Bangla - তন্ত্র

অঘোরীর উত্তরাধিকার

Spread the love

বিপ্লব দে


বারাণসীর নিশ্ছিদ্র অন্ধকার গঙ্গার ধারে মণিকর্ণিকা ঘাটে সেই রাতটা যেন মৃত্যুর গন্ধে মোড়া। শতাব্দীপ্রাচীন ঘাটের ভাঙাচোরা সিঁড়িগুলোয় অগ্নিশিখা নেচে বেড়াচ্ছে, মৃতদেহ দাহের ধোঁয়া গঙ্গার কুয়াশার সঙ্গে মিশে তৈরি করেছে ভয়ঙ্কর অথচ পবিত্র আবহ। আগুনের লাল আভায় নদীর জল কালো রঙে চকচক করছে, যেন গঙ্গাই আজ এক মহাশ্মশান। সেই শ্মশানের প্রান্তে, এক জরাজীর্ণ ঘাটঘরে শায়িত মহেশ্বর নাথ—অঘোর তন্ত্রের এক প্রবীণ সাধক। তাঁর শরীর ক্ষয়ে গেছে, হাড়গোড় বেরিয়ে এসেছে, তবুও মুখে এমন এক দীপ্তি যা মৃত্যুকেও হার মানায়। বুক ওঠানামা করছে কষ্টে, চোখের গভীরে জ্বলছে অন্তিম আলো। পাশে বসে অরিন্দম, গুরুপ্রেমে ভিজে চোখে জল। শিষ্য হাত দিয়ে গুরুজীর পা মুছে দিচ্ছে ভেজা কাপড়ে, যেন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সেবায় কোনো ত্রুটি না থাকে। গঙ্গার ঢেউ যখন দাহের শব্দের সঙ্গে মিশে উঠছে, তখন মনে হচ্ছিল—এই মহাশ্মশানে এক মহাকাব্যিক উত্তরাধিকারের জন্ম হচ্ছে, যা শুধু এক শিষ্য নয়, সময়কেও প্রভাবিত করবে।

মহেশ্বর নাথ কষ্টে দম নিয়ে শিষ্যের দিকে হাত বাড়ালেন। তাঁর হাত কঙ্কালসার, কিন্তু তাতে লুকিয়ে আছে যুগযুগান্তের সাধনার শক্তি। অরিন্দম ভয় আর শ্রদ্ধার মিশ্র অনুভূতিতে গুরুর হাত ধরল। গুরু ধীরে ধীরে বললেন, কণ্ঠ যেন মৃত্যুর সীমানা ছুঁয়ে আসছে—“অরিন্দম, যা তোমাকে দিতে যাচ্ছি, তা কেবল শক্তি নয়, দায়ও। সময়কে থামানো বা বাঁকানো—এটা মানুষের হাতে দেওয়া অভিশাপ। যে এর ব্যবহার করবে, সে হয় অমর কীর্তির অধিকারী হবে, নয় ধ্বংসের কারণ। মনে রেখো, তন্ত্র শুধু শক্তি নয়, আত্মার ভারও।” তাঁর কম্পমান হাতে বেরিয়ে এল এক ছোট পাথরের মতো বস্তু, কিন্তু তা কোনো সাধারণ পাথর নয়—অন্ধকারে থেকেও সেটি নিজস্ব আলোর ঝলকানি ছড়াচ্ছিল। কালো রঙের মধ্যে নীলাভ আগুনের নাচন, যেন তার ভেতরেই লুকিয়ে আছে মহাকালের স্রোত। অরিন্দম স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইল, যেন গঙ্গার ঢেউ থেমে গেছে, ঘাটের আগুন নিভে গেছে, আর এই মুহূর্ত ছাড়া আর কিছু নেই। মহেশ্বর নাথ সেই মণি তাঁর কাঁপতে থাকা আঙুলে রেখে দিলেন, ধীরে বললেন—“এটাই মহাকাল মণি। এ আমার উত্তরাধিকার। তুমি চাইলে সময়কে তোমার ইচ্ছেমতো ঘুরিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু মনে রেখো—একবার ব্যবহার করলে, তোমার আত্মা আর মুক্ত থাকবে না।”

অরিন্দম কাঁপা হাতে মণিটা নিল, মনে হলো যেন পুরো শরীরে আগুন বয়ে যাচ্ছে। গঙ্গার শব্দ, দাহের গন্ধ, রাতের হাহাকার—সব মিলিয়ে মুহূর্তটা ভয়াল অথচ অদ্ভুতভাবে মহিমান্বিত। শিষ্যের চোখে জল জমে উঠল, সে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে বলল—“গুরু, আমি কীভাবে এই দায় বহন করব? আমি তো কেবল আপনার আশ্রয়ে থাকা এক ক্ষুদ্র প্রাণী।” গুরু চোখ বন্ধ করলেন, ঠোঁটে ক্ষীণ হাসি ফুটল। তাঁর শেষ বাক্য যেন আকাশে ভেসে উঠল—“উত্তরাধিকার মানে শুধু শক্তি পাওয়া নয়, তার দায় কাঁধে নেওয়া। সিদ্ধান্ত তোমার—ব্যবহার করবে, নাকি ধ্বংস করবে।” মুহূর্তের মধ্যে তাঁর নিঃশ্বাস থেমে গেল, শরীর শান্ত হয়ে গেল গঙ্গার ঢেউয়ের মতো। বাইরে শ্মশানে চিতার আগুন আরও উঁচু হয়ে উঠল, যেন মহেশ্বর নাথের আত্মাকে মহাকালের দিকে বিদায় জানাচ্ছে। অরিন্দম নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে রইল, হাতে মণি, বুক ভরা ভয় আর শ্রদ্ধার মিশ্রণে। সেই রাতেই বারাণসীর আকাশে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো, আর এক তরুণ শিষ্য হয়ে উঠল মহাকালের দায়ভার বহনকারী উত্তরাধিকারী।

গঙ্গার কুয়াশাচ্ছন্ন প্রভাত, বারাণসীর ঘাটে মৃতদেহ দাহের ধোঁয়া এখনও ভেসে বেড়াচ্ছে। রাতের ভেতরে যে দায়ভার এসে অরিন্দমের হাতে ধরা দিয়েছে, ভোরের আলোয় সেটি যেন আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। সে মণিটা মুঠোর মধ্যে ধরে বসেছিল, শরীর কাঁপছিল অকারণে। যেন ঠান্ডা নয়, বরং ভিতরের অস্থিমজ্জায় আগুন জ্বলে উঠেছে। গঙ্গার ঢেউয়ে ভেসে আসা শব্দ হঠাৎ থেমে যাচ্ছে, আবার কখনো অস্বাভাবিকভাবে দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। অরিন্দম আতঙ্কে টের পেল—তার চারপাশের সময় অদ্ভুতভাবে বদলাচ্ছে। পাখিরা উড়তে উড়তে মাঝআকাশে স্থির হয়ে থাকছে, আবার পরমুহূর্তে তারা চোখের সামনে ঝড়ের মতো দ্রুত সরে যাচ্ছে। ঘাটের ঘণ্টাধ্বনি কানে পৌঁছতে পৌঁছতে কখনো দীর্ঘশ্বাসের মতো দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে, কখনো বজ্রপাতের মতো হঠাৎ কর্কশ শব্দে ফেটে পড়ছে। পৃথিবী যেন তার মুঠোয় বন্দি হয়ে গেছে, আর সেই মুঠোয় রয়েছে এক কালো, আগুনে ঝলসানো মণি। মুহূর্তেই বুঝে গেল—এটা শুধু এক বস্তু নয়, বরং সময়কে বাঁকিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাধারী এক অভিশপ্ত অস্ত্র। আতঙ্কে তার হাত কাঁপতে লাগল, কিন্তু মণিটা ছাড়তে পারল না। মনে হলো, ওটা যেন হাত থেকে ফেলে দিতে চাইলেও আঙুলে গেঁথে আছে, তার ভেতরের সত্তায় ঢুকে গেছে।

সে দৌড়ে গিয়ে গঙ্গার সিঁড়ির ধারে বসে পড়ল, কপালে হাত রেখে হাঁপাতে লাগল। চোখের সামনে তখনও ধরা দিচ্ছিল ভাঙা ভাঙা দৃশ্য—কখনো শৈশবের মা, যিনি ছোটবেলায় তাকে ঘাটে খেলতে দেখতেন, কখনো গুরুর তীব্র চোখ, কখনো আবার ভবিষ্যতের মতো লাগা অচেনা দৃশ্য, যেখানে আগুন আর রক্ত মিশে বারাণসীর গলিগুলোকে অন্ধকার করে রেখেছে। অরিন্দম বুঝতে পারছিল না, এ দৃশ্য তার কল্পনা নাকি মণির শক্তি। হৃদপিণ্ড দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছিল, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল, যেন সময়ের ভার তাকে মাটির সঙ্গে পুঁতে ফেলছে। এই বিভ্রমের মধ্যে, গঙ্গার ঘাটের ধারে ছায়ার মতো এসে দাঁড়াল এক অন্ধ সাধু। মলিন কাপড়, গায়ে ছাই, চোখ দুটি শূন্য গহ্বরের মতো। তিনি এক অদ্ভুত সুরে হেসে উঠলেন, সেই হাসি যেন মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি। অরিন্দম ভয়ে পিছিয়ে যেতে চাইলে সাধু বললেন—“ভয় পেও না, আমি যা দেখছি তা তুমি বুঝছ না। এই মণি তোমাকে শাপ আর বর—দুটো একসঙ্গে দিয়েছে।” তাঁর কণ্ঠে ছিল এক অদ্ভুত দৃঢ়তা, যেন বারাণসীর মৃতপ্রায় অগ্নিশিখার ভেতর থেকে কথা বলছে।

অরিন্দম হতভম্ব হয়ে তাকাল তাঁর দিকে। প্রশ্ন করল—“এটা কী? গুরু কেন আমাকে দিলেন?” অন্ধ সাধু মৃদু হেসে উত্তর দিলেন—“কারণ, গুরু জানতেন, তুমি শুধু শিষ্য নও, তুমি সময়ের দোলাচলে জন্ম নেওয়া এক সৈনিক। এই মণি একদিকে দেবতার প্রসাদ, অন্যদিকে রাক্ষসের অভিশাপ। যে একে ব্যবহার করবে, সে হয় দেবতুল্য হয়ে উঠবে, নয়তো নরকের দ্বার খুলবে।” সাধুর চোখে শূন্যতা, কিন্তু তার কণ্ঠে ছিল অকাট্য সত্যের ভার। তিনি আবার বললেন—“তুমি আজ যে ধীর আর দ্রুত সময় দেখলে, এটা কেবল শুরু। সামনে তোমার দেহ, মন, আত্মা—সবাইকে পরীক্ষা দিতে হবে। মহাকালকে বশ করার মানে হলো নিজের নিয়তিকে আগুনে ফেলে দেওয়া।” অরিন্দম স্তব্ধ হয়ে শুনল। ভেতরে দ্বন্দ্ব আরও ঘন হতে লাগল—মণি কি সত্যিই তার মুক্তির পথ, নাকি সর্বনাশের সোপান? গঙ্গার জলে সূর্যের প্রথম আলো প্রতিফলিত হচ্ছিল, কিন্তু অরিন্দমের চোখে শুধু অন্ধকার। অন্ধ সাধুর ছায়া ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল কুয়াশার সঙ্গে, রেখে গেল শুধু এক শিহরণ জাগানো সতর্কবার্তা—“মণি শুধু আশীর্বাদ নয়, অভিশাপও।” অরিন্দম হাতের মণিটাকে শক্ত করে ধরে রইল, মনে হলো এ শুধু এক বস্তু নয়, বরং তার নিয়তি, যা থেকে সে কোনোদিন মুক্তি পাবে না। সেই মুহূর্তে বারাণসীর আকাশে কাকের ডাকা প্রতিধ্বনিত হলো, যেন মহাকাল নিজেই তার শিষ্যের প্রথম পরীক্ষা ঘোষণা করে দিল।

বারাণসীর ঘাটে গুরুদাহ শেষ করার পর রাত যেন আরও গভীর হয়ে উঠেছিল। অরিন্দম দাঁড়িয়ে ছিল অগ্নিকুণ্ডের পাশে, গুরু মহেশ্বর নাথের দেহ ধীরে ধীরে ভস্মে পরিণত হচ্ছিল। চিতা থেকে উড়তে থাকা ধোঁয়া গঙ্গার বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছিল, আর সে ভাবছিল—আজ থেকে সে একেবারে নিঃস্ব। চোখে জল ভরে উঠলেও বুকের ভেতর ভারী এক শূন্যতা জমে গিয়েছিল। গুরুর দেওয়া মহাকাল মণি তখনও তার হাতে ধরা, আলো ঝলকানো পাথরটিতে তার চোখ পড়লেই বুক কেঁপে উঠছিল। সেই রাতে ঘুম এল না; দাহ শেষ করে এক কোণে বসে অরিন্দম বারবার মণির দিকে তাকাচ্ছিল। কখনো মনে হচ্ছিল মণি তাকে টেনে নিচ্ছে, আবার কখনো মনে হচ্ছিল গুরু যেন দূরে কোথাও দাঁড়িয়ে তাকে ডাকছেন। ক্লান্তি আর দুঃখের ভারে অবশেষে ঘুম এসে গেল, আর সেই ঘুমেই শুরু হলো এক অদ্ভুত স্বপ্ন।

স্বপ্নে সে দেখল, বিশাল এক অন্ধকার শূন্যতায় দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ সেখানকার আকাশ আলোকিত হয়ে উঠল, আর গুরু মহেশ্বর নাথ তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর দেহে তখন আর মরণের ক্লান্তি নেই, বরং দাউদাউ আগুনের মতো দীপ্তি ছড়াচ্ছে। গুরু গভীর চোখে তাকিয়ে বললেন—“অরিন্দম, তোমার পথ এখানেই শেষ নয়। তুমি যে মণি হাতে পেয়েছ, তা কেবল এক উত্তরাধিকার নয়, এটি মহাকালের গোপন রহস্যের দ্বার। এর আসল শক্তি বুঝতে হলে তোমাকে যাত্রা করতে হবে নীলাচল পাহাড়ে। সেখানেই কামাখ্যা দেবীর গুহামন্দিরে লুকানো আছে সেই সত্য, যা তোমার নিয়তি নির্ধারণ করবে।” স্বপ্নের ভেতরে অরিন্দম কেঁপে উঠল—“কিন্তু গুরু, আমি কি পারব?” গুরু মৃদু হাসলেন, তাঁর চোখে অনন্ত মহাকালের ঝলকানি, বললেন—“যখন আত্মা ভয় পায়, তখনই সাধনার শুরু হয়। যাত্রা করো, নীলাচলে তোমার অপেক্ষায় রয়েছে দেবীর আহ্বান।” এই কথা বলে গুরু ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলেন শূন্যতায়, রেখে গেলেন শুধু প্রতিধ্বনি—“কামাখ্যা… কামাখ্যা…”। অরিন্দম হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠল, বুক ভিজে গেছে ঘামে, কানে তখনও প্রতিধ্বনি বাজছে।

পরদিন সূর্যোদয়ের আগে সে সিদ্ধান্ত নিল, গুরুজীর স্বপ্নাদেশ অনুসারে যাত্রা শুরু করবে। গঙ্গার ঘাটে একবার শেষ প্রণাম করে, অগ্নিশিখার ধোঁয়ার ভেতরে যেন গুরুর মুখ আবার দেখতে পেল। তারপর মণি বুকে লুকিয়ে বেরিয়ে পড়ল দীর্ঘ যাত্রায়। পথ তার কঠিন—গঙ্গার পাড় ছাড়িয়ে উত্তর-পূর্বের অজানা পথে, ঘন জঙ্গল, পর্বত আর নদী পেরিয়ে। কয়েকদিনের যাত্রায় সে দেখল ভারতের অন্তঃসলিলা বাস্তবতা—কোথাও পাথরে খোদাই করা প্রাচীন মন্দির ভগ্নাবশেষ, কোথাও শ্মশানকুণ্ডে বসে থাকা তান্ত্রিক, কোথাও আবার নির্জন অরণ্যে অদ্ভুত ছায়া তাকে অনুসরণ করছে। তার মনে হচ্ছিল, মণি কেবল একটি বস্তু নয়, বরং সে নিজেই যেন সময়ের এক টুকরো বহন করছে, আর সেই সময় তাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে কামাখ্যার দিকে। অবশেষে বহুদিনের ক্লান্ত যাত্রার পর সে নীলাচল পাহাড় দেখতে পেল—মেঘে ঢাকা, সবুজে মোড়া, অথচ ভেতরে যেন অদ্ভুত রহস্যে ভরপুর। পাহাড়ের নিচে দাঁড়িয়ে অরিন্দমের মনে হলো, এ শুধু ভৌগোলিক গন্তব্য নয়, বরং এক আধ্যাত্মিক দ্বার। গুরুর কণ্ঠ আবার কানে ভেসে এল—“সত্য বোঝার পথ এখানেই শুরু।” বুক ধড়ফড় করতে লাগল, কিন্তু দৃঢ় পদক্ষেপে সে এগিয়ে গেল পাহাড়ের দিকে, যেখানে কামাখ্যার আহ্বান অপেক্ষা করছে তার জন্য।

কামাখ্যার অগ্নিময় পরিবেশে, গম্ভীর ঢাক–কাঁসার সুর, ধূপের ঘ্রাণ আর ভক্তদের ভিড়ের ভেতর প্রথমবার অবন্তিকাকে দেখে অরিন্দম। সে যেন ভিড়ের বাইরে থেকেও ভিড়ের ভেতরে—মাথায় হালকা ওড়না, চোখে অদ্ভুত দীপ্তি, ঠোঁটে গম্ভীর স্থিরতা। প্রথমে অরিন্দম ভাবে সে স্রেফ মন্দিরের সাধারণ পূজারিণী, কিন্তু মুহূর্তেই বুঝতে পারে তার ভেতরে অন্য এক শক্তি লুকিয়ে আছে। অবন্তিকার চোখে সে যেন নিজের মণির ছায়া দেখতে পায়—সময়কে নাড়িয়ে দেওয়ার সেই একই রহস্যময় কম্পন। অবন্তিকা শান্ত স্বরে বলে ওঠে, “তুমি সেই মণি বহন করছো, তাই না?” অরিন্দম বিস্মিত হয়—সে তো কাউকে কিছু বলেনি। অবন্তিকা যেন তার মনের কথাই পড়ে ফেলছে। তারপর একরকম নির্লিপ্ত স্বরে জানায়—“কামাখ্যার গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে চাইলে আমার সহায়তা দরকার।” অরিন্দম বিভ্রান্ত হয়, কারণ তার গুরু তো কেবল স্বপ্নে বলেছিলেন—চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে কামাখ্যায়, কিন্তু কারো সাহায্য নিতে হবে—এটা বলেননি। অবন্তিকার শান্ত অথচ অস্বাভাবিক উপস্থিতি তাকে একইসঙ্গে আকর্ষণ আর আশঙ্কায় ভরিয়ে তোলে।

দিন গড়িয়ে যেতে থাকে, অরিন্দম ও অবন্তিকার মধ্যে দূরত্ব কখনো কমে আসে, আবার হঠাৎ বেড়ে যায়। অবন্তিকা তাকে নানা পথে সহায়তা করে—মন্দিরের পুরোহিতদের কড়া নিয়ম এড়িয়ে তাকে নির্দিষ্ট সময় মন্দিরের নির্জন প্রাঙ্গণে নিয়ে যায়, প্রাচীন শাস্ত্রের উদ্ধৃতি পড়ে শোনায়, এমনকি কখনো মন্ত্রপাঠে সহায়তাও করে। তবু তার আচরণে এমন কিছু অদ্ভুত বৈপরীত্য যে অরিন্দম অনেক সময়ই অস্থির হয়ে পড়ে। কখনো অবন্তিকা অরিন্দমের দিকে এমন করুণ দৃষ্টিতে তাকায় যেন বহু পুরনো কোনো যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছে, আবার কখনো তার মুখে এমন কঠোর শীতলতা নেমে আসে যেন সে একেবারেই অপরিচিত এক শক্তির হাতে পরিচালিত। এক রাতে, মন্দির চত্বরে জ্যোৎস্নায় ভিজে থাকা সময়ে অবন্তিকা হঠাৎ বলে ওঠে—“মণির শক্তি তুমি ধরে রাখতে পারবে না, অরিন্দম। এ শক্তি তোমাকে ধ্বংস করবে।” অরিন্দম উত্তরে কিছু বলতে চাইলেও তার গলা শুকিয়ে যায়, কারণ সেই মুহূর্তে অবন্তিকার চোখে এমন এক অন্ধকার ঝলক দেখে যা মানুষের চোখে থাকার কথা নয়। পরক্ষণেই সে আবার স্বাভাবিক হয়ে মৃদু হেসে ফেলে, যেন কিছুই ঘটেনি। অরিন্দমের মনে তখন আর কোনো সন্দেহ থাকে না—অবন্তিকার সঙ্গে গভীর কোনো রহস্য জড়িয়ে আছে, যা কামাখ্যার মাটির মতোই অতল আর ভয়ঙ্কর।

ক্রমে অরিন্দম বুঝতে পারে, অবন্তিকা শুধু এক পূজারী পরিবারের তরুণী নয়, বরং কামাখ্যার শক্তিক্ষেত্রের সঙ্গে অদ্ভুতভাবে যুক্ত। একদিন অবন্তিকা তাকে পাহাড়ের পাদদেশে নিয়ে যায়, যেখানে ধ্বংসপ্রায় এক শিবালয়ে কালের চিহ্ন এখনো স্পষ্ট। সেখানে দাঁড়িয়ে অবন্তিকা গম্ভীর কণ্ঠে বলে—“আমার জন্ম কেবল পার্থিব নয়, মন্দিরের গর্ভগৃহের সঙ্গে বাঁধা। আমি জানি না আমি কাকে বিশ্বাস করি—নিজেকে, দেবীকে নাকি কোনো অজানা শক্তিকে।” অরিন্দম হতবাক হয়ে শোনে, কিন্তু তখনই মনে হয় অবন্তিকা হয়তো কোনো অদৃশ্য শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মণির চারপাশে যেভাবে ছায়া নেমে আসে, অবন্তিকার কথার মাঝেও তেমনই অদৃশ্য ছায়া লুকিয়ে আছে। তবু তার কাছে একরকম টান অনুভব করে অরিন্দম—মনে হয়, অবন্তিকা ছাড়া সে মণির রহস্যে প্রবেশ করতে পারবে না। গুরুজীর স্বপ্নের ধ্বনি, অবন্তিকার অস্থির উপস্থিতি, আর কামাখ্যার গম্ভীর আবহ মিলেমিশে তাকে এমন এক সঙ্কটে ফেলেছে যেখান থেকে ফেরা অসম্ভব। অবন্তিকার সঙ্গে পরিচয়, সাহায্য, এবং সেই বিভ্রান্তিকর দ্বৈততা—এসবই যেন তাকে আরো গভীরভাবে মণির অভিশাপের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, অথচ পথের অন্য প্রান্তে লুকিয়ে আছে এক অচিন শক্তির দিগন্ত, যা তাকে না ডাকলেই নয়।

অন্ধকারে ঢেকে থাকা শ্মশানের ধোঁয়া আর আগুনের শিখার মাঝখান দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে ভৈরব তান্ত্রিক। একসময় মহেশ্বর নাথের আশ্রমে তার দীক্ষা হয়েছিল, গুরু হিসেবে মহেশ্বর নাথকে সে শ্রদ্ধা করত, কিন্তু তার ভেতরের লোভ আর অতৃপ্ত বাসনা তাকে অন্য পথে টেনে নিয়ে যায়। সাধারণ তন্ত্রের সীমা ভেঙে, কালো তন্ত্রের ভয়ঙ্কর শক্তি আহ্বান করতে শুরু করে সে। তার গায়ের কালো ধুতি, কপালে গাঢ় লাল সিঁদুরের টান, গলায় হাড়ের মালা—তার প্রতিটি উপস্থিতিই ভয়ের সঞ্চার করে। মানুষ বলত, ভৈরব রাতের আঁধারে শুধু সাধনা করে না, বরং অশুভ আত্মাদের আহ্বান করে তাদের শক্তি শুষে নেয়। মহেশ্বর নাথ তাকে বারবার সতর্ক করেছিলেন, কিন্তু সে কান দেয়নি। বরং বিদ্রোহ করে আশ্রম ছেড়ে চলে যায়, আর এখন ফিরে এসেছে সেই একই শক্তিকে ব্যবহার করে মণি দখল করার জন্য। গঙ্গার পাড়ের মৃতশ্মশানের ভেতরে, কাকের ডাক আর চিতার ছাইয়ের গন্ধে মোড়া পরিবেশে ভৈরব প্রতিজ্ঞা নেয়—অরিন্দমের হাত থেকে যেভাবেই হোক মণি কেড়ে নেবে।

কামাখ্যার আঙিনায় যখন অরিন্দম অবন্তিকার সাহায্যে মণির রহস্য বোঝার চেষ্টা করছে, ঠিক তখনই দূরে বসে তাকে লক্ষ্য করছে ভৈরব। অন্ধকার রাতে মন্দির চত্বরে তার ছায়া যেন সাপের মতো গাঢ় হয়ে মাটিতে গড়িয়ে বেড়ায়। সে জানে অবন্তিকা শুধুই পূজারী পরিবারের এক তরুণী নয়, তার ভেতরে লুকিয়ে আছে কোনো এক গোপন সূত্র। অরিন্দম ও অবন্তিকার প্রতিটি কথাবার্তা, প্রতিটি পদক্ষেপ সে নজরে রাখছে, কারণ মণির শক্তি উন্মোচনের চাবিকাঠি হয়তো ওই তরুণীর ভেতরেই লুকানো। ভৈরবের মুখে এক অদ্ভুত হাসি খেলে যায়, যা মানুষকে অজান্তেই শীতল করে দেয়। সে গোপনে কয়েকজন শিষ্যকেও পাঠিয়েছে, যারা ছদ্মবেশে বাজারের ভিড়ে কিংবা মন্দিরের ভেতরে অরিন্দমকে অনুসরণ করছে। যখনই অরিন্দম মণি হাতে নেয়, দূর থেকে ভৈরব অনুভব করে সেই শক্তির স্পন্দন, যেন অগ্নিশিখা তার নিজের দিকেও ছুটে আসছে। এই টানই তাকে আরও মরিয়া করে তোলে, আর তার কণ্ঠে ফিসফিস করে ভেসে আসে—“মণি যদি আমার হাতে আসে, তবে সমগ্র কামরূপ আবার অন্ধকারের বশীভূত হবে।”

কিন্তু ভৈরব তান্ত্রিকের শক্তি যত ভয়ঙ্করই হোক, তার লোভ তাকে অন্ধ করেছে। সে বুঝতে পারে না, মণি শুধু শক্তির আধার নয়, এক অনন্ত পরীক্ষার প্রতীক। যে একে পাবে, তাকে শুদ্ধতার আগুনে দগ্ধ হতে হবে। অরিন্দম এখনো সেই আগুনের স্বাদ পায়নি পুরোপুরি, কিন্তু তার অন্তর ভয় ও দ্বিধায় জর্জরিত। অবন্তিকা বারবার তাকে সতর্ক করে, কখনো সরাসরি, কখনো ঘুরিয়ে—“সবাই তোমার মঙ্গল চায় না।” তবুও অরিন্দমের মনে প্রশ্ন জাগে, অবন্তিকা কি নিজেই ভৈরবের ছায়ার সঙ্গে যুক্ত নয়? ভৈরব এদিকে এক জটিল যজ্ঞের প্রস্তুতি নিচ্ছে, যেখানে মানববলির আভাস পাওয়া যায়। রাতের আঁধারে শ্মশান তার ক্ষেত্র, আর সেখানে আগুন, রক্ত আর মন্ত্রের মিলনে সে গড়ে তুলতে চায় এক অদম্য ক্ষমতা। তার চোখে শুধু একটাই লক্ষ্য—অরিন্দমকে ধ্বংস করে মণি ছিনিয়ে নেওয়া। কামাখ্যার শান্ত পরিবেশের আড়ালে তাই তৈরি হচ্ছে এক অশুভ ঝড়, যার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে ভৈরব তান্ত্রিক, আর যার ছায়া ধীরে ধীরে অরিন্দম ও অবন্তিকার জীবনের চারপাশে ঘনিয়ে আসছে।

অবন্তিকার পথনির্দেশে অরিন্দম পৌঁছায় নীলাচলের এক বিস্মৃত গুহায়, যার প্রবেশপথ ঝোপঝাড় আর পাথরের আড়ালে ঢাকা। গুহার ভেতর ঢুকতেই সে অনুভব করে বাতাসে এক অদ্ভুত ঘনত্ব, যেন সময় সেখানে থমকে আছে বহু যুগ ধরে। দেওয়ালে আঁকা প্রাচীন তান্ত্রিক চিহ্ন, যজ্ঞকুণ্ডের ছাই, আর ভাঙাচোরা মূর্তির ভেতর থেকে ভেসে আসে এক প্রাচীন শক্তির অনুরণন। অবন্তিকার কণ্ঠস্বর গম্ভীর হয়ে ওঠে—“এই গুহাই একসময় প্রাচীন তান্ত্রিক গুরুদের সাধনাস্থল ছিল। এখানে যে শক্তি লুকিয়ে আছে, তা মানুষকে সময়ের স্রোত নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দেয়। কিন্তু সেই শক্তি যেমন আলোকময়, তেমনি অন্ধকারও সৃষ্টি করতে পারে।” অরিন্দম ধীরে ধীরে মণিটি বের করে আনে, যার আভা অন্ধকার গুহাটিকে এক অদ্ভুত নীলচে আলোয় ভরে তোলে। মণির দীপ্তি দেওয়ালের প্রতিটি প্রতীকের ওপর প্রতিফলিত হয়ে এক এক করে জীবন্ত হয়ে ওঠে, যেন শতাব্দী পুরনো মন্ত্র আবারো উচ্চারিত হচ্ছে। অবন্তিকা তাকে সতর্ক করে দেয়—“এটি তন্ত্রের পরীক্ষা। তুমি যদি নিয়ন্ত্রণ হারাও, তবে শক্তি তোমাকে গ্রাস করবে।” অরিন্দম চোখ বন্ধ করে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করে, আর তার মস্তিষ্কে ভেসে ওঠে সময় থেমে যাওয়ার দৃশ্য—পাখির উড়ে যাওয়া মাঝআকাশে থেমে আছে, ঝরনার জল বাতাসে স্থির হয়ে আছে, আর তার হৃদস্পন্দন যেন ধ্বনিহীন হয়ে গেছে।

কিন্তু সেই নিস্তব্ধতার মাঝেই অরিন্দম দেখতে শুরু করে অদ্ভুত কিছু চিত্র। এক অগ্নিঝরা আকাশ, চারদিকে রক্তলাল অগ্নিস্রোত, মাটিতে মানুষের দেহ ছড়িয়ে আছে। আর সেই ভীতিকর দৃশ্যের কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে আছে ভৈরব তান্ত্রিক—তার কপালে কালো বিভীষণ টিলক, চোখে হিংস্র জ্যোতি, আর হাতে অরিন্দমের মণি। সে বিজয়ের উন্মাদনায় চিৎকার করছে, আর তার প্রতিটি মন্ত্রোচ্চারণে পৃথিবীর বুকে আরও অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ছে। অরিন্দম বুঝতে পারে, এটা শুধু এক দুঃস্বপ্ন নয়, বরং ভবিষ্যতের এক সম্ভাব্য রূপ। মণির শক্তি যদি ভৈরবের হাতে পড়ে, তবে পৃথিবীর ভারসাম্য ভেঙে পড়বে। হঠাৎই দৃশ্যপট বদলে যায়—সে দেখে অবন্তিকা কাঁদছে, তার চারপাশে কালো শিকল জড়িয়ে আছে, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে বন্দি করেছে। অরিন্দম চমকে উঠে চোখ খুলতে চেষ্টা করে, কিন্তু মণির শক্তি তাকে আরও গভীরে টেনে নেয়। তার শরীর কাঁপতে শুরু করে, রক্তে অদ্ভুত উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে, এবং মাথার ভেতরে কেউ ফিসফিস করে বলে—“তুমি এই শক্তির যোগ্য নও… এটিকে ছেড়ে দাও… নইলে ধ্বংস আসন্ন।” গুহার দেয়ালে প্রতিধ্বনি ওঠে, যেন সেই কণ্ঠস্বর গুহার ভেতরেই বাস করে। অবন্তিকা অরিন্দমকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে ওঠে—“তুমি যদি হার মানো, তবে সব শেষ হয়ে যাবে!”

অবশেষে অরিন্দম এক প্রবল শক্তি প্রয়োগ করে মণিকে বুকে চেপে ধরে চোখ খুলে ফেলে। গুহার আলো নিভে যায়, প্রতীকগুলো নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে, আর সময় আবার স্বাভাবিক গতিতে প্রবাহিত হয়। চারদিকে গুহার নিস্তব্ধতা ফিরে আসে, কিন্তু অরিন্দমের শরীর জুড়ে ঘাম জমে গেছে, তার শ্বাসপ্রশ্বাস ভারী হয়ে উঠেছে। অবন্তিকা তাকে জড়িয়ে ধরে বলে—“তুমি আজ তন্ত্রের প্রথম পরীক্ষা পেরিয়েছো। কিন্তু মনে রেখো, মণি শুধু শক্তি দেয় না, ভবিষ্যতের সতর্কবার্তাও দেখায়। যা তুমি দেখেছো, সেটি এক সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ—ভৈরব যদি মণি দখল করে, তবে পৃথিবী ধ্বংসের দিকে যাবে।” অরিন্দম চোখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলে—“তাহলে আমাকে যেভাবেই হোক, তাকে থামাতে হবে।” অবন্তিকার চোখে এক অদ্ভুত অশ্রুজল চিকচিক করে ওঠে, যেন সে জানে এর পথ সহজ হবে না। দূরে কোথাও বজ্রপাতের শব্দ ভেসে আসে, পাহাড় কেঁপে ওঠে, আর অরিন্দম বুঝতে পারে তার পথের পরীক্ষাগুলো মাত্র শুরু হলো।

অরিন্দমের মনে তখন যেন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। গুহার অন্ধকারে বসে সে হাতে ধরা মণির দিকে তাকায়, যার আলো মাঝে মাঝে তার চোখে পড়ে মায়ার মতো ঝলসে উঠছে। সে স্পষ্ট অনুভব করতে পারে, মণির ভিতরে যে শক্তি লুকিয়ে আছে, তা একদিকে ধ্বংস আনতে সক্ষম, আবার অন্যদিকে অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে পারে। ঠিক সেই মুহূর্তেই তার হৃদয়ের গভীর থেকে এক অচেনা আকাঙ্ক্ষা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে—যদি সে মণির শক্তি ব্যবহার করে মাকে ফিরিয়ে আনতে পারে? ছোটবেলায় দুর্ঘটনায় হারানো মায়ের মুখ এখনো তার মনের পর্দায় জীবন্ত হয়ে ভেসে ওঠে। মায়ের সেই স্নেহমাখা কণ্ঠস্বর, মায়ের হাতের উষ্ণতা—এসব তার জীবনে চিরকালই এক অভাব হয়ে থেকেছে। মণির সামনে দাঁড়িয়ে সেই অভাব মেটানোর সুযোগ যেন হাতের নাগালে চলে এসেছে। কিন্তু এই ভাবনা সঙ্গে সঙ্গেই তাকে অস্থির করে তোলে। সে বুঝতে পারে, এই আকাঙ্ক্ষা যদি তাকে গ্রাস করে, তবে সে আর মহেশ্বর নাথের প্রকৃত শিষ্য হয়ে উঠতে পারবে না।

তবুও, মণির আলো তাকে যেন ক্রমে নিজের দিকে টেনে নিতে থাকে। অরিন্দমের মনে পড়ে তার জীবনের সেই সব মুহূর্ত, যখন সে অসহায় হয়ে পড়েছিল—বন্ধুদের অবিশ্বাস, সমাজের উপহাস, আর নিজের একাকিত্ব। তার অন্তরে ক্ষত জমা হয়েছিল বছরের পর বছর ধরে, আর এখন মনে হচ্ছে মণি সেই ক্ষত মুছে ফেলতে পারে। যদি সে মণিকে দিয়ে অতীতের ভুলগুলো বদলে দিতে পারে? যদি সে নিজের জীবনটা নতুন করে লিখে ফেলতে পারে? এই চিন্তা একদিকে তাকে শক্তি দেয়, অন্যদিকে ভীষণ ভয়ও দেখায়। কারণ সে জানে, মণির শক্তি যতটা আশীর্বাদ হতে পারে, ততটাই অভিশাপও হয়ে উঠতে পারে। এই দ্বিধা তাকে এক ভয়ঙ্কর অগ্নিপরীক্ষার মধ্যে ঠেলে দেয়। চোখ বন্ধ করলে সে দেখতে পায় এক ভয়ংকর দৃশ্য—মণি ভৈরবের হাতে চলে গেছে, পৃথিবী অন্ধকারে ডুবে গেছে, মানুষ মানুষকে হত্যা করছে, আর সভ্যতা ধ্বংসের দিকে এগোচ্ছে। কিন্তু চোখ খুললেই মনে হয়, যদি সে মাকে ফিরিয়ে আনতে পারে, তবে অন্তত তার নিজের পৃথিবীটা আলোকিত হবে। এই টানাপোড়েন তাকে নিঃশ্বাস নিতে দেয় না।

ঠিক তখনই অবন্তিকার কণ্ঠস্বর তার মনে প্রতিধ্বনিত হয়। অবন্তিকা বলেছিল, “তুমি যদি নিজের দুর্বলতার কাছে হার মানো, তবে মণি তোমাকে গ্রাস করবে।” এই সতর্কবার্তা তার মনের ভেতর আগুনের মতো জ্বলতে থাকে। অরিন্দম বুঝতে পারে, এই আগুন থেকে বাঁচতে হলে তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—নিজের ব্যক্তিগত শোক ও আকাঙ্ক্ষার কাছে নত হবে, নাকি বৃহত্তর দায়িত্ব পালন করবে। তার অন্তরের দ্বন্দ্ব তখন জ্বালামুখীর মতো ফেটে বেরোচ্ছে। সে চিৎকার করে ওঠে, মায়ের নাম ধরে কাঁদে, আবার কিছুক্ষণ পর নিজেকেই ধমক দেয়, “না, আমি দুর্বল হতে পারি না।” অন্ধকার গুহার দেয়ালে তার সেই চিৎকার প্রতিধ্বনিত হতে থাকে, যেন প্রকৃতিও তার দ্বন্দ্বের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শেষমেশ সে উপলব্ধি করে, এই দ্বন্দ্ব তাকে আরও শক্তিশালী করছে, যদিও সেই শক্তি আসছে এক ভয়াবহ যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে। মণি তার হাতে তখন জ্বলছে, আর তার ভেতরে দ্বিধা ও দায়িত্বের এই আগুন এক ভয়ংকর সঙ্কটের দিকে তাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে—যেখানে তাকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

পূর্ণিমার রাত্রি। আকাশে রক্তাভ চাঁদ উঠতেই কামাখ্যা মন্দির ও তার আশেপাশের কানন যেন অন্য এক অলৌকিক শক্তিতে মোড়ানো হয়ে উঠল। ঢাক, শঙ্খ, আর আগুনের আলোর মধ্যে মহাযজ্ঞ শুরু হল। সাধকরা অগ্নিকুণ্ড ঘিরে মন্ত্রপাঠ করছে, কিন্তু সেই মন্ত্রোচ্চারণের ভিতর লুকিয়ে আছে এক ভয়াবহ অশনি সংকেত। হঠাৎ করেই গম্ভীর এক হাহাকার মন্দির প্রাঙ্গণে ছড়িয়ে পড়ল—প্রতিনায়ক ভৈরবের আবির্ভাব। তার কালো বস্ত্রে আগুনের শিখা প্রতিফলিত হয়ে ভয়ঙ্কর আভা তৈরি করছিল। তার কণ্ঠে গর্জন, “আজ মণি আমার হবে, কেউ আটকাতে পারবে না।” ভৈরব তান্ত্রিকের চোখে ছিল দহনশক্তি, আর তার হাতে তন্ত্রমুদ্রা জ্বলে উঠছিল। এই আক্রমণের সামনে দাঁড়াতে বাধ্য হল অরিন্দম। সে জানে, এই রাতেই মণির ভাগ্য নির্ধারিত হবে।

দুই তান্ত্রিক শক্তির সংঘর্ষ যেন পাহাড়-পর্বতের ভূমিকম্পের মতো। ভৈরব মন্ত্রোচ্চারণ করে অগ্নির শিখাকে ঝড়ের মতো ছুড়ে দিচ্ছিল, আর অরিন্দম মণির দীপ্তি দিয়ে প্রতিটি আক্রমণ প্রতিহত করছিল। চারিদিকে আগুন, বজ্রপাত, আর অশরীরী ছায়ার হাহাকার ছড়িয়ে পড়ল। মন্দিরের প্রাচীন গম্বুজ কেঁপে উঠছিল প্রতিটি সংঘর্ষে, যেন ইতিহাস নিজেই ভেঙে পড়তে চায়। দর্শনীয় যজ্ঞভূমি মুহূর্তে রণক্ষেত্রে পরিণত হল। এই যুদ্ধের মাঝেই অরিন্দম নিজের দ্বন্দ্বের ভেতরে লড়ছিল—সে কি মণিকে ব্যবহার করবে নিজের স্বার্থে, নাকি পৃথিবীকে রক্ষা করবে? এই বিভ্রান্তির সুযোগ নিতে চাইল ভৈরব, অগ্নিদণ্ড ছুড়ে দিয়ে অরিন্দমকে আঘাত করল। অরিন্দম কিছুটা পিছলে গেলেও মণির আলো তাকে রক্ষা করল। সেই মুহূর্তে অবন্তিকা এগিয়ে এল, তার মুখে গাম্ভীর্য, চোখে অচেনা দীপ্তি।

অবন্তিকা তখন প্রকাশ করল সেই গোপন সত্য, যা এতদিন লুকিয়ে ছিল। সে বলল, “অরিন্দম, আমি কোনো সাধারণ মানুষ নই। আমি জন্ম থেকেই এই মণির রক্ষাকারী শক্তি। এই দায়িত্ব আমার রক্তে, আমার প্রাণে বয়ে চলেছে।” অবন্তিকার শরীর থেকে তখন এক অদ্ভুত আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছিল, তার চুল বাতাসে উড়ছিল, আর তার কণ্ঠ যেন দেবীর উচ্চারণ। ভৈরব এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল, কিন্তু তাড়াতাড়ি আবার উন্মত্ত হয়ে উঠল, কারণ সে বুঝেছিল এই প্রকাশ তার জন্য আরও ভয়ঙ্কর। অবন্তিকার শক্তি আর অরিন্দমের মণি—এই দুই একত্রিত হলে তাকে আর রোখা যাবে না। মন্দিরকাননে আগুন জ্বলতে থাকল, রক্তচন্দ্র আকাশে জ্বলজ্বল করতে থাকল, আর শুরু হল তন্ত্রের সর্বশেষ সংঘর্ষ। এটি শুধু মণির জন্য যুদ্ধ নয়, বরং মানুষের লোভ আর সত্যিকারের দায়িত্বের মধ্যে এক মহাযুদ্ধ।

মন্দিরকাননে তখন রক্তচন্দ্রের আবেশ এখনও ঝুলে আছে, আর সেই ভয়াল মুহূর্তেই ভৈরব তার সমস্ত কূটচাল সফল করে মণি ছিনিয়ে নেয়। অরিন্দমের চোখের সামনে থেকে ভৈরব মণি উঠিয়ে নেবার পরপরই যেন চারদিক অন্ধকারে ঢেকে যায়—মহাশক্তির এক অদ্ভুত প্রবাহে আকাশের তারা কেঁপে ওঠে। অরিন্দম তখন ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ছে, কারণ সে জানে এ মণি কেবল এক তান্ত্রিক শক্তির প্রতীক নয়, এটি গোটা পৃথিবীর জীবনীশক্তি। ভৈরবের হাতে পড়লে মানুষ, প্রকৃতি, আর দেবশক্তি—সবই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়াবে। মুহূর্তের মধ্যে ভৈরব মণির প্রভাব ব্যবহার করে ভয়ংকর আভা ছড়িয়ে দেয়, চারদিকের গাছপালা শুকিয়ে যায়, প্রাণীরা ভয়ে পালিয়ে যায়, আর মন্দিরের পুরোনো দেওয়ালগুলোতে ফাটল ধরতে থাকে। অরিন্দম কিছুক্ষণের জন্য অসহায়তার গহ্বরে তলিয়ে যায়, কিন্তু সেই মুহূর্তেই গুরু প্রদত্ত শিক্ষার প্রতিধ্বনি তার মনে জেগে ওঠে—”শক্তি পাওয়ার চেয়ে বড় হলো শক্তিকে নিয়ন্ত্রণের সাধনা।” তার মনে পড়ে অন্ধ সাধুর সেই অগ্নিকথা, যেখানে তিনি শিখিয়েছিলেন আত্মশক্তি জাগ্রত হলে বাইরের মণি প্রয়োজন হয় না। আবার অবন্তিকার বলা সেই কথাও মনে পড়ে—“তুমি কেবল উত্তরাধিকারী নও, তুমি নিজেই রক্ষক।” এই সব স্মৃতি মিলেমিশে অরিন্দমের ভেতরে নতুন এক আগুন প্রজ্জ্বলিত করে, আর সে বুঝতে পারে এই যুদ্ধে তাকে ভেতর থেকে জাগতে হবে, কেবল বাহ্যিক অস্ত্র দিয়ে নয়।

ভৈরব তখন তার অন্ধকার মন্ত্রোচ্চারণে আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে। তার চোখে রক্তিম আগুন, হাতে মণি উঁচিয়ে সে এমন এক শক্তি আহ্বান করে যা পৃথিবী কাঁপিয়ে দিতে পারে। হঠাৎ আকাশে বিদ্যুৎ চমকায়, বজ্রগর্জনে চারপাশ কেঁপে ওঠে, আর সেই বজ্রের আলোতে অরিন্দম যেন নিজের ভেতরের রূপ দেখে ফেলে—সে আর কেবল এক মানব নয়, সে উত্তরাধিকারী, যার রক্তে প্রাচীন সাধকদের সাধনা বহমান। এই উপলব্ধি মুহূর্তেই তার চেতনাকে পরিবর্তন করে দেয়। সে নিজের দুই হাত মুঠো করে শক্তি আহ্বান করে, আর মণিহীন হয়েও তার শরীর থেকে তীব্র আলোকবিস্ফোরণ ছড়িয়ে পড়ে। ভৈরব প্রথমে ঠাট্টা করে বলে ওঠে—”মণি ছাড়া তুই কিসের সাধক?” কিন্তু পরক্ষণেই ভয় পেয়ে যায়, কারণ অরিন্দমের ভেতরের শক্তি ক্রমে মণির প্রভাবকে প্রতিহত করতে থাকে। এই যুদ্ধে অস্ত্র নয়, বরং আত্মশক্তি আর বিশ্বাসই সবচেয়ে বড় হয়ে ওঠে। অরিন্দম ধ্যানমগ্নের মতো মন্ত্র জপ করতে শুরু করে, আর অবন্তিকা তার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে আত্মবিশ্বাস জোগায়। মন্দিরকানন তখন দুই বিপরীত শক্তির সংঘর্ষে আগ্নেয়গিরির মতো উত্তাল—একদিকে ভৈরবের অন্ধকার, অন্যদিকে অরিন্দমের আলোক। ক্রমে ক্রমে ভৈরবের ডাকে আসা অশুভ শক্তিগুলো দুর্বল হতে শুরু করে, কারণ অরিন্দমের অন্তরের আলো তাদের জ্বালিয়ে দিচ্ছে। ভৈরব মরিয়া হয়ে মণিকে আরও শক্তি দিতে বলে, কিন্তু মণি নিজেই যেন কেঁপে ওঠে—সে আসল উত্তরাধিকারীকে চিনতে পেরেছে।

অবশেষে সেই মহাযুদ্ধের পরিণতি আসে। অরিন্দমের সমস্ত শক্তি এক বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত হয়, আর সে ভৈরবের দিকে অগ্নিবাণের মতো ছুটে যায়। ভৈরব শেষ চেষ্টা করে অরিন্দমকে রুখতে, কিন্তু নিজের অন্ধকারে এতটাই ডুবে যায় যে মণিও তাকে আর সাড়া দেয় না। এক মহা বিস্ফোরণে ভৈরব মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, তার শরীর থেকে অন্ধকার ধোঁয়ার মতো শক্তি বেরিয়ে গিয়ে শূন্যে মিলিয়ে যায়। মণি তখন নিজে থেকেই অরিন্দমের হাতে ফিরে আসে, যেন তার প্রকৃত উত্তরাধিকারীকে স্বীকার করেছে। ক্লান্ত অরিন্দম মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে, চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে আসে, শুধু মন্দিরকাননের বাতাসে ভেসে আসে ধূপের গন্ধ আর প্রাচীন স্তোত্রের প্রতিধ্বনি। অবন্তিকা এগিয়ে এসে বলে—“তুমি এখন শুধু সাধক নও, তুমি মণির রক্ষক।” অরিন্দমের চোখে জল এসে যায়, কারণ সে জানে এই দায়িত্ব কেবল শক্তি নয়, এক অনন্ত বোঝা। কিন্তু একইসঙ্গে তার মনে গর্বও জেগে ওঠে—সে তার পূর্বপুরুষের যোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। ভৈরব ধ্বংস হয়েছে, অন্ধকার বিদূরিত হয়েছে, আর এখন পৃথিবী আবার স্বস্তি পেতে পারে। তবে অরিন্দম জানে, লড়াই শেষ নয়; প্রকৃত রক্ষককে চিরকাল সতর্ক থাকতে হয়। আর সেই সত্য উপলব্ধি করে সে দাঁড়িয়ে ওঠে, হাতে দীপ্তিমান মণি, চোখে প্রতিজ্ঞার অগ্নি—সে হবে সেই উত্তরাধিকারী, যে আলো দিয়ে অন্ধকারকে প্রতিহত করবে।

১০

কামাখ্যা মন্দিরের গোপন অগ্নিকুণ্ডের পথে যখন অরিন্দম এগোচ্ছিল, তখন তার শরীর ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছিল, কিন্তু মন ছিল দৃঢ় সংকল্পে দৃপ্ত। মণিটি তার হাতে দীপ্ত হয়ে উঠছিল, যেন নিজের ভাগ্যের শেষ মুহূর্তের অপেক্ষায় আছে। এই অগ্নিকুণ্ড ছিল এমন এক রহস্যময় স্থান, যেখানে যুগে যুগে দেবীশক্তির অবতাররা তাঁদের পূণ্যশক্তিকে বিসর্জন দিয়েছেন, যাতে তা আর কোনো মানুষের হাতে অপব্যবহারের শিকার না হয়। পথে আসা প্রতিটি ধাপেই অরিন্দমের মনে মায়ের মুখ ভেসে উঠছিল, সেই মমতাময়ী হাসি, যা সে একদিন হারিয়েছে। মণির টান ছিল প্রবল, একবার তার মনে হয়েছিল—এত কষ্টের পর যদি মণিকে পেয়ে সে নিজের অতীত বদলে দিতে পারে, তবে তার দুঃখ মুছে যাবে। কিন্তু ঠিক তখনই গুরুজীর কণ্ঠ তার ভেতরে প্রতিধ্বনিত হলো—“উত্তরাধিকার মানে শুধু শক্তি পাওয়া নয়, তার দায় নেওয়া।” এই উপলব্ধি তার সমস্ত দ্বিধাকে ভেঙে দিল। সে জানল, নিজের ব্যথা মুছে ফেলার লোভে যদি সে মণি রেখে দেয়, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সে এক অন্ধকারের পথ খুলে দেবে। তার কণ্ঠ শুকনো হলেও মনে এক গভীর স্পষ্টতা এলো—এই শক্তি তাকে ভোগ করতে হবে না, মুক্ত করতে হবে।

যখন সে অগ্নিকুণ্ডের সামনে পৌঁছল, তখন দৃশ্যটি যেন কোনো মহাযজ্ঞের মতো মনে হচ্ছিল। প্রাচীন শিলালিপি ঘেরা গুহার মধ্যে সেই অগ্নিকুণ্ড জ্বলছিল, লাল ও সোনালি আগুনের শিখা উঠছিল আকাশ ছুঁতে, যেন দেবী নিজে আগুনের রূপে অবতীর্ণ হয়েছেন। অবন্তিকা তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু তার মুখে এক অদ্ভুত শান্তি। সেই মুহূর্তে অবন্তিকা সত্য প্রকাশ করল—“আমার জন্মই হয়েছিল মণির রক্ষক হিসেবে। তোমার আজকের সিদ্ধান্তই আমার অস্তিত্বের পরিণতি।” অরিন্দম তার দিকে তাকাল, চোখে কৃতজ্ঞতা ও দুঃখ মিশে। মণিটি যখন অগ্নিকুণ্ডের শিখার উপরে ধরে সে বিসর্জনের মন্ত্র উচ্চারণ করল, তখন পুরো গুহা কেঁপে উঠল, যেন পৃথিবী একবার নিশ্বাস ফেলে থেমে গেছে। আগুনের শিখা মণিকে গ্রাস করল, দীপ্তি এক মুহূর্তে চোখ-ধাঁধানো আলো ছড়াল, আর তারপর ধীরে ধীরে সব নিভে এলো। অবন্তিকার শরীর আলোর ধুলোয় ভেঙে গেল, বাতাসে মিলিয়ে গেল তার অস্তিত্ব। সে যেন হাসি মুখে বিদায় নিল, কারণ দায়িত্ব পূর্ণ হয়েছিল। অরিন্দম হাত শূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু মনে হলো কাঁধের বোঝা শতগুণ হালকা।

শেষ দৃশ্যে সে গঙ্গার ঘাটে ফিরে বসেছিল। ভোরের আলো ধীরে ধীরে আকাশ ছুঁয়ে উঠছিল, সূর্যের প্রথম কিরণ গঙ্গার জলে ঝিকমিক করছিল। তার হাতে কোনো মণি নেই, পাশে অবন্তিকাও নেই, কিন্তু তার অন্তরে এক অনন্য শান্তি প্রবাহিত হচ্ছিল। গুরুজীর সেই কথাগুলো তার কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল—“উত্তরাধিকার মানে শুধু শক্তি পাওয়া নয়, তার দায় নেওয়া।” সেই মুহূর্তে অরিন্দম বুঝল, সে সত্যিই উত্তরাধিকারী হয়েছে—শক্তির নয়, দায়িত্বের। গঙ্গার জলে হাত ছুঁয়ে সে একরাশ ঠান্ডা অনুভব করল, যেন সমস্ত ক্লান্তি গলে যাচ্ছে। তার চোখ বুজে এল, আর মনে হলো অনেক দিন পরে সে সত্যিই মুক্ত, সত্যিই হালকা। মণিহীন অরিন্দম আজ এক অমূল্য প্রাপ্তির অধিকারী—শক্তি বিসর্জনের মধ্য দিয়ে সে খুঁজে পেয়েছে নিজের আসল শান্তি, নিজের মানবিকতার জয়।

-সমাপ্ত-

1000054045.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *