তিয়াসা রায়
গরমের সন্ধ্যা নামছিল ধীরে ধীরে। দক্ষিণ কলকাতার পুরনো লাইব্রেরিটির জানালায় আলোর রেখা এসে পড়ছিলো এক আড়ষ্ট ঢেউয়ের মতো। ঈশান বসেছিল লাইব্রেরির কাঠের ডেস্কে—একদিকে ছড়িয়ে রাখা বইয়ের স্তূপ, অন্যদিকে তার নিজের নোটবুক। চারপাশে খুব বেশি পাঠক নেই আজ, শুধু দূরের কোণায় বসে একজন মাঝবয়সী মানুষ মগ্ন হয়ে পত্রিকা উল্টাচ্ছেন। এমন শান্ত সন্ধ্যা ঈশান ভালোবাসে, যখন পৃষ্ঠার শব্দ, দূরের হকারের আওয়াজ আর রোদের ক্লান্ত আলো মিলে এক অদ্ভুত গল্প রচনা করে চারপাশে। তার চোখ হঠাৎ জানালার বাইরে গিয়ে ঠেকে। রোদের ঝলকে ধরা পড়ে এক মেয়ে—চুপচাপ দাঁড়িয়ে, লাইব্রেরির জানালার পাশেই। তার হাতে একটা পুরনো বই, “শরতচন্দ্রের উপন্যাস সমগ্র – প্রথম খণ্ড।” মেয়েটি বইটার প্রচ্ছদে আঙুল বোলাচ্ছে, যেন কোনো চেনা মুখের গাল ছুঁয়ে দিচ্ছে। ঈশান একটু অবাক হয়—কেউ কি বইকে এভাবে ছোঁয়? তার চুল বাঁধা ছিল ঢিলে করে, নরম হলুদ রঙের সুতির কামিজে তার যেন নিজের মতো করে সূর্য ডুবিয়ে চলেছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মেয়েটি ফিরে যায়—না কোনো শব্দ, না কোনো প্রশ্ন। ঈশানের মাথায় ঘুরতে থাকে তার চোখের চাহনি। গভীর, বিষণ্ণ কিন্তু শান্ত।
পরদিন সন্ধ্যাতেই মেয়েটি আবার আসে। লাইব্রেরির ভেতরে ঢোকে আস্তে আস্তে, যেন কোনো শব্দ না করে হাঁটতে চায় সে। কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা না করে একটা নিরিবিলি কোণ বেছে নেয়, হাতে আবার সেই একই বই। ঈশান তাকে লক্ষ্য করে, এবার একটু সাহস করে এগিয়ে যায়। “আপনি কি নতুন পাঠক? আমাদের এখানে ফর্ম পূরণ করতে হয়,” – এই কথাটুকু বলতেই সে একটু থেমে যায়। মেয়েটি তাকিয়ে থাকে তার দিকে, শান্ত চোখে, কিছু না বলে। তারপর ব্যাগ থেকে বের করে একটা ছোট নোটবুক। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে লিখে দেয়:
“আমি কথা বলতে পারি না, কিন্তু শুনতে পাই।”
ঈশান থমকে যায়। কেমন যেন এক মুহূর্তে চারপাশের শব্দ থেমে যায় তার কানে। সে বলে না কিছু, শুধু মাথা নাড়ে। মেয়েটি হাসে—একটুখানি, কিন্তু সেই হাসিতে ছিল আস্থার মতো কিছু। এরপর থেকে প্রায় রোজ আসতে শুরু করে সে। কোনোদিন শুধু বসে পড়ে, কোনোদিন বই উল্টায়, কোনোদিন ঈশানের টেবিলে একটা ছোট কাগজ রেখে যায়: “আজকের গল্পটা কেমন লাগলো?”, “তোমার প্রিয় কবিতা কোনটা?”, “সত্যিই কি মানুষ একা একা থাকতে পারে?” — ঈশান মুগ্ধ হয়ে পড়ে এই চুপচাপ জিজ্ঞাসার ভেতর। তার নিজস্ব জগৎ যেন একটু একটু করে ধাক্কা খায় মেয়েটির নীরব স্পর্শে। তারা একসঙ্গে বসে, কোনো কথা বলে না, শুধু একে অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। নীরবতা এত অর্থপূর্ণ হতে পারে, ঈশান জানত না।
তিয়াসা—এই নামটা সে জেনেছিল তৃতীয় সপ্তাহে। মেয়েটি একদিন একটা বই ফেরত দিতে গিয়ে তার সঙ্গে দিলো একটা ছোট কাগজে লেখা নাম—“তিয়াসা সেনগুপ্ত”। সঙ্গে ছোট একটা স্কেচ—একটা বইয়ের উপর বসে থাকা দুই পাখি। সেই স্কেচে এমন কোমলতা ছিল, ঈশান অনুভব করে, এই মেয়ে তার জীবনকে নীরবে জড়িয়ে ফেলছে। ইশারা, চোখের দৃষ্টি, আর ছোট ছোট কাগজে লেখা কিছু কথা—এই দিয়েই তারা দু’জনে একে অপরকে চিনতে শুরু করল। শব্দ ছাড়াও অনুভূতি প্রকাশের অসংখ্য পথ রয়েছে—এ কথা ঈশান আগে বইয়ে পড়েছিল, এখন অনুভব করছিল। লাইব্রেরির সেই নীরব কোণ যেন হয়ে উঠল তাদের একান্ত আশ্রয়, যেখানে শব্দ ছিল অনুপস্থিত, কিন্তু অনুভব ছিল স্পষ্ট, উজ্জ্বল। সমাজের শত কথার বাইরে এক চুপকথা জেগে উঠছিল—প্রথমে হালকা, তারপর সাহসী। চোখের ভাষায় লেখা হচ্ছিল এক নতুন গল্প—যেখানে ভালোবাসা শিখছিল নিরবতার ব্যাকরণ।
–
সপ্তাহ পেরিয়ে গেলো। লাইব্রেরির নিয়মিত পাঠকদের পাশাপাশি তিয়াসা হয়ে উঠলো যেন ঈশানের এক নীরব অভ্যেস। প্রতিদিন একই সময়ে, একই ছায়ায় সে হাজির হয়, হাতে কখনো শরৎচন্দ্র, কখনো জীবনানন্দ, কখনো বা শুধু একটা ডায়েরি। কথা হয় না, শব্দে না; কিন্তু একটা সম্পর্ক যে গড়ে উঠছে, সেটা বোঝা যাচ্ছিল নিঃশব্দ স্পর্শে। ঈশান একসময় নিজেই অপেক্ষা করতে শুরু করে বিকেলের নির্দিষ্ট সময়ে জানালার পাশে ওই চেনা মুখটার জন্য। তিয়াসা মাঝে মাঝে হাতে ছোট ছোট রঙিন কাগজে লিখে রাখে কিছু লাইন, কখনো কবিতার, কখনো নিজের বানানো কিছু কথা। সেদিন যেমন লিখে আনলো—
“ভালোবাসা শব্দে নয়, চোখে দেখা যায়। তুমি কি দেখেছো?”
ঈশান পড়ে, মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। কীভাবে এমন গভীর কথা এত অল্প কথায় লেখা যায়, তাও এমন একজনের হাতে, যিনি শব্দ উচ্চারণই করতে পারেন না! সে টেবিলের নিচে রাখা নিজের খাতার এক পৃষ্ঠা ছিঁড়ে তিয়াসার দিকে এগিয়ে দেয়:
“হয়তো দেখেছি… কিন্তু এখন স্পষ্ট দেখছি।”
তিয়াসার চোখে তখন এক ফালি চাঁদের আলো।
তাদের ‘আলাপ’ বলতে শব্দগত আদান-প্রদান নেই। কিন্তু সেই নোটপত্রের ভাষা দিনকে দিন গভীর হতে থাকে। তিয়াসা একদিন লিখে আনে—
“তুমি কি জানো, আমি কখনো কারও সাথে এতদিন ধরে যোগাযোগ রাখিনি?”
ঈশান জবাব দেয়:
“আমিও না।”
তিয়াসা আবার লিখে দেয়—
“তুমি কি ভয় পাও না, এই বন্ধুত্ব অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে?”
ঈশান থেমে যায়। ঠিক কী বলবে ভেবে পায় না। সে জানে না ভালোবাসা বলতে কী বোঝায়, কিন্তু এই মেয়েটিকে সে প্রত্যেকদিন দেখতে চায়, তার অনুভব ছুঁতে চায়।
তাদের এই অদ্ভুত ভাষার জগতে একটা নিয়ম তৈরি হয়—প্রতিদিন অন্তত একটা কাগজের নোট দেওয়া হবে একে অপরকে। ছোট, কিন্তু সত্য। কেউ কাউকে ঠকাবে না, এমন একটা নীরব অঙ্গীকার।
সেই নোটগুলোতে ধরা পড়তে থাকে এক নিঃশব্দ আবেগ। যেমন:
“তোমার সঙ্গে বসে থাকলে আমার মনে হয় আমি স্বাভাবিক।”
“তোমার চোখে কি আমার দোষগুলোও সুন্দর লাগে?”
“তুমি কি আমার নীরবতাকে ভয় পাও না?”
প্রতিটা প্রশ্ন, প্রতিটা উত্তর, যেন এক অদৃশ্য দড়িতে বাঁধা—নড়ছে, কিন্তু ছিঁড়ছে না।
একদিন তিয়াসা খুব চুপচাপ আসে, আজ যেন একটু গম্ভীর। মুখে হাসি নেই। ঈশান জিজ্ঞাসা করে না কিছু, শুধু একটা খাতা এগিয়ে দেয়। তিয়াসা লিখে—
“আজ সকালে একজন বলেছিল—বোবা হলে ভালোবাসা হয় না। আমি হাসিনি। কাঁদিনি। কিছু বলিনি। কিন্তু তোমাকে বললাম, কারণ আমি জানি তুমি বুঝবে।”
ঈশানের মনে একটা হাহাকার জন্ম নেয়। কী নির্মম, কী নির্লজ্জভাবে সমাজ কিছু কথা বলে ফেলে! সে জবাব লেখে—
“তারা শব্দ বোঝে, ভাষা বোঝে না। তুমি ভালোবাসার ভাষা জানো। তুমি শব্দ ছাড়াই অনেক বেশি বলো।”
তিয়াসা তাকিয়ে থাকে তার দিকে, অনেকক্ষণ। এরপর কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা প্যাচানো কাগজ বের করে দেয় ঈশানের হাতে। খুলে লেখা:
“তুমি কি আমার ‘শব্দ’ হয়ে উঠবে? আমি বলবো না, তুমি বোঝাবে?”
ঈশান চুপ করে বসে থাকে কিছুক্ষণ। তার বুকের মধ্যে এক অব্যক্ত কিছু ভরে ওঠে। সে মাথা নাড়ে, কিন্তু খুব আস্তে—যেন একটা প্রতিজ্ঞা, শব্দহীন।
সেই দিন থেকেই ঈশানের জীবনে শব্দের মানে বদলে যায়। শব্দ শুধু উচ্চারণ নয়, শব্দ মানে অনুভব, স্পর্শ, বোঝাপড়া।
আর তিয়াসা? সে যেন প্রথমবার নিজের নিঃশব্দ জগতে কাউকে জায়গা দেয়।
তাদের মাঝে জন্ম নেয় ‘চুপকথা’—এক নীরব নৌকা, যেখানে শব্দ নেই, কিন্তু গন্তব্য আছে।
–
সেদিন সকালটা ছিল ধূসর। আকাশে সূর্য উঠলেও আলো যেন কিছুটা ঘোলা, একটু ক্লান্ত। ঈশান লাইব্রেরির দরজা খুলে চেয়ার টেনে বসতেই দেখল—তিয়াসা আগেই এসে অপেক্ষা করছে। চুল এলোমেলো, চোখের নিচে চাপা ক্লান্তি, আর মুখে সেই গভীর নীরবতা। আজ যেন অন্য রকম লাগছে তাকে। কোনো কাগজের নোট নেই হাতে, কোনো হাসিও নয় চোখে। ঈশান চিন্তিত হয়ে পড়ে, কিন্তু সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস পায় না। সে পাশে গিয়ে বসে, নিজের খাতা খুলে একটি বাক্য লেখে—
“সব ঠিক আছে তো?”
তিয়াসা চোখ রাখে সেই লেখার উপর। অনেকটা সময় চুপচাপ বসে থেকে অবশেষে ব্যাগ থেকে বের করে ছোট্ট এক খাম। ঈশান খুলে দেখে, ভেতরে একটা পুরনো ছবি—ছোট তিয়াসা, মাত্র ছয় বছর বয়স, গলায় সাদা কাপড়ের স্কার্ফ, হাসপাতালের বেডে। সঙ্গে একটা কাগজ, যেখানে লেখা—
“ছয় বছর বয়সে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে কণ্ঠনালী অকার্যকর হয়ে যায়। ডাক্তার বলেছিল, হয়তো আবার কথা ফিরবে। কিন্তু ফেরেনি। তখন থেকে আমি শব্দ ছাড়াই বেঁচে থাকি।”
ঈশান বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এতদিনে সে প্রথমবার বুঝল, তিয়াসার নিঃশব্দতার পেছনে কতটা যন্ত্রণা, কতটা অভিমান, আর কতটা অপূর্ণতা জমে আছে। তিয়াসা তাকে আরেকটা কাগজ দেয়—
“তুমি যতটা সহজে আমার কাছে আসছো, আমি ততটা ভয় পাচ্ছি। তুমি কি জানো, যারা আমার মতো বোবা, তাদের ভালোবাসা কেউ সিরিয়াসলি নেয় না?”
ঈশান প্রথমবার বুঝতে পারে, এই নীরব সম্পর্কের ভিতরে কতটা গোপন টানাপোড়েন রয়েছে। তার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। সে জানে, এই ভালোবাসা তার জীবনের সবচেয়ে সত্যি জিনিস, কিন্তু একই সঙ্গে সবচেয়ে বেশি জটিল।
তিয়াসা আবার লিখে—
“তুমি আমার হাত ধরতে চেয়েছিলে গতকাল। কিন্তু আমি পিছিয়ে এসেছি। দয়া ভেবে নয়, ভয় পেয়ে। তুমি যদি একদিন ক্লান্ত হয়ে যাও, যদি বলো—‘তোমার সঙ্গে সব কঠিন’, তখন আমি কী করব?”
ঈশান এবার আর কাগজে কিছু লেখে না। শুধু ধীরে ধীরে নিজের হাত বাড়িয়ে দেয় তার দিকে। কিন্তু তিয়াসা আবার একটু সরিয়ে নেয় নিজের হাত।
ঈশান মুচকি হেসে বলে—”ঠিক আছে, ধরব না। কিন্তু তুমি জানো, এই না ধরা হাতটাই আমাকে সবথেকে বেশি টেনে রাখে তোমার দিকে।”
তিয়াসা তার চোখের দিকে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর ব্যাগ থেকে আবার খাতা বের করে লেখে—
“তুমি জানো, শব্দহীন সম্পর্কেও স্পর্শের সীমা থাকে?”
ঈশান মাথা নাড়ে। সে জানে, ভালোবাসার নাম করে ছুঁয়ে ফেলা আর সত্যিকারের ভালোবাসায় ছুঁতে ভয় পাওয়া—এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য অনেক।
তিয়াসার চোখে আজ এক অন্যরকম প্রশান্তি। যেন ঈশান তার না বলাও বুঝতে পেরেছে।
এরপর কয়েকদিন তিয়াসা লাইব্রেরিতে আসে না। ঈশান প্রথম দু’দিন ভাবে, হয়তো অসুস্থ। তৃতীয় দিনে অস্থির হয়ে ওঠে। প্রতিদিন সে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, চোখ রাখে গেটের দিকে, কিন্তু মেয়েটি আসে না। পঞ্চম দিনে সে একটা সিদ্ধান্ত নেয়। লাইব্রেরির রেজিস্ট্রার থেকে তার নাম ও ঠিকানা খুঁজে বের করে। সন্ধেবেলা সে গিয়ে দাঁড়ায় তিয়াসার ছোট্ট দোতলা বাড়ির সামনে—এক শান্ত অলিগলির মধ্যে। কলিং বেলের আওয়াজে দরজা খোলে এক প্রৌঢ়া—গার্গী সেনগুপ্ত, তিয়াসার মা।
ঈশান ভদ্রভাবে বলে—“আমি ঈশান। তিয়াসার বন্ধু।”
মহিলা কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থাকেন, তারপর বলেন—“তিয়াসা কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব করে না। বিশেষ করে ছেলেদের সঙ্গে তো নয়ই।”
ঈশান মাথা নিচু করে বলে—“আমি তিয়াসার নিঃশব্দ বন্ধু। কথা বলি না, কেবল বুঝি।”
গার্গীদেবীর চোখে একটু নরম ভাব আসে, কিন্তু কণ্ঠে কড়াকড়ি রয়ে যায়।
তিনি বলেন—“তিয়াসা একটু বেশি আবেগপ্রবণ। ওর জগতটা শব্দহীন বলে অনেকে ভাবেন, ওর অনুভব নেই। কিন্তু তুমিও যদি একটা সময় ক্লান্ত হয়ে যাও?”
ঈশান ধীরে ধীরে বলে—“আমি চুপ থেকেও ওকে বলেছি—আমি আছি। ওর স্পর্শের সীমা আমিও বুঝি।”
গার্গীদেবী দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তারপর বলেন—“ও তোমার অপেক্ষা করছে নিজের ঘরে। যাও।”
ঈশান চমকে ওঠে। ভেতরে ঢুকে দেখে, তিয়াসা বিছানায় বসে আছে, হাতে একরাশ কাগজের ছোট ছোট নোট।
তার দিকে তাকিয়ে শুধু একটা নোট এগিয়ে দেয়:
“আমি ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি তো ফিরে এসেছো।”
ঈশান মৃদু হাসে। এবার আর কিছু বলে না। শুধু তার চোখে বলে দেয়—“আমি আছি। যতোটা নীরব, ঠিক ততটাই সত্যি।”
–
গার্গী সেনগুপ্ত এমন একজন মা, যিনি জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে সাহসী থেকেছেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর একাই মেয়েকে মানুষ করেছেন, মেয়ের বোবামি ও সমাজের বাঁকা কথা—দুটো নিয়েই তিনি লড়েছেন প্রতিদিন। কিন্তু বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তার ভিতরের কঠোরতাও যেন জমাট বেঁধেছে। তিনি ভালোবাসেন তিয়াসাকে, কিন্তু সেই ভালোবাসা হয়ে দাঁড়িয়েছে এক রক্ষাকবচ, যা কারও সংস্পর্শে এলেই ভয় পায়। ঈশান যখন প্রথমবার তিয়াসার সঙ্গে দেখা করতে এল, গার্গী দেবীর মনে হয়েছিল—এই ছেলেটাও হয়তো অন্যদের মতো। হয়তো একসময় কৌতূহল মেটালেই চলে যাবে। কিন্তু সে যখন বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ায়, নত দৃষ্টিতে শুধু বলে, “আমি ওর নিঃশব্দ বন্ধু,” তখন গার্গীর মনে হয়, এ ছেলে হয়তো একটু আলাদা।
তিয়াসা, যাকে কোনো বন্ধুর কথা তিনি শোনেননি কখনও, হঠাৎ করে এই ছেলেটিকে ঘরে ডেকে নেয়—এই বদল তিনি বুঝতে পারছিলেন না।
ঈশানের ফিরে যাওয়ার পর রাতে গার্গী চুপচাপ বসে ছিলেন তিয়াসার পাশে। মেয়েটি ডায়েরিতে কিছু লিখে এগিয়ে দেয়—
“তুমি ভয় পাও কেন, মা?”
তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন—“কারণ আমি জানি, সমাজ তোমার জন্য সোজা রাস্তা রাখেনি। যারা ‘স্বাভাবিক’, তারা বুঝতে চায় না আমাদের পৃথিবীটা কেমন।”
তিয়াসা আবার লিখে দেয়—
“সে আমাকে বোঝে। শব্দ ছাড়াই।”
গার্গী বলেন—“আজ বোঝে। কাল যদি না বোঝে?”
এই আশঙ্কাই ছিল তার ভয়। যে ভয় এক মা প্রতিনিয়ত লুকিয়ে রাখে—মেয়েকে ঠকানোর নয়, মেয়ের মন ভাঙার ভয়।
এরপর দিন কয়েক ধরে গার্গী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সবকিছু লক্ষ করলেন। ঈশান ঠিকঠাক আসে কিনা, কথা বলে কিনা, দৃষ্টি কেমন থাকে—সব কিছু। তিনি বুঝলেন, ঈশান ছেলেটি চঞ্চল নয়, তার চোখে তিয়াসার প্রতি সম্মান আছে।
একদিন বিকেলে গার্গী নিজেই তিয়াসাকে বলেন—“ওকে আবার ডেকে আনো। আমি কিছু কথা বলতে চাই।”
ঈশান একটু ভয়ে ভয়ে এল, কারণ সে জানে না কী অপেক্ষা করছে।
গার্গী সোজাসুজি বললেন—“তুমি কি তিয়াসার দায়িত্ব নিতে পারো?”
ঈশান হতবাক। সে বলে—“আমি… আমি জানি না কতটুকু পারব। কিন্তু আমি চেষ্টা করব। আমি ওকে ভালোবাসি।”
গার্গী একনজর তিয়াসার দিকে তাকান। মেয়েটি চুপচাপ দাঁড়িয়ে, কিন্তু চোখের কোণে জল।
“ভালোবাসা শুধু অনুভব নয়, দায়িত্বও,” গার্গী বলেন।
ঈশান মাথা নিচু করে বলেন—“আমি জানি। আমি তিয়াসার নীরবতাকে ভয় পাই না।”
গার্গী এবার আর কিছু বলেন না। শুধু বলেন—“তাহলে আজ থেকে একটিবার করে হলেও সন্ধ্যাবেলা এসো। আমি দেখতে চাই তুমি কতটা সত্যি।”
এই ছিল এক মা’র শর্ত—ভালোবাসার পরীক্ষার শুরু।
সন্ধ্যে আসতে আসতে ঈশান সেই নিয়ম মেনে প্রতিদিন আসে। কখনো তিয়াসাকে বই পড়ে শোনায়, কখনো দু’জনে ছাদে বসে কাগজে আঁকা খেলে, কখনো গার্গীর সঙ্গে চা খায়। গার্গী লক্ষ্য করেন—ঈশান কখনো তিয়াসাকে ছুঁয়ে ফেলার চেষ্টা করে না, কখনো তার বোবামিকে সহানুভূতির ছায়ায় ঢেকে দেয় না। বরং তারা একসঙ্গে হাসে, গল্প করে, চোখে চোখ রেখে কথা বলে।
একদিন গার্গী তিয়াসার সঙ্গে রান্নাঘরে চা বানাতে বানাতে বলেন—“তোমার বাবা থাকলে আজ খুশি হতেন। কিন্তু তার থেকেও বেশি চিন্তা করতেন, যেমন আমি করি।”
তিয়াসা জবাবে কাগজে লেখে—
“তুমি ভয় পাও আমি আবার কষ্ট পাবো?”
গার্গী মাথা নাড়িয়ে বলেন—“হ্যাঁ। কারণ আমি জানি, তুমি অনেকটা পথ একা চলে এসেছো। কিন্তু এখন যাকে পাশে চাইছো, সে যেন মাঝপথে না হারিয়ে যায়।”
তিয়াসা এবার কাগজ ছিঁড়ে লেখে—
“ও হারালে আমি নিজেকে আর খুঁজে পাব না, মা।”
গার্গী আর কিছু বলেন না। শুধু মেয়েটার মাথায় হাত রাখেন।
এই ছিল মা-মেয়ের নিঃশব্দ বোঝাপড়া—যেখানে শব্দ নেই, তবুও দু’জন জানে, তারা একে অপরকে কতটা ভালোবাসে।
–
সন্ধ্যার অন্ধকার ধীরে ধীরে নামছিল কলকাতার মাথায়। বাতাসে হালকা ঠান্ডা, পাড়ার গলিতে হালকা আলো, কিন্তু ঈশানের মনে যেন এক অদৃশ্য ধোঁয়া জমে ছিল। প্রতিদিন তিয়াসার সঙ্গে দেখা, চা খাওয়া, তার চোখের ভাষা পড়া, সেই কাগজে লেখা কথাগুলো, সেই নিঃশব্দ হাসি—সবই এত স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে যেন এটাই ঈশানের জীবন। কিন্তু একটা ভয়, খুব ছোট্ট একটা দানা, অজান্তেই তার মনের ভিতরে গেঁথে গেছে। সে নিজেকেই প্রশ্ন করে—এই পথটা কি সত্যিই সে হাঁটতে পারবে? শব্দ ছাড়া, সংলাপ ছাড়া, সমাজের শোরগোলের মধ্যে এতটা নীরব ভালোবাসা বাঁচিয়ে রাখা কি সম্ভব? ঈশান কখনো এত গভীরে ভাবেনি। কিন্তু গার্গী দেবীর চোখের সেই অভিজ্ঞ দৃষ্টি, প্রতিবেশীদের চাপা কথাবার্তা, বন্ধুদের প্রশ্ন—“তুই ঠিক করছিস তো?”—সবকিছু একসঙ্গে এসে যেন একটানা টোকা মারতে থাকে তার ভাবনায়।
এক সন্ধ্যায় সে আর তিয়াসার বাড়ি যায় না। ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে গড়িয়াহাটের ভিড়ে হাঁটতে হাঁটতে সে নিজেকে অদ্ভুতভাবে একা অনুভব করে। না, তার অভ্যাস ভেঙে যায়নি, কিন্তু সাহসটা যেন একটু পিছিয়ে পড়েছে।
ঈশান একটি পার্কে গিয়ে বসে। গাছের ছায়া, ছেলেমেয়েদের চেঁচামেচি, দূরের ট্রামের ঘণ্টাধ্বনি—সবকিছু চলতে থাকে তার চারপাশে, কিন্তু তার ভেতর থেমে আছে সময়। সে নিজের ডায়েরি খুলে লেখে—
“ভালোবাসা মানে কি সব দায় স্বীকার করা? আমি কি পারব তিয়াসার জীবনের প্রতিটি কঠিন মুহূর্তে তার পাশে দাঁড়াতে?”
তার মাথায় আসে ভবিষ্যতের ছবি—বিয়ে, পরিবার, সমাজ, কাজ, প্রতিবন্ধকতা।
সে আবার লেখে—
“তিয়াসা আমাকে ভালোবাসে নিঃশব্দে। কিন্তু আমি কি তাকে ভালোবাসি ততটা স্পষ্টভাবে? নাকি আমি প্রেমে পড়েছি তার বিশেষত্বে, তার ব্যতিক্রমে?”
সে কাগজ ছিঁড়ে ফেলে। উঠে হাঁটতে শুরু করে।
তার পায়ের নিচে শুকনো পাতা ভাঙে, মাথার ভেতর চলে দরকারি ও অপ্রয়োজনীয় প্রশ্নের খেলা।
সে ভাবে—তিয়াসা যদি কখনো বদলে যায়? যদি একদিন তার অভিমান হয়? যদি ঈশানের ‘স্বাভাবিক’ দুনিয়া তিয়াসাকে দমিয়ে দেয়?
কোনও প্রশ্নের উত্তর নেই তার কাছে।
শুধু আছে এক দমবন্ধ দোলাচল।
পরদিন সকালে সে হঠাৎ লাইব্রেরি যায় না। একটা ছোট্ট ছুটির আবেদন দিয়ে বাড়িতে থাকে। সারাদিন বিছানায় পড়ে থাকে, জানলার বাইরে তাকিয়ে। বিকেলের দিকে তার ফোনে একটা মেসেজ আসে—“তুমি আসোনি। ঠিক আছো?”
মেসেজ পাঠিয়েছেন গার্গী সেনগুপ্ত।
সঙ্গে ছোট্ট একটি ছবি: তিয়াসা খাটে বসে আছে, তার হাতে কাগজের একগুচ্ছ ছোট ছোট পাখি। ঈশান জানে, এই পাখিগুলো তিয়াসা একসঙ্গে বসে ভাঁজ করত—সবসময় বলত, “এগুলো কথা বলে না, উড়ে যায়।”
তার বুকটা টনটন করে ওঠে। সে ভাবে, পালিয়ে গিয়ে কিছুই হয় না। ভালোবাসা পালিয়ে বাঁচে না। বরং মুখোমুখি হতে হয়—নিজেকে, ভয়কে, ভবিষ্যৎকে।
ঈশান খাতা খুলে লেখে—
“ভয় পাই। কিন্তু ভালোবাসি বলেই ভয় পাই। সাহস করব, কারণ আমি তিয়াসাকে শব্দে নয়, অস্তিত্বে ভালোবাসি।”
সে উঠে দাঁড়ায়। ব্যাগে একটা বই রাখে—তিয়াসার প্রিয় কবিতার সংকলন।
তারপর সোজা চলে যায় সেই বাড়িতে, যেখানে প্রতিদিন তার অপেক্ষায় থাকে একটি শব্দহীন পৃথিবী।
গার্গী দরজা খোলেন। চুপ করে তাকিয়ে থাকেন ঈশানের দিকে। ঈশান বলে—“আমি ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু আজ বুঝেছি, ভয় থাকলে ভালোবাসা আরও বেশি সতর্ক হয়।”
তিয়াসা এসে দাঁড়ায় পাশ থেকে। তার চোখে প্রশ্ন—একদিন না এসেই তুমি পালিয়ে যাবে?
ঈশান ব্যাগ থেকে বই বের করে দেয়, সঙ্গে নিজের হাতে লেখা একটা চিঠি—
“আমি তোমার নিঃশব্দ জগতেই থাকতে চাই। আমি শব্দের মানুষ নই, আমি অনুভবের মানুষ। যদি তোমার নীরবতায় জায়গা থাকে, আমি থাকতে চাই চুপ করে, চিরকাল।”
তিয়াসা কিছু বলে না।
শুধু চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে, দু’চোখে মেঘ আর রোদ্দুরের সংমিশ্রণ।
গার্গী জানেন, এই নীরব চোখের সংলাপই সবচেয়ে গাঢ়।
ঈশান ভয় পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ভয় পেয়ে যে আবার ফিরে এসেছে—এই সাহসই হয়তো সত্যিকারের প্রেমের পরিচয়।
–
সন্ধ্যে নেমেছে শহরের গায়ে, কিন্তু লাইব্রেরির ভেতরে আলো এখনো নিঃশব্দে জ্বলছে। বইয়ের স্তূপের ফাঁকে বসে রয়েছে রঘুনাথ কাকা—এই লাইব্রেরির মালিক, বয়স প্রায় পঁচাত্তর, তবু স্মৃতির ভাঁজে এখনও বহু গল্প জমে আছে তার। ঈশান দরজার ঘণ্টা বাজিয়ে ভেতরে ঢোকে, হাতে একটা থলে, তাতে তিয়াসার পছন্দের নতুন বইগুলো। কাকা তাকিয়ে বলেন, “তুই তুই করতে পারিস, বাবা। এত বছর ধরে তোকে দেখছি। আজ তো তোর মুখে একেবারে ‘ভবিষ্যতের ভার’ লেখা আছে।”
ঈশান চুপচাপ হেসে বসে পড়ে। দু’জনে হাতে ধরা চায়ের কাপ। কিছুক্ষণ চুপ থেকে রঘুনাথ কাকা বলেন—
“তুই জানিস, আমি একদিন একজন অন্ধ মেয়েকে ভালোবেসেছিলাম?”
ঈশান চমকে ওঠে, “সত্যি?”
কাকা মাথা নাড়েন।
“তার নাম ছিল নন্দিতা। শান্তিনিকেতনের ছাত্রী ছিল। আমি তখন সদ্য কলেজে, বইয়ের পোকা। একদিন রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইন মুখে মুখে বলতে বলতে দেখলাম, এক মেয়ে ঠান্ডা রোদের ভেতর দাঁড়িয়ে, একা। তার মুখে ছিল বিস্ময়ের ছোঁয়া, আর হাতে ছিল ব্রেইল বই। আমি অবাক হয়ে তার পাশে বসেছিলাম। ধীরে ধীরে কথা বলতে শিখলাম। সেই প্রথম আমি বুঝি—চোখ দিয়ে না দেখে, মন দিয়েও দেখা যায়।”
ঈশান চুপচাপ শুনতে থাকে, এই গল্প যেন তার নিজের বর্তমানের আয়না।
রঘুনাথ কাকার গলা ধীরে ধীরে ভারী হয়ে ওঠে।
“তখন চারপাশে লোকজন বলতে লাগল—‘এ মেয়েটার সঙ্গে কিসের প্রেম? ও তো দৃষ্টিহীন!’ আমার বাবা-মা একদিন স্পষ্ট বলে দিলেন—‘আমরা এই সম্পর্ক মেনে নেব না।’ নন্দিতা আমাকে কিছু বলেনি। শুধু একদিন চলে গেল। চিঠি ফেলে গিয়েছিল—‘তুমি যদি সত্যিই ভালোবাসো, সমাজের সঙ্গে লড়ো। আর না পারো, তবে আমাকে মনে রেখো, ভুলে নয়—ক্ষমা করে।’”
তিনি চোখ মুছলেন।
“আমি পারিনি, রে ঈশান। সেই বয়সে বুকের ভেতরে সাহস ছিল, কিন্তু চারপাশের কণ্ঠস্বরগুলো এত জোরে বাজছিল যে নিজের গলার আওয়াজ হারিয়ে ফেলেছিলাম। আজও ভাবি—যদি একটা মুহূর্তের জন্য সাহস করে দাঁড়াতাম, যদি বলতাম ‘ভালোবাসি’, তাহলে হয়তো সবটা বদলে যেত।”
ঈশান মাথা নিচু করে বসে থাকে।
এই গল্প তাকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দেয়। তার যেন মনে হয়, সে যেন রঘুনাথ কাকার ফেলে যাওয়া সাহস খুঁজে পেয়েছে তিয়াসার চোখে।
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর ঈশান বলে, “তিয়াসা বোবা, কথা বলতে পারে না। কিন্তু আমি তাকে বোঝার চেষ্টা করি, কাগজে, চোখে, ইশারায়।”
রঘুনাথ কাকা তাকিয়ে থাকেন গভীর চোখে, বলেন—“ভালোবাসা বোঝার চেষ্টা করলেই শুরু হয়। কিন্তু তার পরে দরকার হয় দাঁড়িয়ে থাকার সাহস। সমাজ, পরিবার, নিজস্ব ভয়—সবকিছুর সামনে দাঁড়িয়ে বলার সাহস—‘এই মানুষটাকে আমি শুধু অনুভব করিনি, আমি বাঁচতে চাই তার সঙ্গে।’”
ঈশান মাথা নাড়ে। সে এবার নিজেকে আর প্রশ্ন করে না, সে জানে তার ভয় ছিল, আছে, থাকবে—কিন্তু তার ভালোবাসার থেকেও শক্তিশালী নয়।
রঘুনাথ কাকা শেষ চুমুক দিয়ে বলেন—“তুই যদি সত্যি তিয়াসাকে ভালোবাসিস, তবে আমার সেই ভুলটা আর করিস না। তুই দাঁড়া, ঈশান, তার পাশে। যেভাবে সমাজ আজও চুপকথাকে বোঝে না, তুই বোঝা শেখা কর।”
ঈশান উঠে দাঁড়ায়, চোখে অদ্ভুত দৃঢ়তা।
তার পকেটে তখন তিয়াসার লেখা ছোট্ট নোট—
“তুমি যদি পাশে থাকো, আমি শব্দ ছাড়া কথা বলতে শিখব।”
এই কথার ওজন এক জীবনের সমান।
–
ঈশানের হাতে তিয়াসার শেষ নোটটা এসেছিল এক শীতের সকালে, যেখানে শব্দের চেয়ে শ্বাস আর দৃষ্টিই বেশি কথা বলত।
তিয়াসা হঠাৎই কয়েকদিন অনুপস্থিত—না লাইব্রেরিতে, না বাড়িতে। ফোনে উত্তর নেই, গার্গী দেবীও বলেন—“ও একটু সময় চাইছে।”
ঈশান অস্থির হয়ে ওঠে। তার মনে পড়ে, শেষদিন তিয়াসা বলেছিল—“আমি কিছু বলব, তবে কাগজে নয়, একদম সামনে দাঁড়িয়ে।”
কিন্তু তারপর সে অদৃশ্য হয়ে যায়।
তিনদিন পর গার্গী দেবী ঈশানকে ডাকেন। হাতে একটি খাম।
“তিয়াসা বলেছে, এই নোটটা তুই একা পড়ে দেখবি। তারপর যদি তুই সত্যি বুঝিস, তবে ওর পাশে ফিরবি।”
ঈশান থমকে দাঁড়িয়ে খামটা খোলে।
ভেতরে একটিই কাগজ—
“তুমি কি জানো, আমি গান গাই—মনে মনে? আমার কাছে শব্দ না থাকলেও সুর আছে। তুমি যদি শুনতে পারো, তবে জানবে—ভালোবাসা শুধু উচ্চারণ নয়, ভালোবাসা বিশ্বাস।
আমি যাচ্ছি শান্তিনিকেতনে—কিছুদিনের জন্য। আমার আঁকা, আমার সুর, আমার নিজস্বতা খুঁজে আনতে।
তুমি যদি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো, তুমি অপেক্ষা করবে… শব্দ ছাড়াই।
আর যদি আরেকজন হয়ে যাও, আমি তাও তোমাকে ক্ষমা করব।
কিন্তু যদি থেকে যাও—তাহলে আমরা আবার কাগজে লিখব একে অপরের হৃদয়।”
ঈশান অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। তার চোখে জল নয়, তার চোখে সেই সুরের প্রতিধ্বনি, যে সুর সে কখনো শোনেনি—তবুও অনুভব করেছে।
সেই থেকে দিন চলতে থাকে। ঈশান প্রতিদিন তিয়াসার প্রিয় জায়গাগুলোয় যায়—লাইব্রেরির সেই কোণ, দক্ষিণ কলকাতার সেই চায়ের দোকান, স্কুলের সামনে বসে থাকা সেই গাছটা।
সব জায়গায় সে রেখে আসে ছোট ছোট চিরকুট—যেমন
“আমি শুনছি তোমার নিঃশব্দ গান।”
“তুমি ফিরলে আবার শুরু করব ‘চুপকথা’। আরও গভীরভাবে।”
সে নিজের ডায়েরিতে তিয়াসার জন্য লিখতে থাকে কবিতা, গল্প, প্রশ্ন।
তিয়াসা নেই, কিন্তু ঈশান তার উপস্থিতি টের পায়—হাওয়ায়, শব্দহীন চোখে, প্রতিটি বইয়ের পাতায়।
রঘুনাথ কাকা একদিন বলে—“বুঝলি ঈশান, তুই অপেক্ষা করছিস ঠিকই, কিন্তু তুই বদলাচ্ছিসও। তুই শব্দের চেয়ে গভীর ভাষা শিখেছিস।”
ঈশান হাসে।
সে জানে, অপেক্ষা আর ভালোবাসা—দুটোই নিঃশব্দ হলে সবচেয়ে সত্য হয়।
এক মাস পরে, এক বিকেলে ঈশান লাইব্রেরিতে বসে। তার সামনে একটি খোলা বই—সেখানে একটি ছোট নোট পড়ে আছে।
তিয়াসার হাতের লেখা—
“আমার গলা এখনো বোলে না, কিন্তু আমার ভালোবাসা চিৎকার করে বলতে চায়—‘আমি ফিরে এসেছি।’”
ঈশান উঠে দাঁড়ায়।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তিয়াসা, শান্ত চোখে, হাতের ব্যাগে কাগজপত্র ভর্তি।
তারা দু’জন কোনো কথা বলে না।
তিয়াসা এগিয়ে এসে ঈশানের হাত ছুঁয়ে ধরে—প্রথমবার।
এই স্পর্শে কোনো ভীতি নেই, নেই কোনো বাধা—শুধু এক গভীর, অকপট ভালোবাসা।
তারা বসে, আবার নতুন এক কাগজ বের করে—
তাতে লেখা:
“আজ থেকে আমাদের চুপকথা আর কাগজে নয়, জীবনে লেখা হবে।”
বাহিরে সূর্য ডুবছে, কিন্তু তাদের মাঝে জেগে উঠছে এক নীরব আলোর উন্মেষ।
–
বছর ঘুরেছে। সময়ের ক্যালেন্ডারে নতুন তারিখ, কিন্তু কিছু অনুভূতি এখনও ঠিক সেই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে—যেখানে ঈশান একদিন তিয়াসার চোখে চুপচাপ ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছিল। এখন তারা একসঙ্গে থাকে—একটা ছোট্ট ভাড়া ফ্ল্যাটে, দক্ষিণ কলকাতার এক পুরনো বাড়ির তলায়। বাড়ির জানালার পাশে রাখা আছে একটা ছোট ডেস্ক—যেখানে এখনও তিয়াসার হাতের লেখা কাগজ জমা হয়, ঈশানের কবিতা, আর মাঝেমধ্যে দু’জনের আঁকা স্কেচ।
তিয়াসা এখনও বোবা—তবু তাদের সংসারে কোনো নিঃশব্দতা নেই। কথা হয় সকালে চোখ মেলেই, ঈশানের প্রথম চায়ের চুমুকে, তিয়াসার নোটে আঁকা সূর্যরেখায়। কথা হয় রাতে, একে অপরের কাঁধে মাথা রেখে নিঃশব্দ হাসিতে।
তিয়াসা এখন শান্তিনিকেতনে একটা ছোট্ট আর্ট ক্লাস নেয়—বিশেষভাবে সক্ষম ছেলেমেয়েদের জন্য। ওদের শেখায়—“তোমরা যদি বলতে না পারো, ভাবতে তো পারো! আর ভাবনাকেও ছবি বানানো যায়।”
ঈশান একটি ছোট প্রকাশনা শুরু করেছে—নাম দিয়েছে “চুপকথা”। সেখানে ছাপা হয় তিয়াসার আঁকা ও লেখা, আর সমাজের অন্য সব মানুষের গল্প, যারা শব্দ ছাড়া ভাবতে শেখে।
তাদের ভালোবাসা আজ সমাজের চোখে হয়তো এখনও অদ্ভুত, কিন্তু তাদের দুজনের কাছে এটাই সবচেয়ে ‘স্বাভাবিক’। কারণ ভালোবাসা কি কখনো শব্দে মাপা যায়?
এক সন্ধ্যায় তারা দুজনে ছাদে বসে। মাথার ওপর খোলা আকাশ, আর নিচে ভেসে চলেছে শহরের গাঢ় আলোর মিছিল।
তিয়াসা খাতা খুলে লিখে—
“তুমি কি জানো, আমার স্বপ্নে শব্দ থাকে না?”
ঈশান জবাবে বলে—“আমার স্বপ্নে তোমার চোখ থাকে।”
তিয়াসা আবার লেখে—
“আমরা কি একদিন একটা শিশু দত্তক নেবো, যার কোনো ভাষা নেই?”
ঈশান থমকে যায়। তারপর হাসে।
“আমরা তাকে ভাষা দেবো না। আমরা তাকে বোঝা শেখাবো। কারণ বুঝতে পারা, বলার থেকেও বড়।”
তিয়াসা এবার আর কিছু লেখে না। শুধু ঈশানের হাত চেপে ধরে।
ওই এক চুপকথা—যার অর্থ অভিধানে নেই, কিন্তু হৃদয়ে আছে।
গল্পের শেষ নেই, শুধু বাঁক আছে।
তাদের জীবন চলতে থাকে সেই ভাষাহীন পথে—যেখানে কাগজের নোটের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে একে অপরের উপস্থিতি।
তারা আর কাগজে কথা লেখে না, এখন তারা চোখে চোখ রেখে সব বলে দেয়।
তিয়াসা একদিন লিখে রেখেছিল—
“ভালোবাসা মানে শুধু পাশে থাকা নয়। ভালোবাসা মানে আমার নিঃশব্দতাকে স্বীকার করে নেওয়া।”
ঈশান বলেছিল—
“তুমি চুপ থেকেও যা বলো, তা অনেক শব্দে বলা যায় না।”
এভাবেই তারা গড়ে তোলে এক ভালোবাসার ঘর—যেখানে কথা নেই, কিন্তু বোঝাপড়া আছে। সেই বোঝাপড়ার নামই—অকথিত প্রেম।
—
সমাপ্ত