তনিমা বসাক
রুদ্রাক্ষী জানত না ঠিক কোন মুহূর্তে তার রোগীর মুখে উঠে আসে সেই চিহ্নটা—একটা বৃত্তের মধ্যে ঘূর্ণায়মান চারটি রেখা, যেটা দেখে মনে হয় যেন কালি ছড়ানো হয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে কিন্তু ভেতরে কোনও গাণিতিক ছন্দ লুকিয়ে আছে। রোগীটির নাম ছিল অনুকূল বসু—৬৫ বছরের এক প্রাক্তন স্কুলশিক্ষক, যার স্মৃতিভ্রংশের উপসর্গেই রুদ্রাক্ষী প্রথমে সন্দেহ করেছিল আলঝেইমার, কিন্তু দ্বিতীয় সেশনে সেই কাগজটা হাতে এল। পুরোনো, হলুদ হয়ে যাওয়া একটা ডায়েরির ভাঁজে তোলা সেই চিহ্ন দেখে হঠাৎ তার মনে পড়ে গিয়েছিল মায়ের শেষদিনগুলো—যখন মা অজান্তে কিছু চিহ্ন আঁকতেন বাতাসে, চুপ করে থাকতেন, বলতেন, “এই লেখাগুলো কারো জন্য নয়, শুধুই অগ্নির জন্য।” মা ছিলেন একসময় রবীন্দ্রভারতীর সংস্কৃত বিভাগে অধ্যাপক, অথচ মৃত্যুর আগে তার মুখে উঠে এসেছিল কামরূপের টোটকা, নামহীন মন্ত্রের পংক্তি, আর আঁকা হত অদ্ভুত সব চিহ্ন—যার ভাষা রুদ্রাক্ষী বুঝত না, কিন্তু ভয় পেত। অনুকূল বসুর মুখে যখন ঠিক সেই চিহ্নের নাম শোনা গেল—‘অগ্নিবিন্দু’—তখন রুদ্রাক্ষী ঠান্ডা ঘামে ভিজে গেল, তার হাত কাঁপছিল, কারণ সে জানত এই নামটা তার স্মৃতির গভীর থেকে উঠে এসেছে, বাইরের পৃথিবী থেকে নয়। অনুকূল তখন বলছিল, “তুমি জানো না এর মানে? না জানলেই ভালো, মেয়ে। এই মন্ত্রে জেগে ওঠে আগুন, যেটা নিভে না, পোড়ায় না, কিন্তু শেষ করে দেয়।” রুদ্রাক্ষী চুপচাপ তার ভিজে ডায়েরিতে আঁকছিল সেই চিহ্নটা, ততক্ষণে ঘড়িতে সন্ধে ছয়টা, কিন্তু ঘরের জানালায় অন্ধকার জমে উঠেছিল কুয়াশার মতো। কেবিনে আলো জ্বালানো ছিল, তবু মনে হচ্ছিল আলোর গভীরে কেউ বসে আছে, যে অন্ধকার থেকে তৈরি নয়—আলো থেকেই জন্ম নিয়েছে। সেই রাতে বাড়ি ফিরে মায়ের পুরোনো আলমারির নিচের তাকে খুঁজে পেল একটা ছেঁড়া খাতা—মলাট নেই, প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা “অগ্নিবিন্দু: শ্রুতি নয়, অনুভব”—তার নিচে লাল কালি দিয়ে আঁকা সেই চিহ্ন। রুদ্রাক্ষীর মনে হল, এ তো তারই হাতের লেখা, অথচ সে কোনওদিন লেখেনি। হঠাৎ কাগজটা হাত থেকে পড়ে গেল, বাতাসের দমকে ঘরের আয়নার সামনে এসে থামল—আর আয়নায় ভেসে উঠল এক অচেনা নারীর মুখ, যার চোখ ছিল জ্বলন্ত—আলো দিয়ে নয়, অভিশাপ দিয়ে। সেই রাতে ঘুমের মধ্যে সে দেখতে পেল, একটা পুরোনো পোড়ানো ঘর, যার দেয়ালে সেই চিহ্ন আঁকা, আর মেঝেতে বসে আছে সে নিজেই—কিন্তু শরীর ছিল অন্য রকম, পোশাক ছিল সাদা ধুতি আর লাল আঁচল, আর চোখের নিচে ছিল চন্দনের দাগ। সামনে বসে আছে একজন পুরুষ, যার চোখে কোনো রঙ ছিল না, শুধু দৃষ্টির চাপ। সে বলছিল, “তুমি ভুল করেছ, অগ্নিবিন্দু জাগবে না বলে চুক্তি হয়েছিল, তুমি প্রেমের নামে তাকে ডেকে এনেছো, এখন আর পালানোর রাস্তা নেই।” ঘুম ভেঙে গেলে রুদ্রাক্ষীর মনে হল সে ধোঁয়া গিলে ফেলেছে, কাশতে কাশতে উঠে দেখল জানালার কাচের ওপাশে সত্যিই কেউ দাঁড়িয়ে ছিল, মুহূর্তে মিলিয়ে গেল। পরদিন সকালে ক্লিনিকে গিয়ে জানতে পারল, অনুকূল বসু গতরাতে মারা গেছেন—ঘরে আগুন লেগেছিল, অথচ ঘরের কিছুই পুড়েনি, শুধু তার দেহ ছাড়া। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে লেখা—death by internal combustion। রুদ্রাক্ষীর মাথা ঝিম ধরে গেল। ফিরে এসে খাতাটা আবার খুলল—এইবার দেখা গেল নতুন করে লেখা হয়েছে একটা বাক্য, যেটা সে আগের রাতে দেখেনি—“তুমি যদি জানতে কে তুমি, তাহলে এই খাতা খুলতে না।” সে বুঝতে পারল, তার সামনে এখন একমাত্র পথ—অতীতের ছায়ার সঙ্গে দেখা করা, এমন এক অতীত যা সময়ের বাইরে, যেটা মন্ত্র নয়, অভিজ্ঞতা। শুরু হল অগ্নিবিন্দু মন্ত্রের প্রথম দীক্ষা—নিজেকেই অস্বীকার করার প্রথম অধ্যায়।
রুদ্রাক্ষী জানত না ঠিক কোন মুহূর্তে থেকে সে বাস্তব আর স্বপ্নের ভেদরেখা হারিয়ে ফেলেছে, ক্যালেন্ডারে দিন পাল্টায়, কিন্তু তার মনে হয় সময় যেন ঘুরছে একটা বন্ধ লুপে, অনুকূল বসুর মৃত্যুর পর সে যেন নিজেকে আর নিজের মতো মনে করতে পারছে না, তার ঘুম আর জাগরণের মধ্যে ঢুকে পড়েছে সেই চিহ্ন, সেই পোড়া ঘর, সেই নির্ভীক চোখের মানুষটি যিনি তার স্বপ্নে বলেছিলেন—তুমি প্রেম করে ভুল করেছো, আর প্রেমের মূল্য সময় নয়, আত্মা দিয়ে দিতে হয়, তার মনে হতে থাকে মায়ের শেষদিনগুলোতে বলা প্রতিটি অদ্ভুত শব্দ আসলে ছদ্মবেশী চিহ্ন, যেন শব্দ নয়, দিকনির্দেশ, যেমন—“যেখানে ছায়া জাগে, আগুন সেখানেই হাসে”—এখন সেই কথার অর্থ সে বুঝতে শুরু করছে, ক্লিনিকে বসে কাগজে সে যখন হঠাৎ করে লিখে ফেলল “অগ্নিবিন্দু সবসময় দুটি চক্ষে দেখা যায় না, একটি চক্ষু বন্ধ থাকলে তবেই সে জাগে”—সে কেঁপে উঠল, কারণ এই বাক্য সে জানে সে লেখেনি, অথচ হাত তার নিজের, অক্ষর তার নিজের কায়দার, তবু বাক্যটি যেন কারো অন্য কণ্ঠের, সে ভাবল হয়তো এ সাইকোজেনিক ডিসঅর্ডার, হয়তো ক্লিনিক্যাল দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা যায়, কিন্তু সে নিজেই এখন প্রতিদিন ঘুম ভাঙার পরে তার আয়নার সামনে দেখতে পায় ছোট ছোট ছায়া, যেন কেউ তার পিছনে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে, কিন্তু ফিরে তাকালে কেউ থাকে না, একটা দিন দুপুরে সে দেখল জানালার বাইরে, পাশের ফ্ল্যাটের ছাদে একজন নারী দাঁড়িয়ে আছে—ঘোমটা ঢাকা মুখ, লাল শাড়ি, নিঃশব্দে সে তাকিয়ে আছে রুদ্রাক্ষীর জানালার দিকে, ঠিক তেমনই যেভাবে তার স্বপ্নে দেখা সেই নারীমূর্তি তাকাত, সে ভেতরে ঢুকে গিয়ে ফোন তুলল, ফ্ল্যাটের কেয়ারটেকার বলল ওই ছাদ তো তালাবন্ধ, কেউ ওখানে ওঠে না, সে আবার জানালায় গিয়ে দেখল—কেউ নেই, শুধু ছাদের রেলিংয়ের গায়ে আঁকা সেই চিহ্নটা—অগ্নিবিন্দু, এখন সে জানে, এটা কাকতালীয় নয়, কেউ তাকে ডাকছে, বারবার ডাকছে, এবং সে জানে ডাকের জবাব না দিলে সেই চিহ্ন নিজের পথ তৈরি করে, সেই রাতে সে ফিরে গেল মায়ের সেই চিহ্নবহুল খাতার পাতায়, যেখানে মাঝখানে একটা পাতা পুরো খালি, কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই মনে হয় যেন সেখানে শব্দ লেখা আছে, অদৃশ্য অক্ষরে, পরদিন সে গেল কলেজ স্ট্রিটে, পুরোনো বইয়ের দোকানে, সেখান থেকে তুলল একটা গ্রন্থ—“নির্বাণচিহ্ন ও বঙ্গতন্ত্র: নেপথ্যের ইতিহাস”—গ্রন্থটি একশো বছর আগে লেখা, লেখকের নাম জানা যায় না, কিন্তু ভূমিকায় লেখা—“এই গ্রন্থে উল্লিখিত প্রতিটি চিহ্ন তন্ত্রের গভীরতর স্তরে প্রবেশের পথ, অগ্নিবিন্দু সে চিহ্নগুলোর মধ্যে সর্বাধিক শক্তিশালী, কারণ এ শুধু তন্ত্র নয়, আত্মচেতনার এক বিকৃত প্রতিচ্ছবি”—রুদ্রাক্ষী বইয়ের ভাঁজে পেল একটি পুরোনো স্কেচ, যেখানে আঁকা ছিল ছায়াময় এক নারী, যার ডান চোখ নেই, মুখে অর্ধেক হাসি, এবং বুকে অগ্নিবিন্দু চিহ্ন আঁকা, স্কেচের নিচে লেখা—“অগ্নিচক্ষু”। সেই রাতে সে আবার স্বপ্নে দেখে আগের সেই ঘর, এবার ঘর অন্ধকার নয়, আগুন জ্বলছে চারপাশে, আর সেই নারী এবার তার দিকে এগিয়ে আসে, ধীরে ধীরে, মৃদু গলায় বলে—“তুই কি প্রস্তুত নিজের ছায়াকে দেখতে?” এবং রুদ্রাক্ষী ঘুম ভাঙার পর আবিষ্কার করে তার বাম চোখে জ্বালাপোড়া, আয়নার সামনে গিয়ে দেখে, তার চোখের তারা লাল হয়ে উঠেছে, মাঝখানে একটা ছোট্ট রেখা—ঠিক যেমনটা ছিল সেই স্কেচে, ঠিক তখনই খোলা জানালার পাশে কাগজের টুকরো উড়ে এসে পড়ে, সে কুড়িয়ে নেয়—তার উপর লেখা “দ্বিতীয় স্তর আরম্ভ হল—ছায়ার চোখে আগুন জ্বলবে”—এইবার সে আর পিছু হটতে পারবে না, কারণ এখন অগ্নিবিন্দু তাকে খুঁজছে, শুধু সে নয়, তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা কোনো ‘অন্য সে’-কে ডাকছে বারবার, যে জাগলেই শুরু হবে তন্ত্রের যাত্রা—আত্মার ছায়াকে ছুঁয়ে দেখার ভয়ঙ্করতম রীতি।
রুদ্রাক্ষী জানত না কোথা থেকে তার বাম চোখে লাল রেখাটা আরও ঘন হচ্ছে, তিনদিন ধরে সে ঘুমোতে পারছে না, ঘুমালেই স্বপ্ন নয়—দেখে যাচ্ছে এক চিহ্নিত জগৎ, যেখানে অন্ধকার আলোয় কথা বলে, আর মানুষ নয় ছায়া হাঁটে, সেই ঘরে সে নিজেকে দেখে অন্য রকম এক সত্তায়, যার কণ্ঠস্বর রুদ্রাক্ষীর নয়, কিন্তু ভাষাটা তার মনের ভাষা, সেই কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে এক দীর্ঘ মন্ত্র—অজানা এক তন্ত্রস্বর, যার প্রতিটি ধ্বনি মনে হয় যেন মৃতদের আত্মা থেকে উঠে আসছে, যেন কেউ তার কানের ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বলছে, “তুই জেগে উঠেছিস, এখন অগ্নিবিন্দু তোকে খুঁজবে না, তোর মধ্য দিয়েই নিজেকে জাগাবে,” সে জেগে উঠে দেখল তার ঠোঁট শুকিয়ে গেছে, যেন সারা রাত সে কোনও কিছু উচ্চারণ করেছে, গলায় জ্বালা, মুখে তেতো স্বাদ, আয়নায় তাকিয়ে দেখল ঠোঁট কেঁপে উঠছে নিজে থেকেই, ঠোঁটের কোণে রক্ত, আর ঠোঁটে স্পষ্ট মন্ত্রের ছায়া—জিভ নাড়ানো ছাড়াই শব্দ বেরিয়ে আসছে, সে বুঝতে পারল এই অবস্থা তার নিজের দেহে নয়, তার দেহের ভিতর কে যেন ঢুকে পড়েছে, একটা অন্য সত্তা, যার সাথে তার আত্মার কিছু চুক্তি হয়েছিল কোনও জন্মে, সেই রাতে সে প্রথমবার খুলে বসে মা’র মৃত্যুর সময়কার ভিডিও, যেটা সে কোনওদিন দেখতে সাহস করেনি, সেই ভিডিওতে দেখা যায় মা হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন, অক্সিজেন মাস্ক, নীল আলোয় দেহ ঢেকে আছে, আর হঠাৎ করে তার ঠোঁট কাঁপতে শুরু করে, কেউ ছুঁয়েও দেখেনি, অথচ ঠোঁট নড়ে উঠে বলে—“অগ্নিবিন্দু, অগ্নিবিন্দু, অগ্নিবিন্দু,” তিনবার, তারপরই কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট, ভিডিও থেমে যায়, রুদ্রাক্ষীর বুক কেঁপে ওঠে, সে জানে এই শব্দ তিনবার উচ্চারণের মানে, কারণ সেই পুরোনো বইয়ে লেখা ছিল—“যে তিনবার অগ্নিবিন্দু মন্ত্র উচ্চারণ করে, সে আর মানুষ থাকে না, সে হয়ে ওঠে এক বাহক, এক মাধ্যম, যার মধ্যে দিয়ে তন্ত্র নিজের পথ খোঁজে, নিজেকে ছড়িয়ে দেয়,” পরদিন সকালে তার ফোনে আসে এক অচেনা নম্বর থেকে কল, কণ্ঠস্বর হালকা কাঁপা, বয়স্ক পুরুষের, বলল—“আপনি কি রুদ্রাক্ষী সেনগুপ্ত?” সে হ্যাঁ বলতেই ওপাশ থেকে বলা হল—“আমি আপনার মা’র জীবদ্দশায় যাকে তিনি ‘দ্বিতীয় গুরু’ বলতেন সেই ব্যক্তি, আপনার মা আপনার জন্য একটা জিনিস রেখে গেছেন, দয়া করে আজ বিকেলে চেতলা শ্মশানে দেখা করুন,” রুদ্রাক্ষী প্রথমে ভয় পেলেও বিকেলে গেল, শ্মশানের ভিতর একটা ঘর, যেখানে এক বৃদ্ধ বসে আছেন, মাথা ভর্তি পাকা চুল, লাল কাপড়ে মোড়া একটা খাম এগিয়ে দিয়ে বললেন—“তোমার মা জানতেন, তুই ফিরে আসবি, এই চিঠিটা শুধুই তোর চোখের জন্য,” খাম খুলতেই বেরিয়ে এল এক চিঠি, লেখা কালি দিয়ে নয়, তামা রঙের এক অদ্ভুত ইঙ্কে, লেখা, “রুদ্র, আমি জানি তুই আমার মেয়ে নয় শুধু, আমার পূর্বজন্মের ভুলও, আমি যে মন্ত্র রক্ষা করতে পারিনি, সেটা তোর মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে, এখন সময় এসেছে তুই বুঝবি, ‘অগ্নিবিন্দু’ কোনও শব্দ নয়, কোনও মন্ত্র নয়, এটা এক আত্মিক চেতনা, এক আত্মা—যে জেগে থাকে শুধু সেই কারো ভেতর, যে আগুনে পোড়েও ছায়া হয়ে বাঁচে,” চিঠির নিচে আঁকা ছিল সেই চিহ্ন, কিন্তু এবার চারপাশে আঁকা ছিল মুখ, ঠোঁট, চোখ—আর প্রতিটি মুখ মিশে যাচ্ছিল অগ্নিবিন্দু চিহ্নের মধ্যে, যেন সব মুখ এক মুখে পরিণত হচ্ছে, সেই রাতে রুদ্রাক্ষী আবার স্বপ্নে দেখল আগুনের ঘর, এবার সে একা নয়, তার পাশে দাঁড়িয়ে এক নারীমূর্তি, যার ঠোঁট নেই, কিন্তু যার কণ্ঠ শোনা যায় মাথার ভেতর, সে বলল—“তুই জানিস মৃতদের ঠোঁট কেন কাঁপে? তারা তো নিঃশ্বাস নেয় না, তবু তাদের মুখে মন্ত্র থাকে, কারণ তারা দেখে এমন জগৎ, যেটা তোর মত মানুষরা চোখ বন্ধ করলে দেখে, অগ্নিবিন্দু সেই জগতে লেখা হয়, চোখ দিয়ে নয়, আত্মা দিয়ে পড়তে হয়,” রুদ্রাক্ষী ঘুম ভাঙার পরে আবিষ্কার করল তার কণ্ঠ বন্ধ হয়ে গেছে, সে গলায় শব্দ তুলতে পারছে না, মুখে আওয়াজ নেই, কিন্তু কাগজে লিখে ফেলছে লাইন—“চতুর্থ স্তর আরম্ভ হল, এবার মন্ত্র তোকে লিখবে, তুই কিছুই বলবি না,” সে বোঝে, মৃতদের ঠোঁটে যে মন্ত্র থাকে, তা হয়তো জীবিতের মুখ দিয়েই শেষবার উচ্চারিত হবে।
রুদ্রাক্ষী সাতদিন ধরে কথা বলতে পারছে না, ডাক্তার দেখিয়েছিল, কণ্ঠনালীতে কোনও শারীরিক সমস্যা নেই, অথচ গলায় যন্ত্রণা, গভীর রাতে সে ঘুম থেকে উঠে দেখে তার বালিশের পাশে রাখা কাগজে নিজের হাতে লেখা অদ্ভুত সব বাক্য, যেগুলোর কোনওটা সে পড়তে পারে, কোনওটা যেন অন্য ভাষায় লেখা—একটা বাক্যে লেখা, “আয়নার দিকে তাকাস না, আয়নার ভিতরে আগুন আছে,” সে প্রথমে ভয় পেয়েছিল, কিন্তু তারপরেই একটা আকর্ষণ অনুভব করল, সেই রাতে সে বসার ঘরের পুরোনো আয়নাটার সামনে দাঁড়ায়, যেটা তার মা রেখে গিয়েছিলেন, আয়নাটা সাদা কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো, ফ্রেমের এক কোণে তামার পাত বসানো—এই পাতটা আগে কখনও খেয়াল করেনি, এবার দেখে পাতটার গায়ে খুব সূক্ষ্মভাবে খোদাই করা অগ্নিবিন্দু চিহ্ন, সে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই আলোর রঙ বদলে যেতে থাকে, চারপাশে নিঃশব্দ, অথচ মনে হয় আয়নার ভেতর থেকে কেউ নিঃশ্বাস নিচ্ছে, আয়নায় তার প্রতিবিম্বটা আর স্থির থাকে না, চোখ কাঁপছে, ঠোঁট একটু একটু করে নড়ে উঠছে, যেন সে আয়নার ভিতরের রুদ্রাক্ষী নয়—ভিন্ন কেউ, হঠাৎ আয়নার নিচ থেকে জ্বলন্ত আগুনের রেখা ওঠে আসে তার প্রতিবিম্বের পায়ে, ছড়িয়ে যায় শরীরজুড়ে, কিন্তু বাস্তবে কোনও আগুন নেই, তাপ নেই, অথচ সে অনুভব করে তার বুকের মধ্যে কিছু একটা গলে যাচ্ছে, ভেঙে যাচ্ছে পরিচয়ের কাঠামো, এমন সময় তার কানের পাশে কেউ ফিসফিস করে বলে, “আয়না আসলে সময় নয়, চেতনার দরজা, অগ্নিবিন্দুর পঞ্চম স্তরে ঢুকলে তুই আয়নায় নিজেকে আর দেখবি না, তুই দেখে ফেলবি যা তোর ভেতরে এতদিন লুকিয়ে ছিল,” ঠিক তখনই তার চোখের সামনে এক ঝলকে ভেসে ওঠে আগুনে পোড়া এক ঘর, ঘরের ভিতর বসে আছে অর্ধেক পোড়া এক শিশু, যার শরীর নেই, শুধু চোখ, আর সেই চোখ থেকে বেরিয়ে আসছে আলো নয়—চিহ্ন, মন্ত্রের চিহ্ন, সে জানে না এই শিশু কে, কিন্তু তার মনে হয়, এটা তার কোনও অতীত জন্ম, অথবা তার নিজের মানসিক ছায়া, যার মুখ ছিল না, শুধু দৃষ্টির ভার, সেই রাতেই সে আবার খাতাটা খুলে দেখে নতুন করে লেখা হয়েছে—“পঞ্চম স্তরে প্রবেশ করেছিস, এবার আয়নার ভেতরে আগুন খুঁজে পেলেই তুই জানবি কে তুই, আর কেন তোকে এই চিহ্ন বেছে নিয়েছে,” পরদিন সকালে সে কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে খোঁজ নেয় আয়নার তান্ত্রিক ব্যবহার নিয়ে, এক পুরোনো বইয়ের দোকানে পাওয়া গেল একটা বিরল পুঁথি—“প্রতিবিম্বতন্ত্র: দেহজ আগুনের প্রতিচ্ছবি,” সেখানে লেখা—“মানবচোখ আয়নার ভিতরে যা দেখে, তা সময়ের বক্র প্রতিফলন, কিন্তু তান্ত্রিক চোখ দেখে আয়নার পেছনে লুকিয়ে থাকা আগুনের ভাষা, সেই আগুনে লেখা হয় আত্মার ইতিহাস,” সে বুঝতে পারে আয়না এখন শুধু প্রতিচ্ছবি নয়, বরং তার নিজের অন্তরের আগুনকে ধরার একমাত্র মাধ্যম, রাতে সে আবার দাঁড়ায় আয়নার সামনে, এবার চোখ বন্ধ করে, ধীরে ধীরে চোখ খুলতেই দেখে তার প্রতিবিম্বে একটি অচেনা চিহ্ন আঁকা—তার কপালে, যেটা বাস্তবে নেই, কিন্তু আয়নাতে স্পষ্ট, সেই চিহ্নে আগুনের রেখা ঘুরে ঘুরে এক গোলক তৈরি করছে, এবং সে শুনতে পায় নিজের কণ্ঠস্বর, যেটা মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে না, কিন্তু ঘরের বাতাসে ভেসে আছে—“আমি আগুনের মেয়ে, আমি ছায়ার গর্ভে জন্ম নিয়েছি,” হঠাৎ করে আয়না কেঁপে ওঠে, এবং এক মুহূর্তে প্রতিবিম্বের ভিতর থেকে সেই আগুন লাফিয়ে বেরিয়ে আসে, বাস্তবে সে পড়ে যায় পেছনে, চোখ বন্ধ করে চিৎকার করতে পারে না, কণ্ঠ নেই, কিন্তু মাথার ভিতরে একটা বিশাল বিস্ফোরণ ঘটে, যেন মস্তিষ্কের সব স্মৃতি একসাথে খুলে যাচ্ছে, এবং সে দেখতে পায়—সেই পুরোনো জন্ম, সেই রাত, সেই পাথরের ঘর, যেখানে সে প্রথম অগ্নিবিন্দু মন্ত্র উচ্চারণ করেছিল এক প্রেমিকের নামে, যার মৃত্যুর পর সে ভুল করেছিল মন্ত্র জাগিয়ে, এবং সেই অপরাধের খেসারত দিচ্ছে এই জন্মে, কারণ সেই মন্ত্রকে তখন থামানো হয়নি, তাই সে বারবার ফিরে আসছে, বারবার জন্ম নিচ্ছে তার শরীরে, সে চোখ খুলে দেখে জানালার কাচে জল জমেছে, যেন বাইরের বাতাস অশরীরী হয়ে এসেছে, আর আয়নায় কিছুই নেই—কোনও প্রতিবিম্ব নেই, সে বোঝে, আয়না এখন তার শরীর নয়, সময় নয়, বরং তন্ত্র নিজে, যেটা তার অস্তিত্বের সব পরত খুলে দিচ্ছে একে একে, সে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখে আয়না ঠান্ডা, অথচ হাত সরাতেই সেখানে লেগে থাকে একটা লাল চিহ্ন—ঠিক অগ্নিবিন্দুর মতো, যেন আয়নাও জানে সে কে।
রুদ্রাক্ষী জানত না ঠিক কখন থেকে সে ঘুমাচ্ছে না অথচ স্বপ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার জীবন এখন একটা বিকৃত ঘূর্ণির মতো, বাইরে স্বাভাবিকতা চালিয়ে যাওয়ার অভিনয়, আর ভিতরে জেগে থাকা আগুন, যে আগুন তার হৃদয়ের ভিতর চিহ্ন এঁকে দিয়েছে, প্রতিদিন সকালে সে আয়নায় নিজেকে দেখে আর দেখে না—সে দেখে নিজের ছায়াকে, একটা ছায়া যে তার মতোই দেখতে কিন্তু চোখে অভিশাপের ছায়া নিয়ে তাকিয়ে থাকে, আর ঠোঁটে ফিসফিস করে বলে, “তুই জেগে উঠেছিস, এখন ছায়া তোর শরীর খুঁজে পাবে,” ছায়ার শরীর হয় না, কিন্তু আত্মা চায় আশ্রয়, আর রুদ্রাক্ষীর ভিতর সেই আশ্রয় তৈরি হয়ে গেছে, সেই রাতে সে প্রথম স্বপ্নে প্রবেশ করে এক দরজার সামনে, যেখানে আগুন জ্বলছে কিন্তু পোড়াচ্ছে না, দরজায় লেখা—“ষষ্ঠ স্তর: ছায়া এখানে থাকে না, ছায়া এখানেই জন্ম নেয়,” সে জানে এই দরজা অতিক্রম করলেই সে আর মানুষ থাকবে না, তার ভেতরে যেই সত্তা ঘুমিয়ে ছিল এতদিন, সে জেগে উঠবে, কিন্তু সে জানে এটাও তার দায়িত্ব, এই পথেই তাকে হাঁটতে হবে, দরজা ঠেলে ঢুকতেই সে দেখল একটা বিশাল অন্ধকার হলঘর, যেখানে কোনও ছাদ নেই, দেয়ালে অদ্ভুত সব চিত্র, আগুনে পোড়া মুখ, চোখ ছাড়া মুখ, আর মেঝেতে বসে আছে শতশত ছায়া—আকার নেই, ভাষা নেই, কিন্তু একসাথে তারা ফিসফিস করছে, “তুই দেরি করেছিস, অগ্নিবিন্দু তোকে খুঁজতে খুঁজতে ছায়াদের ছায়া হয়ে গেছে,” রুদ্রাক্ষী আগাতে থাকে, প্রতিটি পদক্ষেপে তার শরীরের ভার কমে আসছে, মনে হচ্ছে তার দেহ বাতাস হয়ে যাচ্ছে, শুধু আত্মা টিকে আছে, একসময় সে পৌঁছায় একটি অগ্নিকুণ্ডের সামনে, সেখানে আগুন জ্বলছে না, আগুন শ্বাস নিচ্ছে, আগুন যেন জীবন্ত, আর আগুনের ভেতরে সে দেখে একটি মূর্তি—নিজেরই প্রতিচ্ছবি, কিন্তু মুখে চোখ নেই, ঠোঁট নেই, কপালে জ্বলছে অগ্নিবিন্দু চিহ্ন, সেই প্রতিচ্ছবি তার দিকে তাকিয়ে বলে, “তুই আমার শরীর, আমি তোর ছায়া, কিন্তু এখন সময় এসেছে এই বিভাজন মুছে ফেলার,” আগুন হঠাৎ করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, ছায়াগুলো কেঁপে উঠে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, আর রুদ্রাক্ষীর শরীর তীব্রভাবে কাঁপে, চোখ থেকে জল নয়—আগুন বেরোচ্ছে, সে বোঝে না এ ব্যথা, না জাগরণ, না পুনর্জন্ম, কিন্তু সে জানে এখন কিছুই আগের মতো থাকবে না, পরদিন সকালে সে জেগে উঠে দেখে তার শরীরের গায়ে আঁকা আছে অগ্নিবিন্দু চিহ্ন, যেন কেউ আগের রাতেই খোদাই করেছে, আয়নায় তাকিয়ে দেখে—প্রতিবিম্ব এখন তার মতোই, কিন্তু চোখের ভিতরে আছে আগুন, ঠোঁটে আছে ছায়া, সে বোঝে অগ্নিবিন্দু এখন তার শরীরের ভিতরেই আছে, বাইরের কিছু নয়, সে নিজেই এখন এক মাধ্যম, যেখান দিয়ে তন্ত্র নিজেকে জাগিয়ে তোলে, সে জানে সে কিচ্ছু উচ্চারণ না করলেও, চারপাশের বাতাস বদলাচ্ছে, লোকজন তাকিয়ে থাকে তার দিকে অন্যরকম দৃষ্টিতে, যেন তারা জানে না কী দেখছে, কিন্তু ভয় পাচ্ছে, যেন সে ছায়া নয়—এক আগুন, অফিসে বসে কাগজে লিখতে গিয়ে সে বারবার লিখে ফেলে, “ছায়া জাগে, আগুন হাসে,” তারপর কেটে ফেলে, কিন্তু কাগজে দাগ থেকে যায়, রাতে সে আবার সেই আয়নার সামনে দাঁড়ায়, এবার নিজেকে বলে—“আমি রুদ্রাক্ষী, আমি তন্ত্র জানি না, কিন্তু তন্ত্র আমার মধ্যে জন্ম নিয়েছে, আমি ভয় পাই না,” আয়নার ভিতর থেকে সেই প্রতিচ্ছবি হাসে, আর ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়, এবার প্রথমবার সে আয়নায় নিজেকে দেখে, পুরোপুরি ভাবে দেখে, আর তার মুখে একরাশ নির্জনতা, যেন এক পাণ্ডুলিপির মতো মুখ, যেখানে কেউ এখনও পড়েনি, কিন্তু লেখা হয়ে গেছে অনেক আগেই, সেই রাতে সে খাতাটা বন্ধ করে রাখে, জানে এখন আর কিছুই বাইরে খুঁজতে হবে না, সব উত্তর তার ভিতরেই তৈরি হয়ে গেছে, এই আত্মজাগরণ, এই চিহ্নের দেহজ বাসস্থান, এই তন্ত্রের অভ্যন্তরীণ আত্মীয়তা—সবই এখন জাগরণ হয়ে ছড়িয়ে পড়বে, আর সেই ছড়িয়ে পড়া শুরু হবে যখন প্রথমবার সে কারও দিকে তাকিয়ে বলবে—“তুই জানিস তোর ভিতরেও আগুন আছে?” এই কথা বলার আগেই কেউ হয়তো জেনে যাবে, কারণ তার চোখ এখন ভাষার আগে কথা বলে, রুদ্রাক্ষী আর শুধু মনস্তত্ত্ববিদ নয়, সে এখন এক বাহক, এক চিহ্নের শরীর, এক আগুনের ছায়া, যার ভেতরে প্রতিনিয়ত লিখে যাচ্ছে এক মন্ত্র—অগ্নিবিন্দু।
রুদ্রাক্ষী জানে তার শরীর এখন আগুন নয়, ছায়াও নয়, বরং একটা চিহ্ন, এক পাণ্ডুলিপির মতো, যেখানে কেউ এখনও নাম লেখেনি, অথচ প্রতিদিন সকালে সে আয়নায় দাঁড়িয়ে দেখে, তার কপালে ভেসে উঠে অদ্ভুত কিছু অক্ষর, যেগুলো হাত দিয়ে ছুঁতে গেলে মিলিয়ে যায়, আর যেগুলো শুধু ভোরের আলোয় স্পষ্ট, দিনের বেলা নেই, রাতের বেলা নেই, শুধু সূর্য ওঠার ঠিক আগে এক মুহূর্ত, যখন অন্ধকার আর আলো একে অন্যকে স্পর্শ করে, ঠিক তখনই, আজ দশ দিন হয়ে গেছে সে কারও সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বলেনি, কেউ চায় না তার চোখে চোখ রাখতে, সে এখন হাসপাতাল ছাড়িয়েছে, তার প্র্যাকটিস বন্ধ, রোগীরা বাতিল, বন্ধুদের ফোন আসেনি বহুদিন, অথচ ভেতরে সে ভয় পায় না, এক ধরনের উল্টো আরাম জমে আছে তার রক্তে, যেখানে কোনো প্রশ্ন নেই, কারণ সব প্রশ্ন আগেই লেখা হয়ে গেছে, তার শরীর এখন যেন একটা লিখনফলক, যেটায় অশরীরী অক্ষর লিখে চলেছে, নিজের মতো করে, নিজের ভাষায়, কিন্তু সেই ভাষা মানুষের নয়, সেই ভাষা বাতাসের, ছায়ার, আগুনের, নিঃশব্দ অভিশাপের, সেই রাতে সে আবার পুরোনো ডায়েরির পাতায় দেখতে পেল নতুন কিছু লেখা—“তোর নাম যা ছিল, তা ছিল বহনের জন্য, এখন তুই নিজের নাম দে, যেটা শরীর পছন্দ করে না, আত্মা পছন্দ করে,” সে জানে এই নাম রাখা কোনও শিশুর জন্মের নামকরণ নয়, এই নাম হবে তার নতুন সত্তার চিহ্ন, সেই নাম যেটা কোনও ভাষায় নয়, কিন্তু উচ্চারিত হলেই বাতাসে রকম ফেরে, সে চোখ বন্ধ করে বসে, ওম-ধ্বনি নয়, জপ নয়, শুধু নিজের নিঃশ্বাস গোনে, আর প্রতিটি নিঃশ্বাসে খোঁজে সেই অক্ষরগুলো, যেগুলো তার শরীর চাইছে, এবং একসময় সে শুনতে পায়—“ঋকা,” প্রথমে মনে হয় এটা কল্পনা, আবার শোনে—“ঋকা,” তারপর নিজের কণ্ঠে নয়, বাতাসে বলে ওঠে—“আমার নাম রুদ্রাক্ষী ছিল, এখন আমি ঋকা,” ঠিক তখনই তার চারপাশের বাতাস ভারি হয়ে ওঠে, যেন কেউ এই নামের অপেক্ষায় ছিল, সে বোঝে এই নাম শুধু এক পরিচয় নয়, এক চুক্তির শুরু, এই নাম উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরের ভিতর কাঁপুনি দেয়, চোখের পাতা কাঁপে, মনে হয় কেউ শরীরের মধ্যে দৌড়াচ্ছে, দেহ থেকে দেহান্তরিত হচ্ছে এক অনামা শক্তি, পরদিন সকালে সে ঘুম থেকে উঠে দেখে জানালার কাচে জল জমে লেখা—“ঋকা,” এবং সেই অক্ষরগুলো যেন ভিজে নেই, বরং জ্বলছে, সে এবার জানে, সে কে, এবং কেন তাকে বেছে নেওয়া হয়েছে, সে যে পূর্বজন্মে সেই মন্ত্রভ্রষ্ট তান্ত্রিক, যে অগ্নিবিন্দুকে ভালোবাসার নামে ডেকে এনেছিল, এখন সেই চক্রের পূর্ণতা হচ্ছে, এবার তাকে আবার সেই পথ পাড়ি দিতে হবে, কিন্তু এবার ভুল না করে, এবার নিজের আত্মার চিহ্ন দিয়ে তন্ত্রকে লিখতে হবে, সেই বিকেলে সে যায় শোভাবাজার রাজবাড়ির গলি দিয়ে এক পুরোনো বাড়িতে, যেখানে একসময় তার মা তার জন্মের আগে থাকতেন, সেখানে গিয়ে দেখে বাড়ি এখন ভেঙে পড়ছে, দরজা বন্ধ, জানালা পোকায় খাওয়া, কিন্তু এক কোনা থেকে সে খুঁজে পায় এক আয়নার টুকরো, সেই আয়নায় তাকাতেই নিজের মুখ নয়—সে দেখে একটি শবদেহ, যার কপালে লেখা—“ঋকা,” আর বুকের উপর জ্বলন্ত অক্ষরে—“আগুন শেষ নয়, শুরু,” এইবার সে বুঝে নেয় সময় এসেছে পুরোনো সব পোড়ানো কাহিনিকে জাগিয়ে তোলার, সে এবার পুরোনো বইপত্র, পুঁথি, তন্ত্রপাঠ কিছুই খোঁজে না, শুধু বসে থাকে ভোরের আগে, এবং চুপচাপ ভাবে—সে কবে নিজের চিহ্নের বাহক হয়ে উঠবে, হঠাৎ করেই তার হাত চলতে থাকে, কাগজে লেখা হয়, “অগ্নিবিন্দুর সপ্তম স্তর: নামহীন আত্মা নাম ধার করে বাঁচে, আর নিজের নাম পেলে সে শরীর ছাড়ে,” সে চমকে ওঠে, তার মানে কি তার সময় এসে গেছে? সে কি এখন দেহত্যাগ করবে? না কি এই লেখাগুলো মৃত্যুর নয়, রূপান্তরের? সে ভাবে, হয়তো এই চিহ্ন তার মৃত্যু নয়, বরং জন্ম, এক সম্পূর্ণ নতুন আত্মার, যাকে কোনও ভাষা ধরতে পারে না, শুধু অনুভবের মতো সে বেঁচে থাকে, এবং ঠিক সেই ভাবনার মধ্যেই সে অনুভব করে, কেউ তার শরীর স্পর্শ করছে, পিছনে তাকায় না, কিন্তু জানে, সেই ছায়া আবার ফিরে এসেছে, এবার তাকে চূড়ান্ত স্তরে নিয়ে যেতে, নামের ওপারটায়, যেখানে শব্দ থেমে গিয়ে শুধু চিহ্ন থেকে যায়।
ঋকা জানে তার নাম এখন আর শুধু উচ্চারণ নয়, তার নাম এখন এক যন্ত্রণা, এক পেরিয়ে যাওয়া স্তর, যেটা সে পেছনে ফেলে এসেছে, প্রতিদিন সকালে আয়নায় সে দেখে নিজের শরীর ঠিক আগের মতো আছে, কিন্তু চেহারার নিচে যে ছায়া বাস করছে সেটা আর কোনও নির্দিষ্ট পরিচয়ের মুখোশ পরে নেই, বরং এক অদৃশ্য আগুনের মতো ধীরে ধীরে তার সমস্ত পরিচয় খসে পড়ে যাচ্ছে, সে এখন যতই চুপ করে থাকে, তার চারপাশের বাতাস ততই ভারি হয়ে ওঠে, এবং মানুষ বুঝতে পারে না ঠিক কীভাবে, কিন্তু তার দিকে তাকালে মনে হয় তারা শুনছে একটা নীরব ডাক, যেটা ভাষাহীন, অথচ বিরতিহীন, সেই ডাক শব্দ দিয়ে হয় না, কারণ সেটা শব্দেরও আগে জন্মেছে, সে জানে তন্ত্রও শব্দ দিয়ে চলে না, মন্ত্র শুধু উচ্চারিত হয়, কিন্তু তন্ত্র তৈরি হয় সেই স্তরে, যেখানে শব্দ তৈরির আকাঙ্ক্ষাও নেই, এখন ঋকা অনুভব করতে পারে, তার নিঃশ্বাসের গভীরে কেউ কথা বলছে, তার বুকের মধ্যখানে কেউ লিখে চলেছে, কিন্তু লিখছে না কালি দিয়ে, লিখছে অস্তিত্ব দিয়ে, অভিজ্ঞতা দিয়ে, চিহ্ন দিয়ে, সে জানে তার শরীরের ভিতরে এখন প্রতিনিয়ত জন্ম নিচ্ছে এমন সব বাক্য, যেগুলোর ভাষা নেই, কারণ তারা সেই স্তরে বাস করে যেখানে ভাষা তৈরি হওয়ার আগেই চেতনার আকার নেয়, একটা সন্ধ্যেবেলা সে গঙ্গার ধারে বসে, যেখানে আগে সে মায়ের সঙ্গে আসত, আর ভাবে—জন্মের আগে কি সে কোনও শব্দ ছিল? যদি তার আত্মা আগেও ছিল, তবে তার পরিচয় কিসে লেখা ছিল? সে হঠাৎ কল্পনা করে, একটা তামার ফলক, যার উপর জল পড়ে আর সেই জলে ভেসে ওঠে অক্ষর, কিন্তু সেই অক্ষর কোনও ভাষার নয়—এমন চিহ্ন যেগুলো শুধু অনুভবে ধরা যায়, আর এই অনুভবই কি তন্ত্র নয়? সে ভাবে, এই চিহ্নই কি সেই আদিম স্তর, যেখান থেকে শব্দেরা ছুটে আসে, আর মানুষ ধরে নেয় তাদের মানে আছে? কিন্তু তন্ত্র তো মানে চায় না, তন্ত্র তো শুধুই অস্তিত্ব, যে নিজেকে ব্যাখ্যা করে না, কেবল ‘হয়ে ওঠে’, সেই রাতে সে স্বপ্নে দেখে এক অন্ধ নারী, যার মুখে কিছু নেই, চোখ নেই, মুখের জায়গায় শুধু জিভ বেরিয়ে আছে, আর সেই জিভে আগুন জ্বলছে, নারীটি বলে—“আমি সেই যা শব্দের আগে ছিলাম, আমি সেই যার নাম কেউ জানে না, কিন্তু যার ছায়া সব নামের আগে জন্ম নেয়,” ঋকা চমকে ওঠে, সে বুঝতে পারে এটা কোনও আলাদা স্বপ্ন নয়, বরং এক প্রবেশ—চিহ্নের উৎসে, সেই জায়গায় যেখানে তন্ত্র তৈরি হয়, নাম হয় না, উচ্চারিত হয় না, কিন্তু চিহ্ন হয়ে চিরকাল বেঁচে থাকে, পরদিন সকালে সে চোখ মেলতেই দেয়ালের পাশে দেখে জলে লেখা অক্ষর, যেগুলো শুকিয়ে গেলেও দেয়ালে থেকে যায়, সে হাত দিয়ে ছোঁয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু হাত কেটে যায়, বুঝতে পারে এই চিহ্ন কালি নয়, এই চিহ্ন আগুন, সেই আগুন যার রং হয় না, যে আলো দেয় না, শুধু ছায়া তৈরি করে, আর সেই ছায়াতেই লেখা থাকে সমস্ত জন্মের ইতিহাস, সে এবার পুরোনো খাতার একদম শেষ পাতা খোলে, যেটা আগে ফাঁকা ছিল, দেখে সেখানে লেখা—“যেখানে শব্দ থামে, সেখান থেকে শুরু হয় অগ্নিবিন্দু, কারণ আগুনের ভাষা শব্দ চায় না, আগুন শুধু ছায়া চায়,” এই বাক্য পড়ে সে বুঝতে পারে এতদিন সে শব্দ ধরে যা বোঝার চেষ্টা করছিল, তা ছিল ভুল, কারণ শব্দ মানে অন্যের শোনা, কিন্তু চিহ্ন মানে নিজের অনুভব, এখন তার কাজ হল সেই স্তরে পৌঁছানো যেখানে সে কিছু বলবে না, কিন্তু সে যা সেইটাই ছড়িয়ে পড়বে, সে সেই রাতে বসে থাকে জানালার পাশে, বাতাসের শব্দ শুনতে চায় না, আলো দেখতে চায় না, শুধু অনুভব করে তার বুকের ভিতর দিয়ে একটা অনাবৃত আগুন চলে যাচ্ছে, সেই আগুন একে একে মুছে দিচ্ছে সব শিখে আসা শব্দ—ভালোবাসা, ভয়, মৃত্যু, মুক্তি—সবকিছুর গায়ে আঁচড় কেটে দিচ্ছে, আর তার জায়গায় বসিয়ে দিচ্ছে নামহীন কিছু অনুভব, যেগুলো কাঁদতে শেখায় না, হাসতেও শেখায় না, শুধু বলে—‘তুই যা, সেটা হ’’, আর সেই হ’ হয়ে ওঠাটাই তন্ত্র, পরদিন সকালে সে তার নামে সই করতে গিয়ে দেখে হাত থেমে গেছে, কলম ছুঁইয়ে কিছু লিখতে পারছে না, কারণ তার হাত নিজেই নিজের নাম জানে না, সে বোঝে এই বিরতিই সবচেয়ে গভীর, যেখানে কেউ তাকে চিনবে না নাম দিয়ে, শব্দ দিয়ে, শুধু চিহ্ন দিয়ে, আর সে নিজেও নিজেকে চিনবে না, শুধু অনুভবে বুঝবে—সে তন্ত্রের ভিতর ঢুকে গেছে, শব্দের বাইরে, ভাষার আগে, পরিচয়ের ওপারে।
ঋকা জানত না কতদিন কেটেছে, এখন তার কাছে দিন বা রাত এক জলের রেখা, যেটা চোখের পাতার মতো ওঠে আর নামে, আর তার মাঝে সে জেগে থাকে, শরীরের মতো নয়, সময়ের মতো, গতিহীন কিন্তু স্পন্দিত, সে এখন প্রতিদিন একটা করে শব্দ ভুলে যাচ্ছে—ভাষা, নাম, পরিচয়, সম্পর্ক—সব কিছু যেন তার বুক থেকে সরে গিয়ে ছায়ার নিচে পড়ে আছে, আর সেই ছায়াগুলো এখন আর অন্ধকার নয়, তারা আগুন ছড়ায়, আগুন পোড়ায় না, কিন্তু গলে যেতে শেখায়, সেই রাতে হঠাৎ করেই সে দেখে তার পুরোনো খাতার প্রথম পাতায় লেখা আছে একটা নতুন লাইন—“তুই যে তন্ত্রকে ডাকছিলি এতদিন, সে তো তোকে আগেই দেখে ফেলেছিল, এখন সময় হয়েছে তাকে স্বীকার করার,” এইবার সে বোঝে, এতদিন ধরে সে যা ভেবেছে—সে খুঁজছে, প্রশ্ন করছে, জেনে নিচ্ছে, আসলে তন্ত্রই তাকে দেখছিল, তাকিয়ে ছিল, নীরবে নিরীক্ষণ করছিল, ঠিক কবে তার শরীর প্রস্তুত হবে এই আগুনের চিহ্ন ধারণ করার জন্য, এবার যখন সব নাম, শব্দ, ভাষা ঝরে গেছে, যখন সে নিজের ছায়াকেও চেনে না, তখনই মন্ত্র তাকে বেছে নেয়, এক রাতে তার ঘুম ভাঙে তীব্র গরমে, মনে হয় যেন বুকের ভেতরে কেউ আগুন জ্বালিয়েছে, আর সেই আগুন একটা মুদ্রার মতো ঘুরছে, ঘুরে ঘুরে শরীরের ভিতর চিহ্ন এঁকে দিচ্ছে, সে আয়নায় ছুটে যায়, দেখে তার কপালে স্পষ্ট লাল আগুনের রেখা, আর ঠোঁট নিজের থেকে কাঁপছে, কিন্তু সে কিছু বলছে না, শব্দ আসছে না, শুধু বাতাসে একটা কম্পন, একটা অদৃশ্য ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছে, যেটা ঘরের বাতাসকে বদলে দেয়, দেয়ালের রং বদলে দেয়, জানালার কাচে জমে ওঠে জল, আর সেই জলে ভেসে থাকে শব্দ—“ঋকা”, কিন্তু এবার সেই নাম তার পরিচয় নয়, তার অস্তিত্ব, সেই রাতে সে আবার সেই আগুনঘেরা ঘরে প্রবেশ করে, যেখানে প্রতিবার তার স্বপ্ন শুরু হত, কিন্তু এবার ঘরে বসে নেই কোনও ছায়া, নেই কোনও গম্ভীর চোখের তান্ত্রিক, শুধু মাঝখানে রাখা এক পুঁথি, তার গায়ে লেখা—“অগ্নিবিন্দু,” সে পুঁথি ছুঁতেই পৃষ্ঠা খুলে যায়, কিন্তু পৃষ্ঠায় কোনও লেখা নেই, শুধু চিহ্ন, সেই চিহ্নগুলো চোখে পড়ে না, অনুভব করতে হয়, আর অনুভব করলেই শরীর কেঁপে ওঠে, কারণ সে বোঝে—এই চিহ্ন আগে তার মধ্যে ছিল না, এখন এসে গেছে, এবার এই চিহ্নই তার ভিতর থেকে লিখে দেবে সবকিছু, সে আর লেখক নয়, বাহক, সে আর জানে না পরের মুহূর্তে কী ঘটবে, কিন্তু জানে সবকিছু ঘটবে ঠিক তেমনভাবেই যেমন আগুন নিজে ছড়িয়ে পড়ে—নিজের নিয়মে, নিজের গতিতে, নিজের ছায়া রেখে, পরদিন সকালে সে দেখতে পায়, তার খাতার প্রতিটি খালি পাতায় কিছু লেখা হয়েছে, কিন্তু সেই লেখা সে নিজে লেখেনি, কেউ তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে, এবং সেই প্রতিটি বাক্য পড়লেই সে কাঁপে, যেমন—“মন্ত্র কাউকে শেখানো যায় না, মন্ত্র কাউকে বোঝানো যায় না, মন্ত্র শুধু নিজে এসে বসে পড়ে, যার ভিতরে সে ঘুমিয়ে থাকবে, যতক্ষণ না শরীর নিজে জেগে ওঠে,” আরেকটা পাতায় লেখা—“মন্ত্র একটা আত্মা, সে নিজের বাহক নিজে খুঁজে নেয়,” এই বাক্যগুলোর মধ্যে দিয়ে সে দেখে নিজেকে, যেভাবে কেউ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আর নিজের শরীর নয়, নিজের অন্তর্লিখিত কাহিনি দেখে, সেই রাতে সে তার ঘরের সব আয়না খুলে ফেলে দেয়, কারণ এখন সে আয়নায় কিছু দেখে না, শুধু আগুন দেখে, চোখের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা আগুন, ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা শব্দহীন জ্বালা, আর সে জানে এখন কিছু শুরু হবে, খুব তীব্রভাবে, হয়তো কিছু ছিঁড়ে যাবে, কেউ হারিয়ে যাবে, কেউ জেগে উঠবে, কিন্তু সবকিছুই হবে এই মন্ত্রের ইচ্ছেতে, যাকে সে কোনওদিন ডাকেনি, তবু যেটা তার ভিতর জন্মেছে, ঠিক সেইভাবে যেমন কোনও নাম নিজে এসে কাউকে বসিয়ে দেয় চিহ্নের গায়ে, সে এখন প্রস্তুত, কারণ এখন সে বোঝে, সে নিজের শরীর নয়, নিজের ভাষাও নয়, সে এখন সেই চিহ্ন যার শরীর আগুনে লেখা, যার উচ্চারণ হয় বাতাসে, আর যার ব্যাখ্যা অসম্পূর্ণ রয়ে যায় সব শব্দের পরেও।
ঋকা এখন জানে ভাষার শেষ কোথায়, শব্দ শেষ হওয়ার পরে যেটা শুরু হয় সেটা শুধু আগুন, আর সেই আগুন কথা বলে না, ব্যাখ্যা দেয় না, সে শুধু নিজেকে উপস্থিত করে, উপস্থিতির মধ্যেই সে রেখে যায় চিহ্ন, যা পড়ে ফেলা যায় না—অনুভব করতে হয়, সে এখন প্রতিদিন রাতে বসে থাকে নিঃশব্দে, ঘরের আলো নিভিয়ে, বাতাসে কান পেতে থাকে, যেন কোনও শব্দ না এলেও ভিতরটা কেঁপে ওঠে, কারণ শরীর এখন অনুভব করছে সেই তরঙ্গ, যে তরঙ্গ ভাষাহীন, তবু তীক্ষ্ণ, সেই তরঙ্গ শরীরের ভিতর দিয়ে সরে যায়, আর হঠাৎ হঠাৎ শরীর থেমে যায়, চোখের পাতা কাঁপে, হাত নিজে থেকেই কাগজে লিখে ফেলে মন্ত্র, যেটা সে জানে না, কখনও পড়ে দেখেও বোঝে না, কিন্তু জানে—এই লেখাগুলো তার নয়, এগুলো তার ভিতর দিয়ে বেরিয়ে আসা সেই অশরীরী আত্মার, যে অনেক জন্ম ধরে ঘুমিয়ে ছিল, এখন সে জেগে উঠেছে, আর এখন তার কোনও ভাষা নেই, কারণ তার প্রয়োজন নেই ব্যাখ্যার, দরকার নেই যোগাযোগের, কারণ সে নিজেই এক জগৎ—যেখানে ছায়া জন্ম নেয়, আলো মারা যায়, শব্দ থেমে যায়, আর আগুন নিঃশব্দে জেগে থাকে, এক রাতে হঠাৎ সে অনুভব করে তার ঘর কাঁপছে না, কিন্তু বাতাস ভারী হয়ে গেছে, যেমনভাবে ঘরে কেউ হঠাৎ এসে দাঁড়ালে বোঝা যায়, শব্দ নেই, দৃশ্য নেই, কিন্তু উপস্থিতির ভার টের পাওয়া যায়, সে জানে সেই আগুন ফিরে এসেছে—যে আগুন নিজে কথা বলে না, বরং অন্যের ভিতর দিয়ে নিজেকে দেখায়, সে আয়নার দিকে তাকায় না, জানালার বাইরেও দেখে না, শুধু চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে, আর তার মনে হয়—একটা দীর্ঘ ফিসফাস, যেন শতশত ছায়া একসঙ্গে নিঃশব্দে বলছে, “তুই প্রস্তুত, এখন আগুন তোকে ছুঁবে,” সে শরীর থেকে ভয় ঝেড়ে ফেলে, তার মনে পড়ে সেই প্রাচীন গানে শোনা একটা পঙক্তি—“আগুন যারে দহন করে, সে আর মানুষ নয়, সে চিহ্ন হয়ে যায়,” এইবার সে নিজেই আগুনের সামনে দাঁড়ায়, অন্তরের সেই অনস্তিত্বপূর্ণ কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করে, যেটা আগে ছিল স্বপ্ন, এখন বাস্তব, আগুন এবার তার শরীরের চারপাশ ঘিরে ফেলে, কিন্তু পোড়ায় না, বরং শীতল অনুভব—যেমন কোনও আত্মা যখন শরীর ছেড়ে বেরিয়ে যায়, যেমন কাউকে খুব কাছে থেকে দেখতে গিয়েও ছুঁয়ে ফেলা যায় না, সেইরকম তীক্ষ্ণ শীতলতা তার ত্বকে জমে ওঠে, আগুনের মধ্যে সে দেখে কিছু চিত্র—তার অতীত নয়, তার ভবিষ্যৎ নয়, বরং সময়ের বাইরের কিছু ক্ষুদ্র ঘটনা, যেখানে সে হয়তো একজন নয়, বহুজন, হয়তো বহু জন্মের স্মৃতি, অথবা বহুরূপী আত্মা, যার শরীর শুধু বাহক, এক সময় সে দেখে তার কণ্ঠ থেকে ধোঁয়ার মতো কিছু বেরোচ্ছে, আর সেই ধোঁয়ার মধ্যে ভাসছে অক্ষর—না লেখা অক্ষর, না উচ্চারিত শব্দ, শুধু অস্তিত্বের ছায়া, সে বোঝে আগুন এখন কথা বলছে না, আগুন কেবল তাকিয়ে আছে, আগুন শুধু নিজের উপস্থিতি জানিয়ে দিচ্ছে, এবং সেই জানানোই অনেক বড় ভাষা, অনেক বড় ঘূর্ণি, অনেক গভীর অনুভব, সে এখন বুঝতে পারে তার শরীর আর তার নিজের নয়, এখন সে অন্য কারো হয়ে গেছে, এখন সে তন্ত্রের শরীর, এখন সে কথা বললে শব্দ হয় না, চিহ্ন হয়, আর চিহ্ন ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে, আর বাতাস জানে কার চোখে গিয়ে বসবে সেই চিহ্ন, পরদিন সকালে সে বাইরে বেরোয়, খুব ধীরে হাঁটে, লোকেরা চেয়ে থাকে, কিন্তু কেউ প্রশ্ন করে না, কারও চোখে অস্বস্তি, কারও চোখে ভয়, কেউ মুখ ফিরিয়ে নেয়, কেউ দাঁড়িয়ে পড়ে, এক বাচ্চা মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলে—“এই মেয়েটার মুখে আলো নেই, তবু কেন আমি তাকিয়ে থাকতে চাই?” তখনই ঋকা বুঝে যায়, আগুন তার ভিতর দিয়ে কাজ করছে, নিজের মতো করে, কথা না বলে, কিন্তু স্পর্শ রেখে যাচ্ছে, ছাপ রেখে যাচ্ছে, আর যাকে ছোঁচ্ছে তার কিছু ভেঙে যাচ্ছে, কিছু গড়ে উঠছে, এই ছোঁয়া কে পাবে, কে পাবে না, সেটা আর তার হাতে নেই, কারণ সে জানে, এখন আগুন নিজের কাজ করছে, ভাষাহীনভাবে, নির্বাকভাবে, নিঃশব্দে, গভীরভাবে, কারণ তন্ত্র কোনওদিন মুখে বলে না, তন্ত্র শুধু রচনা করে।
ঋকা জানে আর কিছুই বাকি নেই, ভাষার সব স্তর পেরিয়ে, আগুনের সব চিহ্ন গ্রহণ করে, শরীরের সব কাঁপুনি মেনে নিয়ে এখন সে এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে, যেখান থেকে না ফেরা যায়, না থেমে থাকা যায়, শুধু হয়ে ওঠা যায়, আর সেই হয়ে ওঠাটাই শেষ কথা, তন্ত্র কোনওদিন শিক্ষা ছিল না, কোনওদিন দর্শন ছিল না, কোনওদিন প্রাচীন পুঁথির ধুলো জড়ানো গল্প ছিল না—তন্ত্র বরাবরই ছিল এক অন্তর্জাগা, এক গোপন আগুন, যেটা অপেক্ষা করত সেই শরীরটার জন্য, যে নিজের পরিচয় ফেলে দিয়ে, নিজের ভাষা ভুলে গিয়ে, নিজের ছায়াকে মেনে নিয়ে একসময় আগুনের ভিতর দাঁড়াতে পারে—ঋকা জানে সে এখন সেই শরীর, আগুন আর আলাদা নেই, আগুন এখন তার হাড়ের ভিতর পঁচে থাকা শ্বাস, তার চোখের ভিতর ঘূর্ণি তোলা সময়, তার ঠোঁটের কিনারে রক্তরঙা নৈঃশব্দ্য, সেই রাতে সে আর কোনও আয়নার দিকে তাকায় না, তার দরকার নেই দেখতে নিজেকে—কারণ সে জানে সে নিজেকে ছাড়িয়ে গেছে, সে এমন এক অস্তিত্ব যেখানে চেহারার দরকার নেই, শব্দের দরকার নেই, মানুষের ভাষায় সেই অভিজ্ঞতাকে বলা যাবে না, সেই অনুভূতিটা এমন, যেন শরীরটা ধীরে ধীরে মাটিতে মিশে যাচ্ছে, অথচ মাটি হয়ে যাচ্ছে না, বরং আগুনে ভেঙে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে, সে জানে এখন যা তার মধ্যে আছে সেটা মানুষের নয়, সেটা চিহ্নের, আগুনের, এবং সেই চিহ্ন এখন কেবল তার কপালে বা গায়ের উপর নেই, সেটা ছড়িয়ে আছে তার স্পর্শে, তার নিঃশ্বাসে, তার হাঁটার গতিতে, যেদিকে সে তাকায়, সেখানে বাতাস একটু ঘন হয়ে ওঠে, আলো একটু বদলে যায়, ছায়া একটু টান পড়ে—এমন নয় যে সবাই তা দেখে, কিন্তু যারা দেখতে পারে, তারা থেমে যায়, এবং বোঝে—এই মেয়েটা আগুন নয়, আগুনের শরীর, সে জানে এখন কেউ যদি তার দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি কে?” সে উত্তর দেবে না, কারণ তার আর কোনও নাম নেই, শুধু একটি চিহ্ন আছে, আর সেই চিহ্ন একসময় কারও কপালে জ্বলবে, যেমনটা তার হয়েছিল, সেই চিহ্ন শব্দ নয়, শব্দের আগের সেই ফিসফিস করা নীরবতা, যে নীরবতা একসময় স্বয়ং অগ্নিবিন্দু হয়ে ওঠে, সে আজ রাতে তার শেষ খাতা খুলে লিখে রাখে—“আমি ছিলাম রুদ্রাক্ষী, আমি হলাম ঋকা, তারপর একদিন আমি হয়ে গেলাম এমন কিছু, যাকে কেউ ডাকতে পারে না, যার ডাক আসে নিজের ভিতর থেকে, আমি এখন অগ্নিবিন্দু—চিহ্ন নয়, বাহক নয়, আমি নিজেই মন্ত্র,” সেই লেখা তার জীবনের শেষ লেখা, কারণ তারপর থেকে কেউ তাকে দেখেনি, কেউ তাকে খুঁজেও পায়নি, তার ঘর খালি, বই পড়ে আছে, কাগজে লাল অক্ষরে লেখা কিছু বাক্য বাতাসে ফুরিয়ে যাচ্ছে, শুধু জানালার কাচে মাঝে মাঝে শিশির জমে ওঠে, আর সেই শিশিরে কোনও নাম থাকে না, থাকে একটাই চিহ্ন—একটি বৃত্ত, যার ভেতরে আগুনের মতো ঘুরছে চারটি রেখা, মানুষ ভাবে সেটা কুয়াশা, কেউ ভাবে সেটা ঘুম চোখে দেখা ভুল, কিন্তু যারা বুঝতে পারে, তারা জানে—অগ্নিবিন্দু এখন কাগজে নেই, আয়নায় নেই, পুঁথিতে নেই, অগ্নিবিন্দু এখন হেঁটে বেড়ায় এক শরীর হয়ে, আর সেই শরীর যে-ই হোক, সে নিজেকে আর কখনও বলে না “আমি”, সে শুধু বলে—“এইখানে আমি ছিলাম, এখন আমি চারদিকে আছি, ভাষাহীনভাবে, আলোছায়ার ভিতর, জাগরণের ঠিক ওপারে, ঘুমের শেষ ধাপে, আমি নিজেই সেই মন্ত্র, যাকে কেউ শেখায় না, শুধু যার ছোঁয়ায় মানুষ নিজেকে ভুলে যেতে চায়,” তারপর একদিন কেউ একটা খাতার ভাঁজে খুঁজে পাবে সেই চিহ্ন, আবার একজন চোখ বন্ধ করে শুনতে পাবে সেই নীরব ডাক, আর শুরু হবে আরেকজনের ভিতর সেই লেখা—যা আগুন দিয়ে শুরু হয়, আর আগুন দিয়েই শেষ, যেমনটা সব জন্মে হয়।
সমাপ্ত




