Bangla - তন্ত্র

অঘোরীর পাঁচ শিষ্য

Spread the love

দিব্যেন্দু হালদার


গ্রীষ্মের শেষ বিকেল। গঙ্গার একটি শাখানদী নীরবে বইছে বাংলার এক অজ পাড়াগাঁয়ের পাশ দিয়ে। চারদিক জুড়ে সোনালি আলো ছড়িয়ে পড়েছে, গাছের পাতায় হাওয়ার মৃদু সুর বাজছে, অথচ গ্রামের মানুষজনের মধ্যে এক অদ্ভুত কৌতূহল ছড়িয়ে পড়েছে। খবর এসেছে—বারাণসী থেকে এক অঘোরী সাধক হঠাৎ এ গ্রামে এসে উপস্থিত হয়েছে। কালো অর্ধফাটা চাদর জড়ানো দেহ, গায়ে চন্দনের বদলে শ্মশানের ছাই, লম্বা জটাজুট বাঁধা চুল, গলায় কপালের মালা আর হাতে একটিমাত্র খুলি। তাকে দেখে প্রথমে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ভয়ে কেঁপে উঠেছিল। গ্রামের কয়েকজন প্রবীণ বলল, “ওরা অঘোরী—শ্মশানই ওদের ঘর।” সত্যিই, সন্ধ্যা নামতেই তাকে দেখা গেল গ্রামসংলগ্ন শ্মশানঘাটে বসতে। একলা আগুন জ্বালিয়ে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করল, চোখ দুটি যেন জ্বলছে দীপশিখার মতো। অনেকেই দূর থেকে দাঁড়িয়ে চেয়ে রইল, কাছে যাওয়ার সাহস করল না কেউ। এমন অদ্ভুত দৃশ্য এ গ্রামে আগে কেউ কখনও দেখেনি। তবে ভয়ের মাঝেই কেমন একটা টান অনুভব করছিল অনেকে—যেন অচেনা সাধকের সঙ্গে গ্রামটার বহু পুরোনো সম্পর্ক আছে।

পরের দিন সকালে কয়েকজন সাহসী যুবক শ্মশানে গিয়ে দেখে, সে নদীর ধারে বসে ধ্যান করছে। চোখ বন্ধ, ঠোঁটে হালকা মন্ত্রগান, অথচ তার চারপাশে অদ্ভুত এক প্রশান্তির আবহ। আশ্চর্যজনকভাবে, নদীতে গত রাতের ঝড়েও যে নৌকোটা ভেসে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল, সেটা অঘোরীর ধ্যানে বসার পর ভেসে এসে শ্মশানের ধারে আটকে গেছে—নৌকোওয়ালা বলল, “এটা নিশ্চয়ই ওর আশীর্বাদ।” গ্রামের মহিলারা দূর থেকে তাকিয়ে বলল, “ও যদি সত্যিই বারাণসী থেকে আসা সাধক হয়, তাহলে আমাদের মঙ্গল করবে।” আবার অন্যরা আশঙ্কা প্রকাশ করল, “না না, এরা বিপজ্জনক—মানুষ খায়, রক্ত পান করে।” শিশুরা অঘোরীর ভয়াল দৃষ্টি এড়িয়ে চলতে লাগল, অথচ অদ্ভুতভাবে গৃহস্থ বাড়ির গরু-ছাগল, এমনকি কুকুরও তার পাশে গিয়ে শান্তভাবে বসে থাকত। যেন প্রকৃতি তাকে আপন করে নিয়েছে, শুধু মানুষই তাকে বুঝে উঠতে পারছে না। ধীরে ধীরে গ্রামের লোকেরা বুঝতে শুরু করল, সে কারও ক্ষতি করছে না, বরং নিঃশব্দে শ্মশানের ধারে বসে দিন কাটাচ্ছে। তবে তার উপস্থিতি গ্রামজুড়ে আলোচনার ঝড় তুলল—কে তিনি? কেন এসেছেন? কতদিন থাকবেন?

কিছুদিন যেতে না যেতেই গ্রামবাসীদের মনোভাব দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। কেউ কেউ বিশ্বাস করল অঘোরী অলৌকিক শক্তির অধিকারী—সে এলে খরা কেটে যাবে, অসুখ দূর হবে। তারা নৈবেদ্য নিয়ে শ্মশানে যেতে শুরু করল, তার পায়ে মাথা ঠেকাল। আবার অন্য অংশ ভয় আর ঘৃণায় তাকে এড়িয়ে চলল—তাদের ধারণা, অঘোরীর উপস্থিতিতে অশুভ শক্তি ডেকে আনবে, গ্রামে বিপদ ঘটবে। এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যেই দিন কেটে যাচ্ছিল। অঘোরী কিন্তু নির্বিকার। সে কখনো কারও দান গ্রহণ করল না, কারও গায়ে হাত রাখল না। শুধু রাতে অগ্নিকুণ্ড জ্বেলে বসত, কখনো গভীর গলায় মন্ত্র জপত, কখনো আবার নীরবে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত। তার চোখে এমন এক রহস্যময় আগুন জ্বলত, যা একদিকে ভয়ংকর, অন্যদিকে আকর্ষণীয়। গ্রামের লোকেরা ধীরে ধীরে বুঝতে পারল, এ সাধককে এড়িয়ে চলা সহজ নয়—সে এখন তাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠছে। হয়তো সে অভিশাপ, হয়তো আশীর্বাদ—কিন্তু নিঃসন্দেহে তার আগমনে গ্রামটার চিরচেনা ছন্দ ভেঙে গেছে, আর সামনে কী ঘটতে চলেছে, তা কেউই অনুমান করতে পারছে না।

গ্রামের চারপাশে অঘোরীর আগমন নিয়ে কৌতূহল ছড়িয়ে পড়ার পর একদিন সে পাঁচজন যুবককে নিজের শিষ্য হিসেবে চিহ্নিত করল। তারা গ্রামের সবচেয়ে সাহসী ও উদ্ভাবনী মনস্ক যুবকরা—কেউ চাষের কাজ করত, কেউ নদীর ধারে নৌকা চালাত, আবার কেউ তত্ত্ব-বুদ্ধির খেলায় মগ্ন থাকত। অঘোরী প্রথমে তাদেরকে একত্রিত করল, অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “তোমরা যদি প্রকৃত শক্তি চাও, তাহলে আমার পথ অনুসরণ করতে হবে। তবে মনে রেখো, পথটি সহজ নয়। রক্ত, ধৈর্য আর আত্মত্যাগ ছাড়া কেউ এগোতে পারবে না।” যুবকেরা অবাক, ভয় পেয়েও কৌতূহলে জ্বলছিল। অঘোরীর দীক্ষার শুরুতেই তাকে শ্মশানের পাশে একটি অগ্নিকুণ্ড বানাতে দেখা গেল। তিনি চারপাশে অগ্নি জ্বালিয়ে শিষ্যদের সামনে বসলেন, আর সেই আগুনের আলোয় তাদের মুখে ভয়ের সাথে কৌতূহলের মিশ্রণ ফুটে উঠল। প্রথমে সে তাদেরকে মৌনতার শিক্ষা দিল—কেননা প্রকৃত জ্ঞান চুপচাপ, নিঃশব্দে আসে। তারপর ধীরে ধীরে অঘোরী শিষ্যদের হাতে রুদ্রাক্ষ ধরা শুরু করল, চোখে অদ্ভুত দীপ্তি জ্বালিয়ে তাদের কাছে শ্মশানের গভীর রহস্য উন্মোচন করল।

প্রথম পর্যায়ের দীক্ষায় যুবকরা শিখল কিভাবে শ্মশানের অগ্নিকুণ্ডকে কেবল দহনের জন্য নয়, বরং শক্তি আহরণের জন্য ব্যবহার করা যায়। অঘোরী তাদের দেখাল কিভাবে আগুনের জ্বলন, ধোঁয়ার গতি, এবং ছাইয়ের রঙের মাধ্যমে প্রকৃতির শক্তি বোঝা যায়। প্রতিটি শিষ্যকে আলাদা আলাদা কাজ দেওয়া হল—একজনকে আগুনে হাত রাখার অনুশীলন, একজনকে ছাইয়ের মধ্যে হাত চালিয়ে অন্তর্জ্ঞানের খোঁজ, একজনকে রাতের নীরবতায় আত্মমনন। অঘোরী নিজে মন্ত্রপাঠ করত, আর শিষ্যরা তার শব্দের প্রতিধ্বনি অনুভব করত। তারা শিখল যে মন্ত্র কেবল উচ্চারণ নয়; তা হলো এমন এক শক্তি যা মানুষের আত্মাকে বদলাতে পারে। মাঝে মাঝে অঘোরী তাদের সামনে চ্যালেঞ্জ রাখত—একটি শিষ্যকে পুরো রাত জুড়ে শ্মশানের চারপাশে বসতে হতে, একটি শিষ্যকে অগ্নিকুণ্ডের ধোঁয়ায় নিঃশ্বাস নিতে হতে। ধীরে ধীরে তারা বুঝল, এ দীক্ষা শুধুমাত্র ভয় কাটানোর জন্য নয়, বরং মন, দেহ আর আত্মার সঙ্গতি স্থাপনের জন্য।

কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পাঁচ শিষ্যের মধ্যে দৃঢ় বন্ধন তৈরি হল। তারা শিখল অঘোরীর অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাতে, তার ইশারায় বুঝতে, কখনো কখনো শুধু অনুভব করতে। তারা ধীরে ধীরে শ্মশানের নীরবতায় কৃতজ্ঞতা জানাতে শিখল, মন্ত্রের শব্দে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করত। অঘোরী তাদের দেখাল কিভাবে রুদ্রাক্ষের প্রতিটি দানা শক্তি ধারণ করে, কিভাবে হাতের নড়াচড়া ও দৃষ্টিভঙ্গি মন্ত্রের কার্যকারিতা বাড়ায়। যুবকরা কখনও কখনও অগ্নিকুণ্ডের কাছে বসে রাত জুড়ে মন্ত্র জপ করত, কখনও কখনও ছাইয়ে হাত দিয়ে আভ্যন্তরীণ শক্তি অনুভব করত। তবে এই দীক্ষার পাশাপাশি একটি ভয়ংকর সতর্কতাও তাদের মনে জন্ম নিল—যে কেউ অঘোরীর নিয়ম ভঙ্গ করবে, সে শুধু শাস্তি পাবেই না, বরং তার আত্মা এমন অজানা শক্তির মধ্যে হারিয়ে যেতে পারে যা কেউ ফিরে আনতে পারবে না। পাঁচ শিষ্য অবশেষে বুঝল যে, তাদের দীক্ষা শুধু জ্ঞান অর্জনের জন্য নয়, বরং তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা—প্রকৃত শক্তি, ধৈর্য, এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ শিখতে। তাদের হৃদয়ে একটি অদ্ভুত উত্তেজনা ও ভয় একসাথে জাগল, যেমন অন্ধকার রাতে দূরে কোথাও বজ্রপাতের শব্দ শোনা যায়, কিন্তু একই সঙ্গে তার আলো অন্ধকারকে কেটে দিয়ে পথ দেখায়। এভাবেই অঘোরীর দীক্ষা শুরু হলো, পাঁচ শিষ্যকে অচেনা জ্ঞানের পথে পরিচালিত করে, যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত ছিল রহস্য, প্রতিটি শ্বাসে লুকানো ছিল শক্তি, আর প্রতিটি দীক্ষা ছিল একটি নতুন অগ্নিপরীক্ষা।

রাত্রি নামলেই গ্রামজুড়ে অদ্ভুত নীরবতা ছেয়ে পড়ত। নদীর জলে চাঁদের হালকা রোদ প্রতিফলিত হলেও শ্মশান ঘাটের দিকে মানুষ সাহস করে তাকাত না। সেই নির্জন শ্মশান এখন পাঁচ শিষ্যের সাধনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। অঘোরী তাদের নিয়ে বসত চিতার পাশে, আগুনের আলো চওড়া ছায়া ফেলে চারপাশে, আর তার মুখের প্রতিটি রেখা যেন অদৃশ্য ইতিহাসের গল্প বলে। শিষ্যরা প্রথম প্রথম ভয়ে কেঁপে উঠত—চিতার জ্বলন, ধোঁয়ার উড়ান, এবং অঘোরীর গভীর মন্ত্রোচ্চারণ তাদের মনকে অস্থির করে তুলত। তবে অঘোরীর ধৈর্য এবং তার দীক্ষার নিখুঁত নিয়মাবলী ধীরে ধীরে তাদের ভয়কে রূপান্তরিত করল কৌতূহলে। সে বলত, “যে কেউ মৃত্যুর সঙ্গে জীবনের সীমারেখা বুঝতে শিখবে, সে প্রকৃত শক্তি অনুধাবন করবে।” এরপর সে শিষ্যদের নির্দেশ দিত—চুপচাপ বসে শুধু আগুনকে, ধোঁয়াকে, এবং চারপাশের নিস্তব্ধতা অনুভব করতে। রাতের শীতল হাওয়া, আগুনের উষ্ণতা, এবং ধোঁয়ার অদ্ভুত গন্ধ মিলিয়ে এমন এক অভিজ্ঞতা তৈরি করেছিল যা শব্দে প্রকাশ করা কঠিন।

প্রতিটি রাত নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসত। অঘোরী তাদের শেখাত কিভাবে মন্ত্রের প্রতিটি উচ্চারণে শক্তি জাগ্রত হয়। কখনও তারা ধোঁয়ার মধ্যে হাত রেখে তা থেকে অন্তর্জ্ঞান আহরণ করতে শেখত, কখনও আগুনের জ্বলন থেকে আত্মার দৃঢ়তা বুঝত। ধীরে ধীরে শিষ্যরা বুঝতে পারল যে শ্মশান কেবল মৃতদেহের বিশ্রামক্ষেত্র নয়; এটি হলো এমন এক জায়গা যেখানে জীবিত এবং মৃতের মধ্যবর্তী সীমানা মুছে যায়। আগুনের নীরব নৃত্য, ধোঁয়ার অদ্ভুত দোলা, এবং অঘোরীর উচ্চারণ—সব মিলিয়ে যেন এক অদৃশ্য তন্ত্র তৈরি করে, যা শিষ্যদের মনকে তাদের সীমারেখার বাইরে নিয়ে যায়। মাঝে মাঝে অঘোরী এমন এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখাত যা শিষ্যদের হ্রদয়ে চরম আতঙ্ক ও বিস্ময় সৃষ্টি করত—একটি ছায়া হঠাৎ কুণ্ডের চারপাশে নাচতে শুরু করত, বা ধোঁয়ার মধ্যে অদৃশ্য মুখ ফুটে উঠত। এই অভিজ্ঞতাগুলি শুধু ভয় প্রদর্শন করত না, বরং তাদের মনে গভীর অন্তর্জ্ঞান জাগ্রত করত, শেখাত জীবন ও মৃত্যুর সত্যকে গ্রহণ করতে।

কয়েক সপ্তাহ কেটে গেলে, পাঁচ শিষ্য শ্মশানের নিয়মিত সাধনার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠল। তারা শিখল কিভাবে চারপাশের শক্তিকে অনুভব করতে হয়, কিভাবে নিজের অন্তরের অন্ধকারকে মন্ত্রের আলো দিয়ে আলো করতে হয়। অঘোরী তাদের জানাল, আসল সাধনা হল আত্মত্যাগ, ধৈর্য, এবং নির্ভীক মন—যেখানে প্রত্যেক শব্দ, প্রত্যেক স্পর্শ, প্রত্যেক নিশ্বাস মানে শক্তি। শিষ্যরা একে অপরের সাথে নীরব সমন্বয় করতে শিখল; আগুনের দাহ, ধোঁয়ার অদ্ভুত রূপ, এবং রাতের নীরবতা মিলিয়ে তারা এমন এক অবস্থা অনুভব করল যেখানে জীবন ও মৃত্যুর সীমানা অস্পষ্ট হয়ে গেছে। কখনও কখনও তাদের মনে হত, যেন মৃতদের ছায়া তাদের চারপাশে ভেসে বেড়াচ্ছে, আবার কখনও মনে হত, এই শক্তি তাদের অন্তরের ভিতর প্রবেশ করছে। প্রতিটি রাত্রি ছিল পরীক্ষার মতো, প্রতিটি মন্ত্র ছিল নতুন জ্ঞান অর্জনের চাবিকাঠি, আর শিষ্যরা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করল—এই শ্মশানের সাধনা শুধুমাত্র শক্তি অর্জনের জন্য নয়, বরং তাদের আত্মাকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যায় যেখানে জীবন, মৃত্যু, ভয়, এবং বোধ সব একত্রে মিলিত হয়। শিষ্যরা জানত, এই পথের শেষে অঘোরীর নির্দেশে যে সত্যের মুখোমুখি হতে হবে, তা সহজ নয়; তবে তাদের অন্তরে জন্ম নিল এক অদ্ভুত দৃঢ়তা—ভয় থাকলেও আকাঙ্ক্ষা এবং জ্ঞানের জন্য নির্ভীক সাহস।

ভোরের প্রথম আলো নরম সোনালি রঙে গ্রামের বাড়িগুলোকে আলিঙ্গন করছিল। পাখিরা গান গাইছিল, নদীর জল নীরবে বইছিল, আর গ্রামের মানুষজন তাদের দৈনন্দিন কাজে মগ্ন ছিল। কিন্তু শ্মশানের দিকে তাকালে দেখা যেত এক অদ্ভুত স্থবিরতা। অঘোরীর শিষ্যরা, যারা প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সাধনা করতে আসে, আজ সকালের ধ্যানের জন্য উপস্থিত হয়নি। প্রথমে কেউ বিশেষ খেয়াল করল না, মনে হল হয়তো তিনি রাতে ভোরবেলা কোনো কাজেই ব্যস্ত। কিন্তু যখন গ্রামের সাহসী যুবকরা শ্মশানে পৌঁছাল, তারা দেখল—প্রথম শিষ্য নেই। তার জায়গায় শুধু মাটি ও ছাইয়ের ওপর একটি কালি মাখা খুলি পড়ে আছে। খুলি–কালো, অদ্ভুত অণুতে মলিন, যেন হঠাৎই কোনো অদৃশ্য শক্তি এটিকে ছেড়ে গেছে। যুবকেরা অবাক, অস্থির এবং ভয়িত—কেউ কখনো এমন অদ্ভুত চিহ্ন দেখেনি। অঘোরীর চোখও ভোরের আলোয় রহস্যময় জ্বলছিল, আর সে চুপচাপ এক দিকে বসে ছিল। গ্রামের মানুষ খবর পেয়ে একে একে শ্মশানে আসতে শুরু করল। গুজব, শঙ্কা, এবং অদ্ভুত কৌতূহল এক সঙ্গে তাদের মনে জাগল—“কী হয়েছে, কেন তিনি অদৃশ্য?” কেউ বলল, “শিষ্য নাকি পালিয়ে গেছে!” আবার কেউ বলল, “এটা কোনো অভিশাপ—অঘোরীর পথ কঠিন, তাই কেউ উত্তীর্ণ হতে পারল না।”

অঘোরী কিন্তু নীরব। সে বলল না, না প্রতিরোধ করল, শুধু খুলি হাতে তুলে শিষ্যদের দিকে তাকাল। পরের কিছু ঘণ্টা গ্রামের মানুষজন ঘন্টার পর ঘন্টা শ্মশানে দাঁড়িয়ে রইল, যেন অদৃশ্যতার রহস্য তাদের চোখের সামনে খুলে যাবে। অন্য চার শিষ্য স্থবির হয়ে বসে ছিল, তাদের মনে অদ্ভুত আতঙ্ক। তাদের মধ্যে প্রথমেই ভয় বাড়ল—যদি তাদেরও এমন কিছু হয়? ধীরে ধীরে তারা বুঝল, অঘোরীর দীক্ষা শুধু ক্ষমতা দেয় না, বিপদও নিয়ে আসে। অগ্নিকুণ্ডের আগুনে মৃদু কেঁপে ওঠা বাতাসে যেন প্রথম শিষ্যের আধ্যাত্মিক শক্তি প্রতিধ্বনি করছে। গ্রামের প্রবীণরা বলল, “যদি অঘোরীর শক্তির পথে কেউ অপমান করে, তবে তার আত্মা অদৃশ্য হয়ে যায়।” ধীরে ধীরে, প্রতিটি মানুষ বুঝতে পারল, যে খুলি মাটিতে পড়ে আছে, তা শুধু শিষ্যের কোনো বস্তু নয়, বরং একটি চিহ্ন—একটি অদৃশ্য শক্তির উপস্থিতি এবং ক্ষমতার প্রমাণ। এ ঘটনা গ্রামের প্রতিটি দ্বারে দ্বারে ভয়ের হাওয়া ছড়িয়ে দিল, রাতে ঘুমও হয়তো অদ্ভুত আতঙ্কে বিঘ্নিত হবে।

দিন পার হতে হতে, গ্রামের মানুষজন অচেনা অনুভূতিতে কেঁপে উঠল। শিশুরা শ্মশানের কাছে যাওয়ার সাহসই পেল না, আর মহিলারা সূর্যাস্তের পরে রাস্তা পাড়ি দিতে ভয় পেল। অঘোরীর চারপাশে গোপন অদ্ভুত শক্তি ঘন হয়ে উঠল। অগ্নিকুণ্ডের ধোঁয়া, রুদ্রাক্ষের দীপ্তি, এবং মন্ত্রের প্রতিধ্বনি যেন আরও প্রখর হয়ে উঠল। বাকি চার শিষ্য নিজের ভয়ের সঙ্গে লড়াই করতে লাগল—কতটুকু তারা এই অদৃশ্যতার শক্তি ধারণ করতে পারবে, তা তারা বুঝতে পারছিল না। অঘোরী ধীরে ধীরে তাদের শেখাল, “যদি তুমি প্রকৃত জ্ঞান চাও, তবে ভয়কে গ্রহণ করতে হবে। প্রথম শিষ্যের অদৃশ্যতা একটি শিক্ষণীয় ঘটনা—এটি জানাচ্ছে, শক্তি কেবল দীক্ষা বা সাহস নয়, বরং আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং সম্যক বোধের ফল।” রাতের নীরবতা এবং শ্মশানের অদ্ভুত আলোতে তারা শিখল, ভয় এবং রহস্যের মধ্যে কতটা শক্তি লুকিয়ে আছে। গ্রামে সেই দিন থেকে এক অদ্ভুত উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। কেউ জানত না, প্রথম শিষ্য কোথায় গেছে, তবে তার অদৃশ্যতা এবং খুলি–মাখা চিহ্ন গ্রামের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে রইল।

রাত্রির নিস্তব্ধতা যখন পুরো গ্রামকে আচ্ছন্ন করেছিল, অঘোরী তার বাকি চার শিষ্যকে শ্মশানের অগ্নিকুণ্ডের চারপাশে বসতে বলল। আগুনের জ্বলন হালকা ধোঁয়া উত্থাপন করছিল, আর তার দীপ্তি চারপাশকে রহস্যময় অন্ধকারে মোড়াচ্ছিল। অঘোরী শান্ত স্বরে বলল, “তোমরা এখন সেই পথের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েছ যেখানে মৃত্যু এবং জীবন একে অপরের সঙ্গে মিলিত হয়। যে শিষ্য প্রকৃত সাধনা করতে চায়, সে মৃত্যুকে জয় করতে হবে—মন, দেহ, এবং আত্মার সমস্ত সীমা ভেঙে। এটি আর কোনো সাধারণ মন্ত্র নয়। এটি নিষিদ্ধ মন্ত্র, যা কেবল সঠিকভাবে, নিঃশব্দে এবং নিবিড় মনোযোগে উচ্চারণ করতে হবে।” শিষ্যরা প্রথমে অস্থির—ভয় ও উত্তেজনার মধ্যে সঙ্গমে—তবে অঘোরীর দৃষ্টিতে এক অদ্ভুত শক্তি ছিল যা তাদের ভয়কে কৌতূহলে রূপান্তরিত করল। সে তাদের শেখাল কিভাবে শব্দের প্রতিটি সুর, ছন্দ, এবং গতি আত্মার গভীরে ঢুকে জীবন-মৃত্যুর সীমানা স্পর্শ করে। “মন্ত্রটি শুধুমাত্র উচ্চারণ নয়,” সে বলল, “এটি এমন এক শক্তি যা তোমার অন্তরের অন্ধকারকে প্রকট করবে, ভয়কে পরাভূত করবে, আর প্রকৃত শক্তি জাগ্রত করবে।” শিষ্যরা গভীর মনোযোগে অগ্নিকুণ্ডের ধোঁয়া, রুদ্রাক্ষের শক্তি এবং অঘোরীর উচ্চারণের ছন্দকে অনুসরণ করল, যেন প্রতিটি শব্দ তাদের হৃদয়ে প্রবেশ করছে।

যতক্ষণ তারা মন্ত্রপাঠ করছিল, ততক্ষণ গ্রামের কিছু মানুষ দূরে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্যটি অবাক চোখে দেখছিল। একজন প্রবীণ বলল, “এ কি সত্যিই সাধনা, নাকি কালো তন্ত্র?” কেউ হেসে বলল, “এটা তো মৃত্যুর সঙ্গে খেলা—বিপদ ছাড়া নয়।” গ্রামের লোকদের মধ্যে ভয়, সন্দেহ, এবং কৌতূহলের এক অদ্ভুত মিশ্রণ তৈরি হল। অঘোরী জানত মানুষ এসব বলবে, কিন্তু সে বলল না, শুধু শিষ্যদের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল। মন্ত্রের শব্দ ছড়িয়ে পড়ছিল, আগুনের জ্বলন আরও তীব্র হয়ে উঠল, এবং ধোঁয়া চারপাশে ঘন অন্ধকারের সঙ্গে মিশে অদ্ভুত চিত্র তৈরি করল। শিষ্যরা অনুভব করল, তাদের শরীরের প্রতিটি কোষ যেন অদৃশ্য শক্তির সংস্পর্শে এসে উত্তেজিত হচ্ছে। কখনও কখনও ধোঁয়ার মধ্যে ছায়া নাচতে শুরু করত, যা তাদের ভীত করলেও একই সঙ্গে আত্মবিশ্বাস বাড়াত। তারা ধীরে ধীরে বুঝল, নিষিদ্ধ মন্ত্রের পাঠ কেবল সাহস বা দীক্ষার পরীক্ষা নয়—এটি আত্মার গভীর রহস্য উন্মোচনের পথ।

কিছুদিনের মধ্যেই, শিষ্যরা ধীরে ধীরে মন্ত্রপাঠে দক্ষ হয়ে উঠল। তারা জানত, প্রতিটি উচ্চারণে মৃত্যুকে সামলে জীবনকে শক্তিশালী করা সম্ভব। অঘোরী তাদের শেখাল, যে কেউ যদি নিয়ম ভঙ্গ করে বা মনোযোগ হারায়, তার আত্মা সেই শক্তির সঙ্গে মিশে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। গ্রামের মানুষজনের মধ্যে সন্দেহ এবং আতঙ্ক আরও বাড়ল। কেউ বলল, “এ কি সত্যিই দীক্ষা, নাকি কালো তন্ত্রের খেলা?” আবার কেউ বলল, “তাদের শরীর, চোখ, এবং মন বদলে যাচ্ছে—এটা স্বাভাবিক নয়।” শিষ্যরা নিজেরা অভ্যন্তরীণ সংঘাতের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল—ভয়, উত্তেজনা, এবং কৌতূহলের এক সঙ্গে মিলন। ধীরে ধীরে তারা বুঝল, যে অঘোরী তাদের পথ দেখাচ্ছে, তা সহজ নয়; তবে এই নিষিদ্ধ মন্ত্রের পাঠ তাদেরকে এমন এক জ্ঞানী ও শক্তিশালী অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে যা সাধারণ মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। শিষ্যরা শিখল, প্রকৃত সাধনা শুধু শক্তি নয়, বরং আত্মার গভীর রহস্যকে গ্রহণ করা, ভয়কে পরাভূত করা, এবং মৃত্যুর সীমানা অতিক্রম করার সাহস অর্জন করা। সেই রাত থেকে গ্রামের আকাশ, নদীর ধারা, এবং শ্মশানের অগ্নিকুণ্ড—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত উত্তেজনা ও রহস্যের আবহ তৈরি করল, যা শুধু শিষ্যরা নয়, পুরো গ্রামকে অনুভব করতে লাগল।

গ্রামের আকাশ অচেনা অন্ধকারে ঢেকে গেছে। রাতের নিস্তব্ধতা যেন আভ্যন্তরীণ আতঙ্ককে আরও তীব্র করে তুলছিল। শ্মশানের অগ্নিকুণ্ডে আগুন জ্বলছিল, ধোঁয়া ঘন হয়ে চারপাশে নীরব অন্ধকার ছড়িয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু সেই রাতে ঘটে গেল এমন ঘটনা যা পুরো গ্রামকে কাঁপিয়ে দিল। প্রথম শিষ্যের অদৃশ্যতার পর বাকি চারজন শিষ্য নিয়মিত সাধনা করছিলেন। রাতের গভীরে, দ্বিতীয় শিষ্য আরেকবার শ্মশানে বসার সময় হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল। কেবল মাটিতে ছাইয়ের মধ্যে এক অদ্ভুত রঙের দাগ আর খুলি পড়ে আছে। শিষ্যরা প্রথমে অবাক, কিছুটা আতঙ্কিত হলেও তারা জানত—এটি অঘোরীর দীক্ষার অঙ্গ। কিন্তু গ্রামের লোকেরা ভয় পেয়ে গেল। তারা ভাবতে লাগল, “এই সাধনা কি আসলেই মানবিক, নাকি কোনো অন্ধকার শক্তির খেলা?” ঘরোয়া আলোয় নেমে আসা ছায়ার মধ্যে গ্রামের প্রতিটি বাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ হয়ে গেল। রাতের নিশ্বাস কাঁপাচ্ছিল—শান্ত নদীর জলও যেন হঠাৎ থেমে গেছে।

পরের কয়েকদিনের মধ্যে, তৃতীয় শিষ্য নদীর ঘাটে নিখোঁজ হয়ে গেল। সকালে নদীর ধারে যুবকরা আরেকটি অদ্ভুত চিহ্ন দেখল—ছাইয়ের ধুলো এবং রক্তের মিশ্রণ। নদীর পানি যেখানে প্রথমে শান্ত ছিল, সেখানে হঠাৎ অদ্ভুত ঢেউ তৈরি হয়েছে, যেন অদৃশ্য শক্তি তার অস্তিত্ব প্রমাণ করছে। বাকি দুই শিষ্য স্থবির হয়ে রইল, তাদের চোখে ভয় এবং বিভ্রান্তি একসাথে জ্বলছিল। অঘোরী নীরবে তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “এ পথ সহজ নয়। যারা সাহসী, তারা অন্তর্ধানকে মেনে নেবে। যারা ভয় পায়, তার অন্তরের শক্তি কমে যাবে।” শিষ্যরা বুঝতে পারল, প্রতিটি অন্তর্ধান কেবল হঠাৎ ঘটনা নয়, বরং একটি পরীক্ষা—মৃত্যু এবং জীবন, অন্ধকার এবং আলো, শক্তি এবং ভয়—সবকিছুর সীমানা স্পর্শ করার পরীক্ষা। গ্রামের লোকেরা ভোরের আলোয় এসে নদীর তীরে দাঁড়িয়ে শুধু ছাই এবং রক্তের দাগ দেখত। রাতের পর রাত কেউ শান্ত ঘুমাতে পারত না। কেউ বলল, “অঘোরীর পথ কি সত্যিই সাধনার, নাকি এটি অশুভ শক্তির চক্রান্ত?” ভয় এবং কৌতূহল, বিশ্বাস এবং সন্দেহ—সব মিলিয়ে গ্রামের মধ্যে এক অদ্ভুত উত্তেজনা এবং ভয় জন্ম নিল।

একপর্যায়ে, বাকি দুই শিষ্য নিজস্ব ভয়ে কাঁপতে লাগল। শ্মশানের ধোঁয়া, আগুনের দাহ, এবং অঘোরীর গভীর দৃষ্টি তাদের মনে বারবার প্রশ্ন তুলত—কখন তাদেরও এমন ঘটনা ঘটতে পারে? অঘোরী তাদের বলল, “এটি একটি শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা। যারা প্রকৃত শক্তি চায়, তাকে মৃত্যুর সীমানা স্পর্শ করতে হবে, ভয়কে দমন করতে হবে। যাদের মন দুর্বল, তারা অন্তর্ধান হবে, যাদের মন দৃঢ়, তারা শক্তিশালী হবে।” রাতের নিস্তব্ধতায় শিষ্যরা অগ্নিকুণ্ডের চারপাশে বসে নিজেদের ভয় এবং বিশ্বাসের মধ্যে লড়াই করত। নদীর জল, শ্মশানের ধোঁয়া, এবং অগ্নিকুণ্ডের জ্বলন—সবই তাদের অভ্যন্তরীণ শক্তিকে পরীক্ষা করছিল। গ্রামের মানুষজন দূরে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখত, আতঙ্কিত, কিন্তু একই সঙ্গে কৌতূহলে। তারা বুঝতে পারল, অঘোরীর দীক্ষা সাধারণ সাধনা নয়; এটি এক অদ্ভুত শক্তির পরীক্ষার মঞ্চ। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিষ্যের অন্তর্ধান পুরো গ্রামের জীবনকে অচেনা করে তুলল, রাতের অন্ধকার এবং রহস্যকে আরও ঘনিষ্ঠ করে তুলল, এবং শিষ্যদের মনকে এমন এক অবস্থায় পৌঁছে দিল যেখানে ভয়, সাহস, এবং শক্তি একে অপরের সঙ্গে অদৃশ্যভাবে জড়িয়ে গেছে।

গ্রামের রাত একবার আরও ঘন অন্ধকারে ঢেকে গেল। নদীর জল নীরবে বইছিল, আর শ্মশানের অগ্নিকুণ্ড থেকে ধোঁয়া ঘন হয়ে চারপাশে অদ্ভুত ছায়ার খেলা খেলছিল। বাকি দুই শিষ্য, যারা আগের দুটি অন্তর্ধানের সাক্ষী, এবার আরও সতর্ক। তারা জানত যে সাধনার পথ সহজ নয়, কিন্তু চতুর্থ শিষ্য যে শ্মশানে তার পথ অনুসরণ করবে, তা কেউ ভাবেনি। অঘোরী নিঃশব্দে বসে তাদের দিকে তাকাল, চোখে এমন গভীর দৃষ্টি যে মনুষ্যিক শক্তি অনুভূত হতেই থমকে যায়। এক রাতে, গ্রামের কিছু সাহসী যুবক শ্মশানের দিকে নজর রাখছিল, হঠাৎ তারা দেখল চতুর্থ শিষ্য শ্মশানের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। তার দেহ সচল, কিন্তু চোখ ফাঁকা—জীবিত দেহে যেন মৃত আত্মা ভর করেছে। তার পদচারণা অদ্ভুত ধীর এবং ঘন ঘন থমকে থমকে চলছিল। ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে তার ছায়া নদীর জল, মাটির খণ্ডাংশ, এবং আগুনের আলোয় মিলেমিশে অদ্ভুত রূপ নিচ্ছিল। মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিল, সে শিষ্য নয়, বরং শ্মশানের অজানা এক অদ্ভুত শক্তির আয়না।

চতুর্থ শিষ্যকে এমন অবস্থায় দেখে বাকি দুই শিষ্য স্থবির হয়ে রইল। অঘোরী ধীরে ধীরে তাদের দিকে বলল, “এ হল সেই সময় যখন মৃত্যুর সীমানা স্পর্শ করা হয়। যে শিষ্য প্রকৃত সাহস এবং একাগ্র চেতনা রাখে, তার আত্মা শক্তিশালী হয়। যে শিষ্য ভয়ে আক্রান্ত হয়, সে অদৃশ্য হয়ে যায়।” চতুর্থ শিষ্য ধীরে ধীরে আগুনের চারপাশ দিয়ে ঘুরতে থাকল, তার চোখে কোনো জীবন নেই, শুধু একটি অদ্ভুত খালি দৃষ্টি। প্রতিটি পদক্ষেপে মাটির ওপর ছাই কেঁপে ওঠে, আগুনের শিখা তার উপস্থিতিতে অচেনা রঙে জ্বলতে লাগল। শিষ্যরা অনুভব করল, এই অভিজ্ঞতা শুধুমাত্র ভয় প্রদর্শন নয়—এটি তাদের অন্তরকে শক্তিশালী করার এক অদ্ভুত পরীক্ষা। ধীরে ধীরে, চতুর্থ শিষ্য অদৃশ্য হয়ে গেল, যেন রাতের অন্ধকার তাকে গিলে খেয়েছে। তার অন্তর্ধান বাকি দুই শিষ্য এবং গ্রামবাসীর মনে এক চিরস্থায়ী আতঙ্ক তৈরি করল।

গ্রামের মানুষজন রাতে আর ঘুমাতে পারত না। নদীর ধারে ঘুরে বেড়ানো বাকি দুই শিষ্য, শ্মশানের ধোঁয়া, এবং অগ্নিকুণ্ডের অদ্ভুত আলো—সবই যেন মৃত ও জীবিতের সীমারেখা ভেঙে দেয়। কেউ বলল, “শিষ্যরা হারিয়ে যাচ্ছে—এটি আর সাধনা নয়, কালো তন্ত্র।” আবার কেউ বলল, “অঘোরীর দীক্ষা কি আসলেই শক্তি দিচ্ছে, নাকি মৃত্যুর ছায়া আনে?” শিষ্যরা নিজেও আতঙ্কিত, তবে তাদের মধ্যে অদ্ভুত দৃঢ়তা জন্ম নিল—ভয় থাকলেও তারা বুঝতে পারল যে প্রকৃত শক্তি অর্জনের জন্য মৃত্যুর সীমানাকে মেনে নিতে হবে। অঘোরীর দীক্ষা শুধু শিষ্যদের শক্তিশালী করছিল না, বরং তাদের আত্মাকে এমন এক অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছিল যেখানে জীবন, মৃত্যু, ভয়, এবং সাহস একত্রে মিলিত হচ্ছিল। চতুর্থ শিষ্যের ছায়া গ্রামের রাতকে চিরস্থায়ী রহস্যে ঢেকে দিল, এবং বাকি দুই শিষ্য জানল—যে পথ তারা বেছে নিয়েছে, তার চূড়ান্ত পরীক্ষা এখন সময়ের অপেক্ষায়।

গ্রামের রাত আরও অন্ধকার এবং অচেনা হয়ে উঠেছিল। পঞ্চম শিষ্য, যে এতদিন নির্ভীক মনে হলেও অদৃশ্যতার আতঙ্ক তার মনকে অস্থির করে তুলেছিল, শেষবার মন্দিরের দিকে হেঁটেছিল। সে জানত, শ্মশানের রহস্য এবং অঘোরীর নিষিদ্ধ দীক্ষা শুধুমাত্র সাহসী শিষ্যদের জন্য, কিন্তু তার হৃদয়ে ভয়, দ্বিধা এবং তৃষ্ণা জেগে উঠেছিল। মন্দিরের শীতল বাতাসে সে দানপাত্রে হাত রাখল, গোপনে সাহায্যের জন্য প্রার্থনা করল। গ্রামের মানুষের চোখে সে এক ভয়ানক দৃশ্য হয়ে দাঁড়াল—এক তরুণ যুবক, যিনি এতদিন সাহস এবং প্রতিজ্ঞার প্রতীক ছিলেন, হঠাৎ শীতল এবং বিভ্রান্ত চোখে প্রার্থনা করছিল। অঘোরী নীরবে দূরে বসে দেখছিল, ধোঁয়া, আগুন এবং মন্ত্রের প্রতিধ্বনি চারপাশে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। পঞ্চম শিষ্য মনে করল, বাকি শিষ্যদের মতো, তাকে মৃত্যুর সীমানা অতিক্রম করতে হবে, কিন্তু তার ভয় তাকে জোর করল অন্য পথ বেছে নিতে। সে ভাবল, হয়তো মন্দিরের পবিত্রতা তার আত্মাকে বাঁচাতে পারবে। তবে রাতের নীরবতা, শ্মশানের অদ্ভুত শক্তি, এবং অঘোরীর দৃষ্টির চাপ তার মনে এক অদৃশ্য উত্তেজনা সৃষ্টি করল—যা তাকে ফিরে আসার পথ বন্ধ করে দিল।

পরের ভোরে, গ্রামের মানুষ শ্মশানের দিকে নজর রাখল। তাদের চোখের সামনে অদ্ভুত দৃশ্য উন্মোচন হল—পঞ্চম শিষ্য শ্মশানের মাঝখানে আগুনে দগ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। আগুনের শিখা উঁচু হয়ে উঠছিল, ধোঁয়া ঘন হয়ে চারপাশে ভয় ছড়াচ্ছিল। গ্রামের মানুষ হতভম্ব হয়ে দাঁড়াল, কেউ সাহস করে এগোতে পারল না। মনে হচ্ছিল, আগুন তার শারীরিক দেহকে ভস্ম করেছে, কিন্তু তার আত্মা আগুনের মধ্য দিয়ে মুক্তি পেয়েছে। শিষ্য নিজেকে উৎসর্গ করেছে—শ্মশানের ধোঁয়া, আগুনের শিখা, এবং ধুলোমাখা মাটির সঙ্গে মিলেমিশে যেন সে চিরস্থায়ী হয়ে গেছে। বাকি শিষ্যরা ভয় এবং হতাশায় স্থবির হয়ে রইল। তারা বুঝতে পারল যে, অঘোরীর দীক্ষা সহজ নয়, এবং প্রকৃত শক্তি অর্জনের জন্য আত্মত্যাগ একান্ত প্রয়োজন। এই ভয়াল পরিণতি গ্রামের মধ্যে একটি অদ্ভুত আতঙ্ক এবং রহস্য ছড়িয়ে দিল, যা কেউ সহজে ভুলতে পারবে না।

গ্রামের মানুষজন রাতের পর রাত ঘুমাতে পারল না। নদীর ধারে, শ্মশানের অগ্নিকুণ্ডের কাছে, এবং মন্দিরের চারপাশে প্রতিটি ছায়া, ধোঁয়া এবং শব্দ—সব মিলিয়ে ভয় ও রহস্যের এক চিরস্থায়ী আবহ তৈরি করল। অঘোরী নীরবে সব দেখছিল, তার দৃষ্টিতে এক অদ্ভুত শান্তি, যেন তার দীক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছে। বাকি চার শিষ্য, যারা এখনও জীবিত, তারা বুঝতে পারল যে সাহস, একাগ্রতা, এবং আত্মত্যাগ ছাড়া এই পথের শেষ নেই। পঞ্চম শিষ্যের পরিণতি তাদের মনে এক অমোঘ সতর্কতা এবং গভীর ভয় সৃষ্টি করল। গ্রামের আকাশ, নদীর জল, শ্মশানের ধোঁয়া—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত রহস্যময় চিত্র তৈরি করল। বাকি শিষ্যরা অবশেষে উপলব্ধি করল, অঘোরীর দীক্ষা শুধু শক্তি দেয় না, বরং তাদের আত্মাকে এমন এক উচ্চতায় পৌঁছে দেয় যেখানে জীবন, মৃত্যু, ভয়, এবং আত্মত্যাগ একসাথে মিলিত হয়। পঞ্চম শিষ্যের ভয়াল পরিণতি সেই গ্রামের ইতিহাসে চিরস্থায়ী হয়ে রইল—শ্মশানের ধোঁয়া আর আগুনে দগ্ধ চিহ্নের সঙ্গে, যা শুধু আতঙ্ক নয়, বরং এক গভীর শিক্ষা ও রহস্যের প্রতীক হয়ে থাকল।

শ্মশান এখন পুরোপুরি নীরব। পাঁচ শিষ্যের ভয়াল পরিণতি গ্রামে এক অদ্ভুত সুনীল-আভা ছড়িয়ে দিয়েছিল। নদীর তীরে হালকা কুয়াশা ভেসে বেড়াচ্ছিল, আর গ্রামের মানুষজন এখনো আগের রাতের আতঙ্ক ভুলতে পারছিল না। এমন সময়, হঠাৎ করে অঘোরী নিজেও উধাও হয়ে গেল। যিনি এতদিন শিষ্যদের দীক্ষা দিচ্ছিলেন, যিনি মৃত্যুর সীমা স্পর্শ করানো এবং অদ্ভুত শক্তি দেখানো পথে পথপ্রদর্শক ছিলেন, তার উপস্থিতি হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল। শ্মশানের মধ্যে শুধু তার কাঠের দণ্ড পড়ে আছে, চারপাশে ছাইয়ের স্তর, আর এক অদ্ভুত গন্ধ যা মানুষের নাকে প্রবেশ করলেই অচেনা এক আতঙ্ক এবং কৌতূহল জাগ্রত করছিল। গ্রামের মানুষজন হঠাৎ শ্মশানে সমবেত হল, কিন্তু তারা কিছুই বুঝতে পারল না। কেউ বলল, “অঘোরী কি আত্মার সঙ্গে মিলিত হয়ে গেছে?” কেউ বলল, “কেমন যেন অদ্ভুত শক্তি তার উপস্থিতি থেকে বেরিয়ে গেছে।” শ্মশান ধীরে ধীরে তাদের মনে এমন এক ভয় সৃষ্টি করল যা সহজে দূর হতে পারবে না।

ছায়ার মধ্যে, অঘোরীর দণ্ড যেন নিজের জীবন্ত শক্তিকে ধরে রাখছিল। ছাইয়ে অদ্ভুত রেখা এবং প্রতীক ফুটে উঠেছিল, যা দেখে মনে হচ্ছিল, অঘোরী তার শক্তি ছেড়ে গিয়েছে না, বরং এটি একটি নতুন রূপে প্রজ্বলিত হয়েছে। নদীর কুলের হাওয়া, আগুনের শেষ নিঃশ্বাস, এবং মাটির উপর ছড়িয়ে থাকা অদ্ভুত গন্ধ—সব মিলিয়ে গ্রামে এক রহস্যময়তা ছড়িয়ে দিয়েছিল। বাকি শিষ্যরা, যারা এখনও বেঁচে আছে, তাদের চোখে ভয় এবং বিস্ময় মিলিত ছিল। তারা বুঝতে পারল, অঘোরী না থাকলেও তার শক্তি এখনো শ্মশানে বিরাজ করছে। অগ্নিকুণ্ডের চারপাশে বসে তারা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করল, দীক্ষা শুধুমাত্র শিষ্যদের জন্য নয়, বরং অঘোরীর আত্মার এক চূড়ান্ত পরীক্ষা ছিল। গ্রামের মানুষজনও অদ্ভুতভাবে সচেতন হল যে, শ্মশান আর আগে মতো নীরব নয়; এটি এখন এক অদৃশ্য শক্তির ঘর, যেখানে মৃত্যুর এবং জীবনের সীমানা সবসময় ক্ষণস্থায়ী।

পরদিন থেকে, গ্রামের মানুষ অঘোরীর উপস্থিতি অনুভব করলেও তাকে আর দেখতে পায়নি। তার অন্তর্ধান এক অদ্ভুত শিক্ষার মতো—যেখানে শক্তি, রহস্য, এবং ভয় একত্রিত হয়ে স্থায়ী হয়ে যায়। নদীর ধারে, শ্মশানের ধোঁয়া এবং আগুনের স্থির চিহ্ন বাকি মানুষের মনে এক অমোঘ আতঙ্ক এবং কৌতূহল সৃষ্টি করল। বাকি চার শিষ্য ধীরে ধীরে নিজেদের ভয়কে মোকাবেলা করতে শিখল, কারণ তারা জানল, অঘোরীর দীক্ষা শুধুমাত্র শারীরিক উপস্থিতিতে নয়, বরং আত্মার গভীরে প্রবেশ করেছিল। অঘোরীর অন্তর্ধান পুরো গ্রামের ইতিহাসে এক রহস্যময় অধ্যায় হিসেবে চিরস্থায়ী হয়ে রইল। শ্মশান, নদী, এবং গ্রাম—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত শক্তির চিহ্ন বহন করল, যা শুধু আতঙ্ক নয়, বরং জীবনের, মৃত্যুর, সাহসের এবং আত্মত্যাগের গভীর শিক্ষা হয়ে রইল।

১০

গ্রামের রাত এখন এক চিরন্তন আতঙ্কের মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে। নদীর ধারে কুয়াশার আভা, ঝরঝরে বাতাস, এবং অদ্ভুত নীরবতা—সব মিলিয়ে যেন শ্মশানকে জীবন্ত করে তুলেছে। পূর্ণিমার রাতে, গ্রামের মানুষজন আজও শ্মশানের দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত আশঙ্কা অনুভব করে। তারা বলে, অঘোরীর দীক্ষিত পাঁচ শিষ্যের আত্মা সেই অগ্নিকুণ্ডের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। কখনও কখনও ধোঁয়ার মধ্যে তাদের ধূসর ছায়া দেখা যায়, কখনও শ্মশানের মাটি হালকা কেঁপে ওঠে, আর আগুন জ্বলতে শুরু করে হঠাৎ করেই। গ্রামবাসীর চোখে এই দৃশ্য এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি তৈরি করে—ভয়, কৌতূহল, আর এক অজানা আকর্ষণ। আগুনের শিখায় কখনও কখনও শিষ্যদের মুখরেখা ফুটে ওঠে, যেন তারা এখনো শ্মশানের নিয়মিত সাধনার পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ধোঁয়া, আগুন, এবং মৃত ও জীবিতের সীমানা—সব মিলিয়ে এই শ্মশান এক অভিশপ্ত স্থানের মতো।

রাতের নিস্তব্ধতা, নদীর শান্ত প্রবাহ, এবং মন্দিরের দূরের ঘণ্টাধ্বনি—সবই মিলিয়ে গ্রামের মানুষদের মনে এক চিরস্থায়ী আতঙ্ক জাগ্রত করে। কেউ সাহস করে শ্মশানের কাছে যায়, আবার কেউ ঘর বন্দী হয়ে রইল। আগুন জ্বলতে শুরু করলে, কান্নার শব্দ ভেসে আসে—যেন মৃত্যুর পরও শিষ্যরা তাদের ভয় এবং আশা প্রকাশ করছে। গ্রামের প্রবীণরা বলে, “এ শ্মশান আর আগের মতো নয়। এটি অভিশপ্ত। যারা এখানে পায়, তারা নিজেরাই অদৃশ্যতার সীমানায় পৌঁছে যায়।” শিশুদের ঘুমে দুষ্ট স্বপ্ন আসে, এবং মহিলারা সূর্যাস্তের পরে রাস্তা পাড়ি দিতে ভয় পায়। অঘোরীর উপস্থিতি না থাকলেও, তার শক্তি এবং দীক্ষার ছাপ শ্মশানে এত দৃঢ় যে, গ্রামের প্রতিটি মানুষ প্রায়শই অজানাতে শ্বাস থেমে যায়। গ্রামবাসীরা জানে, এই শ্মশান শুধু ভয় নয়, এক অদ্ভুত শিক্ষা, রহস্য, এবং মৃত্যুর সঙ্গে জীবনের মিলনস্থল।

কেউ জানে না, অঘোরী কখনো ফিরে আসবে কি না। তার অন্তর্ধান এবং পাঁচ শিষ্যের ভয়াল পরিণতি গ্রামে এমন এক রহস্যময় ও চিরন্তন আতঙ্ক তৈরি করেছে যা সহজে ম্লান হয় না। পূর্ণিমার রাতে, শ্মশানের আগুন জ্বলে ওঠে, ধোঁয়া নরম বাতাসে নাচে, আর শিষ্যদের ছায়া আকাশের সঙ্গে মিলেমিশে অদৃশ্য হয়ে যায়। গ্রামের মানুষজন জানে যে, তারা এখনো সেই দীক্ষার এবং শক্তির প্রভাবে আছেন—শিশু থেকে বৃদ্ধ, সবাই সেই রহস্যময় অভিশপ্ত শ্মশানকে মনে রাখে। নদী, শ্মশান, অগ্নিকুণ্ড, এবং অঘোরীর ছায়া—সব মিলিয়ে এই গ্রাম আর কখনো শান্ত হয়নি। এটি এক চিরন্তন অধ্যায়, যেখানে জীবন, মৃত্যু, ভয়, সাহস, এবং আত্মত্যাগ এক অদ্ভুত ছায়ায় মিলিত হয়েছে। শ্মশান শুধু অগ্নি আর ধোঁয়ার স্থান নয়, বরং মানুষের অন্তরের ভয়, কৌতূহল, এবং রহস্যময় আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা গ্রামবাসীর মনে চিরকাল অমোঘভাবে লেগে থাকবে।

সমাপ্ত

1000064481.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *