Bangla - তন্ত্র

শবনৃত্য

Spread the love

ঋত্বিক বসু


পর্ব

শ্মশানের ধোঁয়া যেমন ধীরে ধীরে রাতের বাতাসে মিলিয়ে যায়, তেমনই গোপালচন্দ্রর জীবনও এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় মিশে গেছে। সে এই শ্মশানকর্তার কাজ করছে প্রায় পনেরো বছর। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত—কখনও কফিনে ঢাকা শরীর, কখনও শবযাত্রার সানাই, আবার কখনও হাহাকার করা আত্মীয়দের চোখের জলে ভিজে যাওয়া কাঠের চৌকি। তার কাছে সব যেন একই রকম। শ্মশান মানেই মৃত্যু, মৃত্যু মানেই চুপচাপ এক ছায়ার দিকে মিলিয়ে যাওয়া।

কিন্তু সে রাতে কিছু যেন অন্যরকম ছিল। আগুন নিভে এসেছে, শেষ কাঠটুকু ছাইয়ে পরিণত হয়েছে। গোপালচন্দ্র বাঁশের ঝুড়ি হাতে গঙ্গার জলে ভিজিয়ে ছাই ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। চারদিক নির্জন, কেবল রাতের পেঁচার ডাক আর দূরে কুকুরের হুক্কাহুয়া। হঠাৎ তার কানে এল এক অদ্ভুত তাল—যেন কারও পায়ের শব্দ, আবার যেন কোনো অদৃশ্য ঢাক বেজে চলেছে।

সে থেমে গেল। চোখ তুলে দেখল—শ্মশানের উত্তর কোণের পাকা ঘাটে সদ্য আনা মৃতদেহগুলোর মধ্যে একটা নড়ে উঠেছে। গোপালচন্দ্র প্রথমে ভেবেছিল আলো-আঁধারির খেলা। কিন্তু তারপর আরও দু’টি, তিনটি… একে একে তারা উঠে দাঁড়াল। মুখে শবের ফ্যাকাশে শূন্যতা, চোখে কোনো আলো নেই, অথচ তাদের হাত-পা যেন তাল মেনে চলতে শুরু করেছে।

গোপালচন্দ্রর বুকের ভেতর ধক করে উঠল। ঘামে ভিজে গেল কপাল। সে চোখ চেপে ধরল দু’হাতে—ভাবল, এই নিঃসঙ্গতার মধ্যে তার মস্তিষ্কই বুঝি তাকে ধোঁকা দিচ্ছে। প্রতিদিন মৃতদেহের সঙ্গে থাকার ফলেই এই ভ্রম। কিন্তু যখন আবার তাকাল, তখন দেখল সেই নৃত্য আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। মৃতরা একে অপরের হাত ধরেছে, বৃত্ত তৈরি করেছে, আর শূন্যে ঘুরছে ধীরে ধীরে।

গোপালচন্দ্রর মনে পড়ল তার ঠাকুমার বলা গল্প। ঠাকুমা বলতেন, অনেক যুগ আগে এই শ্মশানভূমিতে এক তান্ত্রিক সাধক বাস করতেন। তিনি মৃত্যুকে জয় করার জন্য এক নিষিদ্ধ মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন। বলা হয়, সেই মন্ত্রের তালে মৃতরা নৃত্যে জেগে উঠত, যতক্ষণ না আকাশের প্রথম আলো ফেটে আসে। ঠাকুমার কথা গোপালচন্দ্র তখন ছেলেমানুষি গল্প বলে উড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আজ… আজ তার সামনে সেই গল্প যেন মাংস-মজ্জায় দাঁড়িয়ে আছে।

সে দৌড়ে পালাতে চাইল, কিন্তু পা যেন মাটিতে গেঁথে গেল। ভয়ের চেয়ে বড় হল বিস্ময়। চোখ ফেরাতে পারল না। মৃতদের শরীর ভেঙে পড়ছে, আবার উঠছে, তাদের মুখে অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠছে। আর গোপালচন্দ্র বুঝল—এই শবনৃত্যের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে সে নিজেই।

কেন? কেন তাকে ঘিরেই শুরু হয়েছে এই ভয়াল নৃত্য? সে কি কেবলই দর্শক, নাকি এই অশুভ মন্ত্রের পুনর্জন্ম তার মাধ্যমেই ঘটছে?

গোপালচন্দ্রর বুক কেঁপে উঠল। দূরে আকাশে মেঘ জমছে, বিদ্যুতের আলোয় ক্ষণিকের জন্য স্পষ্ট হল মৃতদের বৃত্তাকার ভঙ্গি—যেন এক প্রাচীন যজ্ঞমণ্ডল পুনরায় অঙ্কিত হচ্ছে শ্মশানের মাটিতে।

সে বুঝল, এ শুধু ভ্রম নয়। এ এক নিষিদ্ধ সত্যের পুনর্জাগরণ। আর তার নিজের জীবনও হয়তো এই নৃত্যের সঙ্গে বাঁধা পড়ে গেছে অদৃশ্য সূত্রে।

পর্ব

গোপালচন্দ্র সারা রাত দাঁড়িয়ে রইল শ্মশানের ঘাটে। তার সামনে মৃতদের ভৌতিক নৃত্য চলতে থাকল নিরবচ্ছিন্ন তালে। মেঘে ঢাকা আকাশে কখনও বিদ্যুতের ঝলকানি, কখনও ঝিঁঝিঁর একঘেয়ে ডাক—সব মিলিয়ে যেন রাতটা হয়ে উঠল এক অদ্ভুত যজ্ঞ। গোপালচন্দ্রর বুকের ভেতর তীব্র ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে এক অচেনা টান তৈরি হচ্ছিল, যেন এই দৃশ্য তার দেখা উচিত, তার চোখের সামনেই ঘটতে হবে সব।

ভোরের আলো ফুটতেই মৃতরা ধীরে ধীরে থেমে গেল। তাদের শরীর আবার নিথর হয়ে পড়ল সেই জায়গাতেই যেখানে আগে রাখা হয়েছিল। যেন কিছুই ঘটেনি। শ্মশানের চারদিক আবার আগের মতোই নীরব হয়ে উঠল। কেবল গোপালচন্দ্রর বুকের ভেতর ঝড় বইতে লাগল।

সকালে বাড়ি ফিরে স্ত্রী শিবানীর কাছে কিছুই বলতে পারল না। জানলে সে হয়তো পাগল ভেবে বসবে। কিন্তু সারাদিন গোপালচন্দ্রর মাথার ভেতর ঠাকুমার সেই গল্প ঘুরতে লাগল—“শ্মশানমন্ত্র জেগে উঠলে মৃতেরা দাঁড়িয়ে নাচে, আর সেই নাচ থামানো যায় কেবল তখনই যখন কেন্দ্রভূমির রক্ত উৎসর্গ করা হয়।”

“কেন্দ্রভূমি” কথাটার মানে কী? আর কেন মনে হচ্ছে সেই কেন্দ্রটা সে নিজেই?

সন্ধের পর শ্মশানে ফেরার সময় বুক কেঁপে উঠছিল। কিন্তু দায়িত্ব তো এড়ানো যায় না। দাহসামগ্রী গুছিয়ে, অগ্নিকুণ্ড সাজিয়ে গোপালচন্দ্র রাত নামার অপেক্ষা করতে লাগল। মনে মনে শপথ করল—আজ প্রমাণ করবে আগের রাতের সবই ভ্রম।

কিন্তু রাত ঘনিয়ে আসতেই আবার শুরু হল সেই অদ্ভুত তাল। বাতাসে কেমন এক গুঞ্জন, যেন বহু দূরের ঢাক বাজছে। গোপালচন্দ্রের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। হঠাৎই দেখল—আজও মৃতরা একে একে উঠে দাঁড়াচ্ছে। আবার শুরু হল বৃত্তাকার নৃত্য।

কিন্তু আজকের রাতটা আগের চেয়ে ভিন্ন। কারণ এবার মৃতদের চোখ জ্বলজ্বল করছে এক অদ্ভুত আলোয়। আর তাদের বৃত্ত ভেঙে এক দিকেই তাকিয়ে আছে—গোপালচন্দ্রর দিকে।

সে হোঁচট খেয়ে পেছাতে লাগল। বুকের ভেতর দম আটকে আসছে। কিন্তু তখনই কানে এল ফিসফিসে স্বর—
“তুই আমাদের রক্ষক… তোর মধ্য দিয়েই মন্ত্র আবার জেগে উঠেছে…”

গোপালচন্দ্র চমকে উঠল। কেউ কি তার সঙ্গে কথা বলল? নাকি হাওয়ার শব্দে কানে এমন লাগছে? কিন্তু সেই স্বর বারবার আসছে, চারদিক থেকে ভেসে আসছে, যেন মৃতরাই মুখ নাড়ছে।

হঠাৎই সে টের পেল, তার কপালে অদ্ভুত তাপ জমছে। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখল—কপালে যেন কেউ অগ্নিচিহ্ন এঁকে দিয়েছে। চমকে উঠল সে। এতদিনে কি বুঝল—এই নৃত্যের কেন্দ্র আসলে তার শরীর, তার রক্ত, তার শ্বাস-প্রশ্বাস?

মৃতদের বৃত্ত ঘুরতে ঘুরতে এবার কাছে চলে এল। গোপালচন্দ্রর বুকের ভেতর কাঁপুনি চলছিল, কিন্তু চোখ সরাতে পারল না। মৃতদের ঠোঁট ফাঁক হয়ে যেন একসঙ্গে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু হল—অচেনা ভাষা, অদ্ভুত ছন্দে। গোপালচন্দ্র বুঝল না, কিন্তু তার মাথার ভেতর অনুবাদ হয়ে বেজে উঠল—
“তুই ছাড়া আমরা মুক্তি পাব না।”

সে আর স্থির থাকতে পারল না। চিৎকার করে ছুটে পালাল শ্মশান থেকে। ছুটতে ছুটতে মনে হচ্ছিল, মৃতদের পায়ের শব্দ যেন পিছু নিচ্ছে, অদৃশ্য ছায়ারা তার পেছনে ধাওয়া করছে।

বাড়ি ফিরে দরজা বন্ধ করেই হাঁপাতে লাগল। কিন্তু কপালের অগ্নিচিহ্ন এখনো জ্বলছে। আয়নায় তাকিয়ে দেখল—স্পষ্ট লালচে দাগ, যেন ত্রিকোণ আকৃতি।

সে বুঝল—এখন আর কেবল ভ্রম নয়। শবনৃত্যের রহস্য তার শরীরেই বদ্ধ। আর এর উত্তর লুকিয়ে আছে সেই তান্ত্রিক মন্ত্রে, যার ছায়া আবার জেগে উঠেছে।

পর্ব

সারারাত ঘুম ভাঙা চোখে বসে রইল গোপালচন্দ্র। কপালের ত্রিকোণ দাগ আয়নায় তাকালেই যেন আরও গাঢ় হয়ে উঠছিল। শিবানী একবার জিজ্ঞেস করেছিল, মাথায় কী হয়েছে, কেন দগদগে লালচে চিহ্ন ফুটে উঠেছে। গোপালচন্দ্র এড়িয়ে গেছে—বলে দিয়েছে চুলার ধোঁয়া বা আগুনে হয়তো লেগেছে। কিন্তু ভেতরে সে জানে, এর সঙ্গে আগুনের কোনো সম্পর্ক নেই।

ভোর হতে না হতেই সে ছুটল কাছের পাকা রাস্তার ধারে পুরনো গ্রন্থাগারের দিকে। ছোট্ট একতলা ভগ্নদশা ভবন, যেটা একসময় জমিদারবাড়ির অংশ ছিল। এখন কেবল গুটিকতক লোক এখানে আসে। কিন্তু গোপালচন্দ্র জানে—এখানেই হয়তো পাওয়া যাবে তার ঠাকুমার গল্পে শোনা সেই তান্ত্রিক সাধকের উল্লেখ।

ঘণ্টাখানেক খোঁজাখুঁজির পর এক মোটা ধুলো পড়া পুঁথি তার হাতে এল—মৃত্যু-সিদ্ধান্ত তন্ত্র”। তালপাতার পাতায় কালি ফিকে হয়ে গেছে, কিন্তু অক্ষরগুলো এখনও ঝকঝকে। গোপালচন্দ্রর বুক কেঁপে উঠল। বইয়ের প্রথমেই লেখা—“যখন মৃত্যুকে জাগ্রত নৃত্যে ডাকা হয়, তখন জীবিত ও মৃতের সীমানা মুছে যায়। কেন্দ্রভূমির ধারকই তখন দ্বাররক্ষক হয়ে ওঠে।”

“কেন্দ্রভূমির ধারক”—এটা কি সে-ই?

পাতা উল্টাতেই পেল একটি চিত্র। ত্রিকোণ চিহ্ন, যার মাঝে রক্তবিন্দুর প্রতীক আঁকা। হুবহু সেই দাগের মতো, যা এখন তার কপালে ফুটে উঠেছে। বুক ধক করে উঠল। এই দাগ মানে সে-ই এখন সেই মন্ত্রের বাহক।

হঠাৎ তার কানে এল ফিসফিসে শব্দ। আশেপাশে কেউ নেই, তবুও শব্দ আসছে।
“তুই বুঝতে শুরু করেছিস… তোর রক্ত ছাড়া আমরা সম্পূর্ণ হব না।”

গোপালচন্দ্র বই বন্ধ করে চোখ বুজল। মাথার ভেতর ঝড় উঠছে। সে যদি দ্বাররক্ষক হয়, তাহলে মৃতদের মুক্তি বা বাঁধন তার উপর নির্ভর করছে। কিন্তু কোন দিকে যাবে সে? এই নাচ কি কেবল মুক্তির, নাকি এর আড়ালে আরও ভয়ঙ্কর কোনো উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে?

বিকেলে সে গেল গ্রামের পুরনো পুরোহিত হরিহর ঝার কাছে। বয়স আশির কোঠায়, শ্মশানের পাশেই ভগ্নপ্রায় কুঁড়ে ঘরে থাকেন। গোপালচন্দ্রকে দেখে তিনি মলিন চোখ মেলে তাকালেন।
“তুই দেরি করে ফেলেছিস, বাছা,” হরিহর ঝা ফিসফিস করে বললেন।
“আপনি জানেন?” বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল গোপালচন্দ্র।
“এই নাচ আমি একবার দেখেছি, যখন আমি ছোট। আমার ঠাকুরদা বলেছিলেন, প্রতি একশো বছরে একবার মন্ত্র জেগে ওঠে। তখন শ্মশানের রক্ষক চিহ্নিত হয়। এড়িয়ে যাওয়া যায় না।”

গোপালচন্দ্রর শরীর কেঁপে উঠল। “তাহলে আমি কী করব?”
পুরোহিত শুষ্ক গলায় বললেন—“মন্ত্র থামাতে হলে তোর রক্তকে উৎসর্গ করতে হবে। নাহলে নাচ ছড়িয়ে পড়বে পুরো গ্রামে। জীবিতরা তখন মৃতের দলে মিশে যাবে।”

গোপালচন্দ্র স্তব্ধ হয়ে গেল। সে কি আত্মবলিদান দেবে? না কি অন্য কোনো উপায় আছে?

আকাশে আবার মেঘ জমতে শুরু করেছে। সন্ধ্যা নামছে ধীরে ধীরে। তার বুকের ভেতর কাঁপুনি চলছে। আজ রাতেই আবার উঠবে শবনৃত্য। আর হয়তো আজকের নাচে গ্রামের সীমারেখা পেরিয়ে যাবে সেই তন্ত্রের অগ্নিচিহ্ন।

গোপালচন্দ্র জানে, আর সময় নেই। তাকে সিদ্ধান্ত নিতেই হবে—সে কি নিজের রক্ত উৎসর্গ করবে, নাকি কোনো গোপন পথ খুঁজে বের করবে, যা এই নৃত্যকে চিরতরে শেষ করতে পারে?

পর্ব

সন্ধ্যা নামতেই গোপালচন্দ্রর বুকের ভেতর এক অদ্ভুত শিহরণ উঠল। আকাশ ঘন মেঘে ঢেকে গেছে, বিদ্যুতের আলো ছড়িয়ে পড়ছে শ্মশানের ওপর। বাতাসে কেমন এক ভেজা গন্ধ, যেন শতবর্ষের পুরোনো ছাই আজও জীবন্ত হয়ে আছে।

হরিহর ঝার সতর্ক বাণী বারবার কানে বাজছে—“তোর রক্ত ছাড়া থামবে না নৃত্য।” কিন্তু গোপালচন্দ্র মনস্থির করতে পারছে না। সত্যিই কি আত্মবলিদান ছাড়া আর কোনো পথ নেই?

তবু পা আপনাআপনিই তাকে শ্মশানের দিকে টেনে নিয়ে গেল। আগুনের কুণ্ড নিভে অন্ধকারে ডুবে আছে। আর ঠিক তখনই শুরু হল সেই পরিচিত তাল—ঢাকের মতো, অথচ অদৃশ্য। গোপালচন্দ্রর বুক ধড়ফড় করতে লাগল।

হঠাৎই চারদিক থেকে মৃতদেহেরা উঠে দাঁড়াতে লাগল। তাদের মুখ নিথর, চোখে আগুনের মতো ঝিলিক। বৃত্তাকার হয়ে তারা হাত ধরে নাচতে শুরু করল। মাটিতে ছাই উড়ল, বাতাসে অদ্ভুত শীতলতা নেমে এল।

কিন্তু আজকের রাত অন্যরকম। আজ নৃত্যের বৃত্ত ক্রমে প্রসারিত হতে লাগল—শ্মশান ছাড়িয়ে যেন গ্রামমুখী। মৃতদের পায়ের শব্দ যেন ভূমিকম্পের মতো ধ্বনিত হতে লাগল।

গোপালচন্দ্র দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। বুকের ভেতর অগ্নিচিহ্নের জায়গাটা জ্বলতে লাগল তীব্র তাপে। সে হাঁটুতে হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল। আর তখনই সেই স্বর ফিরে এল—
“তুই ছাড়া আমরা মুক্ত নই। তোর রক্ত দে, নয়তো এই নৃত্য গ্রাস করবে জীবিতদের।”

গোপালচন্দ্র চিৎকার করে উঠল, “কেন আমি? কেন আমাকেই বেছে নেওয়া হল?”
উত্তর এল ফিসফিসে স্বরে, মৃতদের ঠোঁট নড়ল একসঙ্গে—
“কারণ তুইই রক্ষক। তোর রক্তেই আছে দ্বার বন্ধের শক্তি।”

তার হাতে ঝুড়ির বাঁশ ভেঙে ধারালো হয়ে উঠেছিল। সে তাকাল কপালের ত্রিকোণ দাগের দিকে। সত্যিই কি নিজের রক্ত ঢাললেই থেমে যাবে সব? নাকি এ ফাঁদ?

হঠাৎ গোপালচন্দ্রর চোখে পড়ল, মৃতদের বৃত্তের কেন্দ্রে শূন্যতা তৈরি হয়েছে। সেই শূন্যতা জ্বলজ্বল করছে অগ্নিস্রোতের মতো। আর তার কপালের চিহ্ন যেন টানছে সেই কেন্দ্রে।

সে দাঁড়িয়ে পড়ল। পা টলছিল, তবু এগোল। ভেতরে ভেতরে তার মনে হল—যদি সে আজ থামাতে না পারে, তবে আগামী ভোরে এই গ্রামে জীবিত আর মৃতের ফারাক থাকবে না।

কেন্দ্রের কাছে পৌঁছাতেই গোপালচন্দ্র অনুভব করল, মাটির ভেতর থেকে হাত বেরিয়ে আসছে। কালো, শুকনো হাত—যেন তাকে টেনে নিচ্ছে। তার বুকের ভেতর সাহস আর ভয় একসঙ্গে লড়াই করছিল।

সে বাঁশের ধারালো অংশ দিয়ে নিজের তালুর ওপর কেটে দিল ছোট্ট এক দাগ। লালচে রক্ত ঝরতেই মৃতদের নাচ আরও তীব্র হয়ে উঠল। বৃত্ত ঘুরতে ঘুরতে ভেতরে ধাক্কা মারল। আর হঠাৎই সেই রক্ত ফোঁটা কেন্দ্রে পড়তেই এক প্রচণ্ড আলো ছড়িয়ে পড়ল।

চোখ ঝলসে গেল গোপালচন্দ্রর। কান বন্ধ হয়ে এল এক অদ্ভুত শব্দে, যেন হাজার মৃত একসঙ্গে হাহাকার করছে।

সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল শ্মশানের মাটিতে।

পর্ব

অন্ধকার ভেদ করে যখন চোখ খুলল গোপালচন্দ্র, তখন ভোরের আলো আকাশে মিশে যাচ্ছে। শ্মশানের চারপাশে সোনালি কুয়াশা, কাকের ডাক, আর বাতাসে অদ্ভুত শীতলতা। সে অনুভব করল তার তালুতে কাটা দাগ এখনও ভিজে আছে রক্তে। কিন্তু আশ্চর্য—তার চারপাশে কোনো মৃতদেহ নেই। না কফিন, না চৌকি, না ছাই। যেন শ্মশান রাতারাতি শূন্য হয়ে গেছে।

গোপালচন্দ্র উঠে দাঁড়াল। শরীর দুর্বল, মাথা ঘোরাচ্ছে। কপালের ত্রিকোণ দাগ এখন কালো হয়ে নিস্তেজ, তবু জ্বলজ্বল করছে এক অদ্ভুত আভায়। সে হাঁটতে হাঁটতে নদীর ঘাটের দিকে গেল। কিন্তু নদীও যেন আজ অন্যরকম—জল স্থির, আয়নার মতো, কোনো ঢেউ নেই।

পানির ধারে দাঁড়িয়ে হঠাৎ সে শুনল সেই পরিচিত ফিসফিসে স্বর।
“তুই রক্ত দিয়েছে… দ্বার খুলে গেছে।”

গোপালচন্দ্রর বুক কেঁপে উঠল। “দ্বার খুলেছে মানে?”
স্বরটি যেন নদীর ভেতর থেকে উঠল—“শতবর্ষের বাঁধন কেটে গেছে। এখন নৃত্য আর শ্মশানেই থামবে না।”

মুহূর্তে তার চোখে ভেসে উঠল রাতের দৃশ্য। মৃতদের সেই ভৌতিক নৃত্য শ্মশান ছাড়িয়ে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে—ঘরবাড়ির ভেতর, মাঠের ওপর, গলির কোণে। জীবিতরা আতঙ্কে পালাচ্ছে, আর মৃতরা বৃত্ত তৈরি করে তাদের টেনে নিচ্ছে।

গোপালচন্দ্র হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। বুকের ভেতর কাঁপুনি—সে কি ভুল করেছে? হরিহর ঝার কথায় বিশ্বাস করে রক্ত উৎসর্গ করল, অথচ এতে কি বাঁধন কেটে গেল, উল্টে শক্তি আরও ছড়িয়ে পড়ল?

পেছন থেকে এক কর্কশ কণ্ঠ ভেসে এল। “তুই ভাবছিস, রক্ষক হবার মানে আত্মবলিদান? না, গোপাল। রক্ষক মানে সেতু—তোর রক্তে মৃতদের নৃত্য আরেক জন্ম পেল।”

গোপাল ঘুরে তাকাল। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে হরিহর ঝা। কিন্তু সে আগের মতো ক্ষীণকায় নয়, চোখে অদ্ভুত লাল আভা। ঠোঁটে হিংস্র হাসি।
“আমি বহু বছর অপেক্ষা করেছি। আমার ঠাকুরদাও ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু এবার তুই সফল করলি। তুই দ্বার খুলে দিয়েছিস।”

গোপাল স্তব্ধ। “আপনি… তাহলে…?”
হরিহর এগিয়ে এল ধীরে ধীরে। “আমি ওই সাধকের বংশধর। মন্ত্র পুনর্জাগরণের জন্যই আমি বেঁচে আছি। তুই ছিলি আমার প্রয়োজনীয় বাহক। তোর রক্তে মন্ত্র আবার সম্পূর্ণ হল।”

গোপালচন্দ্রর শরীর ঘেমে উঠল। সে বুঝল—তার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। রক্ত উৎসর্গ মানে ছিল না মুক্তি, বরং এক নতুন শাপ।

হঠাৎই চারদিক থেকে আবার পায়ের শব্দ উঠল। মৃতরা ফিরে আসছে, চোখে জ্বলন্ত আলো। এবার তারা শুধু নাচছে না—হাসছে। দাঁত বের করা সেই অমানবিক হাসি কেটে যাচ্ছে ভোরের বাতাস।

গোপালচন্দ্র কপাল চেপে ধরে চিৎকার করে উঠল। আকাশ যেন তার চিৎকারে ভেঙে পড়ল। পাখির ঝাঁক উড়ে গেল দূরে, আর নদীর স্থির জলে ঢেউ উঠল তীব্রভাবে।

সে বুঝল, নৃত্যের শেষ নেই। কারণ দ্বার এখন পুরোপুরি খোলা। আর তাকে কেন্দ্র করেই গ্রাস করতে শুরু করেছে জীবিতদের জগৎ।

পর্ব

গোপালচন্দ্রর বুকের ভেতর দম বন্ধ হয়ে আসছিল। শ্মশানের নীরবতা ভেঙে মৃতদের হাহাকার আর হাসি মিশে এক অদ্ভুত সুরে বাজছিল। হরিহর ঝা দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে, চোখে আগুনের মতো লালচে আভা। কপালের দাগ আরও জ্বলতে লাগল, যেন মন্ত্রের তালে তার শরীরকে বেঁধে ফেলছে।

“তুই থামাতে পারবি না, গোপাল,” হরিহর ঝা শ্বাস ফেলল। “দ্বার খোলা হয়েছে, এখন এই নৃত্য ছড়িয়ে পড়বে প্রতিটি ঘরে, প্রতিটি রক্তনালীতে। জীবিত আর মৃতের মধ্যে কোনো ফারাক থাকবে না।”

গোপাল কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু কেন? এর মানে কী?”
হরিহর ঝা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, “মানুষ মৃত্যুকে ভয় পায়। আমরা চাই সেই ভয় শেষ হোক। আমরা চাই—মৃত্যু আর জীবনের মিলন। তোর রক্ত সেই সেতু তৈরি করেছে।”

মাটির ভেতর থেকে হাড়গোড়ের কঙ্কাল উঠে আসতে লাগল, বৃত্তের চারপাশে নাচতে লাগল। হাওয়া ভারী হয়ে উঠল, পচা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। গোপালচন্দ্র চোখ বন্ধ করতেই কানে এল অসংখ্য স্বর—কেউ কাঁদছে, কেউ হাসছে, কেউ মন্ত্র পড়ছে।

কিন্তু সেই কোলাহলের মাঝেই এক কোমল স্বর ভেসে এল—মায়ের মতো।
“গোপাল… মনে আছে, আমি বলতাম মৃত্যু শূন্য নয়, মৃত্যু পূর্ণতা। ভয় কোরো না।”

চমকে উঠল সে। ঠাকুমার কণ্ঠ! সেই গল্প বলা ঠাকুমার কথা মনে পড়ল, যে বলেছিল শ্মশানমন্ত্র কেবল ধ্বংস নয়, মুক্তির পথও। গোপালচন্দ্রর বুকের ভেতর সাহসের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠল।

সে হাঁটু গেড়ে মাটিতে হাত রাখল। কপালের দাগ তীব্র আলো ছড়াল, আর পুঁথিতে পড়া মন্ত্র মনে পড়ল—
যদি কেন্দ্রভূমি নিজেকে আত্মার সঙ্গে মিলিয়ে দেয়, তবে নৃত্য থেমে যায়, দ্বার আবার বন্ধ হয়।”

অর্থাৎ আত্মবলিদানই একমাত্র উপায়। কিন্তু রক্ত নয়—পুরো জীবন।

হরিহর ঝা চিৎকার করে উঠল, “না! থামিস না!”
কিন্তু গোপালচন্দ্র দাঁড়িয়ে পড়ল, চোখ বন্ধ করল, আর কপাল থেকে আলো শূন্য বৃত্তে ছড়িয়ে দিল। শরীরের সমস্ত শক্তি যেন বেরিয়ে যেতে লাগল। হাত-পা শীতল হয়ে উঠল, বুকের শ্বাস থেমে আসছে।

মৃতরা হাহাকার করে উঠল। নাচ থেমে গেল। এক ঝলক আলো আকাশে ফেটে বেরোল, আর নদীর স্থির জলে বিশাল ঢেউ উঠল। হরিহর ঝার শরীর কেঁপে ভেঙে পড়ল মাটিতে।

গোপালচন্দ্র বুঝল, সে আর বাঁচবে না। কিন্তু তার আত্মা যেন অদ্ভুত শান্তিতে ভরে উঠল। চোখ বুজে যাওয়ার আগে সে দেখল—মৃতরা একে একে মাটিতে শুয়ে পড়ছে, নিস্তব্ধতায় মিশে যাচ্ছে।

ভোরের সূর্য উঠল। শ্মশানের ওপর সোনালি আলো ছড়িয়ে পড়ল। পাখিরা ডেকে উঠল। আর গোপালচন্দ্র পড়ে রইল নিথর, ঠোঁটে এক শান্ত হাসি।

তার আত্মা হয়তো শ্মশানেই মিশে গেল—রক্ষক হয়ে।
আর নৃত্য থেমে গেল অন্তত আরও একশো বছরের জন্য।

পর্ব

ভোর গড়িয়ে সূর্য যখন আকাশে উঠল, তখন গ্রাম থেকে কয়েকজন শ্মশানের দিকে এল। রাতের পর থেকে সবাই আতঙ্কে ছিল—কুকুররা হুক্কাহুয়া ডাকছিল, বাতাসে পচা গন্ধ ভেসেছিল, ঘরের ভেতর মানুষজন ঘুম ভাঙার মতো ভয়ে কেঁপে উঠেছিল। তারা ভেবেছিল, হয়তো শ্মশানে কোনো অঘটন ঘটেছে।

ঘাটে এসে তারা দেখল—সব শান্ত। আগুন নিভে আছে, কেবল ছাই ছড়িয়ে আছে চারদিকে। আর মাটির ওপর শুয়ে আছে গোপালচন্দ্রর নিথর দেহ। চোখ বন্ধ, ঠোঁটে এক অদ্ভুত শান্ত হাসি, যেন বহু ক্লান্তির পর অবশেষে বিশ্রাম পেয়েছে।

শিবানী ছুটে এল। স্বামীর মুখে হাত রাখতেই আঁতকে উঠল—দেহ ঠাণ্ডা, কিন্তু কপালে সেই ত্রিকোণ দাগ এখন ম্লান হয়ে গেছে, যেন আলো হারিয়ে কেবল চিহ্নটুকু রয়ে গেছে।

“গোপাল… গোপাল…” শিবানী কাঁদতে লাগল। কিন্তু তার চোখে জল আসার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের অন্যদের চোখে ভয়ের বদলে শ্রদ্ধার ছাপ ফুটে উঠল। কেউ ফিসফিস করে বলল—
“সে রক্ষা করেছে। যদি গোপাল না থাকত, আজ হয়তো আমরা কেউই বেঁচে থাকতাম না।”

কথাটা ছড়িয়ে পড়ল আগুনের মতো। লোকেরা মনে করতে লাগল রাতের অদ্ভুত শব্দ, হাওয়ার অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা। তারা বুঝল, গোপালচন্দ্র একা সেই ভয়ের সঙ্গে লড়েছে।

সন্ধ্যায় গ্রামের প্রবীণরা সিদ্ধান্ত নিল—গোপালচন্দ্রকে সাধারণ শ্মশানের নিয়মে দাহ করা হবে না। তাকে নদীর ঘাটের কাছে, শ্মশানের প্রান্তে সমাধি দেওয়া হবে। কারণ সে ছিল রক্ষক।

মাটিতে খুঁড়ে সমাধি বানানো হল। ফুলে ঢাকা হল দেহ। শিবানী কান্নায় ভেঙে পড়লেও বুকের গভীরে এক অদ্ভুত গর্ব জন্ম নিল। তার স্বামী কেবল শ্মশানকর্তা নয়, সে গ্রামকে রক্ষা করেছে।

সেই রাতেই শ্মশান আবার নিস্তব্ধ হয়ে উঠল। কোনো নাচ নেই, কোনো অদ্ভুত তাল নেই। শুধু হাওয়া বইছে ছাইয়ের ওপর দিয়ে।

কিন্তু মানুষজন ধীরে ধীরে বলতে লাগল, “গোপাল শ্মশানরক্ষক হয়ে গেছে। প্রতি শতবর্ষে যখন মন্ত্র জেগে উঠবে, তখন আবার সে ফিরবে।”

কথাটা লোককথায় পরিণত হল। শিশুরা রাতে ভয়ে ফিসফিস করে বলত—“শবনৃত্যের সময় আসবে, কিন্তু গোপাল রক্ষা করবে।”

আর সমাধির ওপর রাখা শুকনো ফুলগুলো মাঝে মাঝে অকারণেই নড়তে থাকত হাওয়ার বিপরীতে—যেন ভেতর থেকে কেউ এখনো পাহারা দিচ্ছে।

পর্ব

বছর কেটে গেল। একে একে দশক পেরোল। গোপালচন্দ্রর সমাধি ঢেকে গেল বুনো ঘাসে, শিবানীও দেহ রেখেছিল সন্তানদের কোলে। কিন্তু গ্রামের লোকেদের মুখে শবনৃত্যের গল্প থামল না। সন্ধেবেলায় আগুনের ধারে বসে বুড়োরা বলতে শুরু করত—
“তখন আকাশ কালো হয়ে গেছিল… মৃতেরা উঠেছিল নাচতে… কিন্তু গোপাল তাদের থামিয়েছিল নিজের প্রাণ দিয়ে।”

কিশোররা ভয়ে গা ঘেঁষে বসত, শিশুরা কাঁপতে কাঁপতে মায়ের আঁচল আঁকড়ে ধরত। ধীরে ধীরে এই কাহিনি গ্রাম ছাপিয়ে আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ল। গোপালচন্দ্র হয়ে উঠল এক কিংবদন্তি—শ্মশানরক্ষক”

কিন্তু সময় যতই এগোল, কিংবদন্তি হয়ে উঠল কেবল গল্প। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করল—ওসব কেবল পুরোনো কুসংস্কার। নতুন প্রজন্ম হাসতে হাসতে উড়িয়ে দিত। সমাধির কাছে কেউ ফুল রাখত না, শুধু কিছু বৃদ্ধ মাঝে মাঝে গিয়ে চুপচাপ মাথা নোয়াত।

একশো বছর পূর্ণ হল সেই ঘটনার। সেই রাতেই আকাশ হঠাৎ ঘন মেঘে ঢেকে গেল। গ্রামে কেউ খেয়াল করল না, বিদ্যুৎ ঝলকানি, কুকুরের অকারণ হুক্কাহুয়া।

কিন্তু শ্মশানের ঘাটে ভিন্ন দৃশ্য। বহু বছর পর আবার মাটির ভেতর থেকে ছাই সরে উঠতে লাগল। অদৃশ্য ঢাকের শব্দ শোনা গেল। মৃতদেহেরা একে একে নড়েচড়ে উঠল। আবার শুরু হল সেই বৃত্তাকার নৃত্য।

আর সমাধির ওপর শুকনো ফুলগুলো হাওয়ার বিপরীতে কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে ঝরে পড়ল। সমাধির ভেতর যেন আলো জ্বলে উঠল।

নৃত্যের বৃত্ত প্রসারিত হতে থাকল। মৃতদের চোখ জ্বলতে লাগল অগ্নি-আলোয়। কিন্তু এবার তারা থামল হঠাৎ। কারণ ঘাটের অন্ধকার থেকে এক পরিচিত ছায়া এগিয়ে আসছে।

লম্বা শরীর, কপালে ম্লান ত্রিকোণ দাগ, ঠোঁটে শান্ত অথচ গম্ভীর হাসি—
গোপালচন্দ্র।

যেন শতবর্ষের ঘুম ভেঙে আবার উঠে এসেছে। শ্মশানরক্ষক ফিরে এসেছে, যেমন প্রতিশ্রুতি ছিল।

পর্ব

শ্মশানের অন্ধকারে যখন গোপালচন্দ্রের ছায়া স্পষ্ট হল, তখন মৃতদের নাচ হঠাৎ থেমে গেল। তারা যেন দ্বিধাগ্রস্ত—যে মানুষটিকে একসময় রক্ষক মান্য করেছিল, আবারও তার আবির্ভাব ঘটেছে। কপালের ত্রিকোণ দাগ ম্লান, তবু অদ্ভুত আলোয় জ্বলছে, যেন শতবর্ষ ঘুমের পরেও সেই চিহ্ন সক্রিয় আছে।

কিন্তু এ গ্রামের মানুষ বদলে গেছে। বিদ্যুৎ, মোবাইল, টিভি—সবই ঢুকে গেছে তাদের জীবনে। শবনৃত্যের গল্প তারা কেবল কুসংস্কার ভেবে হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। সেই রাতেই কিছু তরুণ সাহসী ছেলে মজা করার জন্য শ্মশানের ধারে ঢুকেছিল। হাতে টর্চ, মুখে হাসি, যেন ভূতের গল্পকেও উপহাস করছে।

তারা থমকে গেল যখন দেখল মৃতদের বৃত্ত নাচছে সত্যিই। আরও হতভম্ব হয়ে গেল যখন অন্ধকার থেকে গোপালচন্দ্র বেরিয়ে এল।
“কে… কে আপনি?” এক ছেলে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল।
গোপালচন্দ্র শান্ত চোখে তাকাল। “আমি সেই রক্ষক… যে একশো বছর আগে নিজের প্রাণ দিয়েছিল তোমাদের জন্য।”

তরুণরা চমকে উঠল। গল্প যে সত্যি হতে পারে, তা তাদের কল্পনাতেও ছিল না।

ঠিক তখনই হরিহর ঝার বংশধরের আবির্ভাব হল। কুটিল চোখ, হাতে পুরোনো তালপাতার পুঁথি, ঠোঁটে তৃপ্ত হাসি।
“অবশেষে নৃত্য ফিরেছে। গোপালচন্দ্র, এবারও কি থামাতে পারবি?”

গোপালচন্দ্রর বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। শতবর্ষ আগে তার আত্মত্যাগ বৃথা হয়নি, কিন্তু সম্পূর্ণ সফলও হয়নি। দ্বার আবার খুলেছে, আর এই প্রজন্ম হয়তো রক্ষার শক্তিতে বিশ্বাসই করে না।

মৃতদের বৃত্ত আরও প্রসারিত হতে লাগল, এবার শুধু শ্মশানেই নয়—গ্রামের দিকে এগোতে থাকল। তরুণরা আতঙ্কে চিৎকার করে পালাতে চাইছিল, কিন্তু পা যেন মাটিতে আটকে গেছে।

গোপালচন্দ্র চোখ বন্ধ করল। কানে বাজল ঠাকুমার সেই কণ্ঠ—
“রক্ষক শুধু নিজের রক্ত দেয় না, সে মানুষকেও শেখায় ভয় জেতার পথ।”

সে তরুণদের দিকে তাকাল।
“ভয় পেয়ো না। এই নৃত্য থামাতে গেলে শুধু আমার নয়, তোমাদেরও প্রয়োজন। রক্ষকের রক্তে দ্বার খোলে, কিন্তু বিশ্বাসের শক্তিতেই তা বন্ধ হয়।”

তরুণরা দ্বিধায়। এতদিন ধরে তারা গল্প শুনে হেসেছে, আজ কি সত্যিই বিশ্বাস করবে?

মৃতরা কাছে আসতে লাগল। বাতাসে আবার সেই পচা গন্ধ, হাড়গোড়ের শব্দ। হরিহরের বংশধর মন্ত্র পড়তে শুরু করল, তার কণ্ঠে অদ্ভুত গর্জন।

গোপালচন্দ্র হাত তুলে বলল, “চোখ বন্ধ করো। ভয় জেতো। মনে করো মৃত্যু মানে শেষ নয়, পূর্ণতা। বিশ্বাস করো।”

তরুণরা অনিচ্ছায় চোখ বুজল। তাদের বুকের ভেতর কাঁপুনি থাকলেও মনের গভীরে গোপালের শান্ত কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হল।

মুহূর্তে মৃতদের বৃত্ত থমকে গেল। অদৃশ্য ঢাকের শব্দ ম্লান হয়ে এলো। আকাশের মেঘ সরে গিয়ে চাঁদ উঁকি দিল।

হরিহরের বংশধর ক্রোধে চিৎকার করল—
“না! ভয় ভাঙলে নাচ থেমে যাবে!”

গোপালচন্দ্রর চোখে আলো জ্বলে উঠল। সে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল বৃত্তের কেন্দ্রে।
“শবনৃত্য তোমাদের ভয় থেকে জন্মায়। ভয় নেই মানেই নৃত্য নেই।”

এক ঝলক আলো ছড়িয়ে পড়ল। মৃতরা একে একে পড়ে গেল, মিশে গেল ছাইয়ে। হরিহরের বংশধর ধপ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, পুঁথি ছড়িয়ে গেল চারদিকে।

গোপালচন্দ্র ধীরে ধীরে অদৃশ্য হতে লাগল। তরুণরা চোখ খুলে দেখল—সে শান্ত হাসি মুখে মিলিয়ে যাচ্ছে ভোরের কুয়াশায়।

পর্ব ১০

ভোরের আলো যখন গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল, তখন শ্মশান নিস্তব্ধ। তরুণদের চোখে এখনও ভয় আর বিস্ময়ের ছাপ। তারা প্রত্যক্ষ করেছে মৃতদের নাচ, দেখেছে রক্ষকের আবির্ভাব। গোপালচন্দ্র আবারও গ্রামকে রক্ষা করেছে—কিন্তু এবার নিজের আত্মবলিদান নয়, বরং বিশ্বাস জাগিয়ে।

হরিহরের বংশধর নিথর পড়ে আছে মাটিতে, তার পুঁথি ছাই হয়ে গেছে। সেই পুঁথির সঙ্গে মন্ত্রের শক্তিও যেন ভস্ম হয়ে গেল। মৃতরা শুয়ে পড়েছে নিস্তব্ধতায়, আর বৃত্ত ভেঙে গেছে চিরতরে।

তরুণরা একে একে গ্রামে ফিরে গেল। মুখে আর উপহাস নেই, বরং এক অদ্ভুত দৃঢ়তা। তারা সকলকে বলল—
“গল্প সত্যি। শবনৃত্য আছে, কিন্তু ভয় জিতলে তা থামে। গোপালচন্দ্র আমাদের শিখিয়ে গেছে।”

গ্রামে শুরু হল নতুন এক আলোচনার ধারা। মানুষ বুঝতে পারল, মৃত্যু কেবল আতঙ্ক নয়, এক ধরনের পূর্ণতা। ভয়কে জয় করা ছাড়া মুক্তি নেই। শিশুরা গল্প শুনতে শুরু করল নতুন করে, কিন্তু এবার সেই গল্প ভয়ের নয়, সাহসের।

শ্মশানের ধারে গোপালচন্দ্রর সমাধি এখনো আছে। সেখানে ফুল রাখা হয়, দীপ জ্বালানো হয়। কিন্তু গ্রামবাসীরা জানে—গোপাল কেবল এক সমাধির ভেতর নেই। সে আছে তাদের হৃদয়ে, সাহসে, বিশ্বাসে।

শতবর্ষ পর আবার মন্ত্র জাগবে কিনা, কেউ জানে না। কিন্তু যদি জাগেও, এবার গ্রামের মানুষ প্রস্তুত। তারা জানে, রক্ষক একা নয়—প্রত্যেকেই রক্ষক হতে পারে।

আকাশে সূর্য উঠল। শ্মশান ধীরে ধীরে ভিজে গেল আলোয়। বাতাসে আর কোনো পচা গন্ধ নেই, বরং শিউলি ফুলের সুবাস ভেসে আসছে।

গোপালচন্দ্রের কিংবদন্তি হয়ে উঠল এক শিক্ষা—
মৃত্যুর নাচ ভয়কে ডাকে, আর বিশ্বাসই তা থামায়।”

সমাপ্ত

WhatsApp-Image-2025-08-28-at-5.12.49-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *