Bangla - তন্ত্র

অঘোরীর চোখ

Spread the love

শুভাশীষ পাল


 

                                     

পর্ব : পাহাড়ের গা থেকে যাত্রা

শিলিগুড়ি থেকে জিপ ছাড়ল সকাল আটটায়। ঋষভ জানালার ধারে বসে রেকর্ডারটা হাতে নিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে একটা লাইন বলল, “আজ আমরা যাচ্ছি দার্জিলিং জেলার গভীর এক গ্রামে, যেখানে এখনও লোকমুখে ভয়ের সুরে উচ্চারিত হয় এক অঘোরী তান্ত্রিকের নাম—ভৃগুনাথ।” শান পিছনের সিটে বসে ক্যামেরার ব্যাগ আঁকড়ে ধরেছিল। মাথায় হালকা ঠান্ডা, বাইরে কুয়াশা। সামনে বসে গাইড টেমবা চুপচাপ পাহাড়ি রাস্তা দেখে গাড়ি চালাচ্ছিল, তার চোখে ছিল একটা অদ্ভুত স্থিরতা, যেন সে জানে তারা কোথায় যাচ্ছে, কিন্তু চায় না তারা সেখানে পৌঁছাক।

চিলোংবস্তির নামটা প্রথম শোনা গিয়েছিল এক পুরোনো তান্ত্রিক পাণ্ডুলিপিতে, যেটা ঋষভ সংগ্রহ করেছিল কলকাতার এক পরিত্যক্ত লাইব্রেরি থেকে। সেখানে লেখা ছিল, “চিলোং—যেখানে সময় থেমে থাকে। যেখানে মৃত্যুর পরও আত্মা জেগে থাকে। যেখানে শরীর বদলে ফিরে আসে সাধক।” এই লাইনগুলোই তার ভিতরে একটা কৌতূহলের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এতদিনে বহু লোককথা নিয়ে কাজ করেছে ঋষভ, কিন্তু তন্ত্র নিয়ে কোনো কাজ হয়নি। আর এই গল্পটা ছিল অদ্ভুতভাবে “অন-দ্য-রেকর্ড” ও “অফ-দ্য-রেকর্ড”-এর মাঝখানে—কিছু সত্য, কিছু গুজব, কিছু গায়েবি ঘটনা।

টেমবা গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “চিলোং আর মাত্র এক ঘণ্টা। কিন্তু আপনি নিশ্চিত তো, মাফ করবেন—ওখানে রাত কাটানো ঠিক হবে?”
ঋষভ হেসে বলল, “ভয়ের কারণ কী টেমবা?”
টেমবা মুখ ঘুরিয়ে বলল, “ভয়ের নয়, সাবধানতার। ওই পাহাড়ে কিছু আছে, যা মানুষের চোখ বোঝে না।”

জিপটা থামল দুপুর একটা নাগাদ। গ্রাম বলা যায় না, কয়েকটা কাঠের ঘর, কিছু ছেঁড়া কংক্রিটের ভগ্নাবশেষ, আর একটা পুরোনো শ্মশান ঘাট। গ্রামের একটা প্রবেশপথের সামনে লাল কাপড় বাঁধা ছিল, তার মাঝে ছাই দিয়ে আঁকা এক চক্র—পঞ্চভূতের প্রতীক। টেমবা গাড়ি থেকে নামল না, শুধু বলল, “আমি এখানেই থাকছি। কিছু হলে গাড়ি বাজাতে বলবেন। দয়া করে সন্ধ্যার পর না বেরোনোই ভালো।”

ঋষভ আর শান ক্যামেরা, সাউন্ড, ট্রাইপড নিয়ে এগোল। প্রথমেই তারা গেল সেই পুরোনো বটগাছটার নিচে, যেটা গ্রামের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে, অনেকটা অঙ্গার হয়ে যাওয়া শরীরের মত। গাছের গায়ে কিছু খোদাই করা—প্রাচীন লিপিতে লেখা মন্ত্র। শান ফোকাস করছিল ক্যামেরায়, ঋষভ জুম করে দেখতে পেল, “অন্তর্জন্মঃ স্বাহা” শব্দটা তিনবার লেখা। তার নিচে একটা চোখ আঁকা, যার মণি ছিল আস্ত একটি নীল পাথর।

হঠাৎ একটা ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেল, এবং গাছটা যেন হালকা কেঁপে উঠল। শান পিছিয়ে এসে বলল, “ভাই, বাতাসে কেমন গন্ধ পাচ্ছিস? ধূপ নয়, কেমন একটা পোড়া মাংসের গন্ধ।”
ঋষভ চুপ করে ছিল। তার চোখ গাছটার পাশে এক জায়গায় আটকে গেছে—একটা ছোটো কাঠের বাক্স, অর্ধেক মাটির নিচে। সে এগিয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে বাক্সটা তোলে। খুলে দেখে, ভেতরে একটা কাঁচের শিশি, তার মধ্যে গাঢ় লাল তরল, আর একটা পাতলা পুরোনো পুঁথি, যার পাতাগুলো ছিঁড়ে যাওয়ার মত অবস্থা।

ঋষভ শিশিটার গায়ে চোখ রেখে বলল, “রক্ত না এটা, তেল… তান্ত্রিকেরা বিশেষ এক ধরণের তেল বানাত। মৃতদেহের মাথার খুলিতে, যেটা পরে ব্যবহার হত দিকবন্ধনের সময়।”
শান একটু পেছিয়ে এল, “তুই কেমন কথা বলছিস, এইসব নিয়ে ঘাঁটিস না রে।”
ঋষভ হাসল না, বরং বলল, “এগুলোই তো ইতিহাসের হারিয়ে যাওয়া দিক। আর জানিস, এই পুঁথিতে যদি সত্যিই ভৃগুনাথের সাধনার ধরন লেখা থাকে, তাহলে এটা তন্ত্রবিদ্যার এক অমূল্য দলিল।”

হঠাৎই, খুব সামান্য একটা শব্দ হল—চোখের পাশে কেউ যেন ফিসফিস করে বলল, “সতর্ক হ…”

ঋষভ কাঁপল, শান থমকে গেল। কেউ কোথাও ছিল না। কিন্তু বাতাস নিঃশব্দে ভারী হয়ে উঠল। সেই মুহূর্তে, পেছনের দিক থেকে একটা দীর্ঘ, কর্কশ শ্বাস টানার শব্দ এলো, যেন কেউ অনেকদিন পরে ফুসফুস ভরে বাঁচার জন্য নিঃশ্বাস নিচ্ছে। দুজনেই একসঙ্গে ঘুরে তাকাল, কিন্তু কিছুই দেখা গেল না। শুধু গাছটার গায়ে আঁকা সেই চোখটা হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, যেন নীল পাথরের ভিতর থেকে আলো ছড়াচ্ছে।

ঋষভ আর শান কোনো কথা না বলে দ্রুত ক্যামেরা, ব্যাগ তুলে গেস্টহাউসের দিকে ফিরতে শুরু করল। কিন্তু তারা জানত না—এই মুহূর্তে তাদের শরীর পেরিয়ে কেউ একজন ‘দেখছে’। তারা যে শুধু ইতিহাস ঘাঁটতে আসেনি, তারা নিজেরাই একটা পুরোনো সাধনার ভিতরে ঢুকে পড়েছে—একটা এমন সাধনা, যা এখনও শেষ হয়নি।

পর্ব : রক্ততেল রাত্রির চক্র

চিলোংবস্তির একমাত্র গেস্টহাউস বলতে যা বোঝায়, সেটা ছিল এক কাঠের ঘর—বহু পুরনো, দেয়ালে ছাঁচ, দরজায় মরিচা ধরা হুক। ঘরে ঢুকে শান সোজা ব্যাগ ফেলে বিছানায় বসে পড়ল, তারপর বলল, “আমরা আরেকটু ভেবেচিন্তে আসতে পারতাম, ঋষভ। তুই বুঝতে পারছিস তো, এটা আর শুধু ডকুমেন্টারি নয়। কিছু আছে এখানে।” ঋষভ তখন সেই পুঁথিটার পাতাগুলো খুলে টর্চের আলোয় পড়ে যাচ্ছিল। পাতাগুলো প্রাচীন সংস্কৃতে লেখা, কিন্তু কিছু কিছু শব্দ বাংলা আর নেপালি মিশ্রণে লেখা ছিল—যা বোঝায়, লোকমুখে এই সাধনার কথা চালু ছিল এখনও শতাব্দীর পরেও।

একটা পাতায় সে দেখতে পেল মন্ত্রের পাশে আঁকা এক চক্র। পাঁচটি বিন্দু, কেন্দ্রস্থলে এক চোখ। তার নিচে লেখা—নয়নবন্ধনে সূচনা, রক্ততেলে উদ্বোধন, চক্রে বসে আত্মা আটকে রাখা যায়। আর এক জায়গায় লেখা ছিল—অঘোরীর চোখে কেউ যদি চোখ রাখে, সে নিজেকে আর ফিরে পায় না।

বাইরে হাওয়ার শব্দ বাড়ছিল। পাহাড়ি হাওয়া হলেও কেমন যেন হাড়ের ভেতর ঢুকে গিয়ে কাঁপিয়ে দেয়। হঠাৎ বাইরে কুকুরের গলা ভেঙে চিৎকার — আর তারপর চুপ। এমন নিস্তব্ধতা যেন চারপাশ কানে তালা লাগিয়ে দিল। শান উঠে দরজার কাছে গেল, কিন্তু বাইরে শুধু কুয়াশা। আর কুয়াশার মধ্যে কেমন যেন নড়াচড়া। সে আবার বিছানায় ফিরে এসে বলল, “তুই কিছু শোনছিস না?” ঋষভ তখন পুঁথির এক পৃষ্ঠা থেকে শিশিটা হাতে নিচ্ছিল। শিশির রঙ লালচে, কিন্তু আলোতে সে লক্ষ্য করল, তেলের ভেতর কিছু ভাসছে। খুব ছোট, সূক্ষ্ম—মাথার চুল, কিংবা নখ। কাঁধটা হঠাৎ হিম হয়ে গেল তার।

“এটা তো সাধারণ তেল নয়,” ঋষভ ফিসফিস করে বলল, “এটা মনে হচ্ছে নয়নবদ্ধ তেল—যেটা চোখের উপর ব্যবহার করে কেউ কাউকে দর্শনের বাইরে সরিয়ে রাখতে পারে। এই তেলে মৃতের সত্ত্বা আটকে রাখা হয়।”

শান বলল, “মানে তুই বলতে চাইছিস এই শিশিতে একটা আত্মা আছে?”
ঋষভ উত্তর দিল না। সে শুধু শিশিটা খাটের এক কোণে রেখে পুঁথি খুলেই বলল, “তুই কিছুতেই এই শিশির ঢাকনা খুলিস না। কোনোভাবেই না। আমরা কাল সকালে পুরোনো শ্মশানে যাব। আর আমি ধারণা করছি, ওই বটগাছটাই ছিল মূল চক্রস্থল। রক্ততেল, চোখ, মন্ত্র—সব কিছু ওই গাছ ঘিরে আবর্তিত।”

রাতটা ঘুমের নামে কাটল না। চারদিকে হাওয়া বইছিল, মাঝে মাঝে যেন কারা হাঁটছে ছাদে, কখনও জানালার গরাদ ধরে কারা যেন দেখছে। মাঝরাতে ঋষভের ঘুম ভাঙল একটা স্বপ্নে—সে দেখল একটা বিশাল বৃত্ত আঁকা মাটিতে, আগুন জ্বলছে পাঁচ কোণে, মাঝখানে বসে আছে এক কঙ্কালসার সন্ন্যাসী। তার চোখ নেই, কিন্তু মুখে হাসি। আর সে বলছে, “আমার চোখের ভিতর কি তুই তাকাতে চাস, ঋষভ?” ঘুম ভেঙে ঋষভ উঠে বসল, শরীর ঘামে ভিজে। পাশে তাকিয়ে দেখে—শিশিটা নিজের জায়গায় নেই।

সে চিৎকার করল, “শান! তুই শিশিটা সরিয়েছিস?”
শান পাশের বিছানা থেকে উঠে বলল, “না রে! আমি কিছু ছুঁইনি। তবে আমি কিছুক্ষণ আগে দেখলাম, জানালার পাশে ছায়া পড়েছিল… মানুষের মতো না… মাথা ছিল না…”
ঋষভ তড়িঘড়ি করে শিশি খুঁজতে শুরু করল। অবশেষে, দরজার ঠিক সামনে, শিশিটা পাওয়া গেল—খোলা, ঢাকনা পড়ে আছে আলনায়। তেলের গন্ধ চারপাশে ছড়িয়ে গেছে, হালকা ধূপ আর পোড়া হাড্ডির গন্ধের মত। তখনই ঘরের এক কোণে অন্ধকার জমাট বাঁধতে শুরু করল। যেন কেউ এসে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু আলোয় ধরা দেয় না।

দুজনেই পিছিয়ে গিয়ে ক্যামেরা বের করল। ক্যামেরায় ইনফ্রারেড মোড চালু করতেই স্ক্রিনে দেখা গেল—একটা ধুতি পরা মানুষের অবয়ব, মাথা নিচু, হাতে একটা পুরোনো শঙ্খ। হঠাৎই সে ক্যামেরার দিকে তাকাল, আর স্ক্রিনে কেবল চোখ। বিশাল, কালো, আগুনের মত জ্বলছে।

স্ক্রিনটা ঝাঁপসা হয়ে গেল, ব্যাটারি অফ। দরজা নিজে থেকেই খুলে গেল, বাইরে ঠান্ডা হাওয়া। আর সেই হাওয়ার সঙ্গে যেন শোনা গেল একটি ফিসফিস কণ্ঠ, খুব কাছ থেকে—
এখন চক্র সম্পূর্ণ হবে। তুই ডাকেছিস আমাকে। এখন দেখবি, চোখ কেমন জিনিস।

ঘরের মেঝেতে একটা অদৃশ্য রেখা আঁকা হয়ে গেল তেলের ছিটায়। চক্র তৈরি হতে থাকল আবার, এবার ঘরের ভিতর। পাঁচ কোণে লাল দাগ, ঠিক যেখানে শিশির ছিটে পড়েছে। আর কেন্দ্রস্থলে—একজোড়া চোখ, খোলা, জেগে আছে। সেই চোখ দুটো কার, সেটা বোঝার আগেই হঠাৎ দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল, বাইরের আলো নিভে গেল, আর ঘরটা ডুবে গেল সেই অঘোর আঁধারে।

পর্ব : অঘোর চক্রের ভিতর

ঘরটা যেন আর ঘর নেই, বরং এক চক্রের গর্ভে দাঁড়িয়ে আছে তারা—ঋষভ আর শান। চারদিকে অন্ধকার এতটাই ঘন যে, হাতের সামনে হাত দেখা যায় না। অথচ তারা অনুভব করতে পারছিল—চার কোণে কিছু জ্বলছে, আলোর নয়, বরং অস্তিত্বের আগুন, যা চোখে দেখা না গেলেও শরীর গরম করে, মনের ভিতর ভয় ঢুকিয়ে দেয়। মেঝের উপর আঁকা পাঁচটি বিন্দু, আর মাঝখানে সেই চোখদুটি, তেল ছিটিয়ে গড়া এক রক্তচক্রের কেন্দ্রবিন্দুতে। হঠাৎ সেই চোখদুটি যেন নড়ল, ওপরে তাকাল।

শান চাপা গলায় কাঁপতে কাঁপতে বলল, “ঋষভ… ওইটা… ওই চোখদুটি আমাদের দেখছে। ওগুলো জীবিত, আমি শপথ করে বলছি।”
ঋষভ জবাব দিল না। ওর মন আর শরীর যেন আটকে আছে কোথাও—চক্রের টান, পুরনো মন্ত্রের ডাকে সাড়া দেওয়া মস্তিষ্ক, বা তেল স্পর্শ করা আত্মার কম্পনে আটকে গেছে। হঠাৎ একটা কণ্ঠ ভেসে এল—কোনো মুখ নেই, তবুও শব্দ আছে।
“চক্র ভাঙা যায় না… যে একবার ডাক দিয়েছে, সে দায় নিয়েছে…”

ঘরের বাতাস ভারী হয়ে এল। খোলা জানালাগুলো আবার নিজে নিজে বন্ধ হয়ে গেল। আর মেঝেতে সেই চক্রের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা অবয়ব, এবার স্পষ্ট দেখা গেল—চামড়াহীন মুখ, পাথরের মত চোখ, কাঁধজুড়ে ছাই। গলায় গাঁদা ফুলের মালা, অথচ তা শুকনো নয়, টাটকা, যেন কেউ সদ্য পরিয়েছে। তার কণ্ঠে ঘন আওয়াজ, “আমি এসেছি… ডাক পড়েছিল… এখন ত্যাগ চাই।”

ঋষভ এক ঝটকায় সেই পুঁথি তুলে নিল টেবিল থেকে। পাতা ওলটাতে ওর চোখ আটকে গেল এক জায়গায়—“যদি চক্র জাগ্রত হয় ভুল সময়ে, তবে তাকে স্থগিত করা যায় চোখ ঢেকে, পাঁচ কপালে ছাই মেখে, আর নাম উচ্চারণ করে যার নামে চক্র বাঁধা… যদি জানা থাকে।”

ঋষভ হোঁচট খেয়ে বলল, “ভৃগুনাথ… নামটা… ভৃগুনাথ অঘোরী… আমি জানি, আমি জানি!”
অবয়বটি তখন চক্রের এক কোণে পা রাখল। আগুন জ্বলে উঠল মেঝেতে। দ্বিতীয় কোণে পা রাখতেই ঘর কেঁপে উঠল। শান ক্যামেরার ব্যাগ থেকে ইনফ্রারেড টর্চ বের করে আলো ফেলল—অবয়বটির চোখ ছিল শুধু আলোতে স্পষ্ট, দগদগে লাল।

ঋষভ কাঁপা কাঁপা গলায় উচ্চারণ করল, “ভৃগুনাথ অঘোরী… আমি জানি তুমি কে! আমি জানি কী করেছ তুমি চিলোংবস্তির বুকে। শ্মশানে মৃতদেহ কেটে বানিয়েছ রক্ততেল। পাঁজর দিয়ে চক্র এঁকেছ। আমি জানি!”
কিন্তু সেই কণ্ঠ থেমে গেল না। “জানা মানেই মুক্তি না… জানা মানেই শিকল আরও টানবে… তুই ডাক দিয়েছিস, এখন ফিরে পাবি না কিছু।”

মাঠি থেকে উঠে আসছিল বুদবুদ আওয়াজ—ঘরের এক কোণে মেঝে ফেটে গেছে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসছে ঘন ছাই। ছাইয়ের ভেতর কিছু নড়ছে—হাড়, দাঁত, আর চোখ। শান হঠাৎ তীব্র চিৎকার করল, “ঋষভ! ছাই থেকে হাত বেরোচ্ছে!”

সেই মুহূর্তে, একটি শাদা মূর্তি ছায়ার মতো জানালার বাইরে এসে দাঁড়াল। মহিলা, মাথায় সাদা কাপড়, মুখ ঢাকা। কাঁধে লাঠি, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। সে ইঙ্গিত করল, “বেরো, এখনই… না হলে সময় পেরিয়ে যাবে।” শান দরজা খুলে দৌড় দিল, ঋষভ তার পেছনে। কিন্তু দরজা যেন হঠাৎ এক অতল গহ্বরে খুলে গেল। তারা পড়ে যাচ্ছিল—দাঁড়িয়ে থাকার জায়গা নেই, শুধু এক অদৃশ্য স্তরে স্তরে নিচে নামা।

হঠাৎই তারা গিয়ে পড়ল এক বৃত্তের মাঝে। চারপাশে আগুনের রেখা, মাঝখানে পুরনো চিতার কাঠ, পচা চন্দন, ছাই। তারা বুঝল—এটা চিলোংবস্তির পুরনো শ্মশান। দিনের আলো কোথায়, কিছু বোঝা যায় না। সেই মহিলাটি তখন সামনের দিক থেকে ধীরে এগিয়ে এল। এবার তার মুখ দেখা গেল—কঠিন চোখ, মুখে গভীর বলিরেখা, কিন্তু দৃঢ়তা অটুট।

“আমার নাম প্রজ্ঞা। আমি ছিলাম ভৃগুনাথের শেষ শিষ্যা। তার মৃত্যুর সময় আমি পালিয়েছিলাম। কিন্তু সাধনা থেমে যায়নি। তার আত্মা আটকে আছে… এই চক্রে, এই চক্রই তার দরজা। তোমরা শিশি খুলেছো, চোখে তাকিয়েছো, এখন সেই দরজা খুলে গেছে।”

ঋষভ বলল, “তবে কি আর কোনও পথ নেই?”
প্রজ্ঞা বলল, “পথ আছে। কিন্তু সে পথ আত্মা দিয়ে বন্ধ করতে হয়। কেউ যদি তার নিজের ইচ্ছায় চোখ বন্ধ করে, চক্রের কেন্দ্রে দাঁড়ায়, আর মন্ত্র উচ্চারণ করে, তবে চক্র ঘুমিয়ে পড়ে… কিন্তু তার বদলে সে আর ফিরতে পারে না।”

শান কাঁপা গলায় বলল, “মানে একজনকে আত্মাহুতি দিতে হবে?”
প্রজ্ঞা মাথা হেঁট করে বলল, “হ্যাঁ। আর সেই আত্মা হতে হবে—যে চোখ দেখেছে, রক্ততেল ছুঁয়েছে, ডাক পাঠিয়েছে।”

ঋষভ বোঝে সে নিজেই সেই মানুষ। তার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। আগুন ধীরে ধীরে নেভে, কিন্তু তার ভিতরটা জ্বলতে থাকে এক নতুন চক্রে প্রবেশের প্রস্তুতিতে।

পর্ব : প্রত্যাহ্বান

আকাশ ছিল স্তব্ধ, পাখি ছিল না, গাছের পাতা নড়ছিল না, যেন গোটা গ্রহ চুপ করে আছে এক সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। চিলোংবস্তির পুরনো শ্মশান, এখন রক্তচক্রের কেন্দ্র। আগুন নিভে গেছে, কিন্তু ছাইয়ের নিচে এখনও যেন কারা নিঃশ্বাস নিচ্ছে—ধীরে, গভীরে। প্রজ্ঞা শ্মশানের মাটিতে ছাই ছড়িয়ে এক নতুন চক্র আঁকছিল, ফিসফিস করে মন্ত্র পড়ছিল এক ভিন্ন কণ্ঠে, যেন তার নিজের কণ্ঠ নয়, কেউ তার ভেতর দিয়ে বলছে। চক্র আঁকা শেষ হলে সে ঋষভের দিকে তাকিয়ে বলল, “ভেতরে প্রবেশ করতে হবে একাই। চক্রের কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে, তেল-মাখা চোখের সামনে বসে, নাম ধরে ডাক দিতে হবে… কিন্তু সতর্ক থাকো, ভৃগুনাথ শুধুই আত্মা নয়, সে এখন চক্রের ভিতরকার এক সত্তা—সময়, স্থান, সত্তা, ইচ্ছা সবকিছুর উর্দ্ধে।”

ঋষভ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমি যাব। কারণ আমিই ওকে ডেকেছি, আমিই শিশি খুলেছি। শান, তুই এখানেই থাক।”
শান চিৎকার করে বলল, “পাগল হয়েছিস? আমি তোকে একা যেতে দিতে পারি না!”
প্রজ্ঞা ধীরে মাথা নাড়ল, “যে ভিতরে প্রবেশ করবে, তাকে একা যেতে হবে। কেউ যদি তার সঙ্গে যায়, তাহলে চক্র একাধিক আত্মা টেনে নেয়। ওর দরজা একটাই।”

ঋষভ চক্রে পা রাখল। পায়ের নিচে ছাই মিশে গেল মাটিতে। শরীর হালকা হয়ে এলো, যেন মাটি ওকে আর টানছে না। চক্রের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে সে মাটির দিকে তাকাল। তেলের শিশির মুখ ঘোরানো চোখ, আগুনজ্বলন্ত চিহ্ন যেন কাঁপছে। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর ধীরে ধীরে বলল, “ভৃগুনাথ অঘোরী! আমি ঋষভ রায়, ইতিহাসের ছাত্র, সাধনার শ্রোতা, তোর ডাক শুনেছি… তোকে জাগিয়েছি… এখন আমি তোকে ফিরিয়ে নিতে এসেছি!”

এক মুহূর্তের নিস্তব্ধতার পরে বাতাস কেঁপে উঠল। ছাই হাওয়ায় ঘুরে ঘুরে উড়তে লাগল। আকাশ রঙ বদলাতে লাগল—কালো থেকে লাল, লাল থেকে ছাইসাদা। হঠাৎ শ্মশানের মাঝে পাথরের এক বেদি দেখা গেল, যেটা এতক্ষণ ছিল না। বেদির উপর বসে আছে এক লোক—রক্তরঙ ধুতি, গায়ের চামড়া ছেঁড়া, শরীরে ভস্ম আর কাঠির আঁচড়। তার চোখ বন্ধ, কপালে আঁকা একটি ত্রিকোণ, তার মাঝখানে একটি খোলা চোখ—তৃতীয় নয়ন, কিন্তু সেটা নড়ছে। চোখের পাতা ওঠে, নিচে পড়ে, কিন্তু সে দেখে না বাইরের কিছু, বরং ভিতর থেকে সব দেখতে পায়।

“তুই ডাকেছিস আমাকে?” তার কণ্ঠে নেই কোনো জোর, কিন্তু শব্দটা যেন মাটির ভেতর থেকেও প্রতিধ্বনি হয়ে আসে।
ঋষভ কিছু না বলে পুঁথির মন্ত্র উচ্চারণ শুরু করল—
নয়নং ক্লীং ভৃগুনাথায় নমঃ। অন্তর্জন্ম বন্ধ ন্যায়ায় স্বাহা।

ভৃগুনাথ হেসে উঠল, “এই মন্ত্র তুই কোথায় পেয়েছিস?”
“তোর নিজের পুঁথিতে,” ঋষভ বলল, “তুই রেখে গিয়েছিলি ভবিষ্যতের জন্য। কিন্তু ভবিষ্যতের কেউ তোকে বন্দি করতে এসেছে, মুক্ত করতে নয়।”

ভৃগুনাথ তখন দাঁড়িয়ে উঠল। তার ছায়া বাড়তে লাগল, যেন পুরো শ্মশান ঢেকে দিল। তার কণ্ঠ গর্জে উঠল, “আমি মরণজয়ী। আমি চক্র বাঁধি, আমি আত্মা ভক্ষণ করি, আমি শ্মশানে জন্মাই, আর মৃতের শরীরে ফিরে আসি। তুই আমাকে থামাতে এসেছিস? তুই কি জানিস আমি কে?”

ঋষভ চিৎকার করে বলল, “তুই সময় পার করে বেঁচে থাকা এক অভিশাপ, তুই নিজের লালসার জন্য মৃতদেহ ব্যবহার করিস, তুই তন্ত্র নয়, তুই এক অভিশপ্ত ব্যভিচার!”

ভৃগুনাথ চিৎকার করে উঠল, তখনই চারপাশে আগুন জ্বলে উঠল। তার দেহ থেকে ছাই ও রক্ত মিশ্রিত তরল ছিটকে পড়ল চক্রের বাইরে। চক্র নড়তে লাগল। এক অদ্ভুত চিৎকার শোনা গেল, যেন হাজারো কণ্ঠ একসঙ্গে বলছে, “তাকে দাও… তাকে দাও… সে ডাক দিয়েছিল… সে ফিরতে পারবে না।”

ঋষভ দাঁড়িয়ে রইল স্থির। সে চোখ বন্ধ করল। মনে মনে বলল, “যদি এই চক্র থামে, তবে আমি হারাতেও রাজি।”
সে আবার উচ্চারণ করল, তিনবার—
নয়নং ক্লীং ভৃগুনাথায় নমঃ। অন্তর্জন্ম বন্ধ ন্যায়ায় স্বাহা।

ভৃগুনাথ এক পা এগোল, চোখজোড়া আগুন হয়ে গেল। ঠিক তখনই, পেছনে এক নারী কণ্ঠ—প্রজ্ঞা। সে বলল, “ঋষভ, এবার তুই দেখতে পাবি নিজেকে। আত্মা যদি সত্য, তবে তুই পারবি।”

আর সেই মুহূর্তে, চোখজোড়া হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটাল। সব আলো, শব্দ, আগুন, ছাই মিলেমিশে এক নীল কুয়াশা হয়ে চারপাশ ঢেকে দিল। চক্র ভেঙে পড়ল। ভৃগুনাথ মাটিতে গলে যেতে লাগল, মুখ থেকে শুধু একটি শব্দ—
চক্র আবার বাঁধা হবেঅন্য এক চোখেঅন্য এক ডাকে…”

ঋষভ চোখ মেলে তাকাল। চারপাশে কিছু নেই। শ্মশান মুছে গেছে। কেবল একটি ধূপের গন্ধ, আর পায়ে ছাইয়ের গরম ছোঁয়া।

পর্ব : নতুন চোখ

প্রথমে আলো ফিরল। আকাশে ছিল হালকা নীল আভা, কুয়াশা সরতে লাগল ধীরে ধীরে। পাখির ডাক শোনা গেল দূরে, যেন কোনও স্বপ্নের প্রান্ত থেকে ফিরে এসেছে সকালের বাস্তবতা। ঋষভ চোখ খুলে দেখল সে শুয়ে আছে গাছতলায়, মাথার নিচে একটা পুরনো কাপড়। শানের মুখটা কুয়াশার ফাঁক দিয়ে আস্তে আস্তে স্পষ্ট হচ্ছিল—তার চোখ বিস্ময়ে ভরা, ঠোঁটে অবিশ্বাস। প্রজ্ঞা একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, এক হাতে ধরা রুদ্রাক্ষের মালা, আর অন্য হাতে গোরজলের পাতিল।

“তুই ফিরেছিস,” শান বলল, গলার স্বর কাঁপছিল, “তুই ফিরেছিস রে, আমি ভাবছিলাম শেষ।”

ঋষভ উঠে বসল। মাথাটা ভারী লাগছিল, মেরুদণ্ডে যেন একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। সে চারপাশে তাকাল—শ্মশান মুছে গেছে, আগুনের চিহ্ন নেই, পুঁথির পাতাগুলো ছড়িয়ে রয়েছে, কিন্তু রক্ততেল শিশি উধাও।

“আমি কোথায় ছিলাম?” তার কণ্ঠে ক্লান্তি ছিল, কিন্তু চোখে ছিল অন্য কিছু—একটা স্পষ্ট পরিবর্তন।

প্রজ্ঞা ধীরে এসে বলল, “তুই ছিলি চোখের ভিতর। ভৃগুনাথের চোখ শুধু দেখা যায় না, ওটা এক দরজা। তুই তোর আত্মাকে নিয়ে গিয়েছিলি সেই দরজার ওপারে… কিন্তু ফিরেছিস। এই ফিরে আসা সাধারণ নয়। কেউ ফিরে আসে না।”

ঋষভ ধীরে মাথা নাড়ল। তারপর ফিসফিস করে বলল, “আমি ওর ভিতরে গিয়েছিলাম… একটা অন্ধকার গুহা… শরীর ছাড়া… শুধু চক্র, ঘূর্ণি, আগুন, ছায়া… এবং একটা বাচ্চা ছেলে—যে কাঁদছিল… জানিস, আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি ও কে… পরে বুঝলাম, ও আমি।”

শান বলল, “তুই কি বলছিস ঋষভ?”
“আমি বলছি,” ঋষভ তাকিয়ে বলল, “ভৃগুনাথ শুধু তান্ত্রিক ছিল না… ও একজন আত্মাগ্রাসী সময়-পরিক্রমা… ওর চোখের মধ্যে প্রতিটি মানুষ তার নিজের ভয় দেখতে পায়, নিজের অন্ধকার। আমি যখন ওকে উচ্চারণ করছিলাম, তখন আমি আসলে নিজেকেই ছুঁছিলাম—আমার ভেতরের ভয়, লোভ, অপূর্ণতা। ও আমাকে গিলে ফেলতে পারত, কিন্তু আমি নিজের চোখ বন্ধ করেছিলাম… নিজের চোখে নিজেকে দেখিনি।”

প্রজ্ঞা মুখ নিচু করে বলল, “তাহলে চক্র থেমে গেল?”
ঋষভ মাথা নাড়ল, “না… চক্র কখনও থেমে না। এটা শুধু একটা স্তরে স্তব্ধ হয়েছে। ওর আত্মা হয়ত এই জায়গা ছেড়ে গেছে, কিন্তু চক্র এখন আমার চোখে। আমি জানি, আমি রাতে ঘুমোলে সে আসবে, প্রশ্ন করবে। আমার ভিতরে সাড়া দেবে।”

শান চুপ করে গেল। হাওয়া ধীরে বয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু তাতে এক ধরণের সতর্কতা ছিল, যেন পাহাড় নিজেই কান পেতে শুনছে।

“আমরা এবার চলে যাই,” শান বলল।
“হ্যাঁ,” ঋষভ মাথা নিচু করে বলল, “চিলোংবস্তি এখন নীরব, কিন্তু আমি জানি, এই নিরবতা শুধু বাইরের… ভেতরে এখনও চোখ খোলা।”

টেমবার জিপ দেখা গেল দূরে। ও যেন আশ্চর্য হয়ে পড়ে আছে, এত সময় পর ফিরে আসা দেখে। প্রজ্ঞা ততক্ষণে ধীরে ধীরে পেছনের জঙ্গলের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে, মাথায় সাদা কাপড় ঢেকে।

তাদের গাড়ি যখন পাহাড় থেকে নামছে, তখন হঠাৎ ঋষভ তার ডায়েরি খুলে লেখে—
তন্ত্রশাস্ত্র বলেচোখ শুধু দেখার জন্য নয়, বহনেরও। আর যদি তুই একবার এমন চোখে দেখিস, যা চক্রের উৎস, তবে তোকে সেই চক্রও বহন করতে হবে। আজ থেকে, আমার চোখ শুধু আমার নয়।

গাড়ি পাহাড়ি রাস্তায় এগিয়ে চলল। কুয়াশা পিছনে পড়ে রইল, পাহাড়ের বাঁকে হারিয়ে গেল চিলোংবস্তির অস্তিত্ব। আর ঋষভ জানত—চক্র এখনও ঘুরছে, এবার অন্য এক কেন্দ্রে, অন্য এক চোখে।

পর্ব : চোখের ভিতরের ছায়া

ফিরে আসার পর প্রথম কয়েকদিন স্বাভাবিক কাটল। কলকাতার ফ্ল্যাটে ফিরে, ঋষভ নিজের ডেস্কে বসে পাণ্ডুলিপি সাজানো, ক্যামেরা ফুটেজ ঘাঁটা, আর ডায়েরিতে লেখা শুরু করেছিল। কিন্তু শানের চোখে সে কিছু একটা দেখতে পাচ্ছিল—একটা অসম্পূর্ণতা, এক অজানা শঙ্কা। এমন নয় যে শান কিছু বলছিল, বরং তার মুখে সব কিছু ‘নরমাল’ থাকার ভান ছিল, কিন্তু ওর চোখ অন্য কিছু বলছিল। ঠিক যেমন ঋষভের ভিতরেও ধীরে ধীরে জন্ম নিচ্ছিল কিছু—একটা অদ্ভুত অনুভব, যা শব্দে ব্যাখ্যা করা যায় না।

একদিন গভীর রাতে, লেখার মাঝে হঠাৎ ল্যাপটপ বন্ধ হয়ে গেল। ইন্টারনেট চলে গেছে। তারপরে ঘরের বাতি হঠাৎ মিটমিট করে জ্বলে উঠল। প্রথমে ভেবেছিল লো-ভোল্টেজ। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা থেমে গেছে—রাত ৩:07—যেখানে প্রতিবার থেমে যাচ্ছে একই সময়ে। একবার নয়, পরপর তিনদিন।

তৃতীয় রাতে, সে হঠাৎ উঠে গিয়ে বাথরুমের আয়নার দিকে তাকাল। সেখানে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেল না। সেখানে ছিল অন্য কিছু—এক মুখ, চোখ নেই, কিন্তু কপালে একটা ছায়া—ত্রিকোণ আকৃতির। আয়না ফেটে গেল না, হাত বাড়ালেও কিছু ছুঁয়ে গেল না, কিন্তু চোখের ভিতরটা যেন ধ্বনিত হতে লাগল একটাই শব্দে:
তুই তো আমায় বহন করছিস। তোকে মনে করিয়ে দিই?”

ঋষভ চমকে উঠল, ঘামছিল। আয়নার সামনে পড়ে থাকা টুথব্রাশটা গড়িয়ে পড়ে গেল। সে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এল। লিভিং রুমে আলো জ্বলছিল, কিন্তু ঘরের কোণে ছায়া জমাট বাঁধছিল যেন। ক্যালেন্ডারের পাশে তারই তোলা একটি পুরনো ছবি—শ্মশানের, যেটা সে কখনো প্রিন্ট করেনি। কে এনেছে সেটা? তার পিছনে লেখা শুধু একটা শব্দ, লাল কালি দিয়ে—নয়ন।

সে শানকে ফোন করল, কিন্তু কল কেটে গেল। তখনই ডোরবেল বেজে উঠল। সে ধীরে দরজা খুলে দেখে—একটা খাম পড়ে আছে মাটিতে। কে রেখে গেছে বোঝা গেল না। খুলে দেখে ভেতরে একটা ছোট চিরকুট—

“চক্র কখনও থেমে না। তুই শুধু কেন্দ্র। নতুন চোখ খুঁজছে পুরনো ছায়া।”

পরের দিন সকালে সে শানের বাড়িতে পৌঁছাল। দরজা খুলল শানের ছোট ভাই। বলল, “ভাইয়া তিনদিন হল বাইরে গেছে, বলেছিল একটা ‘লোকেশনে’ যাচ্ছে ছবি তুলতে, তারপর ফোন বন্ধ। কোথায় গেছে জানি না।”
ঋষভ চুপ করে গেল। তার বুক ধড়ফড় করছিল। একটা অজানা আঁধার যেন তার চারদিকে ঘুরছে—কোনো কিছু আবার ঘুরে আসছে।

রাতে, সে পুরনো ভিডিও ফাইলগুলো স্ক্যান করছিল। তখন সে আবিষ্কার করল এক আশ্চর্য ব্যাপার—চিলোংবস্তিতে প্রথম দিন বটগাছের নিচে করা শুটে, ক্যামেরার ফ্রেমের এক কোণে একটা ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে ঘুরছিল। আগেও এই অংশটা দেখে সে কিছু টের পায়নি। এবার সে জুম করে দেখল—ছায়াটা মাথা নিচু, হাতে কিছু একটা, আর চোখের জায়গায় শূন্যতা। কিন্তু… কিন্তু পাশে দাঁড়ানো মানুষটা ছিল সে নিজে। মানে, সেই সময়েই কারা যেন আরও ছিল, অদৃশ্য থেকে দৃশ্যের অপেক্ষায়।

সে পেছন ফিরে তাকাল, নিজের ঘরের কোণায় ঝুলছে পুরনো ট্রাইপডটা। হঠাৎ মনে হল তার গলা চেপে ধরছে কেউ, নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। চোখ বন্ধ করল সে, আর দেখতে পেল—চক্র। আবার। আগুন, মন্ত্র, ছাই, আর তারই মত দেখতে একটা ছেলেকে—চোখ ফাঁকা, ঠোঁটে একটা বাক্য, কিন্তু আওয়াজ নেই।

সেই ছেলেটা ধীরে করে এগিয়ে এসে বলল, আমার চোখ কেড়ে নিয়েছিস। এবার তুই কি দিতে পারবি?”

ঋষভ হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, আলো জ্বলে উঠল ঘরে, আর সবকিছু যেন ফিরে এল মুহূর্তেই। কিন্তু তখন সে জানত—ও আর আগের মত নেই।
তার চোখে এখন যা আছে, সেটা শুধু দৃষ্টিশক্তি নয়—একটা প্রবেশপথ, যেটা তার ভিতর দিয়ে বাইরের কিছু দেখছে।

পর্ব : প্রেতলোকের দরজা

ঘুমে আর বিশ্রামে কোনো উপশম আসছিল না। ঋষভ জানত, সে এখন শুধুই এক মানুষের চামড়া পরে বেঁচে থাকা এক ‘বাহক’। ভেতরের অচেনা আলো—যা চোখের পেছনে জ্বলছিল—তা তাকে বারবার ঠেলে দিচ্ছিল এক নতুন মাত্রার দিকে, যাকে সে চেনেনি, ভাবেনি, কখনো চাইওনি। প্রতিটা আয়না এখন তার শত্রু। প্রতিটা নিরবতা এখন শব্দে পরিণত হয়। আর প্রতিটা চোখের পলক পড়া—একটা ইঙ্গিত, যে কেউ তার চোখের দিকে তাকালে কিছু দেখে না, কিন্তু সে তাদের ভিতরের ছায়া দেখতে পায়।

এক রাতে সে হঠাৎ নিজের লেখার ডেস্কে বসে পুঁথির শেষ পাতাটায় চোখ রাখে—যেটা তখনো পড়া হয়নি। পাতাটা ছিল একটু মোটা, যেন দুটো পাতার মাঝে কিছুকে লুকানো। সে আস্তে করে আলাদা করে দেখল—ভেতরে একটা কাঁচের পাতলা স্লাইড, আর তার মধ্যে ধরা এক সরু ধূসর রেখা, অনেকটা কাটা শিরার মত দেখতে। তার পাশে লেখা ছিল—এই চিহ্ন যার চোখে প্রবেশ করে, সে দ্বাররক্ষকপ্রেতলোকের, মৃত আত্মার, অবরুদ্ধ সময়ের।

ঋষভ বুঝল—তাকে এখন দেখা হচ্ছে, কেবল সে দেখছে না।
ঠিক তখনই ফোন বেজে উঠল।
ডিসপ্লেতে নাম নেই।
সে রিসিভ করল।

কোনো শব্দ নেই।
তিন সেকেন্ড, তারপর একটা ফিসফিস কণ্ঠ—
সুধীর মণ্ডলের নাম জানিস? কাশীপুরে একটা পুরনো শ্মশান আছে, যেখানে সে শরীর রাখে। সে দরজা খোলেমৃতদের জন্য। আর এক চোখ খোলা রাখেজীবিতদের জন্য।

ফোন কেটে গেল।
সুধীর মণ্ডল—এই নামটা তার মাথায় বাজতে থাকল। সে ইন্টারনেট ঘাঁটতে লাগল, কিছুই মেলেনি। কিন্তু একটা পুরনো ব্লগে একটা মন্তব্য দেখা গেল—

“যদি কেউ রাত ৩টায় কাশীপুর শ্মশানে পা রাখে, আর তার চোখে ছায়া দেখা যায়—তাহলে বুঝবে, সুধীর তোমার অপেক্ষায় আছে। সে ফিরে আসে, আবার আবার, যখন কেউ চক্রে ফিরে পড়ে।”

ঋষভ আর সময় নষ্ট করল না। মাঝরাতেই সে রওনা দিল কাশীপুর। কলকাতা শহর তখন ঘুমিয়ে, কিন্তু তার শরীর জেগে, মন সজাগ—আর চোখ জ্বলছিল এক অদ্ভুত উত্তাপে।

কাশীপুর শ্মশান ছিল গঙ্গার ধার ঘেঁষে, আগাছায় ঢেকে যাওয়া একটা ঢালু জমি, যেখানে কুকুরের ডাক আর গঙ্গার জলের শব্দ ছাড়া কিছু শোনা যায় না। সেখানে পৌঁছে সে দেখতে পেল—একটা ছোট ঘর, পুরনো দাহঘরের পাশেই, দরজাটা আধখোলা।

সে এগিয়ে যেতেই ঘর থেকে বেরোল এক লোক। শরীরে আলখাল্লা, মাথা ভর্তি জটা, চোখে এক রকম দৃষ্টিশূন্যতা।
“তুই কি দ্বাররক্ষক?” লোকটা প্রশ্ন করল।
ঋষভ মাথা নিচু করে বলল, “আমি চোখে দেখেছি, যার দেখার কথা ছিল না। আমি ফিরিয়ে দিতে চাই যা আমার নয়।”

সুধীর মণ্ডল হেসে উঠল। সেই হাসি ছিল ধ্বংসের মত। তারপর সে বলল, “দেখবি তো? আসলি তো? তবে চল।”

সে ঋষভকে নিয়ে গেল পেছনের ঘরে। ঘরের মেঝেতে আঁকা ছিল চক্র, কিন্তু এইটা ভিন্ন—এটা যেন স্পর্শমাত্রেই নড়বে, ছায়া দেবে না, আলো টানবে। সুধীর বলল, “এটা প্রেতচক্র। এখানে দাঁড়ালেই তুই দেখবি কারা তোকে দেখতে চায়।”

ঋষভ চক্রে দাঁড়াল। চোখ বন্ধ করল। আর তখনই চারপাশ ভরে গেল এক ধরনের ফিসফিস শব্দে—মেয়ের কান্না, বাচ্চার দমবন্ধ হওয়া শব্দ, পুরুষের আর্তনাদ—সবকিছু একসঙ্গে যেন এক দরজা ঠেলে বেরোতে চাইছে।

তার চোখ খুলতেই সে দেখতে পেল—ঘরের দেয়ালে মানুষ, ঝুলন্ত, মুখহীন, চোখ থেকে কালো তরল পড়ছে। আর তাদের প্রত্যেকেই তাকিয়ে আছে তার দিকেই।

সুধীর বলল, “ওরা পথ হারিয়েছে। কেউ তোর চোখে ফিরে আসতে চায়। কেউ তোর ভিতর দিয়ে যেতে চায়। তুই কি জানিস তোর চোখ এখন প্রেতলোকের দরজা?”

ঋষভ শ্বাস নিল গভীরভাবে। হ্যাঁ, সে জানত।
আর এবার… এবার সে শুধু ভয় কাটাতে আসেনি।
সে এসেছিল একটা প্রশ্নের উত্তর পেতে—
আমি কীভাবে মুক্তি পাব?”

 

পর্ব : জীবনের দামে চক্র

প্রেতচক্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা মানে ছিল না শুধু মন্ত্রের খেলায় নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া, বরং ছিল আত্মার গভীরে নেমে নিজের অস্তিত্বের ছায়াগুলোর মুখোমুখি হওয়া। ঋষভ অনুভব করল চারপাশ থেকে যেসব আত্মা তাকিয়ে আছে, তারা শুধু অপরিচিত নয়—তাদের কিছু মুখে রয়েছে তার নিজস্ব স্মৃতি, কিছু দৃষ্টিতে তার গোপন অপরাধ, কিছু স্পর্শে তার চাপা গ্লানি। এই আত্মারা শুধু অশরীরী নয়, তারা ছিল ঋষভের ভেতরের ভুলে যাওয়া ভয়, ছায়া হয়ে বেঁচে থাকা দায়।

সুধীর ধীরে ধীরে এক পাথরের বেদির ওপর বসে বলল, “তুই যদি মুক্তি চাস, তবে তোর ভিতরের সেই সত্তাটাকে সবার সামনে দাঁড় করাতে হবে—যে তোর সমস্ত চোখের ভিতরে লুকিয়ে আছে। আমরা সবাই দৃষ্টির বাহক, কিন্তু খুব কম মানুষই সেই চোখ বন্ধ করার সাহস রাখে।”

“আমি কী করতে পারি?”—ঋষভ জিজ্ঞেস করল।

সুধীর বলল, “তোর চোখ এখন কেবল তোর না। এটা একটা চক্রের প্রতিচ্ছবি—ভৃগুনাথ তো শুধুই শুরু ছিল। তোর চোখ দিয়ে সে এখন অন্য আত্মাদের পথ খোঁজে, পুনর্জন্ম চায়। সেই পথ যদি বন্ধ করতে চাস, তবে যা কিছু এখনও তোর নিজের—মন, শরীর, আত্মা—তা এই চক্রে সঁপে দিতে হবে। যাকে বলে আত্মবিসর্জন, অথচ বেঁচে থেকে।”

“তাহলে কি আমি মরব না, কিন্তু আমার জীবন আর আমার থাকবে না?”
“ঠিক তাই। তুই বাঁচবি, কিন্তু একজন ‘চক্ষু-রক্ষক’ হিসেবে। তুই জীবিতদের মাঝে থাকবি, কিন্তু তোর চোখ দিয়ে মৃতরা দেখবে। আর কেউ যেন চক্র খুলতে না পারে।”

ঋষভ চুপ করে গেল। এক অদ্ভুত ক্লান্তি তাকে ভর করছিল। কিন্তু তার মধ্যে ছিল এক তীব্র উপলব্ধি—এই সবকিছুর শুরু হয়েছিল একটা কৌতূহল থেকে, ইতিহাস জানার বাসনা থেকে, অথচ ইতিহাস সবসময় বলে না, কোন দরজা কখন খুলবে, আবার কবে বন্ধ হবে।

সে চক্রের কেন্দ্রে গিয়ে বসে পড়ল। চোখ বন্ধ করল। আর ভেতর থেকে উচ্চারণ করল সেই মন্ত্র—
নয়নং ক্লীং ভৃগুনাথায় নমঃ, অন্তর্জন্ম বন্ধ ন্যায়ায় স্বাহা।

মন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠল। বেদির চারপাশে বাতি নিভে গেল, অথচ এক লাল আভা ঋষভের চারপাশে ছড়াতে থাকল। তার মস্তিষ্ক যেন জ্বলছিল, প্রতিটি স্মৃতি খোঁড়া হচ্ছিল, প্রতিটি ভুল চোখের সামনে ফিরিয়ে আনা হচ্ছিল—তার প্রেমে প্রতারণা, তার বাবার চিঠি না পড়া, তার বন্ধুর বিপদে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, সবকিছু।

তারপর… হঠাৎ সব নীরব। মনে হল সময় থেমে গেছে। শুধু সে আর একটি কণ্ঠ—

তুই ফিরবি না। তুই দেখবি, কিন্তু কেউ তোকে দেখবে না।

চোখ খুলতেই সে দেখল—সুধীর নেই। ঘর নেই। কাশীপুর শ্মশান নেই।

সে রয়েছে এক আধো আলো আধো ছায়ার সীমান্তে। আর তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক বালক, চোখ নেই, কপালে ত্রিকোণ, আর ঠোঁটে সেই চিরচেনা বাক্য—

তুই এখন চক্রের প্রহরী। তোর চোখে আমি ঘুমাব।

ঋষভ মাথা নিচু করে বলল, “আমি গ্রহণ করি।”

আর তারপরই তার চোখের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো এক ফিনকি রক্ত, তারপর একটা আগুনরঙা রেখা, যেন পাথরে খোদাই করা নতুন চক্র।

সে আবার পৃথিবীতে ফিরে এল—একটা রাস্তার ধারে, রাত তিনটে বাজে, পেছনে গঙ্গা বয়ে চলেছে। তার পকেটে সেই পুঁথির শেষ পৃষ্ঠা, চোখের সামনে কেবল নিজের ছায়া, আর ভিতরে সেই নিঃশব্দ ভয়—

এই চোখে এখন অনেকেই দেখতে পায়। কিন্তু সে কী নিজের চোখে নিজেকে দেখতে পারে?

পর্ব : চোখহীন যারা

কলকাতার ভিড়ে ফিরে এসে ঋষভ যতটা চুপচাপ থাকত, ততটাই দ্রুত সে মানুষের চোখে ধরা পড়ত। ট্রামে বসে থাকা সেই বৃদ্ধ, অফিসলিফটে চেয়ে থাকা অচেনা মহিলা, কিংবা রাস্তার কুকুর—all seemed to look at him just a moment too long. এবং আশ্চর্যের বিষয় ছিল, সে এখন আর প্রশ্ন করত না। সে জানত, তারা চায় না তাকাতে—তাদের চোখে ঢুকে পড়ে কেউ, এবং সে কেউ এখন ঋষভ।

তিন দিন ধরে সে খাবার ছুঁয়ে দেখেনি। ক্ষুধা পেত না। পিপাসাও না। কিন্তু তার চোখ ঘুমোতে চাইত, অথচ কিছু একটা সেই ঘুম কেড়ে নিত। রাত গভীর হলে সে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াত। তার নিজের চোখে তাকালে সে দেখতে পেত অন্যদের—অন্ধ ছেলেটা যার মা তাকে শ্মশানে ফেলে দিয়েছিল, সেই বৃদ্ধ যাকে তার ছেলেরা ফেলে গেছিল বৃদ্ধাশ্রমে, সেই নববধূ যার স্বামী আত্মহত্যা করেছিল তার অসুখ জানার পরে। তারা ছিল সবাই চোখহীন। কারণ দৃষ্টি মানে শুধু দেখা নয়—দৃষ্টি মানে বেঁচে থাকা, স্মরণে থাকা।

এক রাতে শান ফিরে এল। অনেকটা রোগা, চোখে কালি, গায়ে ধুলো। সে কিছু না বলে এসে কেবল বলল, “তুই জানিস না আমি কোথায় ছিলাম, তুই জানিস না আমি কী দেখেছি, কিন্তু আমি জানি—তুই এখন আর আমার বন্ধু ঋষভ না। তুই কিছু বহন করছিস।”
ঋষভ তার দিকে তাকাল না। কেবল বলল, “তুই চাইলে আমায় শেষ করতে পারিস। কিন্তু মনে রাখিস, শেষ মানে মুক্তি নয়। চক্র আরম্ভ হলে সে শেষ হয় না—সে শুধু ঘুরে ঘুরে অন্য কাউকে খোঁজে।”

শান বসে পড়ল। মাথা ধরে কান্না করল। বলল, “তুই চাইলে আমি চোখ ফিরিয়ে নিতে পারি, কিন্তু তোর ভিতরটায় একদিন আমারও অংশ ছিল, আজ সেটা কুয়াশায় ঢেকে গেছে।”

ঋষভ তার দিকে তাকাল। তারপর বলল, “আমার চোখে যদি তুই দেখতে চাস, তাহলে তুই সত্যিই হারিয়ে যাবি। কারণ এই চোখ এখন দরজা, জানালা নয়। তুই শুধু ভাবিস তুই তোর মত—কিন্তু আমি তো এখন অনেকের।”

তারপরের দিন সকালে সে নিজেকে আয়নায় দেখল না। বরং আয়না ছিল ফাঁকা। শুধু একটা রঙিন ছোপ পড়ে ছিল কাচের উপর—ত্রিকোণ, আর তার মাঝখানে এক বিন্দু। সে জানত, সে আর একা নয়। তার শরীরই এখন পথ।

একদিন, সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখল, একটা ছোট মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে বলল, “তোমার চোখে আলো নেই। কিন্তু একটা চক্র আছে। আমি দেখতে পাচ্ছি। মা বলে, আমি আগেও এমন একজনকে দেখেছিলাম। তারা বলে, আমি হয়ত চোখের আগে জন্মেছিলাম।”
ঋষভ জিজ্ঞেস করল, “তোর নাম কী?”
“আমি জানি না,” মেয়ে বলল, “কিন্তু আমারও চোখ আছে। আর তুমিও জানো।”

ঋষভ বুঝতে পারল—চক্র আবার নিজের উত্তরসূরিকে খুঁজে পেয়েছে। কারণ চক্র কখনও শেষ হয় না, চক্র বেছে নেয়।

সে হাঁটু গেড়ে বসল, মেয়েটির চোখে তাকাল। এবং প্রথমবার, বহুদিন পরে, তার ভিতরে এক শীতল বাতাস ঢুকল। তাতে ভয় ছিল না, ছিল উপলব্ধি।

সে বলল, “যদি কেউ আবার চক্র ছুঁতে চায়, তুই কী করবি?”
মেয়েটি হেসে বলল, “আমি চোখ বন্ধ করব। যেমন তুমিও করেছিলে একদিন।”

 

পর্ব ১০: শেষ চক্র

গল্পের শেষ কোথায় হয় কেউ জানে না। কেউ বলে মৃত্যু, কেউ বলে বিস্মৃতি, কেউ বলে মুক্তি। কিন্তু চক্রের ভিতর যারা চলে আসে, তারা জানে—শেষ মানে কখনওই থামা নয়, বরং একটি নতুন কেন্দ্র, নতুন বহনকারী, নতুন দরজা।

ঋষভ জানত তার সময় ঘনিয়ে এসেছে। তার চোখের নীচে কালো ছায়া, কপালের ভাঁজে ত্রিকোণছাপ স্পষ্ট, এবং প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সে আর নিজেকে পুরোপুরি ‘ঋষভ’ বলে মনে করত না। যেন একটা অতিরিক্ত সত্তা তার ভিতর বাস করছে, ধীরে ধীরে তার ভাষা, গন্ধ, চিন্তা, এমনকি হৃৎস্পন্দনের ছন্দ বদলে দিচ্ছে।

সে সেই মেয়েটির কথাই বারবার ভাবছিল—যে চোখ বন্ধ করতে জানে, এবং যার দৃষ্টি কোনো সাধারণ সময়ের ভেতরে বাঁধা নয়। সেই মেয়েটিই হয়তো হতে পারে ভবিষ্যতের রক্ষক, কিন্তু তাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব এখনও ঋষভের।

সে সিদ্ধান্ত নিল, এই চক্র আর ঘুরবে না। তাকে থামাতে হবে। শুধু একবারের জন্য হলেও।

রাত তিনটায় সে আবার সেই পুরনো পুঁথির শেষ পাতাটা বের করল। এবার সেখানে নতুন কিছু লেখা ছিল—অদ্ভুতভাবে কালির গন্ধ একদম টাটকা।

“যদি চোখ নিজেকে ছুঁয়েছে,
তবে তৃতীয় চক্র বন্ধ করতে হয় ত্যাগে।
দরজা খুলে, সত্তা দিয়ে,
এবং নিজেকে মুছে।”

ঋষভ জানত কী করতে হবে।
সে পুঁথি ছেঁড়ে ফেলল না, বরং প্রতিটা পাতায় আগুন ধরিয়ে দিল। আগুনের হলকা ছড়িয়ে পড়ল ঘরে, কিন্তু ধোঁয়া ছিল না। কেবল একটি গন্ধ—চন্দনের, রক্ততেলের, মৃতদেহ পোড়ার মিশ্রণে এক আতঙ্কময় শান্তি।

আয়নাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে, এবং প্রথমবার নিজের চোখের দিকে তাকাল—তাতে প্রতিচ্ছবি নেই, ছিল অসংখ্য চোখের দৃষ্টি। তারা বলছিল, “আমরা তোকে ছেড়ে যেতে চাই না। তুই তো আমাদের পথ। আমাদের দেখার একমাত্র দিক।”

“কিন্তু আমি তো মানুষ,” ঋষভ বলল।
“তুই ছিলি মানুষ। এখন তুই দরজা।”

ঋষভ হাসল। তারপর চোখ বন্ধ করল। মন্ত্র পড়ল না, কিছু বলেনি, শুধু একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করল।

সেই মুহূর্তে, জানালার বাইরে হাওয়া উঠল। ঘরের আলো নিভে গেল। আয়নাটি ফেটে গেল শব্দ ছাড়াই। আর ঠিক তখনই, ঘরের মাঝখানে যেখানে চক্র আঁকা ছিল একদিন, সেখানে দেখা গেল একটি ফোঁটা রক্ত, তারপর নিঃশব্দে জ্বলে ওঠা আগুন, এক গোল রূপে।

সকালে প্রতিবেশীরা দরজা ভাঙল, ঘরের ভিতর কিছুই পাওয়া গেল না—না কোনো দেহ, না কোনো পোড়া চিহ্ন। শুধু একটা পুরনো ক্যামেরা, যার ভেতরের শেষ ভিডিওতে দেখা যায়—একজন পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে, চোখে অপার এক শূন্যতা, ঠোঁটে অর্ধেক হাসি, আর পেছনে লেখা—

চক্র এখন ঘুমোচ্ছে। কিন্তু কারো চোখ খোলা থাকলেই, সে ফিরে আসবে।

এক বছর পর, হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এক লোকজনহীন দুপুরে, একজন ফুলবিক্রেতা দেখল একটা ছোট মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কপালে ত্রিকোণ আঁকা, চোখ বন্ধ। সে বলল, “চোখ বন্ধ রাখো। আবার কেউ ডাক দেবে।”

ফুলবিক্রেতা ভয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। কারণ কেউ ডাকলেও, সে ফিরিয়ে দিতে জানে না।

কিন্তু মেয়েটি জানে।
কারণ এখন, অঘোরীর চোখ আর একটা নয়।
এটা বহুজনের ভিতর ঘুমিয়ে থাকা এক আগুন—যা শুধু দৃষ্টি চাই, আর একটু ডাক।

শেষ

WhatsApp-Image-2025-06-29-at-9.53.18-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *