ার আগেই সে বারবার খামটা খুলে পড়ত, যেন সেখান থেকে নতুন করে সাহস টেনে নিতে পারে। প্রতিবার পড়ার সময় মনে হতো, চিঠির লেখক অদৃশ্যভাবে তার পাশে দাঁড়িয়ে দিচ্ছে আশ্বাস—“চল, এগিয়ে যা। ভয় করিস না।” আসলে সেই চিঠিই তাকে প্রথম বুঝিয়েছিল, নিজের ভেতরের কণ্ঠকেই শ্রদ্ধা করা সবচেয়ে জরুরি। প্রকাশের সময় তার মনে হয়েছিল, সে যেন চিঠির দেওয়া বার্তাকেই বাস্তবে রূপ দিচ্ছে। চিঠি ছিল তার গোপন শিক্ষক, গোপন বন্ধু, আর পথপ্রদর্শক। তাই যখন প্রথম গল্প মুদ্রিত হলো, অন্বেষা খামের দিকে তাকিয়ে হাসল—যেন চিঠির লেখককেও জানিয়ে দিল, “তোমার প্রেরণায় আজ আমি আমার আসল সত্তাকে প্রকাশ করতে পেরেছি।” আর সেই দিন থেকেই অন্বেষার কাছে লেখালিখি শুধুই কলম আর কাগজের খেলা নয়, বরং আত্মপ্রকাশের সবচেয়ে বড় দরজা।
৭
অন্বেষার প্রথম গল্প যখন ছাপা হলো, তখন তার ভেতরে যেমন আনন্দ জাগল, তেমনি শুরু হলো নতুন এক পরীক্ষার পথ। পরিবারে যেন ঝড় বয়ে গেল। মা গল্প পড়ে মুখ গোমড়া করে বললেন, “এগুলো কী লিখেছিস? সংসারের কথা বাদ দিয়ে সমাজ নিয়ে বড় বড় কথা! মেয়েদের এসব লেখার কি প্রয়োজন?” বাবার চোখে স্পষ্ট বিরক্তি—তিনি মনে করলেন, লেখালিখি মানেই সংসারকে অবহেলা করা। আত্মীয়স্বজনের কেউ কেউ সরাসরি সমালোচনা করল, বলল, “মেয়েদের বেশি স্বাধীনতা দিলে মাথা ঘুরে যায়, এখন তো দেখাই যাচ্ছে।” এই কথাগুলো অন্বেষার কানে আগুনের মতো বিঁধলেও, সে এবার চুপ করে থাকল না। ভেতরের কলমশক্তি তাকে শিখিয়ে দিয়েছিল, প্রতিটি সমালোচনা আসলে তার শক্তিকে যাচাই করার উপায়। কিন্তু মনের গভীরে ভয়ও কাজ করছিল—যদি পাঠকরাও একইভাবে আঙুল তোলে? যদি তার শব্দগুলোকে কেউ মূল্য না দেয়? দ্বিধা, ভয় আর চাপে সে মাঝে মাঝে রাত জেগে কেঁদে ফেলত, তবুও লিখে যেত। কারণ সে বুঝতে শিখেছিল, ভয়কে জয় না করলে তার কলম থেমে যাবে, আর সেই থেমে যাওয়াই হবে সবচেয়ে বড় পরাজয়।
এই কঠিন সময়ে মৃণালীই ছিল তার একমাত্র আশ্রয়। বন্ধুর কণ্ঠ তাকে বারবার মনে করিয়ে দিত, “সমালোচনা মানে তুই সঠিক পথেই হাঁটছিস। মানুষ তো নতুন কিছু দেখলেই ভয় পায়, রাগ করে।” মৃণালী তার প্রতিটি লেখা মনোযোগ দিয়ে পড়ত, ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিত, আবার সাহস যোগাত। একদিন যখন অন্বেষা দমে গিয়ে বলল, “হয়তো ওরা ঠিকই বলছে, আমার লেখা আসলে কোনো মূল্য নেই,” তখন মৃণালী দৃঢ়ভাবে তার হাত ধরে বলল, “তোর লেখা শুধু গল্প নয়, তোর আত্মার ভাষা। এটা যদি থেমে যায়, তুইও থেমে যাবি। তুই যদি লিখিস, আমি পড়ব; আর যদি পড়তে পারি, তবে জানবি তোর লেখা বৃথা যায়নি।” এই কথাগুলো অন্বেষার অন্ধকার ভেদ করে আলো নিয়ে এলো। বন্ধু তাকে বোঝাল, অন্যরা যা-ই বলুক, তার শব্দই তাকে জীবিত রাখবে। তাই মৃণালীর পাশে দাঁড়ানো ছিল সেই সময় অন্বেষার সবচেয়ে বড় শক্তি।
তবে অচেনা চিঠিটিও এই সংকটময় সময়ে আবার নতুন রূপে সামনে এলো। প্রতিবার সমালোচনার আঘাতে যখন অন্বেষা ভেঙে পড়তে যাচ্ছিল, তখন সে খাম খুলে সেই চিঠি পড়ত। অদ্ভুতভাবে মনে হতো, অচেনা লেখক যেন আগেই জানতেন তার জীবনে এসব বাধা আসবে। প্রতিটি শব্দ তাকে সাহস দিত, যেন বলছে, “লড়াই ছাড়া কোনো স্বাধীনতা আসেনা। লিখে যাও, তবেই মুক্তি পাবে।” পরিবার তাকে যতই বিরোধিতা করুক, সেই চিঠি আর মৃণালীর সমর্থন তাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। সমালোচনার ভেতর দিয়েই তার কলম আরও দৃঢ় হচ্ছিল। সে নিজের গল্পে আরও সাহসী হয়ে উঠল—নারীর শৃঙ্খল, সমাজের চাপ, ভয়ের অন্ধকার—সবকিছু ভেঙে দিয়ে চরিত্রগুলো দাঁড়াতে লাগল নতুন এক আলোয়। অন্বেষা বুঝল, এই সমালোচনার মাঝেই জন্ম নিচ্ছে তার আসল লেখকসত্তা। আর এভাবেই সে ধীরে ধীরে নিজেকে প্রস্তুত করছিল বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার জন্য।
৮
অন্বেষার কলম যতই প্রবাহিত হচ্ছিল, ততই সে নিজের ভেতরের এক অচেনা সত্তাকে চিনতে শুরু করল। আগে যে মেয়েটি ছিল পরিবারের নিয়ম-কানুনে বাঁধা, আত্মবিশ্বাসহীন, সবসময় অন্যের স্বীকৃতির আশায় থাকা—সে যেন ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছিল। তার জায়গায় জন্ম নিচ্ছিল এক সাহসী নারী, যে নিজের গল্পের ভেতরে নিজের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাচ্ছিল। প্রতিটি চরিত্র তার মনে করিয়ে দিত—সে একা নয়, তার মতো আরও অনেকেই আছে, যারা শৃঙ্খল ভেঙে আলো খুঁজছে। সেই আলোই তার নতুন পরিচয়। আর এই পরিচয় বাইরের কোনো লেবেল নয়; এটি তার নিজের ভেতরের সত্য, যা সে প্রথমবারের মতো স্বীকার করতে শিখল। তার লেখা পড়ে পাঠকরা প্রতিক্রিয়া জানাতে শুরু করল, কেউ মুগ্ধ হলো, কেউ প্রশ্ন তুলল। কিন্তু যাই হোক না কেন, এই প্রতিক্রিয়াগুলো তাকে বোঝাল—তার কণ্ঠ এখন অন্যদের কানে পৌঁছাচ্ছে। এই উপলব্ধিই তাকে আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলল, যেন সে নিজের জীবনকেই নতুনভাবে পুনর্লিখন করছে।
এই যাত্রায় অচেনা সেই চিঠির গুরুত্ব যেন আরও বেড়ে গেল। চিঠির প্রতিটি অক্ষর যেন তাকে প্রতিদিন নতুন করে মনে করিয়ে দিচ্ছিল, “তুই যা খুঁজছিস, তার উত্তর তোর ভেতরেই আছে।” অন্বেষা এখন বুঝতে পারল, চিঠিটা শুধুই এক অচেনা মানুষের লেখা নয়, বরং তার নিজের ভেতরের অব্যক্ত কণ্ঠের প্রতিচ্ছবি। তবুও রহস্যটা অটুট রইল—সে জানত না কে লিখেছিল চিঠি, কেন লিখেছিল। আর হয়তো সেই অজানাই তাকে আরও প্রেরণা দিচ্ছিল। কখনো কখনো রাত জেগে সে খামের দিকে তাকিয়ে ভাবত, “তুমি যেই হও না কেন, তোমার কথায় আমি আমার নতুন আমি-কে খুঁজে পেয়েছি।” অচেনা চিঠির সঙ্গে এই অদৃশ্য বন্ধন তার লেখার পথপ্রদর্শক হয়ে উঠল। চিঠির রহস্যের ভেতরেই যেন সে এক ধরনের আশ্রয় খুঁজে পেল, যা তাকে ভয় থেকে দূরে সরিয়ে আত্মবিশ্বাসের দিকে ঠেলে দিল।
তবে পরিবারের প্রতিক্রিয়া এখনও জটিল। মা আর বাবার চোখে পরিবর্তন স্পষ্ট—তারা বুঝতে পারছিল, অন্বেষা আর আগের মতো নিরুপায় মেয়ে নেই। তার ভেতরে এমন এক শক্তি জন্মেছে, যা সহজে ভাঙা যাবে না। কিন্তু এই পরিবর্তনকে পুরোপুরি মেনে নিতে তারা প্রস্তুত নয়। মা মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন, “মেয়েরা যদি এভাবে নিজের মতো চলে, সংসার ভেঙে যাবে।” বাবা নীরবে তাকিয়ে থাকতেন, যেন বুঝতে পারছিলেন—মেয়ের জীবনে তারা আর আগের মতো প্রভাব ফেলতে পারছেন না। এই টানাপোড়েনের মাঝেও অন্বেষা বুঝতে পারল, তার পরিবর্তন শুধু লেখালিখির ভেতর নয়, বরং তার আত্মপরিচয়ের গভীরে পৌঁছে গেছে। সে আর কেবল পরিবারের মেয়ে নয়; সে এক লেখক, এক কণ্ঠ, যে নিজের আলোয় দাঁড়াতে শিখছে। এই দ্বন্দ্বপূর্ণ পরিস্থিতিতেই তার নতুন পরিচয় ধীরে ধীরে দৃঢ় হতে শুরু করল—এক পরিচয়, যেটা আর কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।
৯
অন্বেষার লেখালিখি ধীরে ধীরে শুধু ব্যক্তিগত আবেগের প্রকাশ নয়, বরং সমাজের সামনে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়ার শক্তি হয়ে উঠল। তার গল্পগুলোতে ফুটে উঠতে লাগল নারীর অবদমন, অচেনা যন্ত্রণার চিত্র, আর শৃঙ্খল ভাঙার আকাঙ্ক্ষা। পাঠকরা একদিকে মুগ্ধ হলো, অন্যদিকে অস্বস্তি বোধ করল। কারণ তার লেখাগুলো নিছক কল্পনা নয়, সমাজের গোপন সত্যের দর্পণ। কিছু সংবাদপত্র তার লেখা ছেপে প্রশংসা করল, আবার কিছু সমালোচক বলল—“অতিরিক্ত সাহসী”, “নারীসুলভ নয়।” কিন্তু অন্বেষা জানত, এই সমালোচনাই আসলে তার সঠিক পথে হাঁটার প্রমাণ। প্রতিটি বাক্যে, প্রতিটি চরিত্রে সে নিজের শিকলভাঙা কণ্ঠকে ঢেলে দিল। আর এভাবেই তার কলম সমাজের অচল দেয়ালে ছোট ছোট ফাটল ধরাতে শুরু করল। এই ফাটলই ছিল তার মুক্তির প্রতীক, যেখান থেকে নতুন আলো ফোটাতে লাগল। অন্বেষার মনে হলো—এবার সে কেবল নিজের জন্য নয়, অগণিত স্তব্ধ নারীর জন্য লিখছে।
তার সাফল্যে মৃণালীর আনন্দ সীমাহীন। বন্ধু যেন নিজেরই স্বপ্ন পূরণ হতে দেখল অন্বেষার মাধ্যমে। প্রতিটি নতুন প্রকাশনার খবর মৃণালী ছুটে গিয়ে সবাইকে জানাত, তার চোখে অন্বেষা এখন কেবল একজন লেখক নয়, বরং সংগ্রামের প্রতীক। একদিন অন্বেষা তাকে বলল, “যদি তুই না থাকতিস, আমি এতদূর আসতে পারতাম না।” মৃণালী হাসল আর বলল, “তুই এসেছিস কারণ তুই কলমকে ভয় পাসনি। আমি শুধু পাশে ছিলাম।” অন্বেষা বুঝতে পারল, এই সমর্থনই তার ভেতরে বীজের মতো রোপিত হয়েছিল, যেখান থেকে সাহস জন্মেছে। আর মৃণালী প্রতিটি মুহূর্তে তার সাফল্যকে নিজের মতো করে উদযাপন করেছে। বন্ধুত্বের এই অটুট বন্ধনই তাকে ভেঙে পড়া থেকে রক্ষা করেছিল, আর সাফল্যের আনন্দকে বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছিল।
পরিবারের ভেতরেও পরিবর্তন আসতে শুরু করল। প্রথমদিকে যারা তার লেখালিখিকে অবহেলা করেছিল, তারাই এখন ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে লাগল, অন্বেষার কণ্ঠ সমাজে গুরুত্ব পাচ্ছে। মা, যিনি একসময় বলেছিলেন “মেয়েদের এসব কাজ মানায় না,” তিনিই একদিন বাজারে কারো মুখে মেয়ের গল্পের নাম শুনে গোপনে গর্ব অনুভব করলেন। বাবা নীরব থাকলেও অন্বেষার বই টেবিলে যত্ন করে রেখে দিতেন, যেন স্বীকৃতির ভাষা আর মুখে বলতে হয় না। পরিবার পুরোপুরি বদলে গেল না, কিন্তু তাদের চোখে প্রথমবারের মতো মেয়েকে এক লেখক হিসেবে দেখা দিল। এই পরিবর্তনই অন্বেষার কাছে ছিল সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি। কারণ সে জানত—তার কলম কেবল নিজের জীবনকে নয়, আশেপাশের মানুষকেও বদলে দিতে শুরু করেছে। এই মুক্তি ও স্বীকৃতিই তার সংগ্রামের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।
১০
অন্বেষার জীবন একসময় ছিল অচল, অন্ধকার আর দমনের দেয়ালে ঘেরা। সেই দেয়াল ভেঙে দিতে যে প্রেরণার হাত বাড়িয়েছিল, তা ছিল এক অচেনা চিঠি। আজ সেই চিঠির প্রভাব তাকে পুরোপুরি নতুন এক মানুষে রূপান্তরিত করেছে। অন্বেষা এখন আর দ্বিধাগ্রস্ত, ভীতু মেয়ে নয়—সে এখন স্বাধীনচেতা, আত্মবিশ্বাসী এক নারী, যিনি জানেন তার কণ্ঠ কতটা মূল্যবান। তার গল্পগুলো পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছে, সমাজে আলোড়ন তুলছে। সে শিখেছে নিজের আবেগ, যন্ত্রণা আর স্বপ্নকে গল্পে রূপান্তর করতে। একসময় যেই অন্বেষা শুধু অন্যের নিয়ম মেনে চলত, আজ সেই অন্বেষা নিজের নিয়মে জীবন সাজাচ্ছে। তার ভেতরের কলমশক্তি তাকে মুক্তি দিয়েছে, তাকে চিনিয়েছে প্রকৃত নিজের সঙ্গে। এই মুক্তিই তার কাছে সবচেয়ে বড় বিজয়।
অচেনা সেই চিঠি তার জীবনে এক অব্যক্ত শিক্ষক, এক অদৃশ্য বন্ধু হয়ে উঠেছে। চিঠির প্রতিটি শব্দ যেন মন্ত্রের মতো তার ভেতরে কাজ করেছে। যদিও সে আজও জানে না, কে সেই চিঠি লিখেছিল, কেন লিখেছিল—তবুও আর সেটা জানার প্রয়োজন নেই। কারণ সেই অজানাই তার জীবনে সবচেয়ে গভীর পরিচয় হয়ে উঠেছে। এখন যখন সে খামটা হাতে নেয়, তার মনে হয় চিঠির লেখক আসলে তার নিজের ভেতরের শক্তি, যা তাকে আগে থেকে জাগাতে চেয়েছিল। অচেনা হয়েও সেই চিঠি তার জন্য সবচেয়ে পরিচিত হয়ে গেছে। আর এই অচেনা পাতা, যা একসময় রহস্য ছিল, এখন তার জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য। তাই অন্বেষা বুঝতে পারে, কিছু রহস্য চিরকাল রহস্য হিসেবেই থেকে যায়, কিন্তু সেগুলো মানুষকে এমনভাবে গড়ে তোলে যে তা অমূল্য হয়ে ওঠে।
পরিবার আর বন্ধুরাও অবশেষে তার এই নতুন রূপ মেনে নিতে শুরু করল। মা, যিনি একসময় তার লেখালিখিকে তুচ্ছ করেছিলেন, আজ মেয়েকে দেখে গর্বে চোখ ভিজিয়ে দেন। বাবা নীরব স্বীকৃতির পাশাপাশি এখন খোলাখুলিই বলেন, “আমার মেয়ে শুধু আমাদের নয়, সমাজকেও বদলাচ্ছে।” মৃণালী তো সবসময়ই ছিল তার পাশে, কিন্তু আজ বন্ধুত্বের এই শক্তি আরও দৃঢ় হয়েছে। তাদের সম্পর্কের মধ্যে এখন আর দ্বিধা নেই, বরং আছে পরস্পরের প্রতি গর্ব আর ভালোবাসা। সম্পর্কের এই ভারসাম্য অন্বেষাকে আরও শান্তি দেয়, আরও এগিয়ে যাওয়ার শক্তি দেয়। সে বুঝতে পারে—অচেনা চিঠি তাকে শুধু লেখক বানায়নি, মানুষ হিসেবে নতুন করে গড়ে তুলেছে। তাই এই অধ্যায় শেষ হলেও, এটি আসলে তার জীবনের নতুন সূচনা। এক নতুন যাত্রা, যেখানে প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি গল্প, আর প্রতিটি অচেনা পাতা তার স্বাধীনতার কাব্য রচনা করবে।
***
				
	

	


