Bangla - প্রেমের গল্প

নিষিদ্ধ স্পর্শ

Spread the love

নন্দিতা রায়চৌধুরী


পর্ব ১: শহরের রাতের জানালা

শহরের এই দিকটায় রাত নামতে সময় লাগে না। দিনের কোলাহল ধীরে ধীরে গলে যায়, গাড়ির হর্ন আর মানুষের ভিড় একসময় মিলিয়ে যায় নিঃশব্দের ভেতরে, শুধু দূরের আলোয় রঙিন হয়ে থাকে আকাশটা। রিমি জানলার সামনে বসে ছিল একা। ছোট এক বেডরুম ফ্ল্যাট, ভেতরে খুব বেশি আসবাব নেই—শুধু একটা পুরোনো সোফা, বুকশেলফে ঠাসা কয়েকটা বই, আর এককোণে অগোছালো গিটার। সবকিছুই যেন অসমাপ্ত, অর্ধেক। ঠিক যেমন তার জীবন।

সে জানলার কাঁচে হাত রাখল। গরম শরীর থেকে শীতল কাচে স্পর্শ ছড়িয়ে গেল। বাইরে রাস্তার আলো, মানুষের ছায়া, চলমান ছুটোছুটি—সবই যেন অন্য কারও জীবন। তার জীবন আলাদা, নিঃসঙ্গতায় ভরা। কাজ থেকে ফিরে প্রতিদিন এই একই রুটিন—শরীর ছুঁড়ে দেওয়া সোফায়, অচেনা গান শোনা, আর জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকা। কোথাও যেন কোনো ভেতরের ক্ষুধা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে, অথচ তার ভাষা নেই।

মোবাইলটা টেবিলে রাখা। অনন্ত নোটিফিকেশন, বার্তা, সোশ্যাল মিডিয়ার জগৎ—সব কিছুই এক অদ্ভুত ক্লান্তি জাগায় তার ভেতরে। মানুষের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না। অথচ শরীরটা অন্য কিছু চায়। অদৃশ্য এক স্পর্শ, যা অদ্ভুতভাবে অচেনা, তবু ভীষণ প্রয়োজনীয়। সে জানে, এই শহরে হাজারো মানুষ একই নিঃসঙ্গতা বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হয়তো তারাও জানালার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবে, কেউ যদি এসে বলে—তুমি একা নও।

কিন্তু এমন কেউ আসে না।

রাতটা ছিল বৃষ্টির। শহরের আকাশে কালো মেঘ জমে আছে। হঠাৎ বাজ পড়ার মতো বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল, মুহূর্তের জন্য জানলার কাঁচে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নিল সে। চুল এলোমেলো, ঠোঁটে শুকনো রেখা, চোখে অদ্ভুত শূন্যতা। নিজের চোখের ভেতরেই সে এক অচেনা ডাক দেখতে পেল।

ক্লান্ত শরীর নিয়ে সে ফ্রিজ খুলল, এক গ্লাস ঠান্ডা জল খেল। বুকের ভেতর অদৃশ্য শূন্যতা আরো চেপে বসছে। হঠাৎই সিদ্ধান্ত নিল, আজ রাতে সে বাইরে বেরোবে। বহুদিন পর। হয়তো হেঁটে যাবে কাছের সেই পুরোনো ক্যাফেতে, যেটার আলো রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে থাকে গরম, কমলা আভায়।

 

ক্যাফেটা ছোট, কিন্তু অদ্ভুতভাবে উষ্ণ। ভেতরে ঢুকেই রিমি অনুভব করল অন্য এক আবহ। বৃষ্টির শব্দ বাইরে, ভেতরে হালকা জ্যাজ বাজছে। কয়েকটা টেবিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে মানুষজন। কেউ একা, কেউ জুটিতে, কারও সামনে ল্যাপটপ খোলা।

সে এককোণে বসে পড়ল। কফি অর্ডার দিল।

কফির অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে চোখ পড়ল অন্যদিকে। এক অচেনা পুরুষ বসে আছে ঠিক জানালার ধারে। লম্বা, গাঢ় শার্ট পরা, চোখে অদ্ভুত এক স্থিরতা। তার হাতে ধরা বই, কিন্তু চোখ বারবার জানলার বাইরে চলে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসি খেলে যাচ্ছে, যেন নিজের সঙ্গেই কথা বলছে।

রিমি চমকে তাকাল। পুরুষটির চোখ হঠাৎ তার চোখের সঙ্গে মিলল। চোখাচোখি এক সেকেন্ড, দু’সেকেন্ড, তারপর পুরুষটি মাথা সামান্য নাড়ল, যেন চেনা মানুষকে অভিবাদন জানানো। রিমি অস্বস্তিতে কফির কাপ হাতে তুলে নিল, অথচ বুকের ভেতর হঠাৎ কেমন যেন কম্পন হলো। এতদিন পরে এভাবে কারও চোখের ভেতর ডুবে যাওয়া—এটা সে একদমই প্রত্যাশা করেনি।

 

কফির চুমুকে ঠোঁট ভিজিয়ে সে আবার তাকাল। পুরুষটির চোখ এখনো ওর দিকেই। এবার আর সে চোখ ফেরাল না। অদ্ভুত নীরবতার ভেতর দিয়ে যেন কথা বলতে শুরু হলো দু’জনের। চোখের ভেতর ভেসে উঠছে প্রশ্ন, কৌতূহল, আর একধরনের গোপন আমন্ত্রণ।

হঠাৎ পুরুষটি বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে এল রিমির টেবিলের দিকে। তার বুক ধকধক করে উঠল। সে কি আমার কাছে আসছে?

পুরুষটির কণ্ঠ নরম, কিন্তু গভীর—
“এই সিটটা ফাঁকা আছে তো?”

রিমি কিছু বলার আগেই ঠোঁট শুকিয়ে গেল। সে মাথা নাড়ল।

পুরুষটি বসল। হাত বাড়িয়ে দিল পরিচয়ের জন্য।
“আমি আদিত্য।”

রিমি হাত বাড়াল। অদ্ভুত এক উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ল শরীরে।
“রিমি।”

 

কথোপকথন শুরু হলো। প্রথমে হালকা, সাধারণ—বৃষ্টি নিয়ে, শহরের ভিড় নিয়ে, কাজের ক্লান্তি নিয়ে। ধীরে ধীরে আলাপ নামল ভেতরের দিকে। আদিত্যর কণ্ঠে এমন কিছু আছে, যা শুনলে বুক হালকা হয়ে যায়। রিমি অনিচ্ছাসত্ত্বেও হাসতে শুরু করল।

একসময় সে লক্ষ্য করল, আদিত্যর আঙুল কাপের গায়ে বুলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। সেই আঙুল যেন তার চোখের সামনে অন্য কোনো ভাষা লিখছে। তার মনে হলো, এই আঙুল যদি কখনো তার ত্বকে ছোঁয়, শরীরের ভেতর আগুন জ্বলে উঠবে।

বাইরে বৃষ্টি থামেনি। কাঁচে কণা জমে আছে। সেই কণার আড়ালে যেন ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে নতুন এক দৃশ্য।

রাত গভীর হলো। কিন্তু রিমির মনে হলো, এই রাত অন্য রকম। জানালার বাইরে শহরের আলো নিভে গেলে, ভেতরের আলোটা কি নিভে যাবে? নাকি এই আলোর শুরু আজ থেকে?

সে জানত না।

কিন্তু জানালার সামনে একা বসে থাকার দিনগুলো আজ হঠাৎ করেই অন্য পথে মোড় নিল।

পর্ব ২: ক্যাফের আলোর নিচে

আদিত্যর চোখে যে স্থিরতা ছিল, তা রিমিকে অদ্ভুতভাবে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। কথোপকথন খুব সাধারণ জায়গা থেকে শুরু হলেও, তার ভিতরে এক অচেনা স্রোত বইছিল। কখনো এমন হয়েছে কি? প্রথম দিনের পরিচয়েই অচেনা মানুষকে এতটা ঘনিষ্ঠ মনে হওয়া?

ক্যাফের আলোগুলো ঝুলছিল মাথার ওপরে, হলুদ বাল্বের মৃদু আভা ছড়িয়ে পড়ছিল টেবিলে। আলোয় আদিত্যর মুখ যেন স্পষ্ট হয়ে উঠছিল—চোখে গভীর রেখা, ঠোঁটে শান্ত হাসি, আর কণ্ঠে এমন এক মিশ্রণ, যা আত্মবিশ্বাসী অথচ কোমল।

রিমি কাপের ভেতরে আঙুল ঘুরিয়ে চলছিল। সে লক্ষ্য করল, আদিত্যর দৃষ্টি প্রায়ই তার হাতের দিকে চলে যাচ্ছে। সেই দৃষ্টির ভেতরে এমন এক অদৃশ্য টান, যা শরীরকে এক অদ্ভুত প্রতীক্ষায় ভরিয়ে তুলছিল।

“তুমি কি প্রায়ই এখানে আসো?” রিমি জিজ্ঞেস করল, শুধু নীরবতা ভাঙার জন্য।

আদিত্য হালকা হাসল।
“না, আসলে আজ অনেকদিন পর এলাম। এই শহরের ভিড় থেকে লুকোনোর জায়গা খুঁজছিলাম। আর তুমি?”

রিমি এক মুহূর্ত ভেবে উত্তর দিল—
“আমিও। আজ হঠাৎ বেরিয়ে পড়েছিলাম। জানালার সামনে বসে থাকতে থাকতে মনে হলো—শ্বাস নেওয়া যাচ্ছে না। বাইরে আসতেই হলো।”

কথাটা শুনে আদিত্যর চোখে যেন মৃদু ঝিলিক খেলল।
“অদ্ভুত না? দু’জনেরই একই সময়ে পালানোর প্রয়োজন হলো।”

ওরা দু’জনেই হেসে ফেলল। সেই হাসির ভেতর জমে উঠল অদ্ভুত এক আরাম। যেন অনেকদিনের চেনা মানুষ, অথচ প্রথম দেখার মুহূর্তের ভেতরেই অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা পড়ে যাচ্ছে।

 

কফির গরম ধোঁয়া ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল। বাইরে বৃষ্টি তখনো পড়ছে। জানলার কাঁচ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জলের ফোঁটা। রিমি অনুভব করল, কাঁচের ওপারে পৃথিবী ভিজে যাচ্ছে, কিন্তু এই টেবিলের চারপাশে যেন ভিন্ন এক উত্তাপ তৈরি হচ্ছে।

আদিত্য হাত বাড়িয়ে কাপ সরাল। টেবিলের ওপর দু’জনের আঙুল খুব কাছাকাছি এল। রিমি অজান্তেই আঙুল একটু এগিয়ে নিল, এক সেকেন্ডের জন্য স্পর্শ হলো। শরীর যেন ঝাঁকুনি খেল। সে তাড়াহুড়ো করে হাত সরিয়ে নিল, কিন্তু চোখে চোখ রেখে ফেলল আদিত্যর সঙ্গে।

কোনো কথা হলো না, শুধু চোখে ভেসে উঠল দু’জনের অস্বীকারহীন স্বীকারোক্তি।

 

সময় গড়িয়ে চলছিল। ভেতরে গানের তাল বদলাচ্ছিল, বাইরে বজ্রপাতের আলো জানালার কাঁচে ছড়িয়ে পড়ছিল। টেবিলের ওপরে রাখা বিলের কাগজ হঠাৎ উলটে গেল হাওয়ায়। রিমি তা ঠিক করতে গিয়ে দেখল, আদিত্যও একই সময়ে হাত বাড়িয়েছে। দু’জনের হাত আবারও একসঙ্গে স্পর্শ করল। এবার কেউ হাত সরাল না।

সেই মুহূর্তে ক্যাফের ভেতরকার শব্দ যেন ম্লান হয়ে গেল। শুধু হৃদস্পন্দনের ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল বুকের ভেতরে।

আদিত্য নিচু স্বরে বলল—
“তোমার চোখে একধরনের ক্লান্তি আছে, কিন্তু একই সঙ্গে একরকম জেদও। তুমি কি জানো সেটা?”

রিমি চমকে তাকাল।
“আমার চোখে তুমি এত কিছু দেখতে পাও?”

“হ্যাঁ,” সে শান্তভাবে বলল। “আমি দীর্ঘ সময় ধরে মানুষ দেখি। চোখ সবসময় লুকোতে পারে না।”

রিমি কিছু বলল না। শুধু নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠল। এই মানুষটিকে সে একেবারেই চিনত না, অথচ মনে হচ্ছিল সে যেন ভেতরের অনেক কিছু বুঝে ফেলছে।

 

বাইরে বৃষ্টি তীব্র হলো। ঝড়ো বাতাসে জানলার কাঁচ কেঁপে উঠল। ক্যাফের ভেতরে কয়েকজন অতিথি উঠে চলে গেল, কিন্তু ওরা দু’জন বসে রইল। আলো আরও ঝিমঝিম করে এল।

আদিত্যর কণ্ঠ হঠাৎ গভীর হলো—
“তুমি কি বিশ্বাস করো, দু’জন মানুষের দেখা হওয়া একেবারেই কাকতালীয় নয়?”

রিমি দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“আমি জানি না… তবে আজকের রাতটা কাকতালীয় বলে মনে হচ্ছে না।”

কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে নিজের বুকের ভেতর কেমন যেন অচেনা কম্পন টের পেল। এতদিন ধরে জমে থাকা শূন্যতা হঠাৎ ভরে উঠছে।

আদিত্য ধীরে ধীরে তার দিকে ঝুঁকল, কিন্তু দূরত্ব রেখে দিল। ঠোঁটের খুব কাছাকাছি শ্বাস মিলছিল, তবু স্পর্শ আসেনি। এই থেমে থাকা মুহূর্তই রিমির শরীরকে আরও অস্থির করে তুলল।

“তুমি চাইলে,” আদিত্য ফিসফিস করে বলল, “আমরা এই কথোপকথন এখানেই শেষ করতে পারি। অথবা চাইলে… এটা আরও দূরে নিয়ে যেতে পারি।”

রিমির বুক ধড়ফড় করে উঠল। উত্তর দিতে তার কণ্ঠ বেরোলো না। শুধু চোখে তাকিয়ে রইল। সেই চোখই হয়ে উঠল সম্মতি।

 

ক্যাফের ভেতর আলো কিছুটা নিভে এলো। বন্ধের সময় এগিয়ে আসছিল। বাইরে তখনো বৃষ্টির ধারা। দু’জন একসঙ্গে উঠে দাঁড়াল। বিল মেটানোর সময় তাদের হাত আবার ছুঁয়ে গেল। সেই স্পর্শে এবার আর কোনো অস্বস্তি ছিল না, বরং এক অদ্ভুত নিশ্চয়তা।

বাইরে বেরোতেই বৃষ্টির ঠান্ডা হাওয়া ধাক্কা দিল। রাস্তা ভিজে চকচক করছিল, আলো গলে পড়ছিল জলে। রিমি ছাতা আনেনি। আদিত্য ছাতাটা খুলে তার দিকে বাড়িয়ে দিল।

“চলবে?”

রিমি মাথা নাড়ল। দু’জন একসঙ্গে হাঁটতে লাগল ভিজে রাস্তায়। ছাতার নিচে তাদের কাঁধ ছুঁয়ে যাচ্ছিল একে অপরকে। নীরবতার ভেতর লুকিয়ে ছিল হাজারো অপ্রকাশিত বাক্য, যা শুধু শরীরের উষ্ণতায় বোঝা যাচ্ছিল।

একসময় রিমি থেমে দাঁড়াল।
“তুমি কোথায় থাকো?”

“খুব দূরে নয়,” আদিত্য উত্তর দিল। “তুমি?”

রিমি হেসে বলল—
“এই শহরেই, তবে অনেক ভিড়ের ভেতরেও যেন খুব একা।”

আদিত্য তাকিয়ে রইল তার দিকে।
“হয়তো তাই আমাদের দেখা হলো।”

রিমি চোখ ফেরাল না। বৃষ্টির ফোঁটা ছাতার পাশ দিয়ে গড়িয়ে তার গালে পড়ছিল। সেই জল আর আদিত্যর চোখের তীব্রতা মিলেমিশে এক অদ্ভুত আগুন জ্বালাচ্ছিল ভেতরে।

 

রাত বাড়ছিল। শহরের আলো কমে আসছিল। কিন্তু তাদের ভেতরে আলো আরও স্পষ্ট হচ্ছিল। রিমি জানত, আজকের রাত এখানেই থেমে যাবে না। এ এক শুরু, যা তাকে নিয়ে যাবে আরও দূরে, আরও অচেনা পথে।

আর সেই অচেনা পথের প্রতিটি ধাপেই থাকবে কামনা, আকর্ষণ, আর একরকম মুক্তি।

 

পর্ব ৩: আঙুলের ছায়া

রাতের শহর তখন ভিজে আলোয় ডুবে। রাস্তার গাড়িগুলো ধীরে ধীরে চলছিল, টায়ারের নিচে জমে থাকা জলের ছিটা ছড়িয়ে যাচ্ছিল দু’পাশে। রিমি আর আদিত্য পাশাপাশি হাঁটছিল ছাতার নিচে। কিন্তু যতবার কাঁধ ছুঁয়ে যাচ্ছিল, তাদের ভেতরে এক অদৃশ্য বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছিল।

রিমির মনে হচ্ছিল, প্রতিটি স্পর্শ যেন ইচ্ছাকৃত। অথচ কেউই সরাসরি কিছু বলছে না। নীরবতার ভেতরেই তৈরি হচ্ছিল নতুন ভাষা।

“তুমি গান শোনো?” হঠাৎই প্রশ্ন করল আদিত্য।

“শুনি,” রিমি উত্তর দিল। “কিন্তু অনেকদিন নতুন কিছু শোনা হয়নি। একই গান বারবার চালিয়ে রাখি।”

আদিত্য হেসে বলল—
“আমিও তাই করি। হয়তো আমরা দু’জনেই সময়ের ভেতর আটকে থাকি।”

কথাটা শুনে রিমি চুপ করে গেল। হেঁটে হেঁটে তারা পৌঁছল এক মোড়ে। রাস্তার বাতির আলোতে দেখা গেল, বৃষ্টির ফোঁটা এখনো ঝরছে, কিন্তু আগের মতো তীব্র নয়।

“তুমি কি ট্যাক্সি নেবে?” জিজ্ঞেস করল আদিত্য।

রিমি মাথা নাড়ল।
“না, হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি যেতে চাই। ভিজে শহরটা আজ অন্যরকম লাগছে।”

আদিত্য তাকাল তার দিকে।
“তাহলে আমি তোমার সঙ্গে কিছুটা পথ হাঁটি?”

রিমি কোনো কথা না বলে শুধু একচিলতে হাসি দিল।

 

রাস্তার একপাশে ছোট্ট চা-দোকান খোলা ছিল। ভেজা কাঠের বেঞ্চে বসে কয়েকজন সিগারেট টানছিল। দোকান থেকে ভেসে আসছিল ধোঁয়া আর চায়ের মিষ্টি গন্ধ। রিমি হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল।

“এক কাপ চা খাওয়া যাক?”

আদিত্য মাথা নাড়ল। তারা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। বৃষ্টিতে ভেজা বাতাসে গরম চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠতে লাগল। রিমি কাপ হাতে নিয়ে দেখল, আদিত্যর আঙুল ঠিক তার কাপের কাছেই।

আবার সেই স্পর্শের খেলা। কাপ সরাতে গিয়েই রিমির আঙুল ছুঁয়ে গেল আদিত্যর আঙুলে। এক মুহূর্ত। মাত্র কয়েক সেকেন্ড। কিন্তু সেই কয়েক সেকেন্ডে তার শরীর ভেতর থেকে কেঁপে উঠল।

আদিত্য কোনো কথা বলল না, শুধু চোখে চোখ রাখল। সেই চোখের ভেতরে লেখা ছিল এমন এক স্পষ্ট বাক্য, যা উচ্চারণ করার প্রয়োজন নেই।

 

চা শেষ করে তারা আবার হাঁটতে লাগল। এবার আর ছাতা খোলা হলো না। বৃষ্টির হালকা ফোঁটা তাদের মাথার ওপর, কাঁধের ওপর ঝরে পড়ছিল। রিমি চুল সরাতে গিয়ে খেয়াল করল, আদিত্যর হাতও একই সঙ্গে তার চুলের ভেজা গোছায় ছুঁয়ে গেল।

দু’জনেই থেমে দাঁড়াল। তাদের মাঝে দূরত্ব খুব সামান্য।

“তুমি কি অস্বস্তি বোধ করছো?” আদিত্য ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করল।

রিমি গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিল।
“না… তবে অভ্যস্তও নই।”

আদিত্যর ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি ফুটল।
“তাহলে নতুন কিছুর সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়ার সময় এসেছে।”

কথাগুলো যেন বাতাসে ঝুলে রইল। রিমির গায়ে কাঁপুনি দিয়ে গেল। সে জানত, এই মুহূর্তে শুধু কথোপকথন নয়, আরও কিছু ঘটছে। অদৃশ্য এক সীমা অতিক্রম করতে চলেছে তারা।

 

হাঁটতে হাঁটতে রিমি পৌঁছল তার বাড়ির কাছাকাছি। পুরোনো বিল্ডিং, উঁচু বারান্দা, নিচে অল্প আলো জ্বলছে। সে থেমে দাঁড়াল।

“এখানেই আমার বাড়ি,” রিমি বলল।

আদিত্য তাকিয়ে রইল দরজার দিকে, তারপর তার চোখে চোখ রেখে বলল—
“তাহলে আজ এখানেই আমাদের কথোপকথন শেষ?”

রিমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উত্তর দিল—
“হয়তো। তবে মনে হচ্ছে এই শেষটা আসলে কোনো শুরু।”

আদিত্য ধীরে ধীরে এগিয়ে এল, খুব কাছাকাছি। তাদের মাঝে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরত্ব। তার আঙুল আবার ছুঁয়ে গেল রিমির আঙুলে। এবার রিমি হাত সরাল না। বরং আঙুলগুলো একে অপরকে আঁকড়ে ধরল।

স্পর্শের ভেতর জমে থাকা সব অব্যক্ত কথা হঠাৎ স্পষ্ট হয়ে উঠল।

 

মুহূর্তটা অনেক দীর্ঘ মনে হলো। শহরের শব্দ থেমে গেছে, বৃষ্টির ফোঁটাও যেন থেমে গেছে। শুধু আঙুলের ছায়া, ঠোঁটের কাছাকাছি শ্বাসের উত্তাপ, আর বুকের ভেতরে দ্রুত স্পন্দন।

রিমি জানত, যদি এখন ঠোঁট ঠোঁটের কাছে চলে আসে, সবকিছু বদলে যাবে।

কিন্তু আদিত্য থামল। শুধু হাত ধরে বলল—
“আমরা আবার দেখা করব, রিমি।”

রিমির ঠোঁটে অদৃশ্য হাসি ফুটে উঠল।
“আমি জানি।”

সে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল। প্রতিটি ধাপে তার মনে হচ্ছিল, আদিত্যর দৃষ্টি এখনো তার ওপর লেগে আছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সে পেছনে তাকাল। সত্যিই, আদিত্য তখনো দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার আলোয়, তার দিকে তাকিয়ে।

 

ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতেই রিমি হাঁপ ছেড়ে বসে পড়ল। বুকের ভেতর এমন এক কাঁপুনি চলছে, যেন এখনো স্পর্শটা টিকে আছে। আঙুলগুলো একেবারে উষ্ণ। সে হাত নিজের ঠোঁটে এনে ছুঁয়ে দেখল। মনে হলো, আদিত্যর আঙুল আসলে তার ঠোঁটের ওপরেই থেকে গেছে।

জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। বাইরে রাস্তার আলো, বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ, আর সেই ছায়া—আদিত্যর। অনেক দূর থেকে হলেও সে এখনো তাকিয়ে আছে। তারপর ধীরে ধীরে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

রিমি বুঝল, আজকের রাত তার জীবনে নতুন এক অধ্যায় খুলে দিল।

পর্ব ৪: গোপন সিঁড়ি

রাত কেটে গিয়েছিল, কিন্তু ঘুম আসেনি রিমির। বিছানায় শুয়ে বারবার সে হাত ছুঁয়ে দেখছিল, যেন আদিত্যর আঙুলের উষ্ণতা এখনো তার চামড়ায় লেগে আছে। চোখ বন্ধ করলে ভেসে উঠছিল তার দৃষ্টি, সেই শান্ত অথচ তীব্র হাসি, আর শরীরের কাছে এসে থেমে যাওয়া নিঃশ্বাসের গরম।

ভোরের দিকে কিছুটা ঘুম এলো বটে, কিন্তু সেই ঘুম ছিল ছিন্নভিন্ন। সকাল থেকে অফিস, মিটিং, ইমেল—সব কিছু যেন স্বাভাবিক রুটিনেই চলছিল। তবুও ভেতরে একটানা ধকধক চলছিল। মনে হচ্ছিল, প্রতিটি মুহূর্তই কেবল অপেক্ষার, কখন আবার দেখা হবে।

বিকেলের দিকে ফোনে একটি মেসেজ এল।
আজ সন্ধ্যায় আসবে? আমি অপেক্ষা করব। – আদিত্য”

বারবার মেসেজ পড়তে লাগল রিমি। শরীর হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠল। অনেকটা দ্বিধা, অনেকটা ইচ্ছে—দু’টোই মিলে এক অদ্ভুত টান তৈরি করল। শেষে উত্তর দিল—
ঠিক আছে। কোথায়?”

একটু পরেই রিপ্লাই এল।
আমার জায়গায়। আমি ঠিকানা পাঠাচ্ছি।”

 

শহরের ভিড় ঠেলে সন্ধ্যায় পৌঁছল সে। রাস্তার আলো জ্বলে উঠেছে, ট্রাফিকের শব্দ গলে যাচ্ছে কানে। মোবাইলের স্ক্রিনে পাঠানো লোকেশন ধরে খুঁজে পেতে সে পৌঁছল এক পুরোনো বিল্ডিংয়ের সামনে। পাঁচতলা বাড়ি, বাইরের দেয়ালে শ্যাওলা লেগে আছে, সিঁড়ির ধারে অল্প আলো।

রিমির বুক ধকধক করছিল। সে থামল, গভীর নিঃশ্বাস নিল। মনে হচ্ছিল, এই সিঁড়ি বেয়ে ওঠার মানেই শুধু কারও ফ্ল্যাটে যাওয়া নয়—বরং নিজের ভেতরের অচেনা দরজা খোলা।

সিঁড়ির ধাপগুলো ভিজে ছিল বৃষ্টির কারণে। প্রতিটি ধাপে উঠতে উঠতে শরীরের ভেতর কেমন যেন কেঁপে উঠছিল। কোথাও যেন অপরাধবোধ, কোথাও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, আবার কোথাও একরকম তৃষ্ণা।

চতুর্থ তলায় পৌঁছেই দেখল, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আদিত্য। কালো শার্ট, গাঢ় চোখ, ঠোঁটে শান্ত হাসি।

“তুমি এসেছ,” সে বলল। কণ্ঠটা ছিল একদম নীচু, অথচ ভেতরটা কেঁপে উঠল রিমির।

 

দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই সে চমকে গেল। ফ্ল্যাটটা বড় নয়, কিন্তু ভেতরের আবহ যেন একেবারে আলাদা। জানালার পর্দা আধখোলা, বাইরে শহরের আলো ভেসে আসছে। ঘরের কোণে একটি গ্লাস টেবিলের ওপর রাখা ওয়াইনের বোতল আর দু’টি গ্লাস। ভেতরে বাজছিল ধীর লয়ের সুর—পিয়ানো আর বৃষ্টির মতো শব্দ মিলেমিশে এক অদ্ভুত আবেশ তৈরি করছিল।

“তুমি ওয়াইন খাও?” আদিত্য প্রশ্ন করল।

রিমি হেসে মাথা নাড়ল।
“কখনো খুব বেশি খাইনি।”

“তাহলে আজ চেষ্টা করে দেখো,” বলল সে, বোতল খুলতে খুলতে।

রিমি সোফায় বসে পড়ল। চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারল, এখানে কোনো অযথা সাজসজ্জা নেই, তবুও ঘরে একরকম উষ্ণতা আছে। যেন প্রতিটি কোণ আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।

গ্লাসে ওয়াইন ঢেলে আদিত্য এগিয়ে দিল তার দিকে।
“নাও। প্রথম চুমুকটা সবসময় নতুন গল্পের শুরু।”

 

ওয়াইনের স্বাদ ছিল টক-মিষ্টি, কিন্তু তার থেকেও বেশি মাতাল করে তুলছিল আদিত্যর দৃষ্টি। সে গ্লাস হাতে নিয়ে পাশে এসে বসল। দূরত্ব খুব কম। এত কম যে রিমি তার শরীরের উষ্ণতা স্পষ্ট অনুভব করছিল।

“তুমি জানো, আমি ভাবিনি এত তাড়াতাড়ি তোমাকে আবার দেখব,” বলল রিমি, ঠোঁট গ্লাসের ধারে রেখে।

আদিত্য তাকিয়ে রইল তার দিকে।
“কিছু কিছু দেখা হয়েই যায়। সময়, নিয়ম, যুক্তি—সবকিছু ভেঙে।”

তার কণ্ঠে এমন কিছু ছিল, যা রিমিকে আরও গভীরভাবে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। সে বুঝতে পারছিল, এই মুহূর্তে থামা আর সম্ভব নয়।

 

আদিত্য ধীরে ধীরে হাত বাড়াল। তার আঙুল গিয়ে ছুঁল রিমির চুলের ভেজা গোছা। কাঁধ বেয়ে নামল আঙুল। রিমি চমকে উঠলেও সরল না। বরং শরীর এক অদৃশ্য সম্মতিতে নিঃশব্দে আত্মসমর্পণ করল।

সেই আঙুল যেন কোনো অজানা অক্ষর লিখছে তার ত্বকের ওপর। প্রতিটি স্পর্শে শরীর জুড়ে শিহরণ ছড়িয়ে যাচ্ছিল। বুকের ভেতর স্পন্দন এত দ্রুত হচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল, কণ্ঠ দিয়ে শব্দ বেরোলে তা ধ্বনি নয়, বরং আর্তনাদ হবে।

“আদিত্য…” নাম উচ্চারণ করল রিমি, গলার স্বর প্রায় ফিসফিস।

সে উত্তর দিল না। শুধু আরও কাছে এল। তাদের মাঝে থাকা সামান্য দূরত্বটুকু কমে আসছিল ধীরে ধীরে। ঠোঁটের দূরত্ব তখন নিঃশ্বাসের পরিমাপে।

কিন্তু সে থামল। চুমু দিল না। বরং মাথা সামান্য সরিয়ে কানে ফিসফিস করে বলল—
“আমি চাই তুমি নিজে থেকে এগিয়ে আসো।”

 

রিমি চোখ বন্ধ করল। তার ভেতরের দ্বিধা, ভয়, অনিশ্চয়তা—সব মিলেমিশে এক অদ্ভুত বিস্ফোরণ তৈরি করছিল। এতদিনের জমে থাকা শূন্যতা, অচেনা ক্ষুধা—সব মিলিয়ে যেন তাকে ঠেলে দিচ্ছিল সামনে।

সে ধীরে ধীরে মাথা এগিয়ে নিল। ঠোঁট ছুঁয়ে গেল আদিত্যর ঠোঁটে। মুহূর্তেই দুনিয়া বদলে গেল। চুমুটা ছিল ধীরে, কিন্তু তীব্রতায় ভরা। যেন বহুদিনের তৃষ্ণা একসঙ্গে মিটে যাচ্ছে।

আদিত্য হাত বাড়িয়ে তাকে জড়িয়ে নিল। রিমি অনুভব করল, তার শরীরের ভেতর আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। ঠোঁট থেকে গলা, গলা থেকে কাঁধ—প্রতিটি মুহূর্তে তারা আরও কাছে আসছিল।

 

হঠাৎ সে থেমে গেল। শ্বাস ভারী হয়ে উঠেছিল। রিমি চোখ খুলে তাকাল।

আদিত্য হাসল, কিন্তু সেই হাসিতে ছিল অদ্ভুত এক সংযম।
“আজ এখানেই থামাই। সবকিছু একসঙ্গে নয়। কিছু জিনিসের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।”

রিমি হতভম্ব হয়ে গেল। তার শরীর এখনো কাঁপছিল, ঠোঁট জ্বলছিল, তবুও এই থেমে যাওয়ার ভেতর এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ তৈরি হলো।

সে শুধু মাথা নাড়ল।
“তাহলে পরের বার?”

আদিত্যর চোখে আগুনের ছায়া।
“হ্যাঁ। পরের বার।”

 

বাইরে তখনো বৃষ্টি পড়ছিল। জানালার কাঁচে ফোঁটার শব্দে মিশে যাচ্ছিল নিঃশ্বাসের উষ্ণতা। রিমি জানত, আজকের রাতের পর তার ভেতরের পৃথিবী আর আগের মতো থাকবে না।

এই সিঁড়ি বেয়ে ওঠা ছিল শুধু শুরু।

 

পর্ব ৫: ঠোঁটের দূরত্ব

রিমি সেদিন রাত বাড়ি ফিরে দরজা বন্ধ করতেই বুঝেছিল—তার ভেতরে এক নতুন দরজা খুলে গেছে। শরীর এখনো কাঁপছিল, ঠোঁটে আদিত্যর স্পর্শের আঁচ রয়ে গেছে। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, সে থেমে গিয়েছিল ঠিক শেষ মুহূর্তে। অদ্ভুত এক সংযম, অদ্ভুত এক প্রতীক্ষা রেখে গেছে তার মধ্যে।

দিন কেটে যাচ্ছিল, কিন্তু প্রতিটি ঘণ্টা যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছিল পরবর্তী সাক্ষাতের দিকে। অফিসে সহকর্মীদের আলাপ, ট্রাফিকের ভিড়, ফোনকল—সবকিছু যেন নিরর্থক লাগছিল। ভেতরের আগুন জ্বলছিল প্রতিনিয়ত।

অবশেষে এল সেই বার্তা—
আজ রাতটা কি আমার সঙ্গে কাটাবে?” – আদিত্য

রিমির বুকের ভেতর ধাক্কা খেল। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে সে উত্তর দিল—
হ্যাঁ।”

 

সন্ধ্যা নামতেই সে পৌঁছল আদিত্যর ফ্ল্যাটে। বাইরে হালকা বাতাস বইছিল, আকাশে চাঁদ আধখানা। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় আগের দিনের মতোই শরীরের ভেতরে কাঁপুনি হচ্ছিল, কিন্তু এবার ভয়ের চেয়ে আকাঙ্ক্ষা বেশি।

দরজা খুলতেই দেখা গেল, ঘরের ভেতরে মৃদু আলো জ্বলছে। টেবিলে কিছু মোমবাতি জ্বলছে, চারপাশে ছায়ার খেলা। কোণে বাজছে ধীর লয়ের সুর—ভায়োলিনের টান, যা বুকের ভেতর কেঁপে যাচ্ছে।

“তুমি এসেছ,” আদিত্য বলল। তার কণ্ঠে সেই পরিচিত গভীরতা।

রিমি কিছু বলল না। শুধু ভেতরে পা রাখল।

 

ওরা সোফায় বসল। কিন্তু এবার আলাপ জমল না আগের মতো। কথার চেয়ে বেশি ভারী হয়ে উঠল নীরবতা। তাদের মাঝে দূরত্ব এত সামান্য যে নিঃশ্বাস মিলেমিশে যাচ্ছিল।

আদিত্য ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে রিমির চুল সরাল। আঙুল গিয়ে ছুঁল তার ঘাড়ের পাশ। শরীর কেঁপে উঠল।

“তুমি কি প্রস্তুত?” সে ফিসফিস করে বলল।

রিমি চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়ল। কোনো শব্দ বেরোলো না। শুধু ঠোঁট শুকনো হয়ে উঠল।

আদিত্য আরও কাছে এল। তার ঠোঁট রিমির ঠোঁটের খুব কাছে। এত কাছে যে উষ্ণতা স্পষ্ট অনুভূত হচ্ছিল, তবু স্পর্শ আসছিল না।

এই দেরি, এই অপেক্ষাই যেন আগুনকে আরও তীব্র করে তুলছিল। রিমির শরীর তখন সম্পূর্ণ প্রস্তুত, ঠোঁট সামান্য কাঁপছিল, যেন নিজেই এগিয়ে আসতে চাইছে।

অবশেষে ঠোঁট ঠোঁটে মিলল।

 

প্রথমে ধীর, নরম। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সেই নরমতা বদলে গেল তীব্রতায়। যেন বহুদিনের ক্ষুধা একসঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে। রিমি শ্বাস নিতে পারছিল না, অথচ থামতেও পারছিল না। হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরল আদিত্যকে।

চুমুর ভেতরেই জমা হলো অগণিত কথা—নিঃসঙ্গতার অভিমান, শরীরের ক্ষুধা, ভালোবাসার গোপন ডাক।

আদিত্যর হাত গিয়ে নামল রিমির পিঠে, ধীরে ধীরে টেনে নিল আরও কাছে। তার শরীরের শক্তি, তার ঠোঁটের আগ্রাসন—সবকিছু মিশে যাচ্ছিল একসঙ্গে।

রিমি অনুভব করল, সে আর নিজেকে আলাদা করতে পারছে না। যেন নিজের শরীরই তাকে বিশ্বাসঘাতকতা করছে, সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করছে এই মানুষটার কাছে।

 

চুমু থামতেই দু’জনেই হাঁপাচ্ছিল। রিমির ঠোঁট লাল, চোখ ভিজে উঠেছে। আদিত্য তার কপালে ঠোঁট রাখল।

“এটাই ছিল আমার প্রতীক্ষা,” সে ফিসফিস করে বলল। “তোমাকে আসতে দেওয়া, নিজে থেকে এগিয়ে আসা।”

রিমি মাথা নামিয়ে হাসল।
“তুমি জানো, আমি এতদিন কাউকে এভাবে চাইনি। কিন্তু তোমার সঙ্গে… সবকিছু বদলে গেছে।”

আদিত্য তার চিবুক তুলে দিল।
“কারণ তুমি প্রস্তুত ছিলে। শুধু তোমার দরকার ছিল কাউকে, যে তোমার ভেতরের আলোটা জাগিয়ে দেবে।”

 

তারপর আবার ঠোঁট মিলল। এবার আর কোনো দ্বিধা নেই। রিমির শরীর এখন সম্পূর্ণ আত্মসমর্পিত। হাত গিয়ে জড়িয়ে ধরল আদিত্যর গলা। সে নিজেকে ভুলে যাচ্ছিল, ভুলে যাচ্ছিল চারপাশ, সময়, নিয়ম—সবকিছু।

আদিত্য তাকে টেনে নিল আরও কাছে, মোমবাতির আলোয় ছায়াগুলো নাচতে লাগল দেয়ালে। রিমি অনুভব করল, তার প্রতিটি শ্বাস যেন নতুন করে জন্ম দিচ্ছে তাকে।

এবার আর শুধু চুমু নয়—স্পর্শ ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। আঙুলের টানে, ঠোঁটের উষ্ণতায়, শরীরের কাছে আসায় সবকিছু মিশে গেল।

কিন্তু আবারও, ঠিক শেষ মুহূর্তে, আদিত্য থামল।

“আজ নয়,” সে বলল ধীরে। “আজ আমরা শুধু শিখব কীভাবে অপেক্ষা করা যায়।”

রিমি অবাক হয়ে তাকাল। শরীর তখনো কাঁপছিল, ঠোঁট জ্বলছিল।
“তুমি কেন থামো বারবার?”

আদিত্য তার হাত ধরে রাখল।
“কারণ আমি চাই, প্রতিটি মুহূর্ত তোমার জন্য স্মরণীয় হোক। কামনা শুধু এক রাতের জন্য নয়—এটা সময়ের সঙ্গে আরও গভীর হয়। তুমি যদি এখনই সব কিছু পেয়ে যাও, তবে এই প্রতীক্ষার মাধুর্য হারিয়ে যাবে।”

রিমি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে জানত, এই থেমে যাওয়ার ভেতরেই লুকিয়ে আছে আরও বড় প্রতিশ্রুতি।

 

রাত বাড়ছিল। বাইরে বাতাসে গাছের ছায়া কাঁপছিল। মোমবাতির আলো ধীরে ধীরে নিভে আসছিল। রিমি মাথা রেখে বসল আদিত্যর কাঁধে। তার বুকের শব্দ, নিঃশ্বাসের তালে তালে যেন নিজের শরীরের ধ্বনি মিলিয়ে যাচ্ছিল।

সেই রাতে তারা আর কিছু করল না। শুধু একে অপরের কাছাকাছি বসে রইল, ঠোঁটের দূরত্ব আর মিলনের মাঝের প্রতীক্ষা উপভোগ করল।

রিমির মনে হলো—এই প্রতীক্ষাই আসলে কামনার সবচেয়ে বড় খেলা।

 

পর্ব ৬: শরীরের অক্ষর

রাতের ঘড়ি যেন থেমে ছিল। বাইরে বাতাসে গাছের পাতার খসখস, মাঝে মাঝে দূরের গাড়ির হর্ন—সবকিছুই যেন অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। রিমি মাথা রেখেছিল আদিত্যর কাঁধে। শরীর তখনো আগের মতো উত্তপ্ত, ঠোঁটে এখনো জ্বলছিল সেই তীব্র চুমুর স্মৃতি।

কিন্তু আদিত্য তাকে থামিয়ে দিয়েছিল। সে বুঝতে পারছিল, এই মানুষটির ভেতরে এক অদ্ভুত সংযম আছে, আর সেই সংযমই তাকে আরও অস্থির করে তুলছে।

“তুমি কি সবসময়ই এভাবে থামিয়ে দাও?” রিমি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল।

আদিত্য হেসে তার চুলে আঙুল চালাল।
“সবসময় নয়। শুধু তখন, যখন জানি প্রতীক্ষার ভেতরে আরও মাধুর্য আছে।”

রিমি চোখ বন্ধ করল। শরীর শিহরে উঠছিল প্রতিটি ছোঁয়ায়। সে অনুভব করছিল, প্রতিটি আঙুল যেন কোনো অদৃশ্য অক্ষর লিখছে তার ত্বকের ওপর। যেন এক অজানা ভাষায় লেখা হচ্ছে কামনা, আকাঙ্ক্ষা, আত্মসমর্পণের কবিতা।

 

আদিত্যর হাত নামল তার ঘাড় থেকে কাঁধে, কাঁধ থেকে বাহুতে। প্রতিটি স্পর্শ ছিল ধীর, তবু নিখুঁত। যেন শরীরের ভেতরের সমস্ত স্নায়ুতে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে।

রিমি শ্বাস নিতে পারছিল না। তার ঠোঁট সামান্য খোলা, বুকের ভেতর নিঃশ্বাস দ্রুততর। সে হাত বাড়িয়ে আদিত্যর হাত চেপে ধরল, যেন বলতে চাইছে—আরও কাছে এসো, আর থামিও না।

কিন্তু আদিত্য আবারও থামল।

“আজ তুমি আমার শরীরের ভাষা শিখবে,” সে বলল ধীরে। “কামনা শুধু তাড়াহুড়ো নয়, এটা অক্ষরে অক্ষরে লেখা এক দীর্ঘ কবিতা।”

রিমি তার দিকে তাকাল। চোখ ভিজে উঠেছিল আকাঙ্ক্ষায়।
“তাহলে লিখো… আমি প্রস্তুত।”

 

আদিত্য এবার সত্যিই থামল না। তার ঠোঁট ছুঁয়ে গেল রিমির কপাল, তারপর চোখের পাতা, তারপর গাল। প্রতিটি স্পর্শ যেন একেকটি শব্দ, একেকটি অক্ষর। রিমি অনুভব করল, সে ধীরে ধীরে নিজের শরীরকে হারিয়ে ফেলছে।

চুমু নামল গলা বেয়ে, কাঁধে, তারপর আরও নিচে। শরীরের প্রতিটি অংশে যেন লেখা হচ্ছে নতুন ভাষা।

রিমি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। তার ঠোঁট থেকে ফিসফিসে শব্দ বেরোল, যা শব্দ নয়, নিঃশ্বাসের সঙ্গীত।

“আদিত্য…”

সে আর কিছু বলতে পারল না।

 

আদিত্যর হাত গিয়ে ধরল তার আঙুল। ধীরে ধীরে আঙুলের ফাঁকগুলোতে মিলিয়ে দিল নিজের আঙুল। সেই জড়িয়ে ধরা মুহূর্তে রিমির মনে হলো, সে আর আলাদা মানুষ নয়—সে মিশে গেছে অন্য এক সত্তায়।

তারপর সে ফিসফিস করে বলল—
“তুমি কি জানো, শরীরের প্রতিটি রেখাই একেকটি অক্ষর? আমি শুধু পড়ছি, আর তুমি আমাকে সেই অক্ষরগুলো লিখতে দিচ্ছ।”

রিমির শরীর সাড়া দিচ্ছিল প্রতিটি স্পর্শে। কাঁপতে কাঁপতে সে অনুভব করল, এ একধরনের মুক্তি—যেখানে শরীর শুধু কামনা নয়, আত্মা পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করছে।

 

ঘরের আলো মোমবাতির মতো নরম। সেই আলোয় ছায়ারা খেলা করছিল দেয়ালে। রিমি চোখ বন্ধ করল, কিন্তু তার শরীর খোলা বইয়ের মতো, যেখানে আদিত্য প্রতিটি অক্ষর লিখে চলেছে।

তার ঠোঁটের উষ্ণতা, আঙুলের টান, শরীরের চাপ—সবকিছু মিলে এক অদৃশ্য কবিতা রচনা করছিল।

রিমি বুঝতে পারল, এতদিন যে শূন্যতা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল, তা আজ ভরে উঠছে। তার শরীরের প্রতিটি অংশ নতুন করে জেগে উঠছে।

 

কিন্তু আবারও, ঠিক শেষ সীমান্তে এসে, আদিত্য থেমে গেল।

রিমি চোখ খুলে তাকাল, বিস্ময় আর অস্থিরতা মিলেমিশে।
“কেন?”

আদিত্য গভীরভাবে তার দিকে তাকাল।
“কারণ এই ভাষা একদিনেই শেষ হয় না। তুমি আজ প্রথম অধ্যায় পড়ছ। পুরো বইটা পড়তে হলে আরও রাত দরকার।”

রিমির ঠোঁট কাঁপল। সে জানত, এই থেমে যাওয়া তাকে আরও তৃষ্ণার্ত করে তুলবে। তবু সে অদ্ভুত এক শান্তি অনুভব করল।

কারণ আজকের রাতেই সে বুঝল—কামনা শুধু শরীরের খেলা নয়, এটা আত্মার অক্ষরে লেখা এক মহাকাব্য।

 

ভোরের দিকে তারা একে অপরের বাহুডোরে শুয়ে ছিল। জানালার বাইরে শহর জেগে উঠছিল। কিন্তু ঘরের ভেতর তখনও নীরবতা, উষ্ণতা, আর প্রতীক্ষার সঙ্গম।

রিমি চোখ বন্ধ করে ভাবল—
এই রাত ছিল প্রথম অধ্যায়। আমি চাই, প্রতিটি অধ্যায় তার হাতের অক্ষরে লেখা হোক।

পর্ব ৭: কামনার আয়না

ভোরের আলো যখন ধীরে ধীরে জানালার কাঁচ ভেদ করে ঘরে ঢুকছিল, রিমির চোখ খুলল। পাশে আদিত্য তখনো ঘুমোচ্ছে। তার মুখ শান্ত, ঠোঁট সামান্য খোলা, বুক ওঠানামা করছে নিঃশ্বাসের তালে। এই দৃশ্য দেখে রিমির বুকের ভেতর হঠাৎ অদ্ভুত এক শান্তি নেমে এলো।

কিন্তু শান্তির মাঝেই ছিল এক অদৃশ্য কম্পন। সে হাত বাড়িয়ে আদিত্যর চুলে আঙুল চালাতে গিয়ে থেমে গেল। মনে হচ্ছিল, এ মানুষটিকে ছোঁয়া মানেই নিজের অজানা দিকগুলোকে ছোঁয়া।

ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল সে। বারান্দার পর্দা সরাতেই সকালের আলো পুরো ঘরে ছড়িয়ে পড়ল। শরীর এখনো ক্লান্ত, ঠোঁট এখনো লাল। সে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

 

আয়নার ভেতরে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে চমকে গেল রিমি।

চোখে এক অদ্ভুত আলো—যা সে আগে কখনো দেখেনি। ঠোঁট সামান্য ফুলে আছে, চুল এলোমেলো, গালে লাল আভা। যেন এক রাতেই সে অন্য মানুষে পরিণত হয়েছে।

তার মনে হলো, সে যেন আর আগের রিমি নেই—যে একাকী জানালার সামনে বসে থাকত, যার ভেতর জমে ছিল অদৃশ্য শূন্যতা। এখন তার শরীর যেন নিজেকে চিনে নিয়েছে নতুনভাবে।

সে নিজের গলায় হাত রাখল। ঠিক সেখানেই আদিত্যর ঠোঁটের ছোঁয়া এখনো গরম। আঙুল নামিয়ে আনল কাঁধে, তারপর বুকের ওপর। প্রতিটি অংশে মনে হলো অদৃশ্য অক্ষর লেখা আছে, যা কেবল তারাই পড়তে পারে যারা ভালোবাসার আর কামনার ভাষা বোঝে।

 

রিমি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার ভেতর দ্বিধা আর নেই। আগে হয়তো সে ভাবত—এটা কি ভুল? সে কি শুধুই কামনার ফাঁদে পা দিচ্ছে? কিন্তু এখন মনে হচ্ছিল, এই কামনা তাকে পূর্ণ করছে, তাকে নিজের সত্যিকার রূপ দেখাচ্ছে।

সে আয়নার সামনে চোখ বন্ধ করে দাঁড়াল। নিজের ঠোঁট আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখল, তারপর মৃদু হাসল।
“হ্যাঁ, এটাই আমি,” মনে মনে বলল সে।

 

ঠিক তখন পেছন থেকে আদিত্যর কণ্ঠ ভেসে এল।
“তুমি আয়নায় কী দেখছো?”

রিমি চমকে ঘুরে তাকাল। আদিত্য তখনো আধো ঘুমে, বিছানায় শুয়ে আছে। তবু তার চোখে সেই পরিচিত তীব্রতা।

রিমি ধীরে ধীরে বলল—
“আমি নিজেকে দেখছি। সেই আমি, যাকে এতদিন চিনতাম না।”

আদিত্য উঠে বসল। তার ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটল।
“তাহলে আমি শুধু আয়না ধরেছি তোমার সামনে।”

রিমি হাঁটতে হাঁটতে তার কাছে ফিরে এল। বিছানার কিনারায় বসে পড়ল।
“হয়তো তাই। তুমি না এলে আমি কখনো নিজেকে এভাবে দেখতে পারতাম না।”

আদিত্য তার হাত ধরল।
“কামনা মানুষকে ছোট করে না, যদি সেটা সত্য হয়। বরং এটা মানুষকে নিজের কাছে সৎ করে তোলে।”

রিমির চোখ ভিজে উঠল।
“তাহলে এটাই সত্যি?”

“হ্যাঁ,” আদিত্য ফিসফিস করে বলল। “তুমি, আমি, আর আমাদের আকাঙ্ক্ষা—সবটাই সত্যি।”

 

সেই মুহূর্তে আবার তাদের মাঝে নীরবতা নেমে এলো। কিন্তু সেই নীরবতা ভারী ছিল না, বরং উষ্ণতায় ভরা। রিমি মাথা রেখে দিল আদিত্যর কাঁধে। বাইরে তখন সকাল পুরোপুরি জেগে উঠেছে, কিন্তু ঘরের ভেতরে সময় যেন থমকে আছে।

 

সেদিন রিমি বাড়ি ফিরল অনেক দেরিতে। পথে হাঁটার সময় তার মনে হচ্ছিল, পৃথিবী এখন অন্যরকম। মানুষের ভিড়, গাড়ির শব্দ—সব একই, অথচ তার চোখে এখন প্রতিটি দৃশ্য নতুন।

ফ্ল্যাটে ঢুকে সে আবার আয়নার সামনে দাঁড়াল। এবার কোনো দ্বিধা ছিল না। সে নিজের চোখে সরাসরি তাকাল।

“আমি আর একা নই,” সে ফিসফিস করে বলল। “আমি আমার শরীরকে চিনেছি, আমার কামনাকে স্বীকার করেছি। আর এই সত্যকে মুছে ফেলা যাবে না।”

 

রাত নামতেই সে বিছানায় শুয়ে ছিল, কিন্তু ঘুম আসছিল না। মাথার ভেতর বারবার ভেসে উঠছিল আদিত্যর চোখ, তার হাত, তার ঠোঁট। সেই স্পর্শগুলো যেন এখনো গায়ে রয়ে গেছে।

সে নিজেই শরীর জড়িয়ে ধরল, যেন আদিত্যকে জড়িয়ে ধরছে। ফিসফিস করে নাম উচ্চারণ করল—
“আদিত্য…”

তারপর ধীরে ধীরে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ল।

 

কিন্তু ঘুমের ভেতরেও আয়নার মতো স্বপ্ন এসে পড়ল। সেখানে সে নিজেকে দেখল—নগ্ন, কামনায় ভেজা, কিন্তু ভয়হীন। চারপাশে আলো আর ছায়া মিশে এক অদ্ভুত রূপ তৈরি করছে। আর আয়নার অপরপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে আদিত্য।

তারা দু’জন একে অপরকে দেখছে, স্পর্শ করছে, আর আয়না ভেঙে যাচ্ছে টুকরো টুকরো।

রিমি ঘুমের ভেতর ফিসফিস করল—
“আমি তোমার…”

 

ভোরে ঘুম ভাঙতেই জানালার কাঁচে আবার নিজের প্রতিবিম্ব দেখল সে। কিন্তু এবার আর কোনো দ্বিধা ছিল না।

সে বুঝল, কামনার আয়নায় একবার নিজেকে দেখে ফেললে আর পিছিয়ে যাওয়া যায় না।

 

 

পর্ব ৮: রাতের ঘড়ি থেমে যায়

দিনের আলো পেরিয়ে সন্ধ্যা নামতেই শহর যেন অন্য রূপ নেয়। জানলার বাইরে আলো-আঁধারি গলে আসে, আর ভেতরে জমে ওঠে প্রতীক্ষা। রিমি সেদিন সারা দিন কাজ করলেও মন কোথাও ছিল না। প্রতিটি ঘড়ির কাঁটা যেন ধীরে চলছিল, প্রতিটি মিনিট তাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল সেই মুহূর্তের দিকে, যখন আবার আদিত্যর সামনে দাঁড়াবে।

রাত ন’টার সময় সে পৌঁছল। এবার দরজা খোলার আগেই বুকের ভেতর অস্থিরতা এতটা বেড়ে গিয়েছিল যে মনে হচ্ছিল, নিঃশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।

দরজা খুলতেই ভেসে এলো মৃদু সুর, ধূপের গন্ধ, আর আলোছায়ার খেলা। ঘর যেন আরেক পৃথিবী। মোমবাতি টেবিল জুড়ে জ্বলছে, আলো গলে পড়ছে মেঝেতে। জানালার বাইরে দূরের আলো ঝাপসা, যেন শহরটা আর নেই—শুধু এই ঘর, এই দু’জন।

আদিত্য দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল। কালো শার্ট, গলায় খোলা বোতাম, চোখে সেই গভীর আগুন। রিমি ভেতরে ঢুকতেই তার ঠোঁট সামান্য হাসল।

“আমি জানতাম তুমি আসবে,” সে বলল।

রিমি কোনো উত্তর দিল না। শুধু তার দিকে এগিয়ে গেল।

 

তাদের মাঝে আর কোনো শব্দ ছিল না। শুধু শরীরের টান, চোখের নীরবতা। আদিত্য হাত বাড়াল, রিমি নিজের হাত রাখল তার হাতে। সেই মুহূর্তেই ঘড়ির কাঁটা যেন থেমে গেল।

তাকে টেনে নিল আদিত্য। প্রথমে একেবারে কাছে, তারপর ঠোঁটে। আর কোনো সংযম ছিল না। আগের সব প্রতীক্ষা, থেমে যাওয়া, দেরি—সব একসঙ্গে ভেঙে পড়ল সেই চুমুর ভেতর।

চুমু ছিল গভীর, তীব্র, একেবারে দাবানলের মতো। রিমি শ্বাস নিতে পারছিল না, তবুও থামছিল না। হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল আদিত্যর গলা, যেন তার ভেতরে ডুবে যেতে চাইছে।

আদিত্য তাকে তুলল, টেনে নিয়ে গেল বিছানার দিকে। মোমবাতির আলোয় ছায়ারা আরও তীব্র হয়ে উঠল। রিমি অনুভব করল, তার শরীরের প্রতিটি অংশ আগুনে পুড়ছে।

 

বিছানায় শুয়ে পড়তেই আদিত্য ধীরে ধীরে নামাল তার পোশাক। প্রতিটি স্তর খোলার সময় তার আঙুল যেন নতুন কোনো গল্প লিখে যাচ্ছিল। রিমি চোখ বন্ধ করে প্রতিটি স্পর্শ উপভোগ করছিল। শরীর শিহরিত হচ্ছিল, বুক কেঁপে উঠছিল প্রতিটি মুহূর্তে।

তারপর আদিত্য নিজেও নিজেকে মুক্ত করল। শরীর আর শরীরের মাঝে কোনো দূরত্ব রইল না। নিঃশ্বাস, ত্বক, ঘাম, আগুন—সব একসঙ্গে মিলেমিশে গেল।

রিমি বুঝল, এটাই সেই মুহূর্ত, যেটার জন্য সে এতদিন অপেক্ষা করেছে।

 

রাতের ঘড়ি তখন সত্যিই থেমে গেছে। বাইরে পৃথিবী চলছে, কিন্তু এখানে সময় থেমে আছে শুধু তাদের জন্য।

আদিত্য তার কানে ফিসফিস করে বলল—
“তুমি জানো, আমি তোমাকে শুধু চাই না, আমি তোমাকে পূর্ণ করতে চাই।”

রিমি নিঃশ্বাসের ফাঁকে উত্তর দিল—
“আমি চাই, তুমি আমাকে ভেঙে আবার গড়ে তোলো।”

সেই কথার সঙ্গে সঙ্গেই শরীরের খেলা শুরু হলো। আর কোনো নিয়ম নেই, শুধু কামনার উচ্ছ্বাস। রিমি অনুভব করছিল, তার শরীর ভেঙে যাচ্ছে, আবার তৈরি হচ্ছে নতুনভাবে। প্রতিটি স্পর্শে, প্রতিটি চাপে, প্রতিটি চুমুতে।

 

ঘরে তখন শুধু তাদের শব্দ। নিশ্বাসের ওঠানামা, শরীরের ঘর্ষণ, গোপন আর্তনাদ—সব মিলেমিশে এক অদৃশ্য সঙ্গীত। মোমবাতির আলো নাচছিল দেয়ালে, যেন ছায়ারা তাদের প্রেমের সাক্ষী।

রিমি অনুভব করছিল, সে আর নিজের ভেতরে নেই। সে ভেসে যাচ্ছে, ডুবে যাচ্ছে, আবার ভেসে উঠছে। তার শরীরের প্রতিটি কোণ জেগে উঠছে নতুন করে।

এবার আর কোনো থামা নেই।

 

ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারা একে অপরের ভেতরে হারিয়ে গেল। বাইরে রাত গভীর হলো, কিন্তু ভেতরে সময়ের কোনো অস্তিত্ব ছিল না।

শেষে ক্লান্ত শরীর বিছানায় গলে পড়ল। রিমি আদিত্যর বুকে মাথা রাখল, নিঃশ্বাস ধীর হচ্ছিল, কিন্তু বুকের ভেতর শান্তি ছড়িয়ে পড়েছিল।

সে ফিসফিস করে বলল—
“আজ আমি সম্পূর্ণ।”

আদিত্য তার চুলে হাত বুলিয়ে দিল।
“আজ রাতের পর আর কিছুই আগের মতো থাকবে না।”

 

ভোর আসছিল ধীরে ধীরে। জানালার কাঁচে আলো ধরা দিচ্ছিল। ঘড়ির কাঁটা আবার চলতে শুরু করল, কিন্তু রিমির মনে হচ্ছিল, রাতটা আসলে কখনোই শেষ হবে না।

কারণ সেই রাতের ভেতরেই সে নিজের সত্য খুঁজে পেয়েছে।

 

পর্ব ৯: সকালবেলার নিঃশ্বাস

রাতের সেই অবিরাম উচ্ছ্বাসের পর জানালার ফাঁক গলে প্রথম আলো ঢুকতে শুরু করল। মোমবাতিগুলো অনেক আগেই নিভে গেছে, ঘরে এখন শুধু ভোরের নরম আলো আর শরীরের ঘামভেজা গন্ধ। রিমি আধশোয়া অবস্থায় শুয়ে ছিল, মাথা রাখা আদিত্যর বুকে। বুক ওঠানামা করছে ধীর ছন্দে, তার ত্বক গরম, যেন রাতের আগুন এখনো সেখানে রয়ে গেছে।

রিমি চোখ মেলেই দেখল, কাঁচে ভিজে আলো জমেছে। তার চুল ছড়িয়ে আছে বালিশে, ঠোঁট এখনো লাল, শরীর ক্লান্ত কিন্তু অদ্ভুতভাবে হালকা। যেন অনেক দিনের ভার নেমে গেছে।

সে নিঃশ্বাস টেনে নিল গভীরভাবে। মৃদু ঘামে ভেজা চামড়ার গন্ধ, আদিত্যর শরীরের উষ্ণতা—সব মিলিয়ে ভোরটা একেবারে অন্য রকম।

আদিত্য তখনও ঘুমোচ্ছে। তার ঠোঁট সামান্য খোলা, নিঃশ্বাস দীর্ঘ, চোখের কোণে ক্লান্তির রেখা। রিমি তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। মনে হচ্ছিল, এই মানুষটিকে স্পর্শ করা মানেই নিজের ভেতরে স্পর্শ করা।

 

বিছানা থেকে ধীরে উঠে সে বারান্দার কাছে গেল। জানালার ফাঁক দিয়ে ভোরের আলো এসে পড়ছে তার খোলা চামড়ায়। আয়নার সামনে দাঁড়াতেই নিজের প্রতিচ্ছবিতে নতুন কিছু খুঁজে পেল।

আজ তার চোখের ভেতরে ক্লান্তি নেই, বরং তৃপ্তি। ঠোঁটে নিস্তব্ধ এক হাসি, গালে লালচে আভা। শরীরের ভাঁজে কামনার ছাপ, কিন্তু সেই ছাপ তাকে অস্থির করেনি। বরং মনে হচ্ছিল—এটাই তার পূর্ণতা।

সে আয়নার সামনে ফিসফিস করে বলল—
“এটাই আমি। আর আমি পালাব না।”

 

পেছন থেকে হঠাৎ আদিত্যর কণ্ঠ ভেসে এলো, ঘুম জড়ানো অথচ গভীর—
“তুমি কী বলছো?”

রিমি ঘুরে তাকাল। আদিত্য উঠে বসেছে, চুল এলোমেলো, চোখে এখনো রাতের ছায়া।

সে মৃদু হাসল।
“আমি নিজেকে স্বীকার করছি।”

আদিত্য এগিয়ে এসে তার কাঁধে হাত রাখল।
“তাহলে আজ তুমি সত্যিই নতুন করে জন্ম নিলে।”

রিমি তার চোখে চোখ রাখল।
“হয়তো। তুমি আমাকে শুধু ছুঁয়ে দাওনি, তুমি আমাকে ভেঙে আবার গড়ে তুলেছো।”

আদিত্য কিছু বলল না। শুধু তার কপালে ঠোঁট রাখল।

 

সকালের আলো বাড়ছিল। বাইরে শহরের শব্দ ধীরে ধীরে ভেসে আসছিল—গাড়ির হর্ন, মানুষের হাঁটা, দোকান খোলার আওয়াজ। কিন্তু ঘরের ভেতর এখনো ছিল শান্তি।

তারা একসঙ্গে রান্নাঘরে গেল। রিমি কখনো ভাবেনি, আদিত্যর হাতের কফি এতটা নিখুঁত হতে পারে। টেবিলে বসে দু’জন কফি খেল, আর মাঝেমধ্যে চোখে চোখ রাখল। কথাবার্তা কম, কিন্তু নীরবতাই যথেষ্ট ছিল।

রিমি হেসে বলল—
“গতকাল রাতটা কি বাস্তব ছিল, না আমি শুধু স্বপ্ন দেখেছি?”

আদিত্য উত্তর দিল ধীরে—
“যদি স্বপ্নও হয়, তবে সেই স্বপ্নই তোমার বাস্তব।”

রিমির বুক ধক করে উঠল। সে বুঝল, এই মানুষটি শুধু কামনা নয়, তার ভেতরের সত্যকেও ছুঁয়ে ফেলছে।

 

কফি শেষ করে আবার তারা সোফায় বসল। বাইরে তখন সূর্য পুরোপুরি উঠেছে। জানালার ফাঁক দিয়ে আলো এসে পড়ছে তাদের শরীরে।

রিমি আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বলল—
“আমি জানি না, এই সম্পর্ক কতদূর যাবে। কিন্তু আমি নিশ্চিত, আমার ভেতরে তুমি এমন কিছু জাগিয়েছো যা আর কখনো ঘুমোবে না।”

আদিত্য তার হাত ধরে রাখল।
“আমাদের কাছে সময়ের হিসেব নেই। যতদিন থাকবে, ততদিন এই মুহূর্তগুলোই সত্য।”

রিমির চোখ ভিজে উঠল। সে হাত শক্ত করে ধরল।
“তাহলে আজকের সকালটাকে আমি মনে রাখব—আমার জীবনের সবচেয়ে সত্য সকাল।”

 

কিছুক্ষণ পর রিমি উঠে দাঁড়াল। তার ফিরতে হবে। দরজার সামনে এসে থামল। পেছনে তাকাল একবার—আদিত্য দাঁড়িয়ে আছে জানালার আলোয়, চোখে সেই গভীর স্থিরতা।

রিমি ধীরে বলল—
“আমি আবার আসব।”

আদিত্য মাথা নাড়ল।
“আমি জানি।”

সে বেরিয়ে গেল। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে মনে হচ্ছিল, শরীরের ভেতর এখনো সেই কামনার উষ্ণতা বহন করছে। রাস্তায় নেমে গাড়ির শব্দে মিশলেও, তার মনে হচ্ছিল এই সকাল তার নিজের একান্ত।

 

বাড়ি ফিরে জানালার সামনে দাঁড়াল রিমি। শহর তখন পুরোপুরি জেগে গেছে। কিন্তু তার ভেতরের নিঃশ্বাস এখনো ভোরের মতো নরম।

সে চোখ বন্ধ করে অনুভব করল—
আদিত্যর স্পর্শ, তার ঠোঁট, তার কণ্ঠ।

তারপর নিজের ঠোঁটে আঙুল ছুঁয়ে বলল—
“আজ আমি শুধু কামনা করিনি, আজ আমি বেঁচেছি।”

পর্ব ১০: অসমাপ্ত মায়া

দিনগুলো যেন অন্যরকম হতে শুরু করল। রিমি অনুভব করছিল, প্রতিটি সকাল আর আগের মতো নয়। কাজের টেবিলে বসে থেকেও তার মন চলে যেত আদিত্যর দিকে। অফিস থেকে ফেরার সময় জানলার বাইরে আলো-আঁধারি দেখলেই তার মনে পড়ত সেই রাত, সেই ঘড়ি থেমে যাওয়া মুহূর্তগুলো।

তাদের দেখা হচ্ছিল নিয়মিত। কখনো ক্যাফেতে, কখনো শহরের ভিড়ের বাইরে কোনো নির্জন পথে হাঁটতে হাঁটতে, আবার কখনো সোজা আদিত্যর ফ্ল্যাটে। প্রতিবারই তারা আরও কাছে আসছিল, আরও গভীর হচ্ছিল আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, প্রতিবারই কোনো না কোনো জায়গায় একটা থেমে যাওয়া রয়ে যাচ্ছিল।

রিমি একদিন জিজ্ঞেস করেছিল—
“তুমি কেন সবসময় থেমে যাও? আমাকে পুরোপুরি নিজের করে নাও না কেন?”

আদিত্য কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেছিল—
“কারণ কিছু সম্পর্ক অসম্পূর্ণ থাকলেই পূর্ণ হয়। আমরা যদি সব পেয়ে যাই, তবে এই আগুন টিকে থাকবে না।”

কথাগুলো শুনে রিমির বুক কেঁপে উঠেছিল। তার ভেতরে দ্বন্দ্ব ছিল—সে কি সত্যিই পূর্ণতা চায়, নাকি এই অসম্পূর্ণতার মায়াতেই ডুবে থাকতে চায়?

 

একদিন রাতে তারা আবার একসঙ্গে শুয়ে ছিল। জানালার বাইরে পূর্ণিমার আলো, ঘরে নরম সুর বাজছে। রিমি মাথা রেখে ছিল আদিত্যর বুকে।

“তুমি জানো,” রিমি বলল ধীরে, “আমি তোমার সঙ্গে থেকে বুঝেছি, ভালোবাসা আর কামনার মধ্যে কোনো ভেদ নেই। দুটো একে অপরকে জড়িয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের এই সম্পর্কটা—এটা কোন দিকে যাচ্ছে?”

আদিত্য তার চুলে হাত বুলিয়ে বলল—
“আমরা হয়তো কোনো শেষের দিকে যাচ্ছি না। আমরা শুধু বেঁচে আছি এই মুহূর্তগুলোর ভেতর। সব সম্পর্ককেই নাম দিতে হয় না।”

রিমি চুপ করে গেল। তার মনে হচ্ছিল, হয়তো এই মানুষটিকে কোনো দিন পুরোপুরি নিজের বলা যাবে না। তবুও যে অনুভূতিগুলো সে পেয়েছে, তা এতটাই সত্য যে হারালেও ভুলতে পারবে না।

 

এক ভোরে ঘুম ভাঙতেই রিমি খেয়াল করল, আদিত্য নেই পাশে। সে উঠে দাঁড়াল, বারান্দায় গিয়ে দেখল, আদিত্য জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সিগারেট হাতে, চোখ অনেক দূরে কোথাও।

“তুমি কি কিছু ভাবছো?” রিমি প্রশ্ন করল।

আদিত্য ঘুরে তাকাল না। শুধু বলল—
“আমরা দু’জনই জানি, এটা চিরকাল টিকবে না। তুমি তোমার জীবনে ফিরে যাবে, আমিও আমার। কিন্তু আজ যা আছে, সেটাই সবচেয়ে বড়।”

রিমির চোখ ভিজে উঠল। সে এগিয়ে গিয়ে আদিত্যর পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরল।
“তাহলে প্রতিটি সকাল আমি মনে রাখব, যেন শেষ সকাল। প্রতিটি রাত মনে রাখব, যেন শেষ রাত।”

আদিত্য তার হাত চেপে ধরল।
“হয়তো এটাই ভালোবাসার সত্যি।”

 

দিন কয়েক পর তাদের দেখা হলো না। কাজের চাপ, সময়ের অভাব, আর অদৃশ্য দূরত্ব তাদের আলাদা রাখল। কিন্তু সেই দূরত্বই যেন আরও টান বাড়িয়ে দিল।

রিমি আবার জানালার সামনে বসেছিল এক সন্ধ্যায়। বাইরে শহর ভিজে আলোয় ডুবে আছে, যেমন প্রথম দিন। সে হঠাৎ বুঝল, সে আবার সেই একাকীত্বের জায়গায় ফিরে এসেছে। কিন্তু এবার আর আগের মতো শূন্য নয়। এবার তার ভেতর আদিত্যর স্মৃতি, তার স্পর্শ, তার চুমুর আগুন মিশে আছে।

আদিত্য হয়তো আজ নেই, হয়তো কালও থাকবে না। কিন্তু যে অনুভূতি সে রেখে গেছে, তা চিরকাল থাকবে।

 

রাত গভীর হলো। ফোনের স্ক্রিনে কোনো মেসেজ এলো না। তবুও রিমি মনে মনে শুনতে পেল সেই কণ্ঠস্বর—
আমি আবার তোমার কাছে আসব।”

তার বুক ধক করে উঠল।

সে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নিজের চোখে তাকাল।
হ্যাঁ, এই চোখ এখন জানে কীভাবে ভালোবাসতে হয়, কীভাবে কামনা করতে হয়, আর কীভাবে সেই অসমাপ্ত মায়ার ভেতরেও পূর্ণতা খুঁজে নিতে হয়।

রিমি ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটিয়ে বলল—
“অসমাপ্ত হলেও, এটা আমার। আমার সত্য।”

 

ভোরে পাখির ডাক শুনে ঘুম ভাঙল। সে বুঝল, জীবন চলবে, কাজ চলবে, দিনগুলো একইভাবে যাবে। কিন্তু ভেতরে যে আগুন জ্বলে উঠেছে, তা আর কখনো নিভবে না।

আদিত্য হয়তো তার জীবনের শেষ গন্তব্য নয়। হয়তো কোনো দিন সে অদৃশ্য হয়ে যাবে। কিন্তু রিমির ভেতর যে আলো আর অন্ধকারের মিশ্রণ সে রেখে গেছে, সেটাই তার বেঁচে থাকার চিহ্ন।

 

শহরের রাত আবার নামবে, জানালার কাঁচে আবার বৃষ্টি জমবে, আর রিমি জানবে—কোথাও না কোথাও, সেই অসমাপ্ত মায়ার ভেতরেই লুকিয়ে আছে তার সবচেয়ে সত্য ভালোবাসা।

সমাপ্ত

WhatsApp-Image-2025-09-03-at-6.07.01-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *