Bangla - তন্ত্র

অগ্নিমণ্ডল

Spread the love

অর্কদীপ সেন


পর্ব ১ : আগুনের পুঁথি

রুদ্রর বয়স তখন সাতাশ। কলকাতার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞানে তার গবেষণা শেষ পর্যায়ে। তার বিষয়—বাংলার লোকবিশ্বাস, ভূতপ্রেত, তন্ত্রমন্ত্র আর আচার। এই শহরে যাদের কাছে তন্ত্র কেবল এক অদ্ভুত ভয়ের প্রতীক, তাদের চোখে রুদ্র ছিল খানিকটা অদ্ভুতুড়ে। সে পুরোনো গ্রন্থাগারে বসে দিনের পর দিন প্রাচীন পুঁথি ঘাঁটতে ভালোবাসত, রাতে ঘরে ফিরে নিজের নোটবইয়ে লিখে রাখত অদ্ভুত সব ছেঁড়া ছেঁড়া তথ্য—যেন একটি ভাঙা আয়নার টুকরো একত্র করছে, কিন্তু আয়নার প্রতিফলন এখনও দেখা যায়নি।

এক বিকেলে, গরমের ধুলোয় ভরা মে মাসে, রুদ্র যায় নীলরতন লাইব্রেরির আর্কাইভ বিভাগে। আর্কাইভের ভেতর ঢুকলেই ম্লান আলোয় অদ্ভুত গন্ধ ছড়িয়ে থাকে—পুরোনো কাগজ, ইঁদুরের দাগ, আর কোনো এক অচেনা পচা-গন্ধ যা বাইরে বাতাসে নেই। কর্মচারীরা তাকে চেনে—‘সেই ছেলেটা যেটা সারাদিন খুঁজে বেড়ায় পুরোনো কাগজ।’ তাই তাকে আর বাধা দেয় না।

আর্কাইভের অন্ধকার কোণে হঠাৎই রুদ্রর চোখ পড়ে একটি খয়েরি কাপড়ে মোড়া পুঁথির দিকে। অন্য বইগুলোর মতো নয়—এটি রাখা ছিল একটি কাঠের বাক্সের ভেতরে, বাক্সে আবার ছোট্ট লোহার তালা। কিন্তু তালাটা ভাঙা, যেন বহুদিন আগে কেউ একে জোর করে খুলেছিল। বাক্স থেকে পুঁথিটা যখন বের করে আনল, তার আঙুলে লেগে রইল গুঁড়া হয়ে যাওয়া কাগজের ধুলো আর সঙ্গে এক অদ্ভুত উষ্ণতা—যেন বই নয়, আগুন ছুঁয়েছে।

পুঁথির নাম লেখা ছিল উল্টোদিকে, প্রাচীন অক্ষরে—“অগ্নিমণ্ডল তন্ত্র”।

এই নাম রুদ্রর ভেতর কেমন এক শিহরণ ছড়িয়ে দিল। তন্ত্র নিয়ে তার এত পড়াশোনা, এত কাহিনি—কোথাও এই নাম সে শোনেনি। পুঁথির পাতাগুলো জীর্ণ, কিছু জায়গায় আগুনে পোড়া দাগের মতো কালচে ছাপ। লেখা অদ্ভুত মিশ্র ভাষায়—সংস্কৃত, প্রাচীন বাংলা, আর কিছু কিছু অচেনা প্রতীক যা একেবারেই বোঝা যায় না।

প্রথম পাতায় লেখা—
“যে অগ্নিকে নিজের ভেতর জাগায়, সে মৃত্যুকেও দাস করে। কিন্তু যে অগ্নিকে সামলাতে পারে না, সে নিজের ছায়ার আগুনে ভস্ম হয়।”

রুদ্রর মনে হল, পুঁথি যেন তাকে দেখছে।

সে পুঁথির প্রথম কয়েক পৃষ্ঠা পড়ল। সেখানে বলা আছে মানুষের শরীরকে ঘিরে থাকা সাতটি অগ্নিচক্রের কথা—যা সাধারণ যোগশাস্ত্রে কুণ্ডলিনীচক্র নামে পরিচিত, কিন্তু এখানে এগুলো আলাদা নামে এসেছে। প্রতিটি চক্রের পাশে আঁকা আছে আগুনের বৃত্ত, আর ভেতরে আঁকা এক একটি অদ্ভুত প্রাণী—কোথাও সাপ, কোথাও শকুন, কোথাও আবার মানুষের মুখওয়ালা বাঘ।

রুদ্রর কৌতূহল বাড়তে থাকে। কিন্তু পুঁথির মাঝে হঠাৎ একটা পৃষ্ঠা আলাদা রঙে ঝলসে উঠল—পাতাটির উপরে লাল কালি দিয়ে আঁকা ছিল এক বৃত্তাকার মণ্ডল, মাঝখানে জ্বলন্ত সূর্যের মতো প্রতীক। তার চারপাশে লেখা ছিল একটি মন্ত্র—
“অগ্নির্বন্ধনমোচকং তত্রহি জপ।”

এই মন্ত্র পাঠ করতেই, রুদ্রর মনে হল বুকের ভেতর কেমন এক চাপা আগুন ধকধক করছে। চোখে অন্ধকার নেমে এলো। আর্কাইভের ম্লান আলো যেন আরও ঘন হয়ে এল, বুকের ভেতর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল।

ঠিক তখনই এক বৃদ্ধ কর্মচারী এসে কাঁধে হাত রাখল। রুদ্র চমকে উঠে বই বন্ধ করল। বৃদ্ধ বলল—
“ওটা হাতে নিয়েছ কেন? ও পুঁথির জন্য একদিন লাইব্রেরিতে অগ্নিকাণ্ড হয়েছিল। লোকজন বলে, বইটা যেখানেই থাকে, সেখানেই আগুন লাগে।”

রুদ্র কেঁপে উঠল। সে শুনেছিল, অনেক তন্ত্রপুঁথির সঙ্গে অভিশাপ জড়িয়ে থাকে। কিন্তু এতটা প্রত্যক্ষ সতর্কবার্তা আগে কখনও পায়নি। তবুও বুকের ভেতর কোথাও এক অদ্ভুত আকর্ষণ টানছিল তাকে—এই বই ছেড়ে যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব।

বৃদ্ধ আরও বলল—
“এই বইয়ের খোঁজে নাকি এখনও কিছু লোক আসে। তারা নিজেদের বলে ‘কপালকুণ্ডলা চক্র’। সাবধান থেকো।”

রুদ্রর মনে প্রশ্নের ঝড় উঠল। কপালকুণ্ডলা চক্র—এরা কারা? বইটার সঙ্গে ওদের সম্পর্ক কী?

সেদিন রাতে ঘরে ফিরে রুদ্র বইটা টেবিলের ওপর রাখল। জানলার বাইরে গরম হাওয়ায় গাছের পাতা শুকিয়ে বাজছিল। ঘরের বাতি নিভে যাওয়ার পরও বইটার ওপর যেন ক্ষীণ লালচে আলো জ্বলছিল, যেমন আগুন নিভে যাওয়ার পরও কয়লার ভেতর স্ফুলিঙ্গ বেঁচে থাকে।

সে বই খুলে আবার পড়তে লাগল। প্রতিটি লাইন যেন এক রহস্যের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। কোথাও লেখা আছে—
“যে নিজের ছায়াকে চেনে, সেই সত্যিকারের তান্ত্রিক।”
কোথাও আবার—
“অগ্নিমণ্ডলের দ্বার খুললে সময় আর মৃত্যুর নিয়ম ভেঙে যায়।”

রুদ্রর কানে যেন ফিসফিসানি ভেসে এলো। মনে হচ্ছিল ঘরে কেউ আছে। সে হঠাৎ তাকিয়ে দেখল—আয়নার ভেতর তার প্রতিচ্ছবি হাসছে। অথচ তার নিজের মুখে কোনো হাসি নেই।

ঘড়ির কাঁটা তখন রাত দুটো। জানলার বাইরে হঠাৎ ঝড় উঠল। বাতাসে পাতা উড়তে উড়তে টেবিলের ওপর এসে পড়ল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে বইয়ের ভেতর থেকে এক পাতলা ছাই বেরিয়ে এসে মেঝেতে ছড়িয়ে গেল। ছাইয়ের মধ্যে লেখা হল একটি শব্দ—
“শুরু।”

রুদ্র বুঝতে পারল—এটি কেবল বই নয়, এটি আহ্বান। অগ্নিমণ্ডল তন্ত্র তাকে ডেকেছে।

কিন্তু আহ্বানের মানে কী? আর সেই কপালকুণ্ডলা চক্র কেন এই বইয়ের জন্য আসে?

সে উত্তর খুঁজে পাবে, তবে তার আগে পেরোতে হবে ভয়ঙ্কর সব দরজা।

এভাবেই শুরু হল রুদ্রর অগ্নিমণ্ডলের যাত্রা।

 

পর্ব ২ : কপালকুণ্ডলার ছায়া

রুদ্রর ঘুম ভাঙল ভোর চারটে নাগাদ। জানলার বাইরে তখনও অন্ধকার, শুধু দূরে কোন অচেনা কাকের ডাক। শরীর জুড়ে এক অদ্ভুত ক্লান্তি, অথচ সে ঠিক ঘুমাতে পারেনি সারা রাত। টেবিলের ওপরে রাখা পুঁথিটা যেন জেগেই ছিল, অন্ধকার ঘরে মৃদু লালচে আভা ছড়িয়ে। রুদ্রর মনে হচ্ছিল, পুঁথি তার বুকের ভেতর কোথাও শ্বাস নিচ্ছে, আর তার ভেতরের আগুনটাকে জাগিয়ে তুলছে ধীরে ধীরে।

সে উঠে জানলার দিকে তাকাল। গরম হাওয়া যেন আরও ঘন হয়ে উঠেছে, আকাশে ভোরের আলো নেই—বরং ছড়িয়ে আছে ধূসর কুয়াশার মতো আস্তরণ। যেন শহর ঘিরে রেখেছে এক অচেনা পর্দা। রুদ্রর মনে হল, রাতের শেষে এ এক অন্য শহর, যেখানে মানুষের চেনা নিয়মকানুন চলে না।

সকালে কলেজে গিয়েও তার মাথা বইয়ের ভেতরেই আটকে রইল। ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তন্ত্র নিয়ে গল্প করলে অনেকেই হেসে ওঠে, কেউ বা মজা করে বলে—“দাদা, ভূত ডেকে দেখান না!” কিন্তু রুদ্র জানত, এই হাসির আড়ালেই লুকিয়ে আছে এক ভয়, যা মানুষ স্বীকার করে না। তারা তন্ত্রকে লোককথা ভেবে দূরে সরিয়ে রাখে, অথচ তন্ত্র বেঁচে থাকে ছায়ার মতো—চোখে না পড়লেও পাশে পাশে থাকে।

কলেজ থেকে বের হয়ে রুদ্র এক পুরোনো চায়ের দোকানে ঢুকল। গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতেই পাশে কেউ বসে পড়ল। লম্বা, গম্ভীর মুখ, মাথায় সাদা চুলের আঁচড়, চোখে কালি। লোকটা অদ্ভুতভাবে তাকাল রুদ্রর দিকে।

“তুমি কি অগ্নিমণ্ডল তন্ত্রের পুঁথি হাতে পেয়েছ?”—সরাসরি প্রশ্ন।

রুদ্র চমকে উঠল। “আপনি কে?”

লোকটা ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটিয়ে বলল, “আমরা যারা ছায়ায় থাকি, আমাদের নাম জানার দরকার নেই। তবে তুমি চাইলে বলতে পারি—আমি কপালকুণ্ডলা চক্রর একজন।”

শব্দটা শুনে রুদ্রর বুক কেঁপে উঠল। এরা কি সত্যিই আছে? নাকি কেউ কেবল ভয় দেখাতে চাইছে?

লোকটা আবার বলল, “পুঁথি যতক্ষণ তোমার কাছে আছে, তুমি আর সাধারণ থাকবে না। তোমাকে আমরা নজরে রাখব। পুঁথির প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি চিহ্ন আমাদের জন্য। কিন্তু মনে রেখো—যে এর রহস্য জানার চেষ্টা করে, তার জীবন আর আগের মতো থাকে না। তুমি কি নিশ্চিত, এ পথে এগোতে চাও?”

রুদ্র চুপ করে রইল। তার কানে তখনও বাজছিল আগের রাতের শব্দ—“শুরু।”

লোকটা চায়ের কাপ শেষ করে উঠে দাঁড়াল। যাবার আগে টেবিলে রেখে গেল একখানা ছোট কাগজ। তাতে কেবল আঁকা এক খুলি, আর তার ওপরে অগ্নিমণ্ডলের মতো বৃত্ত।

রুদ্র কাগজটা হাতে নিয়েই বুঝতে পারল, খেলাটা কেবল বই আর কৌতূহলের নয়—এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে জীবন্ত মানুষ, গোপন সমিতি, আর এক অদ্ভুত ষড়যন্ত্র।

রাত বাড়তেই বই খুলে সে পড়তে শুরু করল। পুঁথির দ্বিতীয় অধ্যায়ে লেখা—
“অগ্নিমণ্ডলের প্রথম দ্বার খুলতে হলে চাই রক্ত। রক্ত শুধু শরীরের নয়, রক্ত মানে ত্যাগ। যা সবচেয়ে প্রিয়, সেটাই দিতে হবে।”

এই লাইন পড়তে পড়তেই তার ফোন বেজে উঠল। ওপাশ থেকে ভয় পাওয়া কণ্ঠ—তার বন্ধু অনির্বাণ।

“রুদ্র, আজ আমার ঘরে অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। জানলার কাচে কেউ লাল রঙে লিখে দিল—‘অগ্নি’। অথচ আমার ঘর তালা দেওয়া ছিল!”

রুদ্র স্তব্ধ হয়ে গেল। অনির্বাণ তো বইয়ের কথা জানেই না। তবুও এই শব্দ তার জীবনে এসে পড়ল কেন?

পরদিন অনির্বাণ দেখা করতে এলো। তার মুখ ফ্যাকাশে, চোখ লালচে। বলল, “তুই কী পড়ছিস রে? আমার মনে হচ্ছে কেউ আমাদের দেখছে। ঘুমোতে গেলেই অচেনা ছায়া আসে।”

রুদ্র দ্বিধায় পড়ল। বন্ধুকে সত্যি বলবে? নাকি চেপে যাবে? কিন্তু অনির্বাণের চোখে ভয় দেখে সে আর গোপন রাখতে পারল না। সব খুলে বলল—পুঁথির কথা, মন্ত্রের কথা, কপালকুণ্ডলার লোকটার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা।

অনির্বাণ শুনে স্তম্ভিত। “মানে তুই সত্যিই ওই বই বাড়িতে রেখেছিস? রুদ্র, এটা তো বিপদ ডেকে আনা!”

রুদ্র হেসে বলল, “কিন্তু এর ভেতরেই তো সত্যি আছে। আমি জানি, এ বই শুধু ভয় দেখানোর জন্য নয়। এর ভেতরে লুকিয়ে আছে কিছু, যা মানুষকে বদলে দিতে পারে।”

সে রাতে ঘরে ফিরে আবার বই খুলল রুদ্র। কিন্তু এবার বইয়ের ভেতর থেকে ধোঁয়া উঠতে লাগল, ধোঁয়ার ভেতরে ভেসে উঠল কিছু অদ্ভুত মুখ—কখনও সন্ন্যাসী, কখনও যোদ্ধা, কখনও এক নারীর চোখ। তারা সবাই একসঙ্গে বলল—
“পথ শুরু হয়ে গেছে। পিছোবার আর উপায় নেই।”

ঠিক তখনই দরজায় টোকা।

রুদ্র দরজা খুলে দেখল—সেই চায়ের দোকানের লোকটা দাঁড়িয়ে। তার হাতে এক প্রদীপ, তাতে কেবল লাল জ্যোতি জ্বলছে।

লোকটা ধীরে ধীরে বলল, “সময় এসেছে প্রথম পরীক্ষার। রক্ত দিতে হবে।”

রুদ্রর বুক কেঁপে উঠল। বুঝতে পারল—অগ্নিমণ্ডলের আহ্বান এখন কেবল বইয়ের ভেতর নেই, বরং তার জীবনের ভেতর ঢুকে পড়েছে।

পর্ব ৩ : রক্তের অনুষ্টান

রুদ্র দরজার সামনে দাঁড়িয়ে স্তব্ধ। চায়ের দোকানের সেই লোকটা প্রদীপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে, প্রদীপ থেকে উড়ে আসছে টকটকে লাল আলো। লাল, কিন্তু আগুনের মতো হলুদাভ নয়—বরং কাঁচা রক্তের মতো উজ্জ্বল, যেন সজীব কোনো দেহ থেকে appena ঝরেছে। লোকটার মুখে অদ্ভুত শান্তি, অথচ তার চোখে টলমল করছে এক অচেনা হুমকি।

“চলো,” লোকটা বলল। “আজ রাতে প্রথম দ্বার খুলবে। রক্ত ছাড়া অগ্নিমণ্ডল কোনোদিন জাগে না।”

রুদ্রর গলা শুকিয়ে গেল। সে কিছু বলার আগেই লোকটা ঘরে পা রাখল, আর দরজা নিজের থেকে বন্ধ হয়ে গেল। চারপাশের আলো নিভে শুধু প্রদীপের লাল জ্যোতি ঘরে ছড়িয়ে পড়ল। ছায়া লাফাতে লাগল দেওয়ালে, মেঝেতে। ছায়াগুলো যেন জীবন্ত, কাঁপছে, প্রসারিত হচ্ছে, আবার সঙ্কুচিত হচ্ছে।

লোকটা মৃদু স্বরে মন্ত্র পড়তে লাগল—
“অগ্নিমণ্ডলং জাগরুকং কুরু,
রক্তমে পথপ্রদর্শকং ভব।”

প্রতিটি শব্দ ঘরের ভেতর প্রতিধ্বনিত হতে থাকল। রুদ্রর বুক কেঁপে উঠল, শিরায় শিরায় যেন অদ্ভুত উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ল। তার মনে হচ্ছিল, শরীরের ভেতর আগুন জমছে, যেন ভেতর থেকে কোনো অচেনা শক্তি বেরিয়ে আসতে চাইছে।

লোকটা প্রদীপটা রুদ্রর হাতে দিল। “তুই বেছে নে, কী দেবে রক্তের দান হিসেবে। মানুষ সবসময় ভাবে রক্ত মানেই শরীর কেটে দেওয়া। আসলে তা নয়। রক্ত মানে ত্যাগ—তোর সবচেয়ে প্রিয়, যা ছাড়া তুই অর্ধেক হয়ে যাবি।”

রুদ্র হতবুদ্ধি। “আমার প্রিয় জিনিস? মানে কী?”

লোকটা হাসল। “ভাব, কী ছাড়া তুই থাকতে পারবি না। সেটাই তোর রক্ত।”

রুদ্র চোখ বন্ধ করল। ছবির মতো ভেসে উঠল তার মা। কলকাতার শ্যামবাজারে মায়ের ছোট্ট ভাড়া-বাড়ি, যেখানে সে মাঝে মাঝে যেত। মা সবসময় বলত—“তুই এসব বই পড়িস না রে। জীবনে আলো চাই, অন্ধকার নয়।” তার মনে পড়ল অনির্বাণের মুখও, যে তার সঙ্গী, বন্ধু, অর্ধেক আত্মার মতো।

হঠাৎই তার বুকের ভেতর অদ্ভুত টান উঠল। যদি সত্যিই কাউকে হারাতে হয়? যদি এই তন্ত্র তার কাছ থেকে কেড়ে নেয় প্রিয়জনকে?

ঠিক তখন প্রদীপের জ্যোতি ছড়িয়ে মেঝেতে তৈরি করল এক মণ্ডল। মণ্ডলের ভেতর ফুটে উঠল তিনটে প্রতীক—একটা মায়ের মুখ, একটা অনির্বাণের চোখ, আর একটা তার নিজের পুরোনো ডায়েরি। ডায়েরির ভেতর রুদ্র লিখেছিল তার সব স্বপ্ন, ভয়, আর প্রেমের ভাঙা গল্প।

লোকটা বলল, “এগুলোর মধ্যে থেকে বেছে নে। আজ রাতে যেটা ত্যাগ করবি, সেটাই হবে তোর রক্ত। একবার বেছে নিলে আর ফেরত পাবি না।”

রুদ্র কেঁপে উঠল। মা, বন্ধু, নাকি নিজের লেখা?

সে ঝুঁকে মণ্ডলের ভেতর তাকাল। মায়ের মুখ ম্লান হয়ে গেল, কিন্তু চোখে টলমল জল। অনির্বাণের চোখে ভেসে উঠল নীরব অনুযোগ। আর ডায়েরি—হাজারটা রাতের নিঃসঙ্গতা, নিজের সত্তার ভাঙাচোরা টুকরো।

রুদ্রর হাত কেঁপে উঠল। সে ডায়েরির প্রতীকে হাত রাখল। মুহূর্তের ভেতর প্রতীকটা লালচে আগুনে জ্বলে উঠে ছাই হয়ে গেল। ঘরের ভেতর একটা অদ্ভুত শব্দ প্রতিধ্বনিত হল—মৃত মানুষের হাহাকার আর নবজাতকের কান্না একসঙ্গে।

লোকটা বলল, “তুই নিজের লেখা, নিজের স্বপ্ন, নিজের কণ্ঠকে রক্ত হিসেবে দিলি। আজ থেকে তুই যা লিখবি, তাতে আর তুই থাকবি না—থাকবে শুধু অগ্নিমণ্ডলের ছাপ।”

রুদ্রর বুক ধক করে উঠল। তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা যদি সত্যিই চলে যায়, তবে কি সে আর নিজে থাকবে?

কিন্তু ঠিক তখনই বইটা টেবিলের ওপরে খুলে গেল নিজের থেকে। পাতাগুলো দ্রুত উল্টোতে লাগল, হাওয়ার শব্দে। তারপর থেমে গেল এক জায়গায়। সেখানে লেখা—
“রক্ত দানের পর সাধক অগ্নির প্রথম দ্বার পার হয়। কিন্তু মনে রাখ, প্রতিটি ত্যাগের পরে তার ছায়া তাকে তাড়া করে।”

হঠাৎই রুদ্র দেখল ঘরের আয়নায় দাঁড়িয়ে আছে আরেকজন রুদ্র। তারই মতো চেহারা, কিন্তু চোখ রক্তাভ, ঠোঁটে বিদ্রূপের হাসি।

“তুই আমাকে মেরে ফেললি, রুদ্র,” প্রতিচ্ছবিটা বলল। “তুই নিজের কণ্ঠ হারালিস। আজ থেকে আমি তোর ছায়া, তোর প্রতিটি লেখার ভেতর আমিই কথা বলব।”

রুদ্র কেঁপে গেল। “না! আমি নিজেকে হারাইনি!”

কিন্তু ছায়া-রুদ্র হেসে উঠল, ভয়ঙ্কর ফিসফিসে স্বরে—“তুই যেভাবেই লিখিস, তাতে তোর ভেতরের ভয়, অন্ধকার, আর অগ্নি ফুটে উঠবেই। তুই আর মুক্ত নস।”

লোকটা প্রদীপ নিভিয়ে দিল। ঘর আবার অন্ধকারে ডুবে গেল, শুধু জানলার বাইরে ভোরের প্রথম আলো ঢুকছিল।

লোকটা বলল, “প্রথম দ্বার খুলে গেল। তুই এখন অগ্নিমণ্ডলের সাধক। কিন্তু সামলে চলিস, ছায়া কখনও ছেড়ে যায় না। তোর প্রতিটি কথায়, প্রতিটি চিন্তায় সে ঘুরে বেড়াবে।”

সে চলে গেল দরজা খুলে, কিন্তু ঘরের ভেতর রুদ্র একা দাঁড়িয়ে রইল। বুকের ভেতর এখনো ধুকপুক করছে অচেনা আগুন।

টেবিলের ওপর বইটা নিজের থেকে আবার বন্ধ হয়ে গেল। মলাটের ওপর লাল দাগ ফুটে উঠল—“প্রথম রক্ত দেওয়া হল।”

রুদ্র বুঝল, খেলা শুরু হয়ে গেছে। আর ফেরার পথ নেই।

কিন্তু তার ভেতর এক ভয় জমে উঠল—এবার যদি ছায়া সত্যিই তার জায়গা নিতে শুরু করে?

 

পর্ব ৪ : স্বপ্নের দ্বার

প্রথম রক্তদানের পর দিন কয়েক কেটে গেছে। কিন্তু রুদ্রর মনে হচ্ছিল, সময় যেন আর সোজাসুজি চলে না। একদিন রাত বারোটার মতো দীর্ঘ হয়ে থাকে, আবার অন্যদিন হঠাৎই গলে যায় আঙুলের ফাঁক দিয়ে। তার ডায়েরির পাতাগুলো ফাঁকা হয়ে গেছে—যতই লিখতে চায়, শব্দগুলো গলে যায় কালি ছড়িয়ে, যেন অদৃশ্য কোনো হাত সেগুলো মুছে দেয়। মনে হচ্ছিল, তার নিজের কণ্ঠস্বর কেউ কেড়ে নিয়েছে, আর লিখতে বসলে কলমে ওঠে অচেনা বাক্য—যেন অন্য কেউ লিখছে তার হাত দিয়ে।

রুদ্রর বন্ধু অনির্বাণ এসময় তাকে দেখতে এলো। তার চোখে ভয়ের ছায়া।
“রুদ্র, তুই বদলে যাচ্ছিস। তোর মুখে আগের মতো কথা নেই। তোর চোখে আমি দেখি অন্য কাউকে।”

রুদ্র কিছু বলল না। শুধু হাসল। সেই হাসি এতটাই অদ্ভুত, যে অনির্বাণ চুপ করে গেল।

সেদিন রাতে, আকাশে মেঘের ভেতর চাঁদ ঢাকা। রুদ্র আবার বই খুলল। পাতাগুলো এবার নিজের থেকে উল্টে গিয়ে থেমে গেল একটি অধ্যায়ে, যার শিরোনাম—স্বপ্নদ্বার”

প্রথম লাইনেই লেখা ছিল—
“সাধক যখন প্রথম রক্ত দিয়ে দেয়, তখন স্বপ্ন তাকে ডাকে। স্বপ্নের ভেতর সে দেখে নিজের অতীত, বর্তমান আর অচেনা ভবিষ্যৎ। কিন্তু সাবধান—যা দেখবে, তা সত্যিও, আবার মিথ্যেও।”

রুদ্রর বুকের ভেতর শীতল শিহরণ বয়ে গেল। পড়তে পড়তেই তার চোখ ভারী হয়ে এল। ঘর অন্ধকার হয়ে গেল, আর সে যেন ভেসে গেল এক অচেনা গভীরতার দিকে।

স্বপ্নের ভেতরে

সে দাঁড়িয়ে আছে এক বিরাট প্রান্তরে। আকাশ জ্বলজ্বল করছে লাল রঙে, চারপাশে আগুনের মতো আভা। দূরে এক নদী বয়ে যাচ্ছে, অথচ নদীর জল কালো, ঘন কালি। নদীর ওপারে দেখা যাচ্ছে বিশাল এক মন্দির, যার গম্বুজ ছুঁয়ে গেছে আকাশ। মন্দিরের গায়ে খোদাই অদ্ভুত প্রতীক—অগ্নিবৃত্ত, খুলির মালা, আর অসংখ্য চোখ।

হঠাৎ সে শুনল, তার নাম ধরে কেউ ডাকছে।
“রুদ্র… রুদ্র…”

সে ঘুরে দেখল, অনির্বাণ দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তার শরীর আধা-স্বচ্ছ, যেন কাচের ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে ভেতরের শিরা-উপশিরা। অনির্বাণের চোখ লাল, আর ঠোঁট থেকে ঝরে পড়ছে আগুনের ধোঁয়া।

“তুই আমাকে ত্যাগ করবি, রুদ্র?”—সে বলল।
“না! আমি তোকে ত্যাগ করিনি, আমি শুধু আমার লেখা…”—রুদ্রর কথা শেষ হওয়ার আগেই অনির্বাণের দেহ ভেঙে গেল, ছাই হয়ে উড়ে গেল বাতাসে।

রুদ্র ছুটে গেল নদীর ধারে। কালো জলের ভেতরে সে দেখল নিজের প্রতিবিম্ব। কিন্তু সেটা তার মতো নয়—চোখ লাল, কপালে আগুনের দাগ, ঠোঁটে বিকৃত হাসি। সেই প্রতিচ্ছবি ফিসফিস করে বলল—
“তুই যত এগোবি, ততই আমি তোর জায়গা নেব।”

হঠাৎ নদীর ওপারের মন্দিরে ঘণ্টা বাজল। কানে এল অজস্র মানুষের একসাথে মন্ত্রপাঠ—
“অগ্নিমণ্ডলং, অগ্নিমণ্ডলং, স্বপ্নদ্বারং খলু জাগরুকং।”

মন্দিরের দরজা খুলল। ভেতর থেকে বেরিয়ে এল এক নারী। তার চোখ অন্ধকার, কিন্তু শরীর আলো ছড়াচ্ছে। কণ্ঠস্বর বজ্রের মতো—
“তুই প্রস্তুত? স্বপ্নের দ্বার এখন খুলবে। কিন্তু মনে রাখ, একবার পার হলে ফেরার পথ থাকবে না।”

রুদ্রর মনে হল বুকের ভেতর আগুন জ্বলছে। সে ধীরে ধীরে নদীতে পা দিল। কালো জলের ভেতর ঢুকে পড়তেই সারা শরীর কেঁপে উঠল। জলের ভেতর থেকে হাত বেরিয়ে এল—মৃত মানুষের হাত, ঠান্ডা, ভেজা। তারা তাকে টেনে নিতে চাইছিল নিচে।

রুদ্র চিৎকার করল, কিন্তু শব্দ বেরোল না। শেষ মুহূর্তে সেই নারী হাত বাড়িয়ে তাকে ওপারে টেনে নিল।

দ্বারের ওপারে

মন্দিরের ভেতর ঢুকতেই সে দেখল, চারদিকে অসংখ্য দরজা। প্রতিটি দরজার ওপরে লেখা আছে এক একটি শব্দ—“মৃত্যু”, “ভয়”, “সত্য”, “মায়া”, “আলো”, “ছায়া”।

নারী বলল, “তুই এখন কেবল একটাই দরজা খুলতে পারবি। কিন্তু মনে রাখ, যা বাছবি, তাই হবে তোর নিয়তি।”

রুদ্রর চোখ পড়ল “সত্য” লেখা দরজায়। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে হাত রাখল। দরজা খুলতেই সে হোঁচট খেয়ে পড়ল এক অচেনা ঘরে।

ঘরে এক বৃদ্ধ সন্ন্যাসী বসে আছেন। তার চোখে শূন্যতা, ঠোঁটে মৃদু হাসি। সন্ন্যাসী বললেন—
“তুই রক্ত দিলি, এখন তুই সত্য চাইছিস? সত্য মানে যা তুই দেখতে চাইছিস না। তোর ভেতরের ভয়, তোর ভেতরের মৃত্যু—সবটাই সত্য।”

রুদ্রর চোখের সামনে ভেসে উঠল তার মা। মায়ের কপাল ফেটে রক্ত ঝরছে, ঠোঁটে ফিসফিসানি—
“রুদ্র, তুই যে পথ বেছে নিয়েছিস, সেখানে আলো নেই। শুধু আগুন।”

রুদ্র কাঁদতে চাইলো, কিন্তু চোখে জল এল না। সন্ন্যাসী আবার বললেন—
“তুই যত এগোছিস, ততই অগ্নি তোকে ভেতর থেকে বদলাচ্ছে। একসময় তুই নিজেকে চিনবিও না।”

তারপর সব মিলিয়ে গেল। রুদ্র হঠাৎই নিজের ঘরে জেগে উঠল।

জাগরণের পরে

ঘড়িতে তখন রাত তিনটে। টেবিলের ওপর বইটা খোলা, আর তাতে নতুন করে লেখা হয়েছে লাল অক্ষরে—
“স্বপ্নদ্বার পার হল। এখন ছায়া আর আলো সমান তোর মধ্যে।”

রুদ্র আয়নায় তাকাল। প্রতিচ্ছবির ঠোঁটে হাসি। তার নিজের ঠোঁট নিস্তেজ।

তখনই ফোন বেজে উঠল। অনির্বাণের নম্বর। ওপাশ থেকে ভাঙা গলায় অনির্বাণ বলল—
“রুদ্র, আমি ভয় পাচ্ছি। প্রতিরাতে দেখি কেউ আমার স্বপ্নে আসে, তার চোখে আগুন… সে দেখতে হুবহু তোর মতো।”

রুদ্রর বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। বুঝল, স্বপ্ন আর বাস্তবের সীমানা ভেঙে যাচ্ছে। আর সেই ছায়া শুধু তাকে নয়, তার প্রিয়জনদেরও তাড়া করছে।

এভাবেই স্বপ্নের দ্বার খুলল। আর এখন রুদ্রর ভেতরে আলো-অন্ধকারের খেলা শুরু হয়ে গেল, যেখানে প্রতিটি স্বপ্ন আসলে ভবিষ্যতের ইঙ্গিত, আর প্রতিটি ভবিষ্যৎ আবার মৃত্যুর ছায়ায় মোড়া।

 

পর্ব ৫ : অন্ধকারের সাধনা

স্বপ্নদ্বার পার হবার পর রুদ্র বুঝতে পারল—এবার থেকে আর কোনো কিছুকে সাধারণ চোখে দেখা যাবে না। আকাশের রং, মানুষের চোখ, বাতাসের শব্দ—সবকিছুতেই লুকিয়ে আছে ইঙ্গিত, যেন অদৃশ্য কেউ তাকে পথ দেখাচ্ছে আবার ভয় দেখাচ্ছে। দিনগুলোতে সে যেন আধা-জাগ্রত, আর রাতগুলোতে স্বপ্ন আর বাস্তব একসঙ্গে গুলিয়ে যাচ্ছে।

এক সন্ধ্যায়, কলকাতার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সে হঠাৎ অনুভব করল, কেউ তাকে অনুসরণ করছে। পেছনে তাকাতেই এক ছায়া দেখা গেল—কালো আলখাল্লা ঢাকা মানুষ, মুখ বোঝা যাচ্ছে না। ভিড়ের মধ্যে সে যেন ভেসে যাচ্ছে, কিন্তু রুদ্র যেদিকেই হাঁটে, ছায়াটা পিছু নেয়। অবশেষে চৌরঙ্গির মোড়ে ভিড় ফাঁকা হতেই রুদ্র থেমে দাঁড়াল। তখনই সেই ছায়ামূর্তি এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল—
“অন্ধকারের সাধনা ছাড়া কোনো সাধক পূর্ণ হয় না। প্রস্তুত হও।”

বলেই সে অদৃশ্য হয়ে গেল।

রুদ্রর শরীর কেঁপে উঠল। বুঝল, এবার তাকে নামতে হবে গভীর অন্ধকারের মধ্যে।

সমাধিক্ষেত্রের ডাক

সেই রাতেই স্বপ্নে এক সমাধিক্ষেত্র ভেসে উঠল। ঘন কুয়াশার ভেতর ছড়িয়ে আছে ভাঙা সমাধিফলক, চারপাশে জ্বলে উঠছে ম্লান প্রদীপ। বাতাসে পচা মাটির গন্ধ। আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক অচেনা নারী, তার চুল ছড়ানো, চোখে ভয়ের আলো।

“এসো,” নারী বলল। “অন্ধকারের সাধনা ছাড়া অগ্নিমণ্ডল তোর ভেতরে পূর্ণ হবে না।”

রুদ্র হঠাৎ চমকে উঠে জেগে গেল। কিন্তু বুকের ভেতর সেই স্বপ্নের গন্ধ, সেই নারীর ডাক রয়ে গেল।

সে পরদিন রাতে ঠিক করল, যাবে। বইটা খুলে দেখল—পাতায় লেখা আছে দিকনির্দেশ—
“দক্ষিণ কলকাতার এক পুরোনো কবরখানা, যেখানে আলো পৌঁছোয় না। সেখানেই শুরু হবে অন্ধকারের সাধনা।”

রুদ্রর বুক কেঁপে উঠল। সে আগে কখনও কবরখানায় যায়নি। তবু রাত বারোটায়, শহর যখন নিস্তব্ধ, তখন সে পৌঁছোল গড়িয়াহাটের কাছের এক পুরোনো সমাধিক্ষেত্রে।

অন্ধকারের ভেতরে

গেট ঠেলে ঢুকতেই বুক শিউরে উঠল। চারপাশে গাছপালা গজিয়েছে, সমাধিগুলো শ্যাওলায় ঢাকা। বাতাসে পচা পাতার গন্ধ। কুকুর ডাকছিল দূরে। রুদ্রর হাতে কেবল একটি টর্চ, কিন্তু টর্চের আলো জ্বলছিল না। যেন কবরখানার ভেতরেই আলো নিভে গেছে।

ঠিক তখনই মাটি কেঁপে উঠল। সমাধির ভেতর থেকে ফিসফিস শোনা গেল—
“এসো… এসো…”

সে বুক শক্ত করে এগোল। মাঝখানে এসে দাঁড়াতেই মাটির নিচ থেকে ধীরে ধীরে বেরোল আগের রাতের সেই নারী। তার শরীর অর্ধেক মাটি মাখা, চোখ জ্বলছে অন্ধকারে।

“তুই যদি সত্যিই সাধক হতে চাস, তবে ভয়কে আলিঙ্গন কর।”

রুদ্র কাঁপা গলায় বলল, “কী করতে হবে আমাকে?”

নারী হাসল, আর মাটিতে আঙুল দিয়ে আঁকল এক অদ্ভুত মণ্ডল। মণ্ডলের ভেতর কালো ধোঁয়া উঠতে লাগল।
“মণ্ডলের মধ্যে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ কর। তারপর যা আসবে, তাকে অস্বীকার করিস না।”

রুদ্র মণ্ডলের মধ্যে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করল।

অন্ধকারের পরীক্ষায়

প্রথমে নিস্তব্ধতা। তারপর চারপাশ থেকে শব্দ আসতে লাগল। কারও কান্না, কারও চিৎকার, কারও হাসি। হঠাৎই তার কানে এল মায়ের কণ্ঠ—
“রুদ্র, তুই আমাকে কেন অন্ধকারে ঠেলে দিলি?”

রুদ্র চোখ খুলতে চাইল, কিন্তু চোখ খোলা গেল না। বুক ধকধক করতে লাগল। সে ফিসফিস করে বলল, “না মা, আমি কিছু করিনি।”

এরপর শোনা গেল অনির্বাণের গলা—
“তুই আমাকে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিস, রুদ্র। তুই লিখিস না, কিন্তু তোর ছায়া আমাকে তাড়া করছে।”

রুদ্রর বুক ভেঙে আসছিল। অন্ধকারের ভেতর থেকে আবার সেই ছায়া-রুদ্র ভেসে উঠল। লাল চোখ, ঠোঁটে বিকৃত হাসি।
“এবার আমি তোর জায়গা নেব। তুই ভয় পাবি, আর আমি সেই ভয় দিয়ে বাঁচব।”

রুদ্রর মনে হল সে পাগল হয়ে যাবে। বুকের ভেতর আগুনের মতো ব্যথা।

তখন হঠাৎ সেই নারী আবার বলল, “ভয়কে আলিঙ্গন কর। পালালে তুই হেরে যাবি।”

রুদ্র দাঁত কামড়ে চোখ মেলল। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মৃত মানুষের দল। তাদের গায়ের মাংস গলে পড়ছে, চোখ ফাঁকা। তারা একসঙ্গে হাত বাড়িয়ে ডাকছে।

রুদ্র এগিয়ে গেল। তাদের হাত ধরল। মুহূর্তেই তার শরীর বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেল। কিন্তু ঠিক তখনই তার বুকের ভেতর আলো জ্বলে উঠল। আগুন নয়, বরং সাদা এক জ্যোতি, যা অন্ধকার ভেদ করে ছড়িয়ে পড়ল। মৃতদের দল মিলিয়ে গেল। ছায়া-রুদ্র অদৃশ্য হল, শুধু তার হাসির প্রতিধ্বনি থেকে গেল।

রুদ্র হাঁপাতে হাঁপাতে দাঁড়িয়ে রইল। নারী বলল,
“তুই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। অন্ধকার তোকে ভয় দেখাতে পারেনি। এবার থেকে তুই অন্ধকারকেও নিজের শক্তি বানাবি।”

সাধনার পর

সমাধিক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে আসতেই রুদ্র দেখল, ভোর হয়ে গেছে। আকাশে লালচে আলো, পাখির ডাক। শহরের রাস্তায় ট্রাম চলছে, মানুষ হাঁটছে। অথচ তার মনে হচ্ছিল, সে যেন আর এই শহরের কেউ নয়।

বাড়ি ফিরে বই খুলে দেখল—পাতার উপরে নতুন লেখা ফুটে উঠেছে লাল কালি দিয়ে—
“অন্ধকারের সাধনা সম্পূর্ণ। আলো ও ছায়া এখন তোর সঙ্গী।”

আয়নায় তাকাতেই সে দেখল—তার চোখে এখন এক অদ্ভুত দীপ্তি। সাধারণ নয়, অচেনা।

কিন্তু সেই হাসির প্রতিধ্বনি এখনও কানে বাজছিল। ছায়া-রুদ্র পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি, বরং কোথাও অপেক্ষা করছে।

পর্ব ৬ : মৃত্যু উপাসনা

অন্ধকারের সাধনার পর রুদ্রর শরীরটা যেন বদলে যেতে শুরু করল। আয়নায় তাকালেই সে বুঝতে পারছিল, চোখের ভেতর এখন আর আগের মতো মানুষী দীপ্তি নেই—সেখানে ভেসে থাকে শূন্যতা, আর মাঝে মাঝে ফুটে ওঠে আগুনের স্ফুলিঙ্গ। মানুষকে দেখলে তার ভেতরে এক অদ্ভুত বোধ জেগে উঠত, যেন তাদের গায়ের গন্ধ, তাদের ভয় আর গোপন দুর্বলতা সে টের পেয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু এই বদল তাকে শান্তি দিচ্ছিল না। রাতে ঘুমোতে গেলেই ছায়া-রুদ্র এসে দাঁড়াত তার শিয়রে, ফিসফিস করে বলত—
“এবার মৃত্যু আসবে। তুই কি প্রস্তুত?”

এক রাতে বই নিজে থেকেই খুলে গেল। পাতায় লেখা উঠল—
“অগ্নিমণ্ডলের তৃতীয় দ্বার মৃত্যু। মৃত্যু কে যদি উপাসনা করতে না শেখে, তবে সাধক কখনও পূর্ণ হয় না। মৃত্যু মানে শেষ নয়—বরং দ্বার।”

এই লাইন পড়তে পড়তেই জানলার কাচে হঠাৎ ধাক্কা লাগল। রুদ্র উঠে গিয়ে দেখল, বাইরে দাঁড়িয়ে আছে এক শকুন। তার চোখে লাল আভা, ঠোঁটে ঝুলছে রক্তমাখা মাংস। শকুন একবার ডাক দিল, তারপর উড়ে গেল। রুদ্র বুঝল, এবার মৃত্যু তাকে ডাকছে।

শ্মশানের পথে

পরদিন ভোরে সে বেরোল কাশীপুরের এক পুরোনো শ্মশানের দিকে। গঙ্গার ধার, যেখানে রাতভর আগুন জ্বলে, আর ভোর হলে শুধু ছাই পড়ে থাকে। সে জানত, মৃত্যু উপাসনা কেবল শ্মশানেই সম্ভব।

পৌঁছেই দেখল, একটা চিতা এখনও ধুঁকছে। ছাইয়ের ভেতর থেকে ধোঁয়া উঠছে। বাতাসে পুড়ে যাওয়া কাঠ আর চুলের গন্ধ। রুদ্রর গা শিউরে উঠল, কিন্তু সে জানত, পিছিয়ে আসার উপায় নেই।

হঠাৎই এক বৃদ্ধ সন্ন্যাসী তার সামনে এসে দাঁড়াল। গায়ে মাখনচীর্ণ ধুতি, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, চোখে শূন্য দৃষ্টি।
“তুইই কি সেই আগুনের সাধক?”—সন্ন্যাসী জিজ্ঞেস করল।

রুদ্র মাথা নেড়ে সম্মতি দিল।

সন্ন্যাসী বলল, “তাহলে চল, মৃত্যু উপাসনা শুরু করি।”

উপাসনার আয়োজন

সন্ন্যাসী তাকে নিয়ে গেল শ্মশানের এক কোণে। সেখানে মাটিতে আঁকা ছিল এক বিশাল মণ্ডল—খুলি দিয়ে সাজানো, মাঝখানে রাখা প্রদীপ। প্রদীপের আলো অদ্ভুত, আগুনে আলো নেই, বরং কালচে আভা।

“এই মণ্ডলে বস। চোখ বন্ধ কর। আজ রাতে মৃত্যু নিজে তোর সামনে আসবে,”—সন্ন্যাসী বলল।

রুদ্র মণ্ডলের মধ্যে পদ্মাসনে বসল। চারদিকে কেবল শূন্যতা, গঙ্গার হাওয়া আর অদ্ভুত গন্ধ। সে চোখ বন্ধ করতেই সন্ন্যাসী মন্ত্রপাঠ শুরু করল—
“মৃত্যুমুখে জীবনের আলো,
অগ্নিমণ্ডলে ছাইয়ের জ্বালা।
এসো, এসো, মৃত্যুর দেবী।”

মন্ত্র ধ্বনিত হতেই হাওয়া বদলে গেল। হঠাৎ চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে এল, যেন পৃথিবী থেমে গেছে।

মৃত্যুর আবির্ভাব

চোখ খুলে রুদ্র দেখল, সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক নারী। তার শরীরে শাড়ি নয়, বরং ছাই মাখা কাপড়, গলায় খুলির মালা। চোখ দুটো গাঢ় অন্ধকার, কিন্তু তাতে এমন টান, যেন সব আলোকে গ্রাস করছে।

তিনি এগিয়ে এসে বললেন—
“তুই কি মৃত্যু চাস, নাকি মৃত্যুকে জয় করতে চাস?”

রুদ্র কাঁপা গলায় বলল, “আমি বুঝতে চাই মৃত্যু কী।”

নারী হেসে উঠলেন। সেই হাসি এতটা কর্কশ যে চারপাশে চিতা ভেঙে পড়ল। তিনি বললেন,
“মৃত্যু মানে শেষ নয়, রুদ্র। মৃত্যু মানে পরিবর্তন। যা আজ তোর কাছে প্রিয়, কাল তা মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। তুই যদি মৃত্যুকে ভয় করিস, তবে অগ্নিমণ্ডল তোর ভেতরে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। কিন্তু যদি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করিস, তবে তুই সময়ের বাঁধন ভাঙতে পারবি।”

রুদ্রর বুক কেঁপে উঠল।

নারী হাত বাড়ালেন। তার হাত ছিল বরফের মতো ঠান্ডা। তিনি রুদ্রকে মণ্ডলের বাইরে টেনে নিলেন। হঠাৎ রুদ্র দেখল, চারপাশে ছড়িয়ে আছে তার নিজের অসংখ্য দেহ—কোথাও কিশোর রুদ্র, কোথাও তরুণ, কোথাও বৃদ্ধ, কোথাও পচা লাশ। সব দেহ তাকে ঘিরে ধরছে।

“দেখ, এরা সব তুই। প্রতিটি মুহূর্তে তুই মরছিস, আবার জন্ম নিচ্ছিস।”

রুদ্র হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। বুকের ভেতর কাঁপুনি। সে ফিসফিস করে বলল, “আমি মৃত্যুকে মেনে নিলাম।”

চিহ্ন

মুহূর্তেই নারীর শরীর থেকে আলো বেরিয়ে এসে রুদ্রর কপালে বসে গেল। কপালে আগুনের মতো একটি চিহ্ন ফুটে উঠল—ত্রিভুজের ভেতর একটি খুলি।

নারী বললেন,
“এখন থেকে তুই মৃত্যুকে ডাকতে পারবি, মৃত্যুর সঙ্গে কথা বলতে পারবি। কিন্তু সাবধান, মৃত্যু খেলনা নয়। তুই যত ডেকে আনবি, ততই মৃত্যুর ছায়া তোর প্রিয়জনদের ঘিরে ফেলবে।”

তারপর তিনি মিলিয়ে গেলেন অন্ধকারে।

উপাসনার পর

রুদ্র যখন চোখ খুলল, তখন ভোর হয়ে গেছে। সন্ন্যাসী নেই, মণ্ডলও নেই। শুধু চারপাশে ছাই আর ধোঁয়া। কিন্তু কপালে সেই চিহ্ন এখনও জ্বলছে।

সে বাড়ি ফিরল। আয়নায় তাকিয়ে দেখল, চিহ্নটা আসলেই আছে—কখনও ম্লান, কখনও উজ্জ্বল। কিন্তু চোখে তাকালেই বোঝা যায়, সে আর আগের রুদ্র নেই।

সেই রাতে ফোন এলো অনির্বাণের কাছ থেকে। ওপাশে ভাঙা গলা—
“রুদ্র, আমি আর পারছি না। প্রতিরাতে দেখি তুই আমার ঘরে দাঁড়িয়ে আছিস, তোর কপালে আগুনের চিহ্ন, তুই শুধু বলছিস—‘এসো মৃত্যুর দিকে।’ আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।”

রুদ্র চুপ করে রইল। সে জানত, মৃত্যু এখন কেবল তার নয়—তার প্রিয়জনের জীবনেও ছায়া ফেলছে।

শেষ পংক্তি

বইটা আবার খুলে গেল। পাতায় লেখা—
“মৃত্যুকে মেনে নিলি। এবার থেকে তুই জীবিত আর মৃতের মাঝের পথিক।”

রুদ্র বুঝল, অগ্নিমণ্ডলের তৃতীয় দ্বার সে পেরিয়ে এসেছে। কিন্তু এখন থেকে প্রতিটি শ্বাস, প্রতিটি রাত, প্রতিটি সম্পর্ক মৃত্যুর ছায়ায় মোড়া থাকবে।

পর্ব ৭ : আত্মার আয়না

মৃত্যুর উপাসনার পর থেকে রুদ্রর জীবনে অদ্ভুত পরিবর্তন আসতে লাগল। তার কপালের আগুনচিহ্ন অদৃশ্য হতে চাইলেও পারত না—দিনে তা প্রায় অদৃশ্য, কিন্তু রাতে বা ছায়ার মধ্যে দাঁড়ালেই জ্বলজ্বল করে উঠত। আশেপাশের মানুষ তাকে অস্বাভাবিক চোখে দেখত। অনির্বাণ ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছিল, মায়ের কাছে ফোন করলে মা অকারণ অস্থির হয়ে পড়তেন। রুদ্র বুঝতে পারছিল, মৃত্যু এখন কেবল তার মধ্যে নয়—তার ছায়া প্রিয়জনদের ভেতরেও ঢুকে পড়ছে।

এক রাতে বইটা আবার খুলে গেল। পাতায় নতুন অক্ষর ফুটে উঠল—
“অগ্নিমণ্ডলের চতুর্থ দ্বার আত্মার আয়না। সাধক যদি নিজের আত্মাকে দেখতে না শেখে, তবে ছায়া তাকে গ্রাস করবে।”

রুদ্রর বুক কেঁপে উঠল। ছায়া-রুদ্রের ভয়ঙ্কর হাসি তার মনে পড়ে গেল। সত্যিই কি এবার তার মুখোমুখি হতে হবে নিজের সেই অচেনা প্রতিচ্ছবির?

আয়নার সন্ধান

বইয়ে লেখা ছিল, আত্মার আয়না পাওয়া যাবে শহরের উত্তরপ্রান্তে এক পরিত্যক্ত রাজবাড়ির ভেতর। সেই রাজবাড়ি নিয়ে বহু গুজব—লোকেরা বলে, সেখানে রাতে অদ্ভুত শব্দ শোনা যায়, আয়নায় কারও মুখ ভেসে ওঠে। বহু বছর ধরে তা বন্ধ, কিন্তু কেউ সাহস করে ভেতরে যায় না।

রুদ্র রাতে একাই বেরোল। চাঁদের আলোয় ভাঙাচোরা প্রাসাদের সামনে দাঁড়াতেই তার বুক কেঁপে উঠল। লতাপাতায় ঢাকা জানালা, ভাঙা দরজা, আর বাতাসে পচা কাঠের গন্ধ।

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই ধুলো আর অন্ধকার তাকে ঘিরে ফেলল। সে টর্চ জ্বালালেও আলো দূরে পৌঁছোল না, যেন দেয়ালগুলো আলো গিলে নিচ্ছে। করিডর পেরিয়ে সে পৌঁছোল এক বিশাল হলঘরে। ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি বিশাল আয়না—ভাঙা, ধুলো জমে থাকা, তবু রহস্যময় দীপ্তি ছড়াচ্ছে।

প্রতিচ্ছবির আবির্ভাব

রুদ্র আয়নার সামনে দাঁড়াতেই বুক ধুকপুক করে উঠল। প্রথমে সে নিজেকেই দেখল—ক্লান্ত চোখ, কপালে ম্লান চিহ্ন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রতিচ্ছবি বদলাতে শুরু করল।

আয়নায় ভেসে উঠল ছায়া-রুদ্র। তার চোখ রক্তাভ, ঠোঁটে বিদ্রূপের হাসি।
“অবশেষে তুই এসেছিস,” প্রতিচ্ছবি বলল।
রুদ্র ফিসফিস করে বলল, “তুই কে?”
“আমি তুই-ই। তোর ভয়, তোর কামনা, তোর হিংসা—যা তুই স্বীকার করতে চাস না, আমি তাই। তুই যত ত্যাগ করিস, আমি তত শক্তিশালী হচ্ছি।”

রুদ্র কাঁপতে লাগল। কিন্তু বইয়ের কথা মনে পড়ে গেল—নিজের আত্মাকে দেখতে না শেখলে ছায়া গ্রাস করবে।

সে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “আমি তোর অস্তিত্ব মানি। তুই আমারই অংশ।”

ছায়া-রুদ্র হেসে উঠল। “তুই যদি আমাকে মেনে নাস, তবে তোর সবকিছু আমি কেড়ে নেব।”

আত্মার পরীক্ষা

হঠাৎ আয়না জ্বলজ্বল করতে লাগল। রুদ্রর চারপাশ মিলিয়ে গিয়ে সে নিজেকে দেখল এক অদ্ভুত জগতে। চারদিকে অসংখ্য আয়না দাঁড়িয়ে, প্রতিটিতে ভিন্ন ভিন্ন রুদ্র। কোথাও সে শিশু, কোথাও সে বৃদ্ধ, কোথাও সে খুনি, কোথাও সে ভিখিরি। প্রতিটি আয়নায় রুদ্র নিজেকে দেখছে, কিন্তু প্রতিটি আলাদা নিয়তি।

একটি আয়নায় সে দেখল, তার মা কাঁদছে, আর সে উদাসীন মুখে তাকিয়ে আছে। আরেকটায় দেখল, অনির্বাণকে সে ছুরিকাঘাত করছে। আবার অন্য আয়নায় দেখল, সে একদল মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে, আর তাদের সবাই আগুনে জ্বলছে।

“এগুলো কী?”—রুদ্র চিৎকার করল।

একসঙ্গে সব প্রতিচ্ছবি বলল, “এগুলো তোর সম্ভাবনা। তুই যা হতে পারিস, সবকিছু।”

রুদ্রর মাথা ঘুরতে লাগল। সে জানত, যদি নিজের ভেতরের অন্ধকার অস্বীকার করে, তবে সে ছায়ার হাতে গ্রাস হবে। তাই সে চোখ বন্ধ করল, বুক ধকধক করতে লাগল, আর ধীরে ধীরে বলল,
“হ্যাঁ, আমি খুনি হওয়ার সম্ভাবনাও রাখি, আমি বিশ্বাসঘাতক হওয়ার সম্ভাবনাও রাখি, আমি পাপীও, আমি সাধকও। আমি আলো আর অন্ধকার দুটোই।”

মুহূর্তেই সব আয়না ভেঙে গেল। চারদিক থেকে ভাঙা কাঁচের শব্দ প্রতিধ্বনিত হল। কিন্তু তার শরীরে কোনো আঘাত লাগল না। শুধু বুকের ভেতর যেন এক শূন্যতা পূর্ণ হয়ে গেল।

প্রতিচ্ছবির সমাধান

শেষে আবার সেই বিশাল আয়নার সামনে দাঁড়াল রুদ্র। এবার আয়নায় তার প্রতিচ্ছবি আর ছায়া-রুদ্র একসঙ্গে দাঁড়িয়ে। ধীরে ধীরে তারা একে অপরের সঙ্গে মিশে গেল। আয়নায় ভেসে উঠল এক নতুন রুদ্র—চোখে ভয়ঙ্কর দীপ্তি, কিন্তু ঠোঁটে শান্তির হাসি।

সে বুঝল, সে নিজের ছায়াকে অস্বীকার করেনি, বরং গ্রহণ করেছে।

ঠিক তখনই আয়নার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো এক আলো, এসে বসে গেল তার বুকে। বুকের ভেতর এক অদ্ভুত শক্তি ছড়িয়ে পড়ল।

বইয়ের পাতায় লাল অক্ষরে ফুটে উঠল—
“আত্মার আয়না পার হল। এখন সাধক নিজের ভেতরের সব রূপ চিনেছে।”

বাড়ি ফেরার পর

রুদ্র বাড়ি ফিরে আয়নায় তাকাল। এবার সে শুধু নিজেকেই দেখল—কোনো ছায়া নেই, কোনো বিকৃত হাসি নেই। তবু চোখে সেই দীপ্তি রয়ে গেছে।

কিন্তু ঠিক তখনই ফোন এল। অনির্বাণের কণ্ঠ ভাঙা—
“রুদ্র, আমার ঘরের আয়নায় আজ রাতে তুই এসেছিলি। তোর চোখ ছিল আগুনে ভরা, তুই শুধু বললি—‘আমি আর তুই আলাদা নই।’ এটা কী হচ্ছে?”

রুদ্র বুঝল, যদিও সে নিজের ভেতরের ছায়াকে মেনে নিয়েছে, সেই প্রভাব এখন ছড়িয়ে পড়ছে বাইরের জগতে।

উপসংহার

আত্মার আয়না তাকে নতুন শক্তি দিয়েছে, কিন্তু সেই শক্তির বোঝা ভয়ঙ্কর। এখন আর সে কেবল মানুষ নয়, বরং এক অদ্ভুত সমন্বয়—আলো ও অন্ধকার, জীবন ও মৃত্যু।

কিন্তু পথ এখানেই শেষ নয়। অগ্নিমণ্ডল এখনও তাকে আরও গভীর পরীক্ষার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

 

পর্ব ৮ : কুণ্ডলিনী জাগরণ

আত্মার আয়না পেরোনোর পর রুদ্রর মনে হল তার ভেতর যেন এক গভীর নীরবতা নেমে এসেছে। আগে যত ভয়, যত শোরগোল, যত ছায়া তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল—সব যেন কোথাও একত্র হয়ে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু সেই নীরবতা শান্তি নয়, বরং অপেক্ষা—যেন ঝড় আসার আগে নদীর জল থমকে থাকে।

বইয়ের পাতায় তখনই ফুটে উঠল নতুন বার্তা—
“অগ্নিমণ্ডলের নবম আগুন হলো কুণ্ডলিনী। যে এটিকে জাগাতে পারবে, সে শুধু সাধক নয়, দেব-মানব। কিন্তু সতর্ক থাক, কুণ্ডলিনী জেগে উঠলে শরীর আর আত্মা দুটোই ভস্ম হতে পারে।”

রুদ্র এই লাইন পড়তেই বুকের ভেতর ধক করে উঠল। এতদিন ধরে যে পথ সে এসেছে, তা যেন কেবল প্রস্তুতি। আসল পরীক্ষার শুরু এখন।

প্রস্তুতি

বই বলল, কুণ্ডলিনী জাগানোর জন্য তাকে শহরের একেবারে প্রাচীনতম তন্ত্রক্ষেত্রে যেতে হবে। সেই স্থান এখন আধুনিক কংক্রিটে ঢাকা—একটা পরিত্যক্ত কারখানার ভেতরে। কিন্তু মাটির তলায় এখনও সক্রিয় আছে এক প্রাচীন যজ্ঞকুণ্ড।

রুদ্র রাতে পৌঁছোল সেই কারখানায়। ভাঙা দরজা, মরচেধরা মেশিন, ভেতরে নিস্তব্ধতা। তবে মেঝের কিছু জায়গায় লাল রঙের দাগ দেখা গেল, যেন বহু আগে এখানে রক্ত পড়েছিল।

সে মাটিতে হাত রাখতেই বুকের ভেতর কম্পন হল। যেন মাটি শ্বাস নিচ্ছে। বইয়ের নির্দেশমতো সে প্রদীপ জ্বালাল, খুলির মালা গলায় দিল, আর ধূপকাঠি জ্বালাল। তারপর পদ্মাসনে বসে চোখ বন্ধ করল।

জাগরণের শুরু

সে গভীর নিঃশ্বাস নিতে লাগল। ধীরে ধীরে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ গরম হতে লাগল। মেরুদণ্ডের গোড়ায় যেন আগুন জ্বলে উঠল। সেখান থেকে ধীরে ধীরে সেই আগুন উপরের দিকে উঠতে লাগল।

প্রথমে নাভিতে জ্বালা। তারপর বুকের ভেতর অদ্ভুত চাপ। অবশেষে গলায় পৌঁছোতেই সে শুনতে পেল অজস্র ফিসফিসানি—কেউ কাঁদছে, কেউ হাসছে, কেউ প্রলোভন দেখাচ্ছে।

সে চোখ খোলার চেষ্টা করল, কিন্তু শরীর পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেছে। হঠাৎই চোখের সামনে ভেসে উঠল সাতটি অগ্নিচক্র—প্রত্যেকটিতে এক একটি প্রাণী। সাপ, শকুন, বাঘ, কাক, নারী, শিশু, আর শেষে সূর্যের মতো দীপ্তিমান এক মুখ।

তারা সবাই একসঙ্গে বলল—
“তুই কি প্রস্তুত আমাদের সামলাতে?”

কুণ্ডলিনীর উত্থান

প্রথম প্রাণী সাপ ফিসফিস করে বলল, “আমাকে ভয় কর। আমি কামনা। যদি আমাকে সামলাতে না পারিস, তুই শুধু ভোগে হারাবি।”

রুদ্র তার দিকে তাকাল, বুক ধুকপুক করছিল। কিন্তু সে ফিসফিস করে বলল, “হ্যাঁ, আমি কামনা। আমি তা মেনে নিলাম, কিন্তু আমি এর দাস হব না।”

সাপ মিলিয়ে গেল।

এরপর শকুন ডেকে উঠল, “আমি লোভ। আমি তোর ভেতর সবকিছু ছিঁড়ে খেতে চাই। তুই কি আমাকে ছাড়তে পারবি?”

রুদ্রর বুক কেঁপে উঠল। তার মনে পড়ল টাকা, খ্যাতি, ক্ষমতা—সবকিছুর আকর্ষণ। তবু সে বলল, “আমি লোভকেও চিনলাম। কিন্তু আমি তোর দাস হব না।”

শকুন অদৃশ্য হল।

এভাবে একে একে বাঘ, কাক, নারী, শিশু—সবাই এল। প্রত্যেকে এক একটি মানসিক জটিলতা, এক একটি শক্তি। রুদ্র তাদের চিনল, স্বীকার করল, কিন্তু বশ হল না।

শেষে এল সূর্যের মতো মুখ। তার আলো এত তীব্র যে রুদ্রর চোখ ঝলসে গেল। সেই মুখ বলল, “আমি অহংকার। আমাকে যদি তুই না মেনে নাস, তবে তুই ধ্বংস হবিই।”

রুদ্র বুক চেপে ধরল। বুঝল, এটিই সবচেয়ে কঠিন। সে ধীরে ধীরে বলল,
“হ্যাঁ, আমি অহংকারও। আমি শক্তির লোভে আছি, আমি দেব-মানব হতে চাই। কিন্তু আমি জানি, তুই-ই আমাকে গ্রাস করতে পারিস। তাই আমি তোকে স্বীকার করলাম, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ দিলাম না।”

মুহূর্তেই সব চক্র মিলিয়ে গেল।

জাগরণের চূড়ান্ত মুহূর্ত

রুদ্রর শরীর হঠাৎ কেঁপে উঠল। মেরুদণ্ড দিয়ে আগুন উঠে এল মাথার ভেতর। চোখ খুলতেই সে দেখল, চারপাশের দেয়াল ভেঙে গেছে, আগুনে সবকিছু জ্বলছে। অথচ তার শরীর পুড়ছে না। বরং তার শরীর থেকেই আলো ছড়াচ্ছে।

তার মনে হল, সে গঙ্গার ওপরে উড়ে গেছে। নিচে দেখা যাচ্ছে কলকাতা শহর, তার আলো, তার মানুষের মুখ। প্রতিটি মানুষের বুকের ভেতর সে দেখতে পাচ্ছে অগ্নিচক্র। কারও চক্র নিভে গেছে, কারও অর্ধেক জ্বলছে, কারও ভেতর শুধু ছায়া।

রুদ্রর বুক থেকে বজ্রধ্বনি বেরোল—
“কুণ্ডলিনী জাগল।”

 

জাগরণের পরিণতি

কিন্তু সেই শক্তি যত বাড়ছিল, ততই শরীর ভেঙে পড়ছিল। রুদ্রর মনে হচ্ছিল, সে পুড়ে যাচ্ছে ভেতর থেকে। তার চোখ দিয়ে রক্ত বেরোতে লাগল। মাটিতে পড়ে কাঁপতে লাগল।

ঠিক তখনই বইয়ের পাতায় অক্ষর ফুটে উঠল—
“কুণ্ডলিনী জেগেছে। সাধক এখন সময় ও মৃত্যুর সীমানা অতিক্রম করতে পারে। কিন্তু সাবধান—এক বিন্দু ভুল হলে সাধক ছাই হয়ে যায়।”

রুদ্রর বুক ধড়ফড় করছিল। মনে হচ্ছিল, সে বাঁচবে না। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বুকের ভেতর থেকে শান্তির স্রোত বেরোল। আগুন ধীরে ধীরে নিভে গিয়ে দীপ্ত আলোয় পরিণত হল।

সে মাটিতে শুয়ে নিঃশ্বাস নিল। তার শরীর ভেজা, চোখে অশ্রু। তবু সে জানত, সে বেঁচে গেছে।

শক্তির আভাস

বাড়ি ফিরে সে বুঝল, কেবল বেঁচে থাকা নয়—তার ভেতর এখন অচেনা ক্ষমতা জেগে উঠেছে। সে চাইলে মানুষের চিন্তা শুনতে পারছে। চাইলে অন্ধকারকে আলোয় রূপ দিতে পারছে।

কিন্তু সেই সঙ্গে ভয়ও বাড়ল। রাতে জানলার কাচে আবার ভেসে উঠল অনির্বাণের মুখ। অনির্বাণ ফিসফিস করে বলল—
“রুদ্র, তুই বদলে গেছিস। তুই এখন মানুষ নস। তোর কাছে থাকলেই আমি ভেঙে পড়ি।”

রুদ্র আয়না থেকে চোখ সরিয়ে নিল। সে জানত, শক্তি পেয়েছে বটে, কিন্তু সেই শক্তি তাকে একা করে দিচ্ছে।

উপসংহার

কুণ্ডলিনী জাগরণের পর রুদ্র এখন আর সাধারণ মানুষ নয়। সে আলো-অন্ধকার দুই-ই। কিন্তু পথ এখানেই শেষ নয়। বইয়ের শেষ পাতায় লাল অক্ষরে লেখা উঠল—
“এবার আসছে মহাচক্র। সেখানে তুই আর একা থাকবি না। সেখানে ঠিক হবে, তুই দেব-মানব নাকি কেবল ছাই।”

পর্ব ৯ : মহাচক্রের সমাবেশ

কুণ্ডলিনী জাগরণের পর দিনগুলো যেন আর দিনের মতো ছিল না। রুদ্রর ভেতরে এখন ক্রমাগত চলছিল অগ্নির স্রোত। কখনও বুকের ভেতর শীতল আলো, কখনও আবার অসহনীয় আগুন। তার শরীর সাধারণ চোখে চেনা গেলেও ভেতরে সে হয়ে উঠছিল অন্য কেউ। রাতের বেলায় সে জেগে উঠত অদ্ভুত শব্দে—ঘড়ির কাঁটা উল্টো চলা, জানলার কাচে হাতের ছাপ, অথবা আয়নায় দেখা পাওয়া এমন প্রতিচ্ছবি যার মুখ তার নিজের নয়।

বই তখন খুলে দেখাল নতুন অধ্যায়—
“যখন সাধক কুণ্ডলিনী জাগায়, তখন তাকে ডাকা হয় মহাচক্রে। সেখানেই ঠিক হয়, সাধক দেব-মানব হবে, নাকি ছাই হয়ে মিশে যাবে। মহাচক্রে আসবে সব ধারক, সব ছায়া, সব সাধক। যে টিকবে, সে-ই বেছে নেবে যুগের ভবিষ্যৎ।”

এই লাইনগুলো পড়তেই রুদ্রর বুকের ভেতর কাঁপুনি উঠল। এতদিন যা কিছু ঘটেছে, তার সবই যেন প্রস্তুতি ছিল এই এক মুহূর্তের জন্য।

আহ্বান

রাতের অন্ধকারে সে স্বপ্ন দেখল। বিশাল এক সমতল, চারপাশে আগুনের বৃত্ত। মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে অগণিত সাধক—কারও চোখে আগুন, কারও কপালে চিহ্ন, কারও হাতে ছাইয়ের প্রদীপ। তাদের সবাইকে ঘিরে আছে ভৌতিক ছায়া, আর ওপরে কালো আকাশে ঘূর্ণি।

সেই ঘূর্ণির ভেতর থেকে বজ্রধ্বনি এল—
“মহাচক্র শুরু হচ্ছে। প্রতিটি সাধক আজ নিজের আগুন প্রমাণ করবে।”

রুদ্রর সামনে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল সেই লোক—যাকে সে প্রথম চায়ের দোকানে দেখেছিল। তার চোখে আজ অন্যরকম দীপ্তি। সে বলল,
“আমরা কপালকুণ্ডলা চক্র। আমরা যুগ যুগ ধরে এই দিনটার অপেক্ষায় আছি। আজ ঠিক হবে, কে নতুন যুগের ধারক।”

রুদ্র অবাক হয়ে দেখল, শুধু সে-ই নয়—এখানে এসেছে অসংখ্য মানুষ। কারও চেহারা আধুনিক, কারও প্রাচীন, কারও আবার অর্ধেক ছায়া, অর্ধেক আলো। যেন যুগে যুগে যারা অগ্নিমণ্ডলের স্পর্শ পেয়েছে, সবাই একসঙ্গে হাজির।

প্রথম পরীক্ষা

একটি কণ্ঠ ঘোষণা করল,
“প্রথম পরীক্ষা—আগুনে দাঁড়িয়ে থাকা।”

মুহূর্তেই মাটির ভেতর থেকে আগুন উঠল। বিশাল শিখা চারপাশ ঘিরে ধরল। অনেক সাধক সেই আগুন সহ্য করতে পারল না, ছাই হয়ে ভেসে গেল বাতাসে। রুদ্র বুক ধকধক করতে করতে দাঁড়িয়ে রইল। তার ভেতরের আগুন এবার বাইরের আগুনের সঙ্গে মিলেমিশে গেল। সে অনুভব করল, আগুন তাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে না, বরং আলিঙ্গন করছে।

ছায়া-রুদ্র তখন তার কানে ফিসফিস করল—
“দেখলি? তুই আর আমি আলাদা নই। আমরা মিলে আগুনের সন্তান।”

রুদ্র চুপ করে রইল।

দ্বিতীয় পরীক্ষা

আবার বজ্রধ্বনি এল—
“দ্বিতীয় পরীক্ষা—ভয়কে সামলানো।”

অন্ধকার নেমে এল। আগুন নিভে গিয়ে চারপাশ ভরে গেল কুয়াশায়। কুয়াশার ভেতর থেকে ভেসে উঠল রুদ্রর সবচেয়ে ভয়ানক স্মৃতি—মায়ের রক্তাক্ত মুখ, অনির্বাণের ভাঙা চোখ, আর তার নিজের লাশ গঙ্গায় ভেসে চলেছে।

সে চিৎকার করতে চাইলো, কিন্তু মনে পড়ল অন্ধকারের সাধনার কথা—ভয়কে আলিঙ্গন কর। সে হাঁটু গেড়ে চোখ বন্ধ করল। বলল,
“হ্যাঁ, এগুলো আমার ভয়। কিন্তু আমি এগুলো মেনে নিলাম।”

মুহূর্তেই কুয়াশা মিলিয়ে গেল। ভয় নিভে গিয়ে রইল কেবল নীরবতা।

তৃতীয় পরীক্ষা

শেষ ঘোষণা হল,
“তৃতীয় পরীক্ষা—মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া।”

চারপাশে আবার ছাইয়ের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। রুদ্রর সামনে দাঁড়িয়ে গেল মৃত্যু-নারী, যাকে সে আগেও দেখেছে। এবার তার চোখ আরও গভীর অন্ধকার। তিনি বললেন,
“তুই কি আমাকে আবার আলিঙ্গন করতে প্রস্তুত?”

রুদ্র মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ।”

নারী তার কপালে হাত রাখলেন। মুহূর্তেই রুদ্র অনুভব করল, সে মরে যাচ্ছে। শরীর নিস্তেজ, শ্বাস বন্ধ, চারপাশ মিলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ঠিক তখনই বুকের ভেতর থেকে আলো ফেটে বেরোল। মৃত্যু হাসলেন।
“তুই পারলি। এখন তুই জীবিত আর মৃতের মাঝখানে দাঁড়ানো পথিক।”

সমাবেশের চূড়ান্ত দৃশ্য

সব পরীক্ষা শেষে যারা বেঁচে রইল, তারা ছিল হাতে গোনা কয়েকজন। বাকিরা ছাই হয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেছে।

কপালকুণ্ডলা চক্রের প্রধান উঠে দাঁড়াল। তার গলায় অসংখ্য রুদ্রাক্ষ, কপালে আগুনের দাগ। তিনি বললেন,
“আজ থেকে আমরা সবাই মিলে এক নতুন যুগ তৈরি করব। কিন্তু আমাদের মধ্যে একজন হতে হবে অগ্নিমণ্ডলের ধারক। যে বহন করবে যুগের ভার।”

সব চোখ রুদ্রর দিকে ফিরল।

সে বুক ধুকপুক করতে করতে দাঁড়িয়ে রইল। তার কপালের আগুন এবার জ্বলজ্বল করে উঠল।

ঘোষণার আগে

কিন্তু সেই মুহূর্তে আকাশ ফেটে গেল। বজ্রপাত নামল, আগুন ছড়িয়ে পড়ল। বইয়ের পাতায় তখন ফুটে উঠল নতুন অক্ষর—
“সতর্ক থাক, মহাচক্র কেবল শক্তির সমাবেশ নয়, বরং বিশ্বাসঘাতকতারও মঞ্চ।”

রুদ্রর বুক কেঁপে উঠল। কারা বিশ্বাসঘাতক হতে পারে? কারা তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে?

সে বুঝল, সমাবেশ শেষ হয়নি—এটি কেবল শুরু। এখন ঠিক হবে, তার ভেতরের আগুন মানুষকে বাঁচাবে, নাকি শেষ করে দেবে।

উপসংহার

মহাচক্র তাকে বেছে নিয়েছে, কিন্তু সেই বেছে নেওয়া এখনো চূড়ান্ত নয়। সামনে অপেক্ষা করছে শেষ দ্বার—অগ্নিমণ্ডলের সত্য।

রুদ্র আকাশের দিকে তাকাল। তার চোখে এবার ভয়ের ছায়া নেই—বরং এক অদ্ভুত শান্তি।

সে জানত, পরের পদক্ষেপই ঠিক করবে তার ভাগ্য।

 

পর্ব ১০ : অগ্নিমণ্ডলের সত্য

মহাচক্রের রাত শেষ হলেও রুদ্রর ভেতর যুদ্ধ থামল না। সে যেন আর সাধারণ মানুষ নয়—বরং আগুন, ছায়া, মৃত্যু আর আলো একসঙ্গে মিশে থাকা এক অদ্ভুত সত্তা। যারা সমাবেশে টিকে ছিল, তারা ছড়িয়ে গেল বিভিন্ন কোণে। কিন্তু তাদের চোখে ছিল অদ্ভুত দীপ্তি, যেন সবাই জানে—শেষ দ্বার এখনও বাকি।

বইয়ের পাতায় তখন একটাই বাক্য ফুটে উঠল—
“শেষ দ্বার হলো সত্য। যে সত্য তোর চোখ এড়িয়ে এসেছে, আজ তা-ই প্রকাশ পাবে।”

রুদ্র বুঝল, এই দ্বার পার হওয়া মানে কেবল শক্তি পাওয়া নয়। এটি মানে—নিজেকে শেষবারের মতো ভেঙে দেখা।

আহ্বানের স্থান

সেই রাতে স্বপ্নে সে দেখল এক বিরাট প্রান্তর। চারপাশে আগুনে ঘেরা, মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল স্তম্ভ। স্তম্ভের মাথায় আগুন জ্বলছে, অথচ তা নিভছে না। আগুনের ভেতর ভেসে উঠছে মানুষের মুখ—কখনও তার মা, কখনও অনির্বাণ, কখনও ছায়া-রুদ্র, কখনও মৃত্যু-নারী।

এক কণ্ঠ বজ্রধ্বনির মতো বলে উঠল—
“এসো, শেষ দ্বারে পা দাও।”

রুদ্র চোখ খুলতেই দেখল, বইয়ের ভেতর সেই একই প্রান্তরের দিকনির্দেশ লেখা। সে জানত, এবার যেতে হবে।

পথের শুরু

সে গভীর রাতে বেরোল শহরের প্রান্তে। গঙ্গার ধারে পরিত্যক্ত এক দ্বীপে পৌঁছোল, যেখানে আগে শ্মশান ছিল। এখন কেবল ছাই আর ভাঙা সমাধি। মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সেই স্তম্ভ।

আকাশ কালো, তারার আলো নেই, বাতাস ভারী। রুদ্র স্তম্ভের দিকে হাঁটতে লাগল। প্রতিটি পদক্ষেপে বুক ধুকপুক করছিল, কিন্তু ভেতরের আগুন তাকে ঠেলে দিচ্ছিল সামনে।

সত্যের দ্বার

স্তম্ভের সামনে পৌঁছে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। আগুন জ্বলছে, আর আগুনের ভেতর ফিসফিস করছে অসংখ্য কণ্ঠ—
“তুই কে, রুদ্র?”
“সাধক নাকি ছায়া?”
“মানুষ নাকি দেবতা?”
“রক্ষক নাকি ধ্বংসকারী?”

রুদ্রর মাথা ঘুরতে লাগল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল অসংখ্য ছবি—

  • ছোটবেলায় তার মায়ের কোলে ঘুমানো।
  • কলেজে বন্ধুদের সঙ্গে হাসাহাসি।
  • অনির্বাণের চোখে ভরসা।
  • আবার সেই একই অনির্বাণের মুখে ভয়, যখন সে বলছিল, “তুই মানুষ থাকিস না।”
  • তার নিজের প্রতিচ্ছবি—যেখানে সে খুনি, বিশ্বাসঘাতক, আবার ত্রাতা।

সে বুঝল, এই দ্বার কেবল এক প্রশ্ন করছে—তুই আসলে কে?

মুখোমুখি

আগুনের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল ছায়া-রুদ্র। এবার সে আর আলাদা নয়—শক্তিশালী, চোখে আগুন, ঠোঁটে হাসি। সে বলল,
“আমি-ই তুই। তুই যত চেষ্টা করিস না কেন, তোর ভয়, লোভ, কামনা, অহংকার—সবকিছু আমি-ই।”

রুদ্র চুপ করে তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল,
“হ্যাঁ, তুই-ই আমি। এতদিন আমি তোকে অস্বীকার করেছিলাম, তাই তুই বেড়ে উঠেছিস। আজ আমি তোকে অস্বীকার করব না। আমি তোকে আলিঙ্গন করব।”

সে ছায়া-রুদ্রের দিকে হাত বাড়াল। মুহূর্তেই ছায়া আগুনে জ্বলতে জ্বলতে তার শরীরের ভেতরে ঢুকে গেল। রুদ্রর বুকের ভেতর বজ্রপাতের মতো শব্দ হল। চোখে দীপ্তি জ্বলে উঠল।

সত্যের প্রকাশ

আকাশ কেঁপে উঠল। বজ্রধ্বনি এল—
“সাধক, তুই নিজের ছায়াকে মেনে নিলি। তুই মৃত্যুকে উপাসনা করলি, অন্ধকারকে আলিঙ্গন করলি, কুণ্ডলিনী জাগালিস। কিন্তু মনে রাখ, সত্য কেবল তোর ভেতরে নয়—সত্য হল তুই মানুষের জন্য কী।”

রুদ্রর চোখের সামনে হঠাৎ ভেসে উঠল ভবিষ্যতের দৃশ্য। সে দেখল—

  • যুদ্ধবিদ্ধস্ত শহর, যেখানে মানুষ একে অপরকে হত্যা করছে। তার কপালের আগুন তাদের আরও উসকে দিচ্ছে।
  • আবার দেখল, একই শহর আলোয় ভরে উঠেছে, মানুষ একে অপরের দিকে হাত বাড়াচ্ছে, তার আগুন তাদের পথ দেখাচ্ছে।

দুটি সম্ভাবনা। দুটি সত্য।

বজ্রধ্বনি বলল,
“তুই-ই ঠিক করবি, তোর আগুন ধ্বংসের, নাকি সৃষ্টির।”

সিদ্ধান্ত

রুদ্র বুক চেপে ধরল। তার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরল। সে ফিসফিস করে বলল,
“আমি আলো চাই। আমি চাই, এই আগুন ধ্বংস না করে মানুষকে শক্তি দিক। আমি চাই, আমার ভেতরের অন্ধকার আমাকে গ্রাস না করে মানুষকে শেখাক, ভয়কে মেনে নিয়ে এগোনো যায়।”

মুহূর্তেই স্তম্ভের আগুন সাদা আলোয় পরিণত হল। আকাশ ভরে গেল দীপ্তিতে। বুকের ভেতর শান্তির স্রোত বয়ে গেল।

পরিণতি

কিন্তু সেই সঙ্গে এক কণ্ঠ ফিসফিস করল,
“মনে রাখ, আলো বেছে নিলেই অন্ধকার মিলিয়ে যায় না। তুই আজীবন ভারসাম্য বহন করবি। প্রতিটি পদক্ষেপে ছায়া তোকে ডাকবে।”

রুদ্র নীরবে মাথা নোয়াল। সে জানত, সত্য মানে নিখুঁত আলো নয়—বরং আলো আর অন্ধকারের মিলন।

ফিরে আসা

ভোরে যখন সে গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল, শহর জেগে উঠছিল। মানুষ রিকশা টানছে, দোকান খুলছে, ট্রামের ঘণ্টা বাজছে। সাধারণ জীবন চলতে শুরু করেছে।

কিন্তু রুদ্র জানত, সে আর সাধারণ নয়। তার ভেতরে এখন অগ্নিমণ্ডলের সত্য।

সে বইয়ের শেষ পাতায় তাকাল। সেখানে লেখা ছিল—
“অগ্নিমণ্ডল তোর ভেতর পূর্ণ হল। তুই এখন যুগের পথিক। তুই আলো আনতে পারিস, ছাইও আনতে পারিস। সিদ্ধান্ত তোর।”

রুদ্র পাতাটা বন্ধ করল। তার চোখে তখন এক অদ্ভুত দীপ্তি, আর ঠোঁটে শান্তির হাসি।

উপসংহার

রুদ্রর গল্প এখানেই শেষ নয়। তার জীবন এখন মানুষের মতো হলেও, প্রতিটি পদক্ষেপে সে বহন করছে আগুনের ভারসাম্য। মানুষ তাকে হয়তো চিনবে না, কিন্তু অদৃশ্যভাবে সে ছড়িয়ে দেবে ভয় আর সাহসের শিক্ষা।

অগ্নিমণ্ডল তন্ত্র কেবল এক সাধকের কাহিনি নয়, বরং মানুষের ভেতরের যাত্রা—যেখানে আলো আর অন্ধকার একসঙ্গে বেঁচে থাকে।

রুদ্র সেই পথ বেছে নিয়েছে। আর তার ভেতরে চিরকাল জ্বলতে থাকবে অগ্নির বৃত্ত।

WhatsApp-Image-2025-08-19-at-3.24.55-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *