Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

অগ্নিশিখা

Spread the love

সহেলী দেব


অগ্নিশিখা দত্ত ছিলেন এক মফস্বল শহরের সাধারণ স্কুলশিক্ষিকা, কিন্তু তার ভেতরে ছিল অদ্ভুত এক দীপ্তি, যা বাইরের সাধারণ চোখে ধরা পড়ত না। শাড়ির আঁচল গুঁজে স্কুলে গিয়ে তিনি যেমন মাটির গন্ধে ভিজে থাকা খড়ের ছাউনিওয়ালা শ্রেণিকক্ষে মেয়েদের পড়াতেন, তেমনি দিনের শেষে ঘরে ফিরে নিজের বুকের ভেতর জমতে থাকা অস্থির স্বপ্নকে আঁকড়ে থাকতেন। ছোটবেলা থেকেই বই ছিল তার নিঃশ্বাসের মতো—বইয়ের পাতায় সে খুঁজে পেয়েছিল পৃথিবীর অচেনা দরজা, ইতিহাসের আলো, আর ভবিষ্যতের কল্পনা। অথচ তার গ্রামে মেয়েদের হাতে বই পৌঁছাত না, তারা বইকে দেখে শুধু পড়াশোনার বোঝা ভেবেই ভয় পেত। অনেক মেয়েই পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হতো, কেউ কেউ সংসারের কাজের ভিড়ে চুপচাপ নিজের ইচ্ছা হারিয়ে ফেলত। অগ্নিশিখা প্রতিদিন যখন এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ত, তার মনে হতো—এই মেয়েরা যদি বইয়ের সঙ্গে একটু সময় কাটাতে পারত, তবে হয়তো তাদের চোখেও স্বপ্নের আগুন জ্বলে উঠত। তাই তিনি একদিন নিজের মনেই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন—যেভাবেই হোক, তিনি একদিন গ্রামের মেয়েদের জন্য একটি লাইব্রেরি গড়ে তুলবেন, যেখানে বই হবে সবার, যেখানে জ্ঞানের আলো কোনো পার্থক্য করবে না ছেলে-মেয়ের মধ্যে।

কিন্তু প্রতিজ্ঞা করা আর বাস্তবায়ন করা এক জিনিস নয়। প্রতিদিনের সংগ্রাম, সীমিত বেতন, সংসারের টানাপোড়েনের মাঝেও অগ্নিশিখা তার স্বপ্নকে জিইয়ে রেখেছিলেন। রাতের বেলা ছোট্ট টেবিল ল্যাম্পের নিচে তিনি পুরোনো বই গুছাতেন, যেগুলো তিনি নিজের সঞ্চয় থেকে কিনেছিলেন কিংবা বন্ধু-পরিচিতদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। তার ঘরের এক কোণায় ধুলো ধরা তাক সাজানো হতে শুরু করল ধীরে ধীরে, যেটি ছিল তার স্বপ্নের প্রথম ইট। গ্রামে যখন কেউ তাকে বলত—“মেয়েদের এত পড়াশোনা করিয়ে কী হবে? সংসারই তো চালাতে হবে তাদের”—তখন তিনি মুখে কিছু বলতেন না, কিন্তু বুকের ভেতর দৃঢ় হয়ে উঠত অগ্নির মতো শপথ। তিনি জানতেন, শিক্ষা মানে শুধু অক্ষর চিনে নেওয়া নয়, বরং নিজের ভিতরে আলো খুঁজে পাওয়া, নিজের ভাগ্য নিজে গড়ে তোলার শক্তি তৈরি করা। গ্রামের মেয়েরা যখন তার শ্রেণিকক্ষে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকত, তখন অগ্নিশিখা অনুভব করতেন—এই চোখগুলোই একদিন তার স্বপ্নকে বাস্তব করবে।

তারপরও সমাজের নির্লিপ্ততা তাকে মাঝে মাঝে আঘাত করত। একদিন স্কুল ছুটির পর তিনি দেখলেন, কয়েকজন মেয়ে রাস্তার ধারে বসে বই পড়ার চেষ্টা করছে, অথচ আশপাশের মানুষ তাদের ঠাট্টা করছে। কেউ বলছে, “বই পড়লে রান্না শিখবে কবে?” কেউ বলছে, “এত পড়াশোনা মেয়েদের মানায় না।” দৃশ্যটা অগ্নিশিখার ভেতরে এক গভীর ক্ষত তৈরি করল, কিন্তু একইসঙ্গে জন্ম দিল আরও বড় সংকল্পের। তিনি ভাবলেন, এই মাটিতে যদি মেয়েদের পায়ে বেড়ি পরানোর রীতি থেকে থাকে, তবে সেই বেড়ি ভাঙতে হবে জ্ঞানের আগুন দিয়েই। আর এই আগুনই হবে তাদের মুক্তির পথ। বাড়ি ফিরে তিনি ডায়েরিতে লিখলেন—“আজ আমি শুরু করলাম আমার অগ্নিযাত্রা। বই শুধু আমার নয়, গ্রামের প্রতিটি মেয়ের অধিকার। আমি তাদের হাতে আলো তুলে দেবো, তারা নিজেরাই লড়াই শিখে যাবে।” সেই মুহূর্তে তার মনে আর কোনো দ্বিধা থাকল না। তিনি জানতেন, এই পথ কঠিন হবে, বাধা আসবে সমাজ, রাজনীতি আর ক্ষমতার অন্ধকার দিক থেকে। কিন্তু তার ভেতরের শিখা নিভবে না, কারণ সেই শিখা জন্ম নিয়েছে স্বপ্নের ভেতর থেকে, যেখানে আগুন মানেই ধ্বংস নয়—আগুন মানে নতুন করে সৃষ্টি, নতুন করে গড়ে তোলা এক আলোকিত ভবিষ্যৎ।

অগ্নিশিখা দত্ত তার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য খুব বেশি কিছু পাননি হাতে—না ছিল বড় অর্থ, না ছিল জমি, না কোনো শক্তিশালী সমর্থন। কিন্তু তার ছিল অটল মনোবল আর নিজের সামান্য সঞ্চয়। সেই টাকাতেই তিনি শহরের পুরোনো বইয়ের দোকানে ঘুরে ঘুরে কিছু বই কিনতে শুরু করলেন। যেসব বই অন্যরা অবহেলায় ফেলে দিয়েছে, ধুলোয় ঢেকে গেছে কিংবা পাতার ধারে ছিঁড়ে গেছে, সেগুলোও তিনি যত্ন করে সংগ্রহ করলেন। কারও বাড়িতে পুরোনো বই থাকলে গিয়ে অনুরোধ করতেন, “এই বইগুলো মেয়েদের কাজে লাগবে, আমায় দিয়ে দিন।” শুরুতে অনেকে অবাক হয়ে তাকালেও তার নিষ্ঠা দেখে কিছু পরিবার খুশি হয়ে দান করল। এভাবেই কয়েক মাসের মধ্যে তার ঘরের এক কোণ বইয়ে ভরে উঠল—পাঠ্যপুস্তক, উপন্যাস, কবিতার বই, গল্পের বই, এমনকি কিছু পুরোনো পত্রিকা। প্রতিটি বইয়ের পাতায় অগ্নিশিখা যেন ভবিষ্যতের আলোর ছোঁয়া দেখতে পেতেন। তিনি জানতেন, এই ছোট্ট সংগ্রহ একদিন গড়ে তুলবে গ্রামের মেয়েদের জন্য মুক্তির জানালা।

কিন্তু শুধু বই জোগাড় করলেই হবে না, পাঠক দরকার, আর সেই পাঠক হবে গ্রামের মেয়েরা। তিনি প্রথমে নিজের স্কুলের কয়েকজন মেধাবী ছাত্রীকে ডেকে বললেন, “বইয়ের ভেতর এক অদ্ভুত শক্তি আছে। এই শক্তি তোমাদের এমন জায়গায় নিয়ে যাবে যেখানে তোমরা আজ কল্পনাও করতে পারছ না।” মেয়েরা প্রথমে লজ্জা পেয়েছিল, কারণ তাদের অভ্যাস ছিল না ক্লাসের বাইরে বই হাতে নেওয়ার। তবে অগ্নিশিখার আন্তরিকতা আর উৎসাহ ধীরে ধীরে তাদের ভেতরে আগ্রহ জাগিয়ে তুলল। প্রতি সন্ধ্যায় স্কুল ছুটির পর কয়েকজন মেয়ে তার ঘরে জড়ো হতে লাগল। ছোট্ট ঘরে তেল ল্যাম্প জ্বেলে বসত তারা, আর অগ্নিশিখা বইয়ের পাতা খুলে পড়তে শুরু করতেন। কোনো দিন তারা শুনত বিভূতিভূষণের প্রকৃতির বর্ণনা, কোনো দিন শরৎচন্দ্রের শক্তিশালী নারীচরিত্র, কোনো দিন রবীন্দ্রনাথের কবিতার সুর। মেয়েরা চোখ বড় বড় করে শুনত, অনেক সময় মুগ্ধ হয়ে প্রশ্ন করত, “দিদিমণি, এই গল্পের মতো আমরাও কি পারব নিজের মতো করে বাঁচতে?” অগ্নিশিখা তখন হাসতেন আর বলতেন, “বইয়ের ভেতর যে আলো আছে, তা তোমাদেরও ভেতর জ্বালাতে পারবে, যদি তোমরা সত্যিই চাও।” ধীরে ধীরে এই ছোট্ট পাঠশালার খবর ছড়িয়ে পড়ল গ্রামে, আর কিছু কৌতূহলী মেয়ে আসতে শুরু করল।

কিন্তু সমাজের শেকল এত সহজে ভাঙে না। কিছু পরিবার মেয়েদের পাঠশালায় যেতে দিতে নারাজ ছিল। তারা বলত, “মেয়েরা যদি বইয়ে ডুবে থাকে, তবে সংসারের কাজ কে করবে? রান্না, ধান মাড়াই, ছোট ভাই-বোন দেখাশোনা—এসবের মধ্যেই তো তাদের জীবন সীমাবদ্ধ।” অনেকে বলত, “এত পড়াশোনা করলে মেয়েরা আর ঘরের কাজ মানবে না, তাদের মাথা উঁচু হয়ে যাবে।” ফলে কয়েকজন মেয়ে গোপনে পাঠশালায় এলেও অনেককে বাড়ির বকাঝকা সহ্য করতে হতো, কেউ কেউ লুকিয়ে আসত। একদিন তো এক অভিভাবক সরাসরি অগ্নিশিখার ঘরের সামনে এসে হট্টগোল করল—“আমার মেয়েকে এসব শেখাবেন না। মেয়েদের বেশি জানলে সর্বনাশ হবে।” মুহূর্তটিতে অগ্নিশিখার বুক কেঁপে উঠেছিল, কিন্তু তিনি দমে যাননি। তিনি দৃঢ় গলায় উত্তর দিয়েছিলেন, “জ্ঞান কারও সর্বনাশ করে না, বরং সর্বনাশ থেকে রক্ষা করে।” তার চোখের দৃঢ়তা দেখে সেই মানুষটি আর কিছু না বলে ফিরে গিয়েছিল। যদিও এ রকম ঘটনা বারবার ঘটত, অগ্নিশিখা প্রতিদিন নতুন করে সাহস জোগাতেন মেয়েদের, বলতেন—“তোমরা ভয় পেয়ো না, আলো সবসময় অন্ধকারকে জয় করে।” সেই প্রথম পদক্ষেপ ছিল ক্ষুদ্র, কিন্তু তাতে যে আগুন জ্বলতে শুরু করেছিল, তা ধীরে ধীরে গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছিল। ছোট্ট ঘরে তেল ল্যাম্পের আলোয় বইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে মেয়েদের চোখে নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন জন্ম নিচ্ছিল, আর অগ্নিশিখা অনুভব করছিলেন—তার স্বপ্নের যাত্রা সত্যিই শুরু হয়ে গেছে।

অগ্নিশিখার ছোট্ট পাঠশালা ধীরে ধীরে আলোড়ন তুলতে শুরু করেছিল। সন্ধ্যার আলোয় তেল ল্যাম্পের নিচে বই পড়তে বসা মেয়েদের দৃশ্য যেন গ্রামের এক নতুন ইতিহাস লিখছিল। কিন্তু অগ্নিশিখার মনে হচ্ছিল—এভাবে তো দীর্ঘদিন চলতে পারে না। একটা স্থায়ী জায়গা দরকার, একটা ঘর চাই যেখানে বই থাকবে নিরাপদে, মেয়েরা নির্ভয়ে বসে পড়াশোনা করতে পারবে। তাই তিনি সাহস করে গ্রামপঞ্চায়েতের অফিসে গেলেন। কাঠের টেবিল আর খড়খড়ি জানালার মধ্যে বসে থাকা প্রধান আর কয়েকজন স্থানীয় নেতা প্রথমে তার কথা শুনে হেসে ফেলল। অগ্নিশিখা শান্তভাবে বললেন, “আমি চাই গ্রামে একটা লাইব্রেরি গড়ে উঠুক। মেয়েরা বই পড়ুক, জ্ঞান অর্জন করুক। আপনারা যদি জমি দিতে সাহায্য করেন, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ আলোকিত হবে।” কিন্তু তার কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রধানের ঠোঁটে কটুকাট্টি হাসি ফুটে উঠল। সে বলল, “মেয়েদের এত পড়াশোনা করিয়ে কী হবে দিদিমণি? তারা যদি বই মুখে দেয়, তবে সংসারের কাজ করবে কে? আমাদের গ্রামের নিয়ম ভাঙার দরকার নেই।”

এরপর শুরু হলো নানা অজুহাত। কেউ বলল, “সরকারি জমি তো আগেই ভাগ হয়ে গেছে।” কেউ বলল, “এখন বাজেট নেই।” আবার কেউ সরাসরি অভিযোগ করল, “আপনার এই লাইব্রেরি আসলে রাজনৈতিক চাল। মেয়েদের মাথা উঁচু করে তুলতে চান, যাতে তারা আর আমাদের কথায় চলবে না।” অগ্নিশিখার বুক কেঁপে উঠেছিল, কিন্তু তিনি দৃঢ় গলায় উত্তর দিলেন, “আমি কোনো রাজনীতি করছি না। আমি চাই মেয়েরা যেন আলো দেখে, অন্ধকারে না থাকে। বই মানুষকে ছোট করে না, বরং বড় করে।” কিন্তু নেতাদের মুখের ভাঁজে স্পষ্ট হয়ে উঠল তাদের ভয়—তারা বুঝে গিয়েছে, যদি মেয়েরা পড়াশোনা করে, যদি তারা নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়, তবে তাদের পুরোনো ক্ষমতার দাপট আর টিকবে না। তাই বারবার তারা সভায় প্রস্তাবটা ফেলে দিচ্ছিল, বারবার অগ্নিশিখার স্বপ্নের দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিচ্ছিল।

গ্রামে এই খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। কেউ কেউ বলল, “প্রধান ঠিকই বলেছে, মেয়েদের এত জানার দরকার কী?” আবার কেউ বলল, “অগ্নিশিখা দিদিমণি হয়তো বড় শহরের প্রভাব নিয়ে গ্রামে নতুন ঝামেলা আনতে চাইছে।” চারদিকে যেন কুৎসার ঝড় উঠল। তবুও অগ্নিশিখা ভেঙে পড়লেন না। রাতের বেলা তিনি ডায়েরিতে লিখলেন, “আজ আমার স্বপ্নকে থামিয়ে দিতে চায় ক্ষমতার দেওয়াল। কিন্তু আমি জানি, দেয়াল যত উঁচুই হোক না কেন, আগুনের শিখা তার ওপর দিয়ে ছড়িয়ে পড়বেই।” তিনি মেয়েদের সামনে সরাসরি কিছু বলেননি, কিন্তু তাদের প্রতিটি চোখের দৃষ্টিতে তিনি প্রতিজ্ঞার আগুন দেখেছিলেন। তারা যেন বুঝে গিয়েছিল, এই লড়াই শুধু অগ্নিশিখার একার নয়—এটা তাদের সবার। গ্রামপঞ্চায়েত হয়তো আপাতত জমি দিতে অস্বীকার করেছে, কিন্তু মেয়েদের বুকের ভেতরে যে আলো জ্বলে উঠেছে, তা নিভিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা কোনো প্রধান, কোনো নেতা বা কোনো অজুহাতের নেই। অগ্নিশিখা জানতেন, এ লড়াই এখন কেবল শুরু, সামনে আরও বাধা আসবে, তবুও তিনি নির্ভয়ে এগিয়ে গেলেন—কারণ আগুন একবার জ্বলে উঠলে তাকে আটকানো যায় না।

গ্রামপঞ্চায়েতের বাধা পেরোনোর পরও অগ্নিশিখার পথ একেবারেই মসৃণ হয়নি। বরং তার বিরুদ্ধে শুরু হলো নানান রকমের অপপ্রচার। গ্রামের হাটে, চায়ের দোকানে কিংবা পুকুরঘাটে দাঁড়িয়ে কথায় কথায় কেউ একজন বলেই ফেলত, “ও দিদিমণি মেয়েমানুষ হয়েও পুরুষদের মতো কাজ করছে।” কেউ আবার ফিসফিস করে বলত, “এমন কাজ মেয়েদের মানায় না, নিশ্চয়ই এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে।” ধীরে ধীরে এসব কথা বিষের মতো ছড়িয়ে পড়তে লাগল। অগ্নিশিখা যখন রাস্তায় হেঁটে স্কুলে যেতেন, তখন কিছু মানুষ মুখ টিপে হাসত, কেউ কেউ কটূক্তি ছুড়ে দিত। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে কানে এল—“এখন নাকি গ্রামের মেয়েরা বই পড়বে, তারপর মাথা উঁচু করবে, স্বামীদের সঙ্গে তর্ক করবে, সংসার ভাঙবে।” কথাগুলো অগ্নিশিখার হৃদয়ে কাঁটার মতো বিঁধলেও তিনি মুখ খুললেন না। তিনি জানতেন, যে সমাজ পরিবর্তনের ভয় পায়, সেই সমাজই প্রথমে প্রতিরোধ করে। তার চোখে ছিল এক অদম্য দৃঢ়তা, যা লোকেদের তিরস্কারকে আগুনের মতো শোষণ করে নিয়ে আবার আলোয় রূপান্তরিত করছিল।

এই অপপ্রচার শুধু অগ্নিশিখার নয়, তার ছাত্রীদের জীবনকেও প্রভাবিত করতে শুরু করেছিল। মেয়েদের কেউ কেউ যখন পাঠশালায় আসত, তখন তাদের মায়েরা শুনত—“তোমার মেয়ে যদি ওখানে যায়, তাহলে সে আর ঘরের কাজ করবে না, বড়লোকের মতো মাথা উঁচু করবে।” অনেকে ভয় পেয়ে মেয়েদের পাঠানো বন্ধ করতে চাইত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই অবস্থায় অগ্নিশিখার ছাত্রীরাই তার সবচেয়ে বড় শক্তি হয়ে উঠল। তারা সাহস করে মায়েদের বোঝাল—“আমরা বই পড়লে সংসারের কাজও ভালোভাবে করতে পারব, আমরা কাউকে অসম্মান করব না, বরং গ্রামের জন্য কিছু করতে পারব।” মেয়েরা নিজেদের ইচ্ছে ও আগ্রহ প্রকাশ করল প্রথমবারের মতো। কেউ বলল, “আমি বড় হয়ে ডাক্তার হতে চাই,” কেউ বলল, “আমি শিক্ষিকা হবো, আরও মেয়েদের পড়াবো।” এই স্বপ্নগুলো শোনার পর অনেক পরিবার দ্বিধা সত্ত্বেও মেয়েদের যেতে দিতে রাজি হলো। গ্রামের কাঁচা রাস্তায় অগ্নিশিখার পাশে হাঁটতে দেখা গেল ছাত্রীদের, তারা যেন অগ্নিশিখার চারপাশে আগুনের বৃত্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল—একটা বৃত্ত যাকে ভেদ করা সহজ নয়।

অগ্নিশিখা অনুভব করলেন, সমাজ যতই কটূক্তি ছড়াক, যতই অপবাদ দিক, মেয়েদের চোখের ভেতরের জেদ আর বিশ্বাসই তার সবচেয়ে বড় উত্তর। তিনি বুঝলেন, এই লড়াই শুধু এক নারীর স্বপ্ন নয়, বরং এক প্রজন্মের ভবিষ্যৎ। তাই প্রতিদিন তিনি নিজেকে আরও শক্ত করে তুললেন। রাস্তায় কেউ বিদ্রূপ করলে তিনি নির্লিপ্ত মুখে সামনে হাঁটতে থাকলেন। কেউ যদি বলত, “এ সব কাজ মেয়েদের জন্য নয়,” তিনি মনে মনে উত্তর দিতেন, “তাহলে মেয়েদের জন্য কাজ বলতে কী বোঝো—শুধু ঘর বাঁধা, সংসার টানা?” সমাজের চোখে তিনি হয়তো আগুন হয়ে উঠেছিলেন—এক এমন আগুন, যাকে তারা ভয় পেত, আবার নিভিয়ে দিতেও চাইত। কিন্তু সেই আগুনে পোড়ে না, বরং জ্বলে ওঠে নতুন আলোর প্রদীপ। আর তার পাশে দাঁড়ানো ছাত্রীরাই প্রমাণ করছিল—একটা স্বপ্নকে নিয়ে যখন মেয়েরা একসঙ্গে এগোয়, তখন কোনো অপপ্রচার, কোনো কটূক্তিই তাদের থামাতে পারে না।

অগ্নিশিখা বুঝতে পারছিলেন, এই লড়াই আর কেবল তার একার নয়। দিন দিন গ্রামের চারপাশে বিরোধিতার কণ্ঠস্বর জোরাল হচ্ছে, পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের ফিসফিসানি—সবকিছু মিলে যেন এক অদৃশ্য দেওয়াল তৈরি করে দিয়েছে তার স্বপ্নের সামনে। অনেক সময় মনে হতো, এত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে একা দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই তিনি উপলব্ধি করলেন, এই স্বপ্ন কেবল তার নিজের নয়, বরং গ্রামের প্রতিটি মেয়ের জীবন থেকে উঠে আসা এক অদৃশ্য চাহিদা। তিনি এক সন্ধ্যায় তার ছোট্ট পাঠশালার মাটির ঘরে সমস্ত ছাত্রীদের একত্র করলেন। তেল ল্যাম্পের আলোয় তাদের মুখগুলো আলোকিত হচ্ছিল, চোখে ফুটে উঠছিল বিভ্রান্তি আর আশঙ্কা। অগ্নিশিখা শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, “শুনো, এই লাইব্রেরি শুধু আমার স্বপ্ন নয়—এটা তোমাদের অস্তিত্বের স্বপ্ন। যদি তোমরা বই হাতে না নাও, যদি তোমাদের চোখে আলো না জ্বলে, তবে আগামী প্রজন্মও অন্ধকারেই থেকে যাবে। আমি একা হয়তো লড়াই করে হেরে যাব, কিন্তু যদি তোমরা আমার সঙ্গে দাঁড়াও, তবে আমরা সবাই মিলে বদলে দিতে পারব আমাদের ভাগ্য।” এই কথাগুলো যেন মেয়েদের বুকের ভেতরে অদৃশ্য আগুন জ্বালিয়ে দিল। প্রথমে তারা চুপ করে ছিল, কিন্তু একসময় একজন মেয়ে সাহস করে বলল, “দিদিমণি, যদি আমার মা আমাকে থামায়?” অগ্নিশিখা মৃদু হেসে উত্তর দিলেন, “তাহলে তুমি তোমার মাকে বোঝাবে। তুমি তাকে বলবে, এই আলো একদিন তার জীবনকেও আলোকিত করবে।”

পরবর্তী দিনগুলো ছিল সংগ্রাম আর বোঝানোর দিন। মেয়েরা বাড়ি ফিরে সাহস করে মায়েদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। কেউ রান্নার হাঁড়ি নেড়েচেড়ে মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “মা, যদি আমি পড়তে পারি, তাহলে তোমার কষ্টও ভাগ করতে পারব।” কেউ আবার বাবার কাছে হাতজোড় করে বলল, “বাবা, বই পড়লে আমি তোমার সম্মান বাড়াবো।” অনেকে অবশ্য বিরক্তি আর রাগের মুখোমুখি হলো—“তুমি কি এখন অগ্নিশিখার মতো ছেলেমানুষি করতে চাও? সংসারের কাজ ছেড়ে বই পড়লে পেট ভরবে?” এমন প্রশ্নে মেয়েদের মন ভেঙে যেত, কিন্তু তারা হাল ছাড়েনি। অগ্নিশিখা প্রতিদিন তাদের উৎসাহ দিতেন, বলতেন, “কোনো পরিবর্তন একদিনে আসে না। তোমরা যদি সত্যিই মন থেকে চাও, তবে একদিন পরিবারও তোমাদের সমর্থন দেবে।” ধীরে ধীরে সেই কথাগুলো সত্যি হতে শুরু করল। কিছু মা, যারা প্রথমে সন্দেহ করত, তারা মেয়েদের চোখের ভেতরের জেদ দেখে নরম হতে লাগল। তারা হয়তো সরাসরি সম্মতি দেয়নি, কিন্তু নীরবে মেনে নিয়েছিল—“যাও, যদি পড়াশোনা তোমার ভালো লাগে।” আর এই সামান্য সম্মতিই মেয়েদের জন্য এক বিশাল জয় হয়ে দাঁড়াল।

এই পরিবর্তনের হাওয়া গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। একদিন দেখা গেল, অগ্নিশিখার ছোট্ট ঘরে আর জায়গা হচ্ছে না। ছেলেমেয়ের দায়িত্ব সামলে, সংসারের চাপে ক্লান্ত থেকেও অনেক মেয়ে বই পড়তে আসছে। তারা জানত, গ্রামের অনেকেই তাদের বিরুদ্ধে কথা বলছে, পাড়ার ছেলেরা কটূক্তি করছে, কিন্তু সেই কটূক্তির আঘাত তাদের পিছু হটাতে পারছে না। বরং তাদের ভেতরে জন্ম নিচ্ছিল এক নতুন সাহস, যেন তারা বুঝে গেছে—এই লড়াই শুধু পড়াশোনার নয়, বরং নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করার লড়াই। অগ্নিশিখা তাদের দিকে তাকিয়ে অনুভব করলেন, তিনি আর একা নন। তার চারপাশে গড়ে উঠছে এক অগ্নিবৃত্ত, যেখানে প্রতিটি মেয়ে আগুন হয়ে উঠছে, প্রতিটি মেয়ে বুকের ভেতরে সাহস জাগিয়ে তুলছে। গ্রামপঞ্চায়েতের দেয়াল, সমাজের কটূক্তি, লোকজনের অপপ্রচার—সব মিলিয়ে যে আঁধার তৈরি হয়েছিল, সেই আঁধার ভেদ করে তারা এগিয়ে আসছে। আর অগ্নিশিখা সেই দৃশ্য দেখে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন—এই আন্দোলন এখন আর থামবে না, কারণ এই প্রতিরোধ কেবল শুরু, সামনে এর আগুন আরও বড় হবে, আরও উজ্জ্বল হবে।

গ্রামের ভোরের আলো ফুটতেই অগ্নিশিখার ছাত্রীরা একে একে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। তাদের চোখেমুখে অদ্ভুত দৃঢ়তা, হাতে বাঁশের কাঠিতে আটকানো কাগজের প্ল্যাকার্ড—“আমাদের বই চাই”, “আমাদের আলো চাই”, “আমরা অন্ধকারে বাঁচব না”। এ যেন কোনো সাধারণ হাঁটা নয়, বরং বহু বছরের দমিয়ে রাখা কণ্ঠস্বরের বিস্ফোরণ। প্রথমে গ্রামবাসীরা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, কেউ হাসছিল, কেউ আবার উপহাস করছিল—“এই মেয়েরা আবার কী করছে?” কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে যখন তাদের স্লোগান চারপাশে গর্জে উঠতে লাগল, তখন গ্রামের বাতাসে এক অদ্ভুত কম্পন তৈরি হলো। চিরাচরিত চুপচাপ মেয়েদের বদলে তারা দেখল, কিশোরী থেকে শুরু করে যুবতী, এমনকি গৃহবধূ পর্যন্ত সবাই একসাথে কণ্ঠ মিলিয়েছে। মেয়েরা শুধু নিজেদের দাবি তুলছিল না, বরং তারা সমাজের চোখে এক অচেনা প্রতিবাদের আগুন জ্বালিয়ে দিল। এই দৃশ্য গ্রামের রাস্তায় আগে কখনও দেখা যায়নি, তাই স্বাভাবিকভাবে আলোড়ন পড়ল।

কিন্তু এই আন্দোলন কারও কারও গায়ে কাঁটা হয়ে বিঁধতে লাগল। রাজনৈতিক নেতারা এবং পঞ্চায়েতের প্রভাবশালী পুরুষরা একসাথে বসে আলোচনা শুরু করল—“এই মেয়েরা যদি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, তাহলে আমাদের নিয়ন্ত্রণে আর থাকবে না।” তারা কয়েকজনকে পাঠিয়ে দিল মেয়েদের ভয় দেখাতে। দু–তিনজন দাদাগিরি করা লোক এগিয়ে এসে মেয়েদের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, “এগুলো বন্ধ করো! রাস্তা আটকে গলা ফাটালে কিছু হবে না, তোমাদের জায়গা রান্নাঘরে।” অনেকেই ভেবেছিল মেয়েরা হয়তো চুপ করে যাবে, হয়তো ভয়ে পিছু হটবে। কিন্তু অগ্নিশিখা সামনে দাঁড়িয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, “রাস্তা যদি পুরুষদের জন্য খোলা থাকে, তবে মেয়েদের জন্যও খোলা থাকবে। আর রান্নাঘরের আগুন সামলাতে জানি বলেই আজ আমরা সমাজের আগুন জ্বালাতে শিখেছি।” সেই কথায় মেয়েদের বুক ভরে গেল সাহসে। তারা স্লোগান থামাল না, বরং আরও জোরে চিৎকার করতে লাগল। দাদাগিরি করা লোকগুলো প্রথমে গালাগালি দিল, কিন্তু মেয়েদের একটুও ভীত না দেখে তারা হতভম্ব হয়ে পিছিয়ে গেল। গ্রামে এই দৃশ্য ছড়িয়ে পড়ল আগুনের মতো—মেয়েরা ভয় পাচ্ছে না, তারা নিজেদের অধিকার দাবি করছে।

নেতারা বুঝতে পারল, এ আন্দোলন সহজে থামানো যাবে না। তারা প্রথমে নানা ভীতি দেখানোর চেষ্টা করল, কেউ বলল, “মেয়েরা যদি পড়াশোনা করে, তবে সংসার ভেঙে যাবে।” কেউ বলল, “এভাবে সমাজের নিয়ম ভাঙলে মেয়েদের বিয়ে হবে না।” কিন্তু মেয়েদের চোখে তখন অন্য আগুন জ্বলছে—শিক্ষার আগুন, স্বাধীনতার আগুন। দিন যত গড়াল, তত বেশি সংখ্যায় মেয়েরা আন্দোলনে যোগ দিতে লাগল। এমনকি যেসব মা–বাবা প্রথমে সন্দেহ করছিল, তারাও ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করল—এই আন্দোলন কেবল বইয়ের জন্য নয়, বরং তাদের মেয়েদের ভবিষ্যতের জন্য। গ্রামের প্রতিটি মোড়ে, প্রতিটি আড্ডায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল অগ্নিশিখার নেতৃত্বে মেয়েদের প্রতিবাদ। নেতারা যতই চেষ্টা করুক, এই আগুন নেভানো সম্ভব হলো না। বরং তারা দেখতে পেল, মেয়েদের দৃঢ়তা সমাজের ভেতরে ভেতরে এক নতুন জোয়ার তুলছে। এবং অবশেষে রাজনৈতিক নেতারা বাধ্য হলো পিছিয়ে যেতে। তারা মুখে কিছু না বললেও বুঝে গেল—এই মেয়েদের দাবিকে উপেক্ষা করলে নিজেদের অস্তিত্বও বিপন্ন হবে। এভাবেই অগ্নিশিখা ও তার সঙ্গীদের আন্দোলন এক নতুন ইতিহাস লিখল গ্রামের বুকজুড়ে, যেখানে মেয়েরা প্রথমবার নিজের কণ্ঠস্বরকে আগুনে রূপান্তর করল।

অবশেষে দীর্ঘদিনের চাপ, বিতর্ক আর তীব্র আন্দোলনের মুখে গ্রামপঞ্চায়েত মাথা নোয়াতে বাধ্য হলো। একদিন অগ্নিশিখাকে ডেকে জানানো হলো—“তুমি যে জমির জন্য এতদিন লড়ছিলে, সেটা মেয়েদের লাইব্রেরির জন্য দেওয়া হবে।” খবরটি যেন বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে পড়ল পুরো গ্রামে। মেয়েদের চোখে জল এসে গেল আনন্দে, তারা বিশ্বাসই করতে পারছিল না যে তাদের এতদিনের সংগ্রাম এত বড় সাফল্য এনে দিয়েছে। অগ্নিশিখার বুক ভরে গেল গর্বে, তবে তার মুখে ছিল শান্ত হাসি—কারণ সে জানত, এই জয় কেবল তার একার নয়, বরং গ্রামের প্রতিটি মেয়ের। তবে জমি পাওয়া মানেই কাজ শেষ নয়। এখনো সামনে কঠিন পথ পড়ে আছে—ইঁট, বালি, কাঠামো, বই সবকিছু জোগাড় করতে হবে। কিন্তু মেয়েরা ভয় পেল না; বরং তাদের মনে হলো, স্বপ্নের অর্ধেক তারা জয় করে ফেলেছে, আর বাকি অর্ধেক পূর্ণ করা এখন তাদের দায়িত্ব। সেই দিন থেকেই শুরু হলো এক নতুন যাত্রা—স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার।

গ্রামের মেয়েরা হাতা গুটিয়ে কাজে লেগে গেল। অগ্নিশিখার নেতৃত্বে তারা একসাথে মাটি কাটতে শুরু করল, কাঁধে করে ইঁট বহন করল, বালি বালতি ভরে জায়গায় আনল। তাদের হাতে হয়তো পুরুষদের মতো শক্তি ছিল না, কিন্তু ছিল এক অদম্য ইচ্ছাশক্তি। সকালবেলা স্কুলের পড়া শেষ করে ছাত্রীদের দল এসে হাজির হতো, কেউ মাটি খুঁড়ত, কেউ আবার ইঁট সাজাত। অনেক মা–বাবাও ধীরে ধীরে এই কাজে হাত লাগালেন। অগ্নিশিখা লক্ষ্য করলেন, যেসব পুরুষ একসময় এই কাজের বিরোধিতা করেছিল, তাদের মধ্যে কিছু লোক চুপচাপ এসে সাহায্য করতে শুরু করেছে। হয়তো সরাসরি তারা কিছু বলছিল না, কিন্তু কাজের মাধ্যমে তাদের সমর্থন প্রকাশ করছিল। অন্যদিকে শহরে কাজ করা কিছু প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী খবর পেয়ে দান পাঠাল, কেউ টাকা, কেউ পুরোনো বই, আবার কেউ কিছু আসবাব পাঠিয়ে দিল। অগ্নিশিখা এই সহযোগিতায় মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি অনুভব করলেন—মানুষ যখন সত্যিকার অর্থে বিশ্বাস করে, তখন সমাজের বাঁধা টিকতে পারে না। প্রতিদিন কাজ চলতে লাগল, গরম রোদে ঘেমে উঠলেও মেয়েদের হাসি থামল না। তারা জানত, এই হাসির পেছনে আছে তাদের স্বপ্ন পূরণের আনন্দ, যা কোনো বাধা ভাঙতে পারবে না।

অবশেষে কয়েক মাসের নিরলস পরিশ্রমের পর দাঁড়িয়ে গেল একটি ছোট কিন্তু সুন্দর লাইব্রেরি। লাল ইটের দেয়াল, টিনের ছাউনি, ভেতরে কাঠের তৈরি তাকগুলো সারি সারি সাজানো—যেখানে রাখা হলো সংগৃহীত বইগুলো। খালি জায়গা থাকলেও সেগুলোই যেন আলোকিত করে তুলল পুরো ঘরটাকে। উদ্বোধনের দিনটিতে গ্রামে এক উৎসবের পরিবেশ তৈরি হলো। মেয়েরা সাদা ও রঙিন পোশাকে সাজল, হাতে রাখল ফুলের মালা। অগ্নিশিখা যখন দরজা খুলে ভেতরে নিয়ে গেল ছাত্রীদের, তাদের চোখে এক অদ্ভুত ঝিলিক দেখা গেল। তারা বইয়ের গন্ধ শুঁকে বুকের কাছে টেনে নিল, যেন জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হাতে পেয়েছে। গ্রামবাসীর অনেকেই ভিড় করেছিল, কেউ অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল, কেউ গর্বে ভরে উঠছিল। এমনকি যারা প্রথমে বিরোধিতা করেছিল, তারাও স্বীকার করল—এই লাইব্রেরি গ্রামের গর্ব। সেই মুহূর্তে অগ্নিশিখা অনুভব করলেন, এই লাইব্রেরি শুধু বইয়ের ঘর নয়, বরং স্বাধীনতার প্রতীক, সাহসের প্রতীক, এবং মেয়েদের জয় করা আলোর প্রতীক। তিনি জানতেন, সামনে আরও অনেক লড়াই আছে, কিন্তু আজকের দিনে তিনি নিশ্চিত হয়ে গেলেন—যে আগুন একদিন তিনি জ্বালিয়েছিলেন, তা এখন আলো হয়ে উঠেছে পুরো গ্রামের চোখে।

উদ্বোধনের সেই সকালে গ্রাম যেন নতুন রূপে সেজে উঠেছিল। লাইব্রেরির চারপাশে রঙিন কাগজের ফিতে, মাটিতে আঁকা আলপনা আর ফুল দিয়ে সাজানো দরজার ফাঁক দিয়ে বইয়ের তাকগুলো উঁকি মারছিল। মফস্বলের এই ছোট্ট লাইব্রেরি হয়তো শহরের চোখে খুব সাধারণ, কিন্তু গ্রামের মানুষের কাছে এটা ছিল এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। অগ্নিশিখা সেদিন সকালে দাঁড়িয়ে ছিলেন লাইব্রেরির সামনের উঠোনে, আর দেখছিলেন কেমন করে তার ছাত্রীরা পরিপাটি পোশাক পরে, চোখে এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতা নিয়ে বই হাতে দাঁড়িয়ে আছে। বইগুলোর গন্ধ, সাদা পাতার খসখস শব্দ যেন বাতাসে নতুন ইতিহাস লিখছিল। গ্রামের মেয়েরা যাদের একসময় বলা হয়েছিল “পড়াশোনা তোমাদের কাজ নয়”, আজ তারা বুকের ভেতর গর্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে বলছিল, “এটাই আমাদের জায়গা, এটাই আমাদের আলো।” অগ্নিশিখার চোখে জল এসে গেল, কিন্তু সেটা দুঃখের নয়, বরং এক অপার আনন্দের—যেন সে হঠাৎ করে অনুভব করল, তার জীবনের সমস্ত সংগ্রাম, সমস্ত অপমান, সমস্ত ক্লান্তি এই এক মুহূর্তের জন্যই ছিল।

উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার পর, মেয়েরা একে একে ভেতরে ঢুকল, তাক থেকে বই নামিয়ে নিল, কেউ চুপচাপ পড়তে বসে গেল, কেউ আবার বন্ধুদের সাথে মিলে পড়তে শুরু করল। অগ্নিশিখা দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিলেন আর ভাবছিলেন—এটা শুধু বইয়ের ঘর নয়, এটা আসলে মুক্তির দরজা। প্রতিটি বই যেন একেকটা জানালা, যার ভেতর দিয়ে মেয়েরা দেখতে পারবে ভিন্ন পৃথিবী, চিনতে পারবে নিজের শক্তি, বুঝতে পারবে যে তাদের ভবিষ্যৎ সীমাবদ্ধ নয়। অগ্নিশিখা মনে মনে বললেন, “আজ থেকে এই মেয়েদের জীবন বদলে যাবে।” গ্রামের মানুষের চোখেও সে দিন ছিল অদ্ভুত এক আলো। যারা প্রথমে এই উদ্যোগকে উপহাস করেছিল, তারা এসে দাঁড়িয়ে দেখল—এই ছোট্ট ঘরের ভেতরে এক বিশাল শক্তি তৈরি হয়েছে। অগ্নিশিখা অনুভব করলেন, তিনি শুধু লাইব্রেরি গড়েননি, তিনি আসলে গ্রামে আত্মবিশ্বাস গড়েছেন, সাহস গড়েছেন, ভবিষ্যতের স্বপ্ন গড়েছেন। আর এই সবকিছুর কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছেন মেয়েরা, যারা একসময় ভয় পেত, কিন্তু আজ বুক চিতিয়ে বলছে—“আমরাও পারি।”

সন্ধ্যা নামতেই গ্রামে আলো জ্বলে উঠল। লাইব্রেরির জানালা দিয়ে আলো বেরিয়ে যাচ্ছিল, যেন গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে অদ্ভুত এক দীপ্তি। অগ্নিশিখা বাইরে দাঁড়িয়ে দেখলেন—তার নামের মতোই আজ তিনি সত্যিই অগ্নিশিখা হয়ে উঠেছেন। তিনি জানেন, এই জয় শুধু তার নয়, প্রতিটি মেয়ের জয়। গ্রামের কিশোরীরা আজ স্বপ্ন দেখতে শিখেছে, মায়েরা আজ বুঝতে শিখেছে, শিক্ষা মানে কেবল বই পড়া নয়, বরং মনের মুক্তি। সেই রাতে অগ্নিশিখা আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন—এই আলো নিভতে দেবেন না, যতদিন তিনি বেঁচে আছেন, ততদিন তিনি আগুনের মতো লড়বেন, যাতে প্রতিটি মেয়ে নিজের আলো খুঁজে পায়। তার চোখে ভেসে উঠল সেই প্রথম দিন, যখন তিনি একা একা স্বপ্ন দেখছিলেন, আর আজ তিনি দেখলেন সেই স্বপ্নের আগুন পুরো গ্রামকে আলোকিত করছে। ভবিষ্যতের পথে এখনো হয়তো অনেক বাধা আসবে, কিন্তু তিনি জানেন, একবার যখন আলো জ্বলে উঠেছে, তখন তা নিভে যাওয়ার নয়। মেয়েদের চোখের ভেতর যে দীপ্তি তিনি দেখলেন, সেটাই ছিল তার আসল জয়—এটাই ছিল অগ্নিশিখার জয়।

***

1000065485.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *