প্রেরণা দত্ত
এক
সকালবেলা স্কুলের ঘণ্টা বাজতেই মফস্বল শহরের মেয়েদের স্কুলের ক্লাসরুম ভরে ওঠে কোলাহলে। দেয়ালের রং অনেক জায়গায় খসে পড়েছে, বেঞ্চিগুলো পুরনো আর খটখটে, জানালার কাচ ভাঙা বলে আলো ঢোকে টুকরো টুকরো হয়ে। এই ক্লাসেই দাঁড়িয়ে থাকেন ইতিহাসের শিক্ষিকা সুবর্ণা দত্ত। বয়স ত্রিশের কোঠা পেরোলেও চোখে যেন এক আশ্চর্য দীপ্তি লেগে আছে। তিনি যখন বোর্ডে ইতিহাসের কথা লিখে বোঝাচ্ছিলেন, তখন তার চোখ হঠাৎ আটকে গেল ছাত্রীদের মুখে। অঞ্জলি, মীরা, গৌরী, ফারজানা—তাদের চোখে অদম্য কৌতূহল, কিন্তু সেই কৌতূহলের পাশে যেন অসহায়ত্বও ভেসে উঠছিল। ক্লাসের শেষে তিনি খেয়াল করলেন, বই পড়তে গিয়ে মেয়েরা বারবার একে অপরের কাছে বই চেয়ে নিচ্ছে। অনেকেরই নিজস্ব বই নেই, কারও কাছে পুরনো দাগধরা খাতা ছাড়া কিছু নেই। এমনকি লাইব্রেরি নামের কোনও জায়গাই এই গ্রামে নেই, যেখানে তারা অবসর সময়ে বসে পড়াশোনা করতে পারবে। সেই মুহূর্তে সুবর্ণার বুকের ভেতরে যেন অজানা এক ব্যথা কাঁপল। তিনি ভেবেছিলেন, শিক্ষা শুধু ক্লাসরুমের চার দেয়ালে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না—একে ছড়িয়ে দিতে হবে, জ্ঞানের আলোয় ভরাতে হবে প্রতিটি ঘর। তার মনে জন্ম নিল এক স্বপ্নের বীজ—এই মেয়েদের জন্য একটি লাইব্রেরি তৈরি করতে হবে, যেখানে বই থাকবে তাদের জন্য খোলা আকাশের মতো।
সেদিন স্কুল ছুটি হতেই তিনি একা হেঁটে ফিরছিলেন গ্রামের পথে। মাটির রাস্তায় ধুলো উড়ছিল, দুই পাশে ক্ষেতের সবুজ গাছ, দূরে গরুর গাড়ি চলে যাচ্ছিল ধীর গতিতে। কিন্তু তার চোখে বারবার ভেসে উঠছিল ছাত্রীদের চোখের সেই ক্ষুধা—জ্ঞানপিপাসার ক্ষুধা। গ্রামের প্রতিটি মেয়ে হয়তো সংসারের বোঝা বইছে, কেউ কেউ বিয়ের চাপে কিশোরী বয়সেই স্বপ্ন গুটিয়ে নিয়েছে, আবার কেউ বা পড়াশোনা করতে চাইলেও বইয়ের অভাবে পিছিয়ে পড়ছে। এই ছবিটাই যেন বারবার সুবর্ণার অন্তরে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছিল। তিনি বুঝতে পারলেন, শিক্ষা শুধু পাঠ্যবই শেষ করার নাম নয়, বরং স্বাধীনভাবে ভাবার ক্ষমতা তৈরি করা। একটি লাইব্রেরি, যেখানে মেয়েরা বই হাতে নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প, ইতিহাস, বিজ্ঞান বা কবিতা পড়বে—এটাই হবে তাদের নতুন আকাশ। হাঁটতে হাঁটতে তিনি নিজেকে প্রশ্ন করলেন—“আমি কি পারব? এত বড় কাজ কি আমার একার পক্ষে সম্ভব?”—কিন্তু সাথে সাথেই মনের ভেতর এক শক্ত কণ্ঠস্বর উঠল, “পারতেই হবে। কারণ যদি আমি চেষ্টা না করি, তবে আর কে করবে?”। স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন তিনি, কেমন হবে সেই লাইব্রেরি—মাটির ঘরে কাঠের তাক, একপাশে জানালা দিয়ে আলো ঢুকছে, ছাত্রীদের মুখে ঝলমল করছে উৎসাহ।
বাড়ি ফিরে তিনি চুপচাপ খোলা খাতায় কয়েকটা লাইন লিখলেন—“লাইব্রেরি: জ্ঞানের আশ্রয়।” তারপর নিজের ঘরের পুরনো বইগুলো একত্র করতে শুরু করলেন। তার হাতে থাকা কয়েকটি পুরোনো উপন্যাস, শিক্ষামূলক বই, কিছু কবিতা—সব গুছিয়ে রাখলেন। যেন ছোট্ট করে হলেও তিনি নিজের স্বপ্নের প্রথম ইটটি রাখলেন। তিনি জানতেন, এই পথ সহজ হবে না। সমাজের অনেকেই হাসবে, অনেকেই বলবে মেয়েদের বই দিয়ে কী হবে, ঘর সামলানোই তাদের আসল কাজ। তবুও সুবর্ণা দত্তর ভেতরে জন্ম নেয়া বীজ আর চুপ করে থাকতে পারল না। তিনি নিজেকে প্রতিজ্ঞা করলেন, এই গ্রামের মেয়েদের তিনি আলোর পথে নিয়ে যাবেন। হয়তো আজ তিনি একা, হয়তো এখন কেবল কল্পনা, কিন্তু আগামী দিনে এই কল্পনাই হয়ে উঠবে আন্দোলন, হয়ে উঠবে লড়াই। আর সেই লড়াইয়ের সূচনা হল ঠিক এই মুহূর্তে, যখন একটি স্কুলশিক্ষিকা ছাত্রীদের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রথমবার অনুভব করলেন—বইয়ের আলোই বদলাতে পারে অন্ধকার ভবিষ্যৎ। এভাবেই জন্ম নিল অগ্নিশিখার স্বপ্নের বীজ।
দুই
পরের সপ্তাহেই সুবর্ণা দত্ত তার বুকের ভেতরে জমে ওঠা সাহস নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন, স্বপ্নটাকে শুধু নিজের ডায়রির পাতায় আটকে রাখা যাবে না। তিনি বিষয়টি প্রকাশ্যে তুলবেন, গ্রামের মানুষের সামনে। সেই উদ্দেশ্যে তিনি গেলেন গ্রামপঞ্চায়েতের সভায়, যেখানে সপ্তাহে একবার গ্রামবাসীরা নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে আসে। কাঁচা মাঠের মাঝখানে বাঁশ দিয়ে তৈরি অস্থায়ী মঞ্চে বসে থাকে কয়েকজন প্রভাবশালী মানুষ, যাদের কথাতেই গ্রামের বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত হয়। সেদিনও সকাল থেকে সবাই ভিড় জমিয়েছিল, কেউ এসেছে রাস্তার মেরামতের কথা বলতে, কেউ আবার জলকষ্টের অভিযোগ নিয়ে। সুবর্ণা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে উঠলেন, তার শাড়ির আঁচল কাঁধে শক্ত করে গুঁজে নিলেন। তিনি স্পষ্ট কণ্ঠে বললেন, “আমি চাই গ্রামে একটি লাইব্রেরি হোক—বিশেষ করে আমাদের মেয়েদের জন্য। তারা পড়াশোনার জন্য বই পায় না, অথচ তাদের চোখে আমি যে কৌতূহল দেখি, সেই আগুন নিভিয়ে দেওয়া অন্যায়।” মুহূর্তেই কানে আসতে লাগল চাপা ফিসফিসানি, কেউ অবাক হয়ে তাকাল, কেউ আবার ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে উঠল। সুবর্ণার চোখ কিন্তু স্থির, তিনি জানতেন এই প্রথম পদক্ষেপটিই সবচেয়ে কঠিন হবে।
সভামঞ্চের মাঝখান থেকে তখন গলা খাঁকারি দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন শশাঙ্ক বাবু, গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান। বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব, গায়ে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা, মাথায় টাক পড়া, কপালে সিঁদুররঙা টিপের মতো তিলক। তার চোখের দৃষ্টি ভারী, কণ্ঠে এমন এক দাপট যে গ্রামের সাধারণ মানুষ চুপসে যায়। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, “শিক্ষিকা মশাই, আপনি যা বলছেন তা ভালো শোনায়, কিন্তু বাস্তবে এর দরকার কী? মেয়েদের এত পড়াশোনা করতে হবে কেন? ঘর সামলানো, সংসার চালানো—এটাই তো তাদের দায়িত্ব। মেয়েরা যদি সারাদিন বই পড়তে বসে, রান্না করবে কে? স্বামী-সন্তানের যত্ন নেবে কে?” সভায় উপস্থিত পুরুষদের মধ্যে অনেকেই হেসে উঠল, কারও গলা থেকে শোনা গেল, “ঠিকই তো বলেছেন প্রধানমশাই।” কেউ আবার বলল, “মেয়েদের মাথায় বই গুঁজলে তারা বাঁধন মানবে না, তখন ঘরের মান-সম্মান যাবে।” সুবর্ণার বুকের ভেতর রক্ত গরম হয়ে উঠল, কিন্তু তিনি জানতেন ক্রোধ প্রকাশ করলে বিপরীত ফল হবে। তবুও তিনি একবার গলা কাঁপিয়ে বললেন, “ঘর সামলানোই কি মেয়েদের একমাত্র কাজ? তারা যদি পড়াশোনা করে, তবে নিজের জীবন নিজের মতো করে গড়তে পারবে। সমাজ এগোবে, গ্রামের উন্নতি হবে।” কিন্তু তার কণ্ঠ চাপা পড়ে গেল বিদ্রুপের হাসিতে। শশাঙ্ক বাবু চেয়ারে হেলান দিয়ে হাত নেড়ে দিলেন, যেন বিষয়টির আর কোনও মূল্য নেই।
সেদিন সভা থেকে ফিরতে ফিরতে সুবর্ণা যেন ভিতরে ভিতরে আরও শক্ত হয়ে উঠছিলেন। গ্রামের রক্ষণশীল মানসিকতার আঁধারটা তিনি যেন হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলেন। চারপাশে দলে দলে পুরুষেরা দাঁড়িয়ে হেসে মন্তব্য করছে—“শিক্ষিকা মশাই বেশি বড় স্বপ্ন দেখে ফেলেছে।” কারও চোখে মৃদু বিদ্বেষ, কারও চোখে অবহেলা। অথচ তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারলেন, এই প্রতিরোধই প্রমাণ করে তার স্বপ্নের প্রয়োজনীয়তা। তিনি দেখলেন, কয়েকজন গ্রামের মহিলা দূর থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে—কেউ যেন ভয়ে কথা বলতে পারছে না, কেউ বা চুপ করে চোখ নামিয়ে নিল। তবুও সুবর্ণা তাদের চোখের ভেতর লুকিয়ে থাকা নীরব সমর্থনটা পড়তে পারলেন। তিনি জানতেন, আজ তার স্বপ্নকে হাসির খোরাক বানানো হচ্ছে, কিন্তু একদিন এই হাসির ফাঁক দিয়েই আলো বেরোবে। সেদিন রাতে বিছানায় শুয়ে তিনি অনেকক্ষণ ঘুমোতে পারলেন না। মনে হচ্ছিল, শশাঙ্ক বাবুদের এই প্রতিরোধ আসলে প্রথম বড় বাধা—কিন্তু স্বপ্নের বীজ যত বড় বাধাই পাক, তা ভাঙার জন্যই জন্মায়। আর তিনি, সুবর্ণা দত্ত, প্রতিজ্ঞা করলেন—এই বাধা তার মনোবলকে ভাঙতে পারবে না, বরং তাকে আরও দৃঢ় করবে। এভাবেই শুরু হল অগ্নিশিখার স্বপ্নযাত্রার প্রথম প্রতিবন্ধকতা, যেখানে একটি নারীর কণ্ঠস্বর সমাজের বদ্ধ প্রথাকে প্রথমবার চ্যালেঞ্জ জানাল।
তিন
গ্রামপঞ্চায়েতের সভায় সুবর্ণার প্রস্তাব খারিজ হয়ে যাওয়ার খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। বাজারে, চায়ের দোকানে, এমনকি পাড়ার উঠোন আলোচনাতেও বিষয়টা জায়গা করে নিল। “শিক্ষিকা মশাই বুঝি বড় শহরের গল্প শুনে মাথা ঘুরে গেছে” কিংবা “মেয়েদের লাইব্রেরি আবার কিসের জন্য?”—এমন ঠাট্টা-বিদ্রুপ শোনা গেল চারপাশে। এই কথাগুলো শুধু বাইরে সীমাবদ্ধ থাকল না, ধীরে ধীরে প্রবেশ করল সুবর্ণার নিজের সংসারের চার দেওয়ালের ভেতরেও। তার স্বামী সায়ন্তন দত্ত, ব্যাংকের কর্মচারী, শান্ত স্বভাবের মানুষ। জীবনে ঝুঁকি নেওয়া বা ভিড়ের বিপক্ষে দাঁড়ানো তার অভ্যেস নয়। সন্ধ্যায় অফিস থেকে বাড়ি ফিরেই তিনি ক্লান্ত গলায় বললেন, “সুবর্ণা, তুমি না হয় স্বপ্ন দেখছ, ভালো কথা, কিন্তু গ্রামের লোকজন যে এখন আমাদের নিয়েই হাসাহাসি করছে। আমার সহকর্মীরাও শুনে মজা করছে, বলে—‘তোমার বউ বুঝি মেয়েদের বিদ্রোহ শিখিয়ে দেবে!’ তুমি বুঝছো না, এতে আমাদের সামাজিক মান-সম্মান নষ্ট হচ্ছে।” সায়ন্তনের কণ্ঠে কোনও কঠোরতা ছিল না, বরং এক ধরনের ভয় আর লজ্জার মিশ্রণ। সুবর্ণা এক মুহূর্তের জন্য থমকালেন, তারপর শান্ত গলায় বললেন, “মান-সম্মান কি কেবল অন্যের চোখে বাঁচানো জিনিস? আমি যদি জানি এই কাজটা সঠিক, তবে কেন আমি থামব?” কিন্তু সায়ন্তনের চোখে তখন শুধু অনিশ্চয়তার কুয়াশা।
পরবর্তী দিনগুলোয় সংসারের ভেতরে অশান্তি বাড়তে শুরু করল। সকালের নাশতার টেবিলে কিংবা রাতের খাওয়ার সময় প্রায়ই একই প্রসঙ্গ ঘুরে ফিরে আসত। সায়ন্তন বলতেন, “আমি চাই না তোমাকে নিয়ে গ্রামে ঝামেলা হোক। তুমি যদি স্কুলের কাজ করো, তাতেই আমি খুশি। আলাদা করে লাইব্রেরির জন্য এত ঝুঁকি নেওয়ার কী দরকার?” তার গলায় ছিল আন্তরিকতা, কিন্তু সেই আন্তরিকতা আসলে ভয়ের শিকল। অন্যদিকে সুবর্ণা যতই বোঝাতে চাইতেন, “এটা কেবল লাইব্রেরি নয়, এটা ভবিষ্যতের জন্য দরজা খোলা,” সায়ন্তন ততই চুপ করে যেতেন। তিনি ভালোবাসতেন তার স্ত্রীকে, তার স্বপ্নকেও হয়তো নিভৃতে শ্রদ্ধা করতেন, কিন্তু বাস্তবের কঠিন চাপ তাকে পিছিয়ে রাখত। গ্রামে কেউ কেউ ছড়াতে শুরু করল—“শিক্ষিকার স্বামী বেচারা নিশ্চয়ই খুব কষ্টে আছে, বউ যদি এভাবে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, সংসার টিকবে তো?” এই ধরনের গুজব সায়ন্তনের কানে পৌঁছালে তিনি আরও বেশি অস্থির হয়ে পড়তেন। এক রাতে বিছানায় শুয়ে বললেন, “আমি তোমার পাশে থাকতে চাই, কিন্তু যদি আমার চাকরির ক্ষতি হয়? যদি উপরের লোকেরা আমাকে বদলি করে দেয়? তখন আমরা বাঁচব কীভাবে?” সেই প্রশ্ন শুনে সুবর্ণা কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। তার বুকের ভেতরে অশান্তির ঝড় বয়ে গেলেও ঠোঁটে তিনি দৃঢ়তা রেখেই বললেন, “তুমি যদি ভয় পাও, তবে আমায় একা চলতে দাও। আমি থামব না।”
এভাবে দিন গড়াতে থাকল, আর সংসারের ভেতরে যেন একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হলো। একদিকে সায়ন্তনের ভালোবাসা, ভয়ের ছায়ায় ঢাকা; অন্যদিকে সুবর্ণার অটল স্বপ্ন, প্রতিবন্ধকতার মাঝেও দীপ্ত। বাড়ির বাতাসে কেমন একটা ভারী নীরবতা নেমে এলো। সন্ধ্যায় তারা পাশাপাশি বসলেও কথাবার্তা কমে গেল, খাবারের টেবিলে চামচের শব্দই যেন একমাত্র ভাষা হয়ে উঠল। তবুও সুবর্ণার মনে এক মুহূর্তের জন্যও ভাঙন ধরল না। তিনি জানতেন, স্বামীর এই দ্বিধা অকারণে নয়—সমাজ তাকে এমনভাবে গড়ে তুলেছে, যেখানে পুরুষরা সামাজিক মান-সম্মানের ভয়ে নিজেদের স্ত্রীর স্বপ্নকেও বাধা দেয়। কিন্তু তিনি এটাও বুঝতেন, একদিন সায়ন্তন হয়তো বুঝবে—এই লড়াই শুধু একটি লাইব্রেরির জন্য নয়, এই লড়াই প্রতিটি মেয়ের জন্য, প্রতিটি ভবিষ্যতের জন্য। তাই তিনি নীরবে নিজের কাজ করে যেতে লাগলেন—পুরনো বই জোগাড় করা, ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ দেওয়া, গ্রামের মহিলাদের সঙ্গে আলাপ শুরু করা। সংসারের ভেতরে দ্বন্দ্ব চলছিল, কিন্তু তার আত্মার ভেতরে ছিল অটল দৃঢ়তা। সেই দৃঢ়তা-ই ছিল অগ্নিশিখার আগুন, যা যতই হাওয়া দিয়ে নিভিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হোক, ততই আরও জ্বলে উঠতে শুরু করল।
চার
গ্রামের আকাশে সন্ধ্যার আলো নামছিল। পাখিদের দল ফিরছিল বাসায়, অথচ স্কুলের উঠোনে তখনও কিছু মেয়ের জমায়েত। তাদের মাঝে দাঁড়িয়ে ছিল অঞ্জলি মণ্ডল, সুবর্ণার সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রী। বয়সে সে হয়তো ষোলো কিংবা সতেরো, কিন্তু চোখে-মুখে ছিল এক অদ্ভুত দৃঢ়তা, যেন অল্প বয়সেই সে জীবনের কষ্ট আর সংগ্রামের স্বাদ পেয়েছে। কৃষকের মেয়ে অঞ্জলি, প্রতিদিন সকালে গরু-মহিষের দেখাশোনা আর ঘরের কাজ সেরে তবেই স্কুলে আসে। কিন্তু পড়াশোনার প্রতি তার ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। সে জানত—বই-ই তাকে অন্য এক দুনিয়ার দরজা খুলে দিতে পারে। সেইদিন সে হঠাৎ এগিয়ে এসে বলল, “আমাদের বই চাই, দিদিমণি। বই ছাড়া আমরা কিছুই হতে পারব না।” অঞ্জলির এই কথাগুলো এতটা দৃঢ়ভাবে উচ্চারিত হয়েছিল যে, উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য মেয়েরা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। অনেকদিন ধরেই তাদের মনের ভেতরে লুকোনো আকাঙ্ক্ষা ছিল, কিন্তু সাহস ছিল না মুখে আনার। অঞ্জলির কথায় যেন তারা এক নতুন শক্তি খুঁজে পেল।
অঞ্জলি একা থাকল না। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মীরা—যার বাবা দিনমজুর, মা গৃহপরিচারিকা—সাহস সঞ্চয় করে বলল, “আমরাও চাই পড়াশোনা, আমাদের জীবন তো শুধু বিয়ে আর রান্নাঘর নয়।” ফারজানা, যে প্রায়ই পড়াশোনা ফেলে খেতের কাজে মাকে সাহায্য করতে যায়, চুপচাপ অঞ্জলির হাত ধরে সামনে দাঁড়াল। সে ধীরে ধীরে বলল, “আমাকে অনেকে বলে—তুই মেয়ে, পড়াশোনা করে লাভ কী? কিন্তু আমি জানি, বই না পড়লে আমি শুধু অন্ধকারেই থেকে যাব।” আরেকপাশে দাঁড়িয়ে থাকা গৌরী, যে সবসময় লাজুক, সেও মাথা তুলে বলল, “দিদিমণি, আমরা একসঙ্গে থাকব আপনার পাশে।” এই চারটি কিশোরী যেন সেদিন একসঙ্গে গ্রামের অন্ধকারে মশাল জ্বালাল। তাদের কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে আশেপাশের অন্য মেয়েদের ভেতরেও সাহস সঞ্চার করল। যারা এতদিন ভয়ে বা সামাজিক চাপে চুপ ছিল, তারা বুক সোজা করে দাঁড়াতে শিখল। মনে হল—যেন সুবর্ণার একার লড়াই হঠাৎ বহু কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
সেদিন থেকে গ্রামে এক অদ্ভুত পরিবর্তনের শুরু হলো। রক্ষণশীল লোকেরা প্রথমে অবাক হয়ে তাকালেও, মেয়েদের দৃঢ় কণ্ঠস্বর আর ঐক্য তাদের চিন্তায় ভাঙন ধরাতে শুরু করল। সুবর্ণার চোখে জল এসে গেল যখন সে দেখল—অঞ্জলি আর তার বন্ধুদের নেতৃত্বে মেয়েরা বারবার বলছে, “আমাদের শেখার অধিকার আছে।” তার বুক ভরে উঠল গর্বে, কারণ সে বুঝতে পারল—স্বপ্নের বীজটা শুধু তার নয়, এখন গ্রামের মেয়েদের মনেও শেকড় গেড়ে বসেছে। মেয়েরা স্কুল শেষে আর নিছক বাড়ি ফিরছিল না; তারা আড্ডার আসরে, পুকুরঘাটে, মাঠের ধারে একসঙ্গে বসে বই আর শেখার স্বপ্ন নিয়ে কথা বলতে শুরু করল। কারো হাতে হাতে পুরনো, ছেঁড়া গল্পের বই, কেউ আবার অন্যের খাতা ধার করে লিখতে শেখার চেষ্টা করছে। এই পরিবেশ দেখে সুবর্ণার মনে হল, অন্ধকার কাটতে শুরু করেছে। আর এই আলোর প্রথম প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছে অঞ্জলিই—যে নিজের কণ্ঠস্বর দিয়ে প্রমাণ করল, মেয়ে মানেই চুপ করে থাকা নয়, বরং প্রতিবাদের আর পরিবর্তনের অগ্রদূত।
পাঁচ
শহরতলির এক কোণে, পুরোনো, ধুলো জমা একটি ভাঙাচোরা বাড়ি ছিল—যেটি গ্রামের শিশুদের কাছে রহস্যময় জায়গা বলে পরিচিত। সেখানে থাকতেন শোভন বাবু, এক বৃদ্ধ, যিনি একসময় ছিলেন কলেজের অধ্যাপক। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হলেও চোখে মুখে এক ধরনের জ্ঞানের দীপ্তি রয়ে গিয়েছিল। গ্রামের মানুষ তাকে কিছুটা বিচিত্র মানুষ ভাবত—কারণ তিনি মানুষের ভিড় এড়িয়ে চলতেন, সভায় যেতেন না, রাজনীতি পছন্দ করতেন না, বরং সারাদিন নিজের ঘরে বসে পুরোনো বইপত্র নিয়ে সময় কাটাতেন। যখন সুবর্ণা একদিন শশাঙ্ক বাবুর অস্বীকৃতি আর গ্রামবাসীর কটু কথায় ভেঙে পড়তে বসেছিলেন, তখন হঠাৎই তার কানে পৌঁছায় শোভন বাবুর কথা। অঞ্জলি জানিয়েছিল, “শিক্ষিকা, শোভন কাকু নাকি অনেক বই জমিয়ে রেখেছেন। তিনি কারো হাতে দেন না, কিন্তু হয়তো আপনার হাতে দেবেন।” প্রথমে দ্বিধা থাকলেও এক বিকেলে সুবর্ণা সাহস সঞ্চয় করে তার বাড়িতে যান। শোভন বাবুর ঘর যেন এক অদ্ভুত জগত—পুরোনো বইয়ের গন্ধে ভরা, ছেঁড়া কভার আর মলাটের মাঝে লুকোনো ইতিহাস। দেয়ালে ঝুলছে বিবর্ণ ম্যাগাজিনের কাটিং, ধুলো জমা তাকগুলোতে ইংরেজি, বাংলা, হিন্দি বইয়ের স্তূপ, আর টেবিলের ওপর পড়ার চশমা। সেই পরিবেশে দাঁড়িয়ে সুবর্ণার মনে হলো—যেন হারানো স্বপ্নের এক গুপ্ত ভাণ্ডার তিনি খুঁজে পেয়েছেন।
শোভন বাবু প্রথমে অবাক হয়ে তাকালেন সুবর্ণার দিকে। অনেকদিন হয় কেউ তার কাছে বই চাইতে আসেনি। গ্রামের মানুষ তাকে ‘পাগল’ বলে এড়িয়ে চলে, কেউ কেউ হাসাহাসি করে বলে যে তিনি নাকি মৃত বইয়ের পাহাড়ে ডুবে আছেন। সুবর্ণা যখন শান্তভাবে তার স্বপ্নের কথা খুলে বললেন—“আমি মেয়েদের জন্য একটি লাইব্রেরি বানাতে চাই, যেখানে আপনার মতো মানুষের সংগ্রহ সত্যিকারের আলো ছড়াতে পারবে”—তখন বৃদ্ধের চোখ চিকচিক করে উঠল। তিনি ধীরে ধীরে তাক থেকে কয়েকটি বই নামালেন—রবীন্দ্রনাথের গীতবিতান, শরৎচন্দ্রের পল্লীসমাজ, আর কিছু ইতিহাস ও বিজ্ঞানবিষয়ক বই। হাতে বইগুলো তুলে দিতে দিতে বললেন, “মা, এই গ্রামে অনেকেই হয়তো তোমার কাজকে বোঝবে না, ঠাট্টা করবে। কিন্তু মনে রেখো, বই কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করে না। এরা নীরব সৈনিকের মতো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আলো বহন করে।” সুবর্ণার বুক কেঁপে উঠল। এই ছিল তার সংগ্রামের প্রথম বাস্তব আশ্বাস—কেউ তাকে শুধু সমর্থনই করল না, হাতে তুলে দিল বাস্তব অস্ত্র, অর্থাৎ বই। এই কয়েকখানি বই হয়তো ছোট, কিন্তু সুবর্ণার কাছে মনে হলো এগুলোই তার স্বপ্নের ভিত্তি।
বৃদ্ধ শোভন বাবুর এই নীরব সমর্থন সুবর্ণাকে ভেতর থেকে এক নতুন শক্তি দিল। অঞ্জলি, মীরা, ফারজানা, গৌরীরা যখন বইগুলো হাতে নিয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসল, তখন মনে হলো তারা যেন পৃথিবীর সেরা ধনসম্পদ পেয়েছে। সেই ছেঁড়া মলাটের বইগুলো তাদের কাছে মুক্তির প্রতীক হয়ে উঠল। গ্রামের অন্যরা যখন এখনও কটাক্ষ করছে, “মেয়েরা লাইব্রেরি দিয়ে কী করবে?”, তখন সুবর্ণার ভেতরে অদ্ভুত এক আশার আলো জ্বলে উঠল। তিনি বুঝলেন, লড়াই যতই কঠিন হোক না কেন, মানুষের মধ্যে কিছু আত্মা আছে যারা নিঃশব্দে স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখে। শোভন বাবুর মতো মানুষই প্রমাণ করে—প্রকৃত পরিবর্তনের শিকড় কখনো উপরে নয়, মাটির গভীরে গড়ে ওঠে। সেই দিন থেকে সুবর্ণা বইগুলো যত্ন করে সাজিয়ে রাখতে শুরু করলেন, যেন এগুলোই একদিন হয়ে উঠবে ভবিষ্যতের ‘অগ্নিশিখা লাইব্রেরি’র প্রথম ইট। রাতের অন্ধকারে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে তিনি বারবার মনে মনে বললেন, “স্বপ্নের শুরু তো হয়ে গেছে। এবার আর পেছনে ফেরার প্রশ্নই আসে না।”
ছয়
রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে সুবর্ণার জীবনের চারপাশে যেন অদৃশ্য এক অন্ধকার বেড়ে উঠতে লাগল। গ্রামের রক্ষণশীল শক্তির প্রতিনিধিত্ব করা শশাঙ্ক বাবু বুঝতে পারছিলেন—সুবর্ণার এই উদ্যোগ কেবল কয়েকটা বইয়ের আলমারি গড়ার পরিকল্পনা নয়, এটা তাদের দীর্ঘদিনের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহ। কারণ মেয়েদের হাতে বই মানে প্রশ্ন তোলা, প্রশ্ন মানে প্রতিবাদ, আর প্রতিবাদ মানে তাদের শক্তির ভাঙন। তাই তিনি তার রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগালেন। প্রথমে ছোটখাটো বিদ্রুপ, তারপর মিটিংয়ে খোলাখুলি অপমান, আর এখন সরাসরি ভয় দেখানো শুরু হলো। রাতের আঁধারে সুবর্ণার বাড়ির সামনে হঠাৎ কয়েকটা বাইকের শব্দ থেমে যেত, টর্চলাইটের তীব্র আলো জানালায় পড়ত, আর চাপা গলায় গালি ভেসে আসত। মাঝে মাঝে দরজায় আঘাত করা হতো, আবার মুহূর্তের মধ্যেই সব নিস্তব্ধ হয়ে যেত। এই নিস্তব্ধতা ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর—কারণ তা জানিয়ে দিত, কেউ চুপিসারে নজর রাখছে, আঘাত আসতে দেরি নেই।
এদিকে স্কুলেও তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু হলো। হেডমাস্টার একদিন হঠাৎ তাকে ডেকে বললেন, “আপনার কাজকর্ম নিয়ে অনেক অভিযোগ আসছে, আপনি মেয়েদের মনে বিদ্রোহী ভাব জাগাচ্ছেন।” সুবর্ণা বিস্মিত হয়ে বুঝলেন, এগুলো সব সাজানো কথা। আসল পরিকল্পনা হচ্ছে তাকে স্কুল থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া। শশাঙ্ক বাবু নাকি জেলাশিক্ষা দপ্তরে চাপ দিচ্ছেন—সুবর্ণাকে বদলি করতে হবে। সহকর্মীদের অনেকে এ ব্যাপারে নিরুত্তাপ, কেউ কেউ আবার গোপনে তাকে সাবধান করল, “আপনি একা টিকতে পারবেন না, মেনে নিন।” বাড়িতেও চাপ বাড়তে লাগল। সায়ন্তন বুঝতে পারছিলেন স্ত্রীর প্রতি ক্রমবর্ধমান শত্রুতা, কিন্তু সামাজিক অবস্থান আর চাকরির ভয়ে তিনি বেশি কিছু করতে পারছিলেন না। এই অস্থিরতার মধ্যে সুবর্ণার চারপাশ যেন এক শূন্যতা তৈরি হলো—যেখানে সবাই পাশে থেকেও দূরে সরে গেল।
কিন্তু এই নিঃসঙ্গতাই তাকে নতুনভাবে ভাবতে শিখাল। ভয়ঙ্কর চাপের মাঝেও তিনি নিজের অন্তরে প্রশ্ন তুললেন—“আমি যদি ভেঙে পড়ি, তাহলে অঞ্জলি, মীরা, ফারজানারা কোথায় যাবে? তাদের চোখের সেই আগুন কি আমি নিভতে দেব?” প্রতিটি রাতের হুমকি, প্রতিটি দিনের অপমান তাকে আরও কঠিন করে তুলতে লাগল। যদিও বাইরের জগৎ তাকে একা করে দিচ্ছিল, ভেতরে ভেতরে তিনি হয়ে উঠছিলেন আরও দৃঢ়। তিনি জানতেন—শশাঙ্ক বাবুর এই চক্রান্ত শুধু বই নয়, ভবিষ্যতের আলোকে রোধ করার চেষ্টা। আর এ লড়াই কেবল তার ব্যক্তিগত লড়াই নয়, বরং সমগ্র গ্রামের মেয়েদের ভাগ্যের লড়াই। তাই সুবর্ণা নিরবিচ্ছিন্ন ভয়কে সঙ্গী করেও সিদ্ধান্ত নিলেন—যে কোনো মূল্যেই হোক, এই স্বপ্ন তিনি থামতে দেবেন না। ভয় তাকে ঘিরে ধরলেও, স্বপ্নের আলো তার ভেতরে আগুন জ্বালিয়ে রেখেছিল।
সাত
গ্রামের আঙিনায় বাতাস যেন একটু একটু করে বদলাতে শুরু করল। প্রথমদিকে যারা চুপচাপ থেকে সবকিছু দেখছিলেন, সেই মহিলারাই একদিন বুকের ভেতরের দীর্ঘশ্বাসকে শব্দে রূপ দিলেন। লক্ষ্মী বৌদি—যিনি প্রতিদিন সংসারের খুঁটিনাটি কাজের ভিড়ে দম ফেলার সময় পান না—সেই তিনিই প্রথম কথা বললেন, “কেন আমাদের মেয়েরা শুধু ঘরে বসে থাকবে? আমরা তো বইয়ের আলো পাইনি, কিন্তু ওরা পেলে কি দোষ?” তার কণ্ঠে যে আগুন ছিল, তা ধীরে ধীরে অন্য মহিলাদের বুকেও জ্বলে উঠল। এতদিন ভয়ে যারা পিছু হটত, তারা হঠাৎ উপলব্ধি করল—শশাঙ্ক বাবুর মতো লোকেরা শুধু ভয় দেখিয়ে রাখার জন্যই ক্ষমতা দেখায়, কিন্তু সত্যি বলতে তারা নিজেরাও জানে, শিক্ষা হলে মেয়েরা আর বশ মানবে না। সন্ধ্যার অন্ধকারে বাড়ির আঙিনায় বসে মহিলারা ফিসফিস করে বলাবলি শুরু করলেন—“আমাদের মেয়েদের ভাগ্য আলাদা হবে, তারা ঘরে ঘরে বন্দি হয়ে থাকবে না।” সেই গোপন কথোপকথনগুলো একসময় নদীর জলে ঢেউ তোলার মতো গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
সুবর্ণা প্রথমে বুঝতেই পারেননি, তার সংগ্রাম আস্তে আস্তে কীভাবে নারীদের হৃদয়ে আলো জ্বালাচ্ছে। একদিন দুপুরে স্কুল থেকে ফেরার পথে তিনি দেখলেন, দু’জন মহিলা তার জন্য অপেক্ষা করছেন। তারা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে বললেন, “শিক্ষিকা মশাই, আমরা আপনার পাশে আছি। হয়তো খুব বেশি কিছু করতে পারব না, কিন্তু মেয়েদের লাইব্রেরির জন্য যা পারি, আমরা করব।” এই কথাগুলো শুনে সুবর্ণার চোখ ভিজে গেল। এতদিন ধরে তিনি নিজেকে নিঃসঙ্গ যোদ্ধা ভেবেছিলেন, কিন্তু বুঝলেন—আস্তে আস্তে গ্রাম্য নারীরা জেগে উঠছে। শশাঙ্ক বাবুর ভয়, কটূক্তি, সামাজিক ব্যঙ্গ—এসবের ভেতর দিয়েও নারীরা সাহস খুঁজে পাচ্ছেন। তারা ধীরে ধীরে স্বামীদের অমান্য করে, সংসারের বাঁধন অতিক্রম করে, মনের ভেতরে এক নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। সেই স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়াল ছোট্ট একটি লাইব্রেরির ধারণা।
এখন গ্রামে সন্ধ্যার পর চুলোর ধোঁয়ার গন্ধে ভরা গৃহস্থালির আঙিনা আর নিছক নির্লিপ্ত জায়গা নয়। সেখানে মহিলাদের চোখে নতুন আলো, কথায় নতুন সাহস। তারা একে অপরকে প্রশ্ন করে—“আমরা কি সারা জীবন শুধু রান্নাঘরেই আটকে থাকব?” উত্তর আসে—“না, আমাদের মেয়েরা অন্য রকম হবে।” এই পরিবর্তন যদিও ধীরে ধীরে ঘটছে, তবু এর অভিঘাত গভীর। সুবর্ণা অনুভব করেন—তার সংগ্রাম আর ব্যক্তিগত লড়াই নেই, এটি এক সামষ্টিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। নারীদের জাগরণই যেন গ্রামটিকে নতুনভাবে বাঁচার সুযোগ দিল। রাতের আকাশে যখন চাঁদ ঝুলে থাকে, গ্রামের মহিলাদের চোখেও তখন একই আলো প্রতিফলিত হয়—শিক্ষার আলো, মুক্তির আলো, আর আগামী দিনের আশার আলো।
আট
গ্রামের শান্ত চত্বরে একদিন হঠাৎ যেন এক নতুন ইতিহাসের জন্ম হয়। সুবর্ণার সাহসিকতায় অনুপ্রাণিত হয়ে অঞ্জলি, মীরা, ফারজানা, গৌরী এবং আরও কত ছাত্রী সাদা কাগজে নিজেদের হাতে লেখা স্লোগান নিয়ে মাঠে জড়ো হয়—“আমাদেরও বই চাই”, “আমরা পড়তে চাই।” সেই দৃশ্যটা যেন গ্রামের ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায় হয়ে দাঁড়ায়। কেউ সেলাই করা কাপড়ে হাতের লেখা ঝুলিয়ে দেয়, কেউ আবার ভাঙা খাতার পাতা ছিঁড়ে তার উপর স্লোগান লিখে বাতাসে উড়িয়ে দেয়। ধীরে ধীরে মাঠটা ভরে যায় মেয়েদের চিৎকারে—যা ছিল সাহসের, শিক্ষার, এবং স্বাধীনতার দাবি। তাদের কণ্ঠস্বর এমন শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে গ্রামের রক্ষণশীল মহলও থমকে দাঁড়ায়। প্রথমে তারা বিদ্রুপ করে, বলে “এইসব বোকামি করে কী হবে?”—কিন্তু স্লোগানের ঝড়ের সামনে বিদ্রুপ ম্লান হয়ে যায়। প্রতিবাদের সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে যেন চারদিকে; প্রতিটি কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে অন্ধকারে আলো জ্বালানো প্রদীপ।
শুধু ছাত্রীরাই নয়, এবার গৃহবধূরা, শ্রমজীবী মহিলারাও ধীরে ধীরে ভিড় বাড়াতে শুরু করে। তাদের অনেকেই জীবনে কোনোদিন নিজের অধিকার নিয়ে রাস্তায় নামেনি, তবুও মেয়েদের দৃঢ় কণ্ঠ শুনে তাদের বুকের ভেতরেও জমে থাকা দমবন্ধ প্রতিবাদের আগুন জ্বলে ওঠে। লক্ষ্মী বৌদি প্রথমে সংকোচ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন ভিড়ের একপাশে, কিন্তু ধীরে ধীরে তার কণ্ঠও মিশে গেল স্লোগানে। অন্য নারীরাও সেই কণ্ঠে যুক্ত হতে থাকলেন। কেউ পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত শাড়ি গুটিয়ে এগিয়ে আসছে, কেউ আবার বুকের শিশুকে কোলে নিয়েই হাতে তুলে নিচ্ছে ব্যানার। সেই মুহূর্তে গ্রামের আকাশ যেন বদলে গেল—যেন দীর্ঘদিনের নীরবতা ভেঙে এক নতুন জাগরণের গান শোনা গেল। প্রতিটি মুখে দৃঢ়তা, প্রতিটি চোখে আগুন। তারা জানত না এই আন্দোলন কোথায় গিয়ে শেষ হবে, কিন্তু বুঝেছিল—আজ আর পিছিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
সংবাদপত্র আর সামাজিক মাধ্যমেও খবর ছড়িয়ে পড়ল। ক্যামেরার ফ্ল্যাশে ধরা পড়ল মেয়েদের মুখের দৃঢ়তা, বউদের কণ্ঠের ঝাঁজ। সাংবাদিকেরা গ্রামের মাটির মাঠে এসে সাক্ষাৎকার নিল, কেউ কেউ ভিডিও করে অনলাইনে ছড়িয়ে দিল। চারদিক থেকে সমর্থনের ঢল আসতে লাগল। কিন্তু এর পাশাপাশি রাজনৈতিক চাপও বাড়তে লাগল। শশাঙ্ক বাবু বুঝলেন, এই আন্দোলন দমন করা সহজ নয়। তার লোকেরা ভীতি সৃষ্টি করতে মাঠের চারপাশে ঘোরাফেরা শুরু করল। রাতে পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হলো, মাইকিং করে হুমকি দেওয়া হলো। তবুও মেয়েরা ভয় পেল না। তারা গলা উঁচু করে বলে উঠল—“আমাদের দাবি ন্যায্য, আমরা থামব না।” সেই কণ্ঠস্বর শুধু গ্রামে নয়, আশেপাশের গ্রামেও ছড়িয়ে পড়তে লাগল। প্রতিবাদের সেই আগুন আর শুধুমাত্র সুবর্ণার স্বপ্নের জন্য নয়, হয়ে উঠল নারীদের অস্তিত্ব আর শিক্ষার অধিকার রক্ষার এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ—যা নিভিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আর কারও হাতে নেই।
নয়
শশাঙ্ক বাবুর চোখে আগুন। গ্রামের মাটিতে মেয়েদের প্রতিবাদ তাকে যেন অপমানিত করে তুলেছিল। তার রাজনৈতিক ক্ষমতা, দাপট, ভয় দেখানোর কৌশল—সবকিছু যেন ভেঙে পড়ছে সেই ছোট্ট মেয়েদের জেদের সামনে। তাই এক রাত গভীর আঁধারে তার প্রেরিত গুণ্ডারা মাঠে গিয়ে মেয়েদের তাড়িয়ে দিতে চাইল। প্রথমে কয়েকজন ভয়ে সরে গেলেও অঞ্জলি মণ্ডল বুক ঠুকে দাঁড়িয়ে গেল সামনে। তার কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠলেও দৃঢ়তায় ভরা—“আমরা ভয় পাই না। আমাদের বই চাই।” গুণ্ডাদের হাতে লাঠি, চোখে হিংস্র দৃষ্টি; কিন্তু সেই কিশোরীর মাটির মতো শক্ত সাহস তাদের কাঁপিয়ে দিল। গ্রামের মানুষ যারা এখনো দ্বিধায় ছিলেন, দূর থেকে সেই দৃশ্য দেখলেন—এক কিশোরী, অন্ধকারের মাঝে, ভয়ঙ্কর ক্ষমতার সামনে দাঁড়িয়ে গেছে। তারা বুঝলেন, এই লড়াই শুধু একটা লাইব্রেরি নয়, এই লড়াই অসমতার শৃঙ্খল ভাঙার জন্য।
সংঘর্ষের উত্তাপ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। মেয়েরা জোট বেঁধে মাঠে শ্লোগান তুলতে লাগল, হাত ধরে একে অপরকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। গুণ্ডারা লাঠি উঁচিয়ে ভয় দেখালেও অঞ্জলির সেই একবিন্দু না কাঁপা সাহস তাদের অসহায় করে দিল। সুবর্ণা দূরে দাঁড়িয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকালেন—তিনি হয়তো ভাবেননি, তার এক শিক্ষার স্বপ্ন এত বড় অগ্নিশিখা হয়ে উঠবে। তার ভেতরে দ্বন্দ্ব জেগে উঠেছিল—সে কি তাদের নিরাপত্তার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে? কিন্তু যখন দেখলেন, অঞ্জলির বুক চিরে বেরোনো দৃঢ় কণ্ঠ, মীরার নির্ভীক হাত, ফারজানার গলা কাঁপলেও অটল দৃষ্টি—তিনি বুঝলেন, এ লড়াই থামানোর নয়। এ লড়াই জন্ম দিয়েছে এমন এক শক্তি, যা বহু বছর ধরে গ্রামকে গ্রাস করা অন্ধকার ভেঙে দেবে। গ্রামের পুরুষরাও সেই রাতে ভেবে উঠতে পারলেন না, কীভাবে ছোট ছোট মেয়েরা এমন ভয়কে জয় করতে পারে।
ভোরের আলো ফুটল যেন নতুন এক প্রতিজ্ঞা নিয়ে। সেই রাতের পর গ্রামে ফিসফাস থেমে গেল, শশাঙ্ক বাবুর দাপটও কমতে শুরু করল। কারণ মানুষ দেখল—মেয়েরা ভয়কে জয় করেছে। তাদের আর ভয় দেখিয়ে চুপ করানো যাবে না। গ্রামের উঠোনে, কুঁড়েঘরের বারান্দায়, এমনকি ক্ষেতের আলেও এখন শুধু একটাই কথা—“আমাদের মেয়েরা ভয় পায় না।” সুবর্ণার বুক ভরে উঠল অপরিসীম গর্বে। তিনি অনুভব করলেন, এ লড়াই আর কেবল তার একার নয়; এ লড়াই পুরো গ্রামের নারীদের, শিশুদের, এবং তাদের ভবিষ্যতের। এই সংঘর্ষই তাদের দৃঢ়তা হয়ে উঠল, এই ভয়ের মুখোমুখি দাঁড়ানোই হয়ে উঠল নতুন ইতিহাসের সূচনা। সুবর্ণা জানলেন, ইতিহাসের পাতায় নাম না উঠলেও এই রাত চিরকাল মনে রাখবে গ্রাম—যে রাতে মেয়েরা ভয়কে জয় করেছিল।
দশ
সকালের প্রথম সূর্যের আলোয় ভিজে ওঠা মাঠের বাতাসে এক ধরনের অনাবিল সতেজতা ছড়িয়ে ছিল, কিন্তু সেই সতেজতার ভেতরেও লুকিয়ে ছিল এক দীর্ঘ লড়াইয়ের সমাপ্তির প্রতিশ্রুতি। গত ক’মাস ধরে গ্রাম কেঁপে উঠেছিল মেয়েদের কণ্ঠে, তাদের সাহসী প্রতিবাদে, আর সুবর্ণার অবিচল অবস্থানে। শুরুতে এটি ছিল এক শিক্ষিকার নিঃসঙ্গ সংগ্রাম, পরে তা পরিণত হয়েছিল গ্রাম্য মেয়েদের অদম্য দাবিতে, আর শেষে রূপ নিয়েছিল নারীদের এক ঐক্যবদ্ধ বিদ্রোহে। অঞ্জলির অগ্নিময় কণ্ঠস্বর, লক্ষ্মী বৌদির দৃঢ় দৃষ্টি আর সুবর্ণার অবিচল বিশ্বাস মিলে গ্রামকে আলোড়িত করেছিল। যখন সংবাদপত্রের পাতায় এবং সামাজিক মাধ্যমে আন্দোলনের ছবি ছড়িয়ে পড়ে, তখন বিষয়টি আর শুধু একটি গ্রামের দাবি রইল না—এটি হয়ে উঠল শিক্ষার জন্য নারীর সংগ্রামের এক প্রতীক। প্রশাসন যখন অবশেষে নজর দিল, তখন গ্রামবাসীর বুকের ভেতর জমে থাকা আক্ষেপ, ক্ষোভ আর স্বপ্ন একসঙ্গে জেগে উঠল। শশাঙ্ক বাবুর দীর্ঘদিনের ভয় দেখানো রাজনীতি যেন মুহূর্তে দুর্বল হয়ে পড়ল, আর মানুষ বুঝতে পারল—ভয় নয়, ঐক্যই আসল শক্তি।
প্রশাসনের নির্দেশে গ্রামে তদন্ত শুরু হলো, আর মেয়েদের কণ্ঠে স্লোগান হয়ে উঠল তাদের সবচেয়ে বড় সাক্ষ্য। মাঠে দাঁড়িয়ে অঞ্জলি আবারো উচ্চারণ করল—“আমাদেরও বই চাই”—আর সেই শব্দ যেন বাতাস ভেদ করে প্রশাসনিক কানে গিয়ে আঘাত করল। শশাঙ্ক বাবুর প্রভাব ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে লাগল, তার সহযোগীরাও পিছিয়ে গেল, আর গ্রামবাসী বুঝতে পারল, সুবর্ণা সত্যিই তাদের জন্য লড়াই করছেন। দিন কয়েকের মধ্যে সরকারি সাহায্যে এবং গ্রামের মানুষদের শ্রমে একটি ছোট্ট ঘর তৈরি হলো—সেই ঘরই হয়ে উঠল প্রথম লাইব্রেরি। শোভন বাবুর দেওয়া পুরোনো বইগুলো ছিল এর প্রথম সম্পদ, কিন্তু সেই কয়েকটি বইয়ের ভেতরে লুকানো ছিল শত মানুষের স্বপ্ন আর হাজার মেয়ের ভবিষ্যৎ। যখন প্রথম দিন লাইব্রেরির দরজা খোলা হলো, গ্রামের মেয়েরা সাদা ফ্রক, সালোয়ার-কামিজ পরে, হাতে বই নিয়ে দাঁড়াল—তাদের চোখে ছিল অদম্য আলো। সেই দৃশ্য দেখে সুবর্ণার বুক ভরে উঠল, চোখ ভিজে গেল, কিন্তু ঠোঁটে ফুটে উঠল এক গভীর তৃপ্তির হাসি।
সেই মুহূর্তে তিনি বুঝলেন, এই জয় কেবল তার ব্যক্তিগত নয়, কেবল অঞ্জলিদেরও নয়—এ জয় সমগ্র গ্রামের নারীদের, এ জয় আগামীর পথচলার প্রতীক। আগুনের মতো যে প্রতিবাদ একসময় ছড়িয়ে পড়েছিল, তা আজ অগ্নিশিখার মতো দীপ্ত হয়ে উঠেছে জয়ের আলোয়। লাইব্রেরির ছোট্ট টেবিলে রাখা প্রথম বইটি ছুঁয়ে সুবর্ণা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন—এ আগুন একদিন গোটা সমাজকে আলোকিত করবে। গ্রামের উঠোনে বই হাতে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে মেয়েরা যেন ইতিহাসের নতুন অধ্যায় লিখছিল, যেখানে ভয় নয়, জ্ঞানই তাদের ভবিষ্যতের দিশারী। মাটির পথ, কাঁচা ঘর, দারিদ্র্য—সবকিছু পেছনে ঠেলে তারা এগিয়ে চলল শিক্ষার আলোয়। সুবর্ণা আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললেন, “আজকের এই অগ্নিশিখা আগামী প্রজন্মের জন্য পথ দেখাবে।” আর সত্যিই, সেই দিন থেকে গ্রামটি কেবল একটি গ্রামের নাম নয়—সে হয়ে উঠল নারীদের জাগরণের প্রতীক, যে জাগরণ সমাজের বুক জুড়ে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল।
—
				
	

	


