Bangla - প্রেমের গল্প

অচেনা নাম, চেনা অনুভব

Spread the love

দিব্যেন্দু মুখার্জী


অধ্যায় ১: ভুল নম্বর, সঠিক সময়

কলকাতার আকাশটা সেদিন কিছুটা ধূসর ছিল। অফিস থেকে বেরোতেই গুমোট গরম শরীরের ওপর চেপে বসল, আর সঙ্গে সঙ্গেই ঋষভের মেজাজটাও যেন কেমন করে উঠল। সেক্টর ফাইভ থেকে সল্টলেকের দিকে যাওয়ার বাসে উঠে সে জানালার পাশে বসে মোবাইলটা হাতে নিল। সারাদিন ধরে ক্লায়েন্ট মিটিং, কোডিং, আর প্রজেক্ট রিপোর্টের চাপে ক্লান্ত সে, মনটা যেন হঠাৎ খুঁজতে লাগল একটুখানি নিঃশ্বাস, কিছুটা নির্জনতা। অন্যমনস্কভাবে কন্ট্যাক্ট লিস্ট ঘাঁটতে ঘাঁটতে সে এক নম্বরে ট্যাপ করে ফেলে—মনে করেছিল পুরনো বন্ধুর নম্বর। কল চলে যায়। দু’বার রিং বাজতেই ওপার থেকে একটা মেয়েলি কণ্ঠ ভেসে আসে, “হ্যালো?”—একটু বিরক্ত, একটু দ্বিধা মেশানো। ঋষভ থমকে যায়। এটা তো নয় সে যাকে কল করতে চেয়েছিল। কণ্ঠটা নতুন, কিন্তু তাতে একটা অদ্ভুত টান ছিল। একটু হকচকিয়ে ঋষভ বলে, “সরি, মনে হয় ভুল নম্বরে কল করে ফেলেছি।” মেয়েটি তখন বলল, “হ্যাঁ, ভুলেই হয়েছে নিশ্চয়… কিন্তু এত রাত্রে ভুল করাটাও বেশ বড় ভুল, জানেন তো?” কথাটা হালকা রসিকতার ছোঁয়া পেলেও তাতে একটা স্পষ্ট অসন্তোষ ছিল। ঋষভ হেসে ফেলল—সে নিজেও জানে, কথোপকথনটা এখানেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু কে জানে কেন, সে বলল, “আপনার কণ্ঠটা কিন্তু খুব চেনা চেনা লাগছে। আপনি কি আগে কখনো আমাকে ফোন করেছিলেন?” মেয়েটা একটু থেমে বলল, “এই ট্যাকটিকসটা অনেকেই ব্যবহার করে, বুঝলেন? আমি কিন্তু সহজে ফাঁদে পড়ি না।” তারপর হঠাৎ করেই লাইন কেটে দিল। ঋষভ হতচকিয়ে গেল, কিন্তু তারপর তার মুখে এল এক মৃদু হাসি—অনেকদিন পর সে একটা ভুলকে মনে মনে শুভেচ্ছা জানাল।

পরদিন সকালে অফিসে পৌঁছে যাবার পর কাজের চাপে সেই ভুল নম্বরটা অনেকটাই ভুলে গিয়েছিল ঋষভ। কিন্তু বিকেল গড়াতেই যখন একঘেয়ে মিটিং-এর মাঝখানে ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল, এবং স্ক্রিনে ভেসে উঠল অচেনা সেই নম্বরটা—ঋষভ অবাক হল। সে দ্রুত মিটিং থেকে বেরিয়ে গিয়ে ফোনটা ধরল, ওপার থেকে সেই কণ্ঠ, একটু নরম, একটু দ্বিধাভরা, “আমি… একটু খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছিলাম হয়তো গতকাল। ক্ষমা করবেন।” ঋষভ মৃদু হেসে বলল, “আপনার অসন্তোষটা একদম যৌক্তিক ছিল। কিন্তু আপনি ফোন করেছেন, সেটাই তো একটা চমক।” মেয়েটি এবার একটু হেসে বলল, “জানি না কেন… মনে হল একটা ভুলকে ঠিক করে দেওয়া দরকার। কিংবা হয়তো সেই কণ্ঠে একটা খাঁটি নিঃসঙ্গতা ছিল, যা আর পাঁচটা ভুল ফোনের মতো মনে হয়নি।” কথাটা শুনে ঋষভ কেমন যেন চুপ করে গেল। এই মেয়েটি তাকে চিনল কীভাবে? নাকি এই বুঝে ফেলার মধ্যে কোনো অলৌকিক স্পর্শ আছে? এরপর তারা মিনিট পাঁচেক কথা বলল—সাধারণ বিষয়, কাজ, পড়াশোনা, শহরের ট্রাফিক। কেউ কাউকে নাম জিজ্ঞেস করল না, কেউ নিজের ঠিকানা জানাল না—কিন্তু দুই কণ্ঠের মাঝখানে এক অদৃশ্য সেতু যেন তৈরি হয়ে গেল, যেটা সময়ের ব্যস্ততায় বহুদিন ধরে অনুপস্থিত ছিল।

সন্ধ্যে নামার সঙ্গে সঙ্গে আকাশটা ভারী হয়ে উঠেছিল, হালকা বাতাসে শহরের আলোগুলো একটু ধোঁয়াটে লাগছিল। ঋষভ সেদিন আর বাসে ওঠেনি, হেঁটেই ফিরছিল, হেডফোনে কোনো গান চালিয়ে নয়—কারণ সে অপেক্ষা করছিল সেই কণ্ঠটার জন্য। ঠিক সময়েই ফোনটা আসে। মেয়েটি বলে, “আজ আকাশটা বড় অদ্ভুত না? জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকলে মনে হয় সব কেমন ঝাপসা।” ঋষভ বলে, “হয়তো আমরা দুজনেই আজ জানালার এপার-ওপার থেকে একই আকাশ দেখছি।” তারপর নিঃশব্দে কেটে যায় মিনিট কুড়ি—কথোপকথনের মাঝখানে কোনো তাড়াহুড়ো নেই, কোনো উদ্দেশ্য নেই, শুধু আছে শোনার ইচ্ছা আর বলার সাহস। অচেনা এক কণ্ঠ, যার নাম জানা নেই, যার মুখ কল্পনাতেই আঁকা হচ্ছে—সে কীভাবে যেন ঋষভর মনের গভীরে জায়গা করে নিচ্ছে। এই প্রথম, অনেক বছর পর, সে অনুভব করল—তাকে কেউ প্রশ্ন করছে না, বিচার করছে না, শুধু শুনছে। সে রাতে ঘুমাতে যাবার আগে সে নিজের ডায়েরিতে একটা লাইন লেখে, “ভুল নম্বর বলে কিছু হয় না… হয় শুধু ভুল সময়ের ঠিক মানুষ।” আর ঠিক সেই সময়, বহু দূরে শান্তিনিকেতনের এক নিঃশব্দ কক্ষে, সেই মেয়েটিও হয়তো এক চুমুক কফির কাপ হাতে নিয়ে মনে মনে ভাবছে, “এমন যদি প্রতিদিন হতো—কেউ শুধু শোনার জন্য অপেক্ষা করে থাকত।”

অধ্যায় ২: “তুমি কেমন আছো?”

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই ঋষভ মোবাইল হাতে নিয়ে অচেনা নম্বরটার দিকে তাকিয়ে থাকল বেশ কিছুক্ষণ। যেন নিজেরই মনকে বুঝতে চাইছিল—কেন এই নম্বরটা এতটা আপন হয়ে উঠল মাত্র একদিনেই? অথচ এখনো সে মেয়েটির নাম জানে না, চেহারাও কল্পনার বাইরে। কিন্তু যতবার কণ্ঠটা তার কানে বাজে, মনে হয় দীর্ঘদিনের কেউ খুব কাছ থেকে কথা বলছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সে প্রায় আনমনা হয়ে পড়ে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই সে নিজে থেকে ফোন করল না, ভেবেছিল… যদি আজ আবার ফোন আসে! হয়তো ও-ই কল করবে, হয়তো গতকালের মতো… আবার এক নতুন কথোপকথনের শুরু হবে। কিন্তু সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেল, ফোন এল না। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে, ভিড় বাসে উঠে কিংবা খাবার অর্ডার দিতে গিয়ে, সবসময় সে একরকম অপেক্ষা করছিল সেই শব্দটার জন্য—tring-tring, সেই একটিমাত্র রিংটোন, যেটা এখন ওর দিন শেষের আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আর ঠিক যখন সে ভেবেই নিয়েছে, হয়তো মেয়েটি আর ফোন করবে না, হয়তো এই বন্ধুত্বটা একদিনের গল্প হয়েই থেকে যাবে, ঠিক তখন রাত দশটা বাজে—ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল। স্ক্রিনে সেই নম্বর! ঋষভ সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করল। ওপার থেকে মেয়েটি বলল, “তুমি কল করোনি আজ, ভাবছিলে না আমি করব?” কণ্ঠে মৃদু অভিমান। ঋষভ হেসে বলল, “ভাবছিলাম ঠিকই… কিন্তু অপেক্ষা করছিলাম তুমি বলো, ‘তুমি কেমন আছো?’” মেয়ে হেসে উঠল, “তাহলে বলি—তুমি কেমন আছো?” সেই তিনটি শব্দ যেন ঋষভর বুকের মধ্যে কোথাও গিয়ে নরম করে দিল। একটা অচেনা কণ্ঠ যদি এভাবে নিয়মিত খোঁজ নেয়, তাহলে সেটাকে আর অচেনা বলা চলে কি? তারা আবার কথা বলতে শুরু করল—এবার কিছুটা গভীরে। মেয়েটি জানাল, সে শান্তিনিকেতনে পড়ে, শেষ বর্ষের ছাত্রী, কবিতা আর গান ভালোবাসে। ঋষভ বলল, সে একটা কর্পোরেট জব করে, অনেকটা যন্ত্রের মতো দিন কাটে, কিন্তু এই একটুখানি সময় যেন ওর জীবনের রঙ হয়ে উঠেছে। তারা ঠিক করল, না… কেউ কারো নাম এখনো জানবে না। নাম না থাকলেই বোধহয় সম্পর্কটা বেশি খাঁটি থাকে—যেখানে শুধু অনুভব থাকে, কোনো সামাজিক পরিচয় নয়।

তাদের প্রতিদিনের রুটিনে এখন একটা নতুন নিয়ম যুক্ত হয়েছে—রাত দশটায় ফোনে কথা। যেমন করে শিশুরা ছোটবেলায় গল্প শুনে ঘুমিয়ে পড়ে, তেমনিভাবে তারা কথার ভেতর দিয়ে নিজেকে জড়িয়ে রাখে। মেয়েটি একদিন বলল, “আজ ক্লাসে রবীন্দ্রনাথের ‘শেষ প্রশ্ন’ পড়ানো হল, জানো? সেখানে এক জায়গায় লেখা আছে—‘ভালোবাসা বোঝা বড় দায়; মুখে বললে, সে তো মাটি হয়ে যায়।’” ঋষভ বলল, “তাই তো আমরা কিছু বলি না। শুধু শুনি। আর শোনা… সেটাই তো সবথেকে সত্য ভালোবাসা।” মেয়েটি নীরব হয়ে গেল কিছুক্ষণ, তারপর আস্তে বলল, “তুমি জানো, তোমার কণ্ঠটা শুনলেই মনে হয় আমি একা নই। এত কাছাকাছি কেউ আগে কখনও ছিল না।” ঋষভ চোখ বন্ধ করল। মনে হল তার জীবনে দীর্ঘদিন পর কোনো শব্দ হৃদয়ে গিয়ে ছুঁল। যাকে সে চোখে দেখেনি, নাম জানে না, শুধু কণ্ঠে চিনেছে—তাকে সে বুঝে ফেলেছে। কিংবা হয়তো চেনার থেকেও বেশি কিছু… অনুভব করে ফেলেছে। সেই রাতে ঘুমানোর আগে দুজনেই জানত, কিছু একটা জন্ম নিচ্ছে তাদের ভেতরে, নামহীন এক বন্ধন, যার প্রতিটি শুরুর শব্দ হয়—”তুমি কেমন আছো?”

অধ্যায় ৩: দুই শহরের দুটি জানলা

ঋষভর জানালার ধারে বসে থাকা এখন অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। অফিস শেষে এককাপ চা, একটা প্যাড—যেখানে সে এলোমেলো কিছু কবিতার লাইন লেখে, আর সঙ্গে সেই পরিচিত রিংটোনের জন্য অপেক্ষা। শহরের এই দিকটায় স্লো ট্রাফিক, আলোর ছায়া আর প্যাসেঞ্জারদের ক্লান্ত মুখ। কিন্তু তার কাছে এখন এই শহরটা একটু অন্যরকম লাগে—যেন তার এক পাশেই একটা অদৃশ্য জানলা খুলেছে, যেখান থেকে অন্য এক শহরের, অন্য এক মেয়ের কণ্ঠ আসে প্রতিদিন। ওপার থেকে তৃষার জানালাটা শান্তিনিকেতনের শান্ত পরিবেশে খোলা থাকে—সেখানে শাল-পলাশের ছায়া, পাখির ডাক, আর সন্ধ্যা হলে রবীন্দ্রসংগীতের মৃদু সুর। তারা কথা বলে, যেন দুটি জানলা একে অপরের দিকে মুখ করে আছে। তৃষা জানায়, কলেজ লাইব্রেরির পাশে তার প্রিয় একটা জায়গা আছে—ওখানে বসে সে চুপচাপ আকাশ দেখে। “তুমি জানো, আকাশও কিন্তু বন্ধু হতে পারে… ও কখনও প্রশ্ন করে না, শুধু পাশে থাকে।” ঋষভ বলল, “ঠিক তাই, যেমন করে তুমি আছো এখন আমার পাশে, কোনো নাম ছাড়াই।”

তাদের কথার মধ্যে এক অদ্ভুত ছন্দ তৈরি হয়ে গেছে। তৃষা প্রতিদিন ঋষভকে বলে, “আজকের দিনটা কেমন গেল তোমার?” আর ঋষভ জানে, এই প্রশ্নটার উত্তর গুছিয়ে বলার দরকার নেই—যে মানুষ শুধু কণ্ঠে তোমাকে পড়ে ফেলতে পারে, তার কাছে কোনো সাজিয়ে বলা মানে নেই। তৃষা কখনো ফোনে গান গায়, কখনো কবিতা পড়ে শোনায়। “আমি জানি না কেন, তোমার কণ্ঠে একটা ক্লান্তি লুকিয়ে থাকে,” একদিন বলেছিল তৃষা, “যেন অনেকটা পথ হাঁটার পর হঠাৎ একটা ছায়া পেয়ে দাঁড়িয়ে গেছো।” ঋষভ কিছু বলেনি, শুধু শুনে গেছে। এই মেয়েটি, যার নাম সে জানে না, যাকে কখনো দেখেনি, কীভাবে এমন করে তার ভেতরের কথা পড়ে ফেলে? নিজের কাছেই উত্তর নেই। সে জানে শুধু এই ফোনকলে সে নিজেকে খুঁজে পায়। একটা কণ্ঠই তো যথেষ্ট, যদি সেটা বুঝে শুনতে পারে। শহরের ব্যস্ত ভিড়ের মাঝে, অফিস-বাসা-ট্রাফিকের স্লটে যাকে সবাই ভুলে যায়, সেই ঋষভ এখন নিজেকে ‘শোনা’ বোধ করে।

সন্ধ্যাবেলা প্রিন্সেপ ঘাটে দাঁড়িয়ে ছিল ঋষভ, মোবাইল কানে। ওপার থেকে তৃষা বলল, “জানালার ওপারে আজ আকাশে একটা তারা জ্বলছে, খুব উজ্জ্বল। ওকে দেখে মনে হচ্ছে, যেন কেউ অপেক্ষা করছে—কাউকে ছাড়া একা নয়, বরং কাউকে ভেবে একা থাকা।” ঋষভ উত্তর দিল, “তোমার কণ্ঠটাই তো আমার সেই তারা। তুমি যদি না বলো, আমি রাতে আকাশেই চোখ তুলতে পারি না।” এইসব সংলাপ হয়তো বাইরে থেকে শুনলে বড় বেশি নাটকীয় লাগে, কিন্তু যারা মনের গভীরে একা হয়ে থাকে, তাদের কাছে এই কথাগুলোই সত্যি হয়ে ওঠে। রাত বাড়ে, আকাশ নেমে আসে শহরের ছাদে, আর তারা দুইজন জানালার এপার-ওপার দাঁড়িয়ে থাকে—একজন গানের ছায়ায়, আরেকজন শব্দের অন্ধকারে। কিন্তু তাদের হৃদয়ের দূরত্ব যেন দিনে দিনে হ্রাস পেতে থাকে। নামহীন এই বন্ধুত্ব এখন সীমানা ছুঁতে চায় না, শুধু পাশে থেকে ভালোবাসতে চায়—একটা কণ্ঠ হয়ে।

অধ্যায় ৪: সুরের ওপারে এক কণ্ঠ

বৃষ্টি হচ্ছিল শান্তিনিকেতনে। জানালার গ্লাসে ছিপছিপে ফোঁটা জমে, আর তৃষা বইয়ের পাতায় আঙুল চালিয়ে চলে গিয়েছিল কোনও দূরের স্মৃতিতে। ফোনটা তখন পাশেই, নিঃশব্দে শুয়ে ছিল, ঠিক সেই সময় সে হঠাৎ করেই ঋষভকে ফোন করে বলল, “আজ তোমার জন্য একটা গান গাইব… যদি তুমি শুনতে চাও।” ওপার থেকে ঋষভর গলা—নরম, মুগ্ধ, “তোমার গলা শুনতে আমি সারাদিন অপেক্ষা করতে পারি।” তৃষা একটু থেমে রবীন্দ্রসংগীত ধরল, “আমার পরাণ যাহা চায়, তুমি তাই…” ফোনের এপার-ওপার দুই শহরের শব্দ একসাথে মিশে গেল। ওই মূহূর্তে কলকাতার ব্যস্ত রাস্তায় গাড়ির হর্ন, ট্র্যাফিকের শব্দ, আর হেডফোনে ভেসে আসা তৃষার কণ্ঠ—সব এক হয়ে গিয়ে তৈরি করল এক অদ্ভুত নিঃশব্দ ঘর, যেটা শুধুই ঋষভর জন্য। সে চোখ বন্ধ করল, মনে হল তার জীবনের সমস্ত ক্লান্তি ধুয়ে যাচ্ছে ওই কণ্ঠসুরে। এতটা গভীর প্রশান্তি সে বহুদিন পায়নি।

গান থেমে গেলে তৃষা বলল, “তুমি কি কখনো এমন কাউকে পেয়েছো, যার মুখ না দেখেও তুমি বুঝতে পারো, ও ঠিক কোন শব্দে হাসে, কোন কথায় চুপ করে যায়?” ঋষভ উত্তর দিল না, শুধু একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। তৃষা বোঝে গেল, সেই নীরবতাই উত্তর। তারা দুজনই অনুভব করছিল, এই সম্পর্কটা আস্তে আস্তে গাঢ় হয়ে উঠছে। এতদিন নাম ছাড়া কথা বললেও, আজ সেই কণ্ঠে গান এসে জুড়ে গেল, আর সম্পর্কটা যেন নতুন একটা রূপ পেল। ঋষভর মাথার ভেতরে তৃষার গানের কলি ঘুরে বেড়াতে লাগল, আর সে বুঝল—এই মেয়েটির কণ্ঠ তার জন্য এক আশ্রয় হয়ে উঠেছে, যেটা তাকে নীরবতা থেকে তুলে এনে বাঁচতে শিখিয়েছে। শহরের এই সমস্ত কোলাহলের মাঝে, সেই কণ্ঠই এখন তার ঘুমের দাওয়াই, একমাত্র সঙ্গী।

তৃষা তখন শান্তিনিকেতনের ছায়াঘেরা বারান্দায় বসে কফির কাপ হাতে, মৃদু গলায় বলল, “তুমি জানো, আমি কখনো আমার গান কাউকে শুনাইনি। আজ প্রথম গাইলাম… তোমার জন্য।” ঋষভর বুক কেঁপে উঠল। এই শব্দগুলো যেন খুব গভীর কোথাও ছুঁয়ে গেল। সে নিজেকে একটু গুটিয়ে বলল, “আমি কি সত্যিই এমন কিছু, যার জন্য তুমি নিজের পৃথিবী খুলে দিচ্ছো?” তৃষা হেসে বলল, “হয়তো তুমিই সেই ভুল নম্বর, যেটা ঠিক সময়ে আমার জীবনে এসেছিল।” রাতটা যেন আর থামতে চাইছিল না। আকাশে তারা ছিল না, কেবল ছিল এক মেয়ের কণ্ঠ, যেটা এক ছেলের সমস্ত নিঃসঙ্গতা ঢেকে দিয়ে বলেছিল—“আমার পরাণ যাহা চায়, তুমি তাই।” আর সেই মুহূর্তে, নামহীন এক ভালোবাসা ধীরে ধীরে গন্ধ ছড়াতে শুরু করল, যেন বৃষ্টিভেজা রাতেও তার সুর শোনা যায়।

অধ্যায় ৫: “তুমি কারো না হয়েও আমার!”

কলকাতার সেই রোজকার ক্লান্তি আর যান্ত্রিকতার মাঝেও আজকের সন্ধ্যেটা কেমন যেন অন্যরকম লাগছিল ঋষভর কাছে। জানালার ধারে বসে সে একরকম অপেক্ষা করছিল, কিন্তু আজ একটু অস্থিরতা বেশি। অফিস থেকে বেরিয়ে আসার পর সেই ছাদে বসার জায়গায় এসে চুপ করে বসে সে, একটা হালকা সিগারেট ধরিয়ে দেয়। আকাশটা মেঘে ঢাকা, বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ, আর হেডফোনে এখনো কিছু বাজছে না। শুধু ফোনের স্ক্রিনটা অন করে আবার বন্ধ করছে সে—যেন কোনো শব্দ, কোনো কণ্ঠ তাকে জাগিয়ে দেবে। আর ঠিক তখনই ফোনটা বাজে। সেই পরিচিত নম্বর। তৃষা। “আজ একটু দেরি হল, জানো?” কণ্ঠে সেই একই আশ্বাসের ছোঁয়া, যেটা ঋষভকে প্রতিদিন একটা নতুন সন্ধ্যে উপহার দেয়। তারা চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, কেউ কিছু বলে না। শব্দের মাঝে শব্দহীনতাটাই যেন বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তারপর হঠাৎ ঋষভ বলে বসে, “জানো, তুমি কারো না হয়েও আমার হয়ে গেছো।”

তৃষা চুপ করে যায়। ফোনের ওপাশে নিঃশব্দে হাওয়ার শব্দ শোনা যায়, মাঝে মাঝে একটা পাখির ডাকা—যেন দূরের কোনো গাছ থেকে। তারপর কণ্ঠটা ফিরে আসে, মৃদু গলায়, “তোমার এই কথাগুলো শুনলে ভয় করে… আমরা তো পরস্পরের কিছু না, তাই তো?” ঋষভ বলে, “না, আমরা কিছু না—তবে সেই ‘কিছু না’-র ভেতরেই তো সবচেয়ে গভীর অনুভবগুলো থাকে। তুমি কি জানো, এই কিছু না হয়ে ওঠা অনুভূতিটাই অনেক বেশি স্থায়ী?” তৃষা হাসে, সেই নরম কণ্ঠে, যেটা অনেকটা বিষাদে মোড়ানো আলোয় ঝলমলে। সে বলে, “আজ সারাদিন কলেজে মন ছিল না। শুধু ভাবছিলাম, তুমি কখন ফোন করবে। ভাবছিলাম, আজ যদি না বলো… ‘তুমি আছো তো?’ আমি হয়তো আর কলটাই করতাম না।” কথাটা শুনে ঋষভর বুক কেঁপে ওঠে। সে চুপ করে থাকে, তারপর বলে, “আমি থাকি, প্রতিদিন… শুধু তোমার অপেক্ষায়।” এভাবে প্রতিদিনের কথোপকথন আর একটু একটু করে জমা হওয়া অনুভব—সব মিলিয়ে এখন তারা এমন এক বন্ধনে জড়িয়ে গেছে, যেটা চোখে দেখা যায় না, শুধু কণ্ঠে কণ্ঠে অনুভব করা যায়।

রাতে তারা একসঙ্গে চাঁদের কথা বলে, তৃষা বলে, “তুমি কি জানো, আজকের চাঁদটা অসম্ভব সুন্দর?” ঋষভ হেসে বলে, “হয়তো তুমি তাকিয়ে আছো বলেই ও সুন্দর লাগছে।” এইসব কথায় তাদের প্রেমের নির্ভরতা জমে ওঠে—কোনো নাম নেই, কোনো সামাজিক চিহ্ন নেই, কেবল কণ্ঠ আর অনুভব। তৃষা একসময় বলে, “তোমার নামটা জানার ইচ্ছে হয় না আমার। কারণ আমি ভয় পাই—নাম জানলে তুমি আর এমন করে কথা বলবে না। এই অচেনা জায়গাটাতেই আমাদের কথা এত আপন।” ঋষভ চুপচাপ শুনে যায়। সে জানে, কোনো নাম, কোনো পরিচয় এই কথাগুলোকে ছাপিয়ে যেতে পারে না। আজ রাতে যখন ফোন কেটে যাবে, তারা আবার সেই নিজ নিজ শহরের জানালায় বসে থাকবে, একা, অথচ একে অপরের ছায়ায় ঢাকা। আর কোথাও না কোথাও, অচেনা এক অনুভব আবার নিজের জায়গা করে নেবে—নামহীন, দাবি-বিহীন, অথচ অদ্ভুতভাবে চিরস্থায়ী।

অধ্যায় ৬: দূরত্বের শহরে কাছাকাছি হৃদয়

তৃষা ফোন করেনি আজ। পুরো একদিন পেরিয়ে গেল, তবু স্ক্রিনে সেই নম্বরটা ভেসে উঠল না। ঋষভ প্রথমে ভাবল, ব্যস্ত থাকবে হয়তো। ক্লাস, টিউশন, হয়তো কারেন্ট নেই শান্তিনিকেতনে, অথবা সে নিজেই ভুলে গিয়েছে কথা বলার কথা। কিন্তু যত রাত বাড়ে, তত তার অস্থিরতা বাড়তে থাকে। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মনে পড়ে যায়, শেষবার তৃষা বলেছিল—”আমি ভাবি, যদি একদিন তুমি না থাকো?” সে তো ছিল! ঠিক সময়েই ফোন হাতে বসেছিল, অপেক্ষা করেছিল, কিন্তু আজ… ও নেই। ঠিক সেই প্রথম দিনের মতোই আবার অচেনা হয়ে গেল সবকিছু। সে ফোন করতে চাইল, কিন্তু সাহস হল না। কে জানে, মেয়েটি চুপ কেন। হয়তো চলে যেতে চায়? হয়তো এই নামহীন অনুভবটা এখন ওর কাছে ভারী হয়ে উঠেছে?

পরদিন সন্ধ্যায়ও ফোন এল না। দুই দিন, চল্লিশ আটঘণ্টা, তৃষার কণ্ঠ ছাড়া ঋষভর পৃথিবীটা কেমন রঙহীন, নিষ্প্রাণ লাগছিল। সে জানত, তারা কেউ কারো কিছু না, কিন্তু অদ্ভুতভাবে সে যে তৃষার অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। রাতের ফোনকলে ভেসে আসা সুর, সেই চুপ করে থাকা মুহূর্তগুলো, সেই ছোট ছোট সংলাপ—সব এখন তার অস্তিত্বের অঙ্গ। তৃষা না থাকলে সে যেন নিজের সাথেই কথা বলতে ভুলে যাবে। এতটা কাছে এসে কেউ যদি হঠাৎ দূরে চলে যায়, সেটা কি আর “অচেনা” সম্পর্ক থাকে? একদিন পরে শেষপর্যন্ত সে নিজেই মেসেজ করল—“তুমি ঠিক আছো তো?” আর কোনো উত্তর না পেয়ে দ্বিতীয়বার লিখল—“আমি এখানে আছি। আজও।” পাঠানোর পরে মনে হল, যদি আর উত্তরই না আসে? যদি এই সম্পর্কটা এখানেই চুপসে যায়? সে জানত, তৃষাকে ভালোবাসে কি না, সে উত্তর তার কাছে নেই। কিন্তু এটা জানে—তৃষা ছাড়া তার সন্ধ্যাগুলো অসম্পূর্ণ।

তৃতীয় দিনে যখন ফোনটা বেজে উঠল, তখন ঋষভ কিছুটা কেঁপে উঠল। স্ক্রিনে সেই নম্বর, সেই রিংটোন, কিন্তু এবার কণ্ঠটা আগের চেয়ে যেন বেশি ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। “আমি ঠিক ছিলাম না। বাবার শরীর হঠাৎ খারাপ হয়ে যায়… হসপিটালে ভর্তি। একটানা দৌড়, ব্যস্ততা, ভয়… ভাবতেও পারিনি ফোনটা হাতে নিতে পারব।” ঋষভ এক মুহূর্তের জন্য নিঃশব্দে শুনে গেল সবকিছু, তারপর বলল, “আমি ভেবেছিলাম… তুমি হয়তো চলে যেতে চাইছো।” তৃষার গলায় কাঁপা ভেসে এল, “আমার এমন সাহস নেই। আমি ভুলে গেছিলাম, কীভাবে একটা কণ্ঠ কোনো মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে।” তারপর কিছুক্ষণ তারা কিছু বলল না। শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ, আর এক অদৃশ্য আশ্বাস—তারা কেউ কাউকে ছাড়েনি। দূরত্ব থাকলেও, তারা এখনো ঠিক ‘একই অনুভব’-এ আবদ্ধ। সেই রাতে তারা ফোন ছাড়েনি একটাও। শুধু কথা নয়, নিঃশব্দে বোঝা—যদি কোনো একদিন আর কণ্ঠ না ভেসে আসে, তবুও হৃদয় তার পথ চিনে নেবে।

অধ্যায় ৭: পরিচয়ের আগে প্রেম

ঝড় থেমে যাওয়ার পরের শান্তিটা যেমন গভীর, তেমনই সেই নিঃশব্দ তিনদিনের বিরতির পর ঋষভ আর তৃষার মধ্যে তৈরি হয়েছিল এক নতুন স্তরের অনুভব—নির্ভরতামিশ্রিত বন্ধুত্ব, অভ্যাসে গাঁথা ভালোবাসা। তারা কেউ এখন আর বলে না “তুমি কে?” কিংবা “এই সম্পর্কের নাম কী?” তাদের প্রতিদিনের সংলাপ, ছোট ছোট আলাপ, আর অবলীলায় ভাগ করে নেওয়া একান্ত মুহূর্তগুলো এমনভাবে জমে উঠেছে, যেন পরিচয়ের আগেই তারা প্রেমে পড়ে গেছে। তৃষা একদিন বলল, “তুমি জানো, আমার কলেজে একজন ছেলে প্রোপোজ করেছিল কিছুদিন আগে। আমি না বলেছি।” ঋষভ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে প্রশ্ন করল, “কারণ?” তৃষা বলল, “কারণ আমি কাউকে মনে রাখার আগে নিজে কাউকে মনে রেখে ফেলেছি।” কথাটা শুনে ঋষভর মনে হল, হৃদয়ের ভিতরে কেউ একমুঠো আলো ছুঁড়ে দিয়েছে।

তারা কেউ প্রেম স্বীকার করেনি এখনো। কেউ বলেনি, “আমি তোমায় ভালোবাসি।” কিন্তু কোনো কথা বলার প্রয়োজনও বোধহয় ছিল না। প্রতিদিন রাত দশটার সেই কল—এতটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল যে, একদিন ফোন না এলে যেন দিনটাই অসম্পূর্ণ থেকে যেত। একদিন তৃষা বলল, “আমরা কি সত্যিই শুধু ‘বন্ধু’?” ঋষভ হেসে বলল, “বন্ধু বললে কি তোমার কণ্ঠ এতটা নরম হয়ে আসে?” তৃষা নিরুত্তর। তারপর সে নিজেই স্বীকার করল, “আমার মন চায় তোমার কথা শুনে ঘুমোতে, আর সকালে উঠে তোমার কথাতেই দিন শুরু করতে।” কথাটা বলেই কেমন যেন গলা কেঁপে ওঠে তৃষার, “আমরা তো কোনোদিন দেখা করিনি, না নাম জানি একে অপরের, তবুও কেন মনে হয়, তুমিই আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ?” ঋষভ আস্তে বলল, “হয়তো কাছের মানুষের সংজ্ঞাই বদলে গেছে আমাদের কাছে। চেনা মুখের চেয়ে চেনা কণ্ঠ এখন বেশি সত্য।”

ঋষভ একদিন কবিতা পড়তে গিয়ে হঠাৎ নিজের মনের কথা বলে ফেলল, “আমি তোমার কণ্ঠে ঘর বেঁধেছি। জানো? তোমার এই নিঃশব্দ হাসি, হালকা দীর্ঘশ্বাস, মাঝেমাঝে অন্যমনস্ক হওয়া—সব শুনি আমি। এমন কেউ কি আর আছে আমার জীবনে?” তৃষা চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, “তুমি কি জানো, একা থাকার মধ্যে সবচেয়ে বড় যেটা ভয়, সেটা হল—তোমার কেউ থাকবে না। কিন্তু এখন আমি জানি, একা থাকলেও তুমি আমার পাশে আছো। তুমি নাম জানো না, ছবি দেখোনি, কিন্তু তুমি আছো। তা-ই তো প্রেম, তাই না?” ঋষভ কিছু বলে না। শুধু গভীরভাবে শ্বাস নেয়, আর মনেই মনে বলে ওঠে—“হ্যাঁ, এটাই প্রেম, নামহীন, দাবি-বিহীন, তবু সম্পূর্ণ।” সেই রাতে তারা দুজনেই ঘুমোয় একসাথে চাঁদের আলোয়, এক ফোনের দুই প্রান্তে—যেখানে শব্দই ছিল প্রেমের ভাষা।

অধ্যায় ৮: প্রথম দেখা—চেনা কণ্ঠ, অচেনা চোখ

এক বিকেলে কথার মাঝেই তৃষা বলে বসে, “একটা পাগলামি করি? দেখা করি?” কিছুক্ষণ নিরবতা ছিল দুই প্রান্তে। তারপর ঋষভ ধীরে বলল, “দেখা মানেই কি সব বদলে যাবে?” তৃষা বলল, “হয়তো বদলাবে, হয়তো নয়। কিন্তু কণ্ঠের ওপর যে ভরসা করেছি এতদিন, চোখেও কি একটু রাখা যায় না?” তারা ঠিক করল, মুখোমুখি হবে। কোনো পার্ক, ক্যাফে বা বন্ধুত্বপূর্ণ ভিড় নয়—একটা নির্জন, শান্ত জায়গা। ঠিক হলো, তারা দেখা করবে কলকাতার প্রিন্সেপ ঘাটে, গঙ্গার ধারে, যেখানে আলো কম, শব্দ কম, কিন্তু অনুভবের গভীরতা বেশি। না নাম, না ছবি—কেবল একটামাত্র চিহ্ন ঠিক করল তৃষা, “আমার হাতে থাকবে একটা সাদা গোলাপ। তুমিই চিনে নিও।”

সেদিন বিকেল পাঁচটা। ঋষভ আগেই এসে পৌঁছেছে। তার বুকের মধ্যে একরকম ঝড় চলছে। সে জানে না, যাকে সে এতদিন শোনে এসেছে, যাকে অনুভব করেছে প্রতিটি শব্দে, সেই মানুষটা দেখতে কেমন—সে কি হাসলে চোখ ছোট হয়ে যায়? নাকি কথার মাঝে কপাল কুঁচকে যায়? সে কি বসে থাকবে সোজা হয়ে, নাকি সামান্য কাত হয়ে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে থাকবে? প্রতিটি মুহূর্তে তার কল্পনায় তৈরি হতে থাকে হাজারটা চেহারা। আর ঠিক তখনই সে দেখে—একটা সাদা কুর্তি পরা মেয়ে ধীরে ধীরে ঘাটের দিকে আসছে, হাতে একটা সাদা গোলাপ। মেয়েটি এসে চুপ করে বসে। কিছু বলে না। শুধু চুপচাপ গঙ্গার দিকে তাকিয়ে থাকে। আর ঋষভ একসময় ধীরে গিয়ে তার পাশে বসে। তারাও কথা বলে না, শুধু বসে থাকে। যে কণ্ঠ এতদিন তাদের দুজনকে বেঁধে রেখেছিল, সে আজ নিশ্চুপ। তারা যেন অনুভব করে—এই নীরবতাও একধরনের ভাষা।

অনেকক্ষণ পর তৃষা মুখ ঘোরায়, তার চোখে আলো পড়ে—সেই কণ্ঠের মেয়েটিকে ঋষভ এই প্রথম দেখে, আর ঠিক সেই মুহূর্তে বোঝে, কণ্ঠ কখনো ঠকায় না। মেয়েটির মুখে কোনো রং নেই, সাজ নেই, কিন্তু চোখে আছে একরকম আশ্বাস, যেটা সে এতদিন ফোনের শব্দে অনুভব করত। ঋষভ হালকা গলায় বলে, “তুমি তো ঠিক সেরকমই, যেরকম কণ্ঠটা বলেছিল।” তৃষা মুচকি হাসে, “আর তুমি তো আমার চোখের চেয়েও বেশি চেনা।” তারা বসে থাকে সন্ধ্যা নামা পর্যন্ত। কোনো প্রতিশ্রুতি নয়, কোনো জোরালো অনুভবের ঘোষণা নয়, শুধু পাশে থাকা। এই দেখা যেন তাদের ভালোবাসাকে নতুন করে দৃঢ় করে দেয়—এবার আর শুধু কণ্ঠ নয়, চোখেও তারা নিজেদের খুঁজে পায়। দুই শহরের জানলা এখন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, একসাথে হাওয়া খাচ্ছে, আর সেই চেনা কণ্ঠ আজ সত্যি হয়ে বসে আছে ঠিক সামনে।

অধ্যায় ৯: কণ্ঠ থেকে করতলে

সেই প্রথম দেখা যেন তাদের দীর্ঘ অপেক্ষার এক পূর্ণতা। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, প্রথম দেখার পর তাদের মধ্যে কথার পরিমাণ কিছুটা কমে যায়। আগে যে প্রতিদিন রাত দশটায় ফোন আসত, তা এখন হয়ত দু-তিনদিন বাদে আসে। আর ফোন এলেও, দুজনেই বুঝতে পারে—এখন যেন কণ্ঠের বদলে চোখ কথা বলে। ঋষভ একদিন বলল, “তোমার সঙ্গে দেখার পর আমার ভয় করছে তৃষা… আগে তো শুধু কণ্ঠ ছিল, তুমি ছিলে একরকম নির্ভার… কিন্তু এখন তুমি একদম সামনে দাঁড়িয়ে, স্পর্শযোগ্য, হারানোর আশঙ্কাও অনেক বেশি।” তৃষা তখন বলল, “আমিও তো ভয় পাচ্ছি। আগে জানতাম, তোমাকে হারালেও কেবল এক কণ্ঠ হারাব। এখন জানি, যদি চলে যাও, তাহলে তোমার মতো মানুষটাই হারিয়ে যাবে। সেটা আমি পারব না ঋষভ।” সম্পর্কটা গভীর হচ্ছিল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাতে জড়িয়ে পড়ছিল একরকম দুরুদুরু অনুভব—যেখানে ভালোবাসা যত বাড়ে, তত তার চারপাশে তৈরি হয় এক অদৃশ্য দেয়াল, যেটা সুরক্ষার মতো, আবার ভয়েরও।

তারা এখন মাঝেমধ্যে দেখা করে। শান্তিনিকেতনে তৃষার ক্যাম্পাসে, বা সল্টলেকের কোনো ক্যাফেতে। তাদের সম্পর্ককে কেউ কিছুই বলতে পারে না। বন্ধুত্ব? প্রেম? না, কিছুই সোজা ভাষায় ফেলা যায় না। একদিন বিকেলে তৃষা তার হাতটা ঋষভর ওপর রাখে, বলে, “জানো, আমি অনেক কিছুকে ভয় পাই। ভবিষ্যৎ, সমাজ, আমার পরিবার… কিন্তু আমি তোমার এই হাতটাকে ভয় পাই না।” ঋষভ চুপ করে থাকে। সে জানে, একটা মেয়ের হাতে হাত রাখা মানে তার জীবনে একরকম প্রবেশাধিকার পাওয়া। কণ্ঠে যে মায়া ছিল, এখন সেই মায়া তার আঙুলের ফাঁক গলে শরীরের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। তৃষা বলে, “আমরা কি সত্যিই একে প্রেম বলব?” ঋষভ হেসে বলে, “আমরা তো কিছুই বলিনি এতদিন, শুধু অনুভব করেছি। যদি প্রেম বলে ফেলি, তাহলে হয়ত সেটা ব্যাখ্যা করতে হবে। আর ব্যাখ্যা শুরু হলে অনুভব হারিয়ে যায়।” তৃষা সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। সেই সন্ধ্যায়, গঙ্গার ধারে বসে, তারা প্রথমবার খুব ধীরে একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসে—যেখানে মুখের চেয়েও স্পষ্ট ছিল চোখের ভাষা।

তাদের এই সম্পর্কটা এখন রুটিন নয়, প্রয়োজনও নয়। এটা একধরনের আশ্রয়, যেটা তারা নিজেরা তৈরি করেছে। দিনশেষে, সবার সঙ্গে লড়াই করে ফেরার পর তারা দুজনেই জানে, একে অপরের কাছে গেলে কোনো ব্যাখ্যার দরকার পড়ে না। সেই ভুল নম্বর, যে কণ্ঠে একদিন অনিচ্ছায় ‘হ্যালো’ বলেছিল, আজ সেই কণ্ঠ করতলে এসে পৌঁছেছে—নিরাপদ, নরম, নিঃশব্দ। তৃষা একদিন ঋষভকে বলে, “জানো, তোমার পাশে বসে থাকলেও আমার ভয় করে… যদি এই মুহূর্তটাই শেষ হয়ে যায়?” ঋষভ তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে, “যে মুহূর্ত কণ্ঠ দিয়ে শুরু হয়েছিল, তা তো কখনো শেষ হয় না তৃষা। কণ্ঠ থেকে করতলে আসা এই পথটাই তো আমাদের ভালোবাসার প্রকৃত মানে।” সেই মুহূর্তে তারা চুপ করে থাকে, কোনো কথা না বলে—শুধু হাত ধরে বসে থাকে। আর সেই নীরবতাই বলে দেয়, কী গভীরভাবে তারা একে অপরকে বুঝে ফেলেছে।

অধ্যায় ১০: শেষ নামহীন বার্তাটি

বসন্ত প্রায় শেষের পথে। শান্তিনিকেতনে পলাশ ঝরে যাচ্ছে, আর কলকাতার গলির মোড়ে ফোটে কুর্চি। তৃষার কলেজের শেষ দিনগুলো। প্রোজেক্ট জমা, বিদায়বেলা, ভবিষ্যতের বিভ্রান্তি—সব মিলিয়ে ওর মধ্যে একরকম চাপা উত্তেজনা, আবার তীব্র উদ্বেগ। আর ঋষভর ক্ষেত্রেও বদল আসছে—ওর কোম্পানি তাকে ট্রান্সফার করতে চায় বেঙ্গালুরু। কিছুই স্থির নয়, কিছুই স্থায়ী নয়, কেবল স্থায়ী হয়ে রয়েছে—তৃষা আর ঋষভর সেই চেনা অভ্যেসটা: একে অপরকে শোনা, আর কোনো নাম না দিয়েও একে অপরের হয়ে থাকা। একদিন সন্ধ্যায় প্রিন্সেপ ঘাটে বসে তৃষা হঠাৎ বলল, “ধরে নাও, যদি আমরা কথা না বলি আর? যদি এমন হয়, কোনো একদিন তুমি এক শহরে, আমি অন্য শহরে, আর কণ্ঠ ছাড়াই আমাদের অনুভবগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়?” ঋষভ তাকিয়ে রইল মেয়েটার চোখে, যে চোখ অনেক কথা বলে ফেলে, অথচ সে চুপচাপ বলে, “তাহলে আমরা একে অপরের ভেতরে রয়ে যাব… ঠিক নামহীন বার্তার মতো।”

সেই রাতে তারা ফোনে দীর্ঘ সময় কথা বলল না। শুধু কিছুক্ষণ পর পর চুপচাপ শোনা—একটা নিঃশ্বাস, একটুখানি কাঁপা হাসি, হালকা কণ্ঠে “তুমি ঘুমাওনি এখনও?” আর এমন করেই ফোনটা কেটে গেল… কোনো বিদায় নয়, কোনো প্রতিশ্রুতি নয়। তার পরদিন থেকেই ছন্দটা যেন ভেঙে যেতে লাগল। তৃষা তার চাকরির কোচিং শুরু করে দিল, আর ঋষভর অফিসে প্রস্তুতি চলছিল বেঙ্গালুরু শিফট করার জন্য। ফোনের ফ্রিকোয়েন্সি কমে গেল, কথা কমে গেল, অথচ অনুভবটা থেকে গেল বুকের গভীরে। একদিন হঠাৎ করে, অনেকদিন বাদে, তৃষার একটা মেসেজ এল:
“তুমি নাম না জেনেও আমার হয়েছিলে। এখন যদি নামটা বলি—তৃষা সেন, তবু তুমি কি আমাকে আগের মতো ভালোবাসবে?”
ঋষভর চোখের সামনে তখন এক ঝলক আলো—তার পৃথিবীর সুর, যার কণ্ঠে সে ঘুমোতো, যার নিঃশব্দে সে বেঁচে থাকত, তার নাম এবার পরিচিত হয়ে উঠেছে।

ঋষভ সেই বার্তার জবাবে কোনো শব্দ লেখেনি। শুধু একটা ভয়ানক ব্যস্ত সকালে সে একটা ভয়েস নোট পাঠায়—
“আমি যদি একদিন হারিয়ে যাই… তখন কোনো কণ্ঠ খুঁজে পেলে, জানবে, আমি তাতেই রয়ে গেছি। তৃষা, আমাদের গল্পের সবচেয়ে সুন্দর দিকটাই ছিল—আমরা কোনোদিন নাম চাইনি। তাই আমি আজও তোমার অচেনা কণ্ঠ, আর তুমি আমার চেনা অনুভব।”

এটাই ছিল তাদের শেষ কথোপকথন।
না, তাদের ভালোবাসা শেষ হয়নি। তারা শুধু আলাদা হয়ে গেল—একজন সাউথ ইন্ডিয়ান শহরের কর্পোরেট ভিড়ে, আর একজন উত্তর কলকাতার কোনো লাইব্রেরিতে বসে চুপচাপ পড়তে থাকা মেয়ের মধ্যে। কিন্তু কোনো এক পূর্ণিমার রাতে, হঠাৎ করে কারো কানে বাজে একটিমাত্র সুর—একটা নামহীন, চেনা গলার “হ্যালো”…
আর কোনো এক অনন্ত সময় ধরে, সেই সুরই বেঁচে থাকে… কণ্ঠের থেকেও বেশি সত্য, নামের থেকেও বেশি আপন।

সমাপ্ত 

1000037625.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *