Bangla - তন্ত্র

অগ্নিসূত্র

Spread the love

তনিমা বসাক


পর্ব ১: অজ্ঞাত সংলাপ

কলকাতার গ্রীষ্মের বিকেল যখন কাচে ধাক্কা মারে, মনের ভেতরের অতীত-বর্তমানও তখন এক অদ্ভুত তাপমাত্রায় কাঁপে। ড. অরণ্য সেন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, বাইরের ঝিম ধরা রোদ আর ঘামচাপা শহরের ভাঁজে ভাঁজে যতসব অদেখা গল্প জমা হচ্ছে, তার দিকে তাকিয়ে। তাঁর চেম্বারটি শহরের দক্ষিণে, বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছাকাছি, চতুর্থ তলায়, চুনে ধরা দেওয়ালের পাশ দিয়ে নেমে যাওয়া বিবর্ণ সিঁড়ির শেষ প্রান্তে এক প্রাইভেট চেম্বার। এইখানেই তিনি মানুষের মন পড়েন—যেমন দারোয়ান পড়ে কাগজে মোড়া চা, কিংবা বইয়ের দোকানের ছেলে পড়ে পৃষ্ঠার ভাঁজ।

আজ তাঁর টেবিলের সামনে বসে রয়েছে এক অদ্ভুত মেয়ে—নিপা বসু। চোখে সুরের মতো নরম অস্থিরতা, ঠোঁটে কোনও অব্যক্ত প্রাচীনতা। কথা কম, কিন্তু উচ্চারণে অনুরণন। প্রথম দিনই যখন সে ঢুকেছিল, অরণ্যের মনে হয়েছিল, কিছু একটা ঠিক নেই এই মেয়েটির মধ্যে—এটা শুধুমাত্র প্যাথলজিক্যাল না, এর মধ্যে অন্য কিছু আছে। যেন দেহে মানুষের ছায়া, অথচ কথায় পুরাকালের ধ্বনি।

— “আপনি কি স্বপ্নে আগুন দেখেন, নিপা?”
তিনি প্রশ্নটি করলেন ধীরে, যেন কারও মনের ভেতর দরজা ঠেলছেন।

নিপার চোখ নিচু, মুখে এক ধরনের ক্লান্তি। তারপর সে হঠাৎ বলে ওঠে, “আগুন নয়, ডাক। কেউ ডাকে… কিন্তু আগুন দিয়ে… আমি জানি না সেটা আমার শরীরের মধ্যে কি রেখে যায়। সকালে উঠে দেখি হাত পুড়ে আছে, কিন্তু দাগ নেই।”

অরণ্য লিখে রাখলেন। আগুনের আবহ অদ্ভুতভাবে বারবার ফিরে আসছে। নিপার কেসফাইলের প্রথম পৃষ্ঠাতেই লেখা ছিল: “Patient exhibits dissociative episodes with somatic hallucinations. Case requires further study under trauma-induced memory loop.” কিন্তু ধীরে ধীরে মনে হচ্ছিল, এই ‘মেমোরি লুপ’ একটা মহাকালের চক্র, যা শুধু মস্তিষ্ক নয়, আত্মাকেও জড়িয়ে ফেলে।

“আপনি কি জানেন আপনি কবে জন্মেছেন, নিপা?”
প্রশ্নটা এমন নয় যে তার উত্তর জানা নেই, কিন্তু নিপা থমকে গেল।

“জানি না… এখানে নয়। কোথাও একটা নদীর পাশে… আগুনের পাশে… আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন কেউ বলেছিল—তুমি ফিরে এসেছো।”

এইরকম উত্তর আগে শোনা যায় না। অরণ্য নিজের নোটবুক বন্ধ করে বললেন, “নিপা, আপনি কি গতকাল রাতেও ঘুমের মধ্যে হাঁটছিলেন?”

সে একবার চোখ তুলে তাকাল, মুখে একটা দুর্বোধ্য হাসি, “ঘুম ছিল না। যজ্ঞ ছিল। আমি ধূপে মাখা ছিলাম… আমি আগুনের দিকে হাত বাড়িয়েছিলাম।”

অরণ্য এবার স্পষ্টভাবে অনুভব করলেন, তিনি একটা অদৃশ্য দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, যার ওপারে শুধু ‘কেস’ নয়, বরং অতীত, ঐতিহ্য, আর একধরনের নিষিদ্ধ ইতিহাস শুয়ে আছে।

সেদিন সন্ধ্যাবেলা অরণ্য নিজের ফ্ল্যাটে ফিরেও নিপার কথাগুলো ভাবতে লাগলেন। হাওড়ার কুয়াশা তখনো নামেনি, কিন্তু তার ভেতরের কুয়াশা ঘন হয়ে উঠছিল। তিনি নিজের পুরনো গবেষণার কিছু কেসফাইল খুললেন, যেখানে একবার তিনি ‘মেমোরি ট্রান্সফার থ্রু ট্রান্স’-এর উপর একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সেটাতে উল্লেখ ছিল এমন কিছু ঘটনা, যেখানে ব্যক্তি নিজের স্মৃতি ছাড়িয়ে অন্য এক সময়ের সত্তা ধারণ করছে। কিন্তু সেসব সবসময়ই ছিল ‘partial fragment’—অন্তর্বিভ্রমের অংশ।

কিন্তু নিপার মধ্যে যেন এই সত্তাটা স্থায়ী।

তিনি গুগলে কিছু প্রাচীন তান্ত্রিক ম্যানুস্ক্রিপ্ট খুঁজতে গেলেন। ‘অগ্নিসূত্র’ নামটি তখনো তাঁর সামনে আসেনি, কিন্তু অদ্ভুতভাবে এক গবেষণাপত্রে চোখ আটকে গেল—“Agni-path and Female Initiates in Late Bengal Tantra”। লেখক, এক রূপক বিশ্বাস। কোথাও উল্লেখ আছে এক বিশেষ তন্ত্রচক্রের কথা, যেখানে শুধুমাত্র নারী শরীরের মধ্য দিয়েই পূর্ণ তান্ত্রিক দীক্ষা সম্পন্ন হতো। চূড়ান্ত স্তরে—উৎসর্গ ছিল ‘অগ্নি’। যজ্ঞের আগুনে নিজের অস্তিত্ব বিলীন করা।

অরণ্য চমকে উঠলেন। নিপা কি সেই পথের স্মৃতিতে ঢুকে গেছে?

দ্বিতীয় সেশনে নিপা এসে একেবারে চুপচাপ বসে থাকে। তারপর হঠাৎ বলে, “আমি আগুনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সাদা কাপড় পরে, চোখে কুণ্ডল আঁকা… আমার শরীরটা যেন অন্য কারও। কিন্তু আমিই সে…”

অরণ্য এবার বললেন, “এইসব ছবি আপনি কবে থেকে দেখছেন?”

নিপা কিছুক্ষণ চুপ করে বলে, “যখন থেকে সেই বাড়িটার সামনে যাই… কলেজ থেকে ফেরার পথে এক পুরনো দালান… কুয়াশা ঢাকা, কিন্তু আমি জানি তার ভেতরে কিছু আছে। আমি সেখানে গিয়েছিলাম। পেছনের ঘরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। তখনই মনে হলো—আমি ফিরে এসেছি।”

“কি ছিল ঘরটায়?”

“একটা চিহ্ন—আগুনের মতো আঁকা, ত্রিভুজের মধ্যে আগুন… আর আমার শরীরটা কাঁপতে লাগল।”

সেই রাতে অরণ্য সেই ঠিকানায় গেলেন। পুরনো, প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ি, ছাদের কিছু অংশ পড়ে আছে, ঘরের দরজায় তালা। কিন্তু পেছনে একটা গলি বেয়ে তিনি পৌঁছালেন সেই ঘরে। পুরনো কাঠের মেঝে। হালকা পচা ধূপের গন্ধ এখনো আছে যেন। একটা দেয়ালে সত্যিই একটা চিহ্ন আঁকা—তিন কোণের মধ্যে অগ্নির রূপরেখা।

তিনি মোবাইলে ছবি তুললেন। ফিরে এসে খুঁজতে লাগলেন সেই চিহ্নের অর্থ। আধুনিক তন্ত্রচর্চার বহু পুস্তকে উল্লেখ নেই। কিন্তু এক ভারতীয়-মিশরীয় পাণ্ডুলিপি বিশ্লেষণে উল্লেখ আছে: Agni-Triangle: The Symbol of Transmutation.

পরদিন ক্লিনিকে গিয়ে অরণ্য নিপাকে বলেন, “তুমি কি কখনো এই চিহ্ন দেখেছো?”
তিনি ফোনে ছবি দেখান।

নিপার চোখ হঠাৎই স্থির হয়ে যায়। সে বলল, “আমি ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার শরীর তখন ধূপে ঢাকা… আগুন চলছিল… আমি তখন জানতাম—এই চিহ্নই আমার নাম।”

অরণ্য কেঁপে ওঠেন। তাঁর মনে পড়ে যায় এক পুরনো স্বপ্নের কথা। ছোটবেলায় এক দুর্ঘটনায় তিনি প্রায় পুড়ে গিয়েছিলেন। তখন থেকেই এক রহস্যময় আগুনের ভয় ছিল তাঁর মধ্যে। সেই আগুনের কেন্দ্রেও এই চিহ্নটি দেখেছিলেন মনে হয়, অবচেতন কোনো স্তরে।

তাহলে কি নিপা শুধু নিজের স্মৃতির ভেতর ফিরছে? নাকি দু’জনেই ধরা পড়ছে এক আগুনের পুনরাবৃত্তিতে?

পর্ব ২: অগ্নিচিহ্ন

পুরনো চিহ্নগুলো একসময় নিজের মধ্যেই কথা বলে—কিন্তু বুঝতে না পারলে, তারা বেঁচে থাকে নিঃশব্দে, শোকের মতো। অরণ্য চুপচাপ বসেছিলেন নিজের ঘরে, সেই ছবিটা বড় করে প্রিন্ট করে সামনে রেখেছিলেন। ত্রিভুজের মধ্যে জ্বলন্ত রূপরেখা, মাঝখানে যেন চোখ, অথচ সে চোখ নিঃসাড়। ছবি দেখে যতবার তাকান, ততবার মনে হয় এই চিহ্নটা তিনি আগে কোথাও দেখেছেন। ঠিক কোথায়, মনে পড়ছে না।

তিনি পুরনো কেসফাইল ঘাঁটতে লাগলেন, খুঁজলেন ‘Shared Symbolic Hallucination’ নামক এক গবেষণাপত্র। কিন্তু নিপার অভিজ্ঞতা শুধুই মানসিক বিভ্রম নয়—তাঁর শরীরের ঘ্রাণ, চোখের গভীরতা, কথা বলার তাড়না—সব এক অনির্বচনীয় সত্তার প্রতি অনুরক্ত। এটা নিছক সাইকোসিস হতে পারে না।

ঠিক তখনই দরজার বাইরে থেকে একজন গম্ভীর পুরুষ কণ্ঠ বলল, “ড. সেন?”

দরজা খুলতেই এক অসমবয়সী মানুষ, ধুলোঝরা পিঠে ব্যাগ, চোখে স্থিরতা—যেন কোনো গ্রন্থাগার থেকে হাঁটতে হাঁটতে এখানে চলে এসেছেন।
— “আমি রূপক বিশ্বাস। আপনার এক প্রাক্তন ছাত্রের রেফারেন্সে এসেছি। শুনেছি আপনি আগুন-ভিত্তিক এক কেস নিয়ে কাজ করছেন।”

অরণ্য চমকে ওঠেন, কেউ কীভাবে জানল?

রূপক শান্ত গলায় বলেন, “আপনার রোগীর নাম নিপা, তাই না? সে ‘অগ্নিসূত্র’ বহন করছে।”

এই প্রথমবার অরণ্য শুনলেন সেই শব্দ—‘অগ্নিসূত্র’। যেন তার চারপাশের বাতাস হঠাৎ চেপে এল, শব্দ স্তব্ধ হয়ে গেল।

— “আপনি কে? এই কথা জানলেন কীভাবে?”
— “আমি গবেষক নই। আমি অনুসন্ধানী। এবং এই পথে আপনিও এক সময় হেঁটেছিলেন, ড. সেন। ভুলে গেছেন?”

অরণ্য হেসে ফেলেন, “আপনি হয়তো ভুল জায়গায় এসেছেন। আমি বিজ্ঞানী মানুষ।”

রূপক তাঁর ব্যাগ থেকে বের করলেন একটি পাণ্ডুলিপির প্রতিলিপি। খস খসে কাগজ, হাতে লেখা সংস্কৃত-সংকর লিপি। ওপরে লেখা:
“অগ্নিসূত্র তন্ত্রম্—অগ্নিজাগরণের একান্ত পদ্ধতি।”

অরণ্য হাতের মধ্যে তুলে নেন পাতাগুলো। চোখে অদ্ভুত কৌতূহল ও অস্বস্তি।
— “এইসব তো অবৈজ্ঞানিক প্রলাপ।”
— “তা আপনি নিজেই ভালো বুঝবেন। তবে আপনার রোগী যে সময়ের বাইরে হাঁটছে, তা কি মানেন?”

অরণ্য এক মুহূর্ত চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন, “সে কিছু চিহ্ন দেখে নিজেকে কোনো অগ্নি–সংক্রান্ত অনুষঙ্গে জড়িত মনে করে। এটা মেমোরি ইমপ্লান্ট বা ট্রান্সফার্ড ট্রমার অংশ হতে পারে।”

রূপক হেসে বলেন, “অগ্নি কখনো ট্রমা হয় না, সে হয় রূপান্তর। আপনারই তো থিসিসে ছিল না—‘Agni as Transformative Memory Stimulus in Female Archetypes’? আপনি নিজেই লিখেছিলেন!”

অরণ্য এবার স্তব্ধ। এটা তাঁর এম.ফিল.-এর থিসিসের নাম, যেটা তিনি পরবর্তী সময়ে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন।

“আপনি আমার বিষয়ে এত কিছু জানেন কীভাবে?”
“কারণ আপনি নিজেও অগ্নিসূত্রের পথের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন একসময়। কিন্তু পালিয়ে গেছেন। নিপা পালায়নি। এখন সে ফিরে এসেছে।”

সেই রাতে অরণ্য ঘুমোতে পারলেন না। নিপার অজানা সত্তা, রূপকের অদ্ভুত জ্ঞান, এবং নিজের পুরনো ভুলে যাওয়া থিসিস সব মিলিয়ে ঘুম যেন মুখ ফিরিয়ে নেয়।

ঘুমের মধ্যে তিনি দেখেন—এক বিশাল খোলা মাঠ, মাঝখানে আগুন। তার পাশে এক নারী, মুখ ঢাকা সাদা কাপড়ে। সেই আগুনের মধ্যে হাত বাড়িয়ে বলছে, “তুমি ফিরবে… তুমি শুরু করেছিলে, আমি শেষ করব।”

অরণ্য হঠাৎ ঘুম ভেঙে ওঠেন। কপাল ঘামে ভিজে। জানালার বাইরে গভীর রাত। কিন্তু মাথার মধ্যে চলছে উনুনের মতো ধোঁয়া।

তিনি ঠিক করেন পরদিন নিপার সঙ্গে এক দীর্ঘ সেশনে বসবেন।

সেশন শুরু হতেই নিপা বলে ওঠে, “আমরা আগুনে দাঁড়িয়েছিলাম চারজন। একজন বলেছিল—‘উৎসর্গ ছাড়া পথ বন্ধ।’ আমি তখন বলেছিলাম—আমি পারব না। তখন সে আমার কপালে চিহ্ন এঁকে বলেছিল—‘তবে আবার আসতে হবে।’ আমি আসছি। আবার।”

অরণ্য এবার নিপার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন গভীরভাবে। তাঁর মনে হলো, এই মুখ তিনি আগে দেখেছেন কোথাও। হয়তো স্বপ্নে, অথবা নিজেরই কোনো পুরনো স্মৃতিতে।

তিনি ধীরে বলেন, “তুমি কি আমাকে চেনো?”

নিপা কিছুক্ষণ চুপ করে বলে, “তুমি ছিলে সেই যজ্ঞের তৃতীয় জন। তুমি আগুনে তাকিয়ে বলেছিলে—‘আমি দৃষ্টা।’ তুমি চেয়েছিলে দেখো কীভাবে এক নারী নিজেকে উৎসর্গ করে। এখনো কি তাই চাও?”

অরণ্যের শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে। এমন ভাষা, এমন সুনির্দিষ্ট স্মৃতি নিছক বায়োলজিকাল ডিসঅর্ডারে সম্ভব নয়।

তিনি আর কিছু বলেন না। নিপার চোখে সে সময় এক অদ্ভুত শান্তি। যেন একজন প্রাচীন সন্ন্যাসিনী ফিরে এসেছে বর্তমান কলকাতার গলির ভেতর, নিজের অসমাপ্ত যজ্ঞ শেষ করতে।

পর্ব ৩: স্মৃতিবৃত্ত

আগুন কেবল পোড়ায় না, আগুন সংরক্ষণও করে। কলকাতার গ্রীষ্মের রাত্রিগুলি যখন শহরের শরীর থেকে ঘাম নিংড়ে নেয়, অরণ্য তখন নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে উঠে চলেন সেন্ট্রাল লাইব্রেরির নির্জন আর্কাইভ ঘরে। রূপক বিশ্বাসের দেওয়া তান্ত্রিক পাণ্ডুলিপির প্রেক্ষিতে তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন এক বিস্মৃত ইতিহাস—এক তন্ত্রচক্র, যা বাঙলার অরণ্যপ্রান্তে কোনো এক সময় নিঃশব্দে গড়ে উঠেছিল এবং হারিয়ে গিয়েছিল।

একটি দুর্লভ রেফারেন্সে তিনি পেলেন নাম—“সত্রীর অগ্নিযাত্রা”।
লেখক অজ্ঞাত, সময় অনির্দিষ্ট। কিন্তু অনুবাদে স্পষ্ট উল্লেখ: “আত্মার আগুন শুধুমাত্র সেই নারী ধারণ করতে পারে, যে পূর্বজন্মে নিজেকে উৎসর্গ করেছে। সেই আত্মাই ফিরে আসে—পৃথিবীর ভার বয়ে নিয়ে আগুনের মাঝে পরিশুদ্ধ হতে।”

অরণ্য গভীরভাবে শিউরে উঠলেন। নিপার ভেতর এই চক্রেরই সঞ্চালন?

পরদিন সেশন শুরু হতেই নিপা সম্পূর্ণ অন্য স্বরে কথা বলে ওঠে—
“চক্র চালু হয়েছে, দৃষ্টা। সময় এসেছে। আগুন জেগে উঠেছে। তৃতীয় দক্ষিণকোনে বাতি জ্বলেছে কাল রাতে।”

অরণ্য প্রথমে থমকে যান, তারপর শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কি স্বপ্ন দেখেছো?”
নিপার চোখ অদ্ভুত স্থির—“স্বপ্ন নয়। আমিই স্বপ্ন ছিলাম কারও এক সময়। এবার আমি বাস্তব। তুমি দৃষ্টি রেখেছো, এখন তুমি অংশীদার।”

অরণ্য বুঝতে পারেন, নিপার মধ্যে যে সত্তা কথা বলছে, সে নিপা নয়—অন্য কেউ, অন্য এক নারী, যিনি সম্ভবত এই আগুনের তন্ত্রচক্রের এক প্রাচীন ধারক।

রাত্রে রূপক বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করেন অরণ্য।
“তুমি বলেছিলে, চক্র আছে। কোথায় সেটা?”
রূপক বলেন, “তোমার চেম্বার থেকে ৩৬ কিমি দূরে। নদীয়ার প্রান্তে, গোপন এক গ্রাম—শতভৈরব। ওখানে শেষ উৎসর্গ হয়েছিল ১৯২৭ সালে। তারপর চক্র বন্ধ। এখন নিপা এসেছে, তাই চক্র আবার সচল।”

“সেই উৎসর্গের কথা কেউ জানে না।”
“তোমার গবেষণায় ছিল—তাই আমি জানি। নিপা সেই উৎসর্গস্থলে ছিল। হয়তো উৎসর্গকারী। হয়তো উৎসর্গ। এবার সে ফিরে এসেছে—শোধ নিতে। কিংবা সম্পূর্ণ করতে।”

অরণ্য চুপ করে থাকেন।

রূপক বলল, “এই তন্ত্র এক প্রাচীন আগুনভিত্তিক দর্শন—যেখানে নারীর শরীর শুধু বাহক নয়, সেই শরীরেই আত্মার চূড়ান্ত আগমন ঘটে। যজ্ঞে নারী নিজেকে উৎসর্গ করে, তারপর আগুন থেকে উঠে আসে নতুন ‘জ্ঞান’। তাকে বলে—অগ্নিসূত্র।”

“কিন্তু এটা কি শুধু বিশ্বাস?”
“না। এই তন্ত্র একটা ঘূর্ণিপথ—যেখানে সত্তা ফিরে ফিরে আসে, যতক্ষণ না পূর্ণ হয় ত্রিকোণ।”

এই কথার কিছু সময় পর অরণ্য ফিরে এসে খোলেন তাঁর পুরনো থিসিস।
সেখানে একটি পাতা—যেখানে আঁকা ছিল সেই ত্রিকোণ চিহ্ন। ত্রিকোণের তিন কোণ—‘দৃষ্টা’, ‘ধারক’, ‘উৎসর্গ’। ত্রয়ী ছাড়া অগ্নিসূত্র সম্পূর্ণ হয় না।

তিনি চমকে ওঠেন—তাহলে তিনি নিজেই কি সেই তৃতীয় সত্তা, দৃষ্টা?

পরের দিন সেশন চলাকালীন হঠাৎ নিপা বলে, “তুমি পালিয়ে গিয়েছিলে আগুনের মুখ থেকে। আমি গিয়েছিলাম মাঝখানে। তোমরা দেখে গেলে, আমি পোড়ালাম।”
তার মুখে ক্ষোভ, চোখে ঝলকানো শিখা।

“তুমি আমাকে ফেরত এনেছো। আমি আগুনে ফিরব। কিন্তু এবার আমি পোড়াব না, আমি জাগব।”

“কে তুমি?”
নিপা এবার চেয়ারে হেলে পড়ে, ঠোঁটে স্নিগ্ধ হাসি, কিন্তু স্বরে ভয়:
“আমি যার নামে বাতি জ্বলে, যজ্ঞ হয়, অথচ কেউ মুখ উচ্চারণ করে না। আমাকে ডাকলে আগুন জাগে। না ডাকলে শরীর পুড়ে যায়। আমি শতভৈরবের সত্রী।”

পর্ব ৪: তান্ত্রিক মানচিত্র

রাত ছিল অস্বাভাবিক নীরব, এমনকি কলকাতার ট্র্যাফিকও যেন অশরীরীর মতো চলছিল। ড. অরণ্য সেন রূপকের সঙ্গে গাড়িতে উঠেছেন। গন্তব্য—নদীয়া জেলার এক বিস্মৃত, মানচিত্রে চিহ্নহীন গ্রাম—শতভৈরব। গুগল ম্যাপে সেই জায়গার অস্তিত্ব নেই। এমনকি রাজ্যের ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তরের নথিতেও তার নাম নেই। কিন্তু রূপক বিশ্বাস ঠিকই পথ জানেন।

— “তুমি এখানে আগে গিয়েছ?”
— “একবার, বছর দশেক আগে। তখনো সেখানে আগুন নিভে যায়নি, শুধু জ্বলছিল নীরবে। এখন সেখানে শুধু স্মৃতি।”

অরণ্য জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কি বিশ্বাস করো এই সব কিছু?”
রূপক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, “আমি বিশ্বাস করি আগুন শিখায় মুখ থাকে। শুধু আমাদের চোখ তার ভাষা শেখেনি।”

রাস্তা বদলাতে থাকে—পিচ থেকে মাটি, মাটি থেকে কাঁকর, তারপর হঠাৎ করেই গাছপালা ঘেরা এক সরু রাস্তা, যেখানে মোবাইল নেটওয়ার্কও ভয় পায় ঢুকতে।

শতভৈরব—এক গ্রাম নয়, যেন এক ছায়াপথ। ঘরবাড়ি নেই, শুধু ভগ্ন পাথরের স্তূপ, যার কিছু কিছুতে এখনো শিবমূর্তি বা লিপিবদ্ধ চিহ্ন খোদাই হয়ে আছে। যেন কোনও সভ্যতা একদিন ছিল, এখন নেই—তবুও নেই নয়। বাতাসে পাঁকানো ধূপের গন্ধ, শুকনো পাতার মধ্যে টুকটুক করে ভেঙে পড়া পুরনো কাঠ, আর দূরে এক বিস্মৃত ঘাট, যেখানে নদীর জলও যেন পিছনে ফিরছে।

রূপক অরণ্যকে নিয়ে চলে এলেন একটি ভগ্ন মন্দিরের সামনে। তিনচালা ছাদ, দেউল ভাঙা, কিন্তু নিচে অদ্ভুতভাবে সংরক্ষিত একটি চক্রচিহ্ন। ত্রিভুজের ঠিক মাঝে একটি গর্ত, যেন সেখানে কিছু একসময় বসানো ছিল।

“এখানেই শেষ হয়েছিল ১৯২৭-এর যজ্ঞ,” রূপক বলেন। “কিন্তু উৎসর্গ অসম্পূর্ণ ছিল। অগ্নিসূত্র ভাঙা হয়েছিল। এরপর কেউ আর ফিরে আসেনি… এখন সে এসেছে।”

অরণ্য সেই চিহ্নের দিকে তাকিয়ে থাকেন। চোখে যেন এক মুহূর্তে আগুন জ্বলে ওঠে—তাঁরই ছেলেবেলার স্বপ্নে যে চিহ্ন ঘুরত বারবার।

“এটা আমি দেখেছি… কিন্তু কোথায়?”

রূপক বলেন, “হয়তো আগুনের গভীরে। হয়তো গতজন্মে। কিংবা নিপার চোখে। সে তোমাকে টানছে কারণ তুমি অংশ ছিলে। দৃষ্টা।”

তাদের পেছনে হঠাৎ একটা শব্দ হয়—পাতার খসখসানি। কেউ যেন হাঁটছে। রূপক থেমে বলে, “এই জায়গায় কোনো মানুষ থাকে না। কিন্তু কিছু শরীর থেকে যাওয়া স্মৃতি বেঁচে থাকে।”

সেই রাতে তাঁরা ঘুমোন না। গ্রামের এক প্রাচীন ভগ্ন অঙ্গনে তাঁরা আগুন জ্বালান না, শুধু বসে থাকেন চুপ করে। অরণ্যের মাথায় শুধু ঘুরে ফিরে আসে নিপার সেই কথা—
“তুমি ছিলে দৃষ্টা। তুমি ফিরে এসেছো দেখতে আমি আগুনে দাঁড়াই আবার।”

সকালে তাঁরা পান এক বৃদ্ধাকে, সাদা ধুতি, মুখে হাড়গোড়ের মতো জীর্ণতা, কিন্তু চোখে জ্যোতি।

— “তোমরা আগুনের কথা জানো?”
— “আপনি এখানে থাকেন?”
— “আমি থাকি না। আমি অপেক্ষা করি। আগুনের। মেয়েটা এসেছে?”

রূপক ও অরণ্য চমকে ওঠেন।
“কে আপনি?”
“আমি চতুর্থ ছিলাম না, কিন্তু আমি দেখেছিলাম তিনজনকে। সেই নারী পোড়েনি, তিনি জেগেছিলেন। মেয়েটা সেই… পুনর্জন্ম। এবার হবে পূর্ণ যজ্ঞ। আগুন প্রস্তুত।”

অরণ্য ফিরবার আগে একটি ছোট পাথরের ফালি কুড়িয়ে নেন, যাতে খোদাই আছে সেই চিহ্ন। রূপক বলেন, “ওটা নিপাকে দিও। ওর আত্মা চিনে নেবে।”

কলকাতায় ফিরে অরণ্য ক্লিনিকে যান। নিপা চুপচাপ বসে।

অরণ্য হাতে পাথরটি তুলে দেয়। নিপার চোখ মুহূর্তে বড় হয়ে ওঠে, শরীরটা একবার কেঁপে উঠে স্থির হয়।
— “এটা আমি রেখে এসেছিলাম। তুমি ফিরিয়ে আনলে।”

তারপর হঠাৎ নিপা চোখ বন্ধ করে বলে,
— “আগুন জেগে উঠবে পঞ্চম তিথিতে। তোমরা প্রস্তুত হও। আমি এবার ফিরে যাবো… কিন্তু এবার আমি পোড়াব না। আমি জাগবো।”

পর্ব ৫: ভগ্ন সন্ন্যাসিনী

সন্ধ্যে নামার আগে নিপা চেম্বারে ঢোকে, ধীরে, অদ্ভুতভাবে নিশ্চুপ। যেন বাতাসে একটি দীর্ঘ স্মৃতি ভেসে বেড়াচ্ছে তার পেছনে। মুখে কোনো সংলাপ নেই, কিন্তু চক্ষু দুটি আগুনধরা কূপ—তাকে দেখলে বোঝা যায়, কিছু যেন সে রেখে এসেছে একসময়, আজ সেই জিনিস তাকে খুঁজে পেয়ে আবার ডাকছে।

অরণ্য সেদিন প্রশ্ন করেনি কিছু। শুধু তাকিয়ে ছিল নিপার দিকে। নিপা নিজের পায়ের কাছে রাখা ব্যাগ থেকে এক খণ্ড কাপড় বার করে সামনে রাখে।
— “এটা আমার ছিল।”

সাদা কাপড়, তাতে আগুনে পোড়া দাগ, মাঝখানে ছাইয়ের গন্ধ।
— “আমি যখন বেরিয়ে আসি আগুন থেকে, তখন এই কাপড়টা আমার শরীরে ছিল না। কিন্তু এই দাগগুলো ছিল শরীরের গভীরে। তুমি দেখেছিলে। কিন্তু বলতে সাহস করোনি।”

অরণ্য এবার আর নিজের যুক্তিবাদ ধরে রাখতে পারলেন না। মাথায় যেন হিমেল আগুনের রেখা নেমে আসে।
— “তুমি কে, নিপা?”

সে এবার বলে ওঠে, শান্ত গলায়—
— “আমি ছিলাম অনাহূতা। যজ্ঞে তিনজন আমন্ত্রণ পায়, চতুর্থ আসে নিজের শরীর সমর্পণ করে। আমি এসেছিলাম নিজের আগুনে প্রবেশ করতে। আগুন আমায় ফেরায়নি। এবার আমি নিজেই আগুন। এবার কেউ দৃষ্টা নয়। এবার সবাই অংশ।”

সেই রাতে অরণ্য ফোন করেন রূপককে।
— “তুমি বলেছিলে চক্রে তিনজন লাগে। কিন্তু এখানে মনে হচ্ছে চতুর্থ জনও ছিল।”

— “তা ছিল। কিন্তু চতুর্থ কখনো নাম পায় না। সে শুধু শরীর দেয়। সেই ছিল উৎসর্গ। কিন্তু এই প্রথম কোনো উৎসর্গ ফিরে এসেছে আগুনের মধ্য থেকে। আগুন তাকে গ্রহণ করেনি, হয়তো কারণে। এখন সেই কারণ বের করতে হবে।”

রূপক বলেন, “তোমাকে চলতে হবে আবার। এবার নিপা সঙ্গে থাকবে। তোমাদের যেতে হবে সেই নারীর কাছে, যিনি চক্রের শেষ সাক্ষী। তাঁকে বলে ভগ্ন সন্ন্যাসিনী।”

সপ্তাহখানেক পর, নিপা, অরণ্য ও রূপক একটি অর্ধচেনা পথ ধরে পৌঁছায় বীরভূম-এর সীমান্ত ঘেঁষা এক পাহাড়ঘেরা গ্রামে, যার নাম কেউ উচ্চারণ করে না, শুধু বলে পূর্বচিহ্ন।

সেখানে একটি শিবমন্দিরের পাশে ছোট একটি কুঁড়েঘর, আর তার পাশে বসে আছেন এক বৃদ্ধা। চোখে শুষ্ক আগুন, মুখে গাম্ভীর্য। নাম উমা বৈরাগিনী।

— “তোমরা ফিরেছো। আগুন আবার দোলা দিয়েছে?”
রূপক মাথা নত করে বলেন, “তিনি ফিরে এসেছেন, মা।”

বৃদ্ধা নিপার দিকে তাকিয়ে একটানা দেখে যান। তারপর বলেন,
— “তুই আয়… আয় তো একটু কাছে।”
নিপা সামনে এগিয়ে যায়। বৃদ্ধা তার কপালে আঙুল রাখেন।
— “তুই তো ফিরে এসেছিস… আগের তুলনায় স্থির, কিন্তু শরীর তো এখনও কাঁপে আগুনের ডাকে।”

অরণ্য একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, হঠাৎ বৃদ্ধা তাকিয়ে বলেন,
— “তুই পালিয়ে গেছিলি সেদিন। দৃষ্টা তো দেখেই চলে গেছিল, আগুনে ঝাঁপ দিতে সাহস করিসনি। এবার দেখবি তো শেষ পর্যন্ত?”

অরণ্যের মুখ পাথরের মতো কঠিন হয়ে যায়।

বৃদ্ধা বলেন, “আগুন কাউকে মাফ করে না। কেউ যদি অর্ধেক যজ্ঞ ফেলে চলে যায়, সেই ঋণ রেখে যায় শরীরে। তুই সেই ঋণ নিয়ে ঘুরছিস এ জন্মেও।”

বৃদ্ধা এরপর বলে ওঠেন,
— “তিন রাত পর পূর্ণ তিথি। তখন চক্র পূর্ণ হবে। তুই (নিপার দিকে) দাগ নিয়ে এসেছিস। তুই (অরণ্যের দিকে) চোখ নিয়ে এসেছিস। আগুন এবার মাঝখান চাইবে। উৎসর্গ না হলেও, চক্রের মাঝখান পূর্ণ না হলে দাগ ভাঙবে, আর শরীর জ্বলে যাবে। তাই এবার কেউ পালাতে পারবি না।”

রূপক নিচু স্বরে বলে, “চক্র এবার সম্পূর্ণ হবে?”

উমা বৈরাগিনী বলেন, “হবে। কিন্তু সেই আগুন কে জাগাবে, কে পোড়াবে, কে দাঁড়িয়ে দেখবে—তা আগুনই জানে। শুধু মনে রেখো, আগুনের ভেতরে কেউ একবার ঢুকলে আর ফিরে আসে না আগের মতো করে।” চক্রের প্রস্তুতি শুরু হয়। নিপা আর কথা বলে না, শুধু এক আগুনচিহ্ন আঁকে নিজের কপালে। অরণ্য দেখে—তার চোখে ভয় নেই, শুধু প্রত্যয়। যেন এবার সে নিজের দেহে নিজেই পূর্ণ জাগরণ ঘটাবে।

রূপক একটি পুরনো তামার পাত্রে সংগ্রহ করে তন্ত্র-চক্রের জন্য ধূপ, ছাই, হোমবালি, এবং একটি ছোট আগুনের ঘূর্ণি।

তিন রাত পর, তারা যাবে অগ্নিকোণ—যেখানে সেই পুরনো চক্র আবার জাগবে।

পর্ব ৬: কলকাতার গোপনঘর

তন্ত্রচক্রের মূল যাত্রা শুরু করার আগে অরণ্যকে রূপক একটি অনুরোধ করে—চল, কলকাতার মধ্যেই একটা জায়গায় যেতে হবে, যেখানে এই আগুনের ইতিহাস একবার ঢুকেছিল শহরের শরীরে।

একটি রাস্তা ধরে তাঁরা পৌঁছায় পটলডাঙা অঞ্চলের এক পুরনো দোতলা দালানে। সামনে লালচে দরজা, উপরে রংচটে যজ্ঞচিহ্ন। রূপক বলেন,
— “এই বাড়ি একসময় ছিল এক গোপন তন্ত্রশিক্ষা কেন্দ্র, যেখানে মহিলাদের মাধ্যমে অগ্নিসূত্র-দীক্ষা দেওয়া হতো। ব্রিটিশরা যখন আগুন দেখেছিল ভিতরে, তারা ভাবছিল এটা বিদ্রোহ। আসলে ছিল জাগরণ।”

অরণ্য চমকে যান—এই বাড়ি তিনি আগে এসেছেন, অনেক আগে, যখন মায়ের মৃত্যুর পর বাবা একদফা তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন চিকিৎসার জন্য। তিনি ভেবেছিলেন পুজো হচ্ছিল।

রূপক তাকে নিচে নামিয়ে আনে এক ঘুপচি ঘরে—সেখানে পুরনো কাঠের তক্তার ওপর এখনো পোড়া কাঠের গন্ধ। দেয়ালে সেই একই ত্রিভুজ আগুনচিহ্ন।

অরণ্য ধীরে ধীরে হাত ছোঁয়ায় চিহ্নে। চোখ বন্ধ করে ফিসফিস করে ওঠে,
— “আমিও ছিলাম। আমি দেখেছিলাম। সেদিন এক মেয়ে আগুনে ঢুকেছিল। আমি তার মুখ দেখেছিলাম—ওই মুখ আজ নিপার।”

রূপক কিছু বলে না। শুধু পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে।

অরণ্য বলে, “আমার ভিতরে সেই আগুন আছে, আমি জানতাম না।”

সেদিন রাতে নিপা একা বসে থাকে ঘরের মধ্যে, মোমের আলোয় নিজের কপালে সেই চিহ্ন আঁকে—লাল রঙের ঘূর্ণি, এক বিশেষ ত্রিকোণ, মাঝখানে আগুনের রেখা। তার ঠোঁটে চলে আসে একটি পুরনো স্তোত্র—ভাষা নয়, স্পন্দন। সেই স্তোত্র শুনে অরণ্য দরজা থেকে থমকে দাঁড়ায়। সে জানে এই ভাষা কোনো গ্রন্থে নেই, এই ভাষা আত্মার গভীরতম স্তর থেকে উঠে আসে।

রূপক বলে, “চক্র শুরু হয়েছে। এখন কিছু আর থামবে না।”

পরের দিন তারা রওনা দেয় অগ্নিকোণ-এর দিকে। ভোররাতে পৌঁছে যায় সেই প্রাচীন ভূমিতে—দূরে নদী, পাশে পাথরঘেরা অঙ্গন, মাঝখানে আগুনজাগার কেন্দ্র—একটা জীর্ণ গর্ত, যার ভেতর আজও ছাইয়ের গন্ধ উড়ে বেড়ায়।

নিপা এগিয়ে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে। হাত রাখে মাটির গায়ে।
— “এখানেই আমি দাঁড়িয়েছিলাম। আগুন আমাকে স্পর্শ করেছিল। এবার আমি স্পর্শ করব আগুনকে।”

রূপক ধূপ জ্বালান, চারদিকে ছড়িয়ে দেন হোমবালি, ছাই, এবং ত্রিকোণ চিহ্ন আঁকেন পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর কোণে। দক্ষিণে থাকবেন দৃষ্টা—অর্থাৎ অরণ্য।

অরণ্য দাঁড়িয়ে থাকে, নিস্তব্ধ, যেন বাতাসও তাকে জানে।

নিপা চক্রের মধ্যস্থলে এসে বসে। তার চোখ আধবোজা, কিন্তু মুখে গভীর এক শান্তি।

— “আমি এসেছি নিজের আগুনে ফিরে। আগুন আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল কারণ আমি অসমাপ্ত ছিলাম। এবার আমি সম্পূর্ণ।”

রূপক উচ্চারণ করেন, “তোমার শরীর কি প্রস্তুত?”
নিপা জবাব দেয়, “শরীর নয়, আত্মা প্রস্তুত।”

অরণ্য বলে, “তুমি আগুনে ঢুকতে চাও?”
নিপা তাকায়, বলে, “আমি ঢুকিনি আগুনে, আগুনই এসেছিল আমার শরীরে। এবার আমি তাকে মুক্ত করব।”

রূপক ত্রিকোণ শেষ করে আগুন জ্বালান মাঝখানে। জ্বলতে শুরু করে আগুন—প্রথমে ধোঁয়া, তারপর শিখা। নিপা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়, আগুনের চারপাশে ঘোরে। তার ঠোঁটে সেই স্তোত্র।

হঠাৎ আগুনের রঙ পালটে যায়—হালকা নীল হয়ে ওঠে। বাতাস ঘন হয়ে আসে।

অরণ্যের মনে হয়, তার ভেতরে কী যেন খুলে যাচ্ছে—এক দরজা, যেটা সে জীবনে বহু বছর বন্ধ করে রেখেছিল।

তার মাথায় হঠাৎ ভেসে ওঠে এক ছবি—এক শিশু, তার হাতে আঁকা ছিল সেই চিহ্ন, পাশে একজন নারী, আগুনে দাঁড়িয়ে। সে চিৎকার করছিল, কিন্তু আগুন স্তব্ধ।

“আমি দেখেছিলাম!” অরণ্য চেঁচিয়ে ওঠে। “আমি পালিয়েছিলাম!”

নিপা তাকিয়ে বলে, “তুমি দৃষ্টা ছিলে, এবার তুমি সাক্ষ্য দাও। তুমি আগুনকে থামাতে পারোনি, এবার আগুন তোমার সামনে দাঁড়াবে।”

আগুন হঠাৎ ফেটে পড়ে। নিপা পড়ে যায়—তার শরীর ধক ধক করে কাঁপে, কিন্তু সে হাত রাখে মাটিতে।

— “আমাকে এবার ফিরিয়ে দাও। আমি প্রস্তুত। আগুন এবার আমার নয়—আগুন এবার নিজের।”

রূপক হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে—“ওর শরীর! ওর হাত! চিহ্ন আবার জেগে উঠছে!”

নিপার হাত জ্বলে ওঠে। সেই ত্রিকোণ চিহ্ন ফুটে উঠেছে যেন গায়ে।

অরণ্য ছুটে যায়—তার মনে হয় আগুন নিপাকে টেনে নিচ্ছে, কিন্তু নিপা চায় না থামাতে। সে একেবারে স্থির।

— “আগুনে যা পোড়ে তা মরে না। তা রূপান্তরিত হয়। আমি মরছি না। আমি রূপ নিচ্ছি। তোমরা শুধু তাকাও—আমি জেগে উঠব।”

শিখা ধীরে ধীরে নিভে আসে। নিপা পড়ে থাকে চক্রের মাঝখানে, চোখ বন্ধ, দেহ অচেতন।

অরণ্য এগিয়ে গিয়ে কাঁপা হাতে ছোঁয়ায় তাকে। নিপার ঠোঁটে একটুখানি হাসি।

পর্ব ৭: যজ্ঞ ও বিভ্রম

আগুন নেভার পর চারপাশে শুধু ধোঁয়া, ছাই আর নিস্তব্ধতা। কোনো পাখির ডাক নেই, কোনো বাতাস নেই—শুধু নিপার নিঃসাড় শরীর, যার ঠোঁটে একটি অস্পষ্ট হাসি জমে আছে, যেন শরীর পুড়েছে না, বরং মাটি আর আগুনের মধ্যে নিজেকে রেখে গেছে কোনো বার্তায়।

অরণ্য তাকিয়ে থাকে তার মুখের দিকে। তার চোখে না ভয়, না অভিমান—শুধু এক নিঃশব্দ প্রশ্ন: এখন কী?

রূপক নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “শরীর স্পন্দিত হচ্ছে না। কিন্তু চিহ্নটা এখনও জ্বলছে।”
আসলে নিপার ডান হাতে এখনও ফুটে আছে সেই ত্রিকোণ আগুনচিহ্ন—লাল, কিন্তু পুড়ে না। শরীর নিস্তব্ধ, কিন্তু সেই চিহ্ন যেন শরীরের বাইরে এক জ্যোতি।

— “সে কি মারা গেছে?”
— “সে নিপা নয় এখন। সে ফিরেছে সেই রূপে, যার নাম নেই, যার জন্ম হয় আগুনে, মৃত্যু হয় ছাইয়ে।”

রূপক চোখ নিচু করে বলে, “তুমি দৃষ্টা ছিলে। এবার তুমি ধারক।”

সেই রাতে অরণ্য নিপার দেহ নিয়ে ফেরে শহরে। কোনো অ্যাম্বুলেন্সে নয়, কোনো হাসপাতালের স্ট্রেচারে নয়—সে নিজের গাড়িতে নিপার শরীর রাখে, ঢেকে দেয় আগুন-গন্ধ মাখা সাদা চাদরে।

কলকাতায় পৌঁছে, সে নিপাকে রাখে তার নিজের চেম্বারে।
শরীর নিঃসাড় হলেও পচন নেই, ত্বক নিস্তরঙ্গ, কিন্তু অদ্ভুতভাবে শীতল নয়। বরং যেন ধীরে ধীরে এক শিখা গেঁথে যাচ্ছে ভেতরে।

সারা রাত অরণ্য বসে থাকে তার পাশে। পুরনো নোট খুলে দেখে।
সেখানে সে একদিন লিখেছিল—
“তন্ত্রের সবচেয়ে ভয়ংকর দিক এটি যে, কোনো প্রমাণ থাকে না—শুধু সাক্ষী থাকে। আগুন পোড়ায় না, আগুন স্মৃতি তৈরি করে।”

সেই সাক্ষী হয়তো সে নিজেই।

পরদিন সকালে নিপার চোখ খোলে। কিন্তু সে নিপার চোখ নয়।

— “তুমি এখন কেমন অনুভব করছো?”
— “আমি কোথাও নেই। আমি কোথাও ছিলাম না। আমি শুধু ছিলাম সেই আগুনে, যেটা তোমরা কেউ দেখতে পাও না।”

— “তুমি কি নিপা?”
— “নাম দিয়ে আর কিছু বোঝায় না। তুমি কি এখনো অরণ্য? তুমি কি সেই ছেলে, যে আগুন দেখে পালিয়েছিল?”

অরণ্য চুপ করে যায়।

— “তুমি ভয় পেয়েছিলে, কারণ তুমি জানতেও পারোনি সেই আগুন তোমার জন্যও জ্বলে উঠেছিল। আমি শুধু শরীর ছিলাম। এখন আমি তা-ও নই।”

— “তবে তুমি কী?”

— “আমি আগুনের শেষ রেখা। আমি সেই রশ্মি, যেটা শেষ চক্রের আগে দেখা যায়। তুমি আমাকে থামাতে পারবে না, আমি নিজেই আর থামব না।”

সেই রাতে অরণ্য নিজের পুরনো ডায়েরিতে লেখেন:
“নিপা ফিরে এসেছে। কিন্তু সে নিপা নয়। সে কারা জানি না। আমি জানি না আমি কে। আগুন হয়তো আমাদের পুড়িয়েছে না, আমাদের খুলে দিয়েছে। আমার অস্তিত্ব যেন এখন ছাইয়ের মতো—জমে আছে, আবার উড়তেও চায়।”

রূপক ফোন করে জানায়—
— “অগ্নিসূত্র চক্র সম্পূর্ণ হয়েছে। তিনদিন পর সেই রাত, যখন আগুন আবার কাউকে ডাকবে।”

— “কাকে?”

— “তোমাকেই হয়তো।”

পরের দিন নিপা চেম্বারের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। সে ধীরে ঘুরে বলে,
— “তুমি এবার আগুনে দাঁড়াবে?”
— “আমি তো দৃষ্টা।”
— “দৃষ্টারা বেশি দিন দৃষ্টি রাখতে পারে না। এক সময় তাদের দাঁড়াতেই হয় আগুনে, শরীর ছাড়া। তুমি তৈরি তো?”

অরণ্য হেসে ফেলেন, তবু চোখে স্নায়বিক কাঁপুনি।

— “তুমি আমাকে পুড়িয়ে দেবে?”
— “আমি না। আগুন নিজেই তার শিকার বেছে নেয়।”

পর্ব ৮: সত্যাগ্নি

কলকাতার রাত তখন ভিজে, নির্জন, ছাদে ছাদে কাকের মতো কুয়াশা বসে আছে। কিন্তু অরণ্য জানালার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুঝতে পারে, বাইরে যা আছে তা একরকম, ভেতরে আরেকরকম—সে জানে, আগুন এখন তার ভেতরেই জ্বলছে।

নিপা বিছানায় বসে। চোখে ঘন নীরবতা, ঠোঁটে ক্ষীণ স্তব। শরীর শীতল, কিন্তু চারপাশে যেন অদৃশ্য উত্তাপ ছড়িয়ে রয়েছে।

রূপক একটি মেসেজ পাঠায়:
“এই তিথি, এই মুহূর্তে, অগ্নিসূত্রের চক্র শেষ হবে—তবে যদি দৃষ্টা আগুনের সামনে দাঁড়ায়। তুই যদি না দাঁড়াস, আগুন নিপাকে আবার টানবে। কিন্তু যদি দাঁড়াস, তুই হয়তো ছাই হয়ে যাবি। তবু, চক্র সম্পূর্ণ হবে।”

অরণ্য চুপ করে থাকে।

নিপা হঠাৎ বলে ওঠে,
— “তুমি এখনো ভয় পাচ্ছো?”
— “হ্যাঁ।”
— “ভয়টাই দরজা। খুলবে তো?”

অরণ্য হেসে ফেলে। অনেক বছর আগে যখন সে শিশু ছিল, আগুন দেখে সে পেছনে সরে গিয়েছিল। আজ আগুন তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, আর সে জানে—এবার পেছানো মানে আরেক জীবন, আরও একটা অসম্পূর্ণ দৃষ্টান্ত।

সে নিপার পাশে বসে বলে,
— “চলো। শেষ যজ্ঞে আমি দাঁড়াব। যদি পোড়াই, পোড়াব। যদি দেখি, দেখব। কিন্তু আর ফিরব না।”

তারা ফিরে যায় সেই অগ্নিকোণ-এ, যেখানে একবার আগুন নিপাকে ছেড়ে দিয়েছিল, আবার গ্রহণ করেছিল। আজ সেখানে শেষ চক্র।

তিনটি চিহ্ন আঁকা হয়—দক্ষিণে দৃষ্টা, পূর্বে ধারক, কেন্দ্রে আগুন।

নিপা এবার চক্রের বাইরে থাকে। সে শুধু আগুন জ্বালায়।

অরণ্য প্রথমবার ত্রিকোণচিহ্নের কেন্দ্রে দাঁড়ায়। চোখ বন্ধ করে বলে,
— “আমি দৃষ্টা ছিলাম, আমি পালিয়েছিলাম। আজ আমি দাঁড়ালাম। যদি আমি ছাই হই, আমি সেই ছাইয়ের মধ্যেই আমার সত্য খুঁজব।”

অগ্নিশিখা ওঠে। ধূপ, চক্র, স্তব—সব একাকার। বাতাস কেঁপে ওঠে। অরণ্যের সামনে আগুন তীব্র হয়ে উঠে যেন গর্জে ওঠে—কিন্তু সে নড়ে না।

তখনই নিপা এগিয়ে আসে, তার চোখে আগুন নয়, জল।
— “তুমি ফিরে এসেছো। এবার আমি যেতে পারি। আমি আর আগুন নই, আমি এখন সাক্ষী।”

তার কপাল থেকে সেই ত্রিকোণ চিহ্ন অদৃশ্য হয়ে যায়। অরণ্যের বুকে ঝলকে ওঠে সেই চিহ্ন।

— “তুমি এখন ধারক।”

অরণ্য কেঁপে ওঠে। আগুন এখন তার ভেতর ঢুকে গেছে। আগুন থামে না, পোড়ায় না, কিন্তু তাকে রূপ দেয়।

তিন দিন পর, নিপা কলকাতা ছেড়ে যায়—নামহীন এক গন্তব্যে। অরণ্য ফিরে আসে চেম্বারে, কিন্তু তার দরজার পাশে নতুন একটি চিহ্ন আঁকা—ত্রিকোণ, মাঝখানে রেখা।

সে আর চিকিৎসক নয় কেবল। সে এখন একজন চক্রদৃষ্টি।

তার কাছে যারা আসে, তারা মানসিক রোগী নয় সবসময়—কেউ কেউ আগুনবাহক, কেউ কেউ দৃষ্টাহীন। এবং সে এখন জানে, কার শরীরে আগুন খুঁজতে হয়, কার চোখে ছাই লুকিয়ে আছে।

একদিন, এক সন্ধ্যায়, এক কিশোরী আসে চেম্বারে। চুপচাপ বসে থাকে। তার চোখে ভয়।

অরণ্য জিজ্ঞেস করে,
— “তুমি কি আগুন দেখো?”
সে মাথা নাড়ে।
— “না, কিন্তু আমি ছাই স্পর্শ করি। আমার হাত পুড়ে যায় না, কিন্তু জ্বলে ওঠে।”

অরণ্য হেসে বলে,
— “তবে তুমি প্রস্তুত। তুমি চক্রে ঢুকতে চাও?”

সে বলে, “আমি আগুন চাই না। আমি শুধু জেগে উঠতে চাই।”

অরণ্য তার হাতে একটি ছোট তামার চিহ্ন রাখে।
— “এইটুকু নাও। বাকিটা আগুন নিজেই করবে।”

সমাপ্তি

Lipighor_1753972572517.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *